২৪. উদ্বৃত্ত মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ

চতুর্বিংশ অধ্যায়– উদ্বৃত্ত মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ

প্রথম পরিচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান আয়তনে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন। পণ্যোৎপাদনের বৈশিষ্ট্যসূচক সম্পত্তির নিয়মাবলীর ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের নিয়মাবলীতে অতিক্রমন।

এই পর্যন্ত আমরা অনুসন্ধান করেছি কি ভাবে মূলধন থেকে উদ্বৃত্ত-মূল্যের উদ্ভব ঘটে; এখন আমরা দেখব কি ভাবে উদ্বৃত্ত-মূল্য থেকে মূলধনের উদ্ভব ঘটে। উদ্বৃত্ত মূল্যকে মূলধন হিসাবে নিয়োজন, তাকে মূলধন হিসাবে পুনঃরূপান্তরণ-একেই অভিহিত করা হয় মূলধনের সঞ্চয়ন বলে। [১]

প্রথমে আমরা এই কর্মকাণ্ডটি বিবেচনা করব ব্যক্তিগত ধনিকের অবস্থান থেকে। ধরা যাক একজন সুতাকাটনি ১০,০০০ পাউণ্ড মূলধন আগাম দেয়, যার মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ (৮,০০০ পাউণ্ড) খাটানো হয় তুলল, মেশিনারি বাবদে এবং পাঁচ ভাগের এক ভাগ (২,০০০ পাউণ্ড) মজুরি বাদে। ধরা যাক, সে উৎপাদন করে বছরে ২,৪০,০০০ পাউণ্ড সুতো যার মূল্য ১২,০০০ পাউণ্ড। উদ্বৃত্ত মূল্য ১০০ শতাংশ হলে, সেই উদ্বৃত্ত-মূল্য থাকে সুতোর ৪০,০০০ পাউণ্ড পরিমাণ উদ্বৃত্ত বা নীট উৎপন্ন-ফলে অর্থাৎ মোট উৎপন্ন-ফলের এক-ষষ্টমাংশ, যার মূল্য ২,০০০ পাউণ্ড, যা নগদে রূপায়িত হবে বিক্রয়ের মাধ্যমে। £ ২,০০০ হল  ২,০০০। এই টাকার অংকটিতে আমরা এক কণা উদ্বৃত্ত-মূল্যের দেখা বা গন্ধও পাইনা। আমরা যখন জানি যে, একটি নির্দিষ্ট মূল্য হল উদ্বৃত্ত-মূল্য, আমরা জানি তার মালিক কিভাবে সেটা পেল; কিন্তু তাতে কারো প্রকৃতি বদলে যায়না মূল্যের, না টাকার।

এই অতিরিক্ত ২,০০০ পাউণ্ডকে মূলধনে রূপান্তরিত করার জন্য, মালিক কাটুনি, বাকি সমস্ত অবস্থা অপরিবর্তিত থাকলে, তুলো ইত্যাদি কেনায় আগাম দেবে পাঁচ ভাগের চার ভাগ (£ ১,৬০. ) এবং অতিরিক্ত কাটুনিমজুর কেনায় পাচ ভাগের। এক ভাগ (৫,৪০০ ), যার বাজার থেকে সংগ্রহ করবে তাদের জীবনধারণের দ্রব্য সামগ্রী, যার মূল্য মালিক তাদের আগাম দিয়েছে। তখন এই ২০০০ পাউণ্ড নোতুন মূলধন সুতাকলে কাজ করে এবং সে-ও আবার, ৪০০ পাউণ্ড উদ্বৃত্ত-মূল্য নিয়ে আসে।

মূলধন-মূল্য গোড়ায় আগাম দেওয়া হয়েছিল টাকার রূপে। অপর পক্ষে, উদ্বৃত্ত মূল্য হল মূলত মোট উৎপন্ন-ফলের একটি নির্দিষ্ট অংশের মূল্য। যদি এই মোট উৎপন্ন-ফল বিক্রয় করা হয়, টাকায় রূপান্তরিত হয়, তা হলে মূলধন-মূল্য তার গোডাকার রূপ ফিরে পায়। এই মুহূর্ত থেকে মূলধন মূল্য এবং উদ্বৃত্ত-মূল্য উভয়ই হয় টাকার অংক, এবং মূলধনে তাদের পুন:রূপান্তরণ ঠিক একই পদ্ধতিতে ঘটে থাকে। একটির মত অন্যটিও ধনিক বিনিয়োগ করে পণ্য-দ্রব্যাদি ক্রয়ের বাবদে; যা কে সক্ষম করে তার সামগ্রীর উৎপাদন নোতুন করে শুরু করতে, এবং এই বারে, আরো সম্প্রসারিত ‘আয়তনে। কিন্তু ঐ দ্রব্যসম্ভার করতে হলে তাকে সেগুলি বাজারে পেতে হবে প্রস্তুত অবস্থায়।

তার নিজের সুতো চালু হয়ে যায়, কেবল এই কারণেই যে সে তা বাজারে নিয়ে যায়, যেমন অন্য সমস্ত ধনিকেরাও অনুরূপ ভাবে তাদের নিজ নিজ পণ্যদ্রব্য নিয়ে করে থাকে। কিন্তু বাজারে যাবার আগে এই সমস্ত পণ্যদ্রব্য ছিল সামগ্রিক বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলের অংশবিশেষ, সর্বপ্রকারের সামগ্রীর মোট সমষ্টির অংশবিশেষ ব্যক্তিগত মূলধনগুলির যোগফল অর্থাৎ সমাজের মোট মূলধা গোটা বছর ধরে যে-সামগ্ৰীসমষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং প্রত্যেকজন ধনিকের হাতে ছিল যার এক-একটি অংশ। বাজারের ক্রয়-বিক্রয়ের কারবারগুলি এই বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলের আলাদা আলাদা অংশগুলির কেবল পারস্পরিক বিনিময়ই সম্পাদিত করে, কেবল সেগুলির এক হাত থেকে অন্য হাতে স্থানান্তরই সংঘটিত করে, কিন্তু তা মোট বাৎসরিক উৎপন্ন-ফলকে বাড়াতেও পারে না, উৎপন্ন সামগ্রীগুলির প্রকৃতি বদলাতেও পারে না। সুতরাং, মোট উৎপন্ন-ফলের ব্যবহার কিভাবে করা যায়, তা সমগ্র ভাবে নির্ভর করে তার নিজের গঠনের উপরে, কোনক্রমেই সঞ্চলনের উপরে নয়।

প্রথমত, বাৎসরিক উৎপাদন সেই সমস্ত সামগ্রী ও ব্যবহার-মূল্য) সরবরাহ করবে, যা থেকে, গোটা বছর ধরে পরিভুক্ত মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলির, স্থান পূরণ করা হবে। এই সব সামগ্রীকে বাদ দিলে যা থাকে, তা হল নীট অথবা উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল যাতে অবস্থান করে উদ্বৃত্ত মূল্য। এবং এই উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল কি দিয়ে তৈরি হয়? কেবল সেই সব জিনিস দিয়ে, যা দিয়ে তৃপ্ত হবে ধনিক শ্রেণীর অভাব ও লিঙ্গ, সেই সব জিনিস দিয়ে, যেগুলি তাবতই স্থান পায় ধনিকের পরিভোগ-ভারে? তাই যদি হত, তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের পেয়ালা লা পর্যন্ত খালি হয়ে যেত, এবং সরল পুনরুৎপাদন ছাড়া আর কিছুই ঘটত না।

সঞ্চয়নের জন্য প্রয়োজন উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটা অংশকে মূলধনে রূপান্তরিত করা। কিন্তু একমাত্র ইন্দ্রজাল ছাড়া, আমরা এমন সমস্ত জিনিস যা ম-প্রক্রিয়ায় নিয়োগ করা যায় (অর্থাৎ উৎপাদনের উপায়) এবং এমন সমস্ত জিনিস যা শ্রমিকের প্রাণধারণের জন্য আবশ্যক (অর্থাৎ প্রাণধারণের উপকরণ ), তা বাদে অন্য কিছুকে আমরা মূলধনে রূপান্তরিত করতে পারি না। কাজে কাজেই, বাৎসরিক উত্তের একটা অংশ অবশ্যই প্রযুক্ত হয়েছে অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের স্থান পূরণ করতে আবশ্যক জিনিসগুলির প্রয়োজনীয় পরিমাণ ছাড়াও উৎপাদন ও প্রাণধারণের অতিরিক্ত উপায়-উপকরণে উৎপাদনের জন্য। এক কথায়, উদ্বৃত্ত-মূল্য কেবল এই কারণেই মূলধনে রূপান্তরযোগ্য যে, উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন-ফল, যার মূল্য এই উদ্বৃত্ত-মূল্য, তার মধ্যে নোতুন মূলধনের বস্তুগত উপাদানগুলি বিধৃত রয়েছে।[২]

এখন, এই উপাদানগুলিকে মূলধন হিসাবে কাজ করবার অবকাশ দিতে হলে, ধনিক শ্রেণীর চাই অতিরিক্ত শ্রম। যদি ইতিপূর্বে নিযুক্ত শ্রমিকদের শোষণ ব্যাপকতার দিক থেকে বা নিবিড়তার দিক থেকে বৃদ্ধি না করা যায়, তা হলে অবশ্যই অতিরিক্ত শ্রমশক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-প্রণালী আগে থেকেই, শ্রমিক শ্রেণীকে মজুরি-নির্ভর একটি শ্রেণীতে পরিণত করে, শ্রেণীর সংস্থান রাখে, যার মামুলি মজুরি কেবল তার জীবনধারণের পক্ষেই যথেষ্ট নয়, তার সংখ্যাবৃদ্ধির পক্ষেও যথেষ্ট। মূলধনের পক্ষে যা করণীয়, তা হল শ্রমিক শ্রেণী প্রতি বৎসর সকল বয়সের শ্রমিকের আকারে যে-অতিরিক্ত শ্রমশক্তি সরবরাহ করে, তাকে বাৎসরিক উৎপাদনের মধ্যে বিধৃত উদ্বৃত্ত-উৎপাদন-উপায়সমূহের সঙ্গে কেবলমাত্র সমন্বিত করে দেওয়া; এবং তা হলেই উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়। বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে, সঞ্চয়ন নিজেকে পরিণত করে ক্রমবর্ধমান আয়তনে মূলধনের পুনরুৎপাদনে। যে-বৃত্তাকারে সরল পুনরুৎপাদন সঙ্কলিত হয়, তা আর আকার পরিবর্তন করে এবং সিম দির ভাষায় বলা যায়, ঘোরানো সিড়ির আকার ধারণ করে। [৩]

এবার আমাদের উদাহরণটিতে ফিরে যাওয়া যাক। এটা সেই পুরানো কাহিনী। আব্রাহাম জন্ম দিলেন ইশাকের, ইশাক জন্ম দিলেন আব্রাহামের, এবং এই ভাবেই চলতে থাকল। ১০,০০০ পাউণ্ডের প্রারম্ভিক মূলধন আনল ২০০০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত-মূল্য, যা মূলধনায়িত হল। ২০০০ পাউণ্ডের নতুন মূলধন আনল ৪০০ পাউণ্ডের উদ্বৃত্ত-মূল্য, তা-ও আবার মূলধনায়িত হল, রূপান্তরিত হল একটি দ্বিতীয় অতিরিক্ত মূলধনে, যা আবার পালাক্রমে উৎপাদন করল ৮০ পাউণ্ডের আরো উদ্বৃত্ত-মূল্য। এবং এই ভাবেই বলটি গড়িয়ে চলল।

উদ্বৃত্ত-মূল্যের যে-অংশটি ধনিক পরিভোগ করে, আমরা তাকে বিবেচনার মধ্যে আনছি না। অতিরিক্ত মূলধনটি কি প্রারম্ভিক মূলধনের সঙ্গে যুক্ত হল স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করার জন্য বিযুক্ত রইল, যে ধনিক তা সঞ্চয়িত করেছিল, সে নিজেই তা নিয়োগ করল কিংবা অন্য কারো হাতে হস্তান্তর করল, তা এই মুহূর্তে আমাদের সামান্যই কাজে আসে। শুধু এই কথাটা ভুললে চলবেনা যে, নব-গঠিত মূলধনের পাশাপাশি প্রারম্ভিক মূলধনটিও নিজেকে পুনরুৎপাদন করতে, উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করতে থাকে, এবং এটা সমস্ত সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের ক্ষেত্রেই এবং তার দ্বারা প্রজনিত অতিরিক্ত মূলধনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

প্রারম্ভিক মূলধন গঠিত হয়েছিল অগ্রিম-প্রদত্ত ১০,০০০ পাউণ্ড দিয়ে। মালিক কিভাবে এই টাকাটার অধিকার পেয়েছিল? রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের মুখপাত্রবৃন্দ সমম্বরে উত্তর দেবেন, তার নিজের শ্রম এবং তার পূর্বপুরুষদের শ্রমের দ্বারা।”[৪] এবং বস্তুত তাদের এই ধারণাটাই পণ্য-উৎপাদনের নিয়মাবলীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একমাত্র তথ্য বলে প্রতীয়মান হয়।

কিন্তু ২,০০০ পাউণ্ড অতিরিক্ত মূলধনের বেলায় ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকার। সেটার উৎপত্তি কি ভাবে হল, তা আমরা সকলেই জানি। এই মূলধনটির মধ্যে এমন এক কণা মূল্যও নেই যা তার অস্তিত্বের জন্য মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের কাছে ঋণী নয়। উৎপাদনের উপকরণাদি, যার সঙ্গে অতিরিক্ত শ্রমশক্তি সংযোজিত হয়, এবং অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রী, যা দিয়ে শ্রমিকরা পরিপোষিত হয়—এগুলি উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের অঙ্গগত অংশ ছাড়া, শ্রমিক শ্রেণীর কাছ থেকে ধনিক শ্রেণী কর্তৃক আদায়ীকৃত বাৎসরিক কর ছাড়া, আর কিছুই নয়। যদিও ধনিক শ্রেণী ঐ করের একটা অংশ দিয়ে এমনকি পুরো দামেও অতিরিক্ত শ্রমশক্তি ক্রয় করে, যাতে করে সমমূল্যের সঙ্গে সমমূল্যের বিনিময় ঘটে, তা হলেও ঐ লেনদেনটা হল কেবল প্রত্যেক বিজেতার সেই চিরপুরার কৌশল; বিজিতদের কাছ থেকে সে পণ্য ক্রয় করে অদের কাছ থেকেই লুষ্ঠিত অর্থের সাহায্যে।

যদি এই অতিরিক্ত মূলধন সেই ব্যক্তিটিকেই নিয়োগ করে যে তাকে উৎপন্ন করেছিল, তা হলে এই উৎপাদনকারী কেবল প্রারম্ভিক মূলধনকেই বাড়িয়ে যেতে থাকবে না, সেই সঙ্গে সে তার পূর্ববর্তী শ্রমের ফলগুলিকে ফেরত কিনে নেবে-সেগুলি বাবদে যে শ্রম খরচ হয়েছিল, তার চেয়ে অধিকতর শ্রম দিয়ে। যখন ধনিক শ্রেণী আর শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে লেনদেন হিসাবে ব্যাপারটাকে দেখা হয়, তখন অতিরিক্ত শ্রমিকেরা যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের সাহায্যে নিযুক্ত হল, তাতে কোনো পার্থক্য হয় না। ধনিক এই অতিরিক্ত মূলধনকে রূপান্তরিত করতে পারে একটি মেশিনে, যার ফলে ঐ মেশিন যারা উৎপাদন করেছে, তারাও কর্মচ্যুত হয় এবং তাদের স্থান পূরণ করে কয়েকজন শিশু। প্রত্যেক ক্ষেত্রেই শ্রমিক শ্রেণী এক বছরের উদ্বৃত্ত-শ্রম দিয়ে যেমূলধন সৃষ্টি করে, যা পরবর্তী বছরে অতিরিক্ত শ্রম নিয়োগের জন্য উদ্দিষ্ট।[৫] আর একেই বলা হয়, মূলধন থেকে মূলধন সৃষ্টি করা।

২,০০০ পাউণ্ডের প্রথম অতিরিক্ত মূলধনটি পুচিত করে যে, ১০,০০০ পাউণ্ড মূল্য আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল, নিজের “আদিম-শ্রম”-এর কল্যাণে ধনিক যে-মূল্যের মালিক ছিল এবং যা সে অগ্রিম হিসাবে দিয়েছিল। উটো ভাবে ৪০০ পাউণ্ডের দ্বিতীয় অতিরিক্ত মূলধনটি কেবল সূচিত করে যে, আগে থেকেই ২,০০০ পাউণ্ড সঞ্চয়ীকৃত ছিল, যার মধ্যে ৪০০ পাউণ্ড হল মূলধনায়িত উদ্বৃত্ত-মূল্য। সুতরাং, তখন থেকে অতীতের মজুরি-বঞ্চিত শ্রমই হয়ে আসছে নিরন্তর ভাবে কম-ধমান আয়তনে জীবন্ত মজুৰি-বঞ্চিত শ্রমের আত্মীকরণের একমাত্র শর্ত। ধনিক যত বেশি সঞ্চয়ন করেছে, আরো তত বেশি সঞ্চয়নের ক্ষমতা সে লাভ করেছে।

১নং অতিরিক্ত মূলধন যা দিয়ে তৈরি, সেই উদ্বৃত্ত-মূল্যটি যেহেতু প্রারম্ভিক মূলধনের অংশ দিয়ে শ্রমশক্তি ক্রয়ের ফল, যেমকার্যটি সম্পন্ন হয় পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবলীর সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গতি অনুযায়ী, এবং যা, আইনের দৃষ্টিতে, শ্রমিকের দিক থেকে তার নিজের শক্তি সামর্থ্যের এবং অর্থ বা পণ্যের মালিকের দিক থেকে তার নিজের মালিকাধীন মূল্যসমূহের স্বাধীন আদান-প্রদানের অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই ধরে নেয়না; যেহেতু ২নং অতিরিক্ত মূলধনটি ১নং মূলধনেরই ফল-মাত্র এবং সেই কারণে উল্লিখিত শর্তগুলির পরিণতি; যেহেতু প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা লেনদেন অনিবার্য ভাবেই পণ্য-বিনিময়ের নিয়মাবশীর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে, ধনিক শ্রম জয় করে এবং শ্রমিক তা বিক্রয় করে, এবং আমরা ধরে নেব যে তা করে তার আসল মূল্যে, যেহেতু এটা সুস্পষ্ট যে, আত্মীকরণৱ নিয়মাবলী তা ব্যক্তিগত সম্পত্তির নিয়মাবলী-যে-নিয়মাবলীর ভিত্তি হল পণ্যের উৎপাদন ও সঞ্চলন—সেই নিয়মাবলী তাদের অন্তর্নিহিত ও অমোঘ দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ার জন্য পরিবর্তিত হয় তাদের প্রত্যক্ষ বিপরীতে। আমরা শুরু করেছিলাম ‘সমমূল্যের সঙ্গে সমমূল্যের বিনিময়’-এই প্রারম্ভিক কর্মকাণ্ডটি থেকে; সেটা এখন এমনি ভাবে ঘুরে গিয়েছে যে পরিণত হয়ে গিয়েছে মাত্র একটি বাহ্যিক বিনিময়ে। এর কারণ এই যে প্রথমত, শ্রমশক্তির সঙ্গে যে-মূলধনের বিনিময় ঘটে, তা নিজেই অপরের শ্রম-ফলের একটা অংশ, যেমকে আত্মীকৃত করা হয়েছে সম-পরিমাণ প্রতিমূল্য ব্যতিরেকেই, এবং দ্বিতীয়ত, কেবল এই মূলধনই তার উৎপাদকের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলে চলবে না, তা প্রতিস্থাপিত হতে হবে তার সঙ্গে সংঘোজিত উদ্বৃত্ত সহ। ধনিক এবং শ্রমিকের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্কটি পরিণত হয় সঞ্চলনের প্রক্রিয়া সংক্রান্ত কেবল একটি বাহ্যিক সাদৃশ্যে, কেবল একটি আনুষ্ঠানিক রূপে—যা উপস্থিত লেনদেনটির আসল প্রকৃতির পক্ষে বহিরাগত এবং যা কেবল তাকে রহস্যময় করে তোলে। শ্রমশক্তির বারংবার পুনরাবর্তিত ক্রয় এবং বিক্রয় এখন কেবল আনুষ্ঠানিক রূপ মাত্র; আসলে যা ঘটে, তা এই: সম-মূল্য ব্যতিরেকেই ধনিক বারংবার অন্যান্যের অতীতের বাস্তবায়িত শ্রমের একটি অংশকে আত্মীকৃত করে, এবং একটি বৃহত্তর পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের সঙ্গে তার বিনিময় করে। প্রথমে সম্পত্তির অধিকারকে মনে হত মানুষের নিজের শ্রমের উপরে প্রতিষ্ঠিত অধিকার বলে। অন্ততঃপক্ষে, এই ধরনের একটা কিছু ধরে নেওয়া দরকার ছিল, কেননা কেবল সমান অধিকার-সম্পন্ন পণ্য-মালিকেরাই পরস্পরের মুখোমুখি হত, এবং একমাত্র যে-উপায়টির মাধ্যমে একজন লোক অন্যান্যের পণ্য-সমূহের উপরে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারত, তা হল তার নিজের পণ্যসমূহের পরীকরণ; এবং সেগুলির প্রতিস্থাপন করা যেত একমাত্র শ্রমের দ্বারা। এখন, কিন্তু, ধনিকের কাছে সম্পত্তি পরিণত হয়েছে। অন্যান্যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রম বা তার ফল আত্মীকরণের অধিকারে এবং শ্রমিকের কাছে তা পরিণত হয়েছে তার নিজেরই উৎপন্ন-ফল আত্মীকরণের অসম্ভব ঘটনায়। যে নিয়মটি বাহ্যতঃ উদ্ভূত হয়েছিল শ্রম ও সম্পত্তির মধ্যে অভিন্নতা থেকে, সেই নিয়মটিরই আবশ্যিক পরিণতি ঘটল শ্রম থেকে সম্পত্তির ভিন্নতাসাধমে।[৬]

অতএব, * ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতি যতই পণ্যোৎপাদনের মূল নিয়মাবলীর খোলাখুলি অবাধ্যতা করুক না কেন, তৎসত্ত্বেও কিন্তু এই নিয়মাবলীর লংঘন থেকে নয়, বরং সেগুলির প্রয়োগ থেকেই তার উদ্ভব। আসুন, গতি-প্রক্রিয়ার পরপর পর্যায়গুলিকে সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে আরেকবার ব্যাপারটিকে পরিষ্কার করে নিই; এই পর্যায়-পরম্পরারই চুড়ান্ত বিন্দু হল ধনতান্ত্রিক সঞ্চয়ন। [* এই অনুচ্ছেদটি (৩১১ পৃষ্ঠার “ধনতান্ত্রিক আত্মীকৱণে নিম”) চতুর্থ জার্মান সংস্করণ অনুযায়ী ইয়জী পাঠে ফুক্ত করা হয়েছে। সংস্করণ।]

প্রথমত, আমরা দেখেছিলাম যে, একটি মূল্যসমষ্টির মূলধনে প্রারম্ভিক রূপান্তরণ সম্পাদিত হয়েছি বিনিময়-নিয়মাবলীর সঙ্গে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে। চুক্তিকারী দুটি পক্ষের মধ্যে একটি পক্ষ তার শ্রম-শক্তি বিক্রয় করে, অপরটি তা ক্রয় করে। প্রথম পক্ষটি তার পণ্যের মূল্য পায়, যার ব্যবহার-মূল্য-শ্ৰম—তদ্বারা ক্রেতার কাছে হস্তান্তরিত হয়ে যায়। উৎপাদনের উপায়-উপকরণ, যার মালিক আগে থেকেই দ্বিতীয় পক্ষটি, সেগুলি তখন তারই সমান মালিকানাধীন শ্রমের সাহায্যে তার দ্বারা রূপান্তরিত হয় একটি নোতুন উৎপন্নে, আইনগত ভাবে সে-ই যার মালিক।

এই উৎপন্ন দ্রব্যটির মূল্যে অন্তর্ভুক্ত থাকে একটি উদ্বৃত্ত-মূল্য সমেত শ্রমশক্তির মূল্যের সমমূল্য। তার কারণ এই যে শ্রমশক্তির মূল্য—যা বিক্রি হয় এক দিন বা এক সপ্তাহ ইত্যাদির মত একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য–সেই সময়কালের মধ্যে তার ব্যবহার দ্বারা সৃষ্ট মূল্য অপেক্ষা অল্পতর। কিন্তু শ্রমিক তার শ্রমশক্তির জন্য বিনিময় মূল্য পেয়ে গিয়েছে এবং তা পেয়ে গিয়ে ঐ শ্রমশক্তির ব্যবহার-মূল্যও হস্তান্তরিত করে দিয়েছে প্রত্যেক ক্রয়-বিক্রয়েই এই রকম ঘটে থাকে।

শ্রমশক্তি নামধেয় এই বিশেষ পণ্যটি যে শ্রম-সরবরাহের এবং এই কারণেই মূল্য সৃজনের বিশিষ্ট ব্যবহার-মূল্যটির অধিকারী—এই ঘটনা পণ্যোৎপাদনের সাধারণ নিয়মটিকে ক্ষুন্ন করতে পারে না। সুতরাং, মজুরি বাবদে অগ্রিম প্রদত্ত মূল্যের আয়তনটি-মাত্র আবার উৎপন্ন-ফলে পাওয়া না গিয়ে যদি সেখানে পাওয়া যায় উদ্ব মূল্যের দ্বারা বিবর্ধিত আয়তনে, তার কারণ এই নয় যে, বিক্রেতাকে প্রতারণা করা হয়েছে, কেননা সে তো আসলে তার পণ্যের মূল্য পেয়েই গিয়েছে। তার একমাত্র কারণ এই যে, এই পণ্যটি ক্রেতার দ্বারা পরিভুক্ত হয়ে গিয়েছে।

বিনিময়ের নিয়মটি দাবি করে কেবল পরস্পরের সঙ্গে বিনিময়-কৃত পণ্যসমূহের সমতা। গোড়া থেকেই তা ধরে নেয় তাদের ব্যবহার-মূল্যের মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের পরিভোগর সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই; পরিভোগ তো শুরু হয় লেন দেনটি সম্পাদিত ও সমাপ্ত হবার পরে।।

অতএব, অর্থের মূলধনে প্রারম্ভিক রূপান্তরণ সম্পন্ন হয় পণোৎপাদনের অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর সঙ্গে এবং তজ্জনিত সম্পত্তির অধিকারের সঙ্গে সর্বাপেক্ষা যথাযথ সুসঙ্গতি অনুসারে। যাই হোক, ফল দাঁড়ায় এইঃ

(১) উৎপ-ফলটির মালিক হয় ধনিক, শ্রমিক নয়;

(২) অগ্রিম-প্রদত্ত মূল্য ছাড়াও, এই উৎপন্ন-ফুলটি ধারণ করে উদ্বৃত্ত-মূল্য যার বদলে শ্রমিকের খরচ হয় শ্রম, কিন্তু ধনিকের খরচ হয় কিছুই না, এবং যা তৎসত্ত্বেও ধনিকেরই সম্পত্তি;

(৩) শ্রমিক তার শ্রমশক্তিকে বজায় রেখেছে এবং তা সে নোতুন করে

বিক্রি করতে পারে, যদি একজন ক্রেতা পায়। সরল পুনরুৎপাদন হচ্ছে এই প্রথম কর্মকাণ্ডটিরই সময়ক্রমিক পুনরাবৃত্তি, প্রত্যেক বারেই অর্থ নোতুন করে রূপান্তরিত হয় মূলধনে। সুতরাং নিয়মটি ভাঙা হচ্ছে না। বরং, নিয়মটিকে সক্ষম করা হচ্ছে কেবল নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যেতে। “বিনিময়ের কয়েকটি উত্তরোত্তর কার্য কেবল সর্বশেষটিকে সক্ষম করেছে সর্বপ্রথমটিকে প্রতিফলিত করতে।’ (সিসমদি, “Nouveaux Principes, etc.” পৃ: ৭০)।

এবং তবু আমরা দেখেছি যে, একটি বিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়া হিসাবে দেখলে, এই প্রথম কর্মকাণ্ডটিকে একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত চরিত্র দিয়ে ছাপ মেরে দিতে সরল পুনরুৎপাদনই যথেষ্ট। “যারা নিজেদের মধ্যে জাতীয় আয় ভাগাভাগি করে নেয়, তাদের মধ্যে একটি পক্ষ (মজুরেরা প্রতি বছরই নোতুন কাজের দ্বারা তাদের ভাগের উপরে নতুন অধিকার অর্জন করে। অন্যান্যরা (ধনিকেরা) প্রারম্ভে কত কাজের দ্বারা তাদের ভাগের উপরে আগেই অর্জন করেছে চিরস্থায়ী অধিকার (সিম দি, ঐ পৃঃ ১১০ ১১১)। এটা বাস্তবিকই একটা কুখ্যাত ব্যাপার যে, শ্রমই একমাত্ৰ ক্ষেত্র নয় যেখানে জ্যেষ্ঠত্বের অধিকার ভেলকি ঘটায়।

সরল পুনরুৎপাদন যদি সম্প্রসারিত আয়তনে পুনরুৎপাদনের দ্বারা, সঞ্চয়নের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তাতেও কিছু এসে যায় না। প্রথম ক্ষেত্রে ধনিক গোটা উদ্বৃত্ত মূল্যটাকেই বিলাস-ব্যসনে উড়িয়ে দেয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সে তার কেবল একটা অংশ পরিভোগ করে, বাকি অংশটা টাকায় রূপান্তরিত করে এবং এই ভাবে তার বুর্জোয়া চরিত্রগুণের প্রমাণ দেয়।

উদ্বৃত্ত-মূল্য ধনিকের সম্পত্তি; তা কখনো অন্য কারো মালিকানায় থাকেনি। যদি সে উৎপাদনের উদ্দেশ্যে তা আগাম দেয়, তা হলে সেই আগাম তার নিজের তহবিল থেকেই আসে, ঠিক সেই দিনটিতে যেদিন সে প্রথমে বাজারে প্রবেশ করল। এই উপলক্ষ্যে উক্ত তহবিল যে তার মজুরদের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম থেকে সংগৃহীত হয় হয় এই ঘটনায় তার আদৌ কোনো ইতর-বিশেষ হয় না। যদি মজুরি-‘ক’ যে উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদন করেছে, তা থেকে মজুর-‘খ’-কে তার মজুরি দেওয়া হয় তা হলে প্রথমত, ‘ক’ সেই উদ্বৃত্ত-মূল্য সরবরাহ করেছিল তার পণ্যের ন্যায্য দাম থেকে একটি হাফপেনিও না-কাটা অবস্থায়, এবং, দ্বিতীয়ত এই লেন-দেনটি নিয়ে ‘খ’-এর কোনো মাথাব্যথা নেই। যা দাবি করে, এবং যা দাবি করার অধিকার তার আছে, তা এই যে ধনিক তাকে তার শ্রমশক্তির মূল্য দেবে। দু জনেই তবু লাভ হচ্ছে, মজুরের লাভ হচ্ছে, কেননা তার শ্রমের ফল সে অগ্রিম পেয়ে যাচ্ছে” (পড়া উচিত। অন্যান্য মজুরের বেতন-বঞ্চিত শ্রমের ফল) “তার নিজের কাজটি সম্পন্ন হবার আগেই (পড়া উচিত। আর নিজের শ্রম ফল প্রসব করার আগেই); এবং নিয়োগ কর্তার (le maitre’) লাভ হচ্ছে, কেননা এই মজুরের শ্রম ছিল তার মজুরির তুলনায় বেশি মূল্যাহ (পড়া উচিত : এই মজুরের শ্রম তার মজুরির তুলনার বেশি মূল্য উৎপাদন করেছিল) (সিসম দি, ঐ পৃঃ ১৩৫)।

আরো নিশ্চয় করে বলা যায়, ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম দেখায়—যদি আমরা ধনতান্ত্রিক উৎপাদনকে তার পুননবীভবনের অব্যাহত প্রবাহের মধ্যে লক্ষ্য করি এবং যদি, ব্যক্তিগত ধনিক এবং ব্যক্তিগত মজুর হিসাবে না দেখে, দেখি তাদের সমগ্রতা, যেখানে ধনিক শ্রেণী এবং মজুর শ্রেণী পাড়ায় পরস্পরের মুখোমুখি। কিন্তু তা করতে গিয়ে আমাদের প্রয়োগ করতে হয় এমন সব মান, যা পণ্যোৎপাদন ব্যবস্থার একেবারে বহির্ভূত।

পণ্যোৎপাদনে কেবল ক্রেতা এবং বিক্রেতা স্বাধীন ভাবে পরস্পরের মুখোমুখি হয়। যে দিন তাদের সম্পাদিত চুক্তিটির নির্ধারিত মেয়াদ শেষ হয়ে যায়, সেই দিনই তাদের সম্পর্কও শেষ হয়ে যায়। যদি লেনদেনটির পুনরাবৃত্তি ঘটে, তা হলে ঘটে একটি নোতুন চুক্তি অনুসারে, আগেকার চুক্তিটির সঙ্গে যার কোন সম্পর্কই নেই এবং যা কেবল ঘটনাচক্রে একই বিক্রেতাকে সেই একই ক্রেতার সঙ্গে সংযোগ ঘটায়।

সুতরাং, যদি পণ্যোৎপাদনকে কিংবা তার একটি সংশ্লিষ্ট প্রক্রিয়াকে তার নিজস্ব অর্থনৈতিক নিয়মাবলীর দ্বারা বিচার করতে হয়, তা হলে, আমাদের তা করতে হবে, পূর্ববতী বা পরবর্তী কোনো বিনিময়-ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক না রেখে, প্রত্যেকটি বিনিময় ক্রিয়াকে আলাদা আলাদা করে। এবং যেহেতু বিক্রয় এবং ক্রয় সম্পূর্ণত দুটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে দরাদরির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়, সেই হেতু এখানে দুটি সমগ্র সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার অবকাশ নেই।

আজকের কর্মরত মূলধন যত দীর্ঘ সময়ক্রমিক পুনরুৎপাদন এবং পূর্ববর্তী সঞ্চয়ন সমূহের মধ্য দিয়েই অতিক্রান্ত হোক না কেন, তা সব সময়েই তার প্রারম্ভিক কুমারীত্ব বজায় রাখে। যত কাল পর্যন্ত বিনিময়ে নিয়মাবলী বিনিময়ের প্রত্যেকটি কার্যে পালিত হয়, তত কাল পর্যন্ত পণ্যোৎপাদনের আনুষঙ্গিক সম্পত্তিগত অধিকারগুলিকে ক্ষুন্ন না করেই, আত্মীকরণের পদ্ধতিটিকে বিপ্লবায়িত করা যায়। সেই সূচনাকালে, যখন উৎপন্ন-দ্রব্যের মালিক থাকে উৎপাদনকারী স্বয়ং, সমমূল্যের বিনিময় অনুসারে যে নিজেকে ধনী করতে পারে কেবল তার নিজের শ্রমের দৌলতে, এবং এই ধনতন্ত্রের কালে যখন সামাজিক সম্পদ ক্রমবর্ধমান হারে পরিণত হয় তাদেরই সম্পদে, যারা ক্রমাগত এবং নিত্য-নোতুন করে অপরের মজুরি-বঞ্চিত শ্রম আত্মসাৎ করতে পারে –এই উভয় কালেই সেই একই অধিকারসমূহ বলবৎ থাকে।

যে মুহূর্তে স্বয়ং শ্রমিক তার শ্রম-শক্তিকে পণ্য হিসাবে অবাধে বিক্রয় করে, সেই মুহূর্ত থেকে এটাই হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী রূপ। কিন্তু কেবল খন থেকেই আবার পণ্যোৎপাদন সাধারণীকৃত হয় এবং উৎপাদনের প্রতিরূপে পরিণত হয়। কেবল তখন থেকেই, প্রথম থেকেই, প্রত্যেকটি উৎপন্ন-দ্রব্য উৎপাদিত হয় বিক্রয়ের জন্য এবং উৎপাদিত সকল দ্রব্য সঞ্চলনের মধ্যে দিয়ে অতিক্রান্ত হয়। কেবল যখন এবং যেখানে মজুরি-এমই ভিত্তিস্বরূপ, তখন এবং সেখানেই পণ্য উৎপাদন নিজেকে আরোপ করে সমগ্র ভাবে সমাজের উপরে, এবং কেবল তখন এবং সেখানেই তা তার সমস্ত লুক্কায়িত সম্ভাবনাগুলিকে উদ্ঘাটন করে দেয়। মজুরি-শ্রমের প্রক্ষেপণ পণ্যোৎপাদনকে ভেজালদুষ্ট করে-এ কথা বলাও যা, পণ্যোৎপাদনকে যদি ভেজালমুক্ত রাখতে হয়, তবে তাকে অবশ্যই বিকশিত হতে দেওয়া হবে না—সে কথা বলাও তা। যতদূর পর্যন্ত পণ্যোৎপাদন, তার নিজের অন্তর্নিহিত নিয়মাবলীর দরুন, আরো বিকশিত হয় গনতান্ত্রিক উৎপাদনে, ততদূর পর্যন্ত পণ্যোৎপাদনের সম্পত্তি-সংক্রান্ত নিয়মাবলীও পরিবর্তিত হয় ধনতান্ত্রিক আত্মীকরণের নিয়মাবলীতে।[৭]

আমরা দেখেছি, এমনকি সরল পুনরুৎপাদনের ক্ষেত্রেও, সমস্ত মূলধন, তার মূল উৎস যাই হোক না কেন, রূপান্তরিত হয় সঞ্চয়ীকৃত মূলধনে, মূলধনীকৃত উদ্বৃত্ত-মূল্যে। কিন্তু উৎপাদনের প্লাবনে প্রারম্ভে অগ্রিম-প্রদত্ত সমস্ত মূলধনই, প্রত্যক্ষ ভাবে সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের সঙ্গে তুলনায় অর্থাৎ মূলধন পুনঃরূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্য বা উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের তুলনায়, তা তার সঞ্চয়নকারীর হাতেই কাজ করুক বা অন্যান্যের হাতেই কাজ করুক— পরিণত হয় একটি শূন্যে পরিণীয়মান রাশিতে ( magnitudo evanescens’, গাণিতিক অর্থে) এই থেকেই রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব মূলধনকে সাধারণ ভাবে বর্ণনা করে “সঞ্চয়ীকৃত সম্পদ” (রূপান্তরিত উদ্বৃত্ত-মূল্য বা আগম) হিসাবে, যাকে আবার নিয়োগ করা হয় উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন”[৮], এবং ধনিককে বর্ণনা করা হয় “উদ্বৃত্ত-মূল্যের মালিক” হিসাবে।[৯] এটা কেবল এই কথাটাই ভিন্ন ভঙ্গিতে বলা যে, সমস্ত বিদ্যমান মূলধনই হল সঞ্চয়ীকৃত কিংবা মূলধনীকৃত সুদ, কেননা সুদ হল উদ্বৃত্ত-মূল্যেরই একটি ভগ্নাংশ মাত্র।[১০]

————

১. মূলধনের সঞ্চয়ন : আয়ের একাংশ মূলধন হিসাবে নিয়োগ।” (ম্যালথাস, ‘ডেফিনিশনস ইত্যাদি’, কাজেনোভ সংস্করণ, পৃঃ ১১)। “আয়ের মূলধনে রূপান্তর।”

(ম্যালথাস : “প্রিন্সিপলস : ইকনমি, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৮৩৬, পৃঃ ৩২)।

২. আমরা এখানে রপ্তানি-বাণিজ্যকে আদৌ হিসাবে ধরছিনা, যার সাহায্যে একটি জাতি বিলাসদ্রব্যাদিকে উৎপাদনের উপায়ে বা জীবনধারণের উপকরণে রূপান্তরিত করতে পারে—এবং বিপরীতটাও। সমস্ত রকমের ব্যাঘাতজনক গৌণ ঘটনাবলী থেকে মুক্ত করে, আমাদের অনুসন্ধানের বিষয়টিকে তার স্বয়ংগত সমগ্রতায় পরীক্ষা করে দেখার জন্য, আমরা গোটা বিশ্বকে একটি জাতি হিসাবে গণ্য করব এবং ধরে নেব যে, ধনতান্ত্রিক উৎপাদন সর্বত্রই প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং শিল্পের প্রত্যেকটি শাখায় তার অধিকার স্থাপন করেছে।

৩. সিম দির সঞ্চয়ন-সংক্রান্ত বিশ্লেষণের একটা বড় ত্রুটি এই যে, তিনি আয়ের মুলধনে রূপান্তরণ নিয়ে নিজেকে অত্যধিক মাত্রায় তৃপ্ত রেখেছেন অথচ এই কম প্রক্রিয়ার বাস্তব অবস্থাবলী অনুধাবনের চেষ্টা করেন নি।

৪. “Le travail primitif auquelson capital a du sa naissance.” Sismondi 1. c. ed. Paris, t. I., p. 109.

৫. “মূলধন এমকে নিল্লোগ করার আগে শ্রম সুলক্ষনকে সৃষ্টি কৰে।” ই. জি. ওয়েকফিল্ড, ইংল্যান্ড অ্যাও আমেরিকা, কণ্ডন, ১৮৩৩, বিজয় খণ্ড, পৃ ১১।

৬. অপরের শ্রমজাত সামগ্রীতে ধনিকের সম্পত্তি হচ্ছে ‘আত্মীকরণের নিয়মটির সুনির্দিষ্ট ফলশ্রুতি, যার মৌল নীতি কিন্তু ছিল বিপরীত—নিজেকে শ্ৰমজাত সামগ্রীতে প্রত্যেক শ্রমিকের একান্ত স্বত্বাধিকার। (cherbuliez, Richesse ou pauvrete’, Paris, 1848, p. 58; সেখানে অবশ্য, দ্বান্দ্বিক প্রতিবর্তন ঠিক ভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি।

৭. সুতরাং, আমরা প্রধোর চালাকিতে বেশ আশ্চর্য বোধ করতে পারি যে, পণ্যোৎপাদনের উপরে ভিত্তিশীল সম্পত্তি-সংক্রান্ত শাশ্বত নিয়মাবলী বলবৎ করে তিনি

নতান্ত্রিক সম্পত্তির অবলুপ্তি সাধন করবেন। ‘

৮. মূলধন অর্থাৎ সঞ্চয়ীকৃত সম্পদ, যা মুনাফায় উদ্দেশ্যে নিয়োজিত হয়েছে। (ম্যালথাস, ঐ)। আয় থেকে সঞ্চিত সম্পদ, যা মুনাফার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তাই মূলধন। (আর. জোন্স,‘অ্যান ইন্টেডাকটরি লেকচার অন পলিটিক্যাল ইকনমি’, লণ্ডন, ১৮৩৩, পৃঃ ১৬)।

৯ ‘উক্ত উৎপন্ন বা মূলধনের অধিকারী। (দি সোর্স অ্যাণ্ড রেমিডি অব দি ন্যাশনাল ভিফিকালটিজ। এ লেটার টু লর্ড জন রাসেল, লণ্ডন, ১৮২১)।

১০. সঞ্চিত মূলধনের প্রত্যেকটি অংশের উপরে চক্রবৃদ্ধি হারে সু সমেত মূলধন এমন সর্বগ্রাসী যে, বিশ্বের সমস্ত সম্পদ, যা থেকে আয়ের উদ্ভব ঘটে, তা অনেক কাল আগেই মূলধন বাবদ সুদে পরিণত হয়ে গিয়েছে। (লন, ইকনমি, ১৯ জুলাই ১৮৫১)।

.

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ ক্রমবর্ধমান আয়তনে পুনরুৎপাদন সম্পর্কে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের ভ্রান্ত ধারণা।

সঞ্চয়ন বা উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনে রূপান্তরণ সম্পর্কে আরো অনুসন্ধানের আগে আমরা চিরায়ত অর্থতাত্ত্বিকদের দ্বারা প্রবর্তিত একটি বিভ্রান্তিকে পরিষ্কার করে নেব।

উদ্বৃত্ত-মূল্যের একটি অংশের সাহায্যে নিজের পরিভোগের যে পণ্যদ্রব্যাদি ধনিক ক্রয় কৰে, তা যেমন খুব সামান্যই মূল্য উৎপাদন ও সৃজনের উদ্দেশ্য সাধন করে, তার স্বাভাবিক ও সামাজিক প্রয়োজনাদি মেটাবার জন্য সে যে শ্রম ক্রয় করে, তা ঠিক তেমন। সামান্যই উৎপাদনশীল শ্রম হয়। উদ্বৃত্ত-মূল্যকে মূলধনে রূপান্তরিত করার পরিবর্তে সে উল্টোটাই করে—ঐসব পণ্য-দ্রব্য ও ঐ শ্ৰম ক্রয় করে সে তা আয় হিসাবে পরিভোগ বা ব্যায় করে। পুরনো সামন্ততান্ত্রিক অভিজাত সম্প্রদায়ের অভ্যস্ত জীবন-যাত্রা পদ্ধতির বিরোধিতায় যা পরিচালিত হয়, যেমন হেগেল সঠিক ভাবেই বলেন, “হাতের কাছে যাই পাও, ভোগের কাজে তাই লাগাও” এই নীতির সাধনায় এবং আরো বিশেষ ভাবে যা নিজেকে জাহির করে ব্যক্তিগত পরিচারক পোষণের বিলাসিতায়, বুর্জোয়া অর্থতত্ত্বের পক্ষে চরম গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই মতবাদটি ঘোষণা করা যে, প্রত্যেক নাগরিকের প্রথম কর্তব্য হল মূলধনের সঞ্চয়ন, এবং অবিশ্রান্ত ভাবে প্রচার করা যে, শ্রমিকদের বাবদে যা ব্যয় হয়, তার চেয়ে বেশি তারা এনে দেয়; সুতরাং আরো বেশি সংখ্যায় উৎপাদনশীল শ্রমিক নিয়োগের জন্য তার আয়ের একটা ভাল অংশ ব্যয় না করে, সে যদি গোটা আয়টাই খেয়ে ফেলে, তা হলে সে সঞ্চয় করতে পারে না। অন্য দিকে, অর্থতাত্ত্বিকদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল সাধারণের এই ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে যা মজুদ করাকে গুলিয়ে ফেলে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের সঙ্গে এবং কল্পনা করে নেয় যে সঞ্চিত সম্পদ যাকে তার উপস্থিত আকারে বিনষ্ট করা থেকে অর্থাৎ পরিভুক্ত হওয়া থেকে রক্ষা করা হয়েছে আর, নয়তো, তা সেই সম্পদ যাকে তুলে রাখা হয়েছে সঞ্চলন থেকে। সঞ্চলন থেকে টাকার বাদ পড়া মানে, সেই সঙ্গে, মূলধন হিসাবে তার আত্ম-সম্প্রসারণ থেকেও বাদ পড়া, অন্য দিকে, পণ্যসম্ভারের আকারে একটা মজুদ জমিয়ে ভোলা হচ্ছে একটা নিরেট ভাড়ামি।[১] বিরাট বিরাট পরিমাণে পণ্যসামগ্রীর পুঞ্জীভবন, হয়, অতি-উৎপাদনের, নয়তো, সঞ্চলন বন্ধ হয়ে যাবার পরিণাম।[২] এটা সত্য যে, এক দিকে ধনী লোকদের ক্রমে ক্রমে পরিভোগর জন্য জমানো জিনিসের স্তূপ[৩], এবং অন্য দিকে, সংরক্ষিত ভাণ্ডার’ (রিজার্ভ স্টক’-এর সংগঠন—এই দৃশ্য জনমানসে দারুণ রেখাপাত করে। এই দ্বিতীয়টি সর্বপ্রকার উৎপাদন-পদ্ধতিরই অভিন্ন ঘটনা; যখন সঞ্চলনের বিশ্লেষণে যাব, তখন এই সম্পর্কে কিছুটা আলোচনা করব। সুতাং চিরায়ত অর্থতত্ত্ব যখন বলে যে, অনুৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা পরিভোগর পরিবর্তে উৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা পরিভোগই হল সঞ্চয়ন-প্রক্রিয়ার একটি চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য, তখন তা সম্পূর্ণ সঠিক কথাই বলে। কিন্তু ঠিক এই বিন্দুতেই আবার ভুলগুলিরও সূচনা হয়। উৎপাদনশীল শ্রমিকদের দ্বারা উত্ত-উৎপন্নের চেয়ে বেশি কিছু নয়, এমন ভাবে সঞ্চয়নকে উপস্থাপিত করা অ্যাডাম স্মিথের কাছে একটা রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার মানে দাঁড়ায় এই যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের মূলধনীকরণ হচ্ছে কেবল উদ্বৃত্ত-মূল্যকে শ্রমশক্তিতে রূপায়িতকরণ। রিকার্ডো প্রমুখ অর্থতাত্ত্বিকেরা কি বলেন, সেটা দেখা যাক : “এটা বুঝতে হবে যে একটা দেশের সমস্ত উৎপাদনই পরিভুক্ত হয়; কিন্তু সেগুলি কি তাদের দ্বারা পরিভুক্ত হল, যারা একটা মূল্য পুনরুৎপাদন করে, না কি তাদের দ্বারা পরিভুক্ত হল, যারা কোনো মূল্য পুনরুৎপাদন করেনা—এই ব্যাপারটাই কল্পনীয় সমস্ত পার্থক্যের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্যের কারণ হয়ে ওঠে। যখন আমরা বলি যে, আয় সঞ্চিত হল এবং মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হল, তখন আমরা যা বোঝাই তা হল এই যে, আয়ের যে অংশ মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হল বলে বলা হয়, সে অংশ উৎপাদনশীল শ্রমিকদের দ্বারা পরিভুক্ত হয়, অনুৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা নয়। মূলধন বর্ধিত হয় অ-পরিভোগের দ্বারা—এর চেয়ে বৃহৎ ভুল ধারণা আর কিছু হতে পারে না।”[৪] “আয়ের যে-অংশ মূলধনের সঙ্গে সংযুক্ত হয় বলে যা বলা হয়, সেই অংশ উৎপাদনশীল শ্রমিকদের পরিভুক্ত হয়” রিকার্ডো, এবং অ্যাডাম স্মিথের পরবর্তী সমস্ত অর্থতাত্ত্বিক যে কথাটার পুনরাবৃত্তি করে চলেন, তার চেয়ে বৃহত্তর ভুল ধারণা আর কিছু হতে পারে না। এই বক্তব্য অনুসারে, সমস্ত উদ্বৃত্ত-মূল্য, যা পরিবর্তিত হয় মূলধনে, তা হয়ে পড়ে অস্থির মূলধন। সুতরাং, এই রকম হওয়া তো দূরের কথা, উদ্বৃত্ত-মূল্য, প্রারম্ভিক মূলধনেরই মত, নিজেকে বিভক্ত করে স্থির মূলধনে এবং অস্থির মূলধনে, উৎপাদনের উপায়ে এবং শ্রমশক্তিতে। শ্রমশক্তিই হল সেই বিশিষ্ট রূপ, যার অন্তরালে অস্থির মূলধন উৎপাদন-প্রক্রিয়া চলাকালে অবস্থান করে। এই প্রক্রিয়াতেই খোদ শ্রমশক্তিই পরিভুক্ত হয় খনিকের দ্বারা যখন উৎপাদনের উপায়গুলি পরিভুক্ত হয় কর্ম-সম্পাদনে অর্থাৎ শ্রমে ব্যাপৃত শ্রম শক্তির দ্বারা। একই সময়ে শ্রম-শক্তি ক্রয়ের জন্য প্রদত্ত-অর্থ রূপান্তরিত হয় অত্যাবশ্যক দ্রব্যসামগ্রীতে, যেগুলি পরিভুক্ত হয় “উৎপাদনশীল শ্রমের দ্বারা নয়, “উৎপাদনশীল শ্রমিকের দ্বারা। একটি আমূল বিকৃত বিশ্লেষণের মাধ্যমে অ্যাডাম স্মিথ এই আজগুবি সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, যদিও প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মূলধন বিভক্ত হয় স্থির ও অস্থির অংশে, সমাজের মূলধন কিন্তু নিজেকে পর্যবসিত করে কেবল অস্থির মূলধনে অর্থাৎ ব্যয়িত হয় একান্ত ভাবেই কেবল মজুরি দেবার জন্য। ধরা যাক, একজন কাপড়-কল মালিক ১,০০০ পাউণ্ডকে মূলধনে রূপান্তরিত করে। এক অংশ সে নিয়োগ করে তন্তুবায়দের ক্রয় করতে, বাকি অংশটা উল, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ক্রয় করতে। কিন্তু যেসব লোকজনের কাছ থেকে সে উল ও যন্ত্রপাতি কেনে, তারা শ্রমের জন্য মজুরি দেয় কেনার টাকার একটা অংশ দিয়ে, এবং এই ভাবেই চলতে থাকে যে-পর্যন্ত সমগ্র ২,০০০ পাউণ্ডই মজুরি বাবদ খরচ না হয়ে যায়, অর্থাৎ ২,০০০ পাউণ্ড যে-উৎপন্ন-সামগ্রীর প্রতিনিধিত্ব করে, তার সমগ্রটাই উৎপাদনশীল শ্রমিকের দ্বারা পরিভুক্ত না হয়ে যায়। এটা স্পষ্ট যে এই চুক্তিটির গোটা সারমর্মটা নিহিত রয়েছে এই কটি কথার মধ্যে এবং এই ভাবেই চলতে থাকে, যা আমাদের কেবল খুঁটি থেকে থামে ঠেলে দেয়। সত্য কথা এই যে, ঠিক যেখানে সমস্যা দেখা দেয়, ঠিক সেখানেই অ্যাডাম স্মিথ তার অনুসন্ধানের ছেদ ঘটিয়ে দেন।[৫]

 যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কেবল বছরের উৎপাদন মোট যোগফলকে আমাদের নজরে রাখি, ততক্ষণ পর্যন্ত পুনরুৎপাদনের বাৎসরিক প্রক্রিয়াটি সহজেই বোঝা যায়। কিন্তু এই মোট উৎপাদনের প্রত্যেকটি উপাদানকে অবশ্যই এক-একটি পণ্য হিসাবে বাজারে আনতে হবে, এবং ঠিক সেখান থেকেই হয় সমস্যার সূত্রপাত। আলাদা আলাদা মূলধনগুলির এবং ব্যক্তিগত আয়সমূহের চলাচল পরস্পরকে ছেদ করে, পরস্পরের সঙ্গে মিশে যায় এবং সাধারণ স্থান-পরিবর্তনের মধ্যে হারিয়ে যায়। এই ঘটনায় দৃষ্টিবিভ্রম ঘটে এবং এমন সমস্ত জটিল সমস্যার সৃষ্টি করে যেগুলির সমাধান খুব দুরূহ। দ্বিতীয় গ্রন্থের তৃতীয় অংশে আমি এই সব তথ্যের আসল তাৎপর্য ব্যাখ্যা করব। ফিজিওক্র্যাট দের এটা একটা বড় কৃতিত্ব যে, তাঁদের অর্থনৈতিক সারণী’-তে (Tebleau economique’) তারাই প্রথম বাৎসরিক উৎপাদনকে এমন আকারে চিত্রিত করতে চেষ্টা করেছিলেন, যে-আকারে তা সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পার হয়ে আমাদের কাছে উপস্থাপিত হয়। [৬]

বাকি বিষয় সম্পর্কে বলা যায়, এটা একটা স্বাভাবিক ব্যাপার যে ধনিকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব আডাম স্মিথের এই মতবাদটিকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়নি যে, উদ্ধত উৎপন্ন-দ্রব্যের সেই অংশ যা রূপান্তরিত হয় মূলধনে, তার সমস্তটাই পরিভুক্ত হয় শ্রমিক শ্রেণীর দ্বারা।

————

১. যেমন ব্যালজাক, যিনি অর্থগৃঃ,তার যাবতীয় রূপ এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে অনুশীলন করেছিলেন, তিনি, বুড়ো কুসীদজীবী ‘গবসেক’ যখন পণ্যের মজুদ জমিয়ে তুলতে লাগল, তখন তাকে আঁকলেন যেন সে উপনীত হয়েছে তার দ্বিতীয় শৈশবে।।

২. স্তুপীকৃত স্টক”অ-বিনিময় অতি-জনসংখ্যা। (টমাস করবেট, ‘অ্যান ইনকুইয়ি”ওয়েলথ অব ইনডিভিজুয়ালস’, পৃঃ ১০৪)।

৩. এই অর্থে নেকার বলেন “objets de faste et de somptuosite of which “le temps a grossi l’accumulation and which “les lois de propriete ont rassembles dans une seule classe de la societe.” (Oeuvres de M. Necker, paris and Lausanne, 1789, t ii p. 291 ),

৪. রিকার্ডো, ঐ, পৃঃ ১৬৩, টাকা।

৫. তাঁর লজিক’ সত্ত্বেও জন স্টুয়ার্ট মিল তার পূর্ববর্তী যেসব ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণ করে গেছেন; সেগুলি ধরেন না, যেমন এটিকে ধরেন নি; অথচ এটি এমন একটি বিশ্লেষণ, যা এমনকি সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞান সম্পর্কে বুর্জোয়া দৃষ্টিকোণ থেকেও সোচ্চাকে সংশোধন দাবি করে। প্রত্যেক ক্ষেত্রে শিষসুলভ গোঁড়ামি নিয়ে তিনি তার গুরুদের চিন্তা ভাবনার বিভ্রান্তিগুলিই আবৃত্তি করে গিয়েছেন। যেমন এখানের “মূলধন নিজেই শেষ পর্যন্ত মজুরিতে পরিণত হয়ে যায়, এবং যখন উৎপন্ন দ্রব্যের বিক্রয়ের দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়, তখন আবার মজুরি হয়ে যায়।”

৬. পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়া এবং সঞ্চয়নের বিবরণে অ্যাডাম স্মিথ যে-কোনও. অগ্রগতি করেন নি, তাই নয়, এমনকি তার পূর্বগামীদের তুলনায়, বিশেষ করে, ফিজিওক্র্যাটদের তুলনায় বেশ কিছুটা পিছিয়ে গিয়েছিলেন। পাঠাংশে উল্লিখিত বিভ্ৰমটির সঙ্গে সংযুক্ত সেই সত্য সত্যই বিস্ময়কর গোঁড়া-বক্তব্যটি, যা তিনি দিয়ে গিয়েছেন রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বকে তার উত্তরাধিকার হিসাবে—যে গোঁড়া বক্তব্যটি অনুযায়ী পণ্যের দাম গঠিত হয় মজুরি, মুনাফা (সুদ) ও খাজনা অর্থাৎ মজুরি ও উদ্বৃত্ত-মূল্য নিয়ে। এই ভিত্তি থেকে শুরু করে স্টর্চ সরল মনে স্বীকার করেন, ‘n est impossible de resoudre le prix necessaire dans ses elements les plus simples.’ (Storch : ‘Cours & Economic politique,” Petersb. Edit. 1815, t i, 141, note.) এ এক অপূর্ব অর্থনৈতিক বিজ্ঞান যা ঘোষণা করে যে পণ্যের দামকে তার সরলতম উপাদানসমূহে পর্যবসিত করা অসম্ভব। তৃতীয় খণ্ডে বি) ল ভাগে এই বিষয়টি আবার আলোচিত হবে।

.

তৃতীয় পরিচ্ছেদ –মূলধন ও প্রত্যাগমে (আয়ে) উদ্বৃত্ত-মূল্যের বিভাজন। ভোগ-সংবরণ তত্ত্ব।

পূর্ববর্তী অধ্যায়টিতে আমরা উদ্বৃত্ত-মূল্যকে (বা উদ্বৃত্ত-উৎপন্নকে) গণ্য করেছি কেবল সরবরাহের ভাণ্ডার হিসাবে। এই অধ্যায়টিতে আমরা এ পর্যন্ত তাকে গণ্য করেছি কেবল সঞ্চয়নের ভাণ্ডার হিসাবে। কিন্তু তা প্রথমটিও নয়, দ্বিতীয়টিও নয়; তা একসঙ্গে দুটিই। একটি অংশ ধনিকের দ্বারা পরিভুক্ত হয় আয় হিসাবে, অন্য অংশটি নিয়োজিত হয় মূলধন হিসাবে,[১] হয় সঞ্চয়ীকৃত।

তা হলে উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ যদি নির্দিষ্ট থাকে, এই দুটি অংশের মধ্যে একটি যত বৃহত্তর হবে, অন্যটি হবে তত ক্ষুদ্রতর। Cacteris Paribus, এইগুলির অংশ অনুপাত সঞ্চয়নের আয়তন নির্ধারণ করে। কিন্তু বিভাজনটি সম্পাদিত হয় একক ভাবে ঐ উদ্বৃত্ত-মূল্যের মালিকের দ্বারাই, ধনিকের দ্বারাই। এটা তার বিবেচনা-প্রসূত কাজ। তার দ্বারা আদায়ীকৃত করের যে-অংশটি সে সঞ্চয়ীকৃত করে, সে অংশটি সে বাঁচিয়েছে বলে বলা হয় কারণ সে তা খায়নি, অর্থাৎ সে পালন করেছে ধনিকের ভূমিকা এবং নিজেকে করেছে সমৃদ্ধতর।

মূলধনের, ব্যক্তিত্বায়িতরূপ ছাড়া ইতিহাসে ধনিকের আর কোনো মূল্য নেই, ইতিহাসে স্থান পাবার কোনো অধিকার নেই; লিচনাওস্কির রসালো ভাষায় বলা যায়, যা কোনো স্থান তারিখ পায়নি। এবং ধনতান্ত্রিক উৎপাদন-পদ্ধতির জন্য অচিরস্থায়ী প্রয়োজন সাধনে যতটা চাই, ততটাই কেবল তার নিজের অচিরস্থায়ী অস্তিত্বের আবশ্যকতা। কিন্তু যখন সে ব্যক্তিত্বায়িত মূলধন তখন ব্যবহার-মূল্য ও তার বৃদ্ধি সাধনই তাকে কাজে প্রণাদিত করে। মূল্যের আত্ম-সম্প্রসারণ ঘটাবার উদ্দেশ্যে উন্মত্ত তৎপরতায়, সে মানবজাতিকে বেপরোয়া ভাবে বাধ্য করে উৎপাদনের জন্যই উৎপাদন করতে; এই ভাবে সে সমাজের উৎপাদিকা শক্তিসমূহের বিকাশকে সবলে ত্বরান্বিত করে এবং সেই সমস্ত বাস্তব অবস্থার সৃষ্টি করে, একমাত্র যে-অবস্থাসমূহ পারে সমাজের একটি উন্নততর সাপের আসল ভিত্তি গড়ে তুলতে এমন এক উন্নততর সমাজ যেখানে প্রত্যেকটি ব্যক্তির পরিপূর্ণ ও অবাধ বিকাশই হবে অধিনিয়ন্তা নীতি। কেবল ব্যক্তি-রূপায়িত মূলধন হিসাবেই ধনিক শ্রদ্ধাভাজন। ধনিক হিসাবে সেও সম্পদের জন্যই কৃপণের যে-লালসা, তার শরিক। কিন্তু কৃপণের ক্ষেত্রে যা কেবল একটা নিছক খেয়াল, ধনিকের ক্ষেত্রে তাই হল সামাজিক যন্ত্রের ফলস্বরূপ, সে নিজে যে-যন্ত্রের একটি চক্ৰমাত্র। অধিকন্তু, ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বিকাশের ফলে একটি নির্দিষ্ট শিল্প-সংস্থায় মূলধনের পরিমাণকে নিরন্তর বাড়িয়ে যাবার প্রয়োজন হয় এবং প্রতিযোগিতা প্রত্যেকটি ধনিককে বাধ্য করে ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অন্তর্নিহিত নিয়মগুলিকে বহিঃস্থিত বাধ্যতামূলক নিয়ম হিসাবে অনুভব করত। তা তাকে বাধ্য করে তার মূলধনের নিরন্তর বিস্তার সাধন করতে যাতে তাকে সংরক্ষা করা যায়। কিন্তু বিস্তার সাধন করতে সে পারে না ক্রমবর্ধমান পরিমাণে সঞ্চয়নের মাধ্যমে ছাড়া।

সুতরাং যে-পর্যন্ত তার কাজ হচ্ছে কেবল মূলধনের কাজ—তার ব্যত্তি রূপে যে মূলধন চেতনা ও সংকল্পে সমম্বিত, সে-পর্যন্ত তার ব্যক্তিগত পরিভোগ হচ্ছে সঞ্চয়নের। উপরে সম্পাদিত লুণ্ঠনকার্য, ঠিক যেমন হিসাব-রক্ষার ক্ষেত্রে ‘ডবলএনট্রি’-র মাধ্যমে ধনিকের ব্যক্তিগত ব্যয়কে তার মূলধনের পালটা বাবদে ধার হিসাবে দেখানো হয়। সঞ্চয়ন করা মানে হচ্ছে সামাজিক সম্পদের দুনিয়াকে জয় করা, তার দ্বারা শোষিত জনসংখ্যার সমষ্টিকে বৃদ্ধি করা এবং এই ভাবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষত উভয় ভাবেই ধনিকের আধিপত্য বিস্তার করা।[২]

কিন্তু সেই আদি পাপ সর্বত্রই কাজ করে চলে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদন, সঞ্চয়ন, এবং সম্পদ যেমন বিকাশ প্রাপ্ত হয়, তেমন ধনিকও কেবল মূলধনের বিগ্রহ মাত্র হিসাবে থাকা থেকে বিরত হয়। তার নিজের অ্যাডামের জন্য তার থাকে একটা সহমর্মিতাবোধ এবং তার অর্জিত জ্ঞান তাকে ক্রমে ক্রমে সক্ষম করে ব্রহ্মচর্যার প্রকৃতিকে প্রাচীন-পন্থী কৃপণের নিছক কুসংস্কার হিসাবে উপহাস করতে। যেখানে চিরায়ত প্রকারের একজন ধনিক ব্যক্তিগত পরিভোগকে চিহ্নিত করে তার কর্তব্য কর্মের বিরুদ্ধে একটি পাপাচার বলে এবং সঞ্চয়ন থেকে “সংবরণ” বলে, সেখানে একজন আধুনিকীভূত ধনিক সঞ্চয়নকে দেখতে সফল হয় সম্ভোগ থেকে সংবরণ হিসাবে।

“দুটি আত্মা, হায় তার বক্ষমাঝে রহে
এক থেকে অন্য রহে সুচির বিরহে।”

ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের ঐতিহাসিক উষাকালে,-এবং প্রত্যেক ধনিক ভুইফোড়কেই ব্যক্তিগতভাবে এই পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়—অর্থলালসা এবং ধনবান হবার কামনাই থাকে প্রধান আবেগ। কিন্তু ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতি কেবল এক আনন্দলোকই সৃষ্টি করেনা; ফটকাবাজি ও ক্রেডিট-ব্যবস্থার মাধ্যমে হঠাৎ বড়লোক হবার হাজার পথও খুলে দেয়। যখন বিকাশের একটি বিশেষ পর্যায়ে উপনীত হওয়া যায়, তখন অমিতব্যয়িতার একটা প্রথাগত মাত্রা—যা আবার ঐশ্বর্য প্রদর্শনের এবং প্রতিপত্তির সৃষ্টির, স্বাভাবিক প্রয়াসও বটে—হয়ে ওঠে “দুর্ভাগ্য” ধনিকের কাছে একটি ব্যবসায়িক প্রয়োজন। মূলধনের বিগ্রহটিতে বিলাসের প্রবেশ ঘটে। তা ছাড়া কৃপণের মত ব্যক্তিগত পরিশ্রম ও ভোগ-সংবরণের অনুপাতে ধনিক ধনবান হয় না, সে ধনবান হয় সেই হারে, যে-হারে সে অপরের শ্রমশক্তিকে নিঙড়ে নিতে এক শ্রমিকের উপরে জীবনের যাবতীয় উপভোগ থেকে বিরত থাকার বাধ্যতাকে চাপিয়ে দিতে পারে। সুতরাং, যদিও ধনিকের অমিতব্যয়িতা কখনো সামন্তপ্রভুর মুক্তহস্ত অমিল্কয়িতার প্রকৃত চরিত্র ধারণ করে না বরং তার পেছনে সবসময়েই উকি দেয় সবচেয়ে উৎকট অর্থ লালসা ও সবচেয়ে উৎকট হিসাব-নিকাশ, তবু তার ব্যয় সঞ্চয়নের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায়—একটির জন্য অন্যটি আবশ্যিক ভাবেই সংকুচিত হয় না, কিন্তু এই বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার বুকের মধ্যে গড়ে ওঠে ফাউস্ট-সুলভ একটি সংঘাত-একদিকে সামনের মাদকতা এবং অন্য দিকে ভোগ-বিলাসের লালসা।

১০১৫ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে ড আইকিন বলেন : “ম্যাঞ্চেস্টারের শিল্পকে চার পর্যায়ে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্যায়, যখন মিলমালিকদের তাদের জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। তারা তখন নিজেদের ধনী করত আপন-আপন বাবা মাকে লুণ্ঠন করে, যাদের অধীনে তাদের সন্তানেরা শিক্ষানবিশ হিসাবে বাঁধা থাকত; বাপ-মাকে দিতে হত উচু খেসারত যখন শিক্ষানবিশদের থাকতে হত অনাহারে। অন্য দিকে গড়পড়তা মুনাফা ছিল নিচু এবং সঞ্চন করার জন্য আবশ্যক হত চরম মিতব্যয়িতা। তারা থাকত কৃপণের মত এবং এমনকি তাদের মূলধন বাবদ প্রাপ্ত আটাও পরিভোগ কত না। দ্বিতীয় পর্যায়ে, যখন তারা কিছু কিছু ঐশষ অর্জন করতে সক্ষম হত কিন্তু তখন কাজ করত আগের মতই কঠোর ভাবে–কেননা, যে-কথা প্রত্যেক গোলাম-মালিক জানে, শ্রমের সরাসরি শোষণের জন্য শ্রম ব্যয় করতে হয়। এবং জীবন-যাপন করত আগের মতই সাদাসিধা ভাবে।” তৃতীয় পর্যায়, যখন শুরু হত ভোগ-বিলাস এবং রাজ্যের প্রত্যেকটি বাজারে ঘোড়-সওয়ার পাঠানো হত ‘অর্ডার সংগ্রহের জন্য যাতে ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নেওয়া যায়। এটা খুবই সম্ভব যে, শিল্প-মারফৎ অর্জিত ৩,০০০ থেকে £৪,০০০ মূলধন ১৬৯০ সালের আগে হয় একটাও ছিল না আর নয়তো খুব কমসংখ্যকই ছিল। কিন্তু সেই সময় থেকে কিংবা কিছু কাল পর থেকে শিল্প-ব্যবসায়ীরা আগে থেকেই টাকা পেতে থাকল এবং কাঠ ও পলেস্তারার পুরনো বাড়ির জায়গায় আধুনিক ইটের বাড়ি তৈরি করা শুরু করল।” এমনকি অষ্টাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের ম্যাঞ্চেস্টারের একজন মিল মালিককে তার অতিথিদের সামনে এক পাইন্ট বিদেশী মদ রাখার দরুন তার প্রতিবেশী দের টিপ্পনী ও মাথা-ঝাঁকুনির মুখে পড়তে হয়েছিল। মেশিনারির উদ্ভবের আগে পর্যন্ত কারখানামালিকেরা সন্ধ্যা বেলায় যেখানে মিলিত হত সেই সরাইখানায় তাদের এক একজনের ব্যয় এক গ্লাস পাঞ্চ’-এর জন্য ছয় পেন্স এবং এক স্কু, তামাকের জন্য এক। পেনির বেশি হত না। ১৭৫৮ সালে হল নোতুন যুগের সূচনা তার আগে পর্যন্ত সত্য সত্যই ব্যবসায়ে ব্যাপৃত এমন লোককে দেখা যেত তার নিজের তল্পিতল্পা নিয়ে যাতায়াত করতে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ৩০ বছর “চতুর্থ পর্যায় হল সেই পর্যায়, যখন ব্যয় ও বিলাসের বিরাট অগ্রগতি ঘটল, সেই পর্যায় যা পরিপোষিত হল সওয়ার ও দালালদের সাহায্যে ইউরোপের প্রত্যেকটি অংশে ব্যবসা-সম্প্রসারণের দ্বারা।”[৩] ডঃ আইকিন যদি তার কবর থেকে উঠে আজকের ম্যাঞ্চেস্টারকে দেখতে পেতেন, তাহলে তিনি কি বলতেন?

সঞ্চয় কর, সঞ্চয় কর ! এই হল মোজস এবং তার পয়গম্বরদের বাণী ! “শিল্প সরবরাহ করে সেই সামগ্রী, সংরক্ষণ যাকে পরিণত করে সঞ্চয়ে।”[৪] সুতরাং যতটা পার ততটা বাচাও অর্থাৎ উদ্বৃত্ত-মূল্যের তথা উত্ত-উৎপন্নের যতটা বেশি অংশ পার, ততটাকে আবার মূলধনে রূপান্তরিত কর। সঞ্চয়নের জন্যই সঞ্চয়ন, উৎপাদনের জন্যই উৎপাদন—এই সূত্রের মাধ্যমে চিরায়ত অর্থনীতি প্রকাশ করেছিল বুর্জোয়া শ্রেণীর ঐতিহাসিক ব্ৰত; এবং এক নিমেষের জন্যও সম্পদের জন্ম-যন্ত্রণা সম্পর্কে আত্ম-প্রতারণা করেনি।[৫] আর ঐতিহাসিক ভবিতব্যতার মুখে বিলাপের সার্থকতাই বা কি? চিরায়ত অর্থনীতির দৃষ্টিতে যখন সর্বহারা (প্রালেতারিয়ান) হল উদ্বৃত্ত-মূল্য উৎপাদনের একটি মেশিন মাত্র, তখন ধনিক হল এই উদ্যমূল্যকে অতিরিক্ত মূলধনে রূপান্তরণের জন্য একটি মেশিন। ধনিকের ঐতিহাসিক ভূমিকাকে অর্থনীতি গ্রহণ করে নিদারুণ ঐকান্তিক ভাবে। ভোগের লালসা এবং ঐশ্বর্যের তাড়না-এই দুয়ের মধ্যে যে ভয়াবহ সংঘাত তার বুকের গভীরে চলছে, তাকে যাদুবলে নিষ্ক্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ম্যালথাস ১৮২০ সালের নাগাদ একটি শ্রম-বিভাজনের সুপারিশ করেন, যে-বিভাজন অনুযায়ী উৎপাদনে বই ব্যাপৃত ধনিককে দেওয়া হল সঞ্চয় করার কাজ এবং উদ্বৃত্ত-মূল্যের বাকি সমস্ত অংশভাকদের-জমিদার, সরকারি কর্মচারী ও যাজকতা-বৃত্তিজীবীদের দেওয়া হল ব্যয় করার কাজ। তিনি বললেন, “ব্যয়ের জন্য আবেগ এবং সঞ্চয়ের জন্য আবেগ-এই দুটিকে পৃথক রাখার গুরুত্ব সামাজিক।[৬] দীর্ঘকাল ধরে ভাল থাকায় অভ্যস্ত এবং পার্থিব জগতের মানুষ হওয়ায় ধনিকেরা সজোরে চেঁচামেচি শুরু করে দিল। রিকার্ডোর এক শিষ্য তাদের এক মুখপাত্র চিৎকার করে উঠল, কী! ম্যালথাস সাহেব ওকালতি করছেন উচু খাজনা, ভারি ট্যাক্সো ইত্যাদির সপক্ষে যাতে করে সব সময়েই পরিশ্রমী ব্যক্তিদের তাড়া দিয়ে কাজ করার জন্য অনুৎপাদক পরিভাোদের হাতে অংকুশ রাখা। যায়! আওয়াজ উঠেছে : উৎপাদন, আরো উৎপাদন, নিরন্তর বর্ধমান আয়তনে উৎপাদন, কিন্তু এমন এক প্রক্রিয়ার দ্বারা উৎপাদন বর্ধিত হবে না, হবে খর্বিত। তা ছাড়া, কেবল অন্যদের খোঁচাবার জন্য এতগুলি লোককে আলস্যের মধ্যে রেখে তাদের পোষণ করাটাও খুব ন্যায়সঙ্গত ব্যাপার নয় বরং এদের চরিত্র থেকেই বোঝা যায় যে এদের দিয়ে যদি কাজ করানো হয়, তা হলে এরা সাফল্যের সঙ্গেই কাজ করতে পারে।”[৭] শিল্প-ধনিকের রুটি থেকে মাখন বাদ দিয়ে কাজের জন্য তাকে তাড়া দেওয়াটাকে তিনি অন্যায় বলে মনে করেন, অথচ “শ্রমিককে পরিশ্রমী রাখবার জন্য তিনি তার মজুরি ছাটাই করে ন্যূনতম অংকে কমিয়ে আনবার আবশ্যকতার কথা বলেন। তিনি এই ঘটনাটিও এক মুহূর্তের জন্য লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করেন না যে মজুরি-বঞ্চিত শ্রমের আত্মীকরণই হচ্ছে উদ্বৃত্ত-মূল্যের গুপ্তকথা। “শ্রমিকদের বর্ধিত চাহিদার মানে তাদের নিজেদের জন্য তাদের নিজেদের উৎপন্ন-দ্রব্যের একটা ক্ষুদ্রতর অংশ গ্রহণের এবং তার বৃহত্তর অংশটা তাদের নিয়োগকর্তাদের জন্য প্রদানের ইচ্ছা ছাড়া আর বেশি কিছু নয়; এবং বলা যায়, এই পরিভোগ কমানোর ফলেই দেখা দেয় চাহিদার অতিরিক্ত সরবরাহের প্রাচুর্য”; (শ্রমিকদের পক্ষে ) “আমি কেবল এই উত্তরই দিতে পারি যে এই অতিরিক্ত সরবরাহ বিপুল মুনাফারই সমার্থক।”[৮]

শ্রমিকদের কাছ থেকে কেড়ে আনা এই লুঠের মাল কি ভাবে সঞ্চয়নের স্বার্থে ধনিক এক ধনী অলস ব্যক্তিদের মধ্যে ভাগ করা যেতে পারে, এই নিয়ে বিদগ্ধ বিতর্কটি জুলাই বিপ্লবের মুখে চাপা পড়ে গেল। অল্পকাল পরেই লিয়ন্স-এর শহুরে সর্বহারারা বিপ্লবের ঘণ্টা ধ্বনিত করল এবং ইংল্যাণ্ডের গ্রামীণ সর্বহারারা গোলাবাড়ির আঙিনায় ও ফসলের গাদায় আগুন লাগাতে শুরু করল। চ্যানেলের এপারে ওয়েনবাদ এবং ওপারে সেন্ট সাইমন-বাদ ও ফুরিয়ার-বাদ ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সময় এল হাতুড়ে অর্থনীতির। মুনাফা (সুদ সমেত) হল বারো ঘণ্টার মধ্যে সর্বশেষ ঘণ্টার উৎপন্ন দ্রব্য—এই আবিষ্কারের ঠিক এক বছর আগে ম্যাঞ্চেস্টারে নাসাউ ডবলু সিনিয়র বিশ্বের কাছে ঘোষণা করেছিলেন তার আর একটা আবিস্ক্রিয়া। তিনি গর্বভরে বলেছিলেন, “উৎপাদনের উপকরণ হিসাবে মূলধন কথাটির পরিবর্তে আমি ব্যবহার করি ভোগ সংবরণ কথাটি।”[৯] হাতুড়ে অর্থনীতির আবিষ্কারগুলির মধ্যে এটি একটি অতুলনীয় নমুনা! একটি অর্থ নৈতিক অভিধার পরিবর্তে তিনি ব্যবহার করেন একটি স্তাবকতাপূর্ণ কথা—voila tout। সিনিয়র বলেন, “যখন কোন বন্য মানুষ ধনুক তৈরি করে, তখন সে একটি শ্রমশিল্প অনুশীলন করে, কিন্তু সে ভোগ-সংবরণ অভ্যাস করে না।” এ থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কিভাবে এবং কেন সমাজের প্রারম্ভিক পর্যায়গুলিতে ধনিকের ভোগ-সংবরণ ব্যতিরেকেই শ্রমের হাতিয়ারগুলি তৈরি হয়েছিল। “সমাজ যত অগ্রসর হয়, ততই বেশি বেশি করে ভোগ-সংবরণের প্রয়োজন দেখা দেয়”[১০]-ভোগ-সংবরণ তাদের জন্য যারা অন্যের শ্রম-ফল আত্মসাৎ করার শিল্প-প্রণালী পরিচালনা করে। শ্ৰম-প্রক্রিয়া সম্পাদন করার সমস্ত অবস্থাগুলি আকস্মিক রূপান্তরিত হয় ধনিকের ভোগ সংবরণের কতকগুলি কার্যে। শস্য যদি সবটা খেয়ে ফেলা না হয়, যদি তার একটা অংশ বোনা হয়, তা হলে সেটা হবে ভোগ-সংবরণ-ধনিকের পক্ষে।[১১] যদি মদ পেকে ওঠার জন্য সময় পায়, তা হলে সেটাও হবে ভোগ-সংবরণ-ধনিকের পক্ষে। ধনিক নিজেকেই লুণ্ঠন করে যখনি সে “উৎপাদনের হাতিয়ারগুলি শ্রমিককে ধার দেয় (!)” অর্থাৎ সেগুলিকে না খেয়ে ফেলে-মি-ইঞ্জিন, তুলল, রেলওয়ে, সার, ঘোড়া ইত্যাদি সব কিছুকে না খেয়ে ফেলে, অথবা, যেমন হাতুড়ে অর্থনীতিকেরা বালখিল্য-সুলভ ভঙ্গিতে বলে থাকেন “সেগুলির মূল্যকে ভোগ-বিলাসে অপচয় না করে, যখনি সেগুলির সঙ্গে শ্রমশক্তি সংযুক্ত করে, সে ঐ শ্রমশক্তি থেকে উদ্বৃত্ত-মূল্য নিষ্কাশন করার জন্য সেগুলিকে ব্যবহার করে।”[১২] শ্রেণী হিসাবে নিকেরা কিভাবে সেই কৃতিত্বটা অর্জন করবে সেটা এমন একটা গুপ্তকথা যে হাতুড়ে অর্থনীতি প্রকাশ করতে আজও পর্যন্ত একগুয়ে ভাবে অস্বীকার করে আসছে। একমাত্র বিষ্ণুর এই আধুনিক অনুতাপী উপাসকের, তথা ধনিকের, আত্মনিগ্রহের কল্যাণেই যে এই জগৎটি এখনো কোন রকমে চলছে, সেটাই যথেষ্ট। কেবল সঞ্চয়নই নয়, এমনকি সাদাসিধা “মূলধন সংরক্ষণের ব্যাপারটিতেও আবশ্যক হয় সেই মূলধন পরিভোগ করার প্রলোভনের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রতিরোধ।”[১৩] অতএব মানবতার সহজ-সরল অনুশাসনগুলি পরিষ্কার ভাবে নির্দেশ করে এই শহীদত্ববরণ ও প্রলোভন থেকে ধনিকের মুক্তি—ঠিক যেমন সম্প্রতি ক্রীত দাসত্বের অবসানের দ্বারা জর্জিয়ার দাস-মালিক এই যন্ত্রণাকর বিকল্প থেকে মুক্তি পেয়েছে। নিগ্রোদের চাবুক মেরে যে উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী পাওয়া গিয়েছে তার সবটাই কি শ্যাম্পেনে উড়িয়ে দেওয়া হবে না কি, তার একটা অংশ আরো নিগ্রো ও আরো জমিতে পুনঃ রূপান্তরিত করা হবে।

সমাজের সবচেয়ে বিভিন্ন ধরনের অর্থ নৈতিক রূপসমূহে কেবল সরল পুনরুৎপাদনই ঘটেনা, সেই সঙ্গে, বিভিন্ন মাত্রায়, ক্রমবর্ধমান হারে পুনরুৎপাদনও ঘটে। ধাপে ধাপে আরো বেশি উৎপন্ন হয়, আরো বেশি পরিভুক্ত হয়, এবং স্বভাবতই আরো বেশি উৎপন্ন সামগ্রী উৎপাদনের উপায়-উপকরণে রূপান্তরিত করতে হয়। অবশ্য, এই প্রক্রিয়াটি নিজেকে মূলধনের একটি সঞ্চয়ন কিংবা ধনিকের একটি কর্মানুষ্ঠান হিসাবে উপস্থিত করেনা—যে-পর্যন্ত না শ্রমিকের উৎপাদনের উপায়-উপকরণ এবং সেই সঙ্গে তার উৎপন্ন সামগ্রী ও জীবনধারণের উপকরণসমূহ মূলধনের আকারে তার মুখোমুখি না হয়।[১৪] রিচার্ড জোন্স, কয়েক বছর আগে যার মৃত্যু হয়েছে এবং যিনি ম্যালথাসের পরে হেইলিবেরি কলেজে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের চেয়ারে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তিনি দুটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের আলোয় এই বিষয়টি ভাল ভাবে আলোচনা করেছিলেন। যেহেতু হিন্দু জন সংখ্যার বিরাট সমষ্টি ছিল কৃষক, যারা নিজেদের জমি নিজেরাই চাষ করত, সেই হেতু তাদের উৎপন্ন দ্রব্য, তাদের শ্রম-উপকরণ ও জীবনধারণের সামগ্রী কখনো এমন একটি ভাণ্ডারের আকার ধারণ করে না, যে ভাণ্ডারটি আয় থেকে বাঁচিয়ে করা হয়েছে, যে ভাণ্ডারটি সেই কারণে অতিক্রান্ত হয়েছে পূর্বতন সঞ্চয়নের একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।”[১৫] অপর পক্ষে, যেসব প্রদেশে প্রাচীন প্রণালীকে খুব সামান্যই ক্ষুন্ন করেছে, সেই প্রদেশগুলিতে অ-কৃষক শ্রমিকেরা কর্মে-নিযুক্ত হয় সেই সব প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিদের দ্বারা, যারা কৃষিগত উদ্বৃত্ত-উৎপন্নের একটা অংশ কর বা খাজনার আকারে প্রাপ্ত হয়। এই উৎপন্নের একটি অংশ ঐ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিরা জিনিসের আকারে পরিভোগ করে এবং আরেকটা অংশ ঐ ব্যক্তিদেরই ব্যবহারের জন্য শ্রমিকদের দ্বারা বিলাস সামগ্রীও অনুরূপ অন্যান্য সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়; বাকিটা যায় শ্রমিকদের হাতে মজুরি হিসাবে—যে শ্রমিকেরা নিজেরাই নিজেদের শ্রম-উপকণ সমূহের মালিক। এখানে সেই জাল সন্ন্যাসী, সেই বিষন্ন চেহারার নাইট’, সেই ধনিক “ভোগ সংবরণকারী”-র হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকেই ক্রমবর্ধমান আয়তনে উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন তাদের নিজেদের পথে চলতে থাকে।

————

১. পাঠক লক্ষ্য করবেন প্রত্যাগম (রেভিনিউ ) কথাটি দুটি অর্থে ব্যবহৃত হয়। প্রথমত, মূলধন কর্তৃক সময়ক্রমিক ভাবে প্রদত্ত উদ্বৃত্তমূল্যকে অভিহিত করতে এবং দ্বিতীয়তঃ ধনিক কর্তৃক সময়ক্রমিক ভাবে পরিভুক্ত ফলের অংশটিকে কিংবা তার ব্যক্তিগত পরিভোগ ভাণ্ডারে সংযোজিত অংশটিকে অভিহিত করতে। আমি এই দুটি অর্থই বজায় রেখেছি কারণ এটা ইংরেজ ও ফরাসী অর্থনীতিবিদদের ভাষার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে।

২. তার রচনায় কুসীদজীবীকে ধনিকের সেই পুরনো ধাঁচের কিন্তু চির-নোতুন ছাঁচের নমুনা হিসাবে ধরে নিয়ে, লুথার খুব সঠিক ভাবেই দেখিয়েছেন যে ধনবান হবার অন্যতম উপাদান হচ্ছে ক্ষমতালিপ্সা। ‘হিদেনরা যুক্তির আলোয় এই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন যে, কুসীদজীবী হল দো-রঙা চোর এবং খুনী। আমরা খ্রীস্টানরা কিন্তু তাদের এমন সম্মানের চোখে দেখি, যে আমরা তার টাকার জন্য প্রায় তাকে পূজা করি। অপরের খাদ্য খেয়ে ফেলে, লুটে নেয় এবং চুরি করে তা সে যে-ই করুক না কেন, সেই একটা মস্ত বড় খুনী, (যেমন খুনী সেই লোকটা) কাউকে উপোস করিয়ে রাখে বা ষোল আনা শেষ করে দেয়। একজন কুসীদজীবী তাই করে, অথচ সে তার আসনটিতে নিরাপদে বসে থাকে, যখন তার বোলা উচিত ছিল ফাঁসীর দড়িতে এবং যত সংখ্যক গিভার (টাকা) সে চুরি করেছে তত সংখ্যক দাঁড়কাকের ভোজ্যে পরিণত হওয়া উচিত ছিল, যদি অবশ্য তার দেহে ততটা মাংস থাকে যা অত সংখ্যক কাক ঠুকরে ঠুকরে খেতে পারে। ইতিমধ্যে আমরা ক্ষুদে চোরগুলিকে ফাসিতে লটকে দেই। ক্ষুদে চোরদের বেড়ি পরানো হয় আর বড় চোরগুলো সোনা ও রেশমে সেজেগুজে আস্ফালন করে বেড়ায়। সুতরাং, এই পৃথিবীতে (শয়তানের পরে) টাকা লুঠেরা ও কুসীদজীবী ছাড়া মানুষের এত বড় শত্রু আর কেউ নেই, কেননা সে হতে চায় সকল মানুষের উপরে ঈশ্বর। তুর্কী, সৈন্য ও স্বৈরাচারীরাও বলোক, কিন্তু তারা অন্য মানুষকে বাঁচতে দেয় এবং স্বীকার করে যে তার বদ লোক এবং শক্ত; এমনকি তারা কখনোসখনন কারো কারো প্রতি করুণাও করে। কিন্তু একটা কুসীদখোর, একটা মুদ্রারাক্ষস এমন একটা জীব যে, সে নিজে যাতে সব কিছু করায়ত্ত করতে পারে এবং সে যাতে সকলের ঈশ্বর এবং সকলে তার ক্রীতদাস হতে পারে, তার জন্য গোটা দুনিয়াকে ক্ষুধায় তৃষ্ণায় দুর্দশায় ও অভাবে ধ্বংস করে দেবে। চমৎকার চমৎকার আলখাল্লা, সোনার হার ও আংটি পরা, মুখ মোছ, যোগ্য ও ধার্মিক লোক হিসাবে গণ্য ও মান্য হওয়া। কুসীদবৃত্তি হল একটা বিকট বিশাল দানব একটা মানুষ-নেকড়ে, যে সব কিছুকে শ্মশানে পরিণত করবার ব্যাপারে যে-কোনো ক্যাকাস, গেরিয়ন বা অ্যান্টাসকে হারিয়ে দেবে। এবং তবু সে ভান করে থাকে এবং তাকে মনে করা হয় ধার্মিক বলে, যাতে করে লোকেরা না বুঝতে পারে যে-গরুগুলোকে সে চুরি করে তার খোঁয়াড়ে রেখেছে, সেগুলো কোথায় গেল। কিন্তু হার্কিউলিস শুনতে পাবেন সেই গোৰুগুলির এবং তার বন্দীদের চীৎকার এবং ক্যাকাসকে খুঁজে বার করবে পাহাড়ের চুড়া আর গুহা থেকে এবং দুবৃত্তের কবল থেকে আবার গোৰুগুলিকে মুক্ত করে দেবেন। ক্যাকাস মানে দুবৃত্ত অর্থাৎ একজন ধার্মিক কুসীদ-খোর, যে সব কিছু চুরি করে, লুঠ কত্রে, খেয়ে ফেলে। এবং কখনো স্বীকার করবে না যে সে এসব করেছে এবং মনে করে যে কেউ অকেৱতে পারবে না, কেননা যে গোরুগুলিকে সে তার হায় টেনে নিয়ে গিয়েছে সেগুলির পায়ের দাগ দেখলে ধারণা হবে যেন সেগুলিকে এদিও-ওদিক ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এইভাবে কুলীদখোর জগৎকে প্রতারণা করবে যে সে কত উপকারী সে গরুগুলি জগতকে দান করেছে। আসলে কিন্তু সে একি সেগুলিকে কাটে এবং খায়। এবং যেহেতু আমরা রাহাজানদের খুনীদের ও বাড়ি লুঠেরাদের তাড়া করি, মুণ্ডুচ্ছেদ করি, সেহেতু সমস্ত কুলীদখোরদের আমাদের কত বেশি তাড়া করা, হত্যা করা শিকার করা, অভিসম্পাত করা ও মুণ্ডুচ্ছেদ করা কর্তব্য। (মার্টিন লুথার, An die pfarrherm Wider den Wucher zu predigen’ Wittemberg, 1540 )

৩. ডাঃ আইকিন, ডেসক্রিপশন অব দি কাউন্টি ফ্রম ৩০ টু ৪০ মাইলস রাউণ্ড ম্যাঞ্চেস্টার’, ল, ১৭৯৫, পৃঃ ১৮২।

৪. অ্যাডাম স্মিথ, ঐ, খণ্ড ৩, অধ্যায় ৩।

৫. এমনকি জে. বি. সে পর্যন্ত বলেন, ‘Les epargnes des riches se font aux depens des pauvres’, ‘নোমান প্রালেতারিয়ান বেঁচে থাকত প্রায় সম্পূর্ণ ভাবেই সমাজের খরচে। এখন এটা প্রায় বলা যায় যে, আধুনিক সমাজ বেঁচে থাকে প্রালেরিয়ানদের খরচে, শ্রমের পারিশ্রমিকের বাইরে সে যা রাখে, তার উপরে। ( সিম দি: Etudes ইত্যাদি’, t. i পৃঃ ২৪)।

৬. ম্যালথাস : প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি’, পৃঃ ৩১৯, ৩২০।

৭. ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দোজ প্রিন্সিপলস রেস্পেকটিং দি নেচর অব ডিমাণ্ড, পৃ: ৬৭।

৮. ঐ, পৃঃ ৫৯।

৯. (সিনিয়র, Principes fondamentaux de Econ. Pol, trad. Arrivabene. Paris, 1836, P. 308 )। পুরানো চিরায়ত মতবাদীদের পক্ষে এটা হয়ে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত বেশি। “মিঃ সিনিয়র এই কথাটির (শ্রম ও মুনাফার’ ) পরিবর্তে বসিয়েছেন শ্রম ও সংবরণ’ কথাটি। যে তার আয়কে রূপান্তরিত করে, সে তার ব্যয় থেকৈ যে ভোগ করতে পারত, তা থেকে নিজেকে সংবরণ করে। মূলধন নয়, মূলধনের ব্যবহারই হচ্ছে মুনাফার হেতু। (জন ক্যাজেনোভ, ঐ, পৃঃ ১৩০ টীকা)। বিপরীত ভবে জন স্টুয়ার্ট মিল এক দিকে রিকার্ডোর মুনাফার তত্ত্বটি গ্রহণ করেন। এবং অন্য দিকে সিনিয়র-এর ‘সংবরণের পারিশ্রমিক’-টিও অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তিনি অসম্ভব সব দ্বন্দ্বের মধ্যে যেমন আরামে থাকেন, তেমনি আবার সমস্ত দ্বন্দ্বতত্ত্বের (ডায়ালেকটিক’-এর) উৎস যে হেগেলীয় দ্বন্দ্ব, তা নিয়ে খুব বিপদে পড়েন। এই সরল চিন্তাটা এই হাতুড়ে অর্থত্বিকের কখনো মনে এল না যে, মানুষের প্রত্যেকটি কাজকেই দেখা যেতে পারে তার বিপরীতটা থেকে সংবরণ’ বলে। খাওয়া মানে উপোস করা থেকে সংবরণ, হাঁটা মানে এক ঠায় দাঁড়ানট থেকে সংবরণ, কাজ করা মানে আলসেমি থেকে সংবরণ ইত্যাদি ইত্যাদি। এই ভদ্রলোকেরা যদি একবার স্পিনোজার ‘ডিটারমিনাশিও এস্ট, নেগাশিও’-র উপরে কিছুটা ধ্যান দিতেন তত ভাল করতেন।

১০. সিনিয়র, ঐ, পৃঃ ৩৪২।

১১. “যেমন, কেউই এগুলিকে পরিভোগ না করে তার গম বুনতে এবং তাকে বাবোমাস জমিতে পড়ে থাকতে দেবে না কিংবা বছর বছর ধরে তার মদ ভূগর্ভস্থ ভাণ্ডারে ধরে রেখে দেবে না যদি না সে অতিরিক্ত মূল্য আশা করে।” (স্কোপ, “পলিটিক্যাল ইকনমি”, edit. by A. Potter, নিউ ইয়র্ক, ১৮৪১, পৃঃ ১৩৩-৩৪)।

১২. “La privation que s’impose le capitaliste, en pretant ( 79cy অর্থনীতির স্বীকৃত রীতি অনুযায়ী এই বাক্যালংকারটি ব্যবহার করা হয় শোষিত শ্রমিককে শোষণকারী ধনিকের সঙ্গে, যাকে আবার অন্যান্য ধনিকেরা টাকা ধার দেয়, তরে সঙ্গে, এক করে দেখাবার উদ্দেশ্যে ) ses instruments de production au travailleur, au lieu d’en consecrer la valcur a son propre usage, en la transforment en objets d’utilite ou d’agrement” ( G. de Molinari, ঐ p. 36 )।

১৩. “La eonservation d’un capital exige…un effort constant pour resister a la tentation de la consommer” (Courcelle-Seneuil. d. p. 57)

১৪. আয়ের সেই বিশেষ বিশেষ শ্রেণীগুলি, যারা জাতীয় মূলধনের অগ্রগতিতে সর্বাপেক্ষা প্ৰচর ভাবে অবদান যোগায়, তারা তাদের অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ে পরিবর্তিত হয় এবং সেই কারণে সেই অগ্রগতির বিভিন্ন অবস্থানে অবস্থিত জাতিসমূহে তারা বিভিন্ন। মুনাফা সমাজের গোড়াকার পর্যায়গুলিতে, মজুরি ও খাজনার তুলনায়, সঞ্চয়নের গুরুত্বহীন উৎস।”যখন জাতীয় শিল্পক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্যসত্যই ঘটেছে, তখন মুনাফা-সঞ্চয়নের উৎস হিসাবে তুলনামূলক ভাবে অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করে।” (রিচার্ড জোন্স, “Text Book ইত্যাদি” পৃ: ১৬, ২১)।

১৫. ঐ, পৃঃ ৩৬।

.

চতুর্থ পরিচ্ছেদ মূলধনে ও আয়ে আনুপাতিক বিভাজন থেকে স্বতন্ত্রভাবে সঞ্চয়নের পরিমাণ নির্ধারণকারী ঘটনাসমূহ। এমশক্তি শোষণের মাত্রা। বিনিযুক্ত মূলধন ও পরিভুক্ত মূলধনের মধ্যে ববিষ্ণু ব্যবধান। অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের আয়তন।

যে-অনুপাতে উদ্বৃত্ত-মূল্য মূলধনে ও আয়ে বিভক্ত হয়, সেই অনুপাতটি নির্দিষ্ট থাকলে, সঞ্চয়ীকৃত মূলধনের আয়তন স্পষ্টতই নির্ভর করে উদ্বৃত্ত-মূল্যের অপেক্ষিক আয়তনের উপরে। ধরা যাক, শতকরা ৮০ ভাগ মূলধনীকৃত হয়েছিল এবং শতকরা ২. ভাগ খেয়ে ফেলা হয়েছিল, তা হলে মোট উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ ৩,০০০ পাউণ্ড হয়েছে, না ১,২০০ পাউণ্ড হয়েছে, তদনুযায়ী সঞ্চয়ীকৃত মূলধন হবে ২,৪০০ পাউণ্ড বা ১,২০০ পাউণ্ড। সুতরাং, যে-সমস্ত ব্যাপার উদ্বৃত্ত-মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ করে, সেই সমস্ত ব্যাপারগুলিই কাজ করে সঞ্চয়নের আয়তন নির্ধারণে। আমরা সেগুলিকে আবার সংক্ষেপে বিবৃত করছি—কিন্তু কেবল যেখানে যেখানে সেগুলি সঞ্চয়ন প্রসঙ্গে নোতুন বক্তব্য প্রকাশ করে।

স্মরণীয় যে, উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার নির্ভর করে, প্রথমত, শ্রম-শক্তিকে কতটা শোষণ করা হয় তার মাত্রার উপরে। রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্ব এই ঘটনাটিকে এত বেশি মূল্য দেয় যে, তা মাঝে মাঝে শ্রমের বর্ধিত উৎপাদনশীলতাজনিত সঞ্চয়নবৃদ্ধিকে শ্রমিকের উপরে বর্ণিত শোষণ-জনিত সখন-বৃদ্ধির সঙ্গে অভিন্ন বলে গণ্য করে।[১] উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন-সংক্রান্ত অধ্যায়গুলিতে সব সময়েই ধরে নেওয়া হয়েছিল যে মজুরি অন্ততঃ পক্ষে শ্রমশক্তির মূল্যের সমান। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই মূল্য থেকে মজুরির জোর করে হ্রাস করার ঘটনা এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে যে, সেই সম্পর্কে একটু আলোচনা করা দরকার। বস্তুত, তা শ্রমিকের আবশ্যিক পরিভোগ-ভাণ্ডারকে, কয়েকটি মাত্রার মধ্যে, রূপান্তরিত করে মূলধনের সঞ্চয়ন-ভাণ্ডারে।

জন স্টুয়ার্ট মিল বলেন, “মজুরির কোনো উৎপাদন ক্ষমতা নেই; মজুরি হল একটি উৎপাদন ক্ষমতার দাম। পণ্যোৎপাদনের ক্ষেত্রে খোদ হাতিয়ারগুলির সঙ্গে হাতিয়ারগুলির দামের যে অবদান, শ্রমের সঙ্গে মজুরির অবদান তার চেয়ে বেশি নয়। যদি ক্রয় না করেই শ্রম পাওয়া যেত, তা হলে মজুরিকে বাদ দেওয়া যেত।[২] কিন্তু শ্রমিকেরা যদি বাতাস খেয়ে বাঁচতে পারত, তা হলে তো কোনো দাম দিয়েই তাদের কেনা যেত না। সুতরাং, তাদের জন্য ‘শূন্য-ব্যয়, গাণিতিক অর্থে, এমন একটি মাত্রা, যা কখনো পৌছানো যায় না, যদিও আমরা সব সময়েই বেশি বেশি করে তার কাছাকাছি যেতে পারি। মূলধনের নিরন্তর প্রবণতাই হল শ্রমের বাবদে এই ব্যয়কে সবলে এই শূন্যের দিকে ঠেলে নেওয়া। আঠারো শতকের একজন লেখক, যাকে আগেও কয়েকবার উদ্ধৃত করেছি, শিল্প ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে প্রবন্ধ’-নামক গ্রন্থের রচয়িতা যখন বলেন যে, ইংল্যাণ্ডের ঐতিহাসিক ব্ৰতই হল ইংরেজ মজুরিকে ফরাসী ও ওলন্দাজ মজুরির মানে দাবিয়ে আনা, তখন তিনি কেবল ইংরেজ ধনতন্ত্রের গোপন আত্মাটিকেই প্রকাশ করে ফেলেন।[৩] অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে তিনি সরল মনে বলেন, “কিন্তু যদি আমাদের গরিবেরা” (শ্রমিকদের বোঝাবার জন্য পরিভাষা) “বিলাসে জীবন যাপন করতে চায় তাহলে, শ্রমকে অবশ্যই হতে হবে মহার্ঘ যখন বিবেচনা করা যায় কি কি বিলাস-দ্রব্য এই উংপাদনকারী জনসাধারণ পরিভোগ করে, যেমন, ব্রাণ্ডি, জিন, চা, চিনি, বিদেশী ফল, জোরালো বিয়ার, ছাপানো ছিট-কাপড়, নস্য, তামাক ইত্যাদি।”[৪] নর্দাম্পটনের এক মিল-মালিকের বই থেকে তিনি একটি উরূতি দিয়েছেন; আকাশের দিকে টেরা চোখে তাকিয়ে এই মিল মালিকটি দীর্ঘনিঃশাস ফেলে দুঃখ করেন, “ইংল্যাণ্ডের তুলনায় ফ্রান্সের মজুরি তিন ভাগের এক ভাগ সন্তা, কারণ সেখানকার গরিবেরা খাটে খুব বেশি কিন্তু খাওয়া-পরা বাবদে পায় খুব কম। তাদের প্রধান খাদ্য হল রুটি, ফুল, লতা-ডাটা ও শিকড়-বাকড় ও শুটকি মাছ; কারণ তার মাংস খায় কদাচিৎ এবং গমের দাম বেড়ে গেলে রুটি খায় খুবই সামান্য।”[৫] আমাদের প্রবন্ধকার আরো বলেন, “এই সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় যে, তারা পান করে শুধু জল বা স মদ, সুতরাং তাদের খরচ পড়ে নামমাত্র পয়সা। এখানে এই অবস্থা তৈরি করা খুবই কঠিন তবে অসম্ভব নয়, কেননা ফ্রান্স ও হল্যাণ্ডে, উভয় জায়গাতেই তা করা হয়েছে।[৬] কুড়ি বছর পরে এক মার্কিন হামবড়া, ব্যাবণ-পদে নিযুক্ত ইয়াংকি, বেঞ্জামিন টমসন ( ওরফে কাউন্ট রামফোর্ড ) একই মহানুভবতার পথ অনুসরণ করে ঈশ্বর ও মানুষের মনোরঞ্জন করেছিলেন। তার প্রবন্ধাবলী” হচ্ছে একটি রান্নার বই, যাতে দেওয়া হয়েছে শ্রমিকের প্রিয় দৈনন্দিন খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্ত হিসাবে ব্যবহার্য হরেক রকম বিকল্প ভোজ্য-সামগ্রীর বন্ধন-প্রণালী। এই বিস্ময়কর দার্শনিকের বিশেষভাবে সার্থক একটি ব্যবস্থাপত্র নিম্নরূপ : ৫ পাউণ্ড যবের গুড়ো, ৭.৫ পেন্স; ৫ রাউণ্ড ভারতীয় শস্য ৬.২৫ পেনি; ৩ পেনি পরিমাণ লাল হেরিং-শুটকি, ১ পেনি মুন, ১ পেনি ভিনিগার, ২ পেনি গোলমরিচ ও মিষ্টি লতা-ডাটা—সব মিলিয়ে মোট ৪.৭৫ পেনি দিয়ে প্রস্তুত করা যায় ৩৪ জন লোকের জন্য স্যুপ’; এবং যব ও ভাতৃতীয় শস্যের মাঝারি দাম ধরে নিলে এই স্যুপ’ মোগানো যায় ১/৪ পেনি দামে, প্রতি ২০ আউন্সের জন্য।”[৭] ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যের ভেজাল বেড়ে যাবার ফলে টমসনের এই আদর্শ ব্যবস্থাপত্রটি বাহুল্যে পরিণত হল।[৮] ১৮ শতকের শেষে এবং ১৯ শতকের শুরুর দশ বছরে, ইংল্যাণ্ডের খাবার-মালিক ও জমিদারেরা সজোরে চালু করে দিল ষৎপয়োনাস্তি ন্যূনতম মজুরি; তারা কৃষি-শ্রমিককে দিতে লাগল মজুরির আকারে ন্যূনতমেরও কম এবং বাকিটা ধর্মীয় ত্ৰাণকার্যের আকারে। ইংরেজ ভাড়গুলো কেমন ভড়ামো করে তাদের মজুরি-হার নির্ধারণের “আইনগত কর্তব্য সাধন করত, তার একটা নমুনা: মিঃ বার্ক বলেন, নরফোক-এর ভূস্বামীরা তখন আহার করেছিলেন, যখন তারা মজুরির হার স্থির করেন, বার্কস-এর ভূস্বামীরা স্পষ্টতই মনে করেন, শ্রমিকদের এই রকম করা উচিত হয়নি, যখন তারা মজুরি-হার হির করেন স্পিনহামল্যাণ্ড-এ, ১৭৯৫। সেখানে তারা স্থির করেন যে একজন লোকের আয় (সাপ্তাহিক হওয়া উচিত ৩ শিলিং, যখন ৮ পাউণ্ড ১১ আউন্সের এক গ্যালন বা আধ-পেক রুটি বিক্রি হয় ১ শিলিংয়ে, এবং তা নিয়মিত বাড়া উচিত যে-পর্যন্ত না রুটির দাম হয় ১ শিলিং ৫ পেন্স; যখন তা এই অংকটাকে ছাড়িয়ে যায়, তখন তা নিয়মিত কমা উচিত যে-পর্যন্ত না তা হয় ২ শিলিং, এবং তখন তার খাদ্য হওয়া উচিত ১/৫ ভাগ কম।”[৯] ১৮১৪ সালে লর্ডসভার তদন্ত কমিটির সামনে এ. বেনেট নামে জনৈক বৃহৎ কৃষক, প্রশাসক, গরিব-আইন’-সংরক্ষক এবং মজুরি নিয়ামককে প্রশ্ন করা হয় : “দৈনিক শ্রমের মূল্যের কোনো অংশ কি গরিব-কর থেকে শ্রমিকদের পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে? উত্তর : হঁ্যা হয়েছে, প্রত্যেক পরিবারের সাপ্তাহিক আয় গ্যালন-রুটি (৮ পাউণ্ড ১১ আউন্স) এবং মাথাপিছু ৩ পেন্স করে পুষিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা মনে করি পরিবারের প্রত্যেকের জীবন ধারণের জন্য সপ্তাহে এক গ্যালন-রুটি এবং জামা-কাপড়ের জন্য ৩ পেন্সই যথেষ্ট; এবং পল্লী যাজনিক যদি জামা-কাপড়ের ব্যবস্থা করতে পারেন, তা হলে ঐ ৩ পেন্স কেটে রাখা হয়। উইল্টশায়ার-এর গোটা পশ্চিমাংশ জুড়ে, এবং আমার বিশ্বাস গোটা দেশ জুড়েই, এইটাই রীতি।[১০] ঐ সময়ের এক বুর্জোয়া গ্রন্থকার চিৎকার করে বলেন, “তারা (জোত-মালিকরা। তাদের স্বদেশবাসীদের একটি প্রদ্ধেয় অংশকে আতুরাশ্রমে আশ্রয় নিতে বাধ্য করে অধঃপাতিত করেছে। যখন সে নিজের লাভ বাড়িয়ে চলেছে, তখন সে শ্রমজীবী পোব যাতে কিছু না জমাতে পারে তার ব্যবস্থা করেছে।”[১১] উদ্বৃত্ত-মূল্য সৃজনে শ্রমিকের আবশ্যিক পরিভোগ-ভাণ্ডার থেকে সরাসরি লুণ্ঠন কি ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তা তথাকথিত ঘরোয়া শিল্পই খুলে ধরেছে (পঞ্চদশ অধ্যায়, অষ্টম পরিচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)। এই সম্পর্কে আরো তথ্য পরে দেওয়া হবে।

যদিও শিল্পের সমস্ত শাখাতেই শ্রমের উপকরণসমূহ দিয়ে গঠিত মূলধনের স্থির অংশটি একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিকের পক্ষে (কাজটির আয়তনের দ্বারা যা নির্ধারিত হবে), তা হলেও নিযুক্ত শ্রমের পরিমাণ-বৃদ্ধির সঙ্গে তা সব সময়ে আবশ্যিক ভাবে একই অনুপাতে বৃদ্ধি পায় না। ধরা যাক, একটি কারখানায় ১০০ জন শ্রমিক দৈনিক প্রত্যেকে ৮ ঘণ্টা করে কাজ করে ৮০০ ঘণ্টা কাজ দেয়। যদি ধনিক এই অংককে আরো অর্ধেক বাড়াতে চায়, সে আরো ৫০ জন কর্মীকে নিযুক্ত করতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে তাকে আরো মূলধন আগাম দিতে হবে কেবল মজুরি বাবদেই নয়, শ্রমের উপকরণ বাদেও। অবশ্য সে ঐ ১০০ শ্রমিককে ৮ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করেও কাজ করাতে পারে এবং তা করলে শ্রমের যে-উপকরণগুলি হাতে আছে তাতেই কাজ চলবে। এইগুলি কেবল তখন আরো দ্রুত বেগে পরিভুক্ত হবে। এই ভাবে মূলধনের স্থির অংশটিতে আনুষঙ্গিক বৃদ্ধি না ঘটিয়েও শ্রমশক্তির অধিকতর তৎপরতা-সঞ্জাত অতিরিক্ত শ্রম উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন ও উদ্বৃত্ত-মূল্যের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে ( যা হচ্ছে সঞ্চয়নের সামগ্রী)।

খনি ইত্যাদি নিষ্কর্ষণ-মূলক শিল্পগুলিতে কাচামাল অগ্রিম-প্রদত্ত মূলধনের কোনো অংশ গঠন করে না। এক্ষেত্রে শ্রমের বিষয় পূর্ববর্তী শ্রমের ফল নয়, প্রকৃতির কাছ থেকে তা পাওয়া গিয়েছে মুফতে—যেমন ধাতু, খনিজ, কয়লা, কয়লা পাথর ইত্যাদি। এই ক্ষেত্রগুলিতে স্থির মূলধন গঠিত হয় প্রায় একান্ত ভাবেই শ্রমের উপকরণ সমূহের দ্বারা যা খুব ভালভাবেই ব্যাপৃত করতে পারে বর্ধিত-পরিমাণ শ্রম ( শ্রমিকদের দিন ও রাত্রির শিফটই চালু করে উঃ’। বাকি সব কিছু সমান থাকলে, উৎপন্ন দ্রব্যের পরিমাণ ও মূল্য ব্যয়িত শ্রমের প্রত্যক্ষ অনুপাতে বৃদ্ধি পাবে। যেমন উৎপাদনের প্রথম দিনটিতে, আদি উৎপন্ন-কাৱকরা—মানুষ এবং প্রকৃতি—মূলধনের বস্তুগত উপাদানের স্রষ্টারূপে পরিণত হয়ে, এখনও কাজ করে একসঙ্গে। শ্রমশক্তির স্থিতিস্থাপকতার কল্যাণে, সঞ্চয়নের পরিধি স্থির মূলধনের কোনো পূর্ববর্তী বৃদ্ধিসাধন ছাড়াই, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে।

কৃষিকর্মে, কর্ষণভুক্ত জমির এলাকা বাড়ানো যায় না আরো বীজ ও সার আগাম না দিয়ে। কিন্তু একবার এই আগাম দিয়ে দিলে মৃত্তিকার নিজস্ব বিশুদ্ধ যান্ত্রিক প্রক্রিয়াই উৎপন্ন সামগ্রীর পরিমাণের উপর উৎপাদন করে আশ্চর্যজনক ফল। আগেকার মত একই সংখ্যক শ্রমিকের দ্বারা সম্পাদিত শ্রমের এক বৃত্তের পরিমাণ এই ভাবে, শ্রমের উপকরণে কোনো অগ্রিম ব্যতিরেকেই, উর্বরতার বৃদ্ধি সাধন করে। আরো একবার মানুষ ও প্রকৃতির প্রত্যক্ষ তৎপরতাই হয়ে ওঠে বিপুলতর সঞ্চয়নের অব্যবহিত উৎস–নোতুন মূলধনের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই।

সর্বশেষে, যাকে বলা হয় ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্প তাতে শ্রমের প্রত্যেকটি অতিরিক্ত ব্যয় ধরে নেয় তদনুযায়ী কাঁচামালের অতিরিক্ত ব্যয়, কিন্তু ধরে নেয় না। তদনুযায়ী শ্রম-উপকরণের আবশ্যিক অতিরিক্ত ব্যয়। এবং যেহেতু নিষ্কণমূলক শিল্প ও কৃষিকর্ম ম্যানুফ্যাকচারকারী শিল্পকে কাঁচামাল সরবরাহ করে, সেইহেতু অগ্রিম মূলধন ব্যতিরেকেই প্রথমোক্ত শিল্প ও কৃষিকার্য অতিরিক্ত উৎপন্ন সামগ্র সৃষ্টি করে, তাও দ্বিতীয়োক্ত শিল্পের অনুকূলে কাজ করে।

সাধারণ ফল : সম্পদের দুটি প্রাথমিক স্রষ্টাকেই, শ্রমশক্তি ও ভূমিকেই, নিজের সঙ্গে সংবদ্ধ করে মূলধন এমন এক সম্প্রসারণ-ক্ষমতা অর্জন করে, যা তাকে সক্ষম করে তার সঞ্চয়নের উপাদানগুলিকে বাহ্নত তার নিজেরই আয়তনের দ্বারা, কিংবা, ইতি পুর্বেই উৎপাদিত উৎপাদন উপায়সমূহের মূল্য ও পরিমাণের দ্বারা নির্দিষ্ট মাত্রার বাইরে প্রসারিত করতে-যে উৎপাদন-উপায়সমুহের মধ্যেই মূলধন ধারণ করে তার অস্তিত্ব।

সঞ্চয়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীলতা।

শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতার সঙ্গে বৃদ্ধি পায় উৎপন্ন-সামগ্রীর পরিমাণ, যার মধ্যে রূপ পরিগ্রহ করে একটি বিশেষ মূল্য তথা একটি নিদিষ্ট আয়তনের উদ্বৃত্ত-মূল্য। উদ্বৃত্ত-মূল্যের হার একই থাকলে, এমন কি কমে গেলেও, যতক্ষণ শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা যেগতিতে বাড়ে তার চেয়ে তা মন্থরতর ভাবে কমে, ততক্ষণ উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী বৃদ্ধি পায়। অতএব আয়ে ও এবং অতিরিক্ত মূলধনে এই উৎপন্ন-সামগ্রীর ভাগাভাগি একই থাকলে, সঞ্চয়নের ভাণ্ডারে কোনো হ্রাস ব্যতিরেকেই ধনিকের পরিভোগ বৃদ্ধি পেতে পারে। একদিকে যখন পণ্যদ্রব্যাদি সস্তা হয়ে যাবার দরুন ধনিক আগের মত সমান সংখ্যক এমন কি তার চেয়েও অধিক সংখ্যক, ভোগ্য সামগ্রী হাতে পায় অন্য দিকে, তখন পরিভোগ-ভাণ্ডারের বিনিময়ে সঞ্চয়ন ভাঙারের আপেক্ষিক আয়তন এমনকি বৃদ্ধিও পেতে পারে। কিন্তু যেমন আমরা দেখেছি শ্রমের ক্রমবর্ধমান উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমিক আরো আরো সস্তা হয় এবং সেই কারণে, উদ্ব মূল্যের হার বৃদ্ধি পায়, এমনকি যখন আসল মজুরি বাড়তে থাকে। আসল মজুরি কখনো শ্রমের উৎপাদনশীলতার সঙ্গে সমানুপাতে বাড়ে না। সুতরাং অস্থির মূলধনে একই মূল্য অধিকতর শ্রমশক্তিকে, অতএব শ্রমকে, গতিশীল করে। স্থির মূলধনে একই মূল্য অধিকতর উৎপাদন-উপায়ে অর্থাৎ অধিকতর শ্রম-উপকরণে শ্রম-বিষয়ে ও সহায়ক সামগ্রীতে রূপান্তরিত হয়; সুতরাং তা ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য উভয়েরই অধিকতর উপাদান সরবরাহ করে এবং সেই সঙ্গে আরো শ্রমকে কাজে লাগাবার সংস্থান করে। সুতরাং অতিরিক্ত মূলধনের মূল্য একই থাকলেও কিংবা এমনকি হ্রাস পেলেও পরিবর্তিত সঞ্চয়ন তখনো ঘটে। কেবল যে পুনরুৎপাদনের আয়তন বস্তুগত ভাবে বিস্তার লাভ করে তাই নয়, উদ্বৃত্ত-মূল্যের উৎপাদন অতিরিক্ত মূলধনের মূল্যের তুলনায় দ্রুততর গতিতে বৃদ্ধি পায়।

শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার বিকাশ উৎপাদন-প্রক্রিয়ায় বিনিযুক্ত প্রারম্ভিক মূলধনের উপরেও প্রতিক্রিয়া ঘটায়। কর্মরত স্থির মূলধনের একটা অংশ গঠিত হয় মেশিনারি ইত্যাদি শ্রম-উপকরণ দিয়ে যেগুলি পৰিভুক্ত হয়ে যায় না, এবং সেই কারণে পুনরুৎ পাদিত কিংবা একই রকমের নোতুন মেশিনারি দিয়ে প্রতিস্থাপিতও হয় না—দীর্ঘ কালের ব্যবধান ছাড়া। কিন্তু প্রত্যেক বছরই ঐসব শ্রম-উপকরণের একটি অংশ ক্ষয় পায় বা তার উৎপাদনী কর্মক্ষমতার সীমায় পৌছে যায়। সুতরাং সেই বছরে তা উপনীত হয় তার কালক্রমিক পুনরুৎপাদনের, একই রকমের নতুন মেশিনারি দিয়ে প্রতিস্থাপনের, নির্দিষ্ট সময়ে। এই সব শ্রম-উপকরণ ক্ষয়প্রাপ্ত হবার কালে, যদি শ্রমের উৎপাদনশীলতা বেড়ে গিয়ে থাকে ( এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অবিরত অগ্রগতির সঙ্গে তা ক্রমাগত বেড়ে যায়, তা হলে আরো নিপুণ এবং সেগুলির বর্ধিত নৈপুণ্যের বিচারে) আরো সন্তা মেশিন, টুল, অ্যাপারেটাস ইত্যাদি পুরানোগুলির বদলে স্থান গ্রহণ করে। আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে এমন সব শ্রম-উপকরণে নিরন্তর প্রত্যংশ উন্নয়ন ছাড়াও পুরানো মূলধন আরো উৎপাদনশীল রূপে পুনরুৎপাদিত হয়। স্থির মূলধনের অন্য অংশটি, কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্ৰীসমূহ এক বছরেরও কম সময়ের মধ্যে নিরন্তর পুনরুৎপাদিত হয়; কৃষিকর্মের দ্বারা উৎপাদিত কাঁচামাল ও সহায়ক সামগ্রীগুলির বেশির ভাগটাই পুনরুৎপাদিত হয় বাৎসরিক। সুতরাং উৎপাদন পদ্ধতিতে প্রবর্তিত প্রতিটি উন্নয়ন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাজ করে নোতুন ও আগে থেকেই কার্যরত মূলধনের উপরে। রসায়ন-বিজ্ঞানে প্রতিটি অগ্রগতি কেবল বিবিধ উপযোগী বস্তু এবং উপযোগী পদ্ধতির পূর্ব-পরিজ্ঞাত প্রয়োগসমূহের সংখ্যাই বহুগুণিত এবং এই ভাবে মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে তার বিনিয়োগ-ক্ষেত্রের বিস্তার সাধন করেনা। সেই সঙ্গে তা শেখায় কিভাবে উৎপাদন, ও পরিভোগ প্রক্রিয়াদ্বয়ের নিঃসারিত আবর্জনাকে পুনরুৎপাদনের প্রক্রিয়ার আবর্তনে পুনরায় নিক্ষেপ করা যায়, এবং এই ভাবে, তা মূলধনের কোনো প্রাকৃ-বিনিয়োগ ছাড়াই মূলধনের জন্য নোতুন সামগ্রী সৃষ্টি করে। কেবলমাত্র শ্রমশক্তির তৎপরতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের বর্ধিত নিষ্কর্ষণের মত, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যা মূলধনকে দান করে এমন এক সম্প্রসারণ-ক্ষমতা যা কর্মক্ষেত্রে কর্মরত মূলধনের নির্দিষ্ট আয়তনের উপরে অনির্ভর। সেই সঙ্গে সেগুলি আবার প্রারম্ভিক মূলধনের উপরেও প্রতিক্রিয়া ঘটায়—যে মূলধন তার পুননবী-ভবনের পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। নতুন আকারে অতিক্রমণের পথে, তা, তার পুরানো আকার যখন পরিভুক্ত হচ্ছিল, সেই সময়ে সংঘটিত সামাজিক অগ্রগতিকে মুফতে আত্মকৃত করে নেয়। অবশ্য, উৎপাদন-ক্ষমতার এই বিকাশের সঙ্গে ঘটে কর্মরত মূলধনের আংশিক অপচয়। যতটা পর্যন্ত এই অপচয় প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজেকে তীব্রভাবে অনুভূত করায়, ততটা পর্যন্ত বোঝাটা পড়ে শ্রমিকের কাধে কেননা এমিকের উপরেই শোষণের ভার আরো বাড়িয়ে ধনিক তার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়।

নিজের বারা পরিভুক্ত উৎপাদন-উপকরণের মূল্য শ্রম তার উৎপন্ন দ্রব্যে সঞ্চারিত করে। অন্য দিকে, শ্রম যত উৎপাদনশীল হয়, ততই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শ্রমের আরা গতি-সঞ্চারিত উৎপাদন-উপকরণের মূল্য ও পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। যদিও একই পরিমাণ শ্রম সব সময়েই তার উৎপন্নসামগ্রীতে যোজনা করে কেবল একই পরিমাণ নোতুন মূল্য, তবু শ্রম-উৎপন্ন সামগ্রীতে যে পুরাতন মূলধন-মূল্য সঞ্চারিত করে, তা শ্রমের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির সঙ্গে বৃদ্ধি পায়।

দৃষ্টান্ত স্বরূপ, একজন ইংরেজ একজন চীনা সুতো-কাটুনি একই তীব্রতা সহকারে একই সংখ্যক ঘণ্টা কাজ করতে পারে; তা করলে, তারা দুজনে এক সপ্তাহে সমান সমান মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু এই সমতা সত্ত্বেও, ইংরেজ লোকটির সাপ্তাহিক উৎপাদনের মূল্য এবং চীনা লোকটির সাপ্তাহিক উৎপাদনের মূল্যের মধ্যে ঘটবে বিপুল পার্থক্য, কারণ যেখানে ইংরেজটি কাজ করে বিরাট এক অটোমেশন দিয়ে, সেখানে চীনাটির আছে কেবল একটি চরকা। যে সময়ে চীনা লোকটি কাটে এক পাউণ্ড তুলে, সেই সময়ের মধ্যে ইংরেজ লোকটি কাটে কয়েক শ পাউণ্ড। তত বহু শতগুণ এবং বৃহৎ পুরানো মূল্যসমূহের একটি অঙ্ক তার উৎপন্ন সামগ্রীর মূল্যকে স্ফীত করে যাতে করে নোতুন ও উপযোগপূর্ণ রূপে ঐ মূল্যগুলির পুনরাবির্ভাব ঘটে এবং এইভাবে মূলধন হিসাবে নোতুন করে কাজ করতে সক্ষম হয়। যে কথা ফ্রেডরিক এঙ্গেলস আমাদের জানান, ১৭৮২ সালে ইংল্যাণ্ডে পূর্ববর্তী তিন বছরের গোটা উল-উৎপাদনটাই শ্রমিকের অভাবে অস্পৃষ্ট অবস্থায় পড়েছিল, এবং অবশ্যই ঐ একই ভাবে পড়ে থাকত যদি না নোতুন উদ্ভাবিত মেশিনারি তার সাহায্যে আসত এবং তাকে সুতোয় পরিণত করত।”[১২] যদিও মেশিনারির আকারে মূর্তায়িত শ্রম সরাসরি একটি মানুষকেও উজ্জীবিত করতে অক্ষম ছিল, তবু তা সফল হয়েছিল অপেক্ষাকৃত অল্পতর জীবন্ত শম যোজনা করে, এক ক্ষুদ্রতর সংখ্যক শ্রমিককে সেই উলকে উৎপাদনশীল ভাবে ব্যবহার ও তার মধ্যে নোতুন মূল্য সঞ্চার করতে, এবং কেবল তাই নয়, সেই সঙ্গে সুতো ইত্যাদির আকারে তার পুরানো মূল্যও সংরক্ষণ করল, সেই সঙ্গে তা উলের পুনরুৎপাদনে বৃদ্ধি ঘটাল এবং প্রেরণা সঞ্চার করল। জীবন্ত শ্রমের স্বাভাবিক ধর্মই এই যে, তা নতুন মূল্য সৃজনের সঙ্গে পুরানো মূল্যকেও সঞ্চারিত করে। উৎপাদনের উপায়-উপকরণের ফলপ্রসূতা, বিস্তার ও মূল্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে এবং কাজে কাজেই, তার বিকাশের সহগামী যে সঞ্চয়ন, তার সঙ্গে শ্রম চির-নোতুন রূপে সদা-বর্ধমান মূলধন-মূল্যকে সংরক্ষিত করে ও চিরন্তনতা দান করে।[১৩] শ্রমের এই স্বাভাবিক ক্ষমতা, যে-মূলধনের সঙ্গে তা সংবদ্ধ, সেই মূলধনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর চেহারা ধারণ করে, ঠিক যেমন খনিকের সামাজিক শ্রমের উৎপাদনশীল শক্তিসমূহ মূলধনের অন্তর্নিহিত গুণাবলীর চেহারা ধারণ করে, ঠিক যেমন ধনিকদের দ্বারা উত্তমের নিরন্তর আত্মীকরণ মূলধনের নিরন্তর আত্মসম্প্রসারণের চেহারা ধারণ করে।

মূলধনের বৃদ্ধিপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিয়োজিত মূলধন এবং পরিভুক্ত মূলধনের মধ্যে পার্থক্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অন্যভাবে বলা যায়, নিরন্তর-পুনরাবর্তিত উৎপাদন-প্রক্রিয়া গুলিতে দীর্ঘ বা অল্প কালের জন্য কাজ করে অথবা নির্দিষ্ট প্রয়োজন-সাধনের জন্য কাজে লাগে এবং সেই কাজ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা কেবল একটু একটু করেই ক্ষয় পায় এবং সেই কারণে নিজেদের মূল্য কেবল টুকরো টুকরো ভাবেই হারায় আর কেবল টুকরো টুকরো ভাবেই সেই মুল্যকে উৎপন্ন সামগ্রীতে স্থানান্তরিত করে, এমন সমস্ত শ্রম-উপকরণের যেমন বাড়ি-ঘর যন্ত্রপাতি নর্দমার পাইপ, কর্ম-নিযুক্ত গবাদিপশু, প্রত্যেক ধরনের হাতিয়ার ইত্যাদির মূল্য ও বস্তুগত পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। উৎপন্ন দ্রব্যটিতে মূল্য সংযোজন না করে, এই সমস্ত শ্রম-উপকরণ যে-অনুপাতে উৎপন্ন-গঠক হিসাবে কাজ করে ঠিক সেই অনুপাতে, অর্থাৎ যে-অনুপাতে সেগুলি সমগ্রভাবে নিযুক্ত অথচ আংশিকভাবে পরিভুক্ত হয়, ঠিক সেই অনুপাতে সেগুলি জল, বাম্প, বাতাস, বিদ্যুৎ ইত্যাদি প্রাকৃতিক শক্তিগুলির মত মুফতে কাজ করে, এটা আমরা আগেই দেখেছি। জীবন্ত শ্রমের দ্বারা যখন অধিকৃত ও আত্ম-সমম্বিত হয়, তখন অতীত শ্রমের এই বিনামূল্য অবদান সঞ্চয়নের অগ্রসরমান পর্যায়গুলির সঙ্গে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।

যেহেতু অতীত শ্রম সর্বদাই মূলধনের ছদ্ম-আবরণে নিজেকে আবৃত রাখে, যেহেতু ‘ক’, ‘খ’, ‘গ’, ইত্যাদির শ্রমের নিষ্ক্রিয় ভাগ অ-শ্রমিক ‘হ’,এর সক্রিয় ভাগের রূপ পরিগ্রহ করে, সেহেতু বুর্জোয়া ও রাষ্ট্রীয় অর্থতাত্ত্বিকরা মৃত ও গত শ্রমের অবদানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, স্কচ-মনীষী ম্যাক-কুলক-এর মতে যার পাওয়া উচিত সুদ, মুনাফা ইত্যাদির আকারে একটা বিশেষ পারিশ্রমিক।[১৪] উৎপাদনের উপায়-উপকরণের রূপের আড়ালে অতীত শ্রম জীবন্ত শ্রম-প্রক্রিয়াকে যে বলিষ্ঠ ও চির-বর্ধিষ্ণু সহায়তা দান করে তা এই কারণে অতীত শ্রমের সেই রূপটিতে আরোপিত হয়, যে-রূপটিতে তা, মজুরি-বঞ্চিত শ্রম হিসাবে, স্বয়ং শ্রমিক থেকেই বিচ্ছিন্নকৃত অর্থাৎ আরোপিত হয় তার ধনতান্ত্রিক রূপটিতে। ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের বাস্তব প্রতিনিধিরা এবং তাদের মতলববাজ তত্ত্ববাগীশরা উৎপাদনের উপায়সমূহকে সেগুলির অধুনা-পরিহিত ছদ্মবেশ থেকে আলাদা করে ভাবতে পারে না, যেমন গোলাম-মালিক গোলামকে ভাবতে পারে না গোলাম হিসাবে তার চরিত্র থেকে আলাদা করে ভাবতে।

শ্রমশক্তি শোষণের মাত্রা নির্দিষ্ট থাকলে, উৎপাদিত উদ্বৃত্ত মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয় যুগপৎ-শোষিত শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে; এবং বিচ্ছিন্ন অনুপাতে হলেও, তা মূলধনের আয়তনের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে। সুতরাং উত্তরোত্তর সঞ্চয়নের দ্বারা মূলধন যত বৃদ্ধি পায়, পরিভোগ-ভাণ্ডার ও সঞ্চয়ন-ভাণ্ডারের মধ্যে বিভক্ত মূল্য তত বৃদ্ধি পায়। সুতরাং, তখন ধনিক আরো স্ফুর্তিবাজ জীবন যাপন করতে পারে এবং সেই সঙ্গে আরো “ভোগ-সংবরণ” প্রদর্শন করতে পারে। এবং সর্বশেষে, অগ্রিম প্রদত্ত মূলধনের পরিমাণের সঙ্গে উৎপাদনের আয়তন যত বিস্তার লাভ করে, ততই উৎপাদনের সমস্ত স্প্রিংগুলি অধিক স্থিতিস্থাপকতাসহ কাজ করে।

————

১. রিকার্ডো বলেন, “সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে মূলধনের সঞ্চয়ন কিংবা শ্রমের নিয়োগ” (অর্থাৎ শোষণ) ‘মোটামুটি দ্রুতগতি এবং সর্ব ক্ষেত্রেই তা নির্ভর করে শ্রমের উৎপাদনক্ষমতার উপরে। শ্রমের উৎপাদনক্ষমতা সাধারণত সেখানেই সর্বাধিক যেখানে থাকে উর্বর জমির প্রাচুর্য। যদি প্রথম বাক্যটিতে শ্রমের উৎপাদন ক্ষমতার অর্থ হয় কোনো উৎপন্নের সেই একাংশের স্বল্পতা যা যায় তাদের কাছে যাদের দৈহিক শ্রম তাকে উৎপন্ন করেছে, তা হলে বাক্যটি প্রায় অভিন্ন, কেননা বাকি একাংশ হল সেই তহবিল যা থেকে মূলধন সঞ্চয়ীকৃত হতে পারে, যদি মালিক ইচ্ছা করে। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে বেশি উর্বর জমি আছে, সেখানে এটা সাধারণতঃ ঘটেনা।” (“অবজার্ভেশনস অন সার্টেন ভাবল ডিসপিউটস, ইত্যাদি” ৭৪, ৭৫)।

২. জন স্টুয়ার্ট মিল, “এসেজ অন সাম আনসেটেল্ড কোশ্চেনস অব পলিটিক্যাল ইকনমি,” লণ্ডন, ১৮৪৪, পৃঃ ৯০।

৩. “অ্যান এসে অন ট্রেড অ্যাণ্ড কমার্স,”লণ্ডন, ১৭৭৩, পৃঃ ৪৪।” ১৮৬৬-র ডিসেম্বর এবং ১৭৬৭-র জানুয়ারিতে ‘টাইমস’ অনুরূপ ভাবে ইংরেজ খনিমালিকের কিছু কিছু মানসিক উচ্ছাস প্রকাশ করে, যাতে চিত্রিত করা হয় বেলজিয়ান খনি-শ্রমিকদের সৌভাগ্য, যারা তাদের “মনিবদের প্রয়োজনে বেঁচে থাকার জন্য যা একান্ত আবশ্যক, তার চেয়ে বেশি কিছু চায়নি এবং পায়নি। বেলজিয়ান শ্রমিকদের অনেক কষ্ট সহ্ন করতে হত কেবল ‘টাইমস পত্রিকায় তাদের “মডেল শ্রমিক হিসাবে স্থান পাবার জন্য ! তারপরে ১৮৬৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এল জবাব : মার্সিয়েন-এ বেলজিয়ান খনি-শ্রমিকদের ধর্মঘট, যা দমন করা হল গুলির মুখে।

৪. ঐ, পৃঃ ৪৪-৪৬।

৫. নর্দাম্পটনশায়ারের ম্যানুফ্যাকচারার একটি সাধু প্রতারণা করেন। যার হৃদয় এত পরিপূর্ণ, তার এইটুকু প্রতারণা ক্ষমা করা যায়। তিনি নামে ইংরেজ এবং ফরাসী কাৱখানা-শ্রমিকদের জীবন তুলনা করার কথা বলেন কিন্তু আসলে, একমাত্র উদ্ধৃত কথাগুলিতে দেখা যাবে, তিনি চিত্রিত করেছেন ফরাসী কৃষি-শ্রমিকদের জীবন এবং সেটা তিনি তার নিজের গোলমেলে ঢঙে স্বীকারও করেছেন।

৬. ঐ, পৃঃ ৭০, ৭১। তৃতীয় জার্মান সংস্করণে টীকা : কিন্তু তারপর থেকে বিশ্বের বাজারে যে প্রতিযোগিতা প্রচলিত হয়েছে, তার কল্যাণে আজ আমরা আরো অগ্রসর হয়েছি। পার্লামেন্ট-সদস্য মিঃ স্ট্যাপলটন তাঁর নির্বাচকদের বলেন, “চীন যদি একটি বিরাট শিল্পোৎপাদনকারী দেশ হয়ে ওঠে, তা হলে আমি বুঝতে পারিনা কি করে ইউরোপের শিল্পোৎপাদনকারী জনসংখ্যা তাদের প্রতিযোগিদের সমান পর্যায়ে নেমে না গিয়ে এই প্রতিযগিতায় টিকে থাকবে? ( ‘টাইমস, ৩রা সেপ্টেম্বর ১৮৭৩, পৃ৮)। ইংরেজ মূলধনের অভীষ্ট লক্ষ্য এখন ইউরোপ-ভূখণ্ডের মজুরি নয়, চীনদেশের মজুরি।

৭. বেঞ্জামিন টমসন : “এসেজ পলিটিকাল, ইকনমিকাল এবং ফিলসফিকাল, ইত্যাদি ৩ খণ্ড লণ্ডন ১৭৯৬-১৮০২ প্রথম খণ্ড, পৃঃ ২৯৪। “দি স্টেট অব দি পুয়োর অর অ্যান হিস্টরি অব দি লেবরিং ক্লাসেস ইন ইংল্যাণ্ড” নামক বইয়ে স্যার এফ. এম. ইচ্ছে কর্ম নিবাসের ওভারসীয়ারদের কাছে রামফোডের ভিখারী-মুরুয়া দারুণ ভাবে সুপারিশ করেন এবং ইংরেজ শ্রমিকদের ভৎসনার সুরে সতর্ক করে দেন যে, “অনেক গরিব লোক, বিশেষ করে স্কটল্যাণ্ডে, মাসের পর মাস বেঁচে থাকে, এবং বেঁচে থাকে বেশ আরামে, কেবল জল ও মুনের সঙ্গে মেশানোজই আর যবের খাবার খেয়ে।” (ঐ, খণ্ড ১, অধ্যায় ১, পরিচ্ছেদ ২, পৃঃ ৫০৩)। উনিশ শতকেও একই ধরনের ইঙ্গিত : “(ইংরেজ কৃষি শ্রমিকদের দ্বারা) ময়দা দিয়ে তৈরি স্বাস্থ্যকর মেশাল-খাবারের এই পাইকারি প্রত্যাখ্যান…শিক্ষা যেখানে উৎকৃষ্ট সেই স্কটল্যাণ্ডে এই কুসংস্কার সম্ভবত অপরিজ্ঞাত।” (চার্লস এইচ প্যারি, এম. ডি. “কোশ্চেন অব কর্ণ লজ কনসিভ লণ্ডন ১৮১৬, পৃ ৬৯)। এই একই প্যারি কিন্তু আবার নালিশ করেন যে, এখন (১৮১৫) ইংরেজ শ্রমিকদের অবস্থা ইভেন-এর সময় (১৭৯৭) থেকে অনেক খারাপ।

৮. জীবনধারণের উপকরণাদির ভেজাল সংক্রান্ত সর্বশেষ পার্লামেন্টারি কমিশনের বিপোর্টগুলি থেকে দেখা যায় যে, এমনকি ঔষধে ভেজালও ইংল্যাণ্ডে ব্যতিক্রম নয়, সাধারণ নিয়ম। লণ্ডনে ৩৪ জন আফিম-ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আফিমের ৩৪টি নমুনা ক্রয় করে দেখা গিয়েছে যে সেগুলির মধ্যে ৩১টিই পোন্ত, ছাতু আর আঠার ভেজাল মেশানো। কয়েকটিতে তো এক কণা ‘মাফিয়া’-ও নেই।

৯. জি. বি. নিউহাম (ব্যারিস্টার): “এ রিভিউ অব দি এভিডেন্স বিফোর দি কমিটি অফ দি টু হাউসেস অফ পার্লামেন্ট অন দি কন লজ”, লণ্ডন, ১৮১৫, পৃঃ ২০ টাকা।

১০. ঐ, পৃঃ :৯, ২০।

১১. সি. এইচ প্যারি, ঐ পৃঃ ৭৭, ৬৯। যে অ্যান্টি-জ্যাকবিয়ান যুদ্ধ তারা ইংল্যাণ্ডের নামে নিজেরাই বাধিয়েছিল, সেই যুদ্ধের জন্য জমিদারেরা কেবল নিজেদের কতিপূরণ’-ই দেয়নি, সেই সঙ্গে নিজেরা কামিয়েও নিয়েছিল প্রচুর। তাদের খাজনা যিগুণ, ত্রিগুণ, চতুগুণ হল এবং একটি ক্ষেত্রে ১৮ বছরে ছয় গুণ বেড়ে গিয়েছিল। (ঐ পৃঃ ১০০, ১০১)।

১২. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, “Lage der arbeitenden Klasse in England” পৃঃ ২০।

১৩. শ্ৰম-প্রক্রিয়া এবং মূল্য-সৃজন-প্রক্রিয়ার ত্রুটিপূর্ণ বিশ্লেষণের দরুন চিরায়ত অর্থতত্ব পুনরুৎপাদনের এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি কখনো সঠিক ভাবে ধরতে পারেনি, যেমন রিকার্ডোর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায়; যেমন তিনি বলেন, উৎপাদন-ক্ষমতায় যে পরিবই হোক না কেন, ম্যানুফ্যাকচার-সমূহে এক মিলিয়ন লোক সব সময়ে একই মূল্য উৎপাদন করে। এটা ঠিক, যদি তাদের শ্রমের বিস্তার ও তীব্রতার মাত্রা নির্দিষ্ট থাকে। কিন্তু তাদের শ্রমে বিভিন্ন উৎপাদন-ক্ষমতা সম্পন্ন এক মিলিয়ন লোককে তা উৎপাদন-উপকরণের অতি বিভিন্ন সম্ভারকে উৎপন্ন দ্রব্যে পরিণত করা এবং সেই কারণে তাদের উৎপন্ন দ্রব্যাদিতে অতি বিভিন্ন মূল্য-সম্ভারকে সংরক্ষিত করা ( যার ফলে উৎপাদিত দ্রব্যাদির মূল্য-সমূহ বেশ বিভিন্ন হতে পারে) থেকে নিবৃত্ত করতে পারে না। প্রসঙ্গত, উল্লেখ করা যেতে পারে, রিকার্ডো বৃথাই জে. বি. সে-র কাছে পরিষ্কার করতে চেষ্টা করেছেন ব্যবহার-মূল্য ( যাকে তিনি অভিহিত করেছেন সম্পদ’ বা ‘বৈষয়িক ধন’ বলে এবং বিনিময়মূল্যের মধ্যেকার পার্থক্য। জে বি সে উত্তরে বলেন, ‘Quanta la difficulte qu’eleve Mr. Ricardo en disant que, par des procedes mieux entendus un million de personnes peuvent produire deux fois, trois fois autant de richesses, sans produire plus de valeurs, cette difficulte n’est pas uue lorsque l’on considere, ainsi qu’on le doit, la production comme un echange dans lequel on donne les services productifs de son travail, de sa terre, et de ses capitaux, pour obtenir des produits. C’est par le moyen de ces services productifs, que nous acquerons tous les produits qui sont au monde. Or…nous sommes d’autant plus riches, nos services productifs ont d’autant plus de valeur qu’ils obtiennent dans l’echange appele production une plus grande quantite de choses utiles.” (J. B. Say, “Lettres a M. Malthus,” Paris, 1820, pp. 168–169.) The “difficulte” — ( ‘সমস্যা’ ) নিশ্চয়ই আছে, তবে রিকার্ডোর নয়, তার নিজের; মিঃ সে যা পরিস্কার করে বোঝাতে চান, তা এই : শ্রমের উৎপাদন-ক্ষমতা বৃদ্ধির ফলশ্রুতি হিসাবে যখন ব্যবহার-মূল্যসমূহের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, তখন ঐ ব্যবহার-মূল্যগুলির বিনিময় মল্য বৃদ্ধি পায় না কেন? উত্তর : সমস্যাটার সমাধান সহজেই করা যায়, ব্যবহার-মূল্যকে বিনিময়মূল্য বলে অভিহিত করে, অবশ্য যদি আপনার মর্জি হয়। বিনিময়মূল্য এমন একটা জিনিস যা কোন-না-কোন ভাবে বিনিময়ের সঙ্গে যুক্ত। সুতরাং, উৎপাদনকে যদি অভিহিত করা হয় উৎপন্ন দ্রব্যের বাবদে শ্রম এবং উৎপাদন-উপায়ের বিনিময় বলে, তা হলে এটা দিনের মত পরিষ্কার যে উৎপাদন যে-অনুপাতে ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, আপনিও সেই অনুপাতে অধিকতর বিনিময়মূল্য পান। ভাষান্তরে বলা যায়, একটা কাজের দিন যত বেশি ব্যবহার-মূল্য দেয়, যেমন মোজা-ম্যানুফ্যাকচারকারীকে যত বেশি মোজা দেয়, সে ততই মোজায় আরো ধনসম্পন্ন হয়। যাই হোক, আচমকা সে-র মনে পড়ে গেল যে, মোজার পরিমাণ বৃদ্ধি পেলে’, সেগুলির দাম ( যার সঙ্গে অবশ্য বিনিময়মূল্যের কোনো সম্বন্ধ নেই!) পড়ে যায় “Parce que la concurrence les ( les producteurs) oblige a donner les produits pour ce qu’ils leur coutent,” fpe Fap TTT খরচা-দামেই বিক্রি করে দেয়, তা হলে মুনাফাটা কোথা থেকে আসে? কুছ পরোয়া নেই। মিঃ সে ঘোষণা করেন যে, বর্ধিত উৎপাদন-ক্ষমতার ফলে প্রত্যেকেই এখন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ পরিমূল্যের বদলে পাবে আগেকার এক জোড়ার জায়গায় এখন দু-জোড়া করে মোজা। যে-ফলটিতে তিনি উপনীত হলেন, সেটি অবিকল সেই রিকাডের প্রবক্তব্যটির মত, যেটি তিনি খণ্ডন করতে চেয়েছিলেন। চিন্তার এই বিপুল প্রয়াসের পরে তিনি বিজয়োল্লাসে ম্যালথাসকে সম্বোধন করে বলেন, “Telle cst, monsieur, la doctrine bien liee, sans laquelle il est impossible je le declare, d’expliquer les plus grandes difficultes de l’economie politique, et notamment, comment il se peut qu’une nation soit plus riche lorsque ses produits diminuent de valeur, quoique la richesse soit de la valeur, (ঐ, পৃঃ ১৭০)। সে-র ‘পত্রাবলী’তে এই একই ধরনের হাত-সাফাইয়ের কৌশলের উপরে মন্তব্য করতে গিয়ে জনৈক ইংরেজ অর্থনীতিবিদ বলেন, “এই কৃত্রিম বাচনভঙ্গিই সাধারণ ভাবে রচনা করে সেই জিনিস, যাকে মশিয়ে সে খুশি মনে বলেন তার মতবাদ এবং যা তিনি ঐকান্তিক ভাবে ম্যালথাসকে অনুরোধ করেন হারফোডে শেখাতে, যেমন তা ইতিমধ্যেই শেখানো হচ্ছে *dans plusieurs parties de l’Europe’, fofa 267A, ‘Si vous troui ez une physionomie de paradoxe a toutes ces propositions, voyez les cho.es qu’elles expriment, et j’ose croire qu’elles vous paraitront fort simples et fort raisonnables.’ নিঃসন্দেহে, এবং এই একই প্রাক্রয়ার ফলে, তারা ‘মৌল’ ব্যতীত অন্য সব কিছু বলেই প্রতিভাত হবে। ( ‘অ্যান ইনকুইরি ইনটু দোজ প্রিন্সিপলস রেস্পেকূটিং দি নেচার অব ডিমাণ্ড ইত্যাদি।” পূঃ ১১৬, ১১)।

১৪. সিনিয়র ‘ভোগ-সংবরণের মজুরির জন্য পেটেন্ট নেবার অনেক আগেই ম্যাক কুলক ‘অতীত শ্রমের মজুরি’-র জন্য পেটেন্ট নিয়ে সেরেছেন।

.

পঞ্চম পরিচ্ছেদ তথাকথিত শ্রম-ভাণ্ডার।

এই তত্ত্ব-জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গে আগেই দেখানো হয়েছে, মূলধন একটি নির্দিষ্ট আয়তন নয়, পরন্তু নোতুন উদ্বৃত্ত-মূল্যের আয়ে ও অতিরিক্ত মূলধন বিভাজনের সঙ্গে স্থিতি স্থাপক ও নিরন্তর পরিবর্তনশীল। আরো দেখা হয়েছে যে কর্মরত মূলধনের আয়তন নির্দিষ্ট থাকলেও, তার মধ্যে মূর্তয়িত শ্রমশক্তি, বিজ্ঞান ও ভূমি ( যার দ্বারা অর্থতত্ত্বের ক্ষেত্রে বুঝতে হবে মানুষ থেকে স্বতন্ত্র ভাবে প্রকৃতির দ্বারা প্রদত্ত শ্রমের যাবতীয় অবস্থাবলী) হল মূলধনের স্থিতিস্থাপক ক্ষমতাবলী, যারা তার জন্য খুলে দেয়, কয়েকটি নির্দিষ্ট মাত্রার মধ্যে, তার নিজের আয়তন-নিরপেক্ষ একটি কর্মক্ষেত্র। এই তত্ত্বজিজ্ঞাসায় আমরা উপেক্ষা করেছি সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার তাবৎ ফলাফল, যা একই পরিমাণে অত্যন্ত বিভিন্ন মাত্রার নৈপুণ্য উৎপাদন করতে পারে। এবং যখন আমরা আগে থেকে ধরে নিয়েছিলাম ধনতান্ত্রিক উৎপাদনের দ্বারা আবোপিত মাত্ৰাসমূহ, অর্থাৎ ধরে নিয়েছিলাম নিছক স্বতঃস্ফুর্ত বিকাশের ফলে অত্যুদিত একটি রূপে সামাজিক উৎপাদনের একটি প্রক্রিয়া, তখন আমরা উপেক্ষা করেছিলাম উৎপাদনের উপায়সমূহ এবং উপস্থিত নিয়োগ-যোগ্য শ্রমশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও প্রণালীবদ্ধ ভাবে সংঘটন করা সম্ভব এমন অধিকতর যুক্তিসিদ্ধ কোনো সংযোজন। চিরায়ত অর্থতত্ত্ব সব সময়েই ভালবাসত সামাজিক মূলধনকে একটি নির্দিষ্ট মাত্রার নৈপুণ্য-সমন্বিত একটি নির্দিষ্ট আয়তন হিসাবে ধারণা করতে। কিন্তু এই ভুল ধারণাটিকে একটি আপ্ত বাক্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন চূড়ান্ত ফিলিস্তিন সেই জেরেমি বেন্থাম-উনিশ শতকের মামুলি বুর্জোয়া বুদ্ধিমত্তার সেই নীরস, পণ্ডিতম্মন্য, চর্মজি দৈববাণী।[১] কবিদের মধ্যে যেমন মার্টিন টুপার, দার্শনিকদের মধ্যে তেমন বেন্থাম। কেবল ইংল্যাণ্ডেই এমন দুটি সামগ্রীর উৎপাদন সম্ভব ছিল।[২] তাঁর এই আপ্তবাক্যটির আলোয় উৎপাদনের সবচেয়ে মামুলি ব্যাপারগুলি পর্যন্ত, যেমন তার আকস্মিক সম্প্রসারণ ও সংকোচন, এমনকি স্বয়ং সঞ্চয়নও হয়ে পড়ে সম্পূর্ণ ভাবে অকল্পনীয়।[৩] এই আপ্তবাক্যটিকে বেন্থাম নিজে, ম্যালথাস, জেম্স মিল, ম্যাক্‌ কুলাক প্রভৃতি ব্যবহার করেছিলেন কৈফিয়ৎ হিসাবে ব্যবহারের জন্য এবং, বিশেষ করে, মূলধনের একটা অংশকে, অস্থির মূলধনকে, অথবা যে অংশ একটি নির্দিষ্ট আয়তন হিসাবে শ্রমশক্তিতে রূপান্তরণীয়, সেই অংশটিকে বোঝাবার জন্য। অস্থির মূলধনের বস্তুগত উপাদান অর্থাৎ শ্রমিকের জন্য যে পরিমাণ প্রাণধারণের উপকরণের তা প্রতিনিধিত্ব করে সেই পরিমাণ কিংবা যাকে বলা হয় “শ্রম-ভাণ্ডার, তাকে বানিয়ে বানিয়ে বর্ণনা করা হয়েছিল সামাজিক সম্পদের এমন একটি আলাদা অংশ হিসাবে, যা প্রকৃতির দ্বারা নির্ধারিত ও অপরিবীয়। সামাজিক মূলধনের যে-অংশ স্থির মূলধন হিসাবে কাজ করবে, তাকে গতিশীল করার জন্য, কিংবা তাকে উৎপাদনের উপায় হিসাবে বস্তুগত রূপে প্রকাশ করার জন্য, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জীবন্ত শ্রমের আবশ্যক হয়। প্রযুক্তিগত ভাবে এই পরিমাণটি নির্দিষ্ট। কিন্তু এই শ্রমশক্তির পরিমাণটিকে তরল করার জন্য কত সংখ্যক শ্রমিক লাগবে তা নির্দিষ্ট নয় (ব্যক্তিগত শ্রমশক্তিকে কি মাত্রায় শোষণ করা হবে, তার উপরে এই সংখ্যা নির্ভরশীল ), এই শ্রমশক্তির দামও নির্দিষ্ট নয়, কেবল তার ন্যূনতম সীমাটাই নির্দিষ্ট, সেটাও আবার অপরিবর্তনীয়। এই আপ্ত বাক্যটির মূলে যেসব ঘটনা রয়েছে, সেগুলি এই : এক দিকে অ-শ্রমিকের উপভোগের উপকরণ এবং উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে সামাজিক সম্পদের বিলি-বণ্টনে শ্রমিকের হস্তক্ষেপের কোন অধিকার নেই।[৪] অন্য দিকে, কেবলমাত্র অনুকূল ও অতি বিরল ক্ষেত্রেই ধনবানদের “আয়”-এর বিনিময়ে শ্রমিক পারে তথাকথিত শ্রম-ভাণ্ডারটির বৃদ্ধি সাধন করতে।

শ্রম-ভাণ্ডারে ধনতান্ত্রিক সীমাবন্ধনকে তার প্রাকৃতিক ও সামাজিক সীমাবদ্ধতা হিসাবে প্রদর্শনের প্রচেষ্টা থেকে কী ধরনের নির্বোধ পুনরুক্তির জন্ম হয় তার একটি দৃষ্টান্ত হিসাবে অধ্যাপক ফসেট-এর কথা উদ্ধত করা যায়।[৫] তিনি বলেন, একটি দেশের আবর্তনশীল মূলধন হল তার মজুরি-ভাণ্ডার। সুতরাং, প্রত্যেক শ্রমিকের প্রাপ্ত গড় আর্থিক মজুরিকে যদি হিসাব করতে চাই তা হলে আমাদের কেবল এই মূলধনের পরিমাণটিকে শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেই হবে।[৬] তার মানে দাড়ায় এই যে, আমরা প্রথমে প্রত্যেক শ্রমিককে সত্য-সত্যই যে-মজুরি দেওয়া হয়েছে, সেগুলিকে যোগ করব এবং তার পরে ঘোষণা করব, এই যে যোগফলটা পাওয়া গেল, সেটাই হল শ্রম-ভাণ্ডার”-এর মোট মূল্য—যা নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং আমাদের হাতে কৃপাভরে তুলে দিয়েছেন স্বয়ং ঈশ্বর ও প্রকৃতি। সর্বশেষে আমরা আবার সেই প্রাপ্ত যোগফলটিকে শ্রমিকদের সংখ্যা দিয়ে ভাগ করব, যাতে করে প্রত্যেকের ভাগে গড়ে কত করে আসে। এটা অসাধারণ জ্ঞানের পরি চায়ক একটা প্রতারণা। একই নিঃশ্বাসে কিন্তু একথা বলতে মিঃ ফসেট-এর বাধেনা যে, “ইংল্যাণ্ডে যে-মোট পরিমাণ সম্পদ বাৎসরিক বাঁচানো হয়, তা দু-ভাগে বিভক্ত। একটা অংশ মূলধন হিসাবে নিয়োগ করা হয় আমাদের শিল্প-চালনার জন্য এবং বাকি অংশটা রপ্তানি করা হয় বিদেশে। . এই দেশে বাৎসরিক যে-সম্পদ বাঁচানো হয়, কেবল তার একটা অংশই–এবং সম্ভবত সেটা একটা বড় অংশ নয়—বিনিয়োজিত হয় আমাদের নিজেদের শিল্পে।”[৭]

এই ভাবে ইংরেজ শ্রমিকের কাছ থেকে বাৎসরিক যে পরিমাণ উদ্বৃত্ত-উৎপন্ন সামগ্রী অপচয় করা হয় তছরুপ করা হয়, কেননা তা আদায় করা হয় কোন প্রতিমূল্য না দিয়ে—তা মূলধন হিসাবে ব্যবহৃত হয় ইংল্যাণ্ডে নয়, বিদেশে। কিন্তু এই ভাবে রপ্তানিকৃত বাড়তি মূলধনের সঙ্গে ঈশ্বর এবং বেন্থাম কর্তৃক উদ্ভাবিত এই “শ্রম-ভাণ্ডার” এরও একটা অংশ বিদেশে রপ্তানি হয়ে যায়। [৮]

————

১. তুলনীয় : জেরেমি বেন্থাম, “থিয়োরি অব রিওয়াড অ্যাণ্ড পানিশমেন্ট, ফরাসী সংস্করণ, ১৮২৬।

২. বেন্থাম একটি বিশুদ্ধ ইংরেজি আবির্ভাব। একমাত্র আমাদের দার্শনিক ক্রিশ্চিয়ান উ ব্যতিরেকে কোনো দেশে কোনো কালে এমন ঘরে-তৈরি আটপৌরে জিনিস এমন আত্মগরিমা নিয়ে আস্ফালন করে বেড়ায় না। হেলভেটিয়াস এবং অন্যান্য ফরাসীরা আঠারো শতকে যে-কথা বলে গিয়েছেন সতেজ ভঙ্গিতে, কেবল সেই কথাই তিনি পুনরাবৃত্তি করেছেন নীরস ঢঙে। কুকুরের পক্ষে কি প্রয়োজনীয় তা জানতে হলে কুকুরের প্রকৃতি অনুধাবন আবশ্যক। এই প্রকৃতিটিকে কিন্তু উপযোগিতার নীতি থেকে নিষ্কর্ষিত করা যাবে না। এটা যদি মানুষের বেলায় প্রয়োগ করা যায়, তা হলে বলতে হয় যে, যে-ব্যক্তি মানুষের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ, গতিবিধি, সম্পর্ক ইত্যাদি উপযোগিতার নীতির সাহায্যে পর্যালোচনা করবেন, তার আগে অনুধাবন করতে হবে সাধারণ ভাবে মানব-প্রকৃতি এবং তার পরে প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক যুগে তা যেমন ভাবে উপযোজিত হয়েছে, তেমন ভাবে। বেন্থাম সংক্ষেপেই পাট চুকিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে নির্জলা সারল্য সহকারে তিনি আধুনিক দোকানদারকে, বিশেষ করে, ইংরেজ দোকানদারকে গ্রহণ করেছেন স্বাভাবিক মানুষ হিসাবে। যা কিছু এই অদ্ভুত লোকটির কাছে এবং তার জগতের কাছে প্রয়োজনীয়, তাই পরম প্রয়োজনীয়। তারপরে, তিনি মানদণ্ডটি প্রয়োগ করেন অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের ক্ষেত্রে। দৃষ্টান্ত হিসাবে, খ্রীস্টধর্ম প্রয়োজনীয় কেননা তা ধর্মের নামে সেই একই সব দোষকে নিষেধ করে, যেগুলিকে ‘দণ্ড-বিধি (পেনাল কোড) আইনের নামে দণ্ডনীয় বলে ঘোষণা করে। শিল্পকলাগত সমালোচনা ক্ষতিকারক কেননা, তা মার্টিন টুপার-কে ভোগ করার ক্ষেত্রে গুণী লোকদের মনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এই ধরনের জঞ্জাল দিয়ে, এই বীরপুঙ্গবটি তার নীতি “inulla dies sine linea”-কে মাথায় নিয়ে, বইয়ের পরে বইয়ের পাহাড় বানিয়ে ফেলেছেন। আমার যদি বন্ধু হাইনরিক হাইন-এর মত সাহস থাকত, তা হলে আমি মিঃ জেরেমিকে অভিহিত করতাম বুর্জোয়া নিবুদ্ধিতার অন্যতম প্রতিভা হিসাবে।

৩. রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিবিদদের একটা প্রবল ঝোঁক হল একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মূলধন এবং একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিককে অভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন উৎপাদনশীল উপকরণ হিসাবে …কিংবা অভিন্ন তীব্রতা সহকারে ক্রিয়াশীল হিসাবে গণ্য করার। যারা এই মত পোষণ করেন যে পণ্যসমূহই হল উৎপাদনের একমাত্র উপাদান : তার প্রমাণ করেন উৎপাদন কখনো পরিবর্ধিত করা যায় না, কেননা এই ধরনের পরিবর্ধনের অপরিহার্য শর্ত হল এই যে, খাদ্য, কাচামাল ও হাতিয়ার ইত্যাদি. আগেভাগে বৃদ্ধি করতে হবে; যার কার্যতঃ অর্থ দাঁড়ায় এই যে, আগেভাগে একবার বৃদ্ধি না ঘটিয়ে কোনো বৃদ্ধি ঘটানো যায় না, তার মানে, যে-কোনো বৃদ্ধি সাধনই অসম্ভব।” (এস বেইলি : “মানি অ্যাণ্ড ভিসিচুডস, পৃঃ ৫৮ এবং ৭০)। বেইলি প্রধানতঃ সঞ্চলন-প্রক্রিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে গোঁড়ামিটার সমালোচনা করেছেন।

৪. জন স্টুয়ার্ট মিল তার “প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি”-তে বলেন, “সত্য সত্যই ক্লান্তিকর, সত্যসত্যই বিরক্তিকর শ্রমই অন্যান্যদের চেয়ে ভাল মজুরি নাপেয়ে, উলটো সর্বত্রই পায় আরো খারাপ মজুরি। কাজটা যত অসহ, ততই এটা নিশ্চিত যে মজুরি হবে সবচেয়ে সামান্য। কাজের কঠোরতা ও উপার্জন যে-কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজে যা হওয়া উচিত, তাই না হয়ে, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ভাবে আনুপাতিক না হয়ে, সাধারণত হয় পরস্পরের সঙ্গে বিপরীত ভাবে আনুপাতিক।” ভুল বোঝাবুঝি এড়াবার জন্য, আমি বলতে চাই যে, জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মত ব্যক্তিরা যদিও তাদের চিরাচরিত গোঁড়া বিশ্বাসগুলি এবং আধুনিক প্রবণতাগুলির মধ্যে স্ব-বিরোধের জন্য দুষণীয়, তা হলেও তাদের হাতুড়ে অর্থ নৈতিক দালালদের গড্ডালিকার সঙ্গে একই শ্রেণীভুক্ত করলে ভুল হবে।

৫. এইচ ফসেট, কেম্বব্রিজে রাষ্ট্রীয় অর্থতত্ত্বের অধ্যাপক, “দি ইকনমিক পোজিশন অব দি ব্রিটিশ লেবারা,” লণ্ডন, ১৮৬৫, পৃ ১২০।

৬. আমি এখানে পাঠককে মনে করিয়ে দিতে চাই যে, “পরিবনীয় (অ-স্থির) ও স্থির মূলধন” অভিধা দুটি আমিই প্রথমে ব্যবহার করেছি। অ্যাডাম স্মিথের কাল থেকে অর্থতত্ত্ব কেবল সঞ্চয়নের প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত স্থির ও আবর্তনশীল মূলধনের মধ্যেকার আনুষ্ঠানিক পার্থক্যের সঙ্গে এই মর্মগত পার্থক্যকে গুলিয়ে ফেলেছে। এই বিষয়ে আরো আলোচনার জন্য তৃতীয় খণ্ড (বাং সং ), দ্বিতীয় বিভাগ দ্রষ্টব্য।

৭. ফসেট, ঐ, পৃঃ ১২২, ১২৩।

৮. বলা যেতে পারে যে কেবল মূলধনই নয়, সেই সঙ্গে শ্রমিকেরাও, দেশান্তর যাত্রীর আকারে, প্রতি বছর ইংল্যাণ্ড থেকে রফতানি হয়। মূল-পাঠে কিন্তু দেশান্তর যাত্রীদের-যাদের বেশির ভাগই শ্রমিক নয়—কোনো সম্পত্তির প্রশ্ন নেই। কৃষি মালিকদের পুত্ররাই তাদের সংখ্যাগুরু অংশ। বিদেশে বাৎসরিক রফতানিকৃত, সুদের বিনিময়ে বিনিয়োগযোগ্য মূলধন বাৎসরিক সঞ্চয়নের যত অনুপাত, তা বাৎসরিক দেশান্তর-যাত্রীরা বাৎসরিক জনসংখ্যা-বৃদ্ধির যত অনুপাত তার তুলনায় বৃহত্তর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *