শীতটা কমে আসার সঙ্গে সঙ্গেই যাতে শীত আর কমতে না পারে সে জন্যেই বোধ হয় গতরাতে আবার ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেল।
রাতারাতি তাপমাত্রা অনেক নীচের অঙ্কে নেমে গেল। সকাল হয়ে যাবার পরও বৃষ্টি থামার লক্ষণ দেখা গেল না। তবে ঝুপঝুপে নয়, ফিসফিসে বৃষ্টি।
হাওয়াটাই বৃষ্টি না বৃষ্টিটাই হাওয়া বোঝা যায় না। হাওয়ায় দাঁড়ালে গা ভিজে যায়।
চারদিকের বন পাহাড়ের গাছগাছালির ধুলো ধুয়ে গেছে। এই হিমেল সকালে চতুর্দিকের প্রকৃতি শান্ত; সিক্ত। গোলাপগুলোর খাঁজে খাঁজে যে লাল ধুলোর সূক্ষ্ম আস্তরণ পড়েছিল তা সব মুছে গেছে। তারা এখন সকলেই নির্মলমুখে চেয়ে আছে।
আমি বসবার ঘরে বসে জুনিয়রদের চিঠি লিখলাম। এখানের তল্পি গোটানোর সময় হয়ে এলো আমার। আবার কবে আসতে পারব জানি না। কোলকাতার কাজের ঘূর্ণিঝড়ে কেজো লোক একবার গিয়ে পৌঁছলে তার আর মুক্তি নেই। ঝড়ে-ওড়া পাতার মত সে তখন ঘুরে মরবে। কখনও-সখনও কোনো হঠাৎ অবকাশের বিকেলে মনে পড়বে এই দিনগুলোর কথা। কানে ভাসবে কাঠ কাটার আওয়াজ, টিয়ার গলার তীক্ষ্ণ সবুজ স্বর, শেষ রাতের কোকিলের কুহু কুহু, মাঝরাতের ডিজেল এঞ্জিনের বুকমোচড়ানো একটানা দীর্ঘশ্বাস।
কিন্তু যা মনে পড়বে, তা সবই মুহূর্তের জন্যে।
পরক্ষণেই ডুবে যেতে হবে ব্রিফের মধ্যে।
টু-টুয়েন্টি-সিক্স-এর পিটিশান, রুলের আবেদন, এ্যাড়জোর্নমেন্ট মোশান, ডিভিসান বেঞ্চের সামনে সওয়ালের নোটিশ-লাল নীল পেন্সিল, নানারকম কলম, পাইপের তামাকের গন্ধ।
কোর্টের জজসাহেবদের জবরজং পোশাকের খসখসানিতে ডুবে যাবে টুনটুনি পাখির গলার স্বর, উকীল ব্যারিস্টারের কালো জোব্বাতে মুছে যাবে হলুদ বসন্ত পাখির হলুদ গায়ের রং।
কয়েকদিন হল মনটা ভারী খারাপ লাগে।
আমি কি তবে এসকেপিস্ট? আমি কি কেবলি কাজ থেকে কর্তব্য থেকে পালিয়ে যেতে চাই? কিন্তু মনে হয়, এসকেপিস্ট হয়ে দোষেরই বা কি? তাছাড়া কাজ আমি করবই বা কেন? কিসের জন্যে? কার জন্যে?
যার জীবনের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কারো কাছেই কিছু পাওনা নেই, নেই কোনো নগ্ন নির্জন কোমল হাতের পরশ, নেই কোনো সহানুভূতির শান্ত ছোঁয়া; নেই কারো সুগন্ধি কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে শুয়ে ক্লান্তি অপনোদনের উপায়; তার কর্তব্য কার জন্যে?
কর্তব্য কি শুধু আজীবন অন্যদের জন্যেই? অন্য সকলের প্রতিই? নিজের প্রতি কি আমার কোনো কর্তব্য নেই? অথবা ছিলো না? নিজেকে সুখী করা, ভরিয়ে তোলাও কি একটা কর্তব্য নয়?
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, আমি শরৎবাবুর উপন্যাসের বালবিধবাদের চেয়েও অসহায়। তাঁদের চেয়েও বেশি নিরুপায় ও পরিণতিহীন কর্তব্যভাবে পীড়িত। আজকাল কেবলি মনে হয়, এই কঠোর শুকনো কর্তব্যের কোনো শেষ নেই, এর কোনো মানে নেই।
সব জানি, সব বুঝি; তবুও আমাকে ফিরে যেতেই হবে কোলকাতায়। কারণ অন্য দশজন পুরুষের মত আমিও একজন পুরুষমানুষ। যে-পুরুষ কাজের মধ্যে না থাকে তার মন নোনা-হাওয়ায় ফেলে-রাখা লোহার মত মরচেতে ভরে যায়। পুরুষের মন যদি ইস্পাতের মত ঝকঝকে তীক্ষ্ণ না হয় তাহলে তার বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে তার কিছু পাওয়ার থাক বা নাই-ই থাক, তবু তার নিজের জন্যেই তাকে কাজ করতেই হয়, শুধুমাত্র নিজের কাছে নিজে ফুরিয়ে-যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাবার জন্যেই।
কাজ আছে বলেই হয়ত আমার মত অনেক হতভাগ্য পুরুষ বাইরের জগতের কৃতিত্বের মেডেল বুকে ঝুলিয়ে, হাহাকার-তোলা অন্তর্জগতে সস্তা যাদুকরের মত এখনও বেঁচে আছে; বেঁচে থাকে, এই নির্দয় সহানুভূতিহীন পৃথিবীতে। যেদিন আমাদের কাজ থাকবে না, কাজ করার ক্ষমতা থাকবে না, সেদিন আমাদের বাঁচাও আর হবে না। আমাদের মত লোকের বাঁচার সেদিন কোনো মানে থাকবে না।
চিঠিটা প্রায় শেষ করে এনেছি, এমন সময় দেখি প্যাট আসছে।
প্যাটের গায়ে সেই আর্মি ডিসপোজালের উইণ্ড-চিটার।
প্যাট নিজের মনে কি একটা গান গুন-গুন্ করতে করতে আসছে।
ওর একপা ফেলার তালে তালে গানটা গাইছে। মার্চিং সং-এর মত করে।
কাছে আসতেই প্যাট বলল, গুড মর্নিং মিস্টার বোস।
আমি লেখার কাগজ মুড়ে রেখে বললাম, ভেরী গুড মর্নিং প্যাট।
প্যাট ভিতরে ঢুকে ওর ক্রাচটা ঠেস দিয়ে রেখে একপায়ে এক লাফে এসে চেয়ারে বসল।
প্যাটকে শুধোলাম, আজ খুব খুশি মনে হচ্ছে তোমাকে প্যাট, কি ব্যাপার?
প্যাট হাসল। একটু লজ্জা পেয়ে বলল, তাই বুঝি? আমাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে বুঝি?
তারপরই বলল, আমি ত সবসময়ই খুশি। আমাকে অখুশি দেখেছ কখনও?
বললাম, না! তবুও আজ যেন বিশেষ খুশি বলে মনে হচ্ছে।
প্যাট হাসল। ওর ঝকঝকে দাঁত হাসিটা ঝিলিক মেরে গেল।
বলল, কফি খাওয়াও। ঠাণ্ডাটা আবার জোর পড়েছে। ঠাণ্ডা না থাকলে আমার আবার ভালও লাগে না। ঠাণ্ডা না থাকলে রোদের দাম, আগুনের দাম এসব কিছুই বুঝি জানা যেত না। তাই না?
আমি লালিকে কফি বানাতে বলে এলাম।
ফিরে শুধোলাম, কি গান গাইছিলে তুমি? গানটার সরুটা ভারী ভালো ত?
প্যাট হাসল। বলল, তুমি শুনতে পেয়েছ?
এ জায়গাটার এই একটা অসুবিধা। জায়গাটা এত নির্জন যে, হানি-মুনিং কাপলস-এর ফিসফিসানিও সারা বাড়ি থেকে শোনা যায়।
আমি বললাম, গাও না গানটা আবার কোথায় শিখলে গানটা?
প্যাট বলল, এই গানের একটা ইতিহাস আছে। বলছি শোনো।
এখানে মিস্টার টিকসারা বলে এক ভদ্রলোক থাকতেন। একলা।
ভদ্রলোকের ডাইভোর্স হয়ে গেছিল। অল্প বয়সে। তারপর বিয়ে করার মত ভুল আর দ্বিতীয় বার করবেন না বলে মনস্থ করেছিলেন। খুব ড্রিঙ্ক করতেন ভদ্রলোক। প্রতি সন্ধ্যায়ই কোথাও না কোথাও বসে যেতেন।
যেদিন কোথাও, মানে কোনো বাড়িতে বসতেন না, সেদিন জঙ্গলের মধ্যে কোনো জায়গা বেছে নিয়ে বসে পড়তেন একা। তারপর বোতল শেষ করে এই গান গাইতে গাইতে টলতে টলতে বাড়ি ফিরে যেতেন।
উনিও একলা ছিলেন। আমি ত চিরদিনই একলা। তাই আমার বাড়িতে ওর ছিল অবারিত দ্বার। মনে আছে, একদিন রাত একটার সময় জঙ্গল থেকে ফিরে এসে দরজায় লাথি মেরে আমাকে তুললেন। বললেন, সন্ধ্যে রাতে ঘুমাও কি করতে? তোমার জড়িয়ে ধরে ঘুমোবার মত কেউ ত নেই। তবে? আর ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যে স্বপ্ন দেখবে তেমন কেউও নেই তোমার–তাহলে আর ঘুমের জন্যে এত কাতর কেন?
বলে হিম পকেট থেকে একটা রামের বোতল বের করে বললেন, বোসো, দুজনে মিলে এটাকে শেষ করে যারা এই মুহূর্তে আরামের ঘরে কাউকে জড়িয়ে শুয়ে আছে তাদের সেই মিথ্যা-সুখের মুখে থুথু দিয়ে এসো আমরা দুজনে স্বাধীনতার আনন্দে বুঁদ হয়ে যাই।
একটু থেমে প্যাট বলল, জানো, এখানের সমস্ত লোকই একদিন এই গানটা গাইতে পারতেন। কারণ, এমন কোনো বাড়ি ছিলো না এখানে, যে বাড়ির সামনের পথ দিয়ে নিশুতি রাতে একা একা গভীর অন্ধকারে এই গান গাইতে গাইতে মিস্টার টিকসারা কোনো কোনো দিন ঘরে ফিরতেন।
ভারী ভাল লোক হিলেন ভদ্রলোক। নির্বিরোধী দিল-খোলা সহজ সরল মানুষ। হাঃ হঃ করে জমাট হাসি হাসতেন।
আমি বললাম, ছিলেন মানে? এখন নেই?
না। উনি মারা গেছেন। তাঁকে কে বা কারা যেন খুন করে যায় তাঁর বাড়িতেই। ফায়ার প্লেসের পাশে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় পরদিন। টাঙ্গী দিয়ে মাথাটা দু ফাঁক করে কাটা ছিল।
প্যাট একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, উনি নেই; কিন্তু গানটা রয়ে গেছে। ভীষণ ভাবে রয়ে গেছে। এ গানটা আমার খুব ফেভারিট গান।
আমি বললাম, শোনাও না প্যাট। গাও আর একবার গানটা? প্যাট একবার গলা খাঁকরে নিয়ে নীচু গলায় সুরু করল। প্যাট গাইছিল—
Show me the way to go home
Im tired and I want to go to bed.
I had a little drink about an hour ago
Which has gone right to my head.
পুরনো দিনের অপেরার গানের সুরের মত সুরটা।
ওই অবধি গেয়েই প্যাট থেমে গেল।
আমি বললাম, কি হল? আর নেই? থামলে কেন?
প্যাট আবার অন্তরা ধরল।
No matter where I roam.
May be on land, on sea or on foam.
You will always hear me singing that song;
Show me the way to go home.
গানটা শেষ করে প্যাট আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল।
আমি বললাম, গানটার সুরটা কিন্তু বড় করুণ। যদিও কথার মধ্যে একথা বলা নেই। তবুও আমাদের রবিঠাকুরের একটা গানের সঙ্গে এ গানের মূলগত একটা মিল আছে।
প্যাট বলল, কি গান?
বললাম, পঙ্কজ মল্লিকের রেকর্ড আছে। ডিরেক্টর প্রমথেশ বড়ুয়া ছবি মুক্তিতে এই গানটা ছিল।
ওরে আয়, আমায় নিয়ে যাবি কে রে দিনের শেষে শেষ খেয়ায়
সন্ধ্যা আসে দিন যে চলে যায়…।
প্যাটকে গানটা অনুবাদ করে শোনালাম।
প্যাট বলল কথার ত কোনো মিলই নেই।
কথার নেই, কিন্তু ভাবের আছে। সুরের গভীরতার আছে। দুটো গানই একজন হারিয়েযাওয়া মানুষের আকুতিতে ভরা।
Show me the way to go home.
এর মধ্যে গায়কের ঘর বলতে যে কিছু নেই এ কথাটাই সুরের মধ্যে দিয়ে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে, যেমন ফুটে উঠেছে, রবিঠাকুরের সেই গানে। যে ঘরেও নেই এবং পারেও নেই, যে নদী পেরুবার জন্যে বেরিয়েছিলো, অথচ যাকে চিরদিন মাঝ-দরিয়াতেই থেকে যেতে হল, যাকে কেউ নরম হাতে হাতছানি দিয়ে কোনো ঘরেই ডাকল না, সে আসন্ন সন্ধ্যায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে হারিয়ে যাবার ভয়ে যেন ভয়ার্ত হয়ে উঠেছে।
প্যাট বলল, তোমার টেগোরের গানের কি এইই ব্যাখ্যা?
আমি বললাম, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞরা এর কি ব্যাখা করবেন জানি না, ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি-সন্ধ্যের সময় যার মুখেই যতবারই এ গান শুনেছি, ততবারই আসন্ন অন্ধকারের মধ্যে পাখির গলার ক্ষীণ স্বরে বারবার এই কথাই মনে হয়েছে। আজ বহুদিন পর তোমার এই গান শুনে ঐ গানের কথা মনে পড়ে গেল।
লালি কফি নিয়ে এসেছিল।
প্যাটকে কফি ঢেলে দিলাম আমি, ইতিমধ্যে লালি প্যাটের জন্যে একটা ওমলেট বানিয়ে, টোস্টও করে আনল।
প্যাট যত্ন করে ওগুলো খেল। এত সকালে ও নিশ্চয়ই ব্রেকফাস্ট করে বেরোয়নি।
কফি শেষ করে প্যাট সবে একটা সিগারেট ধরিয়েছে। এমন সময় গেট খুলে একজন স্থানীয় লোককে দৌড়ে আসতে দেখলাম। লোকটাকে আমি চিনতে পারলাম না।
আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে প্যাট ওদিকে তাকাল।
তাকিয়ে লাফিয়ে উঠে দেওয়ালের দিকে গিয়ে ওর ক্রাচ দুটো বগলে লাগাল। লোকটা হাঁপাচ্ছিল। লোকটা কোনোরকমে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, বয়েল সাব, গিদ্ধড়, গিদ্ধড়। বয়েল সাব।
আমিও ওর কথার মানে বুঝলাম না।
প্যাট বোধহয় মানে বুঝবার জন্যে দাঁড়াতেও চাইল না।
প্যাট প্রায় উড়ে গিয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে বাইরে পড়ল। আমাকে বলল, কাম মিস্টার বোস, লেটস রান ফর মিস্টার বয়েলস প্লেস।
প্যাট ওর ক্রাচে ভর করে যে অতজোরে দৌড়তে পারে, তা না দেখলে আমার বিশ্বাস হত না।
প্যাট যেন পুরোনো দিনের রণ-পা-চড়া কোনো ডাকাত হয়ে গেল। আমি ওর সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে যেতে রীতিমত হাঁপিয়ে পড়ছিলাম।
পথে কোনো কথা হলো না।
প্যাটের দ্রুতগতি ক্রাচের সুষম ও এক লয়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ আমার কানে আসছিল না।
কতক্ষণ আমরা দৌড়ে গেলাম আমাদের হুঁশ ছিল না। দূর থেকে মিস্টার বয়েলস-এর বাড়িটা দেখা যাচ্ছিল।
বাড়িটা বৃষ্টিভেজা মেঘলা আবহাওয়ায় উথাল-পাথাল হাওয়ার মধ্যে কোনো স্থবির অনড় প্রাচীন বিশ্বাসের মত দাঁড়িয়েছিল।
একটা বাঁক ঘুরে বাড়িটার সামনে আসতেই আমরা দুজনে থমকে দাঁড়ালাম।
প্যাট স্বগতোক্তি করল, মাই গড! হোয়াট ইজ ইট?
প্যাট আবার বলল, আই ডোন্ট নো, হোয়াট হ্যাড ইট টু হ্যাপেন–এন্ড হ্যাপেন টু দিস পুওর ওন্ড ম্যান।
আমাদের চোখকে আমরা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মিস্টার বয়েলস বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় পা সামনে টান-টান করে সেই ইজিচেয়ারটিতে বসে ছিলেন।
তাঁর পায়ের কাছে লুসি। আর ওদের চারধারে, মাটিতে, গাছের ডালে ডালে প্রায় পঞ্চাশটা শকুন।
আমরা এগিয়ে যেতেই শকুনগুলো ওদের কুৎসিত ভারী শরীর নিয়ে অদ্ভুতভাবে পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে সরে যেতে লাগল।
আর একটু এগিয়েই প্যাট রাগে পাগলের মত হয়ে গেল। পাগল হয়ে গিয়ে, ওর ডান হাতের কাচটা বর্শার মত করে ছুঁড়ে দিল সেদিকে।
যেকটা শকুন তখনও মিস্টার বয়েলসের কাছে ছিল, তারা সরে গেল। কিন্তু উড়ে দূরে গেল না। কাছাকাছি গাছে তাদের লোমহীন কদর্য লম্বা লম্বা গলাগুলো বের করে বসে রইল।
আমরা আর একটু এগিয়ে গিয়েই আৎকে উঠলাম। মিস্টার বয়েলস-এর চোখ দুটো ওরা খুবলে খেয়ে নিয়েছে।
যেখানে এক সময় চোখ ছিল, সেখানে এখন দুটি কালো কোটর দেখা যাচ্ছে। শুধু চোখই নয়, শকুনগুলো কুরে কুরে মুখ, গলা, বুক এসবও খেয়েছে। সবসুদ্ধ মিলে এমন একটা বীভৎস দৃশ্য হয়েছে যে তা চোখে দেখা যায় না। সহ্য করা যায় না। পরিচিত-জনের এই পরিণতি বিশ্বাস করা যায় না।
প্যাট দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এক ক্রাচে ভর করেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্রমান্বয়ে বলে চলল, ও গড, ও গড, আই কান্ট বিলিভ ইট।
সঙ্গের দেঁহাতী লোকটিই সেদিন আমাদের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকিয়েছিল। সেও স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইল।
কয়েক মুহূর্ত সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার পর লোকটির হুঁশ এল।
সে দৌড়ে ঘরে ঢুকে সেখান থেকে একটা বাঁশের লাঠি এনে শকুনগুলোকে ধাওয়া করতে লাগল।
যেগুলো নীচের ডালে ছিল, সেগুলোকে ধপ ধপ করে দু-চার ঘা লাগিয়েও দিল।
তখন শকুনগুলো এক এক করে গাছের ডাল ছেড়ে অনিচ্ছার ভারী দুর্গন্ধ পাখা মেলে উড়ে যেতে আরম্ভ করল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা থেকে ঐ মৃত্যুর দৃতগুলো উধাও হয়ে গেল।
লুসিও শুয়ে ছিল। কিন্তু অর্ধমৃত হয়ে ছিল। সে তার প্রভুকে এই শ্মশানের চরগুলোর হাত থেকে বাঁচাবার অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে সে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্তই হয়েছিল। তার প্রভুর মৃতদেহকে তবুও সে অক্ষত রাখতে পারে নি।
আমরা অনুমান করলাম, তিন কি চারদিন আগে সকালে অথবা বিকেলে রোদ পোয়াবার জন্যে মিস্টার বয়েলস এইখানে এসে বসেছিলেন। তারপর হার্টফেল করেই হোক অথবা যেভাবেই হোক কোনো স্বাভাবিক কারণেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
তখনও তাঁর কোলের উপর বাইবেলটা খোলা পড়ে ছিল। যমদূত তাঁর কালো আলখাল্লা পরে এসে তাঁকে কোথায় কোন দেশে ডাক দিয়ে নিয়ে গেছিল জানি না, কিন্তু যমদূত যে এসেছিল তা নিশ্চিত।
সেই থেকে তাঁর মৃতদেহ ওখানে ওরকম ভাবেই পড়ে ছিল। এদিকে তিন চারিদিনের মধ্যে কারোরই এবং আমাদেরও আসার অবকাশ হয়নি।
শকুনগুলো নিশ্চয়ই আজ সকাল থেকেই তাদের ভোজ শুরু করেছিল, নইলে এতক্ষণে ওর হাড় কখানা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকার কথা ছিল না।
প্যাট লুসিকে তুলে নিয়ে ঘরে গেল। আমাকে বলল, পাহারায় থাকতে।
আমি মিস্টার বয়েলস-এর নিস্তব্ধ বীভৎস মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম।
প্যাট চিঠি লিখে যাদের যাদের জানাবার সবাইকে এই খবর জানিয়ে সেই লোকটির হাতে সব চিঠি দিয়ে পাঠিয়ে দিল।
তারপর একটা চাদর এনে ঢেকে দিল মিস্টার বয়েলস-এর নিপীড়িত শরীরটিকে। মৃত্যু ত সকলেরই হয়, কিন্তু মৃত্যুর পরও এমন বীভৎসতার মধ্যে এই শীতার্ত একাকী বৃদ্ধকে কেন ভগবান টেনে আনলেন জানি না।
একটা পাথরে বসে ও একটা সিগারেট ধরাল। ও কোনো কথা বলছিল না। ওকে এমন বিচলিত আমি কখনই দেখিনি।
সিগারেটটা শেষ করে ও আবার মিস্টার বয়েলস-এর কাছে ফিরে গিয়ে তাঁর কোল থেকে বাইবেলটা তুলে আনল।
বাইবেলটা রক্তে ও কিমার মত মাংসের কুচিতে ভরে গেছিল।
প্যাট বাইবেলটা খুলল। ঝড়বৃষ্টিতে বাইবেলের পাতাগুলো নেতিয়ে গেছিল। কোননা অক্ষর আর পড়া যাচ্ছিল না।
যার এই জগত থেকে ছুটি হয়ে গেছে তার নিজের কোনো কাজে লাগে না এসব বই। শুধু বাইবেল কেন, যে কোনো ধর্মপুস্তকই দুয়োর পেরোবার পর আর কাজে লাগে না। চিরদিনের মত ছুটি হয়ে যাবার পর এসবই নিছক অপ্রয়োজনীয় এবং অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তাই প্যাট আবার বাইবেলটাকে নিয়ে গিয়ে মিস্টার বয়েলসের কোলে রেখে এল।
দেখতে দেখতে অনেক লোক এসে জমা হলেন। কাছে এসেই প্রত্যেকে মাথার টুপী খুলে ফেললেন।
একজন পাদ্রী সাহেবও এলেন। তারপর কেউ কোন কথা না বলে মিস্টার বয়েলসকে চেয়ারসুদ্ধ ধরে ঘরে নিয়ে গেলেন।
এত লোক দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, মিস্টার বয়েলস-এর জন্যে এত লোকের দয়া ও সহানুভূতি ছিল। নাকি এঁদের মধ্যে অনেকেই ওঁর মৃত্যুর পর ওঁর আত্মার শান্তি কামনা করবেন বলেই এসেছিলেন, যদিও জীবিতাবস্থায় ওঁর জীবন্ত ব্যথাতুর আত্মাকে কোনোরকম সহানুভূতি দেখাবার প্রয়োজন মনে করেননি এরা কেউই?
সমবেত শোকার্তদের মধ্যে কে-কে এই বৃদ্ধকে বেশি ভালবাসতেন, বেশি করে জানতেন, তা দেখানোর হুড়োহুড়ি পড়ে গেল।
চুপ করে এক কোণায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে লাগলাম।
লুসিকে ইতিমধ্যেই চেয়ারে বসিয়ে অন্যত্র পাঠানো হল তাকে চিকিৎসা করাবার জন্যে।
দেখতে দেখতে মিস্টার বয়েলস-এর মৃতদেহকে চান করানো হল সুগন্ধি ঢেলে বাথটবে। তারপর আলমারী খুলে তার সবচেয়ে ভালো যে শতছিচ্চ সুটখানি ছিল তা পরানো হলো।
কারা যেন শিমুলকাঠে তৈরী একটা মস্ত কফিন এনে হাজির করলেন। অন্যরা ওর বাড়ির পাশে একটা তেঁতুলগাছের তলায় কবর খুঁড়তে শুরু করলেন।
এখানের যে-কোন সাহেব মরলে তাকে কবরখানাতেই নিয়ে গিয়ে কবর দেওয়া হয়, কিন্তু উনি নাকি জীবদ্দশাতেই ডেপুটি কমিশনারের কাছ থেকে তাঁর নিজের বাড়ির কম্পাউন্ডেই সমাধিস্থ হবার অনুমতি নিয়ে রেখেছিলেন। তাই তাঁর জন্যে এই ব্যবস্থা।
কফিনের মধ্যে তুলো দিয়ে চতুর্দিক মোড়া হল। তারপর ধীরে ধীরে মিস্টার বয়েলস-এর শরীরকে বয়ে এনে কফিনের মধ্যে শোয়ানো হল।
সমস্ত কিছু ঘটতে ঘণ্টা দুয়েকের বেশি সময় লাগল না। তারপর কফিনটাকে কালো কাপড়ে মুড়ে উপরে সাদা তুলো দিয়ে একটি ক্রস আঁকা হল।
কফিনটিকে বইবার জন্যে অনেকে এগিয়ে গেলেন। প্যাট এক কোণায় আমার সঙ্গে দাঁড়িয়ে সব দেখছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল, ও জীবিত মিস্টার বয়েলসের বড় আপনার লোক ছিল। এই মৃত লোকটির সঙ্গে ওর যেন কোনো যোগ নেই। মৃত লোকটির প্রতি দরদ দেখাতে আজ এত লোক উপস্থিত যে, সেখানে যেন ও বেমানান।
কফিনটা ওরা তুলতে যাবে এমন সময় প্যাট পাদ্রীসাহেবকে গিয়ে কি যেন বলল। পাদ্রীসাহেব আমাকে ডাকলেন, ডেকে কফিনটি অন্যদের সঙ্গে বইবার জন্যে অনুরোধ করলেন।
আমি ক্রীশ্চান নই, মিস্টার বয়েলস-এর আপনজন নই, ওর নিজের গোষ্ঠীর লোক নই; তবুও আমাকে এই সম্মান দেওয়াতে রীতিমত অভিভূত হয়ে পড়লাম।
মনে পড়ে গেল মিস্টার বয়েলস প্রথম দিন আলাপ হবার পর বলেছিলেন, প্লিজ ডু মী আ ফেভার। লেন্ড প্যাট আ হ্যান্ড অ্যাট দ্য টাইম অফ মাই ব্যেরীয়াল।
সকলের সঙ্গে আমিও কফিন কাঁধে নিয়ে দাঁড়ালাম।
পাত্রী সাহেব আগে আগে বাইবেল থেকে অনেক কিছু পড়তে পড়তে হাঁটছিলেন। পড়ছিলেন, শান্ত গম্ভীর গলায়। পাদ্রীসাহেবের হাঁটা-চলা, হাব-ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যে উনিও যেন মিস্টার বয়েলস-এর মৃত অন্য কোনো জগতের লোক।
কবরের সামনে পৌঁছে কফিনটি নামিয়ে রেখে আবার অনেক কিছু পড়লেন পাদ্রীসাহেব। আমার কানে কিছুই যাচ্ছিল না! কতগুলো শর্তহীন শীতার্ত শব্দ বাতাসের মত কানে এসে লাগছিল।
উনি আমাদের বললেন, এবার কফিন নামানো হোক। কিছুক্ষণ পর দড়ি বেঁধে কফিন নামিয়ে দেওয়া হল গহ্বরে।
তারপর আর সকলের সঙ্গে আমিও মুঠো মুঠো লতাপাতাফুল সমেত ভেজা মাটি কবরের উপর চাপা দিতে লাগলাম।
প্যাট এবারও এদিকে এলো না। যে পাথরে বসেছিল, তার সামনে দাঁড়িয়ে উঠল
পাদ্রীসাহেব তখন পড়ছিলেন,
Thou knowest, Lord, the secrets of our hearts, shut not thy merciful ears to our prayer, but spare us, Lord most holy, O God most mighty, O holy and merciful saviour, thou most worthy Judge eternal suffer us not, at our last hour, for any pains of death to fall from thee.
তারপর মাটি পড়ে পড়ে যখন কবর প্রায় ভরে এল, পাদ্রীসাহেব বললেন,
We therefore commit his body to the ground, earth to earth, ashes to ashes, dust to dust in sure and eternal hope of resurrection to eternal life…
আমার খুব ইচ্ছে করছিল জানতে যে, মাটির নীচে শুয়ে-থাকা মিস্টার বয়েলস কি এ কথাগুলো শুনতে পাচ্ছেন!
শুনতে পেলে কি তাঁর মুখ অবিশ্বাসে কুঁচকে যেত না? দেখতে দেখতে সব শেষ হয়ে গেল। একে একে সকলেই চলে গেলেন সেই চত্বর ছেড়ে।
সব শেষে গেলেন পাদ্রীসাহেব।
প্রথম দিন প্যাটের সঙ্গে এ বাড়িতে এসেছিলাম। এখানের সকলেই এ বাড়িকে মিস্টার বয়েলস প্লেস বলে জানত।
কিন্তু আজ থেকে অনেকদিন পরে, আমি যেমন ছুটির হাত ধরে সেই পোডড়াবাড়ি নাইটিঙ্গেলে বেড়াতে গেছিলাম, তেমনি কোনো বেড়াতে-আসা যুবক তার যুবতী বান্ধবীর হাত ধরে বেড়াতে একদিন এখানে আসবে।
তখন এ বাড়ির দরজা জানালা কিছুই থাকবে না, অশ্বথের চারা গজিয়ে উঠবে। দেওয়ালে দেওয়ালে। সাপের খোলস পড়ে থাকবে এদিকে ওদিকে।
সেদিনও এমনি করে হাওয়া বইবে ঝুঁকে-পড়া গাছগাছালির পাতায় পাতায়। অথবা হয়ত আকাশে ঝকঝক করবে রোদ্র। হয়ত সেই যুবক ও যুবতী হাতে হাত রেখে মিস্টার বয়েলসের কবরের উপরেই দাঁড়িয়ে থাকবে। কিন্তু তারা কখনও জানবে না যে, এখানে একজন মানুষ একটু উষ্ণতার জন্যে কি অপরিসীম কাঙ্গালপনা নিয়ে একদিন বেঁচে ছিল–যে এই শীতল মাটির নীচে ঘুমিয়ে আছে।
ওদের অল্পবয়সী উত্তাল ভালোবাসায়, এই নির্জন শান্ত পরিত্যক্ত পরিবেশে ওরা হয়ত একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে, উষ্ণতায় ভরে দেবে দুজন দুজনকে; অথচ একবারও ভয় হবে না, ওরা কখনও জানবে না যে, সমস্ত উষ্ণতাই একদিন নিভে যায়। সমস্ত উষ্ণতার স্বাদ উষ্ণতার সাধ, সব নিঃশেষে নিয়মিত এই অমোঘ পরিণতির দিকে গড়িয়ে যায়ই যায়।
ওরা তা যদি জানত, তবে এক মুহূর্তের জন্যেও একে অন্যকে ছাড়তো না, অন্যের হাত থেকে কখনও তবে হাত সরাতো না।
ওরা জানবে না, আমি জানি না, আমরা কেউই জানি না যে, যতক্ষণ যৌবন থাকে, জীবন ভোগ করার সহজ সরল অধিকার থাকে, ততক্ষণ জীবনকে আমার ছুটির বুকের মত সবসময় মুঠিভরে ধরে রাখতে হয়–এক পরম সুগন্ধি উষ্ণতায়।
তাকে এক মুহূর্তও বুঝি হাতছাড়া করতে নেই। প্যাট সেই পাথরের উপরই বসে ছিল, পাশে কাচটা হেলান দিয়ে রেখে। সিগারেটটা ছুঁড়ে ফেলে প্যাট উঠে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে কবরটার দিকে এগিয়ে গেল। আমি হঠাৎ আবিষ্কার করলাম, প্যাটের দু চোখ বেয়ে অঝোরে জল ঝরছে। প্যাট দাঁত দিয়ে ওর নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, অল রাইট ওল্ড ম্যান। অল দ্য বেস্ট টু ঊ্য। হ্যাভ আ নাইস টাইম ইন দা ওয়ার্লড উ হ্যাভ জাস্ট রীচড়।
বলেই, প্যাট ঘুরে দাঁড়াল। তারপরই কোনো কথা না বলে ফিরে চলল। মিস্টার বয়েলস-এর বাড়ির বাইরের দরজাটা হাঁ করে খোলা পড়ে রইল। হাওয়াটা বাঁশী বাজিয়ে, টালির ছাদে, শূন্য বাড়িময় খেলে বেড়াতে লাগল।
একটু দূরে গিয়ে প্যাট আমার দিকে ফিরে বলল, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমারও আপনজন যদি কেউ থাকত, বেশ হত তাহলে।
আমি বললাম, আপনজন মানে? প্যাট হাসল।
ওর গালে চোখের জলের দাগ তখনও শুকোয়নি। সেই কান্নাভরা মুখে ওর চোখ দুটো হেসে উঠল।
ও বলল, আই মীন, আ বিচ অফ আই ওওন। এক্সকুসিভলি মাই ওওন। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম।
প্যাট আবার পুরোনো প্যাট হয়ে বলল, ওয়েল, হেল্ উইথ ইট। আই অ্যাম ভেরী হ্যাপী এজ আই এ্যাম।
দেখলাম, এ কথা বলতে বলতে প্যাটের চোখ দুটো আবার জলে ভরে গেল।
আমি ওকে লজ্জার, দুঃখের একাকীত্বর গ্লানির হাতে এমন ভাবে কষ্ট পেতে দেখতে চাইনি। ওকে দেখে আমার এতদিন মনে হয়েছিল এমন পুরুষও থাকে, আছে, যার
কোনো নারীর নরম হাতের উষ্ণতার জন্যে কাঙ্গালপনা না করলেও চলে।
আজ নিশ্চিতভাবে জানলাম, আমি যা ভাবতাম, তা ঠিক নয়। কোনো পুরুষই বোধহয় কোনো ভালোবাসার নারীর সঙ্গ ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। সে-সব পুরুষ, মানুষ হিসেবে কখনই সম্পূর্ণ নয়।
আমি প্যাটের মুখ থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্য দিকে চেয়ে, প্যাটের পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম।
কখনও আমি জট দৌড়াদৌড়ি স্থলম একা একা।
.
২৪.
সকালবেলার হাঁটা সেরে ফিরে আসছিলাম একা একা।
আজকাল হাঁটাহাঁটি দৌড়াদৌড়ি সবই এমন অক্লেশে করি যে মনেও পড়ে না কখন কখনও আমি ভীষণ অসুস্থ হয়েছিলাম। সেইসব অন্ধকার দিনগুলোর কথা এখন মনে করতেও খারাপ লাগে।
পথের বাঁদিকে পাহাড়ের খোলে একটা দোলা মত দু-তিনটি ন্যাড়া পাথরের টিলা। সবচেয়ে নীচু জায়গায় এখনও জল আছে। জল, বসন্ত অবধি থাকবে। তারপর গ্রীষ্মের দাবদাহে সে জল শুকিয়ে যাবে।
জলের পাশে একটা ঝাঁকড়া অশ্বত্থ গাছ। তাতে একদল হরিয়াল ঝাঁপাঝাঁপি করছিল। তাদের হলদেটে সবুজ গায়ে সকালের রোদ এসে পড়েছিল।
ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার লাবুর কথা মনে পড়ে গেল। লাবু বলেছিল হরিয়ালেরা কখনও মাটিতে পা দেয় না। যদি বা কখনও ওরা জল খেতেও নামে তবে মুখে করে পাতা নিয়ে নামে, পাতার উপর পা ফেলে জলের পাশে দাঁড়িয়ে জলে ঠোঁট ডুবিয়ে জল খায়।
আমি তন্ময় হয়ে হরিয়ালদের দেখছি, এমন সময় চামার দিক থেকে একটা গাড়ি আসার আওয়াজ শোনা গেল।
দেখতে দেখতে আওয়াজটা একেবারে কাছে এসে গেল।
দেখলাম একটা ট্যাকসি।
ট্যাকসিটা যখন আমাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে এমন সময় হঠাৎ সশব্দে ব্রেক কষে ট্যাকসিটা দাঁড়িয়ে পড়ল।
একটি মেয়েলি হাত জানালা দিয়ে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল।
তারপর কে যেন বলল, এ্যাই। উঠে এসো।
কাছে গিয়ে তাকিয়ে দেখি রমা।
আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি? কোনো খবর না দিয়ে?
রমা বলল, খবর দিয়েই আসা উচিত ছিল। আমার স্বামীর ঘরে আমার স্লিপ দিয়েই ঢোকা উচিত। সে ঘরে কে কখন থাকে ঠিক থাকে না ত।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
রমা বলল, পথের মধ্যে সীন কোরো না, উঠে এসো। বলেই এক ঠেলা দিয়ে দরজা খুলে দিল।
আমি উঠে বসলাম রমার পাশে।
রমার চুল উস্কোখুস্কো, চোখ-বসা, রাতে বোধহয় ঘুমোয়নি।
আমি বললাম, রাঁচী একসপ্রেসে এলে বুঝি?
রমা বলল, না। এসেছি কালকে। প্লেনে এসেছিলাম।
সে কি? প্লেনে এসেছিলে, তাহলে ত কাল দুপুরেই পৌঁছে গেছিলে রাঁচী। কাল সারাদিন কোথায় ছিলে?
বি. এন. আর হোটেলে ছিলাম।
কেন? রাঁচীতেই যদি এলে তবে এখানে এলে কেন? বললাম আমি।
রমা উত্তরে কোনো কথা বললো না। আমার দিকে খুব রহস্যময় চোখে তাকালো। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমার সতীনের বাড়ি গেছিলাম। বলেই হাসল।
কেন জানি না, রমা যদিও আমার স্ত্রী, তবুও ওর হাসিটা ডাইনীর হাসির মত মনে হল।
আমি মুখ তুলে বললাম, মানে?
রমা বলল, মানে, তুমি জানো না?
আমি বললাম, না, জানি না।
তবে আর কি! জানবে, বিস্তারিতই জানবে। সবই জানবে।
দেখতে দেখতে বাড়ি এসে গেল।
রমা ট্যাকসিওয়ালাকে বিদায় দিল না। টাকা দিয়ে বলল, স্টেশনে গিয়ে খাওয়াদাওয়া করে বিকেল তিনটের পর যেন আবার আসে–ওয়েটিং চার্জ যা লাগবে তা ও দিয়ে দেবে। বিকেলের রাঁচী-হাওড়া এক্সপ্রেস ধরিয়ে দিয়ে তবে ট্যাকসিওয়ালার ডিউটি শেষ।
আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার কিছু বলার ছিলো না।
রমা পেয়ারাতলার বেতের চেয়ারে গিয়ে বসে, পায়ের কাছে নামিয়ে রাখা ছোট সুটকেসটার উপর মেক-আপ বাক্সটা রাখল। তারপর বলল, তোমার চেলা-চামুণ্ডাদের ডাক। একটু চা খাব।
আমি লালিকে ডেকে আমাদের চা ও ব্রেকফাস্ট দিতে বললাম।
রমা আমাকে আর কিছু না বলে মেক-আপ বাক্সটা হাতে করে নিয়ে উঠে ভিতরে চলে গেল।
রমা নিশ্চয়ই বাথরুমে গেছিল।
আমি জানি, বাথরুমে গিয়েই রমার চোখ পড়বে একটা নাইটির উপর। নাইটিটা ছুটির। গতবার তাড়াতাড়িতে যাবার সময় ছুটি ফেলে গেছিল। সেই অবধি ওটা ওখানেই আছে। আমি অনেক দিন ভেবেছি যে ওটাকে কাচিয়ে তুলে রাখব। প্রতিদিন চান করার সময় ওটাকে দেখে সেকথা ভেবেছি, কিন্তু বাথরুম থেকে বেরিয়েই আবার ভুলে গেছি।
বসে বসে রমার আসার কারণটা অনুমান করার চেষ্টা করছিলাম। গতবার যাবার সময় ওকে যে মুডে দেখেছিলাম, তা থেকে এখনকার মুড সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাছাড়া ও গতকাল রাঁচীতেই যে থেকে গেল কেন তাও বুঝে উঠতে পারছি না।
আপাতত আমার কতগুলো অনুমান নিয়ে নাড়াচাড়া করা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই।
ও বাথরুম থেকে বেরিয়ে, সামান্য প্রসাধন করে বাইরে এল। ও বিয়ের এক বছর পর থেকে শুধু আমার জন্যে বা নিজের জন্যে কখনও প্রসাধন করেনি; করেছে, বাইরে যাবার সময়, (আমার সঙ্গ ছাড়া, কারণ আমার সঙ্গে গত বহু বছর সে কোথাওই যায়নি) এবং বিশেষ কারো সঙ্গে (যেমন সীতেশ) দেখা করতে যাবার সময়। তাই ওকে প্রসাধিত অবস্থায় কেমন দেখতে লাগে তা প্রায় ভুলেই গেছিলাম আমি।
রমা এসে বসল।
মালু এসে রমার সুটকেসটা তুলে নিয়ে গেল।
রমা ওকে একবার অপাঙ্গে দেখল।
তারপর নিজের মনেই যেন বলল, নাইটিটা বেশ ভালো। ছুটিকে পরলে নিশ্চয়ই ভারী সুন্দর দেখায়, না?
আমি চুপ করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
রমা বলল, বেহায়া কথাটার মানে জানো তুমি?
আমি তেমনই চুপ করে থাকলাম।
রমা আবার বলল, তোমার বোধ হয় মনে আছে, তোমাকে আজকালকার মেয়েদের সম্বন্ধে কি বলেছিলাম গতবারে, বলেছিলাম, ওদের মধ্যে গভীরতা বলে কোনো বস্তু নেই। এই ওরা গলা ধরে ঝোলে, অমনি ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে দৌড় দেয়। মনে আছে?
তারপর বলল, বোধহয় আমার কথাটা তুমি তখন মনোযোগ দিয়ে শোনোনি। এখন যা বলছি শোনো। তোমার প্রেমিকা, তোমার একনিষ্ঠ পাঠিকা ছুটি, বিয়ে করেছে। এবং এখন হানিমুন করছে। অবশ্য রাঁচীতেই। রাঁচীতেই আছে। রাঁচী ছেড়ে দূরে চলে গেলে তোমার মুখে এমন করে চুনকালি ত মাখানো যেত না। তোমাকে দুঃখও দেওয়া যেত না।
আমি কথাটা শুনে চমকে উঠলাম। কিন্তু রমার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পেলাম যে রমা মিথ্যা কথা বলছে।
কারণে অকারণে মিথ্যা কথাটা ও এমন ভাবে বলা রপ্ত করেছে যে, যে-কোনো মিথ্যা কথাই আর ওর মুখে আটকায় না। ওর চোখ কাঁপে না এতটুকু।
আমি তবুও কোনো কথা বললাম না।
রমা এবার বলল, কি? চুপ করে আছ যে? কিছু একটা বল? তুমি ভেবেছিলে, গাছটারও খাবে তলাটারও কুড়োবে, তাই না? তুমি মেয়েদের নিয়ে মনগড়া গল্প লিখে নিজেকে খুব একটা কেউকেটা মনে কর। মেয়েদের তুমি কিছুই জানো না, চেনো না।
এমন কোনো বোকা ও নিঃস্বার্থ মেয়ে এ পৃথিবীতে নেই, যে-শুধু ভালোবাসার জন্যেই ভালোবাসা দিতে পারে। জীবনে নেই; তোমার থার্ডরেট লেখকের গল্প-উপন্যাসে হয়ত থাকতে পারে। মেয়েরা ঘর চায়, স্বামীর পরিচয় চায়, সন্তান চায়, তার দেওয়া হোক কি নাই-ই হোক, স্বামীর সামাজিক শীলমোহরটা চায়। এ নইলে কোনো মেয়ে বাঁচতে পারে না। পোশাকী ভালোবাসা কখোনোই টেকে না যে তা দেখলে ত!
একটু চুপ করে থেকে রমা বলল, ফুঃ, ভালোবাসা! কী ভালোবাসাই না দেখালো। ভালোবাসা না ছাই। ভালোবাসার ঢং করে কিছু হাতিয়ে নেওয়ার তাল! যেই দেখল উদ্দেশ্য সাধন হয়েছে অমনি স্বমূর্তি ধারণ করল। লেখকের অনুপ্রেরণা হবার সাধ তার শেষ হয়ে গেল। ঘর গোছাতে লাগল স্বামীর সঙ্গে, বিছানা পাততে লাগল ফুল ছিটিয়ে। ছিঃ ছিঃ! আমি ত ভাবতেই পারি না যে কোন মেয়ে এমন ঢং করতে পারে; এতখানি ঢং। এতখানি ইনসিনসিয়র কোনো মানুষ হয়?
আমি হঠাৎ রমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, রমার দু চোখ জলে ভিজে গেছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম।
কি করা উচিত আমার তা বুঝতে পারলাম না। ভেবে পেলাম না, এ চোখের জল কার জন্যে? রমার নিজের জন্যে? ছুটির জন্যে? নাকি আমারই জন্যে? আমার জন্যে কেন রমা কাঁদতে যাবে? আমি বললাম, তুমি কাঁদছ কেন?
রমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমার ভীষণ কষ্ট হয়। তুমি আমার স্বামী, তুমি আমার সঙ্গে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছ, কিন্তু সেটা আমাদের ব্যাপার। ঝগড়া হোক, ভাব হোক, ভুল বোঝাবুঝি হোক, সেটা আমাদের একান্ত ব্যাপার। কিন্তু বাইরের একটা সস্তা বাজে, একরত্তি মেয়ের কাছে তুমি এমন ভাবে অপমানিত হবে এটা আমার ভাবলেও কষ্ট হয়। তোমার মান-সম্মান বলে কি কিছুই নেই? কি তুমি দেখেছিলে ওর মধ্যে? কি খাইয়ে বশ করেছিল ও তোমায় কোন মন্ত্রে? যার জন্যে তুমি এমনভাবে নিজের সব কিছু নিজেকে, তার সঙ্গে আমাকেও মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিলে? কেন তুমি এরকম করলে?
আমি অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম। আমার ওকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছিল যে, ছুটি আমাকে চিরদিনের মত বা আমি ছুটিকে চিরদিনের মত পেয়েছি একথা জানলেও কি রমা খুশি হত? তার পরও কি এমন করেই এত কথা বলত না?
আমি কিছু বলার আগে রমা নিজেই বলল, এর চেয়ে ও তোমার সঙ্গে থাকলেও আমি খুশি হতাম। আমি জানতাম, জীবনে একবার অন্তত তুমি জিতলে, নিজের বুদ্ধিমত কাজ করে। তোমাকে বোকা পেয়ে, তোমার টাকার জন্যে, তোমার দেওয়া সুযোগের জন্যে তোমার কাছে মুখোশ পরে এ পর্যন্ত কত বন্ধু, কত প্রেমিকা, কত আত্মীয়ই ত এল, তুমি তাদের সকলের কাছেই বোকার মত ঠকে গেলে। ও-ও যদি তোমাকে না ঠকাত তবে বুঝতাম ও সৎ। ওর মধ্যের মানুষটা খাঁটি। আসলে ও-ও আর একজন সস্তা ফোর-টোয়েন্টি।
আমি কুয়োতলার দিকে চেয়ে বসেছিলাম। আমার মাথায় কোনো কথা ঢুকছিল না।
লালি এসে একসময়ে চা ও ব্রেকফাস্ট নামিয়ে রেখে, তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেল।
রমাকে ওরকমভাবে কাঁদতে দেখে ও নিজেই খুব অপ্রতিভ বোধ করছিল।
রমা বলল, কি? তুমি এখনও কোনো কথা বলছ না যে? তোমার কি বলার কিছুই নেই?
আমি বললাম, না।
ছুটি বিয়ে করেছে শুনেও না?
আমি বললাম, আমি ও কথা বিশ্বাস করি না। ছুটি কেমন মেয়ে তা আমি জানি; ছুটিকে আমি চিনি। তুমি ছোট করলেই ত সে আর ছোট হয়ে গেল না। আমি কেবলি ভাবছি, একজনের নামে বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যা কথা বলে যাকে আমি ভালোবাসি, ভালোবাসব চিরদিন, তাকে ছোট করে তোমার কি লাভ? তুমি কি পাবে তাতে?
রমা একটা টোস্টে কামড় দিয়েছিল। টোস্টটা ঠোঁট থেকে বের করে বলল, তোমার শিক্ষা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। ভেবেছিলাম আমার দেওয়া শিক্ষাই তোমাকে শুধরাতে পারবে, এখন দেখতে পাচ্ছি তোমার কপালে অনেক দুঃখ আছে। আরো অনেক দুঃখ।
আমি চুপ করেই থাকলাম।
কেন জানি না, আমার বার বার রুণের মুখটা মনে পড়তে লাগল। ওর চোখ দুটো বড় করুণ। কাটা কাটা নাক-চিবুক। কিন্তু বড় দুর্বল ও। গালের ও কপালের শিরাগুলো গোনা যায়। ও সবসময় ওর বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো দিয়ে আমাদের মধ্যে এই বৈষম্য বোঝবার চেষ্টা করে, নিজে হেসে আমাদের হাসাবার চেষ্টা করে। কিন্তু বেচারী রুণ! ওর এই ছেলেবেলার জীবনে শান্তি কাকে বলে ও জানল না। বাবা-মার আদর কাকে বলে, বাবা-মার সুস্থ স্বাভাবিক সহজ সম্পর্ক কাকে বলে তা ও জানল না।
মাঝে মাঝে রুণের জন্যে নিজেকে বড় অপরাধী বলে মনে হয়। অন্তত ওর মুখ চেয়েও রমার ও আমার মানিয়ে নেওয়া উচিত ছিল দুজনে দুজনকে। কিন্তু এখন যে বড় দেরী হয়ে গেছে।
রমার খাওয়া শেষ হলে আমি বললাম, এবার বলো, তুমি কেন এসেছ এমনভাবে হঠাৎ? কিছু কি চাই তোমার?
রমা চীৎকার করে উঠল। বলল, না! কিছুই চাই না। তোমার কাছে আমি কিছুই চাই। রমার চীৎকার শুনে কুয়োতলায় জল নেওয়া মেয়েগুলো দাঁড়িয়ে পড়ে এদিকে দেখতে লাগল।
আমি বললাম, একদিন আমি পুরোপুরি তোমারই ছিলাম, একমাত্র তোমারই। কিন্তু সেই আমি আর আজকের আমি এক লোক নই। তোমাকে সুখী করার–কোনোভাবেই সুখী করার ক্ষমতা আমার নেই। আমাকে ক্ষমা কোরো। আমি অনেক ভেবে দেখেছি। যা ভেঙে গেছে, তা ভেঙে গেছে। তোমাকে এর আগেও বলেছি, তুমি আমার বাড়িতে থাকতে পারো, যতদিন থাকবে বাইরের সব লোকের কাছে তুমি আমার স্ত্রীর মর্যাদা পাবে, কিন্তু আমার কাছে কিছু চেও না। তোমাকে দেবার মত কিছুই নেই আমার। বাকি নেই কিছু।
ছুটি ত তোমাকে অপমান করেছে, তোমার মুখে থুথু দিয়েছে। এখন তোমার যাবার জায়গা কোথায় দেখি। শেষ পর্যন্ত আমি ছাড়া তোমার কে থাকে তা আমি দেখব।
আমি হাসলাম, বললাম, কোনো জায়গাই যদি আমার না থাকে, নাইই বা থাকল। তাছাড়া শেষ বলতে তুমি কি বোঝ জানি না। আমার ত মনে হয় শেষটা একটা ইচ্ছাধীন ব্যাপার। যে কোনো মুহূর্তই শেষের মুহূর্ত হতে পারে।
রমা হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে তাকাল। ঠাট্টার হাসি হাসল। তারপর বলল; এ কথাটা এর আগেও বহুবার বলেছো। বলল, তুমি কি আত্মহত্যার কথা বলছ? যে-লোক মুখে বলে আত্মহত্যা করব, সে কখনও তা করতে পারে না। আত্মহত্যা করতে সাহস লাগে। তুমি কোনোদিনও মারতে পারবে না নিজেকে নিজে হাতে।
আমি চুপ করে থাকলাম অনেকক্ষণ। তারপর বললাম, ঝগড়া ত অনেকদিন, অনেকবার করেছ রমা, এখন ঝগড়া থাক। তোমার যা বলার তা কি শান্তভাবে বলতে পারো না? তুমি কি মনে করতে পারো না আমরা দুজন বাইরের লোক, বাইরের লোকের মত ভদ্র ব্যবহারও কি একে অন্যের সঙ্গে একেবারেই করা যায় না? আমি ত তোমার কাছে আর কিছুই চাইনি–শুধু শান্তি ছাড়া। তবু তুমি এখান অবধি ধেয়ে এসে সেই শান্তি বিঘ্নিত করে কি আনন্দ পাও?
পাই, পাই; অনেক আনন্দ পাই। সে কথা কি বুঝবে? তোমার মত যেসব স্বার্থপর লোক শুধু নিজেদেরই ভালোবাসে, নিজের প্রফেশান, নিজের লেখা, নিজের যশ ছাড়া জীবনে আর কিছু ভাবার যাদের সময় হয় না, তাদের এমনি করে তিলে তিলেই মরতে হয়। এটুকু জেনো, মরবার সময়ও তোমাকে আমি শান্তিতে মরতে দেব না। শকুনের মত তোমাকে আমি কুরে কুরে খাব। তবে আমার সাধ মিটবে।
কেন জানি না, রমার এই কথায় সেদিন সকালে দেখা মিস্টার বয়েলসের ঠাণ্ডা রক্তাক্ত মৃতদেহটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল।
রমা বলল, তোমাকে বলতে এসেছি যে, সীতেশকে আমি বিয়ে করছি। সীতেশকে যা ভাবতাম, সীতেশ তা নয়। ও বড়লোকের ছেলে হতে পারে, কিন্তু বড়লোকের লালু ছেলে নয়। ও নিজের জীবনে অনেক কিছু করেছে। ওর নিজের একটা পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গী আছে জীবনের প্রতি। আমি ওর পাশে থাকলে আরো অনেক কিছু করবে বলেই আমার বিশ্বাস। ও আমাকে কাঙালের মত চায়; আমাকে ভালোবাসে। সীতেশ মানুষটা বড় ভালো। ও জীবনে একটু কাজ, একটু অবকাশ, ঘরের মধ্যে শান্তি এইসব চায়। ও তোমার মত মিথ্যে নামের পিছনে দশজনের মধ্যে একজন হবার মিথ্যে মোহে নিজের এবং অন্য কারু জীবন নষ্ট করে না।
আমি জানি, কোনো পার্টিতে, সমাজে, তোমার স্ত্রী বলে পরিচিত হতে আমার যতখানি ভালো লাগত, ওর স্ত্রী বলে পরিচিত হতে ততখানি ভালো লাগবে না। কিন্তু সমাজ ত জীবনের একটা অংশমাত্র। জীবনের বেশীটাই ত ঘরের মধ্যে। সেই ঘরের মধ্যে সবসময় আমাকে দেখাশোনা করবে সীতেশ। ও কথা দিয়েছে, রোজ সকাল থেকে লাঞ্চ অবধি কাজ করবে–তারপরই বাড়ি চলে আসবে। আমরা দুজনে অনেক মজা করব। রেসে যাব, সুইম্ করব, কখনো বোলিং করব, ছবি দেখব, ক্লাবে যাব। জীবনের যতটুকু বাকী আছে সেটুকুকে এখনও স্যালভেজ করার সময় আছে। যতটুকু পারি, তা করব সাধ মিটিয়ে।
আমি শুনছিলাম। বললাম, তোমাকে এখনও বুঝতে পারছি না। ঠিক করে বলল। ব্যাপারটা ত ছেলেখেলার নয়।
রমা বলল, আমি জানি যে, নয়, ছেলেখেলা করতে আমি এখানে আসিনি। আমি দুটো সিদ্ধান্তই খোলা রেখেছি এখনও। চয়েসটা তোমার। সীতেশকে আমার কাল কথা দিতে হবে। কথা পেয়েই ও ওর স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা আনবে। এরপর আর আমার ফেরার পথ থাকবে না। আমাকে দোষ দিও না।
আমি বলালম, সীতেশের স্ত্রীর কি হবে?
রমা বিরক্ত গলায় বলল, সে ভাবনা তোমার নয়। সে ছুটিরই মত। টাকা পেলেই খুশি। তাছাড়া চেহারা দেখে যেমন গোবেচারা মনে হয় ওকে, ও তেমন নয়। ও একটি ভিজে বেড়াল। ওর এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের আগে থাকতেই এ্যাফেয়ার ছিল। ছেলেটি ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স-এর পাইলট। ওরা দুজনে ডাইভোর্স পেলেই বিয়ে করবে। সীতেশের অনেক দুঃখ। বেচারীকে দেখবার, ওর জন্যে ফীল করবার কেউ নেই। এর জন্যে সত্যিই আমার খারাপ লাগে।
আমি বললাম, তাহলে তুমি যা ঠিক করেছ, তাইই করো। তাছাড়া কালকের মধ্যে আমার কিছু বলা সম্ভব নয় তোমাকে।
কেন সম্ভব নয়? ছুটির সঙ্গে পরামর্শ করবে? পরামর্শ করার কি আছে? সে ত এখন জমিয়ে হানিমুন করছে, তোমার প্রেমিকা ছুটি। ফুঃ প্রেমিকা।
আমি বললাম, বারে বারে একটা মিথ্যা কথাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেই সেটা সত্যি হয়ে যায় না। যতবারই তুমি ওকে ছোট করার চেষ্টা করছ, ততবার তুমি নিজেকেই ছোট করছ। এতে তোমার কি লাভ? যার সম্বন্ধে মনে মনে একটা ধারণা গড়ে উঠেছে সে ধারণা নিজে থেকে না ভাঙলে অন্য কেউ এমন করে ভাঙতে পারে না। কেন তুমি নিজেকে এত ছোট করছ? তোমাকে ত বলেইছি, নিজে চোখে দেখলেও আমি বিশ্বাস করি না যে ছুটি আমাকে কিছুমাত্র না জানিয়ে বিয়ে করতে পারে। আমি মরে গেলেও একথা বিশ্বাস করব না।
তাহলে তোমার উত্তর কি? রমা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে শুধোল।
আমার কোনো উত্তর নেই। তুমি আমাকে নিয়ে সুখী হওনি। দোষটা আমার। আমার মত করে আমি চেষ্টা করেছিলাম, সুখী করতে পারিনি তোমাকে। সেটা আমার দূর্ভাগ্য। কিন্তু আমি আমার মতই থাকতে চাই। আমি সীতেশের মত কি আর কারো মতই হতে চাই না। তুমি যাকে সুখ বলে জেনেছো, পুরুষমানুষের সংজ্ঞাকে যদি তুমি সীতেশের মধ্যে খুঁজে পেয়েছ বলে মনে করো তবে তুমি সুখী হও। আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
ওরকম করে বললে হবে না। ন্যাকা-ন্যাকা কাব্য-করা কথা আমি শুনতে চাই না। পরিষ্কার করে বলো।
পরিষ্কার করেই বলছি। তুমি ডাইভোর্স, চাও বা নাই চাও, আমি কোনোরকম বাধা দেব না। একদিন তোমাকে ভালোবেসেছিলাম, সারা জীবন তোমাকে আশ্রয় করেই বাঁচতে চেয়েছিলাম, তা যখন হলো না, তখন তোমার প্রতি আমার যা-কিছু করণীয় থাকে তা শুধু কর্তব্য। সে সবই আমি করব! যতদিন বিয়ে না কর। যদি চাও, বিয়ের পরও তোমার দেখাশোনা করব।
ইসস্। কত্ব সাহস। ফোঁস করে উঠল রমা। বলল, সীতেশ কি তোমার কাছে চাঁদা নিয়ে আমাকে রাখবে? মুখ সামলে কথা বল। তাকে, তার মত সরল, উঁচু মনের মানুষকে অপমান করার কোনো অধিকার তোমার নেই। নিজের স্ত্রীকে দেখতে পারে না তেমন পুরুষমানুষ সীতেশ নয়।
অপমান করিনি। আমি আমার কথা বললাম। আমি কি করতে রাজী আছি তাইই বললাম।
রমা বলল, আর রুণ? রুণের কি হবে? সে কি ছুটি দিদিমণির কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ভর্তি হবে?
কেন? রুণকে তুমি নেবে না?
রমা বলল, না। নেব না। যার রক্তে তোমার রক্ত তাকে আমার দরকার নেই। তোমার কোনোরকম স্মৃতি আমি রাখতে চাই না। ছেলে তোমারই রাখতে হবে।
তাকে কোথায় রাখবে? আমাকে শুধোলো রমা।
বললাম, সে যখন আমার দায়িত্ব, আমিই বুঝব। তুমি বৃথা এ নিয়ে উত্তেজিত হয়ে না।
রমা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। বলল, তাহলে সব চুকেবুকে গেল? ঠিক ত?
আমি চুপ করে রইলাম।
রমা দাঁড়িয়েই রইল। তারপর বলল, তোমার এখানে আজ দুপুরে লাঞ্চ করে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আর তা হয় না। আমি তাহলে যাই।
রমার মুখে হাসির আভাস দেখা গেল। ঠাট্টার হাসি। ঠাট্টা, না ঠাট্টার সঙ্গে অন্য কিছুও ছিল বুঝলাম না।
আমি বললাম, তা কেন? স্বামী-স্ত্রী নাই-ই বা রইলাম, পরিচিত বন্ধুর মত সম্পর্কটা রাখতে ত বাধা নেই কোনো। অপরিচিত লোকও ত অন্যের বাড়ি থাকে, খায়; ব্যাপারটাকে না হয় সেরকমভাবেই দেখলে। সম্পর্ক শেষ হলেও ত সুন্দরভাবে শেষ হতে পারে?
তারপর আমরা দুজনেই অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম। কারো মুখেই কোনো কথা ছিলো না। শুধু মনের মধ্যে উথাল-পাথাল করছিল স্মৃতির হাওয়া।
ডাইভোর্স কথাটা দুজনেই বহুদিন শুনেছি, দুজনেই নানাভাবে ভেবেছি কিন্তু বিয়ের এতদিন পরে যখন অন্য একজনকে জীবনের একটা অবিসংবাদী অংশ বলে মেনে নিয়েছি, তাকে কোন এক মুহূর্তে হঠাৎ অস্বীকার করতে কেমন লাগে তা আমাদের কারোরই জানা ছিল না।
ব্যাপারটার গভীর অভাবনীয়তায়, ব্যাপারটার এক অবিশ্বাস্য দুঃখময়তায় রমা এবং আমি, আমরা দুজনেই বোবা হয়ে গেছিলাম।
রমা বসে পেয়ারাতলা ছাড়িয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। রমা বলল, ভাবতেই কেমন লাগছে।
অথচ তোমাকে ছেড়ে যাবার কথা আমি সব সময়ই ভাবছি গত কয়েক বছর ধরে। ভেবেছিলাম, ছেড়ে গেলে আমার সব কিছু ফিরে পাব।
এই মুহূর্তে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। কিন্তু তেমন একটা আনন্দ কিছু লাগছে না ত! তোমার কি লাগছে?
আমি হাসলাম, বললাম, লোকে বড় লটারী জিতলে প্রথমটা কিছু বুঝতে পারে না। আনন্দেরও একটা শক্ আছে। পরে বোধহয় বুঝতে পারবে তুমি।
কি জানি, জানি না। রমা বলল। তারপর বলল, কদিন থেকেই অনেক পুরনো কথা মনে পড়ছে। তোমার সঙ্গে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিল সেদিনের কথা। জাহাজের দিনগুলোর কথা। তুমি বলেছিলে, প্লেনে না ফিরে জাহাজে ফিরতে–জাহাজেই মজা হবে। বেশ লাগে ভাবলে, না? বলে রমা হাসল।
পরক্ষণেই বলল, ভাবতে পারছি না, তোমার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক থাকবে না। মানে, ভাবাটা কঠিন।
আমি বললাম, সম্পর্কটা ত আজকে শেষ হয়নি রমা। হয়েছে বহু বছর আগেই। তার পরের এই কটা বছর শুধুই সংস্কারের বছর, অভ্যাসের বছর। তবুও আমি কিন্তু কোনোদিনই ভাবতে পারিনি যে, আমাদের সম্পর্কটা সত্যিই এমন পর্যায়ে কখনও আসবে যে, ছাড়াছাড়ি হবে আমাদের।
তারপর বললাম, কিন্তু তুমি বড় কষ্ট পেতে। তোমার জন্যে সত্যিই আমি কিছু করিনি, তুমি যা চেয়েছ, যেমন করে চেয়েছ। কেন পারিনি সে কথা অবান্তর। তুমি বলেছ এই না করতে পারাটা স্বার্থপরতা। জানি না; হয়তো তাই। সে যাই হোক, এটা ঠিক যে, তুমি যে ভাবে বাঁচছিলে তাকে বাঁচা বলে না।
রমা বলল, আর তুমি?
বললাম, আমার কথা থাক। তারপর বললাম, জানো রমা, বিয়ের এই সম্পর্কটা ত কোনো তেজারতি কারবারের মুচলেকা নয় যে যা কবুল করেছি, তা না দিতে পারলেই জেল হবে। আইন-আদালতে যাবার অনেক আগেই এ-সম্পর্কের ফয়সালা হয়ে যায়। দুজনের মনে সে মুহূর্তে সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, সেই মুহূর্তেই সেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। তারপর যা বাকি ছিল, তা শুধু নিজেদের নিজেরা ঠকানো। অভিনয়, সংস্কার, লোভয়, এসব ভেঙে বেরিয়ে আসার সাহসের অভাব। তুমি যা করেছ, ঠিকই করেছ।
তোমার নিশ্চয়ই অধিকার আছে তোমার নিজের ইচ্ছেমত জীবনে বাঁচবার।
একটু হেসে বললাম, আমার কিন্তু খুব হালকা লাগছে নিজেকে, তোমাকে যে সুখী করতে পারিনি আমার সর্বস্ব দিয়েও; এ কথাটাই সবসময় আমাকে বড় পীড়ন করত। এই পীড়নটাকে ছাপিয়ে নিজের সুখের দিকে কখনও তাকাবার অবকাশ হয়নি। তুমি কেন আমার জন্যে তোমার জীবন নষ্ট করবে? তা কখনই করা উচিত নয়। অন্য কারো জন্যে তুমি নিজেকে কেন ফাঁকি দেবে?
রমা বলল, আর তুমি?
আমি হাসলাম। বললাম, আমার ব্যক্তিগত জীবনটা এত ছোট যে, সেটা একটা বড় সমস্যা নয়। তুমি জানো যে, সেখানে পরিসর এত কম যে সেটা ভরিয়ে তোলা কিছু কঠিন নয়। তাছাড়া শেষ যখন…
থাক, বলে রমা আমার দিকে ভর্তসনার চোখে তাকাল।
রমাকে ভারী ভালো দেখাচ্ছিল।
আমার হঠাৎ মনে হল, অনেক অনেকদিন আমি রমার মুখের দিকে ভালো করে তাকাইনি। রমার মুখ ভারী সুশ্রী এবং অভিজাত। বিশেষ করে ও যখন হাসে, তখন ওকে ভারী পবিত্র ও মিষ্টি দেখায়। আমার রমা যদি কখনও জানত যে মেয়েদের সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য তাদের শান্ত নম্র ব্যবহার! যদি কখনও তা জানত, তবে আজ ওকে এমন করে আমার হারাতে হত না।
রমা আবার বলল, তুমি নিশ্চয়ই ছুটিকে বিয়ে করতে। কিন্তু বেচারী তুমি। কোনো মেয়েই কি তোমার সঙ্গে ঘর করতে পারবে? মনে হয় না। তোমার আরও একটু সাধারণ হওয়া উচিত ছিল। তোমার মত পুরুষদের বিয়ে করা উচিত নয়–কারণ তোমরা সাধারণের ব্যতিক্রম। বিয়েটা একটা সস্তা দৈনন্দিন, একঘেয়ে হিহি-হা-হা জীবন। সেখানে তোমার মত সবসময় চশমা-নাকে সিরীয়াস গম্ভীর গুণী লোককে মানায় না। মেয়েরা এমন লোককে দূর থেকে পুজো করে, কিন্তু তাদের পক্ষে এরকম লোকের সঙ্গে ঘর করা সম্ভব নয়।
একটু থেমে রমা বলল, বিশ্বাস করো, তোমাকে কিন্তু মিথ্যা বলিনি। তুমি দেখো। ছুটি সত্যিই বিয়ে করেছে। তোমাকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ বলো?
আমি রমার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলাম।
আমার মাথার মধ্যে অনেক ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। কিছুক্ষণ পর রমা উঠে, চানটান করে নিতে গেল।
ওর চান হয়ে যাবার পর আমিও চান করে নিলাম।
খেতে বসে রমা আমার প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলল, শোনো, মাঝে মাঝে এসে তোমাকে আমি রান্না করে খাইয়ে যাব। তোমার নতুন স্ত্রী ত জানে না, তুমি কি কি খেতে ভালোবাস।
চোখ তুলে দেখলাম, রমার দু চোখ জলে ভরে গেছে। আমি বললাম, একি হচ্ছে? একি?
তারপর বললাম জানো, এরকম হয়; এত বছর একসঙ্গে ছিলে। গুণ্ডা বদমাসের সঙ্গে থাকলেও মন খারাপ হয়–আমি ত গুণ্ডা বদমাসের চেয়ে একটু ভালো, বল? বাড়ির কুকুর-বেড়ালকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়, আর আমি ত একটা মানুষ।
কিন্তু এই চোখের জলটা কিছু নয়। বিয়ের পরদিন যেদিন তোমাকে তোমাদের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম, সেদিন বাড়িসুদ্ধ সকলের কান্না এবং তোমার কান্না দেখে নিজেকে অভিশাপ দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, আমিই যত অনিষ্টর কারণ। গাড়িতে তুমি কি কান্নাই না কাঁদলে, মনে আছে। অথচ বৌভাতের পরদিনই যখন আবার গেলে আমার সঙ্গে তোমাদের বাড়ি, তখন কি হাসি কি হাসি। তখন কে বলবে যে এ বাড়িতে তিন-চারদিন আগে অমন কান্নাকাটি হয়েছিল। তা-ই বলছি, এ চোখের জল নিয়ে ভেবো না। তুমি এবার আমার খারাপ-সঙ্গ, খারাপ বাড়ি, সব ছেড়ে ভালো সঙ্গ, চমৎকার স্বামী, আনন্দ মজা কত কিছুর মধ্যে গিয়ে পড়বে। গিয়ে পড়লেই, পুরনো সব কথা ভুলে যাবে। তখন দেখবে, ফেলে আসা এতগুলো বছর কোথায় চলে গেছে। মনে করতে চাইলেও হয়ত তোমার মনেই পড়বে না। দেখবে আমি এবং আমার সবকিছু তোমার স্মৃতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
খাবার ঘরের পাশের পেঁপে গাছের উপর কতগুলো শালিক এসে বসেছিল।
দুপুরের শান্ত রোদ আলতো ভাবে বাবুর্চিখানার পাটকিলে-রঙা দেওয়াল, কারিপাতা গাছগুলোয়, শালিকের গ্রীবায় এসে পড়েছিল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে রমার দিকে চোখ পড়তে হঠাৎ এতদিন এতবছর পরে আমার মন বলল, রমাকে আমি দারুণ ভালোবাসি। মন বলল, দুটো আশ্চর্য জীবন তোমরা নষ্ট করলে। একটু চেষ্টা করলেই, সময়মত এই দুর্ঘটনা এড়াবার চেষ্টা করলেই, এটা ঘটতো না।
রমা মুখ নীচু করে বসে প্লেটের উপর কাঁটা চামচ দিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। হঠাৎ ও বলে উঠল, তোমার সঙ্গে হয়ত হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে কোনো ছুটির দিনে, পার্ক স্ট্রীটের লাল বাতির সামনে। আমি সীতেশের পাশে বসে থাকব, তুমি তোমার নতুন স্ত্রীর পাশে বসে থাকবে স্টিয়ারিং-এ।
তুমি ঘাড় হেলিয়ে বলবে, ভালো?
আমি হেসে বলব, ভালো। ভাবা যায় না, না? সত্যিই ভাবা যায় না? তোমার কাছে আমি এবং আমার কাছে তুমি এত চেনা, এত কাছের, আমাদের মধ্যে গোপনীয় বলতে কিছুই নেই; অথচ সেদিন তুমি আমাকে বাইরের লোক ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতে পারবে ।
আমি চুপ করে ছিলাম। হেসে বললাম, মনে হচ্ছে, তুমি বাইরে যতখানি শক্ত, ভিতরে ততখানি নও। এখন তোমাকে দেখে কিন্তু মনে হচ্ছে যে তোমার সিদ্ধান্তে পৌঁছে তুমি খুব ঘাবড়ে গেছ।
রমা চোখ তুলে চাইল। ওর মুখ লজ্জায় লাল হয়ে গেল। ও বলল, মোটেই তা নয়। তবে কি জানো, আমার বাইরেটা চিরদিনই শক্ত, ভিতরটা কোনদিনই নয়। আমার দুঃখ এইটুকুই যে তুমি চিরদিন আমার বাইরেটা দেখেই আমাকে বিচার করলে, আমার ভিতরটা কখনও দেখতে চাইলে না। যদি আমি উদ্ধত হয়ে থাকি, আদুরে, একগুয়ে, অবাধ্য হয়ে থাকি, তা তোমার জন্যে গর্বিত ছিলাম বলেই হয়েছিলাম। তোমার জন্যে গর্বিত হওয়াটা যে তোমাকে অপমানিত করবে কখনও তা বুঝতে পারিনি; তোমার উপর সমস্ত অভিমান যে তোমার কাছে নোংরা রাগ-বলে মনে হবে, এও বুঝতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কি, মানুষ হিসাবে বিয়ের আগে তুমি যেমন ছিলে, যেমন রসিক, যেমন হাসি-খুসী, যেমন সূক্ষ্ম, এখন আর তেমন নেই। তুমি যেন এখন কেমন হয়ে গেছ। তোমাকে দেখলে সত্যিই আমার কষ্ট হয়।
আমি বললাম, চল, বাইরে রোদে গিয়ে বসি। তোমার ট্যাকসি আসার সময় হয়ে গেল।
বাইরে যেতে যেতে বললাম, ভাবছি, তোমাকে রাঁচী অবধি পৌঁছে দিয়ে আসি। জঙ্গলের পথ আছে অনেকটা, তারপর রাত হয়ে যাবে পৌঁছতে পৌঁছতে, তুমি একেবারে একা যাবে। তাছাড়া এরপর তোমার সঙ্গে কোথাও যেতে ত সীতেশের পারমিশান লাগবে।
রমা আমার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ। তারপর বলল, আমারও খুব ইচ্ছা করছিল তোমাকে বলতে, কিন্তু সঙ্কোচ হচ্ছিল। এখন তুমি আমার কেউ নও। তোমার উপর আমার জোর কোথায়? অবশ্য যখন কেউ ছিলে, তখনও জোর ছিল না।
আমি বললাম, না। আমি যাব।
সকালবেলার রমা আর এখনকার রমা যেন একেবারে অন্য লোক। কেমন মিষ্টি করে হাসছে রমা–কেমন লাজুক চোখে তাকাচ্ছে, যেন এই মাত্র ওর সঙ্গে আমার আলাপ হল।
রমা হঠাৎ বলল, তুমি ছুটিকে খুব ভালোবাস, না?
বললাম, মিথ্যা বলব না; বাসি।
আমার চেয়েও অনেক বেশি ভালোবাস, না? মানে যখন আমাকে ভালোবাসতে।
বললাম, কোনো সম্পর্কের সঙ্গে অন্য সম্পর্কের তুলনা কোরো না। তুলনা হয় না ওরকম। প্রতিটি সম্পর্কই আলাদা।
রমা বলল, আজ তোমাকে বলা দরকার। কোনোদিন পরিষ্কারভাবে বলিনি, বলতে সঙ্কোচ হয়েছিল। আপমানের ভয় ছিল। কিন্তু আজ ত আর সে-সব ভয় নেই। আজকে তোমার এবং আমার সম্পর্কের এই পরিণতির কারণ কিন্তু ছুটি। ছুটির জন্যেই এটা ঘটল।
আমি বললাম, সীতেশ নয় কেন?
রমা বলল, বিশ্বাস করো, সীতেশ ছেলেটা খারাপ নয়। ওর মনটা বড় নরম। নার্সিং হোমে তুমি আমার হাতে হাত দিয়ে বসে থাকতে দেখেই খারাপ ভেবেছিলে, কিন্তু ও বন্ধুত্বের অমর্যাদা কখনও করেনি তোমার। তখন আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছিল, তুমি আসার আগে সেদিন ও আমার মাথাও টিপে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে কোনো রোম্যান্স ছিল না। ওর সঙ্গে সম্পর্কটা আমার কোনোদিনও অমন ছিলো না। ছুটির হ্যাংলামি ও তোমার ওর সঙ্গে এমনভাবে মেলামেশা আমাকে বড় কষ্ট দিয়েছিল। সীতেশের সঙ্গে সম্পর্কটা অন্য রকম করার মূলে আমি। ওতে ওর কোনো দোষ নেই। আমি চাই, তুমি সীতেশকে ভুল বুঝবে না! ছুটি তোমার জীবনে না এলে আজকে আমার এবং তোমার এই অবস্থা হতো না। এমন করে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যেত না। তবুও বুঝতাম ও যদি তোমাকে খুশি করত। চেষ্টা করত খুশি করার।
আমি চুপ করে থাকলাম।
রমা আবার বলল, তুমি দেখো, আমার অভিশাপ কি করে লাগে ওর জীবনে। ও কোনোদিন সুখী হবে না। ও সারাজীবন জ্বলে-পুড়ে মরবে। একের পর এক ভুল করবে ও। ওর মনে কখনও শান্তি থাকবে না। ও লোককে দেখাবে, জানাবে যে ও সুখী। বাইরে ও সুখের ডংকা বাজাবে কিন্তু সারাজীবন ওর হাহাকারে কাটবে। মনের মধ্যে ও কখনও শান্তি পাবে না। অন্যকে এমন করে ঠকিয়ে কেউ কোনোদিনও শান্তি পায়নি। সব পাপের প্রায়শ্চিত্ত ওকে করে যেতেই হবে। এ জন্মেই ও তোমাকে যেমনি করে ঠকিয়েছে, ওকেও সবাই তেমনি করে ঠকাবে।
আমি বললাম, রমা, থাক না এসব কথা।
রমা হঠাৎ চুপ করে গিয়ে বলল, তুমি বিয়ে করবে ত? বিয়ে না করলে কিন্তু তোমাকে ছেড়ে গিয়েও নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগবে আমার। কথা দাও। এবারে খুব দেখেশুনে বিয়ে কোরো।
কেন? আমি বললাম।
কেন না, তুমি মেয়েদের উপর ঠিক কতখানি নির্ভরশীল তা আর কেউ না জানুক, আমি জানি। কারো নরম ভালোবাসার মন, কারো ইচ্ছুক শরীর তোমার হাতের কাছে না থাকলে তুমি কতখানি কষ্ট পাবে তা আমি অন্তত বুঝতে পারি।
আমি বললাম করব। ছুটি যদি রাজী থাকে, ছুটিকে বিয়ে করব। অন্য কাউকে নয়। আর নতুন করে বাঁধনে জড়াতে ইচ্ছা নেই আমার। বাঁধনের যন্ত্রণার চেয়ে মুক্তির যন্ত্রণা অনেক ভাল।
রমা অবাক গলায় বলল, ছুটিকে বিয়ে করবে? তোমার এখনও বিশ্বাস হল না যে, ছুটি বিয়ে করেছে?
আমি বললাম, না। তুমি নিশ্চয়ই ভুল বুঝেছ, ভুল দেখেছ।
রমা আশ্চর্য চোখে আমার দিকে চাইল। বলল, এই মেয়েটাই তোমার জীবনের শনি। তুমি দেখে নিও। ওকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না।
তারপর বলল, একটা কথা বলব? এ পর্যন্ত কত টাকা তুমি দিয়েছ ওকে? রাঁচীতে কি তুমি ওকে বাড়ি কিনে দিয়েছ? ব্যাঙ্কে ওর নামে নাকি অনেক টাকা রেখে দিয়েছ? অন্য কোনো ভালো মেয়ের জন্যে করতে যদি, আমার আপত্তি ছিল না। ও ত যারা শরীর বিক্রী করে, তাদের চেয়েও নীচ। সে সব মেয়ে বদলে তবু কিছু দেয়। তারা তবু একটা দেওয়া-নেওয়ায় বিশ্বাস করে। সে বিষয়ে তারা সৎ অন্তত। কিন্তু এরা ত ঠগী, এরা ত নীচ; জোচ্চোর। তুমি কি করে যে এর হাতে পড়লে, আমি ভেবেই পাই না।
আমি এবার রীতিমত বিরক্ত হলাম। বললাম, রমা, তুমি এবার থামো। তোমার যাবার সময় হয়ে এল। অন্য কথা বলল। আমি ত সীতেশ সম্বন্ধে কোনো কথা বলিনি, বলবও না, অথচ সীতেশকে তুমি কতটুকু জানো তা আমি জানি না। আমি শুধু চাই যে, তুমি যেভাবে হতে চাও সেভাবেই সুখী হও। তুমি নিজে সুখী হলেই ত হল। ছুটির সুখ নিয়ে তোমার মাথাব্যথা কেন?
একটু পরে ট্যাকসিটা এসে গেল।
মালপত্র তুলে রমাকে নিয়ে আমি উঠে পড়লাম।
পথের দুপাশে শেষ বিকেলের রোদ ছড়িয়েছে। এখানে ওখানে ঘুঘুরা পথের উপর কি যেন খুঁটে খাচ্ছে। বাসারীয়ার কাছে এক ঝাঁক তিতিরের সঙ্গে দেখা হল। গাড়ি দেখে তরতরিয়ে রাস্তা ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে গেল।
রমা জিগ্যেস করল, আমি কি কালই বাড়ী ছেড়ে চলে যাব?
তোমার যেদিন খুশি। আমি বললাম।
আমার শাড়ি গয়না (যা আমার) সব থাকবে। তুমি কোলকাতা ফিরলে একদিন এসে তোমার সামনে নিয়ে যাব। হিসেব করে।
আমি হাসলাম, বললাম, তুমি ত এখনও পর হওনি। আইনত। তোমাকে আমি একদিন যা কিছু দিয়েছি, সবই ত তোমার। তাছাড়া আরো তুমি যা নিতে চাও সবই তোমারই জন্যে, শুধু লাইব্রেরীর চাবিটা রেখে যেও। আর সব ঘরের মালিক তুমি। তোমার প্ল্যানে করা বাড়ি, তোমার সাজানো ফার্ণিচার, তোমার টাঙ্গানো ছবি, এ সবে কি অন্য কারো অধিকার জন্মাতে পারে? এ সবই বরাবরের তোমার। যদি অন্য কেউ আমার জীবনে আসেই, যদি আসে, সে নিজের পছন্দমত নিজের বাড়ি সাজাবে। তোমার বাড়িতে তার ত কোনো অধিকার নেই।
রমা আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, আমি নেব কেন?
বললাম, একদিন আমাকে ভালোবেসেছিলে, আমার ভালোবাসা পেয়েছিলে, সে জন্যে নেবে। যা পেয়েছিলে এবং দিয়েছিলে তা কি কিছুই নয়? তা কি একেবারেই ধুলোয় ফেলার?
রমা কথা না বলে আমার হাতটা ওর কোলে নিল।
রমা এবং আমি দুজনেই বুঝতে পারছিলাম না আমাদের দুজনের জীবনের এই দারুণ পরিবর্তনটা আমরা কি করে মেনে নেব। অথচ এখন মেনে না-নেওয়া ছাড়াও অন্য কোনো উপায় নেই।
ট্রেনের সময়ের একটু আগেই আমরা স্টেশনে পৌঁছলাম।
রমা এয়ারকন্ডিশান কোচের টিকিট কেটেছিল। একটা কূপেও পেয়েছিল। ওকে তুলে দিয়ে, ওর রাতের খাবারের অর্ডার দিয়ে দিলাম।
যখন ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে এল, রমা হঠাৎ উঠে দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল। বন্ধ করে দিয়ে, আমার বুকে মুখ গুঁজে দাঁড়াল। দরজাটা আমিই বন্ধ করতাম, কিন্তু যদি ও কিছু মনে করে, এই ভেবে করিনি।
রমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে, গলায়, ওর ঠোঁটে চুমু খেলাম আমি।
রমার চোখের জলে আমার কোটের একটা জায়গা ভিজে গেল।
রমা অস্ফুটে বলল, তুমি ভীষণ খারাপ, তুমি ভীষণ খারাপ।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম, তুমি এখন নতুন জীবনে প্রবেশ করছ, আমার পুরোনো বৌ। অমন কোরো না। নিজের মন থেকে যা করেছ, সেটাকে ঠিক বলে জেনো। তোমার নিজেকে বাঁচতে হবে। তুমি তোমার মত করে বাঁচবে। এতে ত কোনো লজ্জা নেই। তোমার সমস্ত অধিকার আছে তোমার নিজের ইচ্ছামত বাঁচার।
তারপর বললাম, সারা রাস্তা আমার সমস্ত খারাপ ব্যবহার, আমার অবহেলা, আমার অত্যাচারের কথা ভাবতে ভাবতে যেও। তাহলে দেখবে ভালো লাগছে। তুমি যে আমার হাত থেকে মুক্তি পেয়েছ এ জীবনের মত, একথা জেনেই ভালো লাগবে। তুমি দেখো, ভালো লাগে কিনা।
রমা আবার বলল, তুমি খারাপ। ভীষণ, ভীষণ; বোকা তুমি।