২৪ আগস্ট, মঙ্গলবার ১৯৭১
দিনগুলো যেন কি একরকম নেশার ঘোরে কেটে যাচ্ছে। রুটিনটা অনেকটা এরকম: আমি সকালে উঠেই একগাদা রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিই, রুমী প্রায় প্রায়ই দুএকজন বন্ধু সঙ্গে নিয়ে আসে। কখনো খায়, কখনো খায় না; তবু খাবার সব সময় মজুত রাখি–যদি এসেই বলে খিদে লেগেছে, খেতে দাও। মাঝে মাঝে দুএকটা রাত বাসায় থাকে, তখন আমাদের মধ্যে আনন্দের ধুম পড়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের বেডরুমে বড় বিছানায় সবাই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিই, বেশির ভাগ সময় রুমীই বক্তা, আমরা প্রশ্নকর্তা।
আলম, বদি, স্বপন, কাজী, চুলু আরো দুএকবার বাসায় এসেছে, এখনো খেয়েছে, কখনো খায় নি। ওরা খেলে আমি খুশি হই, কারণ শুধু ঐ সময়টাতে খাবার টেবিলে ওদের পাই, মুক্তিযুদ্ধ, মেলাঘর, খালেদ মোশাররফ, হায়দার বিভিন্ন বিষয়ে দুচারটে কথা শুনতে পাই। খালেদ মোশাররফকে এতদিন বাঁকার ভাগনে মণি হিসেবেই চিনতাম, এখন মেলাঘরের এই গেরিলাদের মুখে শুনে শুনে তার একটা অন্য ভাবমূর্তি মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে। যে হায়দারকে কোন দিন চোখে দেখি নি, সেও যেন একটা চেহারা নিয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠেছে। এস.এস.জি, অর্থাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল-সার্ভিস গ্রুপের অর্থাৎ কম্যান্ডো গ্রুপের ক্যাপ্টেন এ.টি.এম. হায়দার যে কি না পাকিস্তানের আটাকফোর্টে স্পেশাল কম্যান্ডো ট্রেনিংপ্রাপ্ত, যাকে বলা হত জেনারেল মিঠঠা খানের হাতে গড়া কম্যান্ডো সেই দুর্ধর্ষ হায়দার এই ছেলেগুলোকে কম্যান্ডো ট্রেনিং দিয়ে থাকে। এদের মুখে শুনে শুনে সেই হায়দারও যেন আমার অতি চেনা, অতি আপন হয়ে উঠেছে।
চেনা হয়ে উঠেছে ডঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ডাঃ এম এ মোবিন। এরা দুজনে ইংল্যান্ডে এফ.আর.সি.এস পড়ছিল। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস. পাস করে বিলেতে চার বছর হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর যখন এফ.আর.সি.এস. পরীক্ষা মাত্র এক সপ্তাহ পরে, তখনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু। ছেলে দুটি পরীক্ষা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে অংশ নিল, পাকিস্তানি নাগরিকত্ব বর্জন করল, ভারতীয় ট্রাভেল পারমিট যোগাড় করে দিল্লিগামী প্লেনে চড়ে বসল। উদ্দেশ্য ওখান থেকে কলকাতা হয়ে রণাঙ্গনে যাওয়া। প্লেনটা ছিল সিরিয়ান এয়ারলাইনস-এর। দামাস্কাসে পাঁচ ঘন্টা প্লেন লেট, সব যাত্রী নেমেছে। ওরা দুজন আর প্লেন থেকে নামে না। ভাগ্যিস নামে নি। এয়ারপোর্টে এক পাকিস্তানি কর্নেল উপস্থিত ছিল ঐ দুজন পলাতক পাকিস্তানি নাগরিককে গ্রেপ্তার করার জন্য। প্লেনের মধ্যে থেকে কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না, কারণ প্লেন হলো ইন্টারন্যাশনাল জোন। দামাস্কাসে সিরিয়ান এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা ওদের দুজনকে জানিয়েছিল–ওদের জন্যই প্লেন পাঁচ ঘন্টা লেট। এমনিভাবে ওরা বিপদের ভেতর দিয়ে শেষ পর্যন্ত মে মাসের শেষাশেষি সেক্টর টু রণাঙ্গনে গিয়ে হাজির হয়েছে।
চেনা হয়ে উঠেছে ডাঃ নাজিমও। সে সদ্য এম.বি.বি.এস পাস করে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজে ইন-সার্ভিস ট্রেনিংয়ে ছিল। ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহ মুক্ত ছিল। তারপর পাকিস্তানিরা শহর দখল করলে, নাজিম কোনমতে পালিয়ে পায়ে হেঁটে, নৌকায়, ট্রাকে, গ্রাম থেকে গ্রামান্তর পেরিয়ে, মে মাসের প্রথমদিকে বর্ডারের ওপারে গিয়ে দাঁড়ায়। খোঁজখবর করে আগরতলা হয়ে মতিনগরে যায়। সেখানে ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের লোকেরা তাকে গ্রেপ্তার করে। সে সময় কেউ ঠিকমত রেফারেন্স দিতে না পারলে বি.এস.এফ-এর লোকেরা তাকে ধরত পাকিস্তানি গুপ্তচর সন্দেহে। শাহাদতের ছোট ভাই ফতেহ চৌধুরীও প্রথম মতিনগরে গিয়ে বি.এস.এফ এর লোকের হাতে পড়েছিল। সে তার আগের চেনা পাড়ার ছেলে ডাঃ আখতার আহমদের নাম বলেছিল। তারপর আর কোন অসুবিধে হয় নি। ডাঃ নাজিমও আগরতলার এক পরিচিত লোকের নাম বলে পার পেয়েছিল। তারপর সোনামুড়ার হাসপাতালে কাজে লেগে যায় সে। সবচেয়ে নাটকীয় ব্যাপার হল–পাঁচ মে নাজিমও মতিনগরে গেল, আর তার পরপরই এগারো মে পাকিস্তানি সৈন্যরা বিবিরবাজার আক্রমণ করে দখল করে নিল। পূর্ব বাংলার বর্ডারের ঠিক ভেতরেই এই বি.ও.পি-টা এতদিন মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। বিবিরবাজার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বেশ কজন জখম হয়। শ্ৰীমন্তপুর বি.ও.পি. ভারতীয় বর্ডারের ঠিক ভেতরেই, প্রায় বিবিরবাজারের মুখোমুখি। পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত শেল শ্রীমন্তপুরেও এসে পড়ছিল। ডাঃ আখতার আহমদ তার এক বেডের ক্যাম্প হাসপাতালটি সরাতে ব্যস্ত ছিল। ওখানে রুগী রাখা মোটেও নিরাপদ ছিল না। তাই যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সোনামুড়ার ভারতীয় হাসপাতালে পাঠানো হতে থাকে। ঐ একই সময়ে খালেদ মোশাররফ ডাঃ নাজিমকে সোনামুড়ায় পাঠায়। সেখানে ফরেস্ট ডাকবাংলোটা দেওয়া হয় মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। ডাঃ নাজিম ওইখানেই আহতদের চিকিৎসায় লেগে যায়। ইতোমধ্যে আখতারও এসে পড়ে শ্রীমন্তপুর থেকে।
ডালিয়া সালাহউদ্দিন ঢাকায় ডাক্তারি পড়ত, বাফার নাচের স্কুলের ছাত্রী ছিল। ভালো নাচে বলে বেশ নামও ছিল। সেই ডালিয়া আর তার হবু স্বামী শামসুদ্দিন এখন সেক্টর টুর হাসপাতালে। শামসুদ্দিনও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিল।
চোখের সামনে মূর্ত হয়ে ওঠে তৈয়ব আলীর চেহারা। তাকে কখনো দেখি নি, কিন্তু রুমীর মুখে শুনে শুনে মনে হয় তৈয়ব আলী এসে দাড়ালেই আমি তাকে চিনতে পারব। ঢাকার উপকণ্ঠে মাদারটেকে বাড়ি তৈয়ব আলীর। লেখাপড়া করেছে ক্লাস সিক্স-সেভেন পর্যন্ত। আম কলা লিচু ফেরি করে জীবিকা নির্বাহ করত ক্র্যাকডাউনের আগে। কিন্তু বুকের ভেতরে ছিল দেশপ্রেম।মার্চের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।ক্র্যাকডাউনের পর চলে যায় দুনম্বর সেক্টরে। তৈয়ব আলীর সাহস আর উপস্থিত বুদ্ধি আশ্চর্য রকম। তার স্পষ্টবাদিতার কারণে মেলাঘরে সে খুব জনপ্রিয় ছিল না; কিন্তু এই গুণের জন্যই রুমী তাকে বিশেষ চোখে দেখত। ক্রমে সেও রুমীর খুব ভক্ত হয়ে ওঠে। ক্যাম্পের অন্য ছেলেদের কথা তৈয়ব আলী তেমন শুনত না। তাকে দিয়ে কোন কাজ করাতে হলে ছেলেরা রুমীকে গিয়ে ধরত। রুমী বললে তৈয়ব আলী বিনা প্রতিবাদে সব কাজ করে দিত। তৈয়ব আলী তার সাহস আর নিষ্ঠার জন্য খুব তাড়াতাড়িই সেক্টর টুতে সবার কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে।
তৈয়ব আলী এখন পিরুলিয়া ক্যাম্পে রুমীদের দলের সঙ্গেই রয়েছে। সেখানে সে সকালে নাশতা বানিয়ে রুমীদেরকে খাওয়ায়। দুপুরে, রাতে রান্না করে রাখে, সারা দিনের পর রুমীরা ক্লান্ত হয়ে ফিরলে তাদের যত্ন করে খাইয়ে শুইয়ে দেয়।
রুমীর বন্ধুরা খেতে এলে সাধারণত মেলাঘরের কথাই জিগ্যেস করি। আজ সাহস করে ঢাকার কথা জিগ্যেস করে ফেললাম। অবশ্য ঘুরিয়ে। কদিন আগে গ্রীন রোডে এক দুঃসাহসিক অ্যাকশান হয়ে গেছে। কয়েকজন বিচ্ছু মিলিটারি ট্রাকে বোমা ছুঁড়েছে, গুলি করেছে। নানা লোকের মুখে যে আশ্চর্যজনক ঘটনাটা শুনতে পেয়েছি, তাহল–ট্রাকের পাকিস্তানি সৈন্যগুলো বিচ্ছুদের প্রতিআক্রমণ করার কোন চেষ্টা না করে পালিয়ে যায়। সেই কথার সূত্র ধরে বললাম, সত্যি সাহস বটে বিন্দুগুলোর আর আওয়াজ যা হয়েছিল না, সারা পাড়া কেপে উঠেছিল। আমার মা ধানমন্ডি ছয় নম্বর রোডে থাকেন। তিনিও আওয়াজ পেয়েছিলেন। সত্যি বলতে কি, আমরা আজকাল দিনরাতের প্রায় সব সময়ই এত ধরনের আওয়াজ শুনি যে, ভেবেই পাই না তোমরা কি করে এত আওয়াজ কর। তবে মজা কি জাননা, আজকাল ঐসব আওয়াজ না শুনলে আমাদের ঘুমই হয় না।
আলম ছেলেটি কথা কম বলে (হয়তোবা আমার সামনে!), সে বেশ ধীরে-সুস্থে গম্ভীর গলায় আস্তে করে বলল, আপনাদের ঘুমানোর জন্য আওয়াজটা খুবই দরকার বলে মনে করছেন। কিন্তু ঢাকার মানুষের ঘুম পাড়ানোর ইচ্ছা বা উদ্দেশ্য আমাদের মোটেও নেই। আমাদের উদ্দেশ্য হল, খানসেনাদের দিনের আরাম, রাতের ঘুম হারাম করা, এদেরকে সব সময় মুকুতের ভূত দেখানো। খালেদ মোশাররফ এগুলোকেই সাইকোলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বলেন।
আমি আড়চোখে রুমীর দিকে তাকালাম, সে ওদিকে মুখ ফিরিয়ে চুলুর সঙ্গে কি যেন বলছে। আমি গলা নামিয়ে আলমকে প্রশ্ন করে ফেললাম, বল না, তোমরা কিভাবে এগুলো কর।
আলম বলল, এগুলো ছোট ছোট অ্যাকশান। এর কোনো ধারাবাহিকতা বা পূর্ব নির্ধারিত প্ল্যান থাকে না। এটা যে যার সুবিধেমত চলতে ফিরতে করে যাচ্ছে। নানা রকম জিনিস দিয়ে এগুলো করা হয়ে থাকে, তবে এর জন্য সবচেয়ে উপযোগী যে জিনিসটা, তা হচ্ছে এ্যান্টি পার্সোনাল মাইন। এগুলো খুব ছোট্ট সাইজের বিস্ফোরক, প্যান্টের পকেটে বা গাড়ির গ্লাভ-কম্পার্টমেন্টে সহজেই লুকিয়ে রাখা যায়।
কথা বলতে বলতে আলম দেয়ালের পাশে কাপ-ডিস রাখার ছোট আলমারির দিকে আঙ্গুল তুলে বলল, ওটা কিসের কৌটো?
তাকিয়ে দেখলাম, খাটো আলমারিটার মাথায় গ্লাস, ওষুধের শিশি-বোতলের সঙ্গে একটা ছোট কৌটো। বললাম, ওটা ওরিয়েন্টাল বাম বলে একটা মলমের কৌটো! কপালে লাগালে মাথা ধরা ছেড়ে যায়।
আলম হেসে বলল, ঐরকম ছোট টিনের কৌটোর চেয়ে একটু বড় দেখতে এই মিনি মাইনগুলো। বলতে পারেন ডবল ওরিয়েন্টাল বাম। এগুলো বিচ্ছুরা সুযোগ সুবিধেমত গাড়ির চাকার নিচে বসিয়ে দেয়। যে রাস্তা দিয়ে মিলিটারির কনভয় যাবে, আগে থেকে জানতে পারলে সেই রাস্তায় বসিয়ে দিয়ে আসে। জীপ বা ট্রাকের চাকা মাইনের ওপর পড়লেই বিকট আওয়াজে চাকা ফাটে। বেশির ভাগ সময়ই গাড়ি উল্টে যা।
জামী হেসে বলল, ঐ ওরিয়েন্টাল বামে খানসেনাদের মাথাধরা ছাড়ে না, আরো বেড়ে যায়।