২৪। শ্বেতপুষ্পের উদ্যান
সেশেনুর জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পুন্ত শহরে আসার পথে তাদের কিছু ফলমূল দেওয়া হয়েছিল। তাই অগস্ত্যদের খিদে পায়নি আর। তারা চারজনে মিলে এবারে চলল ঋষভের সঙ্গে শ্বেতপুষ্পের কাননের দিকে। নগরীর মাঝের একটি প্রশস্ত পথ ধরে হাঁটতে লাগল তারা। চলার সময়ে অগস্ত্য উপলকে বলল, ‘খানিক আগে এক বড় অদ্ভুত ঘটনা ঘটল বুঝলে।’
‘কী ঘটনা?’
‘ওই ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমি সবার পিছনে ছিলাম। আমি যখন দরজা দিয়ে বেরোতে যাব তখন ওই বৃদ্ধা আমাকে আবার ভিতরে ডাকলেন। তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, ‘তোমার এবং তোমার বন্ধুটির সঙ্গে আমার কথা হল না, কিন্তু তোমাদের মনের মধ্যে যদি কোনও সংশয়ের ভাব জন্মায় তবে কোনও কর্ম করার আগে আমার কাছে এসো, কথা বোলো আমার সঙ্গে। আমার ঘরের দ্বার তোমাদের জন্য সর্বদা খোলা।’
উপল অগস্ত্যর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
‘এর কী অর্থ?
‘জানি না ভাই। কোন সংশয়ের কথা বলতে চাইলেন তিনি তা বুঝছি না। সংশয় তো একটি নয়, অনেকগুলি। চিন্তার জাল যেন মনের সবটুকুকে জড়িয়ে রেখেছে। আমি আমার স্ত্রী-এর বংশপরিচয় এতদিন জানতাম না, সে নিজেও তাতে অজ্ঞাত ছিল। কিন্তু সেও তো আমার অতীতকে আজও জানে না। স্বামী-স্ত্রী বিবাহ বন্ধনে এক আত্মায় বাঁধা পড়ে এই সামাজিক চিন্তা যে ভুল, তা তুমি আর আমি দুজনেই জানি উপল। দুটি মানুষ যতই কাছাকাছি থাকুক না কেন, তাদের মধ্যে একটি অদৃশ্য আড়াল রয়েই যায়।’
‘আমি জানি তুমি এটা ভেবে মনের মধ্যে পীড়া অনুভব করো যে ইরতেনসেনু তোমার সবটাকে চেনে না।’
‘হুম, ঠিক। কিন্তু তার কি প্রয়োজন আছে? যে গোপনীয়তাকে আমরা নিজেদের প্রাণ দিয়ে রক্ষা করছি তার তুল্য কি আর কিছু হয় আদৌ?
উপল মাথা নামিয়ে বলল, ‘না হয় না।’
অগস্ত্যর এই সময়ে কিছু একটা মনে হওয়াতে সে বলল, ‘তুমি কি আমার থেকে কিছু একটা লুকাচ্ছ উপল?’
‘না তো ভাই, কী লুকাব?’
‘তা আমি জানি না, কিন্তু পুন্ত নগরীতে পৌঁছনোর পর থেকে তোমাকে আমি অন্যমনস্ক দেখছি। তোমার স্বভাবের আরেকটা দিকের কথা আমি জানি। তুমি যখন নিজের মনের মধ্যে দ্বিধায় পড়ো তখন চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো না, মাথা নামিয়ে নাও। এখন তোমাকে তেমনই করতে দেখলাম।’
উপল এবারে মুখে হাসি টেনে এনে বলল, ‘না না ভাই। সত্যিই তেমন কিছু নয়। আসলে আমার মনটিও অশান্ত হয়ে আছে। কীভাবে তোমাদের সঙ্গে এই অভিযানে জড়িয়ে পড়লাম তা ভাবতে গেলেও মনে হয় আমি যেন কোনও গল্প বা কোন অলীক স্বপ্নে বাস করছি। তার উপরে এই পুন্ত অধিবাসীর মুখে প্রাকৃত সদৃশ এমন ভাষা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।’
‘ঠিক বলেছ, আমিও বেশ অবাক হয়েছি। ঋষভকে জিজ্ঞাসা করতে হবে এর কারণ। ভারত ভূখণ্ডের সঙ্গে নিশ্চয়ই এর কোনও যোগাযোগ আছে।’
‘হুম, তাই হবে।’
কথা বলতে বলতে তারা নগরীর বাইরে চলে এল। পুন্তে সর্বমোট অধিবাসীর সংখ্যা একশতর কাছাকাছি, তাই জনপদটি খুবই ছোট। অরণ্যের মধ্যে কিছুটা জায়গা পরিষ্কার করে তা বানানো। নগরীর বাইরে অরণ্যের মধ্য দিয়ে একটি অপ্রশস্ত পায়ে হাঁটা পথের উপর দিয়ে চলতে লাগল তারা। তাদের দু’পাশে বৃক্ষদল আবার ঘন হয়ে এসেছে। আকাশে সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ হল, গোধূলির ম্লান আলো এই অরণ্যে প্রবেশ করতে পারে না।
কিন্তু অগস্ত্যরা দেখল আঁধার নামার প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই এক নরম নীল আলোয় ভরে গেল অরণ্য। সেই সঙ্গে আকাশেও যেন এই নীল আলোর ছটা। এর উৎস কোথায় তা বোঝা যাচ্ছে না, তবে এখন নীল আলোতে চারপাশ বেশ পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে। তাদের কিছুটা দূর দিয়ে বয়ে চলেছে নীলনদ। নদী এখানে অনেকটা অপ্রশস্ত, কিন্তু তার স্রোত প্রবল, প্রচণ্ড ব্যস্ততার মধ্যে যেন সে সমতলভূমিতে নেমে আসতে চায়। অগস্ত্য দেখল নীলনদের জলেও স্নিগ্ধ শুভ্র এক আলোক রশ্মি খেলা করছে, এই আলোর পথ ধরেই তো রাত্রের অন্ধকারে তারা আকাশে হাথোরেতকে ঠিক পথে চালনা করে আনতে পেরেছিল! পথ চলতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। এই সময়ে বাকারি ঋষভের উদ্দেশে প্রশ্ন করল, ‘জঙ্গলের মধ্যে এত আলো কীভাবে আসছে।’
ঋষভ সামান্য হেসে জবাব দিল, ‘ধৈর্য ধরো, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তোমার প্রশ্নের উত্তর পাবে।’
‘আর নদীর জলের ওই আলোর আভা? তার উৎস কী?’
‘সেশেনুর এই অরণ্য বড়ই অদ্ভুত বাকারি। এই অঞ্চলের নীলনদের জলে এক অতিসূক্ষ্ম ছত্রাক মিশে থাকে, অন্ধকারে তার শরীর থেকে এমন আলো বিচ্ছুরিত হয়।’
জঙ্গলের এই অংশ সমতল নয়। উঁচু-নীচু অজস্র টিলায় ভরা। তার মাঝের অমসৃণ রাস্তা ধরেই তারা এগিয়ে চলল। বোঝা যাচ্ছিল কিছুটা উপরের দিকে উঠে আসছে তারা। পাশে নীলনদের স্রোতের গর্জন ক্রমশই তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল। এক সময় তারা এসে পৌঁছল একটি পাহাড়ের পাদদেশে। অগস্ত্য দেখল পাহাড়ের গায়ে পাথর কেটে ধাপ বানানো আছে, বোঝা যায় এই পথে নিত্যদিন পাহাড়ের উপরে ওঠে পুন্তবাসী। ঋষভ বলল, ‘এই পাহাড়ের উপরিভাগে রয়েছে নীলনদের উৎস, সেখানেই শ্বেতপুষ্পের উদ্যান। এসো।
ধাপগুলি সংকীর্ণ। একবারে একজন মানুষই একটি ধাপে দাঁড়াতে পারে। ধাপগুলিতে পা দিয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল অগস্ত্যরা। বেশ কিছুটা উপরে ওঠার পর নীচের দিকে তাকাল ইরতেনসেনু। নীচে গভীর গিরিখাত। তাকালেই যেন মনে হয় দেহের ভারসাম্য টলে যাচ্ছে, অন্ধকার গিরিখাত যেন কোন এক অমোঘ আকর্ষণে তাকে নিজের কাছে টেনে নিতে চাইছে। অগস্ত্য ইরতেনসেনুর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘নীচের দিকে তাকিও না এখন। সামনে দৃষ্টি রেখে চলো। সাবধানে।’
সিঁড়ির শেষ ধাপটায় পা দিয়ে পাশের দিকে সরে দাঁড়াল ঋষভ। হাসি বলল, ‘এসো, দেখো। এই হল নীলনদের উৎস! এই হল শ্বেতপুষ্পের উদ্যান!’
একে একে তারা চারজনে পাহাড়ের উপরে উঠে এসে ঋষভের পাশে এসে দাঁড়াল। তারা তাদের সামনে এখন যা দেখতে পাচ্ছে তাকে ভাষায় বর্ণনা করার সামর্থ্য হয়তো কারোরই ছিল না! এমন আশ্চর্য দৃশ্য স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না। প্রথমেই তাদের মনে হল এক বিশাল সমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা! বিপুল জলরাশির এক আধার তাদের সামনে। জলের মৃদু স্রোত বাতাসের টানে তাদের পায়ের কাছে এসে পড়ছে। ঠিক যেমনটা সমুদ্রের তীরে দেখা যায়। কিছুটা দূরে এই সমুদ্রের একটি অংশ সৃষ্টি করেছে এক জলপ্রবাহকে। এই জলধারাকে তারা দেখেছে তীব্রবেগে পাহাড়ের গা বেয়ে নীচের দিকে নেমে আসতে। এই তাহলে নীলনদ! তাহলে নদীর উৎস কোন বরফে ঢাকা পাহাড় নয়? এক সমুদ্র! কিন্তু অরণ্যের মাঝে পাহাড়ের বুকে এমন সমুদ্রের সৃষ্টি হবে কী করে!
ধীরে ধীরে তাদের ভ্রম ভাঙল। সমুদ্রের অপর প্রান্তকে তো সাধারণত দেখতে পাওয়া যায় না। কিন্তু এখানে তারা দেখল এই জলাধার বিপুলা হলেও যেন দিগন্তে ঘন কালো জঙ্গলের রেখা দেখা যাচ্ছে। এটি তাহলে একটি হ্রদ, একটি অতিকায় হ্রদ! যা প্রকৃতির কোন খেয়ালে তৈরি হয়েছে পাহাড়ের কোলে। এই হ্রদের আকার এতই বড় যে প্রথম দর্শনে তাকে সমুদ্র বলে ভ্রম হয়। হ্রদের একটি প্রান্ত থেকে নীল আলো বিচ্ছুরিত হতে দেখা যাচ্ছিল। বোঝা যায় ওই আলোই নীলনদের সেশেনুর অরণ্যকে আলোকিত করে রেখেছে।
তাদের নাকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল। এই দৈত্যাকার হ্রদের বিহ্বলতা কাটিয়ে তারা এবারে তাকাল হ্রদের পাশের জমির দিকে। সেখানে সারি দিয়ে রয়েছে ছোট, মাঝারি বড় আকারের বৃক্ষরাজি। নীল আলোর মধ্যে বৃক্ষগুলির মাথা নীলাভ সাদা বর্ণের হয়ে রয়েছে। সেই দিকে আরও বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হল অগস্ত্যদের। কাছাকাছি আসতেই বুঝল এই বৃক্ষ তাদের চেনা, এই গন্ধ তারা আগেও পেয়েছে, ফারাও হাতসেপসুতের মন্দিরে! শ্বেতপুষ্প!
অসংখ্য শ্বেতপুষ্পের গাছ এখন তাদের সামনে। মৃদু হাওয়ায় তাদের ডালপালাগুলি দুলছে! তাহলে এক অসাধ্যকে সাধন করতে পেরেছে ইরতেনসেনুরা! যে চিন্তা কিছুদিন আগেও অলীক বলে মনে হয়েছিল তাকে সত্যি করতে পেরেছে তারা! শুধুমাত্র বুদ্ধি এবং সাহসের বলে। নিজের মুখেই অস্ফুটে ইরতেনসেনু বলে উঠল, ‘হে দেবী হাথোর! আপনি পরম করুণাময়ী!
শ্বেতপুষ্পের অগভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল তারা। পুষ্পের সেই অলৌকিক গন্ধ যেন কোন মন্ত্রবলে তাদের স্নায়ুকে শান্ত করে তুলছিল। প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছিল তারা সবাই। বাকারি সবার আগে চলছিল। তার মুখমণ্ডলে আনন্দের ছটা ফেটে পড়ছে। সে দ্রুত একটি ছোট শ্বেত পুষ্পের কিশলয়কে খুঁজে বার করল, একটি বড় বৃক্ষের পাদদেশে লালিত ছিল সেটি। তারপর চাইল ঋষভের দিকে।
ঋষভ হাসি মুখে মাথা সামান্য সামনের দিকে নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। এরপর উপল এবং বাকারি উবু হয়ে মাটির উপরে বসল। উপল একটি খুরপি নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। তাই দিয়ে অতি সন্তর্পণে শ্বেতপুষ্পের কিশলয়টিকে মাটি থেকে তুলে এনে বাকারির হাতে দিল। যেন সদ্যজাত সন্তানকে কোলে নিয়েছে, এমন ভাবে পরম যত্নে কিশলয়টিকে নিজের বুকের কাছে টেনে নিল বাকারি। তারপর আনন্দোজ্জ্বল চোখে তাকাল ইরতেনসেনুর দিকে।
ইরতেনসেনুর চোখ তখন ছলছল করছে। আনন্দের অশ্রু তার গালণ্ড বেয়ে নীচের দিকে নামছে। সে পেরেছে তার পিতার দেওয়া দায়িত্বকে পালন করতে! এই পুন্ত নগরী তাকে জন্ম দিয়েছে, কিন্তু তাকে লালন করেছে তো মরুভূমি, নীলনদের দেশ মিশর! সেই দেশ তার পালিকা মা, কিন্তু আপন সন্তানের স্নেহ দিয়ে তাকে বড় করে তুলেছে। তার এই শরীর, মন, মস্তিষ্ক সব কিছু সেই দেশের দান, থীবস নগরের দান। আজ তার মনে হচ্ছে এর প্রতিদানে সেও কিছু করে উঠতে পারল।
আগামীকাল ভোরেই এই কিশলয়টিকে নিয়ে থীবসের উদ্দেশে যাত্রা করবে তারা। কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফারাও হাতসেপসুতের মন্দিরের ফাঁকা স্থানে শোভা পাবে নতুন একটি শ্বেতপুষ্প বৃক্ষ। যে বা যারা ফারাওয়ের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল, যারা তার পিতাকে হত্যা করেছিল তাদের পরিচয় সে জানে না, জানে না সেই পরিচয় সে আদৌ কখনও পাবে কিনা। কিন্তু সে এখন জানে সেই চক্রান্ত যতই কুটিল হোক না কেন, তাকে ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে চার অকুতোভয় নারী এবং পুরুষ। তার দেশ, তার পালিকা মাতা মিশরের বুকে শান্তি অক্ষুণ্ণ থাকবে। অক্ষুণ্ণ থাকবে ফারাও হাতসেপসুতের সিংহাসন।
ইরতেনসেনু এবারে তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অগস্ত্যর দিকে তাকাল। তাকিয়েই তার অন্যরকম লাগল। শ্বেতপুষ্পের বৃক্ষগুলিকে প্রথমবার দেখতে পাওয়ার পর অগস্ত্যর মুখেও উচ্ছ্বাসের চিহ্ন দেখেছিল সে। কিন্তু এখন সেই ভাব কোনও কারণে অন্তর্হিত হয়েছে। অগস্ত্য এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে শ্বেতপুষ্পের গাছটির দিকে, কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি যেন দিগন্তে নিবদ্ধ। তার মুখমণ্ডলে যেন এক কষ্টের ছাপ।
‘কী হয়েছে অগস্ত্য?’
‘কই, কিছু না তো।’
অগস্ত্যর যেন সদ্য ঘুম ভাঙল। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এবার বলল, ‘আমরা ভাগ্যবান ইরতেনসেনু! তাই আজ এই স্বর্গীয় উদ্যানে দাঁড়িয়ে রয়েছি। এখনও মনে হচ্ছে যেন স্বপ্ন দেখছি। ফারাও তোমায় বুকে জড়িয়ে ধরবেন যখন আমরা এই কিশলয়টিকে নিয়ে থীবসে পৌঁছব।’
‘হ্যাঁ! চরম আনন্দের দিন আজ!’ উপল বলে উঠল।
বাকারি ঋষভকে বলল, ‘আপনাদের মহানুভবতার জন্য আজ মিশরের সিংহাসন পুনরায় সুরক্ষিত হল। এর প্রতিদানে আমাদেরও কিছু দিতে দিন। আজ আমাদের বড়ই আনন্দের দিন। আজ পুন্ত নগরীতে উৎসব হোক। রাত্রিবেলায় আসুন নগরীর সবাই একসঙ্গে আহার করি। আমি অতি উত্তম শূকরের মাংস রান্না করতে পারি! সকালে যে শূকরগুলি শিকার করেছিলেন সেগুলি রান্না করতে চাই আমি। তারপর এক মহাভোজ হবে।’
‘বাকারি সত্যিই ভীষণ ভালো শূকরের মাংস রান্না করে।’ বলল ইরতেনসেনু।
‘তবে তো খুবই ভালো! মিশরীয় ভোজ হোক তাহলে আজ রাত্রে! তাহলে তো এখনই আমাদের ফিরতে হয়।’
ঋষভকেও এই প্রস্তাবে উৎসাহিত দেখাল।
‘কিন্তু ওই আলোটা? ওই আলোর উৎস কী তা তো জানা হল না আর।’
কথাটি বলল অগস্ত্য। তার দিকে সবাই তাকাল এবারে। তার দৃষ্টি তখন নিবদ্ধ হ্রদের অন্য পাড়ে, যেখানে নীল আলোটি তীব্রতম।
‘কীভাবে এই আলো উৎপন্ন হচ্ছে? তা কি জানা যাবে না?’
এবার ঋষভ সামান্য ইতস্তত করে বলল, ‘জানা যে যাবে না তা নয়। তবে আমি আশা করছিলাম যে তোমাদের কেউ এই প্রশ্নটি না করো। ওই আলোর উৎসটিকে রক্ষা করার জন্যই পুন্ত নগরী গত এক সহস্র বছর ধরে বাইরের জগতের থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। তোমাদের আমি অবিশ্বাস করি না।
‘অনিকাদেবী এই নগরীর জ্যৈষ্ঠাতমা, তাঁর কথা আমরা সবাই মেনে চলি। তোমাদের এখানে নিয়ে আসার আগে তিনি আমাকে বলেছিলেন যে যদি তোমরা ওই উৎসের সন্ধান করতে চাও তাহলে আমি যেন তোমাদের বাধা না দিই, সাহায্য করি। তবু মনের মধ্যে একটা দ্বিধা চলেই, আশা করি বুঝতে পারছ সেটি।’
‘হুম, তোমার চিন্তার কারণ আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি এবং ইরতেনসেনু বিজ্ঞানের সাধক। কোনও প্রকার অলৌকিকতায় আমরা বিশ্বাসী নই। তাই মনে হয়েছে ওই আলোর উৎসের পিছনে বিজ্ঞানই দায়ী কোনওভাবে। উপল আমার ভাইয়ের মতো, আমি নিজের চেয়েও তাকে বেশি বিশ্বাস করি। বাকারি তো ইরতেনসেনুর ভাই-ই। আমি তোমাকে কথা দিতে পারি, তোমাদের গোপনীয়তা আমরা কোনওভাবে লঙ্ঘন করব না। পুন্ত নগরীর কথা আমাদের চারজন ব্যতীত আর কেউ জানবে না। এই নগরী লোককথার মধ্যেই রয়ে যাবে যেমন গত ছয়শো বছর ধরে আছে।’
‘আচ্ছা চলো তবে। এই পথ পাড়ি দিতে সময় লাগবে বেশ অনেকটাই। হ্রদের পাশ দিয়ে হেঁটে গিয়ে ওই প্রান্তে পৌঁছতে হবে।’
‘তোমরা যাও, আমাকে এখনই নগরীতে ফিরতে হবে।’ বাকারি বলল।
‘এই শ্বেতপুষ্পের কিশলয়টিকে অতি যত্নে মিশরে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমি নিয়েছি। কিশলয়টিকে মাটি থেকে তুলে আনলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে যদি এটিকে কোনও একটি পাত্রে প্রতিস্থাপন না করতে পারি তাহলে এর ক্ষতি হতে পারে। ওই আলো যা থেকেই তৈরি হোক না কেন তাতে আমার কোনও আগ্রহ নেই। তোমরা ঘুরে এসো। তোমাদের জন্য অতি উপাদেয় শূকরের মাংস প্রস্তুত থাকবে।’
বাকারির কথায় যুক্তি আছে। কিশলয়টিকে মাটিতে রোপন না করলে তা জল এবং খাদ্যের অভাবে শুকিয়ে যেতে পারে। ঋষভ বলল, ‘কিন্তু তুমি যাবে কীভাবে? আমি তো এখন ইরতেনসেনুদের নিয়ে হ্রদের অন্য প্রান্তে গমন করব। তাহলে কী সবাই ফিরেই যাই নাকি? আগামীকাল তোমরা যাত্রা শুরুর আগে না হয় এই স্থানে নিয়ে আসব আবার।’
‘না না, তা হয় না। আগামীকাল সূর্য ওঠার সঙ্গে-সঙ্গেই আমরা থীবসের উদ্দেশে রওনা দেব। এইখানে আসবার সুযোগ আর হবে না। তুমি ওদের নিয়ে ঘুরে এসো। আমি ঠিক পথ চিনে চলে যাব। আসার সময় খেয়াল করেছি, জঙ্গলের মধ্যে একটিই তো পথ। আর এই আলোয় সেই পথ চিনে ফিরতে খুব অসুবিধা হবে না।’
বাকারি কিশলয়টিকে কোলে নিয়ে সন্তর্পনে পাহাড়ের গায়ের সিঁড়ি বেয়ে নীচের দিকে নেমে গেল। সে পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হওয়ার পর অগস্ত্যরা ঋষভের পিছু পিছু হ্রদের ধার ঘেঁষে হাঁটতে শুরু করল। সবার আগে হাঁটছিল ঋষভ, তার পিছনে উপল, তার পিছনে অগস্ত্য এবং ইরতেনসেনু। হাঁটতে হাঁটতে ঋষভ এই সেশেনুর জঙ্গলের গতিপ্রকৃতির বর্ণনা দিচ্ছিল তাদের। এই অরণ্যের মধ্যে এত বছর ধরে বাস করতে করতে কীভাবে পুন্তবাসীরা সেশেনুর বনানীকে নিজের হাতের তালুর মতো চিনে নিয়েছে তা বলছিল ঋষভ। তার মুখে অরণ্যের বিভিন্ন হিংস্র জীবের কথাও শুনছিল তারা। একসময় উপল বলল, ‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি ঋষভ। কামারু নামের কোনো জীবের কথা শুনেছ তুমি?’
ঋষভ পিছন ফিরে উপলের দিকে চাইল। তারপর ঈষৎ হেসে বলল, ‘হ্যাঁ শুনেছি বইকি, তবে তাকে চোখে কখনও দেখিনি।’
‘কেন? লোককথায় যে আছে পুন্তের নগরীতে কামারু নামের এক অদ্ভুত দর্শন জন্তু রয়েছে। মেন্তুহোতেপের প্রহেলিকাতেও তার উল্লেখ আছে।
‘হ্যাঁ ঠিক। আমি এও শুনেছি যে নুবিয়দের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীন এই কামারু মেন্তুহোতেপকে যুদ্ধে জিততে সাহায্য করেছিল। কিন্তু আমার কী মনে হয় জানো? কামারু লোককথারই একটি অংশ, আদতে তার কোনও অস্তিত্ব নেই। এই জনপদের কেউই কোনওদিন সেই ভয়াল দর্শন জীবকে দেখেনি। এমনকী অনিকাদেবীও দেখেননি। কিন্তু পুন্তের মানুষ বিশ্বাস করে কামারু আছে, সে ঘুমিয়ে আছে এই হ্রদের নীচে। এমনও হতে পারে যে এই অরণ্যে সত্যিই হয়তো এমন জীব ছিল কোনও এককালে, যার দর্শন পেয়েছিলেন ফারাও মেন্তুহোতেপ। এই সেশেনুর জঙ্গল সত্যিই অদ্ভুত, এই শ্বেতপুষ্পের গাছও তো এই অরণ্য ব্যতীত পৃথিবীর আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।’
‘ঠিক, নদীর জলের ওই আলো বিচ্ছুরণকারী ছত্রাকও তো আর অন্য কোথাও দেখতে পাইনি আমি। বলল উপল।
‘তবে ছ’শো বছর ধরে কোনও জীবের পক্ষে বেঁচে থাকার কথা নয়। আমার ধারণা কামারু নামের জীবটি এই অরণ্যে কোনও সময়ে থাকলেও তা কালের নিয়মে মারা গেছে। হয়তো এই হ্রদের গভীরেই সেই জীবের অস্থি রয়েছে।’
অগস্ত্য চুপ করে তাদের কথা শুনছিল। কামারুর ব্যাপারে তার কোন প্রকার আগ্রহ নেই। এই জীবটির নাম শুনে এবং মেন্তুহোতেপের মন্দির গাত্রে এর ছবি দেখার পরে অগস্ত্যর দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে কামারুর আদৌ কোন অস্তিত্ব নেই। জীবটি একেবারেই মানুষের কল্পনাপ্রসূত, যা এক লোকগাথাকে যুগের পর যুগ ধরে জীবন্ত রাখতে সাহায্য করেছে। তার মনের মধ্যে এখন এক অদ্ভুত ভাব বিরাজ করছিল।
আজকের দিনটি যেন তার জীবনের অন্য সবক’টি দিনের থেকে আলাদা। প্রথমে হাথোরেতের অরণ্যের মধ্যে ভেঙে পড়া, তারপর পুন্ত নগরীর সন্ধান পাওয়া, তারপর জানা যে তার স্ত্রী মিশরীয় নন, এই নগরীতেই তার জন্ম হয়েছিল। সর্বশেষে অনিকাদেবী, ওই বৃদ্ধার কথাগুলি এখনও তার কানে ভাসছে। তার মনের কোন সংশয়ের নিরসনের জন্য অনিকাদেবী অপেক্ষা করে আছেন? কেন তিনি বললেন কোন কর্ম করার কথা ভাবলে তা সমাধা করার আগে যেন তার সঙ্গে দেখা করে অগস্ত্য? কেন তিনি ঋষভকে আগে থেকেই বলে রেখেছিলেন যে ওই রহস্যময় আলোর উৎস, যা পুন্ত নগরী সহস্র বছর ধরে গোপন করে রেখেছে, সেই আলোর উৎসের সন্ধান অগস্ত্যর কাছে উন্মোচিত করতে? কেন? কী আছে সেইখানে?
এক অজানা আশঙ্কা অগস্ত্যর বুকে দানা বাঁধতে লাগল। তার মনটিও ভালো নেই। যে বৃক্ষের নীচের কিশলয়টিকে বাকারি এবং উপল সংগ্রহ করল সেই বৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে অগস্ত্যর বুক সহসাই কেঁপে উঠেছিল। থীবসের সেই রাত্রে, হাথোরেতে যাত্রা শুরুর আগের রাত্রে স্বপ্নে অগস্ত্য এই বৃক্ষটিকেই দেখেছিল? কীভাবে? অবিকল এই বৃক্ষটিই! এই বৃক্ষের নীচেই অগস্ত্য দেখেছিল রক্তের দাগ! দেখেছিল কারো এক মৃতদেহ, যার মুখ সে দেখতে পায়নি, কে সে!
অগস্ত্যর বারবার মনে হচ্ছিল সে এক বড় প্রহেলিকার মধ্যে বাস করছে। কিন্তু প্রহেলিকাটি যে কি তাই সে বুঝতে পারছে না, শুধু তার মনে হচ্ছে আজকের দিনটি এতটাই অন্যরকম! কোনওভাবে দিনটি কেটে গেলে সে যেন মনের মধ্যে শান্তির ভাব অনুভব করবে। কিন্তু কেন এমনটা তার মনে হচ্ছে তা সে জানে না। ইরতেনসেনুকেও সে এই ব্যাপারে কিছু বলতে চায়নি। দীর্ঘদিনের ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা, বিনিদ্র রাত্রি যাপনের পর আজ ইরতেনসেনুর মন অবশেষে শান্ত হয়েছে। তার হৃদয় এখন ভরে উঠেছে পরম আনন্দে। সেই আনন্দকে অগস্ত্য নষ্ট করতে চায় না নিজের অলীক চিন্তার কথা বলে। সে চুপচাপ হাঁটতে লাগল বাকিদের সঙ্গে।