২৪
বুধবার মধ্যরাত্রি।
মিসির আলির রুটিনের ঝামেলা শুরু হয়ে গেছে। ঘরে রান্না হয় নি। তাঁকে রাতে হোটেলে খেয়ে আসতে হয়েছে। ডাল-গোশত নামের যে খাদ্যটি তিনি কিছুক্ষণ আগে গলাধঃকরণ করেছেন, তা এখন জানান দিচ্ছে। মিসির আলি পেটে ব্যথা নিয়ে জেগে আছেন। ফুড পয়জনিং-এর লক্ষণ কি না কে জানে? পেটের ব্যথা ভুলে থাকবার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে থ্রিলারজাতীয় কোনো রচনায় মনোনিবেশ করা। কিন্তু ঘরে এ জাতীয় কোনো বই নেই! তবু মিসির আলি বুকসেলফের কাছে গেলেন। সবই একাডেমিক বই। একটি সায়েন্স ফিকশন পাওয়া গেল -Horseman from the sky. তেমন কোনো ইন্টারেস্টিং বই নয়। আগে এক বার পড়েছেন। তবুও সেই বই হাতে নিয়েই বিছানায় গেলেন এবং তখন ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। বৃষ্টি ও বাতাস দুই–ই থেমে গেছে, তবুও। মাঝরাতে লোড শেডিং হবার কথা নয়, কিন্তু ঢাকা শহরের ইলেকট্রিসিটির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই।
মিসির আলি অত্যন্ত বিরক্ত মুখে ড্রয়ার খুললেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ড্রয়ারে বড় বড় দু’টি মোমবাতি পাওয়া গেল। হানিফা নিশ্চয়ই একময় কিনে রেখে দিয়েছে। মিসির আলি মোমবাতি জ্বালিয়ে বই খুললেন। দ্বিতীয় বার পড়বার সময় বইটি অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি শারীরিক ব্যথা ভুলে আগ্রহ নিয়ে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলেন। চমৎকার লেখা–এক ভোরবেলায় মস্কো শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক ঘোড়সওয়ারের আগমন হল। লোকটির চেহারা কুৎসিত। মাথায় সার্কাসের ক্লাউনের টুপির মতো এক টুপি। সে তার ঘোড়া নিয়ে নানান খেলা দেখাতে শুরু করল। দেখতে দেখতে তাকে ঘিরে ভিড় জমে গেল।
এত মজার একটি বই আগের বার পড়তে এত বাজে লাগছিল কেন পাঠকের জন্ম মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন–চা বানাবেন। চা খেতে-খেতে আরাম করে পড়া যাবে। তাঁর মনে হল, মোমবাতির আলোয় বই পড়ায় আলাদা একটা আনন্দ আছে। আধো আলো আধো ছায়া। বইয়ের জগৎটিও তো তাই–অন্ধকার এবং আলোর মিশ্রণ। লেখকের কল্পনা হচ্ছে আলো, পাঠকের বিভ্রান্তি হচ্ছে অন্ধকার। নিজের তৈরি উপমা নিজের কাছেই চমৎকার লাগল তাঁর। তিনি নিজেকে বাহবা দিয়ে সিগারেটের জন্যে পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিতেই দরজায় খুব হালকাভাবে কে যেন কড়া নাড়ল।
মিসির আলি ঘড়ি দেখলেন, রাত প্রায় একটা। এত রাতে কে আসবে তাঁর কাছে! তিনি বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘কে, কে
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। মিসির আলি গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘কে ওখানে ‘আমি।’
মিসির আলির বিস্ময়ের সীমা রইল না। নীলুর গলা। সে এত রাতে এখানে কী করছে পাগল নাকি!
‘কি ব্যাপার নীলু
নীলু জবাব দিল না। ছোট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মিসির আলি ছুটে গিয়ে দরজা খুললেন–নীলু নয়, ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে।
ফিরোজের দু’টি হাত পেছন দিকে। সে হাতে সে কী ধরে আছে তা মিসির আলির বুঝতে অসুবিধা হল না। তাঁর শিরদাঁড়া দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। তিনি হাসতে চেষ্টা করলেন।
‘কেমন আছ ফিরোজ নীলুর গলা তো চমৎকার ইমিটেট করলে। এস, ভেতরে এস। ইস, ভিজে গেছ দেখি!’
ফিরোজ ভেতরে ঢুকল। পলকের জন্যে মিসির আলির ইচ্ছা করল ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। তাঁর পা পাথরের মতো ভারি হয়ে গেছে। অত্যন্ত সহজ এবং স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করলেন।
‘কিছু খাবে, ফিরোজ চা খাবে ঠাণ্ডায় চা-টা ভালো লাগবে। ইন ফ্যাক্ট আমি চা বানানোর জন্যেই উঠেছিলাম।
ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে ঘরের মাঝখানে। সে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। সে মাঝে মাঝে ঠোঁট টিপে হাসছে।
মিসির আলি বললেন, ‘বস ফিরোজ, দাঁড়িয়ে আছ কেন এতক্ষণ শুয়ে-শুয়ে বই পড়ছিলাম। একটা সায়েন্স ফিকশন। তুমি কি সায়েন্স ফিকশন পড়’
ফিরোজ এবার শব্দ করে হাসল। মিসির আলি শিউরে উঠলেন। কী অমানুষিক হাসি! এই হাসির জন্ম পৃথিবীতে নয়, অন্য কোনো ভুবনে। অচেনা ভয়ঙ্কর এক ভুবন, যার কোনো রহস্যই মিসির আলির জানা নেই। মিসির আলির সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেল। তিনি বহু কষ্টে বললেন, ‘তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে ফিরোজ?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন ফিরোজ আমি কি তোমার ক্ষতি করেছি?’
ফিরোজ তার জবাব দিল না। লোহার রডটি উঁচু করল। মিসির আলি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন। চিৎকার দিতে ইচ্ছে করল, চিৎকার দিতে পারলেন না। তাঁর কাছে শুধু মনে হল, মোমবাতির আলো অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠছে এবং আশ্চর্যের ব্যাপার–ছেলেবেলার একটি স্মৃতি তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের এক দুপুরে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ব্রহ্মপুত্রের শীতল জলে। ঠাণ্ডা ও ভারি সেই পানি। মাছের চোখের মতো সেই স্বচ্ছ জলে ইচ্ছে করে তলিয়ে যেতে।
মৃত্যুর আগে গত জীবন চোখের সামনে এক বার হলেও ভেসে ওঠে, এটা কি সত্য? হয়তো সত্য। নয়তো হঠাৎ করে ভুলে-যাওয়া শৈশবের এই ছবি চোখে ভাসবে কেন?
মিসির আলি কিছু-একটা বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু বলতে পারলেন না। তার আগেই লোহার রড প্রচণ্ড বেগে নেমে এল তাঁর দিকে। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। তীব্র ও তীক্ষ্ণ ব্যথা। এক গভীর শূন্যতা। মিসির আলি বুঝতে পারছেন, তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর চারদিকে সীমাহীন জলরাশি। তিনি কিছু বলতে চেষ্টা করলেন–বলতে পারলেন না।
.
‘মিসির আলি। মিসির আলি। তাকাও তুমি। তাকিয়ে দেখ।‘
মিসির আলি চোখ মেললেন। মোমবাতি জ্বলছে। আলো এবং আঁধার। তিনি কি বেঁচে আছেন? নাকি এটা মৃত্যুর পরের কোনো জগৎ? কোনো অদেখা ভুবন?
‘মিসির। মিসির।’
কে কথা বলে? কোথেকে আসছে কিন্নরকণ্ঠ। ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু দেখার উপায় নেই। সমস্ত শরীর অসহ্য ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিতে এত কষ্ট! এত কষ্টও আছে পৃথিবীতে? কোথায়, ফিরোজ কোথায়?
মিসির। মিসির আলি। আর কোনো ভয় নেই, সে পালিয়ে গেছে। আমি এসেছি। তাকাও, তাকাও আমার দিকে।
কে পালিয়ে গেছে? কে কথা বলছে? কার দিকে তাকাতে বলছে? মিসির আলি তাকাতে গিয়ে ব্যথায় নীল হয়ে গেলেন। মুখ ভর্তি করে বমি করলেন। টকটকে লাল রক্ত এসেছে বমিতে। ফুসফুস ফুটো হয়েছে। পাঁজরের হাড় ঢুকে গেছে ফুসফুসে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই কারণে।
মিসির আলির চোখে জল এসে গেল—এত কষ্ট, এত কষ্ট!
‘মিসির, মিসির।’
‘কে তুমি?’
‘তাকিয়ে দেখ।’
মিসির আলি তাকালেন। যন্ত্রণা এবং ব্যথার জন্যেই কি তিনি এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখছেন? হেলুসিনেশন? হেলুসিনেশন।
‘মিসির আলি, আমি কে বল তো।’
‘জানি না, কে।’
‘ভালো করে দেখ, ভালো করে দেখ। চোখ নামিয়ে নিচ্ছ কেন? আমার সঙ্গে কথা বলতে থাক, তাতে ব্যথা ভুলে থাকবে। বল আমি কে?’
মিসির আলি আবার মুখ ভর্তি করে বমি করলেন।
‘আমিই সেই দেবী। তুমি তো আমাকে বিশ্বাস কর না। নাকি এখন করছ?’
‘তুমি আমার কল্পনা। উইশফুল থিংকিং। দেবী আবার কী?’
‘আমিই কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়েছি।’
দেবীমুর্তি খিলখিল করে হেসে উঠল। কী চমৎকার হাসি! কী অপূর্ব সুরধ্বনি! ঘরে চাঁপা ফুলের গন্ধ, তীব্র সৌরভ। হেলুসিনেশন। হেলুসিনেশন হচ্ছে। হেলুসিনেশন ছাড়া এ আর কিছুই নয়।
দেবী হাসল। চাঁপা ফুলের গন্ধ কি দেবীর গা থেকেই আসছে? তাকে রক্তমাংসের মানবীর মতোই লাগছে। ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু কী কষ্ট! কী কষ্ট! মিসির আলি হাঁফাতে হাঁফাতে বললেন, ‘দেবী, আমার কষ্ট কমিয়ে দাও।’
‘আমাকে বিশ্বাস করছ তাহলে?’
‘না।’
‘কেন করছ না? এ জগতের সমস্তই কি যুক্তিগ্রাহ্য? এই আকাশ, অনন্ত নক্ষত্রপুঞ্জ? তুমি কি বলতে চাও, এর কোথাও কোনো রহস্য নেই? অসীম কী? এই সামান্য প্রশ্নের জবাব কি তোমার জানা আছে? বল, তুমি জান?’
‘আজ জানি না, কিন্তু একদিন জানব। আমি না জানলেও আমার পরবর্তী বংশধর জানবে।’
‘মিসির আলি, তুমি বড় অদ্ভুত লোক!’
মিসির আলি কাতর কন্ঠে বললেন, ‘আমার ব্যথা কমিয়ে দাও, আমার ব্যথা কমিয়ে দাও।’
দেবী হেসে উঠল। মৃদু স্বরে বলল, ‘আমায় বিশ্বাস করছ না, অথচ ব্যথা কমিয়ে দিতে বলছ?’
‘বড় কষ্ট, বড় কষ্ট!’
‘তোমার বন্ধু চলে আসছে। তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। তুমি আবার সুস্থ হয়ে উঠবে। এবং মজার ব্যাপার কি জান? নীলুর সঙ্গে বিয়ে হবে তোমার। যদি কোনোদিন হয়, আমার কথা মনে করো।
মিসির আলি আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। তিনি দেবীর কথা এখনো শুনতে পাচ্ছেন। কী অপূর্ব কণ্ঠ! কী অলৌকিক সৌন্দর্য। কিন্তু এ সবই মায়া। অসুস্থ ব্যথা-জর্জরিত মনের সুখ-কল্পনা। প্রকৃতি চাচ্ছে নারকীয় কষ্ট থেকে তাঁর মন ফিরিয়ে নিতে। সে-জন্যেই সুখের স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁকে ভোলাচ্ছে। হয়তো নীলুর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হবে। তাতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। প্রমাণ বড় কঠিন জিনিস। বড় কঠিন।
মিসির আলি কাতর কন্ঠে বললেন, ‘কষ্ট কমিয়ে দাও। কষ্ট কমিয়ে দাও।’ অপরূপা নারীমূর্তি চাঁপা ফুলের গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে দূরে সরে যাচ্ছে। তার পায়ে ঝুমঝুম করছে নূপুর। কে যেন দরজা ধাক্কা দিচ্ছে। কে সে? সাজ্জাদ হোসেন? ওরা কি ধরে ফেলেছে ফিরোজকে? ওকে সুস্থ করে তুলতে হবে। ইসিটি দিয়ে দেখলে হয়। কিংবা কে জানে হয়তো এখন সে সুস্থ। তাঁকে একবার আঘাত করেই তার চেতনা ফিরে এসেছে।
হানিফা। হানিফা কেমন আছে? কোথায় আছে? সুখে আছে তো?
আহ্, বড় কষ্ট! কেউ আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও—ঘুম পাড়িয়ে দাও। আমি তলিয়ে যেতে চাই অতল অন্ধকারে। বড় কষ্ট, বড় কষ্ট!
.
সাজ্জাদ হোসেন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। টর্চের আলো ফেললেন মিসির আলির মুখে। সাজ্জাদ হোসেনের মুখে এক ধরনের প্রশান্তি লক্ষ করা গেল। কারণ, নগ্নগাত্র আগন্তুককে কিছুক্ষণ আগেই ধরা হয়েছে। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, পুলিশকে সে প্রথম যে-কথাগুলি বলে, তা হচ্ছে, ‘আপনারা স্যারকে বাঁচানোর চেষ্টা করুন।’এক্ষুণি হাসপাতালে নিয়ে যান। আর আমার বাবাকে টেলিফোন করে বলুন, আমি ভালো হয়ে গেছি। স্যারের বাসায় এক জনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। সে আমাকে ভালো করে দিয়েছে।’
.
গল্পের অধিকাংশ চরিত্রই কাল্পনিক। পরিচিত কিছু চরিত্র এবং কিছু ঘটনা ব্যবহার করেছি। তবে কাউকে হেয় করবার জন্যে করা হয় নি। মানুষের প্রতি আমার মমতা মিসির আলির মতো হয়তো নয়, কিন্তু খুব কমও নয়।