২৪. ঊনসত্তরের কালরাত্রি

কালরাত্রি ২৫ মার্চ কালরাত্রি—এই তথ্য আমরা জানি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ হত্যা-উৎসবে মেতেছিল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

ঊনসত্তরের ২৫ মার্চও কিন্তু কালরাত্রি। ওই রাতে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে দেশের ক্ষমতা তুলে দেন জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে।

 

পরিশিষ্ট

কিছুক্ষণ আগে হাজেরা বিবি মারা গেছেন।

মৃত্যুর সময় নাদিয়া একাই উপস্থিত ছিল। দাদির পাশে বসে লিখছিল। হাজেরা বিবি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, কী লেখ?

নাদিয়া বলল, তোমার কথা লিখি।

লেখা ‘বন’ কর। আমার দিকে মুখ ফিরা।

নাদিয়া খাতা রেখে দাদির দিকে ঘুরে তাকাল। অবাক হয়ে বলল, আজ তোমাকে অন্যরকম লাগছে।

কী রকম?

চেহারা উজ্জ্বল লাগছে। চোখ ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমে গেছে।

হাজেরা বললেন, শইল্যের ভিতর মরণের বাতি জ্বলছে। মরণের বাতি জ্বললে চেহারায় জেল্লা লাগে।

মরণের আবার বাতি আছে নাকি? আছে।

আল্লাপাক এই বাতি জ্বালায় দেন। আজরাইল আইসা নিভায়।

নাদিয়া বলল, তুমি খুব ভালো আছ, সুস্থ আছ। তোমার মরতে এখনো অনেক দেরি।

হাজেরা বিবি শব্দ করে আনন্দময় হাসি হাসলেন।

নাদিয়া বলল, বাহ! তুমি তো কিশোরী মেয়েদের মতো হাসছ। হাজেরা নাদিয়ার হাত ধরে কোমল গলায় বললেন, আমি তোর বাপের কাছে অপরাধ। তুই আমার হইয়া তার কাছে ক্ষমা চাইবি। মা ছেলের কাছে ক্ষমা চাইতে পারে না। জায়েজ নাই।

কী অপরাধ করেছ?

ছোটবেলা থাইকা নানানভাবে তারে কষ্ট দিয়েছি। খাটের সাথে সারা দিন বাইন্ধ্যা রাখছি। খাওয়া দেই নাই। পুসকুনিতে একবার তারে নিয়া গোসলে নামছি, হঠাৎ তার মাথা পানিতে চাইপ্যা ধইরা বলছি- মর তুই মর।

কেন দাদি?

তোর দাদাজান তার ছেলেরে খুব পছন্দ করত। ছেলে ছিল তার চোখের মণি। ছেলেরে কষ্ট দিলে সে কষ্ট পাইত। এইজন্যে কষ্ট দিতাম। তোর দাদাজান ছিল অতি বহু মানুষ। কত দাসী যে তার কারণে পেট বাধাইছে। ছিঃ ছিঃ ছিঃ।

দাদাজানকে শাস্তি দেওয়ার জন্যে তুমি তার ছেলেকে কষ্ট দিয়েছ। কাজটা ভুল করেছ।

অবশ্যই। হাবীব বড় হইছে তারপরেও তারে কষ্ট দিয়েছি। আমি জানি ‘হাবু ডাকলে রাগ করে। ইচ্ছা কইরা ডাকি—হাবু হাবু হাবুরে।

কেন দাদি? এখন তো আর দাদাজান বেঁচে নেই। এখন কেন কষ্ট দেওয়া?

আমি চেয়েছি সে রাগ করুক। আমারে দুইটা মন্দ কথা বলুক। ছোটবেলায় তার দিকে যে অন্যায় করেছি তার কিছুটা কাটা যাক। কিন্তু আমি এমন ছেলে পেটে ধরেছি যে আমার উপর রাগ করে না। তারে রাগানির চেষ্টায় আমার ত্রুটি ছিল না। একসময় তার চরিত্র নিয়া কথা শুরু করলাম। অতি নোংরা কথা। সফুরার পেটে তার সন্তান–এইসব হাবিজাবি। তাও আমার পুলা রাগে না।

নাদিয়া বলল, তোমার কাছে শুনে শুনে মা নিজেও কাজের মেয়েদের নানান কথা বলেন। বাবার সামনে যেন কেউ না যায়—এইসব। বাবার ত্রুটি আছে। নোংরা ত্রুটি নাই।

হাজেরা বিবি বললেন, অবশ্যই নাই। এইটা আমার পুলা। ছগিরন মাগি, বছিরুন মাগির পুলা না।

নোংরা কথা বন্ধ করো দাদি।

হাজেরা বিবি বললেন, মইরাই তো যাইতেছি। পচা কথা আর বলতে পারব না। দুই একটা বলি। তোর পছন্দ না হইলে কানে হাত দিবি।

আচ্ছা বলো যা বলতে চাও। তবে তুমি কঠিন চিজ। সহজে মারা যাওয়ার জিনিস না।

তারপরেও ধুম কইরা মইরা যাইতে পারি। তুই তখন অবশ্যই আমার হইয়া

তার কাছে পায়ে ধইরা ক্ষমা চাইবি।

বললাম তো ক্ষমা চাব। মৃত্যুর কথাটা আপাতত বন্ধ থাকুক। দু’একটা আনন্দের কথা বলো।

এখন তোর বাপরে ডাক দিয়া আন। আইজ তারে আমি হাবু ডাকব না। আইজ তারে ডাকব হাবীব। সুন্দর কইরা বলব, হাবীব। বাবা কেমন আছ? আমার সামনে বসো। কী বলতেছি মন দিয়া শোনো। সব মানুষের মাতৃঋণ থাকে। তোমার নাই।

নাদিয়া বলল, এখন বাবাকে ডাকতে পারব না দাদি। আমি লেখা শেষ করব।

হাজেরা বললেন, আচ্ছা খাক। লাগবে না।

বলেই মাথা এলিয়ে পড়ে গেলেন। নাদিয়া তাকিয়ে ছিল, সে সত্যি সত্যি দাদির চোখে গোলাপি আলো দেখতে পেল।

 

হাবীব চেম্বারে মক্কেলদের সঙ্গে ছিলেন। নাদিয়া শান্ত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল। বাবার কাধে হাত রেখে বলল, বাবা! আমি বাগানে কদমগাছের নিচে সারা রাত বসে থাকব। কেউ যেন সেখানে না যায়, কেউ যেন না যায়।

হাবীব অবাক হয়ে বললেন, তোর কী হয়েছে রে মা?

নাদিয়া বলল, আমার কিছু হয়নি। আমি ভালো আছি। খুব ভালো আছি। দাদিজান মারা গেছেন।

 

নাদিয়া কদমগাছের নিচের বেদিতে বসে আছে কাছেই বকুলগাছে ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধে চারপাশ আমোদিত। ঝাক বেধে জোনাকি বের হয়েছে। নাদিয়া তার দাদির কথা ভাবছে না। সে তার ছোটমামার কথা ভাবছে। আবার সে তার মামার নাম ভুলে গেছে। কিছুতেই নাম মনে করতে পারছে না। মৃত মানুষ কত সহজেই না হারিয়ে যায়।

জীবিত মানুষও মাঝে মাঝে হারিয়ে যায়। হাসান রাজা চৌধুরী এখনো জীবিত। হাজতে আছে। কিন্তু সে হারিয়ে গেছে। যা

হাসান রাজা তাকে একটা চিঠি লিখেছে। নাদিয়া তার উগ্র লিখে রেখেছে। পাঠানো হয়নি। নাদিয়া ভেবে রেখেছে বাবাকে সঙ্গে নিয়ে জেলহাজতে হাসান রাজার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। তাকে চিঠিটা হাতে হাতে দেবে।

নাদিয়া লিখেছে—

আমি তোমার সাহসে মুগ্ধ হয়েছি। তোমার মতো একজন সাহসী ভালো মানুষের সঙ্গে আমি বাস করতে পারব নী এই দুঃখ আমি আজীবন পুষে রাখব। তুমি লিখেছ আমার জন্যে বুজরা বানানোর কথা তুমি তোমার বাবাকে বলেছ। বজরা তৈরি হোক আমি একাই সেই বজরায় রাত কাটাব। তোমার দেওয়া টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র খুঁজে বের করব। নক্ষত্রের নাম Sirius, বাংলায় লুব্ধক।

 

ভাদু নাদিয়াকে দেখেছে। মেয়েটি একা। আশেপাশে কেউ নেই। সহসাই যে কেউ আসবে সে সম্ভাবনা নেই। ভাদু জেনেছে, বুড়িটা মারা গেছে। সবাই বুড়িটাকে নিয়ে ব্যস্ত। ভাদু এগোচ্ছে। তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই। হাতে অফুরন্তু সময়।

 

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান রওনা হয়েছেন বাংলাদেশের দিকে। তার সামনে ব্লাক ডুগের বোতল। তিনি আয়েশ করে হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিচ্ছেন। তার মধ্যে কোনো ব্যস্ততা নেই। তার হাতেও অফুরন্ত সময়।

 

ভাদু কাছাকাছি চলে এসেছে। সে এখন এগুচ্ছে হামাগুড়ি দিয়ে। তাকে দেখাচ্ছে জন্তুর মতো। তার মুখ থেকে জন্তুর মতো গোঁ গোঁ শব্দ হচ্ছে। সে চেষ্টা করেও শব্দ আটকাতে পারছে না।

নাদিয়া চমকে তাকাল। ভাদুকে দেখে অবাক হয়ে বলল, এই তোমার কী হয়েছে? এরকম করছ কেন?

ভাদু নাদিয়ার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

 

দিঘির পানিতে নাদিয়া পড়ে আছে। তার চোখ খোলা। যেন সে অবাক হয়ে পৃথিবী দেখছে।

নাদিয়া দিঘির যেখানে পড়ে আছে সেখানেই সে একবার নিজের ছায়া দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল।

————-

 

ময়মনসিংহ সেন্ট্রাল জেলে মে মাসের আট তারিখ হাসান রাজা চৌধুরীর ফাঁসি হয়।

1 Comment
Collapse Comments

Why do I feel so pain after finishing the story?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *