২৪. আর কতকাল নারী কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?

ভারতীয় ছবির মেগা স্টার অমিতাভ বচ্চনের ছেলে অভিষেকের সঙ্গে ঐেশ্বর্যার বিয়ে হতে পারে এরকম একটি খবর যখন পত্রিকায়, সকলের অতি ভালোবাসার ধন অমিতাভ বচ্চন বলে দিলেন জ্যোতিষি বলেছে ঐশ্বর্যাকে বিয়ে করলে অভিষেকের অমঙ্গল হবে, সুতরাং বিয়ে বাদ। তারপর নানারকম পুজো আচ্চা করে নাকি সঙ্গেট মোচন হল। অমঙ্গলও মোচন হল। অভিষেক এখন বিয়ে করতে পারে ঐশ্বর্যাকে। ঐশ্বর্যা নামী অভিনেত্রী। তাঁর পক্ষে কি অভিনয় করা সম্ভব হবে বিয়ের পর, এই প্রশ্ন সকলের মনে। তাঁকে কি অভিনয় করার অনুমতি দেবে তাঁর স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ি? অভিষেক শুনেছি বলেছেন, ঐশ্বর্যা অভিনয় করতে চাইলে করবে। বিয়ের পর অভিষেকের অভিনয় বন্ধ হবে কী হবে না তা নিয়ে কিন্তু কেউ প্রশ্ন করেনি। ঐশ্বর্যার কাছে জানতে চায়নি অভিষেককে তিনি অনুমতি দেবেন কিনা অভিনয় করার।

কারও কাছে কি এগুলো খুব অবাক করা ব্যাপার? না। কারও কাছেই নয়। এসব সবই খুবই স্বাভাবিক। কেন এমন? কেন এই প্রশ্নটি কেউ করে না, যে, বিয়ে কেন মেয়ের জীবনকে পাল্টে দেয়, ছেলের জীবনকে নয়?

শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা নারীকে সম্পূর্ণ স্বাধীন মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে দেয়, এ কথা অনেক নারীবাদীরাও বলে। ভুল বলে নিশ্চয়ই। ভুল না হলে নামী অভিনেত্রী যে কিনা শিক্ষিত এবং অঢেল টাকাকড়ির মালিক, ভীষণভাবে স্বনির্ভর, তাকে কেন স্বামীর ইচ্ছের যূপকাষ্ঠে বলি হতে হয়? তবে কি এই সত্য যে এই স্বামী সংসার ব্যাপারটির মধ্যেই যত গঞ্জগোল! কারণ এখানে মেয়েরা এখনও বন্দি, মেয়ে শিক্ষিত হোক কী অশিক্ষিত হোক, স্বনির্ভর হোক না হোক, সকলের জন্য একই নিয়ম। স্বামী সেবা কর, স্বামীর আদেশ নির্দেশ পালন কর, স্বামীর সন্তান উৎপাদন কর, সন্তান লালন পালন কর — এই নিয়মটির নাম পুরুষতন্ত্র, জগতের সকল নারী এই তন্ত্রের শিকার। পুরুষেরা যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখছে এই নোংরা কুৎসিত পুরুষতন্ত্র। স্বামীসন্তানসংসারকে মেয়েরা যেন তাদের জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করে, এরকম একটি মন্ত্র মেয়েদের মাথায় আজকাল পুরে দেওয়া হচ্ছে। আগে তো মেয়েদের লেখাপড়া করারই সুযোগ ছিল না, স্বনির্ভর হওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এখন মেয়েদের ইস্কুল কলেজ হচ্ছে, মেয়েরা বিএএমএ পাশ করছে, কিন্তু হলে হবে কী ! পাশ করে হয় গৃহবধূ হয়ে বসে আছে নয়তো চাকরি বাকরি ব্যবসা বাণিজ্য করছে, করছে কিন্তু পুরুষের অনুমতি নিয়ে, বাবার নয়তো স্বামীর নয়তো পুজ্ঞের। মেয়েদের গলায় বা কোমরে শক্ত দড়ি বাঁধা। এই দড়ি খুলে ফেলার সাহস এবং শক্তি কোনওটাই যেন মেয়েদের না থাকে, তার সবরকম ব্যবস্থাই পুরুষেরা করে রেখেছে। পুরুষেরা দড়ি নাড়ে, এই নাড়ায় দড়িতে ঝুলে থাকা মেয়েদের জবুথবু জীবন আর নড়বড়ে ভবিষ্যত নড়ে।

বিখ্যাত নারীবাদী লেখক গ্লোরিয়া স্টেইনেম বলেছেন, ‘আই হ্যাভ ইয়েট টু হিয়ার অ্যা ম্যান আস্কস ফর অ্যাডভাইস অন হাউ টু কমবাইন ম্যারেজ অ্যান্ড এ কেরিয়ার।’

বিয়ে সম্পর্কে অনেক মন্তব্যই করেছেন গ্লোরিয়া। ‘একবার আমাকে একজন জিজ্ঞেস করেছিল, মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা কেন জুয়ো খেলে বেশি। এর কমন সেন্স উত্তর আমার, আমাদের টাকা পয়সা বেশি নেই তাই। ওটা সঠিক কিন্তু অসম্পূর্ণ উত্তর। ইন ফ্যাক্ট উইমেনস টোটাল ইন্সটিংট ফর গ্যাম্বলিং ইজ স্যাটিসফাইড বাই ম্যারেজ।’ আর, গ্লোরিয়ার সেই কথাটা? ‘এ লিবারেটেড উইম্যান ইজ ওয়ান হু হ্যাজ সঙ্গে বিফোর ম্যারেজ এণ্ড এ জব আফটার।’ বিয়ে নিয়ে তিনি বলেছেন, যে, ‘বিয়েটা নারীর চেয়ে পুরুষের জন্য খাটে ভালো।’ ‘ম্যারেজ ওয়ার্কস বেস্ট ফর মেন দ্যান উইমেন। দ্যা টু হ্যাপিয়েস্ট গ্রুপস আর ম্যারেড মেন অ্যান্ড আনম্যারেড উইমেন।’ সবচেয়ে সুখী হল দু ধরনের মানুষ, বিবাহিত পুরুষ আর অবিবাহিত নারী। গ্লোরিয়ার প্রতিটি কথা আগুনের মতো সত্য। ষাটের দশকে যে স্লোগানটি জগতব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ভাবা হত ওটি বুঝি গ্লোরিয়ার। ‘এ উওম্যান উইদাউট এ ম্যান ইজ লাইক এ ফিস উইদাউট এ বাইসাইকেল।’ তন্ত্রে মন্ত্রে বুঁদ হয়ে থাকা নারীর পক্ষে বোঝা শক্ত যে নারীর জীবনে পুরুষের প্রয়োজন নেই, মাছের জীবনে যেমন সাইকেলের প্রয়োজন নেই।

কত মাধুরী, কত কাজল, কত নিতু সিং, কত শ্রীদেবী, কত কারিশমা, কত জানা কত অজানা অকালে ঝরে গেল যেহেতু বিয়ে নামক ঘটনাটি তাদের জীবনে ঘটেছিল। মেয়েদের জন্য বিয়েটা খুব ভয়ঙ্কর। অভিশাপের মতো। পশ্চিমের নারীবাদীরা একসময় বলেছেন, ‘নারী পুরুষের বৈষম্য নির্মূল করতে ততদিন পারবো না, যতদিন না আমরা বিয়েটা নির্মুল করতে পারবো।’

বলেছেন, যেহেতু বিয়ে ব্যাপারটি নারীকে পুরুষের দাসী বানায়, এটা খুব স্পষ্ট যে, নারী আন্দোলনের প্রথম কাজ এই বিয়েপ্রথাটিকে ভেঙে ফেলা। বিয়ের বিলুপ্তি ছাড়া নারীর স্বাধীনতা অর্জন কখনই সম্ভব নয়।

ষাট সঙ্গের দশকে বিয়ে ব্যাপারটির জনপ্রিয়তা পশ্চিমের মেয়েদের মধ্যে মোটেও ছিল না। কিন্তু বিয়ে ফিরে আসছে, দুঃসময় যেমন ফিরে আসে। রক্ষণশীলতা ফিরে আসছে, দুর্যোগের মেঘ যেমন হঠাৎ হঠাৎ ফিরে আসে আকাশ কালো করতে। ভারতবর্ষের অর্ধেক আকাশে তো চিরকালই দুর্যোগের ঘনঘটা। এই ভারতবর্ষে বিয়ের বিলুপ্তি কোনওদিনই হয়নি। চিরকালই মেয়েরা এই প্রথার বলি হয়েছে। আজও হচ্ছে। যে সমাজে নারীর নিজের অধিকার বলতে কিছু নেই, নারীর নিজস্বতা বা আলাদা অস্তিত্ব বলে আদৌ কিছু নেই, যেখানে নিজের নামে স্বামীর পদবী ধারণ করে, শাঁখা সিঁদুর পরে পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করতে হয়, যেখানে নারীকে নিজের বাড়িঘর ছেড়ে পুরুষের বাড়িতে আশ্রয় নিতে হয়, ভবিষ্যত কী হবে তা নির্ধারণ করবে অন্য লোকে, সেখানে বিয়ের কী করে বিলুপ্তি হবে!

এখনও নারীর অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতাকে সত্যিকার স্বনির্ভরতা বলে বিচার করা হয় না। পুরুষের উপার্জনকে যে মূল্য দেওয়া হয়, সে মূল্য নারীর উপার্জনকে দেওয়া হয় না।

পুরুষ উপার্জন করে তিনটে কারণে, প্রথম কারণ টাকা, দ্বিতীয় কারণ স্টেটাস, আর তৃতীয় কারণ স্যাটিসফেকশান। নারীও উপার্জন করে ওই তিনটে কারণে, তবে কারণগুলো প্রথম স্যাটিসফেকশান, দ্বিতীয় স্টেটাস, তৃতীয় টাকা। উচ্চবিত্ত এমনকী মধ্যবিত্তদের আচরণ এমনই, যেন নারীর উপার্জনের খুব প্রয়োজন নেই, শখের জন্য, তৃপ্তির জন্য, যেন ব্যাপারটি টাইমপাসের জন্য।

উপার্জনের প্রয়োজন যেন কেবল নিম্নবিত্ত নারীদের, স্বামীরা বাউন্ডুলে বদমাশ বলে, অল্প পয়সা কামায় বলে, টাকা পয়সা দেয় না বলে, ভাত দেয় না বলে গতর খাটতে হয় বা ঘরে স্বজন-পরিজন উপোসে বলে খাটতে হয়। উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত স্বামীদের স্ত্রীরা খুব খুশি যে তারা গরিব নয়, স্বামীদের পয়সায় তারা বেশ আরাম করতে পারে। এই নারীরা ঘরের শোভা বর্ধনের জন্য বেশ উপকারী বটে। শোভা বর্ধন তো আছেই, একই সঙ্গে সতীত্ব এবং নারীত্ব এবং মাতৃত্ব এবং গৃহবধূত্ব রক্ষা করে তাদের বিবাহিত জীবন সার্থক করতে হয়।

নিজের স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতা রক্ষার জন্য পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা আজও করছে না নারীরা। আজও তারা যত ধনী হোক, যত বিদুষী হোক, যত নামি হোক, দামি হোক, নিজেদের পতনে নিজেরাই প্রশ্রয় দিচ্ছে। এই নারীরাই আবার চোখে ঠুলি এঁেট বলে যে, নারী তার স্বাধীনতা সবটাই পেয়ে গেছে ভারতবর্ষে। একটা কথা তারা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বলে না যে এই ভারতেই প্রতি ২৬ মিনিটে একটি মেয়েকে যৌন হেনস্থা সইতে হচ্ছে, প্রতি ৩৪ মিনিটে একটি মেয়েকে ধর্ষিতা হতে হচ্ছে, প্রতি ৪২ মিনিটে একটি মেয়ে যৌন লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছে, প্রতি ৪৩ মিনিটে একটি করে মেয়েকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে, প্রতি ৯৩ মিনিটে একটি মেয়েকে খুন করা হচ্ছে। এটি সরকারি হিসেব। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যা নিশ্চয়ই আরও তিনগুন বেশি।

মেয়েদের খুন করা হয়, সবচেয়ে বেশি কিন্তু হয় ঘরের ভেতর, স্বামী দ্বারা। নির্যাতন নিষ্পেষণ যা কিছুই মেয়েদের জীবনে ঘটে, পৃথিবীর সর্বত্র একই ঘটনা, ঘটে ঘরে। স্বামীর ঘরের মতো অনিরাপদ এবং অনিশ্চিত জায়গা মেয়েদের জীবনে আর কিছু নেই। স্বামীকে দেবতা মানার রেওয়াজ আছে এখানে। এই দেবতারাই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে স্ত্রীদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ তারা চায় কী না। না চাইলে স্ত্রী যতই প্রতিভার পুকুরে ডুবে থাক, ওখান থেকে স্বামীর অত্রুলিহেলনে উঠে তাকে আসতেই হবে তীরে। যে সংসার নারীকে ছিঁড়ে ছিবড়ে খায়, সেই সংসারে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য নারীর যে আকুলতা, সেটি কি নারীর নিজের নাকি বাইরের? শেখানো?

আমার বিশ্বাস এটি শেখানো। আমার বিশ্বাস আত্মসম্মানবোধ অর্জন করলে নারী বিদ্রোহ করবে। নিজের মতো বাঁচবে। নিজের মতো যে বাঁচাটাকে সবচেয়ে ভয় পায় পুরুষ এবং তার তন্ত্র মন্ত্র, তার শাসন করা সমাজ। পুরুষের কি আজও ভয় পাওয়ার, ভেঙে যাওয়ার, হাহাকার করার সময় আসেনি? আর কতকাল নারীরা কোলে কাঁখে রেখে অমানুষ করবে পুরুষজাতকে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *