২৪. অকলামেনসি

২৪. অকলামেনসি

সিরিয়সের ভয়ে ক্রেচার চিলে কোঠায় লুকিয়ে ছিল। সিরিয়স খুঁজতে খুঁজতে ক্রেচারকে ওইখানে খুঁজে পেয়েছে, সারা অঙ্গ ঝুলকালিতে মাখামাখি। তবে হ্যারি দেখলো ক্রেচার এখন অনেকটা স্বাভাবিক। কথাবার্তা শুনছে, মন দিয়ে কাজকর্ম করছে। বিড় বিড় করে আর কিছু বলে না। মাঝে মাঝে হ্যারি লক্ষ্য করে ক্রেচার ওর দিকে লোভির মতো তাকিয়ে রয়েছে, হ্যারি ওর দিকে তাকালে সব সময়ই সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।

হ্যারি অবশ্য সে কথা সিরিয়সকে বলেনি। ওদিকে ক্রিস্টমাস শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সিরিয়সের হাস্যকৌতুক ও উল্লাস একটু একটু করে কমতে থাকে। হোগওয়ার্টসে ফিরে যাবার দিনও ঘনিয়ে আসছে।

সিরিয়সকে একলাটি, ক্রেচারকে নিয়ে থাকতে হবে ভাবলেই ওর মন খারাপ হয়ে যায়। হোগওয়ার্টসে যাওয়া মানে আধাপাগল আবার ডলোরেস আমব্রিজের স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য করা। যতই ভাবে মন উদাস হয়ে যায়। আসলে কিডিচ খেলতে পারবে না সেটাও দুঃখের ব্যাপার! পরীক্ষার দিনগুলো আগত, হোমওয়ার্কের চাপও কমবে না বরং বেড়ে চলবে। ওর যদি ডিএর ব্যাপারটা না থাকতো তাহলে ও সিরিয়সকে অনুরোধ করতে হোগওয়ার্টস ছেড়ে ওকে গ্রিনল্ড প্লেসে থাকতে দেবার জন্য।

তারপর ফিরে যাবার ঠিক একদিন আগে এমন একটা কিছু ঘটলো যাতে ওর স্কুলে ফিরে যেতে ভয় করতে লাগলো।

রনের ঘরে বসে রন হ্যারির সঙ্গে উইজার্ড দাবা খেলছিল। হারমিওন জিনি খেলা দেখছে, হারমিওনের কোলে ওর কুকশ্যাংকস। মিসেস উইসলি দরজাটা ইষৎ ফাঁক করে মুখ বাড়িয়ে বললেন, তোমাদের সঙ্গে প্রফেসর স্নেইপ দুএকটা কথা বলতে এসেছেন।

হ্যারি প্রথম চোটে মিসেস উইসলি যে কি বললেন বুঝতে পারলো না। ওর ক্যাসেল তখন রনের দাবার বড়ের সঙ্গে দারুণ টানা পোড়েনে ব্যস্ত।

–সরি মিসেস উইসলি, আপনি কি যেন বললেন আমাকে।

–প্রফেসর স্নেইপ কিচেনে বসে আছেন, তোমার সঙ্গে দুএকটা কথা বলতে চান।

হ্যারি হঠাৎ দারুণ ভয় পেয়ে গেলো। রন, জিনি, হারমিওন ওর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলো। কশ্যাংক হারমিওনের কোল থেকে লাফিয়ে নেমে পড়লো।

হ্যারি ভাসা ভাসাভাবে বললো, স্নেইপ?

হ্যারি একটু চিন্তায় পড়ে গেলো। মাথায় কিছুতেই আসছে না হঠাৎ প্রফেসর স্নেইপের এখানে আসার কারণ কি থাকতে পারে।

মিসেস উইসলি চলে গেলে রন বললো–মাথায় ঢুকছে না, তুমি কী কোনও অন্যায় কাজ করেছো?

–মোটেই না। তাহলে কী ওর শেষে দেওয়া হোমওয়ার্কটা ভাল হয়নি? টি পেয়েছি?

দুএক মিনিটের মধ্যে হ্যারি কিচেনে গিয়ে দেখলো। সিরিয়স ও স্নেইপ বসে রয়েছেন। কেউ কারও মুখের দিকে তাকিয়ে নেই। হ্যারি জানে দুজনেই দুজনকে একটুও দেখতে পারেন না। হ্যারি দেখল সিরিয়সের সামনে একটা খোলা চিঠি পড়ে রয়েছে।

–এসেছি, হ্যারি ওর উপস্থিতি জানালো।

স্নেইপ ওর দিকে তাকালেন। তৈলাক্ত, চকচকে তার মাথার চুল আর গোমড়া মুখ।

–বসো পটার, বললেন স্নেইপ।

সিরিয়স সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে পা দুটো ছড়িয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, প্রফেসর স্নেইপ আশাকরি আপনি জানেন যে গ্রিমন্ডপ্লেস বাড়িটা আমার। এখানে অন্য কেউ এসে হুকুম চালায় এটা আমি বরদাস্ত করবো না। আশাকরি আপনি কোনও অর্ডার দেবেন না।

কথাটা শুনে স্নেইপের গোমড়া মুখ আরও গোমড়া হয়ে গেলো। হ্যারি, সিরিয়সের পাশে বসলো।

–আমি তোমার সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে চাই, কিন্তু ব্ল্যাক ….!

–জেনে রাখবেন আমি পটারের ধর্মপিতা, সিরিয়স অনেকটা গর্জন করে উঠে বললেন।

–উপায় নেই ডাম্বলডোরের আদেশ, স্নেইপের গলা যেন সিরিয়সের গলাকে ছাপিয়ে গেলো। আপনিও ব্যাপারটায় জড়িত আছেন।

সিরিয়স চেয়ারটা পেছনে ঠেলে বললেন–আপনি কি বলতে চাইছেন?

স্নেইপ বললেন, আমার স্থির বিশ্বাস আপনার এই ব্যাপারে কিছু করার নেই। গলা শোনা যায় না এমনভাবে বললেন, অর্ডারের স্বার্থে। স্নেইপ বিজয়ীর মতো হ্যারির মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, হেড মাস্টার আমাকে তোমায় জানাতে বলেছেন যে তার ইচ্ছে, এই টার্ম থেকে তুমি কলামেনসি সম্বন্ধে পড়াশুনা করো।

হ্যারি বললো–কী পড়তে হবে?

 স্নেইপ বেশ দৃঢ় মুখ ভঙ্গি করলেন।

অকলামেন্সি পটার। বাইরের বলপূর্বক বিদ্ধতা থেকে জাদুর দ্বারা আত্মপ্রতিরোধ। এক অজানা–অজ্ঞাত জাদুর শাখা। কিন্তু তোমার অতি প্রয়োজনীয়।

হ্যারির স্নেইপের কথা শুনে অজানা সেই পাঠ্যক্রমের ভয়ে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করতে লাগলো। বাইরের দ্বিদ্ধতা থেকে প্রতিরোধ? কিন্তু সে রকম তো কিছুই ওর ঘটেনি।

ও তোতলাতে তোতলাতে বললো, কেন ওই অ–অ-অকলা শিখতে যাবো?

–কারণ হেডমাস্টার মনে করেন শেখা দরকার। স্নেইপ ইতস্তত না করে বললেন, তুমি ক্লাশের পড়া ছাড়াও ওটা আলাদাভাবে শিখবে; কিন্তু কি শিখছো কাউকে বলতে পারবে না, ডলোরেস আমব্রিজকে তো ভুলেও না! বুঝতে পেরেছো?

হ্যাঁ পেরেছি, কে শেখাবেন?

স্নেইপ ভুরু কোঁচকালেন। আমি।

হ্যারির শরীরের ভেতরটায় অদ্ভুত এক কম্পন শুরু হলো। মনে হলো ওর শরীরের সবকিছু গলে গলে পড়ছে। এমন কী অপরাধ এই পৃথিবীতেও করেছে যার জন্য এই শাস্তি? ও সিরিয়সের সাহায্যের জন্য তার দিকে তাকালো।

–ডাম্বলডোর, হ্যারিকে তো শেখাতে পারেন? তা তোমাকে এই দায়িত্ব দিলেন কেন স্নেইপ?

–এটা হেডমাস্টারের একটি বিশেষ অধিকার, যাকে খুশি তিনি পড়ানোর দায়িত্ব দিতে পারেন। স্নেইপ সাধারণভাবে বললেন, তোমাকে আমি এইটুকু বলতে পারি আমি মোটেই তাকে এই দায়িত্বটা আমাকে দিতে অনুরোধ করিনি।

কথাটা বলে স্নেইপ দাঁড়ালেন, হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললেন, মঙ্গলবার সন্ধ্যা ছটার সময় আমি তোমার আসার অপেক্ষায় থাকবো। আমার অফিসে পটার। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে, আমি প্রতিষেধক হিসেবে পোসান খাচ্ছি। তোমার ক্লাশের ছেলেরা তোমাকে আমার অফিস ঘরে দেখলে তারাও সে কথা অস্বীকার করতে পারবে না যে তোমার প্রতিশোধকের দরকার।

স্নেইপ তার ট্রাভেলিং রোবস দুলিয়ে চলে যেতে যেতে বললেন, ব্ল্যাক তোমার মতো তো আমার অখণ্ড অবসর নেই, আমার অনেক কাজ আছে।

–ঠিক আছে, ঠিক আছে। সিরিয়স উঠে দাঁড়ালেন। হ্যারি দেখলেন স্নেইপ সিরিয়সের চেয়েও লম্বায় খাটো। সিরিয়স পকেটে হাত ঢোকালেন, সন্দেহ নেই নিজের জাদুদণ্ডে হাত দিয়েছেন, শোনো স্নেইপ হ্যারি যদি বলে বা আমি শুনি অকলামেন্সি শেখাবার নাম করে তুমি ওকে কষ্ট দিচ্ছো, তাহলে তোমায় আমাকে জবাবদিহি করতে হবে, পরিষ্কার বলেদিলাম।

–আহ কি সুন্দর কথা! স্নেইপ মুখ বেঁকালেন, তুমি বোধ হয় লক্ষ্য করেছো সিরিয়স, পটার অনেকটা ওর বাবার মতো?

–হা জানি, সিরিয়স গর্বিতভাবে বললেন।

–বেশ, তাহলে জানবে… ও এতো বেশি একগুঁয়ে যে যদি কেউ ওকে সমালোচনা করে তাহলে ও ক্ষেপে যায়, আখেরে ওরই তাতে ক্ষতি হয়। স্নেইপ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।

সিরিয়স শব্দ করে চেয়ারটা সরিয়ে স্নেইপের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, স্নেইপের দিকে হাতের জাদুদণ্ডটা তুলে ধরলেন। স্নেইপ ও তার দণ্ডটা টেনে বার করলেন। দুজনেই আক্রোশে ফেটে পড়ছেন। স্নেইপ, সিরিয়সের জাদুদণ্ডের দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকালেন।

–সিরিয়স, হ্যারি ওকে বাধা দেবার জন্য জোরে জোরে বললো।

–আমি তোমাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছি, স্নেইপ। সিরিয়স মাত্র এক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে বললেন ডাম্বলডোর মনে করতে পারেন তুমি শুধরে গেছে, কিন্তু আমি মনে করি না। আমি অনেকের চেয়ে ভাল জানি।

স্নেইপ বললেন, তা যদি জানো তাহলে তাকে বলো না কেন। হয়তো মনে করছো তোমার কথায় কান দেবেন না, তাই বলো না। তাছাড়া অপরাধ করে তুমি তোমার মায়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রয়েছে কম করে ছ মাস কি বলো?

–বলো তো লুসিয়াস ম্যালফয় কেমন আছে? আমার মনে হয় ওর ল্যাপড়গ হোগার্টসে ঠিক মতো কাজ করার জন্য খুবই আনন্দিত তাই না?

–ও হো কুকুরের কথা বলছো? স্নেইপ সামান্য সুর নামিয়ে বললেন, তুমি বোধহয় জানো না গতবার যখন বাইরে বেরিয়েছিলে ও তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছিলো। খুবই চালাক মনে করেছে নিজেকে সিরিয়স! ভেবেছিলে, যে প্ল্যাটফরমে কারও চোখ পড়বে না সেখানে কুকুর হয়ে থাকলে কেউ তোমাকে চিনতে পারবে না? তোমাকে তো বেশ কয়েকবার সতর্ক করে দিয়েছেন বাইরে না বেরোতে, করেননি?

সিরিয়স আবার হাত তুললো।

হ্যারি লাফিয়ে দুজনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন–না, সিরিয়স না।

হ্যারিকে ঠেলে দিয়ে সিরিয়স বললেন–আমাকে তুমি ভীতু মনে করেছো? আবার হ্যারিকে ঠেলে দিলেন, হ্যারি এক ইঞ্চিও সরলো না।

স্নেইপ বললেন, না, তুমি কেন ভীতু হবে।

সিরিয়সের যে হাতটায় দণ্ড ধরা নেই সেই হাতটা দিয়ে হারিকে সরিয়ে দিয়ে বললেন–হ্যারি আমি বলছি তুমি সরে যাও।

কিচেনের দরজা সেই সময় খুলে গেলো। উইসলি পরিবারের সকলে আর হারমিওন ঢুকলো। ওদের সকলকেই উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। মি. উইসলি ওদের মাঝে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পরণে স্ট্রাইপড পা-জামা আর ম্যাকিনটশ।

–সেরে গেছে, একেবারে সেরে গেছে।

ওরা সকলেই সিরিয়স আর স্নেইপকে জাদুদণ্ড নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থতমত খেয়ে গেলো।

মি. উইসলি হেসে বললেন, কি হতে যাচ্ছে এখানে?

সিরিয়স আর স্নেইপ দুজনেই নিজেদের জাদুদণ্ড পকেটে রেখেদিলেন। স্নেইপ ঘর ছেড়ে চলে যাবার আগে হ্যারির দিকে তাকিয়ে বলতে গেলে মি. উইসলিকে একরকম ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন–সোমবার সন্ধ্যা মনে থাকে যেন, পটার।

স্নেইপের চলে যাবার পর মি. উইসলি বললেন, কি ব্যাপার? সিরিয়স যেনো অনেকটা পথ দৌড়াতে দৌড়াতে এসেছেন এমন ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললেন–কিছু না, এই পুরনো স্কুল বন্ধুর সঙ্গে একটু তক্কাতক্কি করছিলাম। যাকগে তুমি সেরে উঠেছ, সত্যি দারুণ খবর।

মিসেস উইসলি স্বামীর দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, হিলার স্মিথউইক শেষ পর্যন্ত তার ম্যাজিক দেখালেন। সাপ ওনার শরীরে দাঁত দিয়ে যে বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো সেটা বার করতে অনেক প্রতিষেধক দিলেন। আর্থার মাগল ওষুধপত্র সম্বন্ধে বেশ কিছু জ্ঞান সঞ্চয় করেছে, তাই না আর্থার?

–হা, হা ঠিক বলেছে, মি. উইসলি ভাবে বললেন।

সেই রাতে খাওয়া-দাওয়া দারুণ জমলো; কিন্তু সিরিয়স সকলের সঙ্গে খুব একটা হাসি ঠাট্টা করলেন না। মুখটা ব্যাজার করে রইলেন। খেতে খুবই ভালবাসেন, অথচ ফ্রেড জর্জের অনেক অনুরোধেও বিশেষ কিছু খেলেন না তখন। হ্যারি মুন্ডানগাস আর ম্যাডআই মুডির খুব কাছাকাছি দাঁড়ালো না। দুজনেই মি. আর্থারকে সুস্থ্য হয়ে হাসপাতাল থেকে ফেরাতে, শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন।

স্নেইপকে খুব একটা পাত্তা দিতে উইসলি, সিরিয়সকে মানা করলেন। ওকে ভীতু বলাতে দুঃখিত হলেন। সকলেই ওকে গ্রিমন্ড হাউসে থাকতে বললেন। হ্যারি, রন আর হারমিওনকে অকলামেন্সি পড়ার কথা বললো।

হারমিওন বললো, ডাম্বলডোর তোমাকে অযথা স্বপ্নের কথা ভাবতে মানা করেছেন যা বলেছেন ঠিক মেনে চলবে।

রন মজা করে বললো, আহা, স্নেইপের কাছে লেশন নেওয়া! আমিও যেন রাতে বিশ্রী স্বপ্ন দেখি।

পরের দিন সকালে ওদের হোগওয়ার্টসে ফিরে যেতে হবে। রাজকীয় বাসে যাবে, সঙ্গে থাকবেন টোংকস আর লুপিন। ওরা ব্রেকফাস্ট খাচ্ছিলেন ঠিক সেই সময় হ্যারি, রন, হারমিওন কিচেনে ঢুকলো। সকলেই ব্যস্ত, কথাবার্তাও কম বলছে।

ওরা যাবার জন্য তৈরি। জানুয়ারি মাসের সকাল, বাইরে দারুণ ঠাণ্ডা। তাই মোটামুটি শীত যাতে না লাগে তেমন পোশাক পরেছে। হ্যারি জানে না কেন, সে সিরিয়সের সঙ্গে কথাবার্তা বললো না। ইচ্ছে ছিলো সিরিয়সকে কারুর সঙ্গে ঝগড়া না করার পরামর্শ দিতে। ও জানে স্নেইপের ভীতু বলার জন্য সিরিয়া দারুন রেগে আছেন, গ্রিমন্ড প্লেস ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার চেষ্টা করছেন। তাও সিরিয়স ওকে একপাশে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন–এটা তুমি সঙ্গে নাও, পেপার ব্যাক বইয়ের মতো একটা প্যাকেট ওর হাতে দিলো।

–এটা কী? হ্যারি জিজ্ঞেস করলো।

–আমি জানি স্নেইপ তোমায় ভাবিয়ে তুলেছে। যাকগে, ডাম্বলডোর যা বলেছেন তাই করবে। এখন প্যাকেটটা খুলবে না, তাহলেও তোমার আমাকে প্রয়োজন হলে এটা ব্যবহার করবে। ঠিক আছে?

–ঠিক আছে। হ্যারি পকেটে প্যাকেটটা রেখে দিলো। ও জানে প্যাকেটের মধ্যে যা আছে তা ওর দরকার পড়বে না। তাছাড়া অকলামেন্সি ট্রেনিংয়ের সময় স্নেইপ ওর সঙ্গে যাই ব্যবহার করুন না কেন, সিরিয়স প্রকারন্তরে ওকে সাবধানে থাকতে বলেছেন।

হ্যারির পিঠে হাত রেখে সিরিয়স বললেন–এবার তাহলে যাওয়া যাক। ওরা। নিঃশব্দে দোতলায় উঠতে লাগলো।

উইসলি পরিবার দরজার কাছে বিদায় জানাবার জন্য দাঁড়িয়েছিলো।

মিসেস উইসলি হ্যারিকে আদর করে জড়িয়ে ধরে বললেন, সাবধানে যাবে। শরীরের খেয়াল রাখবে।

–আবার দেখা হবে হ্যারি, আমার জন্য সাপের দিকে চোখ রাখবে; মি. উইসলি হ্যারির সঙ্গে করমর্দন করে বললেন।

হ্যারি আরও একবার সিরিয়সকে সাবধানে থাকতে বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। সিরিয়স ওকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বিষন্দু মুখে বললেন, ভালো থেকো, হ্যারি শরীরের যত্ন নেবে।

তারপরই টোংকস আর লুপিনের চাপে পড়ে ও বরফের মত ঠাণ্ডা জানুয়ারি মাসের সাত সকালে রাস্তায় দাঁড়ালো। টোংকস মেয়েরা যতটুকু পারেন তেমনই সেজেছেন।

বার নম্বর গ্রিমন্ড প্লেসের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। হ্যারি যেতে যেতে পেছন ফিরে তাকালো। মনে হলো বার নম্বর বাড়িটা একটু একটু মাটির তলায় চলে যাচ্ছে। তারপরই বাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলো।

টোংকস তাড়া দিয়ে বললেন–জোরে পা চালাও। সময় হাতে নেই বাস ছেড়ে দেবো।

হ্যারি দেখলো টোংকস একটু নার্ভাস, লুপিন ডান হাতটাতে বাড়ালেন।

ওরা দেখলো গাঢ় বেগুনি রঙের ট্রিপল ডেকার বাস রাস্তায় একধার দিয়ে ওদের কাছে আসছে। আসার সময় রাস্তার ল্যাম্প পোস্টে যাতে না লাগে তার জন্য গতিও কম।

গাড়ি ওদের সামনে থামলে পা-দানি থেকে একজন নীল বেগুনি রঙের ইউনিফর্ম পরা ছেলে নেমে বললো–ওয়েলকাম।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ আমরা জানি এই বাসে আমাদের উঠতে হবে। নাও হে তোমরা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ো, টোংকস তাড়া দিয়ে ছেলে–মেয়েদের বললেন।

টোংকস হ্যারিকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাবার সময় কন্ডাক্টর হ্যারিকে দেখে বললো, আরে… হ্যারি না? টোংকস রেগে গিয়ে বললো, ফের যদি তুমি ওর নাম উচ্চারণ করেছে তো তোমাকে অবলিভিয়ন কার্স দেবো কন্ডাক্টর ভয় পেয়ে জিনি আর হারমিওনকে ওদের সিটে বসিয়ে দিলো।

রন, হ্যারির পাশে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে বললো, আমার এইরকম বাসে চড়ে যেতে মজা লাগে।

সকালের বাস, প্রায় খালি। এর আগে সন্ধ্যাবেলায় হ্যারি যে বাসে গিয়েছিলো শুধু ভিড় আর পেতলের ডাণ্ডাভর্তি ছিলো বাসে।

টোংকস শুন্য সিটগুলো দেখতে দেখতে বললেন–তোমরা সবাই এক জায়গায় বসবে না। অনেক সিট খালি দেখে বললেন, ফ্রেন্ড, জর্জ, জিনি তোমরা ওই পেছনের সিটে গিয়ে বসো। রেমাসও তোমাদের সঙ্গে বসতে পারে। হারমিওন সিট থেকে উঠে রন আর হ্যারির সঙ্গে টপ ডেকে টোংকের সঙ্গে উঠলো। সামনের দিকে দুটো সিট, আর তার পেছনে দুটো সিট খালি ছিলো। স্টেনশানপাইক, কন্ডাক্টর হ্যারি আর রনকে পিছনের সিটে বসালো। একবার ও হ্যারির দিকে তাকালো। রন দেখলো বাসের সকলেই হ্যারির দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

হ্যারি, রন, স্ট্যানকে এগার শিকেল আলাদা আলাদা করে বাসের ভাড়া দিলো। বাস দুলে উঠে চলতে শুরু করলো। বাস গ্রিমন্ড প্লেস চক্কর দিয়ে আবার প্রচণ্ডভাবে ব্যাংগ শব্দ করে ব্যাক করতেই রন পড়ে যেতে যেতে সামলে নিলো। পিগউইজন খাচার মধ্যে রনের কোলে বসেছিলো, গাড়ির ঝাঁকুনিতে খাচার দরজা আলগা হতেই বেরিয়ে গিয়ে বাসে ঘুরতে লাগলো। উড়তে উড়তে হারমিওনের কাঁধে বসলো। হ্যারি সামনের সিটের ক্যান্ডেল ব্র্যাকেট ধরে নিজেকে বাঁচিয়ে নিলো।

বার্মিংহাম ছেড়ে যেতে যেতে স্টেন নিজের মনেই হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললো, নিউজ পেপারে রোজই তোমার সম্বন্ধে খবর পড়ি হ্যারি। এবারে গরম কালেও পড়েছি। কোনোটাই ভাল নয়। রনের সাথে তোমার সম্বন্ধে অনেক গল্প করেছি।

নাইট বাস একের পর এক বাস, গাড়ি ইত্যাদিকে ওভারটেক করে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চললো। হ্যারি দেখল পিগউইগ তখনও হারমিওনের কাঁধে বসে রয়েছে। দূরন্ত হাওয়া থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য হারমিওন চোখের ওপোর হাত চেপে রেখেছে।

ব্যাংগ বাসের চেয়ারগুলো দুলে উঠলো। নাইটবাস বার্মিংহাম মোটরওয়ে থেকে শান্ত শহরতলীর রাস্তা দিয়ে চললো, মাঝে মাঝে হেয়ারপিন বাঁক। ওধারের গাড়ি আসার শব্দ শুনে গতি কমাচ্ছে সাবধানে বাঁক পার হচ্ছে। সেখান থেকে বিভক্ত রাস্তায় এসে পড়লো। তারপরে মেইন স্ট্রিট একটা সরগরম শহর ছেড়ে বিরাট পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছলো। তারপর বড় বড় ফ্ল্যাট। পাহাড়ি ঝড় বইছে। মাঝে মাঝে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে ব্যাংগ… ব্যাংগ।

স্টেন বললেন, এটা হোগওয়ার্টস স্টপ। টোংক বললেন, সকলে প্রস্তুত হয়ে নাও। দাঁড়াও দাঁড়াও প্রথমে ম্যাডাম মার্শকে নামতে দেবে কিন্তু, তাড়াহুড়ো করবে না। লাইন লাগিয়ে নামবে।

কিছুক্ষণ পরে নাইটবাস ছোট একটা পারের পাশে দাঁড়ালো। সরু রাস্তা, গাড়ির ধাক্কা বাঁচাতে যতোটা পেরেছে রাস্তা ছেড়ে দিয়েছে পারের মালিক। ওরা শুনতে পেলো স্টেনের গলা, ম্যাডাম মার্শকে বাস থেকে নামিয়ে দিলো। বাস আবার চলতে লাগলো, একটু একটু করে গতিও বেড়ে গেলো।

ব্যাংগ, ব্যাংগ, ব্যাংগ শব্দ করেই বাস চলেছে।

স্নো ঢাকা হগসমিড দিয়ে চললো বাস। হ্যারির চোখে পড়লো ওর পরিচিত হগসহেড পাব, একেবারে রাস্তার শেষ প্রান্তে। পাবের ভাঙা চোরা, ঝুলে পড়া সাইনবোর্ড প্রচণ্ড হিমেল হাওয়াতে দুলে চলেছে। বাসের সামনের কাঁচে থোকা থোকা স্লো জমা হচ্ছে। অবশেষে বাস হোগার্টসের গেটের বাইরে থামলো।

লুপিন আর টোংকস ছেলে–মেয়েদের ওদের মালপত্র নিয়ে এক এক করে বাস থেকে নামতে সাহায্য করলেন। চতুর্দিকে জনমানবহীন রাস্তা দেখতে দেখতে বললেন লুপিন, পরীক্ষা যেন ভালো হয়, ওকে।

লুপিন এক এক করে সকলের সঙ্গে করমর্দন করতে করতে বললেন নিজেদের নিজেরা দেখাশুনো করবে, ভালোভাবে থাকবে। ছেলে মেয়েরা যখন টোংকসের কাছে বিদায় নিচ্ছে তখন লুপিন হ্যারিকে খুব আস্তে আস্তে বললেন শোনো, আমি খুব ভালো করেই জানি তুমি স্নেইপকে পছন্দ করো না, কিন্তু ও অতি গুণি অকালামেনস্। আমরা এবং সিরিয়সও চায় তুমি ভালভাবে ওটা শিখে নাও তোমাকে প্রোটেক্ট করার জন্য। মনে থাকে যেনো?

হ্যারি লুপিনের কুঞ্চিত চামড়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা আবার দেখা হবে।

পিছল রাস্তা দিয়ে অতি কষ্টে ওরা ক্যাসেলে পৌঁছোলো। সঙ্গে ওদের বড় বড় ট্রাঙ্ক। হারমিওন এলফের জন্য অনেক মোজা–টুপি বানিয়েছে, সেগুলোও সঙ্গে করে এনেছে। হ্যারি ওক গাছের দরজা থেকে দেখলো নাইট বাস অনেক দূরে চলে গেছে। জানে না ওর কপালে কি লেখা আছে।

***

হ্যারির পরদিন সন্ধ্যাবেলার কথা ভেবে উৎকণ্ঠায় দিন কাটলো। সকালে ডবল পোসান লেসন ওর ভয় মিশ্রিত চাঞ্চল্য কমাতে কনামাত্র সাহায্য করলো না। ওর অস্বস্তি ডিএ সদস্যদের নিয়ে। করিডোরে দেখা হলেই জানতে চেয়েছে সেদিন রাতে মিটিং হবে কি হবে না।

হ্যারি ওদের বার বার বলেছে, সময় হলে তোমাদের জানাবো; কিন্তু আজ রাতে কিছুতেই সম্ভব হবে না। বললো, রেমিডিয়ন পোসান নিতে হবে।

লাঞ্চের পর জ্যাকেরিয়া স্মিথ বললো, তুমি রেমিডিয়ন পোসান খাও? হ্যারি তখন এনট্রেন্স হলের মুখে দাঁড়িয়েছিলো। ঈশ্বর, তোমার বোধহয় পড়াশুনোর ব্যাপারে খারাপ সময় চলছে। স্নেইপতো দারুণ কড়া, কবে থেকে একস্ট্রা লেসন দিচ্ছেন?

ও মনে মনে ভাবলো আজেবাজে কথা বলার জন্য স্মিথকে জাদুমন্ত্রে (জিঙ্কস) চুপ করাবে কিনা; তারপর ভাবলো, যাকগে।

–হ্যালো হ্যারি।

হ্যারি চমকে পেছনে তাকিয়ে দেখলো চো-চ্যাং। হারমিওন ওর কনুই ধরে টানতে টানতে বললো–আড্ডা দিলে চলবে? লাইব্রেরিতে যেতে হবে না?

–ক্রিস্টমাস কেমন কাটালে, চো জিজ্ঞেস করলো।

–খুব একটা খারাপ না; হ্যারি বললো। তোমার?

–একরকম। খুব একটা হৈ চৈ করা হয়নি।

হ্যারি লক্ষ্য করলো ওর মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। আগামীকাল আমাদের হগসমিডে ট্রিপ আছে, নোটিশ বোর্ড দেখেছো?

–কী বললে? নাতো, এখনও পর্যন্ত নোটিশ বোর্ড দেখার সুযোগ পাইনি।

–ওটা হবে ভ্যালেন্টাইন ডে তে? হ্যারি বুঝতে পারলো না চো ওকে কথাটা বললো কেন।

–তাহলে তুমি তো যাবে?

–ও হ্যাঁ, যেতে পারি।

বেশ, যদি যাওতো তোমাকে ওখানে খুঁজে নেবো।

চো চলে গেলো। হ্যারি ওকে দেখতে লাগলো। চোকে ডিএর কথা বলাতে চো তেমন তাপ উত্তাপ দেখায়নি।

হঠাৎ হ্যারির মনে পড়ে গেলো একটা কথা ওকে বলা হয়নি। ও তাই বেশ জোরে জোরে ডাকলো–চো… চো…।

কথাটা বলে ওকে ধরবার জন্য হ্যারি একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে ওকে পাথরের সিঁড়ির কাছে ধরে ফেললো।

–তুমি আমার সঙ্গে হাসমিডে ভ্যালেন্টাইনডেতে যাবে?

–উঃ নিশ্চয়ই, কেন যাবো না! চোর গাল দুটো লাল হয়ে গেলো।

–তাহলে তাই কথা রইলো, খুঁজতে হবে না, আমি যাবো।

বিকেলের হোমওয়ার্ক, পড়াশুনোর জন্য হ্যারি লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলো রন, হারমিওন পড়াশুনো করছে।

মনের মধ্যে চো-এর স্বপ্ন নিয়ে সন্ধ্যে ছটা বাজার আগে প্রফেসর স্নেইপের ঘরের সামনে পৌঁছালো। দুরু দুরু বুকে ও বন্ধ দরজা নক করে ঘরে ঢুকলো। আধা আলো অন্ধকার ঘরে দেখলো দেওয়াল আলমারি আর র‍্যাকে সাজানো রয়েছে নানা আকারের বোতল আর জার। তাতে রঙিন পোসানের মধ্যে রয়েছে অনেক গাছের গুলু আর ছোট ছোট জম্ভ আর পোকা মাকড়। স্নেইপের টেবিলের ওপোর আর কাবার্ডে রয়েছে পোসান ভর্তি অনেক বোতল। একবার স্নেইপ ওকে পোসান সরানোর মিথ্যা অভিযোগে কটুক্তি করেছিলেন। ও ডেস্কের পাশে দেখলো একটা অপরিষ্কার পাথরের বেসিন। তার গায়ে খোদিত রয়েছে পুরনো দিনের নানা ভাষার। অক্ষর আর সিম্বল। মোমবাতির আলো পড়ে সেগুলো জুল জুল করছে। ওর বুঝতে বাকি রইলো না বেসিনটা ও ডাম্বলডোরের অফিস ঘরে খুব সম্ভব দেখেছে। ডাম্বলডোর পেনসিভ। স্নেইপের ঠাণ্ডা গলার স্বর শুনে ও একরকম লাফিয়ে উঠলো।

–পটার, তুমি কিন্তু ঘরে ঢোকার পর দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছে, ওটা বন্ধ করে দাও।

হ্যারি আধখোলা দরজাটা বন্ধ করে ধীরে ধীরে স্নেইপের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো।

–হ্যারি, তুমি নিশ্চয়ই জানো ডাম্বলডোরের নির্দেশমতো তোমাকে অকলামেন্সি শেখানোর জন্য এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে। আমি আশা করছি পোসান ছাড়াই তুমি ওই প্রতিরোধটা ভাল করে শিখে নেবে।

–হ্যাঁ। হ্যারি বললো। হ্যারি বলতে যাচ্ছিল, আপনি বোধহয় জানতে চান কবে আমাদের ডিএ মিটিং হবে।

স্নেইপ তার ছোট ছোট চোখে আপাদ-মস্তক খুঁটিয়ে হ্যারিকে দেখে বললেন, এটা কিন্তু সাধারণ ক্লাস নয় মনে রাখবে। যেহেতু আমি তোমার এখনও শিক্ষক, তাই তুমি আমাকে স্যার বা প্রফেসর বলে সম্বোধন করবে।

–হ্যাঁ, স্যার; হ্যারি বললো।

–অকলামেন্সি সম্বন্ধে তোমাকে আমি তোমার অতি প্রিয় ধর্মপিতা সিরিয়সের সামনে বলেছি। আবার বলছি, একরকমের ম্যাজিক যা তোমাকে তোমার অস্বাস্থ্যকর চিন্তা ও জাদুশক্তি থেকে প্রতিহত করবে, এই জাদুর প্রবল শক্তিতে।

হ্যারি বললো, প্রফেসর ডাম্বলডোর কেন আমাকে ওটা শিখতে বলেছেন, দয়া করে বলবেন স্যার? ও স্নেইপের মুখের দিকে উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো।

–অবশ্যই তোমার শেখার প্রয়োজন আছে। পটার তুমি বোধহয় জানো না ডার্কলর্ড প্রভূতভাবে লেগিলিমেন্সি সম্বন্ধে অত্যান্ত পারদর্শী।

–সেটা কী স্যার?

–অন্যদের মনের ভেতর থেকে তাদের চেতনা এবং স্মৃতি শুষে নেয়ার ক্ষমতা।

–উনি মানুষের মনের কথা অতীতের স্মৃতি জানতে-পড়তে পারেন? হ্যারি ভয় পেয়ে গেলো।

–পটার তোমার ধরতে পারার ক্ষমতা খুবই অল্প, স্নেইপ জ্বলন্ত চোখে বললেন, তোমার পার্থক্য বোঝার শক্তি কম। সেই জন্যই তুমি পোসান–বানানোর ব্যাপারে অতি দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ।

স্নেইপ হ্যারিকে প্রকারন্তরে অপমান করার জন্য খুবই খুশি।

 তারপর গর গর করে বলে যেতে লাগলেন:

–মাগলরা মনের কথা পড়ার (মাইন্ড রিডিং) কথা বলে থাকে। মন কিন্তু আসলে একটা বই নয় যে যখন খুশি পড়বে। চিন্তা, মানুষের খুলির ভেতরে খোদাই করা থাকে না, যে বাইরে থেকে পড়া যাবে। চিন্তা ভাবনা খুবই জটিল ব্যাপার।

এই ধরো ডার্কল, কে বা কারা তার সঙ্গে মিথ্যে বলছে, কিছু গোপন করছে ওই বিদ্যের সাহায্যে তিনি তা বুঝতে পারেন। মিথ্যেকে ধরতে, অন্যের প্ল্যান-কুমতলব ধরতে পারা এবং কে বা কারা বিরুদ্ধচারণ করছে একমাত্র যারা অকলামেন্সিতে পারদর্শী তারাই ধরতে পারে। তাছাড়া ছানবিন না করেই সেটা ধরতে পারেন।

স্নেইপ যা বকবকানি করুন না কেন, লেজিলিমেন্সি কথাটা প্রকৃত মনের কথা পড়ার বা জানার ব্যাপারটা ওর তেমন মনপুত হলো না।

–তো আমরা এখন যা আলোচনা করছি তা কি ভোল্ডেমর্ট জানতে পারবেন স্যার?

ডার্কলর্ড এখন আমাদের থেকে অনেক দূরে রয়েছেন, তাছাড়া আমাদের হোগওয়ার্টস স্কুলের দেওয়াল, মাঠ, অতি পুরাতন মন্ত্রের দ্বারা রক্ষিত। এখানে যারা থাকে তারাও জাদু-মন্ত্র থেকে সব রকমভাবে সুরক্ষিত। কালের ও সময়ের যুগ্ম পরিপ্রেক্ষিত জাদুর ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, স্নেইপ বললেন।

–বেশ, তাহলে আমাকে অকলামেন্সি শেখাবেন কেন?

স্নেইপ হ্যারির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। অভ্যাস মতো হাতের লম্বা লম্বা আঙ্গুল দিয়ে নিজের গালে চাপ দিলেন।

–পটার ব্যবহারিক নিয়ম তোমার ওপর প্রযোজ্য নয়। যে কার্স তোমাকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয়েছে তাতে তোমার ও ডার্কলর্ডের মধ্যে সম্পর্কের একটা যোগাযোগ রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, যখন তোমার মনের গতিবেগ সম্পূর্ণভাবে হ্রাস পায় আর ভাবাবেগপূর্ণ, ধরো যখন ঘুমোচ্ছো, তখন তুমি ডার্কলর্ডের সঙ্গে একই নৌকোতে চলতে থাকো, চিন্তা আর ভাবাবেগ ভাগ করে নাও। ডাম্বলডোর বলছেন, এইরকম অবস্থা চলতে দেওয়া ঠিক হবে না। আমাকে বলেছেন যেন সেই অবস্থার অবসান ঘটে এমন কিছু শেখাতে।

হ্যারির নাড়ি আবার দ্রুত চলতে থাকে, কোনো কিছুই দানা বাঁধে না যেন।

ও একটুও সময় অপব্যয় না করে বললো, ডাম্বলডোর সেটা বন্ধ করতে চাইছেন কেন? আমি মনে করি ওটা দরকারি। মি. উইসলিকে ডাকলর্ডের সাপ আক্রমণ করতে যাচ্ছে আমি যদি না দেখতাম তাহলে প্রফেসর ডাম্বলডোর তাকে বাঁচাতে পারতেন না। বলুন পারতেন?

হ্যারির প্রতিটি কথা বিশ্বাসযোগ্য ভেবে স্নেইপ চুপ করে রইলেন। মুখের ওপোর তখনও আঙ্গুল। আবার কথা বলতে শুরু করলো হ্যারি। প্রতিটি শব্দ যেনো ওকে বেশি সময় দিয়েছে।

যতদূর মনে হয় ডার্কলর্ড ব্যাপারটা অবগত ছিলেন না। মনে হয় এখন থেকে তোমার চিন্তা ভাবাবেগ একই সঙ্গে বহন করছেন। কিন্তু ক্রিসমাসের আগে যেটা দেখেছো….।

–মিঃ উইসলি আর সাপ?

–আমাকে বাধা দিও না হ্যারি, স্নেইপ রাগতঃ স্বরে বললেন। যা তুমি দেখেছো, সেটা ডার্ক লর্ডের একটি শক্তিশালী চিন্তার বহি আক্রমণ বলতে পারো।

–আমি সাপের মধ্যে আমাকে দেখেছিলাম, তাকে নয়!

–একটু আগেই বলেছি, আমাকে বাধা দেবে না।

হ্যারির স্নেইপের রাগে কিছু যায় আসে না।

–আমি কেমন করে সাপের চোখ দিয়ে আমার দেখা দেখলাম? যদি ভোল্টেমর্টের চিন্তা আমি বহন করছি?

–তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি ডার্কলর্ডের নাম আমার সামনে মুখে আনবে, স্নেইপ বললেন।

 হ্যারি শান্ত স্বরে বললো–ডাম্বলডোরতো তাই বলেন।

–ডাম্বলডোর একজন অতি অভিজ্ঞ জাদুকর, স্নেইপ বললেন, সুরক্ষিত থাকেন।

হ্যারি ওর হাতের উপরাংশে বুলায়, অনেকটা অন্য মনস্কভাবে, যদিও জানে ডার্কলর্ড চামড়াটার কিছু অংশ পুড়িয়ে দিয়েছেন।

–আমি মোটামুটি ব্যাপারটা জানতে চাইছিলাম, হ্যারি আবার বলতে শুরু করলো। চেষ্টা করলো নরম সুরে কথা বলতে। কিন্তু কেন?

স্নেইপ মুখ বিকৃত করে বললেন, তুমি সাপের মনের মধ্যে একাত্ম হয়েছিলে, কারণ ঠিক সেই সময়ে ডার্কলর্ড সেখানে ছিলেন। সাপ তখন তার বশে ছিলো, তো তুমি স্বপ্নে দেখেছিলে তুমি সাপের মধ্যে রয়েছে।

–তো ভো… বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি ওখানে ছিলাম?

স্নেইপ বললেন–তাইতো মনে হয়।

–কেমন করে আপনি জানলেন? প্রফেসর ডাম্বলডোর একটা কিছু অনুমান করেছিলেন। অথবা…?

–কতবার তোমাকে বলেছি, আমাকে স্যার বা প্রফেসর সম্বোধন করতে।

হ্যারি বললো–হ্যাঁ স্যার, কিন্তু কেমন করে আপনি জানলেন?

–যাক ও সব কথা। আমরা জেনেছি এটাই যথেষ্ট। স্নেইপ জোর দিয়ে বললেন–ডার্কলর্ড এখন জানতে পেরেছেন তুমি তার চিন্তা ও অনুভূতির পথে ঢুকে পড়েছে। বুঝতে পেরেছেন, যা করতে চেয়েছেন সেটা ঘুরে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে।

তাহলে তো আমাকে দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করাতে পারেন, হ্যারি প্রশ্ন করেই। বললো স্যার?

–ভাবতে পারেন, করতে পারেন, স্নেইপ বললেন। যাকগে ওসব কথা, এখন আমরা অকলামেন্সি নিয়ে কথা বলি।

স্নেইপ কথাটা বলে তার রোবের পকেট থেকে জাদুদণ্ডটা টেনে বার করতেই হ্যারি ওর চেয়ারে স্থির হয়ে বসলো। কিন্তু স্নেইপ দণ্ডটা তার কপালে ঠেকিয়ে তার অগ্রভাগটা মাথার তৈলাক্ত চুলে খুঁজলেন। একটু পরে সেটা টেনে নিতেই কিছু রূপালী পদার্থ বেরিয়ে এসে তার কপাল ও জাদুদণ্ড ভরে দিলো। দণ্ডটা টেনে নিতেই পদার্থটা পেনসিভে গিয়ে পড়লো। তারপর রূপালী পদার্থটা ঘুরতে লাগলো। রূপালী পদার্থটা গ্যাস অথবা তরল পদার্থ নয়। দুবার জাদুদণ্ড দিয়ে কপালে ঠেকিয়ে রূপালী পদার্থ পাথরের বেসিনে জমা করলেন। তারপর কোনও কিছু প্রশ্নের অপেক্ষা না করে পেনসিভটা অতি যত্নের সঙ্গে হাতে নিয়ে হ্যারির মুখের দিকে তাকালেন। হাত থেকে কিন্তু জাদুদণ্ড সরালেন না। অন্য কিছু করার জন্য প্রস্তুত হলেন।

–পটার, তোমার জাদুদণ্ডটা হাতে নিয়ে দাঁড়াও, স্নেইপ আদেশ করলেন।

হ্যারি নার্ভাস হয়ে দাঁড়ালো। ডেস্কের দুধার থেকে সামনা সামনি তাকালো।

–এখন, তুমি তোমার জাদুদণ্ড ব্যবহার করে আমার ক্ষমতা খর্ব করতে পারো। অথবা যেমন করে হোক বা যেভাবেই হোক নিজেকে বাঁচাবার পন্থা চিন্তা করো, স্নেইপ বললেন।

হ্যারি স্নেইপের জাদুদণ্ডের দিকে তাকিয়ে বললো–আপনি এখন কি করতে চান?

স্নেইপ বললেন, আমি তোমার মনের ভেতর প্রবেশ করতে চাই। আমরা দেখিতে চাই তুমি কেমন সুন্দরভাবে নিজেকে বাঁচাও। আমাকে জানানো হয়েছে তুমি নাকি ইমপেরিয়স কার্স প্রয়োগে সফল হয়েছে। এখন তুমি দেখাবে সেইরকম ক্ষমতা তোমার পক্ষে প্রয়োজন আছে, দৃঢ় করে নিজেকে।

হ্যারি আত্মরক্ষা করার প্রস্তুতি নেবার আগেই স্নেইপ ওকে আঘাত করলেন। মুহূর্তের মধ্যে অফিসের সবকিছু ওর চোখের সামনে আবর্তিত হতে হতে অদৃশ্য হয়ে গেলো, মনের ভেতর নানা মূর্তি একের পর এক ছবির মতো ছুটতে লাগলো। অনেকটা ক্লিক ক্লিক করে ছবি তোলার মত। দেখতে দেখতে সুদূর অতীতে ও চলে গেলো।

হ্যারি দেখছে

ওর বয়স পাঁচ, ও দেখছে ডাডলি একটা নতুন লাল বাইসাইকেলে চেপে বনবন করে ঘুরছে। ওর হিংসে তো হবেই। ওর বয়স নবছর, বুলডগ রূপার ওকে তাড়া করছে। ভয়ে ও একটা গাছে উঠে পড়েছে আর ভার্নন ওর অবস্থা দেখে লনে দাঁড়িয়ে হেসে ফেটে পড়ছে। ও সর্টিং হ্যাটের তলায় বসে রয়েছে ওকে বলা হচ্ছে, তুমি স্নিদারিনে যাও তোমার ভাল হবে। হারমিওন হাসপাতালের বেডে শুয়ে রয়েছে। ওর সমস্ত মুখটা কালো চুলে ঢাকা। অন্ধকার লেকের ধারে ওকে একশটা ডিমেন্টরস তাড়া করেছে। আবছা আবছা কুয়াশা, চো চ্যাং ওর খুব কাছে আসছে।

ওর মাথার ভেতর থেকে কে যেন বললো, না। চো এখন ওর অনেক কাছে এসেছে। তুমি ওটা দেখছো না, এটা দেখছো না, খুবই ব্যক্তিগত কথা বলছে চো।

হাঁটুতে ওর তীব্র ব্যথা। পরিষ্কার স্নেইপের অফিস দেখতে পাচ্ছে। ও হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলো। একটা হাঁটু স্নেইপের ডেস্কে লেগেছে। হাঁটুতে অসম্ভব যন্ত্রণা। ও স্নেইপের দিকে তাকালো, স্নেইপ জাদুদণ্ড নামিয়ে রেখে নিজের কব্জিতে হাত বোলাচ্ছে। কে যেনো চাবুক মারলো তারই শব্দ। গায়ে দাগ পড়ে গেলো।

–তুমি কি যন্ত্রণাদায়ক জাদুদণ্ড ব্যবহার করতে চাও? স্নেইপ জিজ্ঞেস করলেন। খুব নরমভাবে।

–না, মেঝে থেকে ধীরে ধীরে উঠে হ্যারি বললো।

–আমিও তাই ভেবেছিলাম, স্নেইপ ওকে খুব কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখে। বললেন–তুমি আমাকে বাধ্য করেছো, তুমি নিজেকে সংযত করতে পারোনি।

–আমি যা যা দেখেছি, আপনিও কি তাই দেখেছেন? হ্যারি জানেনা স্নেইপ ওর প্রশ্নের জবাব দেবেন কি দেবেন না।

–আবার বলো, স্নেইপ বললেন–তার ঠোঁট বেঁকে গেছে, কুকুরটা কার?

–আমার মাসী মার্গির, হ্যারি স্নেইপকে তাচ্ছিল্য করে বিড়বড়ি করে বললো।

স্নেইপ বললেন, প্রথম চোটে বলতে হবে ভালই হয়েছে। এতোটা আশা করিনি। আবার জাদুদণ্ড তুললেন, তুমি আমাকে মাঝে মাঝে থামিয়ে দিতে চেয়েছো, চিৎকার করে সময় ও শক্তি নষ্ট করেছো। তুমি অবশ্যই কেন্দ্রীভূত থাকবে। তোমার মস্তিষ্কের সাহায্যে আমাকে অবনমিত করবে, তোমার যেন জাদুদণ্ডের প্রয়োগ করতে না হয়।

হ্যারি রেগে গিয়ে বললো, আমি চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনি আমাকে কেমন করে ওগুলো হলো বলছেন না। স্নেইপ দারুণ ক্ষেপে গিয়ে বললেন, সভ্যতা, ভদ্রতার প্রয়োজন। আমি চাই তুমি তোমার চোখ বন্ধ করো।

 হ্যারি স্নেইপের দিকে বিশ্রীভাবে তাকালো, যা বলা হয়েছে তা করার আগে। ও ওখানে দু চোখ বন্ধ করে দাঁড়াতে চায় না। যখন স্নেইপ ওর দিকে তাকিয়ে থাকবেন তখন ওর হাতে থাকবে জাদুদণ্ড।

–না-আ-আ-আ!

হ্যারি আবার দাঁড়ালো, দুহাতে মুখ ঢাকলো। কে যেন ওর মাথার ভেতর থেকে মস্তিষ্ক টেনে বার করতে চাইছে, দারুণ অব্যক্ত এক যন্ত্রণা!

–উঠো, উঠে দাঁড়াও বলছি, স্নেইপ হুংকার দিলেন। তুমি কোনও রকম চেষ্টা করছে না, কোনও কঠোর প্রচেষ্টা করতে চাইছে না। তুমি এখন তোমার স্মৃতিতে আমাকে প্রবেশাধিকার দিচ্ছে। সেসব স্মৃতিকে তুমি ভয় পাও, তোমার অস্ত্র আমাকে দিয়ে দিতে ভয় পাচ্ছো।

হ্যারি আবার উঠে দাঁড়ালো। ওর বুকের ভেতরটা বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠলো, যেন এই মাত্র ও সেডরিককে কবরস্থানে মৃত অবস্থায় দেখতে পাচ্ছে। স্নেইপ যেন আগের চেয়ে শীর্ণ-বিবর্ণ, আরও বেশি রাগী কিন্তু হ্যারির মতো নয়।

ও দাঁতে দাঁত চেপে বললো–আমি চেষ্টা করছি

–তোমাকে বলেছি না তোমার মানসিক আবেগ থেকে তুমি মুক্ত হও!

হ্যারি বললো, আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছি।

–যদি না করো তাহলে অতি সহজে ডার্কলর্ডের মুঠোর মধ্যে চলে যাবে, স্নেইপ দাঁত মুখ খিচিয়ে বললেন–মুর্থেরা তাদের আবেগ আয়ত্ত্বে রাখতে পারে না, পালিয়ে গিয়ে গর্বিত হয়, সহজেই অন্যের প্ররোচনার ফাঁদে পা দেয়, এক কথায় তারা শক্তির কাছে কাঠপুতলী! পটার তুমি কী বুঝতে পারছে না ডার্কলর্ড তোমার মনের ভেতর বাধাহীন হয়ে প্রবেশ করবেন।

হ্যারি চাপা গলায় বললো–আমি দুর্বল নই। মনের ভেতর উম্মা জমা হয়ে চলেছে। ও ভাবলো, যে কোনও মুহূর্তে ও স্নেইপকে আক্রমণ করতে পারে।

স্নেইপ তখন থুতু ফেলার মতো মুখের ভাব করে বললেন–তাহলে প্রমাণ করো তুমি দুর্বল নয়। মনকে সংযত করো, নিয়ন্ত্রিত করো। আমরা আবার চেষ্টা করি, নাও তৈরি হও! লেজিলিমেন্স!

ও দেখতে পাচ্ছে আঙ্কল ভার্নন হাতুড়ি দিয়ে চিঠির বাক্স ভাঙছেন শত শত ডিমেন্টরসরা লেক থেকে ওকে ধরবার জন্য সাতরে সঁতরে আসছে ও একটা জানালাবিহীন করিডোর দিয়ে দৌড়াচ্ছে সঙ্গে রয়েছেন মি. উইসলি একটু একটু করে সাদা মাটা কালো দরজার কাছে এসে গেছে। দরজাই সেই করিডোরের শেষ। ও সেই দরজা ঠেলে ঢুকতে গেলে মি. উইসলি ওকে বাধা দিলেন, বাঁ দিকে নিচে নামার একটা পাথরের সিঁড়ির মুখে নিয়ে গেলেন।

আমি জানি! আমি জানি।

ওরা চারজনে আবার স্নেইপের অফিসে। ওর কাটাদাগে কি যেনো সূঁচের মতো অনবরত বিধে চলেছে, কিন্তু মুখ থেকে বেরিয়ে এলো বিজয় বার্তা। ও আবার জোর করে দাঁড়ালো, দেখলো স্নেইপ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে, ওর ম্যাজিক দণ্ডটা ওঠালো। কিন্তু তার আগেই জাদুদণ্ডটা তুলেছেনও হ্যারির সঙ্গে লড়াইয়ে প্রস্তুত।

–তারপর কি হলো পটার, হ্যারির দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে স্নেইপ বললেন।

–আমি দেখেছি, আমার মনে আছে, হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে বললো। আমি তখন বুঝতে পারলাম।

–বুঝতে পারলে? কী বুঝতে পারলে? স্নেইপ তীক্ষ্মভাবে প্রশ্ন করলেন।

হ্যারি তৎক্ষণাৎ স্নেইপের মর্ম বুঝতে পারলো না। ও কপালে হাত বোলাতে লাগলো।

মাসের পর মাস ও একই স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে–জানালাবিহীন করিডোর। করিডোরের শেষ প্রান্তে তালাবন্ধ এক দরজা। এখন ও বুঝতে পারছে ১২ আগস্ট ও মি. উইসলির সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের কোর্টরুমে যাবার জন্য ওইরকম করিডোর দিয়ে গিয়েছিলো। ওই করিডোর ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজের দিকে গেছে, ভোল্টেমর্টের সাপ তাকে দংশন করার সময় উইসলি সেই রাতে ওখানে ছিলেন।

ও আবার স্নেইপের দিকে তাকালো।

 –ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজ-এ কী আছে?

–কী প্রশ্ন করলে তুমি? স্নেইপ ধীরে ধীরে বললেন। এই প্রথম হ্যারি দেখলো স্নেইপ ভয় পেয়ে গেছেন।

হ্যারি আবার বললো–সেখানে কী আছে স্যার?

 –কেন তুমি এই প্রশ্ন বার বার করছো? স্নেইপ বললেন।

–কারণ, কারণ স্বপ্নে যে করিডোরের মাসের পর মাস দেখে চলেছি। সেটা কোথায় আমি বুঝতে পেরেছি। ওই করিডোরটা সোজা চলে গেছে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজের দিকে। আমার মনে হয় ভোল্ডেমর্ট সেখানে কিছু সগ্রহ করতে চাইছেন।

–আমি তোমাকে কতবার বলবো যে ডার্কলর্ডের নাম তুমি মুখে আনবে না?

দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকালো। হ্যারির কাটাদাগে আবার যন্ত্রণা শুরু হলো। তার জন্য ওর মাথা ব্যথা নেই, পরোয়া করে না। স্নেইপকে দেখে মনে হয়। দারুণ উত্তেজিত, কিন্তু যখন কথা বললেন–মনে হয় চেষ্টা করছেন শান্ত হতে আর কোনও কিছু ক্ষেপ না করতে।

–ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজ-এ অনেক কিছু আছে পটার, তার মধ্যে কিছু তুমি বুঝতে পারবে, বাকিগুলোর না বুঝলেও চলবে। আমি কী তোমায় সোজাভাবে বোঝাতে পেরেছি?

–হা, হ্যারি বললো, তখন ও কপাল চুলকে যাচ্ছে, আরও যেনো ব্যথা বেড়ে চলেছে।

–আমি চাই আগামী বুধবার কোনও এক সময়ে তুমি আবার এখানে আসবে, আবার আমরা কাজ করবো।

স্নেইপের অফিস ঘর থেকে হ্যারি চলে আসতে পারলে বাঁচে রন, হারমিওনকে দেখতে পেলে ভাল লাগবে।

–প্রতিরাতে শুতে যাবার আগে তুমি তোমার মন থেকে সবকিছু হটিয়ে দেবে, শূন্য মনে থাকবে। এবং শান্ত রাখবে বুঝেছো?

–আচ্ছা, হ্যারি অস্ফুট স্বরে বললো। তারপর ও স্কুল ব্যাগটা তুলে কাঁধে ঝুলিয়ে দরজার দিকে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো। বাইরে যাবার আগে একবার স্নেইপের দিকে তাকালো, স্নেইপ হ্যারির দিক থেকে পেছন ফিরে বসে আপন চিন্তায় মগ্ন। পেনসিভটা জাদুদণ্ডের মুখে ঠেকিয়ে খুব সাবধানে মাথার ওপোর রাখলেন। হ্যারি নিঃশব্দে সেখান থেকে চলে আসার আগে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। তখনও ওর কাটা দাগটা দপদপ করে চলেছে, তারই সঙ্গে ব্যথা কমছে না।

হ্যারি লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলো রন আর হারমিওন বসে রয়েছে। ওরা আমব্রিজের দেওয়া নতুন হোমওয়ার্ক করছে। বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রী পঞ্চম বার্ষিকের। বাতি জ্বালানো টেবিলে বসে বইতে মুখ গুঁজে, কুইল দিয়ে মাথা চুলকে চলেছে। এমনিতে ঘরটা নিস্তব্ধ। জানালার বাইরে আকাশ একটু একটু অন্ধকার হয়ে চলেছে। মাঝেমাঝে ম্যাডাম পিনসের জুতোর মচমচ শব্দ শোনা যাচ্ছে। লাইব্রেরিয়ান সজাগ দৃষ্টি দিয়ে চলেছেন পাঠরত ছাত্র-ছাত্রীদের ওপোর। তার একমাত্র লক্ষ্য ওরা যেনো অমূল্য বইগুলো নষ্ট না করে।

হ্যারি তখনও কাঁপছে, যন্ত্রণার উপশম হয়নি, মনে হয় ওর জ্বর আসছে।

হারমিওন বললো, কেমন হলো? তোমার শরীর ভাল আছে তো?

–হ্যাঁ ভাল, খুব ভাল। শোনো, এখন একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি।

ও এক এক করে স্নেইপের ঘরে যা ঘটেছে সব বলে গেলো।

 রন খুব আস্তে আস্তে বললো যাতে ম্যাডাম পিনসের কানে না যায়।

–তাহলে ওটাই মনে হয় অস্ত্র, ইউ-নো-হু চাইছেন মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিক আয়ত্ত্বে আনতে।

–মিনিস্ট্রি অফ মিস্ট্রিজ এ তোমার বাবার সঙ্গে কোর্ট রুমে আমার হিয়ারিং এ যাবার সময় যে করিডোর ধরে গিয়েছিলাম সেটা দেখেছি। আর সেই একই করিডোর গার্ড দিচ্ছিলেন যখন তাকে সাপে দংশন করেছিলো।

–অবশ্যই, হারমিওন বড় দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললো।

–অবশ্যই কি? রন অধৈর্য হয়ে বললো।

–রন ভাবতে শেখো। স্টারগিজ পডমোর, মিনিস্ট্রি অফ ম্যাজিকের একটা দরজা ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন। সেই করিডোর, সেই দরজা খুব বেশি একটা কাকতালীয় ব্যাপার নয়।

রন বললো, স্টারগিজ তো আমাদের দলে। তিনি কেন দরজা ভাঙতে যাবেন?

হারমিওন বললো, তাতো বলতে পারবো না। কেমন যেনো বেখাপ্পা সবকিছু মনে হচ্ছে।

–তাহলে ডিপার্টমেন্ট অফ মিস্ট্রিজে কি আছে? তোমার বাবা কখনও কিছু বলেননি? হ্যারি বললো।

হ্যারি ওর কপালটা হাত দিয়ে চেপে ধরে রইলো।

হারমিওন বললো, হ্যারি শরীর খারাপ লাগছে?

–না, ভাল আছে। কথাটা বলে ও কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। আমি ভাবছিলাম অকলামেন্সি আমার একটুও ভাল লাগছে না।

হারমিওন সহানুভূতির সুরে বললো–ভালো না লাগাই স্বাভাবিক।

জর্জ-ফ্রেডএর অনেক প্রশ্নের একটারও জবাব দিলো না হ্যারি। ওর শরীর ভীষণ খারাপ লাগছে। বললো আমাকে আবার আগামীকাল যেতে হবে।

–তোমার হোমওয়ার্ক প্ল্যানারে লিখে রাখো হ্যারি। তুমি ভুলে যেতে পারো হারমিওন বললো।

থাকগে আমি শুতে চললাম। ওর মনের যা অবস্থা ফ্রেড আর জর্জের ভঁড়ামী ভাল লাগছে না।

লাইব্রেরি ঘরের বাইরে পা দিতেই আবার প্রবল মাথার যন্ত্রণা। মনে হতে লাগলো মাথাটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে। সব যেন ঘুলিয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না কোথাও দাঁড়িয়ে রয়েছে না শুয়ে রয়েছে। নিজের নামটাও মনে করতে পারছে না।

কে যেন কানের কাছে মুখ এনে খন খনিয়ে হাসছে হাসি তার থামছে না। আশ্চর্য! ওর মনে হতে লাগলো আগের চেয়েও অনেক সুখী আনন্দ ভরা ওর মন।

দারুণ, দারুণ একটা জিনিস সংগঠিত হয়েছে যেন!

হ্যারি? হ্যারি?

কে যেনো ওর মুখে সজোরে চড় মারলো। হঠাৎ মনের সেই আনন্দ অন্তহীত হয়ে গেলো। কিন্তু কানের কাছে সেই বিশ্রী খনখনে হাসির বিরাম নেই। হেসেই চলেছে বিদেহী কেউ।

হঠাৎ মনে হলো, অন্য কেউ হাসবে কেন? হাসছে তো ও নিজেই। যখনই সে উপলব্ধি করলো, হাসিও বন্ধ হয়ে গেলো।

হ্যারি হাঁফাতে হাঁফাতে মেঝেতে বসে পড়লো। অসম্ভব যন্ত্রণার সঙ্গে কাটাদাগ দপদপ করেই চলেছে।

রন ওর পিছু পিছু ডরমেটরিতে যাচ্ছিলো। হ্যারিকে দুহাতে কপাল চেপে বসে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললো, কী হয়েছে হ্যারি?

–বলতে পারছি না,

হ্যারি হাঁফাচ্ছে। সত্যি সত্যি ও খুবই আনন্দিত, সুখী।

 –ইউ-নো-হু?

হ্যারি বিড় বিড় করে বললো, দারুণ ভাল লাগছে, কিছু একটা ঘটেছে। আগে সাপ দেখে যেমন কাঁপছিলো তেমনভাবে ও কাপতে লাগলো। ঠিক মি. উইসলিকে সাপে কাটার পর যেমন কাঁপছিলো। দারুণ বমি বমি পাচ্ছে। রনের গায়ে যাতে না পড়ে সেজন্য মুখ সরিয়ে নিলো। ডিন, সিমাস ধারে কাছে নেই। খুব ভাল, খুব ভাল!

–হারমিওন আমাকে তোমার সঙ্গে যেতে বললো, তাই এসেছি, রন বললো। ও দুহাতে হ্যারিকে মেঝে থেকে তুলে ধরে বললো, এখন তোমার প্রতিরোধের কোনও ক্ষমতা নেই।

হ্যারি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

রন হ্যারিকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

অকলামেনসির প্রথম লেসন ওকে দারুণ দুর্বল করে দিয়েছে। শরীর ও মনের সব ক্ষমতা যেন উবে গেছে। দারুণ ভয়জনিত কম্পনে ওর মনে হলো এমন কি ঘটেছে যার জন্য লর্ড ভোল্ডেমর্ট গত চৌদ্দ বছরে এতো সুখী কেমন করে হলেন!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *