পিহাঁ থা দাম সখ করীব আশিয়াঁ-কে,
উড়নে নহ্ পায়ে হে কেহ্ গিরফতার হুয়ে।
(ফাঁদ পাতা ছিল বাসার খুব কাছে,
উড়তে-না-উড়তেই ধরা পড়ে গেলাম আমি।)
অনেকক্ষণ ধরে আপনার উসখুস করছেন, বুঝতে পারছি, ভাইজানেরা। মির্জাসাব বড় ভারী কিস্সা শোনালেন, কিন্তু আমরা হচ্ছি রাস্তার কুত্তা, পেটে ঘি সইবে কেন? দেখুন, দেখুন মির্জাসাব, আমাদের লোম খসতে শুরু করেছে। চিন্তা নেই ভাইজানেরা, এই মান্টো আছে কী করতে, আপনাদের জন্য এর মধ্যেই ডাস্টবিন থেকে হাড়গোড় কুড়িয়ে এনেছি, বেশ মজা করে চিবোতে পারবেন।
মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই মির্জাসাব, আমিও শালা কী করে ফাঁদে পড়ে গেলাম! বম্বেতে এসে মস্তিতেই দিনগুলো কাটছিল; খোলিতে থাকলেও একা একা থাকার মজাই আলাদা, ঝাড়া হাত -পা, কারুর কাছে কৈফিয়েত দেওয়ার নেই, যেমন খুশি বাঁচো, সেই যেমন হাফিজসাব বলেছিলেন,
ইশক্ বাযী ব জবানী
ব শরাবে লালা ফাম
মজলিসে ইন্স ব হরীফে
হমদব ব শুর্বে মুদাম।
মানেটা বুঝলেন তো ভাইজানেরা? যৌবন দাও, প্রেম দাও, লাল সুরা দাও, আসর ভরে উঠুক সাঙ্গোপাঙ্গে, যেন প্রিয় বন্ধু পাই, খাবারদাবারটুকু যেন মিলে যায় খোদা। একা মানুষ আর কী চাইতে পারে? এভাবে বেঁচে থাকার মতো স্বাধীনতা আর আছে? কিন্তু শালা মান্টোও ফাঁদে পড়ে গেল। ভাইজানেরা, সেই কিস্সাটাই এবার আপনাদের বলছি।
বিবিজান তো অমৃতসর থেকে বম্বেতে এসে পৌঁছল। আমার দিদি ইকবাল বেগমের বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হল। খোলিতে আমিই দুমড়ে-মুচড়ে জীবন কাটাই, সেখানে তো আর আম্মিজানকে নিয়ে আসা যায় না। বিবিজানের সঙ্গে আমি রাস্তায় দেখা করতাম, কোনও চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে গল্প করতাম। দিদির বাড়িতে তো আমার মতো কাফেরের ঢোকার অনুমতি নেই। ইকবাল বেগমের বাদশা তো আমাকে সহ্য করতে পারত না। বিবিজান রোজই বলে, বেটা তুমি কোথায় থাকো, আমাকে নিয়ে চলো। আমি তো তোমার। জন্যই এসেছি। কিন্তু ওই খোলিতে তো বিবিজানকে নিয়ে যাওয়া যায় না। সত্যি বলতে কী, মানুষ কত নোংরা ভাবে বেঁচে থাকে, তা আমি বিবিজানকে দেখাতে চাইনি। তার সুন্দর। মনটাকে নষ্ট করে দেওয়াটা কি ঠিক, বলুন? কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি আটকাতে পারিনি। বিবিজান একদিন আমার সঙ্গে সঙ্গে খোলিতে এলোই। অন্ধকার খুপরিটার চারদিকে চোখ চালিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর তার দুই চোখ থেকে জলের ধারা নামল। বিবিজানকে এমনভাবে আমি কখনও কাঁদতে দেখিনি। আমার চোখ তো জ্বালা করছিল। তবু হেসে বললাম, একজন মানুষের এর চেয়ে বড় ঘরের কী দরকার বলো?
-মান্টো
বিবিজান আমার হাত চেপে ধরে নোংরা বিছানার ওপর বসে পড়ল। আমি তার পাশে বসে মাথায়, পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে শান্ত করার চেষ্টা করছিলাম। তবু বিবিজানের কান্না থামে না আর মাঝে মাঝেই বলে ওঠে, খোদা, ইয়ে মুঝে কেয়া দিখায়া! অনেক পরে কান্না থামল, কোনও কথা না-বলে বিবিজান আমার নোংরা জামাকাপড়গুলো এখানে-ওখানে জড়ো করতে লাগল।
-আরে, এসব কী করছ তুমি বিবিজান?
-এখনই আমার সঙ্গে যাবে।
-কোথায় যাব?
-ইকবালের বাড়িতে।
-বিবিজান, তুমি তো জানো, ও-বাড়িতে আমার জন্য নত ছাড়া আর কিছুই নেই।
-তাই বলে এই জাহান্নমে-
-আমি ভাল আছি, বিবিজান। খোদা কসম, খুব ভাল আছি। ঘৃণার দাওয়াত খাওয়ার চেয়ে। একা একা এভাবে থাকা অনেক আনন্দের।
বিবিজান চুপ করে বসে রইল। আমি তার কাধে হাত রেখে বললাম, চলো তোমাকে পৌঁছে। দিয়ে আসি। এজন্যই তোমাকে এখানে আনতে চাইনি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি, বিবিজান। অনেকক্ষণ নিজেকে সামলে রাখার পর আমি আর পারিনি, মির্জাসাব, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম। আমি খোলিতে থাকি বলে নয়, বিবিজানকে এই নরক- জীবন দেখতে হল বলে।
দীর্ঘ বছর পর, যেন আমি ছোট্টটি, বিবিজান আমাকে জড়িয়ে ধরে কত যে চুমু খেল আর কোরানের একটাই রুকু বিড়বিড় করে বলে যাচ্ছিল। কী যে বলছিল, আমি বুঝতেও পারছিলাম না। কোরান তো কখনও পড়িনি। মরে যাওয়ার আগের যে রাতে আমি রক্তবমি করছিলাম, তখনও মাঝে মাঝে যেন বিবিজানের ওই বিড়বিড়ানি শুনতে পাচ্ছিলাম, সেই প্রথম আমার মনে হয়েছিল, কথাগুলো যদি বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারলেই বা কী হত? তখন তো শুধু অন্তিমের অপেক্ষা।
রাস্তায় যেতে যেতে বিবিজান বলল, তুমি আর একটু বেশি রোজগার করতে পারো না?
-কেন?
-তাহলে এই কিচরের মধ্যে—
-আমি ভালই আছি বিবিজান। বেশিটাকা দিয়ে কী করব বল তো? যা রোজগার করি, তাতে আমার বেশ চলে যায়।
-না চলে না, আমি জানি। লেখাপড়া বেশি দূর করলে না, বেশি রোজগারই বা করবে কী করে? বিবিজানের ওপর আমি কখনও রাগ করিনি। কিন্তু তার এই কথাটা শুনে আমার মেজাজ গরম হয়ে গেল। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, আমি তো বললাম, যা রোজগার করি, তাতে আমার চলে যায়। লেখাপড়া না শিখেও অনেক টাকা রোজগার করা যায়।
-তুমি চেষ্টা করো না কেন?
এবার আমার মজা করার ইচ্ছে হল। আমার এই মজাই হল কাল। আমি বলে ফেললাম, কার জন্য আরও বেশি টাকা কামাব বলল তো? বিবি থাকলে দেখতে, আমিও কত কামাতে পারি।
-শোভানাল্লা। নিকে করতে চাও?
-হ্যাঁ। না করার কি আছে?
এসব হচ্ছে কথার পিঠে কথা। কিন্তু কথাটা বলে কী যে বেওকুফি করে ফেললাম, তাও বুঝতে পারিনি। বিবিজান আমাকে পরের সপ্তাহে মাহিমে যেতে বলল। ইকবালরা মাহিমেই থাকত। মির্জাসাব, নিজেকে ধরার ফাঁদ আমি আমি নিজেই পাতলাম। কিন্তু তখনও বুঝতে পারি নি। বুঝতে পারলাম পরের রবিবার মাহিমে গিয়ে।
ইকবালের বাড়ির সামনের রাস্তায় দাড়িয়েছিলাম। বিবিজান চারতলার জানলা দিয়ে আমাকে দেখতে পেয়ে নেমে এল।
-আসতে বলেছ কেন?
-আমার সঙ্গে চলো বেটা।
-কোথায়?
-আরে সামনেই। চলো না–
-ব্যাপার কী বলো তো?
-তোমার বিবি ঠিক করেছি।
-মানে?
বিবিজান হেসে বলল, শফিয়া, বড়ি আচ্ছি বেটি। তোমাকে ঠিক সামলে রাখতে পারবে।
-আমি নিকে করব, কে বলেছে?
-কেন? সেদিন তুমিই তো বললে,বেটা। শফিয়াকে যেদিন দেখি, আমার খুব মনে ধরেছিল। ফিরে এসেই ওর চাচার সঙ্গে কথা বললাম। আমরা কাশ্মীরি, ওরাও কাশ্মীরি, এককথায় রাজি।
-বিবিজান-
-তকলিফ কেয়া হ্যায়?
-আমার রোজগার তো তুমি জান? এভাবে নিকে করা যায়?
-বিবি এলে সব ঠিক হয়ে যাবে। চলো-চলো-শফিয়াকে দেখলে তোমারও পছন্দ হবে।
বিবিজান আমার হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে চলল। আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু বিবিজানের শক্তমুঠোয় আমার হাত।
জলহস্তীর মতো একটা লোকের সামনে বসিয়ে বিবিজান ভেতরে চলে গেল। তাঁর নাম মালিক হাসান, শফিয়ার চাচা, চাকরি করতেন গোয়েন্দা বিভাগে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন। আমিও বলে যেতে লাগলাম এবং সুযোগ বুঝে জানিয়ে দিলাম যে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আমার পানাভ্যাস আছে। আমি তো ফাঁদ কেটে বের হতে চাইছি। এই নিকে কখনও হয় নাকি? এরা রইস আদমি আর আমি তো বম্বেতে রাস্তার কুকুর।
সব শুনে হাসানসাহেব পায়চারি করতে করতে বলতে লাগলেন, বহৎ খুব, বহৎ খুব। তারপর কাকে যেন ডেকে বললেন, বহিনজিকে বোলাও। একটু পরেই বিবিজান এসে হাজির। হাসানসাব বিবিজানের হাত চেপে ধরলেন, ক্যায়সি বেটা বানায়া বহিনজি।
বিবিজান আমার দিকে তাকায়। আমি তখন মনে মনে ভাবছি, আবার আমাদের দুজনকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া হবে। এর চেয়ে খুশি আর কী হতে পারে?
-বাত খতম্।
-মতলব? বিবিজানের ফ্যাসফেসে গলা শুনতে পাই।
-নিকাহ পাক্কা। প্রথম কথা কাশ্মীরি পরিবার ছাড়া আমি শফিয়ার বিয়ে দেব না। আর আপনার বেটা। একদম সাফ দি। হর রোজ পিতে হ্যায়, এ ভি কবুল কিয়া। হামকো সাচ্চা আদমি চাহিয়ে।
মির্জাসাব, এ কেমন বদনসিব আমার বলুন, মালিক হাসানের মত গোয়েন্দা অফিসার আমাকে সাচ্চা আদমি মনে করলেন? হিরামান্ডির রাতগুলোর কথা না বলে কী যে ভুল করেছিলাম! এরপর যে কাণ্ডটা ঘটল, তাতে আমিই নিজেকে ফাঁসিয়ে দিলাম। হাসানসাব বললেন, বহিনজি, বিটিয়া কো লে আইয়ে।
শফিয়া এল। ওড়নায় মুখ ঢাকা। অস্পষ্ট, ছায়া- ছায়া, দেখলাম তাকে। তাকে ছুঁতে ইচ্ছে। করল, সেই প্রথম বুঝতে পারলাম, আমি একা থাকবার মতো মানুষ নই, আমার একাকিত্বের জন্যও পাশে কাউকে দরকার। সারা জীবন ধরে আমার ওই খামখেয়ালির মূল্য দিতে হয়েছে শফিয়া বেগমকেই। যখন আমরা দুয়েকদিন ভাল থাকতাম, আমি নিজেকে বলতাম, কী হবে মান্টো এইসব লেখা লিখে? তুমি অন্তত একজন মানুষকে সুখী করো। কাগজ কলম জ্বালিয়ে দাও। তুমি তার বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে থাকো, সে তোমার চুলে অদৃশ্য সব তসবির এঁকে দিক, তুমি ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ো।
আমার নিকাহ-র দিন ঠিক হয়ে গেল। বিশ্বাসই হতে চায় না আমার। এসব তো স্বপ্নেও কখনও ভাবিনি। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। পকেটে ফুটো পয়সা নেই, আমি যাব নিকে করতে? বিবিজানকে কত বোঝালাম, সে কিছুতেই আমার কথা শুনবে না, সে শুধু বলে, বেটা সব ঠিক হয়ে যাবে। বিবি তোমার নসিব বদলে দেবে। খোদার ইচ্ছে না থাকলে তো হাসানভাই রাজি হতেন না।
আমি আর কী করি, নসিবের হাতেই নিজেকে ছেড়ে দিলাম। নৌকো ভাসালাম, দরিয়া, এবার তুমি যেখানে পারো নিয়ে চলো। তখন কিছুদিন ইম্পিরিয়াল ফিল্ম কোম্পানিতে গল্পলেখক হিসেবে পার্ট-টাইম কাজ করছিলাম। তা সে কোম্পানিরও তখন লাটে ওঠার দশা। নইলে কিছু টাকা আগাম পাওয়া যেত। হঠাৎ মনে পড়ল, কোম্পানির কাছে আমিই তো শালা দেড় হাজার টাকা পাই, শেঠ আরদেশারকে গিয়ে ধরলাম টাকার জন্য। শেঠের তখন অবস্থা খুবই খারাপ। টাকা দিতে পারলেন না, তবে আমার হবু বিবির জন্য কিছু গয়নাগাঁটি, শাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। ভাবুন ভাইজানরা, আমার পকেটে একটাও পয়সা নেই, অথ বিবির শাড়ি-গয়না জোগাড় হয়ে গেল। এরই নাম মান্টো ম্যাজিক। এ তো আমি একা একাই নিকাহ্-র সব জোগাড়যন্তর করে ফেললাম। এভাবেই একটু একটু করে শফিয়াকে ভালবেসে ফেলেছিলাম।
শেষ পর্যন্ত শালা মান্টোর নিকে হয়ে গেল। শফিয়া ওর চাচার কাছেই রয়ে গেল, আমি ফিরে এলাম খোলিতে। হ্যাঁ ভাইজানেরা, ওই নিকাহ্ দিনেই। ছারপোকা ভরা বিছানায় শুয়ে ভাবছিলাম, শালা সত্যিই আমার নিকে হয়েছে তো আমার? নাকি খোয়াব দেখছিলাম? আমার পকেটে তখনও শুকনো খেজুর, এলাচ। তার মানে আজই তোমার নিকে হয়েছে মান্টো। তবু বিশ্বাস হচ্ছিল না। পগল না হলে কেউ তার মেয়ের সঙ্গে মান্টোর বিয়ে দেয়?
বছরখানেক কেটে গেল। শফিয়া ওর চাচার বাড়িতে, আমি আমার খোলিতে। হাসানসাহেব অনেকদিন ধরেই চাইছিলেন, আমরা যাতে একসঙ্গে থাকি। কিন্তু বিবিকে তো ওই খোলিতে নিয়ে তোলা যায় না। শেষ পর্যন্ত আমিও আর পারলাম না। কে পারে বলুন, ভাইজানেরা? কচি বউ তোমার থাকবে এক জায়গায়, আর তুমি নোংরা বিছানায় রোজ তার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়বে? মাসে ৩৫ টাকা ভাড়ায় একটা ফ্ল্যাট নিয়েছিলাম। এও মান্টো-ম্যাজিক। মাইনে আমার ৪০ টাকা, আর ফ্ল্যাটের ভাড়াই ৩৫ টাকা। সারা মাসের খরচের জন্য ৫ টাকা।
কিন্তু প্রোডিউসার নানুভাই দেশাইয়ের কাছে তখন আমি আঠেরশো টাকা পেতাম। তাঁর সিনেমার জন্য কয়েকটা গল্প লিখে দিয়েছিলাম। বিবিকে ঘরে নিয়ে আসার দিন তো দাওয়াতেরও বন্দোবস্ত করতে হবে। নানুভাইকে গিয়ে ধরলাম টাকার জন্য। শালা একবার হাসে তো একবার কাঁদে, আর বলে, দেখুন মান্টোসাব, নিজের চোখে দেখুন, আমার পকেট একদম ফুটা। আমি কোথা থেকে টাকা দেব আপনাকে?
শেঠকে সব খুলে বললাম, তবু সে কিছুতেই বোঝে না। শেষে হাতাহাতি হওয়ার মতো অবস্থা। নানুভাই তার লোক ডেকে তার অফিস থেকে বার করে দিল। আমিও ঠিক করলাম টাকা না পেলে অফিসের দরজা থেকে নড়ব না। দরকার হলে অনশন শুরু করব। এরা গল্পলেখককে কী ভাবে? গল্প নিয়ে কৃতার্থ করে দিয়েছি? গল্পলেখক পেটে কিল মেরে বসে থাকবে, তাই না? শালা, সবাইকে সব কিছুর জন্য তোমরা টাকা দিতে পারো, আর গল্প নেবে মুফতে? লেখা কি লাওয়ারিশ নাকি? খবরের কাগজেও আমি এক জিনিস দেখেছি। গল্পলেখকের জন্য সবচেয়ে কমটাকা বরাদ্দ। কেন ভাই? খোয়াবের কোন দাম নেই নাকি? দুনিয়াটাকে তোমরা টাকা দিয়ে বিচার করো, আর খোয়াবটাই ফেলনা?
নানুভাই -এর সঙ্গে আমার লড়াইয়ের খবরটা বাবুরাও প্যাটেলের কানে গিয়ে পৌঁছেছিল। শুনেছি, উটের শরীরের কোন অঙ্গই নাকি সোজা নয়। তা হলে উটের পরেই বাবুরাওয়ের নাম আসবে। কথায় কথায় শালা-বাঞ্চোত বলে গালাগালি দিতেন। চোখ দুটো ছোটো ছোটো, মোটা নাক, ঠোঁট, ক্ষয়ে যাওয়া দাঁত, তবে কপাল বেশ চওড়া ছিল। ফিল্ম ইন্ডিয়া-র সম্পাদক বাবুরাও কারবা নামেও একটা উর্দু পত্রিকা চালাতেন। সেখানে কয়েকমাস আমি চাকরি করেছিলাম। শুনেছি, যৌবনেই বাবার সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বাবার কথা উঠলেই বলতেন, ও শালা একটা আস্ত হারামি। শুনে হাসি পেত। বুড়ো প্যাটেল যদি সত্যিই হারামি হয়ে থাকেন, তা হলে বাবুরাও হারামিপনায় তার চেয়ে কয়েক পা এগিয়েই ছিলেন। আর মেয়ে দেখলেই হয়, অমনি তার পিছেন পড়ে যাবেন। রিটা নামে ওঁর এক সেক্রেটারি ছিল জানেন, মির্জাসাব। সবার সামনেই রিটার পেছনে চাপড় মেরে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতেন। তো বাবুরাওজি নানুভাইকে ফোন করে একচোট ঝাড়লেন, শেষে নিজেই নানুভাইয়ের অফিসে এলেন। অনেক দর কষাকষি করে আটশো টাকায় রফা হল। আমাকে আর দেখে কে? কড়কড়ে টাকা হাতে পেয়ে আমি তো একেবারে বাদশা।
শফিয়ার জন্য শারী-গয়নাগাটি আর নিজের জন্য এক বোতল জনি ওয়াকার কেনার পর দেখি, পকেটের অবস্থা আগের মতোই ফাঁকা। নতুন ভাড়া নেওয়া ঘরে ঢুকে হঠাৎ মনে হল, আরে ঘর তো আমার পকেটের চেয়েও ফাঁকা। আসবাবপত্র বলে তো কিছু ছিল না। তবে, আমি দেখেছি, ভাইজানেরা, মানুষ সবসময়ই মানুষের পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার পাশেই থাকত একটা পরিবার। তো সেই পরিবারের বাবুটি কিস্তিতে কিছু আসবাব কেনার ব্যবস্থা করে দিল। তাতেও দুটো ঘর মরুভূমির মতোই মনে হচ্ছিল।
বাড়িতে বিবি আসবে, একটা তো দাওয়াতের ব্যবস্থা করতে হয়। নাজির লুধিয়ানভিসাব কার্ড ছেপে দিলেন। বেশ জোড়দার পার্টি হল। ফিলিমের সব লোকজনরাই এসেছিল।-কারদার সাব, গুঞ্জলি, বিলিমোরিয়া সাব, বাবুরাওজি, নূর মহম্মদ, পদ্মা দেবী, আরও কত যে। পদ্মা দেবীকে কেউই তেমন চিনত না। কিন্তু বাবুরাওজি-র হাতে পড়ে তার ভোল পাল্টে গেছিল। বাউরাওজি তাকে একেবারে কালার কুইন বানিয়ে দিলেন। ফিল্ম ইন্ডিয়ার প্রত্যেক সংখ্যায়। তাঁর ছবি, নিজে হাতে ক্যাপশন লিখে দিতেন বাবুরাওজি। খেলাটা বুঝতে পারছেন তো ভাইজানেরা? ফিলিমের দুনিয়াটাই এমন। ঠিক লোকের বিছানায় যেতে পারলে, তাকে আর পায় কে!
জমজমাট দাওয়াত হয়েছিল। খাওদাওয়ার ব্যাপারে, মির্জাসাব, আমি একেবারে আপনারই মতো। এ-ব্যাপারে কোন ভেজাল বা কঞ্জুষি চলবে না। সব রান্না হয়েছিল একেবারে কাশ্মীরি স্টাইলে। বাবুরাওজি নাচ জুড়ে দিলেন, ওদিকে রফিক গজনবি, নন্দা আর আগা কাশ্মীরি সমানে এ-ওকে খিস্তি করে যাচ্ছে। যাকে বলে নরক গুলজার। সব শেষ হওয়ার পর বিলিমোরিয়া সাবের গাড়িতে চড়ে বিবিজান, আমি,শফিয়া নতুন ঘরে এসে উঠলাম। কী বলব, ভাইজানেরা, পরদিন দেখি, আমার অর্ধেকটা শফিয়ার শওহর হয়ে গেছে। তবে ভালও লেগেছিল খুব। এই অনুভূতির স্বাদই আলাদা। পরদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ফিরে বোতল খুলে বসেছি, শফিয়া এসে আমার হাত চেপে ধরল। সে যে নতুন বিবি, তার কোনও লক্ষণই নেই। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, এসব খাবেন না মান্টোসাব।
-কেন?
-আপনার শরীরের ক্ষতি হবে।
-না খেলে আমি লিখতেই পারব না।
-লেখার জন্য শরাব খেতে হয় বুঝি।
-তা নয়
-তবে ছেড়ে দিন।
-ঠিক হ্যায়। আজকের দিনটা তো খেতে দাও।
-না, আর একদিনও নয়।
-আজ খুব আনন্দের দিন শফিয়া।
-কেন?
-তোমাকে প্রথমবার কাছে পেয়েছি।
-তা হলে শরাব লাগবে কেন?
-লাগবে, লাগবে। আমি তার কোমড় জড়িয়ে ধরলাম। না হলে বিছানায় তুমি আসল মান্টোকে পাবে কী করে? শফিয়া হাসতে হাসতে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিল। শফিয়া ছিল এইরকমই সহজ, সোজা, মনের কথা স্পষ্ট বলতে পারত, সোজাভাবে যেমন আপত্তি জানাত, তেমন ভালবাসতেও পারত, কোনও ভণিতা ছিল না। কিন্তু মান্টোর সঙ্গে ওর জীবনটা জড়িয়ে যাওয়া ঠিক হয় নি, ভাইজানেরা। মান্টো নিজের সঙ্গেই লুকোচুরি খেলতে খেলতে বড় হয়েছে। খোলা রাস্তার বদলে গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতেই তার ভাল লাগত। শফিয়া অনেক চেষ্টা করেছিল, তবু শরাব থেকে আমাকে সরিয়ে আনতে পারেনি। নেশার জন্য কত মিথ্যা কথা বলেছি, ওর সঙ্গে জোচ্চুরি করেছি। হ্যাঁ, মির্জাসাব, মাঝে মাঝে বেশ কিছুদিনের জন্য খাওয়া ছেড়ে দিতাম। বেশ ভালো লাগত তখন, মনে হত, নতুন করে জন্ম হয়েছে। কিন্তু তারপর আবার। ওই পথ কেটে আমি আর সারা জীবনে বেরোতেই পারলাম না। অনেক পরে শফিয়া একদিন বলেছিল, মান্টোসাব আপনি কাহানি না লিখলে, আমাদের জীবনটা এভাবে নষ্ট হয়ে যেত না। হয়ত তাই।