২৩. হঠাৎ করে কুয়াশা পড়েছে

হঠাৎ করে কুয়াশা পড়েছে। এমন কুয়াশা যে এক হাত দূরের মানুষ দেখা যায় না। নাদিয়া কুয়াশা গায়ে মাখার জন্যে দোতলা থেকে নামল। কুয়াশা হচ্ছে মেঘের এক রূপ। কুয়াশা গায়ে মাখা এবং মেঘ গায়ে মাখা একইরকম।

সিঁড়ির গোড়ায় প্রণব দাঁড়িয়ে ছিলেন। নাদিয়াকে দেখে বললেন, একজন দ্রলোক তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।

নাদিয়া বলল, কে? তাকে অতিথঘরে বসিয়েছি। নিজে গিয়ে দেখো কে?

পরিচিত কেউ?

প্রণব হাসতে হাসতে বললেন, পরিচিত কেউ না। আমরা তাকে চিনি না।

হাসান রাজা চৌধুরী?

হুঁ।

আশ্চর্য! কুয়াশার অতিথি!

 

হাসান রাজা নাদিয়াকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে দাঁড়াল। নাদিয়া বলল, কেমন আছেন?

ভালো আছি। আপনার জন্যে একটা টেলিস্কোপ এনেছি। তারা দেখতে পারবেন।

ও আচ্ছা।

হাসান কাঠের বাক্স এগিয়ে দিল। নাদিয়া টেলিস্কোপ বের করেছে। আগ্রহ নিয়ে দেখছে। নাদিয়া বলল, এমন দিনে টেলিস্কোপ এনেছেন যে আকাশ থাকবে কুয়াশায় ঢাকা।

কুয়াশা কেটে যাবে।

কীভাবে জানেন কুয়াশা কেটে যাবে?

ঘন কুয়াশা বেশিক্ষণ থাকে না। হালকা বাতাসেই সরে যায়। পাতলা কুয়াশা সরে না।

জানতাম না। নতুন জিনিস শিখলাম।

হাসান বলল, আমি এখন উঠব।

টেলিস্কোপ দেওয়ার জন্যে এসেছিলেন?

হ্যাঁ।

নাদিয়া অবাক হয়ে বলল, টেলিস্কোপ দেওয়ার জন্যে তো আপনার আসার প্রয়োজন ছিল না। ২৫ তারিখের পর আমি যাচ্ছি আপনার কইতরবাড়িতে। আচ্ছা কবুতরগুলি কি এখনো আছে?

আছে।

আমি যে ঘরে থাকব সেখান থেকে হাওর দেখা যাবে?

হাসান রাজা ক্ষীণস্বরে বলল, যাবে।

আপনাদের কি কোনো বজরা আছে?

না। বড় নৌকা আছে।

আমি বিশাল একটা বজরা বানাব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেরকম বজরায় করে পদ্মায় ঘুরতেন সেরকম বজরা। আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের বজরার ছবি আছে। ছবি দেখে কারিগররা বজরা বানাতে পারবে না?

পারবে।

বজরায় লাইব্রেরি থাকবে। গান শোনার ব্যবস্থা থাকবে। রাতে ঘুমাবার আয়োজনও থাকবে।

হাসান চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। নাদিয়া বলল, চলুন পুকুরঘাটে যাই। কুয়াশার ভেতর চা খাই। যাবেন?

হুঁ।

আপনি ঘাটে গিয়ে বসুন। আমি চায়ের কথা বলে আসি। রবীন্দ্রনাথের বজরার ছবিটাও নিয়ে আসি। আপনাকে দিয়ে দেব। আপনি এখনই বানাতে দিবেন।

আচ্ছা।

দিঘির ঘাটে আমরা দুজন একসঙ্গে চায়ের কাপে চুমুক দেব। এবং তখন থেকে আমি আপনাকে তুমি করে বলব। আপনিও আমাকে তুমি করে বলবেন। আমার মা বাবাকে আপনি করে বলেন, আমার বিশ্রী লাগে।

নাদিয়া উঠে দাঁড়াল। হাসান রাজা বলল, শেষবারের মতো আপনাকে আপনি করে একটা কথা বলি।

নাদিয়া বলল, বলুন।

আমার জীবনের পরম সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমি আপনার কথা মনে করব।

নাদিয়া বলল, চায়ের জন্যে অপেক্ষা করব না। আমি এখন থেকেই তুমি বলব। এই তুমি এমন নাটকীয় ডায়ালগ কেন দিচ্ছ? মনে হচ্ছে স্টেজে অভিনয় করছ। যাও ঘাটে গিয়ে বসো। আমি আসছি।

নাদিয়া চা নিয়ে ঘাটে এসে কাউকে দেখতে গেল না। অতিথঘরে কেউ নেই, বাগানে কেউ নেই।

 

ডিসট্রিক্ট জজ আবুল কাশেম সপ্তাহে চার দিন হাঁটেন। বাড়ির বাইরে যান না। কম্পাউন্ডের ভেতরই হাঁটেন। অনেক বড় কম্পাউন্ড। পুরো কম্পাউন্ড চক্কর দিতে পনেরো মিনিট লাগে।

আজ তাঁর হাঁটার দিন। বাড়ি থেকে বের হয়েই দেখলেন, অত্যন্ত সুদর্শন এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। দারোয়ান আটকে দিয়েছে, ঢুকতে দিচ্ছে না। তিনি যুবককে অগ্রাহ্য করলেন। পুরো কম্পাউন্ড চক্কর দিলেন। যুবক চলে গেল না। তিন দফা চক্করের পরে তাঁর হাঁটার সমাপ্তি হলো। তিন চক্করের পরেও যুবককে পঁড়িয়ে থাকতে দেখে তিনি এগিয়ে গেলেন।

যুবক বলল, স্যার আমি আপনার কাছে কিছু চাইতে আসি নাই। তিন মিনিট কথা বলতে এসেছি।

কী বিষয়ে কথা বলবে?

একটা মামলা বিষয়ে।

মামলা বিষয়ে আমি কারও সঙ্গে কথা বলি না।

স্যার, আপনি একজন ভুল মানুষকে ফাঁসি দিয়েছেন। তার নাম ফরিদ। সে খুন করে নাই। আমি খুন করেছি। আমার নাম হাসান রাজা চৌধুরী। আমার বাবার নাম রহমত রাজা চৌধুরী। আমাকে বাঁচানোর জন্যে একজন নির্দোষ মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে।

আবুল কাশেম বললেন, এসো ভেতরে। আমি প্রশ্ন করব উত্তর দিবে। নিজ থেকে কিছু বলবে না।

জি আচ্ছা।

 

হাসান রাজা চৌধুরী আবুল কাশেমের মুখোমুখি বসেছে। তার সামনে চায়ের কাপ। হাসান চায়ে চুমুক দিচ্ছে না।

খুন তুমি করেছ?

জি।

ঠান্ডা মাথায়?

জি। কারণ কী?

যাকে খুন করেছি ছোটবেলায় আমি তাঁর বাড়িতে থেকে মোহনগঞ্জ স্কুলে পড়তাম। উনি আমার মামা। আপন মামা না। দূরসম্পর্কের মামা। উনি আমাকে ব্যবহার করতেন।

শারীরিক ব্যবহার?

জি।

আমি কষ্টকে বলতে পারতাম না। নিজের মনে কাঁদতাম। এতবড় লজ্জার কথা কীভাবে বলি! আমার যখন বয়স দশ, তখন ঠিক করি একদিন উনাকে খুন করব।

তোমাকে ব্যবহারের ঘটনা তুমি আর কাউকে বলেছ?

একজনকে শুধু বলেছি। যাকে খুন করেছি তার মেয়েকে মেয়ের নাম রেশমা।

চা খাও।

চা খাব না স্যার।

আবুল কাশেম বললেন, তুমি আর কিছু বলবে?

আমি চাই নির্দোষ মানুষটা ছাড়া পাক। আমার শাস্তি হোক।

ফাঁসিতে ঝুলবে?

জি ঝুলব।

আবুল কাশেম দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লন। হাসন রাজা বলল, স্যার আমি এখন কী করব? থানায় যাব?

হ্যাঁ। তুমি যাও। বাকি ব্যবস্থা আমি করব। আচ্ছা তোমার হাতটা বাড়াও তো তোমার সঙ্গে হাত মিলাই। এই প্রথম আমি জেনে শুনে একজন খুনির সঙ্গে হাত মিলাচ্ছি। তবে তোমার বিচার আমি করব না। অন্য কোনো বিচারক করবেন। আমি রিটায়ারমেন্ট চলে যাচ্ছি।

 

হামান রাজা চৌধুরী হাজতে আছে। তার মামলা নতুন করে শুরু হয়েছে।

 

২৫ ফেব্রুয়ারি মোনায়েম খান বিয়েতে উপস্থিত হওয়ার তারিখ দিয়েছিলেন। ওই তারিখে তিনি কাউকে কিছু না জানিয়ে দেশ ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্থানে পালিয়ে গলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *