চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ
আগে নিজের ভুলের কথা বলুন
কয়েক বছর আগে, আমার ভাইঝি জোসেফাইন কার্নেগী কানসাস সিটির বাড়ি থেকে নিউইয়র্কে আমার সেক্রেটরির কাজ করতে আসে। ওর বয়স উনিশ, তিনবছর আগে উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ও স্নাতক হয়। তবে ওর ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতার ঝুলি ছিলো শূন্য। আজ সে সুয়েজ খালের পশ্চিম এলাকার মধ্যে সবসেরা একজন সেক্রেটারি। তবে গোড়ার দিকে সে অনেক কিছুই জানতো না। একদিন আমি যখন ওকে একটু সমালোচনা করতে গেলাম, আমি নিজেকেই বললাম এক মিনিট দাঁড়াও ডেল কার্নেগী, এক মিনিট দাঁড়াও। তোমার বয়স জোসেফাইনের দুগুণ। তোমার ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতাও দশহাজার গুণ বেশি। তুমি কেমন করে আশা কর যে তোমার মতই দৃষ্টিকোণ, বিচার বুদ্ধি, আগ্রহ ইত্যাদির অধিকারী হবে-তোমার সে বিচার বুদ্ধি যত সাধারণই হোক? এক মিনিট দাঁড়াও। ডেল, তুমি ঊনিশ বছর বয়সে কি করেছো? মনে পড়ে তোমার সেই ভুলগুলো? বোকার মত তোমার সেই সব ভুল। মনে করে দেখ তুমি এই সব করেছো….তাছাড়া…?’
বেশ কিছুক্ষণ সব ব্যাপারটা ঠাণ্ডা মাথায় আর নিরপেক্ষতার সঙ্গে ভেবে নিয়ে আমি স্থির সিদ্ধান্ত করলাম যে জোসেফাইনের ব্যাটিংয়ের গড় আমার উনিশ বছর বয়সের ব্যাটিং গড়ের চেয়ে ঢের ভালো আর–আর আমি দুঃখিত যে জোসেফাইনকে তার প্রাপ্য প্রশংসা দিতে চাইছি না।
অতএব এরপর থেকে জোসেফাইনের কিছু ভুল ধরিয়ে দেবার আগে আমি বলতাম, একটা ভুল করেছ, জোসেফাইন। তবে ইশ্বর জানেন, আমি যা ভুল করি তার চেয়ে খারাপ নয় এগুলো। তুমি তো বিচার বুদ্ধি নিয়ে জন্মাও নি, এসব আসে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তোমার বয়সে আমি যা ছিলাম তার চেয়ে তোমার অবস্থা ভালো। তোমার মত বয়সে আমি যেসব বোকার মত ভুল করেছি তাতে তোমাকে আর সমালোচনা করার মত ইচ্ছে নেই। কিন্তু ভেবে দেখ তুমি অন্য রকম হলে আরও ভালো হতো। তাই না?
নিজের ত্রুটির কথা বক্তা আগেই শোনাতে চাইলে শ্রোতার পক্ষে তার সমালোচনা শোনা সহজই হয়।
১৯০১ সালে প্রিন্স ফন বুলো এরকম ব্যবহার করার তীব্র প্রয়োজন অনুভব করেন। ফন বুলো তখন জার্মানীর ইম্পিরিয়াল চ্যান্সেলর ছিলেন। সিংহাসনে তখন ছিলেন দ্বিতীয় উইলহেলম-উইলহেল্ম অত্যন্ত বদমেজাজী আর অহঙ্কারী ছিলেন। এই উইলহেলম ছিলেন জার্মান কাইজারদের মধ্যে শেষ যিনি মহাশক্তিশালী সেনাদল আর নৌবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই সেনাবাহিনী নিয়ে তার অত্যন্ত অহঙ্কারও ছিলো। ঐ বাহিনী দিয়ে তিনি নাকি যা ইচ্ছে তাই করতে পারতেন।
একবার একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। কাইজার এমন সব কথা বলতে লাগলেন আর অস্বাভাবিক রকম করতে লাগলেন যে সারা ইউরোপ কেঁপে উঠে একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল। যার রেশও ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবী জুড়ে। ব্যাপারটা আরও খারাপ করে তুলতে কাইজার স্বয়ং আত্মম্ভরিতাপূর্ণ, বোকামি ভরা অদ্ভুত সব ঘোষণা করতে লাগলেন জনসাধারণের কাছে। তিনি এসব করলেন ইল্যাণ্ডে যখন তিনি অতিথি হিসেবে ছিলেন। আরও মজার কথা হল রাজকীয় বদান্যতায় এসব তিনি ডেইলি টেলিগ্রাফে প্রকাশ করতেও দিলেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, জার্মান হিসেবে তিনিই একমাত্র মানুষ যে ইংল্যাণ্ডের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন। তিনি জাপানের বিরুদ্ধে এক নৌবাহিনী গড়ে তুলছেন এবং তিনিই একমাত্র লোক যিনি রাশিয়ার আর ফ্রান্সের হাতে ইংল্যাণ্ডের হেনস্থা আটকান। একমাত্র তারই পরিকল্পনায় ইংল্যাণ্ডের মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকায় বুয়র যুদ্ধে জয়লাভ করে…ইত্যাদি।
একশ বছরের মধ্যে শান্তির সময় কোন ইউরোপীয় রাজার মুখ থেকে এ ধরনের অদ্ভুত কথা বেরোয়নি। সারা মহাদেশে এ নিয়ে হৈ চৈ পড়ে গেল। ইংল্যাণ্ডে সকলে ক্ষেপে আগুন। জার্মানীর রাজনীতিকরা শিউরে উঠলেন। এই রকম হৈ হট্টগোলে কাইজার ভয় পেয়ে গেলেন আর ইম্পিরিয়াল চ্যান্সেলর ফন বুলোকে বললেন যে, তিনি যেন সকলকে জানিয়ে দেন এসব কিছুর দায়িত্ব তারই। তিনিই সম্রাটকে এই অদ্ভুত কথাগুলো বলার জন্যে উপদেশ দেন।
ফন বুলো প্রতিবাদ করে বললেন, ‘কিন্তু মহান সম্রাট, জার্মানী বা ইংল্যাণ্ডের কেউ বিশ্বাসই করবেন আমি আপনাকে এমন উপদেশ দিতে পারি।’
যে মুহূর্তে কথাগুলো ফন বুলোর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো তিনি বুঝতে পারলেন যে মারাত্মক একটা ভুল করেছেন। কাইজার ক্ষেপে উঠলেন।
‘তুমি আমায় গাধা মনে করো? তিনি চিৎকার করে উঠলেন। তুমি যে ভুল করতে পারো না ভাবো আমি তাই করতে পারি।’
ফন বুলো বুঝলেন সমালোচনার আগে তার প্রশংসা করা উচিত ছিল। তবে দেরী হয়ে গেছে, তখন সেই অবস্থায় সবচেয়ে যা ভালো তিনি তাই করলেন। সমালোচনার পর তিনি প্রশংসা করলেন। আর তাতে অলৌকিক কাণ্ড ঘঠে গেল–প্রশংসায় যা হয়।
তিনি শ্রদ্ধার সঙ্গে বললেন ‘আমি কখনই তা বলছি না’, ‘অনেক ব্যাপারেই সম্রাট আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ, শুধু নৌবাহিনী বা সামরিক ব্যাপারেই নয়। তারচেয়েও আপনার গভীর জ্ঞান আছে বিজ্ঞানে। আমি বহুবার অবাক হয়ে শুনেছি সম্রাট কি চমৎকার ভাবে ব্যারোমিটার, বেতার টেলিগ্রাফ বা রঞ্জন রশ্মি সম্পর্কে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। রসায়ন বা পদার্থ বিদ্যায় আমার কোনই জ্ঞান নেই, স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনার সম্বন্ধে ও আমার কোন ধারণাই নেই। ফন বুলো বলে চললেন, এর ক্ষতিপূরণ স্বরূপ যেহেতু আমার কিছু ঐতিহাসিক জ্ঞান আছে’ এটা বিশেষ করেই কাজে লাগে কূটনীতিতে।
কাইজার খুশি হয়ে উঠলেন। ফন বুলো তার প্রশংসা করেছে। ফন বুলো তাঁকে উঁচুতে তুলে নিজের সমালোচনা করেছে। এসবের পর কাইজার ওর সব অপরাধই ক্ষমা করলেন। তিনি তাই উৎসাহের সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তোমাকে বলিনি যে আমরা দুজনে দুজনের পরিপূরক? আমাদের দুজনে একসাথে থাকা উচিত আর তা থাকবোও।‘
তিনি ফন বুলোর সঙ্গে একবার নয় বেশ কয়েকবার করমর্দন করলেন। শুধু তাই নয় ওইদিনই একসময় তিনি বেশ উৎসাহের সঙ্গে ঘুসি পাকিয়ে বললেন, কেউ যদি প্রিন্স ফন বুলোর বিরুদ্ধে কিছু বলে তাহলে তার নাকে ঘুসি মারবো।’
ফন বুলো সময় মতই নিজেকে বাঁচাতে পেরেছিলেন–কিন্তু কৌশলী কূটনীতিক হয়েও তিনি একটা ভুল করেন। তার উচিত ছিল সম্রাটকে প্রশংসা করে নিজের সমালোচনা করে শুরু করা। তার মোটেই উচিত হয়নি। সম্রাটকে বুদ্ধিহীন বলা কিংবা তাঁর একজন অভিভাবক দরকার ইত্যাদি ইঙ্গিত করা।
যুদ্ধ কাইজারকে যদি কিছু আত্মসমালোচনার কথা শান্ত করতে পারে আর তাকে বন্ধু করে তুলতে সক্ষম হয়, তাহলে ভেবে দেখুন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এই রকম কাজ মানুষকে কি করতে পারে: মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ঠিক ভাবে ব্যবহার করলে এতে ভোজবাজীর মতই কাজ হয়।
অতএব কারও মধ্যে ক্রোধ বা অসন্তোষ না জাগিয়ে তাকে পরিবর্তিত করতে তিন নম্বর নিয়ম হল : অপরের সমালোচনা করার আগে নিজেকে সমালোচনা করুন।