ত্রয়োবিংশতিতম অধ্যায়-স্বজনপ্রীতি
গুরু। এক্ষণে হর্বর্ট স্পেন্সরের যে উক্তি তোমাকে শুনাইয়াছি, তাহা স্মরণ কর।
“Unless each duly cares for himself, his care for all others is ended by death; and if each thus dies, there remain no others to be cared for.”
জগদীশ্বরের সৃষ্টিরক্ষা জগদীশ্বরের অভিপ্রেত, ইহা যদি মানিয়া লওয়া যায়, তবে আত্মরক্ষা ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম; কেন না, তদ্ব্যতীত সৃষ্টিরক্ষা হয় না। কিন্তু এ কথা আত্মরক্ষা সম্বন্ধেই যে খাটে, এমন নহে। যাহারা আত্মরক্ষায় অক্ষম, এবং যাহাদের রক্ষার ভার তোমার উপর, তাহাদের রক্ষাও আত্মরক্ষার ন্যায় জগৎরক্ষার পক্ষে তাদৃশ প্রয়োজনীয়।
শিষ্য। আপনি সন্তানাদির কথা বলিতেছেন?
গুরু। প্রথমে অপত্যপ্রীতির কথাই বলিতেছি। বালকেরা আপনাদিগের পালনে ও রক্ষণে সক্ষম নহে। অন্যে যদি তাহাদিগকে রক্ষা ও পালন না করে, তবে তাহারা বাঁচে না। যদি সমস্ত শিশু অপালিত ও অরক্ষিত হইয়া প্রাণ ত্যাগ করে, তবে জগৎও জীবশূন্য হইবে। অতএব আত্মরক্ষাও যেমন গুরুতর ধর্ম্ম, সন্তানাদির পালনও তাদৃশ গুরুতর ধর্ম্ম; আত্মরক্ষার ন্যায়, ইহাও ঈশ্বরোদ্দিষ্ট কর্ম্ম, সুতরাং ইহাকেও নিষ্কাম কর্ম্মে পরিণত করা যাইতে পারে। বরং আত্মরক্ষার অপেক্ষাও সন্তানাদির পালন ও রক্ষণ গুরুতর ধর্ম্ম; কেন না, যদি সমস্ত জগৎ আত্মরক্ষায় বিরত হইয়াও সন্তানাদি রক্ষায় নিযুক্ত ও সফল হইয়া সন্তানাদি রাখিয়া যাইতে পারে, তাহা হইলে সৃষ্টি রক্ষিত হয়, কিন্তু সমস্ত জীব সন্তানাদি রক্ষায় বিরত হইয়া কেবল আত্মরক্ষায় নিযুক্ত হইলে, সন্তানাদির অভাবে জীবসৃষ্টি বিলুপ্ত হইবে। অতএব আত্মরক্ষার অপেক্ষা সন্তানাদির রক্ষা গুরুতর ধর্ম্ম।
ইহা হইতে একটি গুরুতর তত্ত্ব উপলব্ধ হয়। অপত্যাদির রক্ষার্থ আপনার প্রাণ বিসর্জ্জন করা ধর্ম্মসঙ্গত। পূর্ব্বে যে কথা আন্দাজি বলিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহা প্রমাণীকৃত হইল।
ইহা পশু পক্ষীতেও করিয়া থাকে। ধর্ম্মজ্ঞানবশতঃ তাহারা এরূপ করে, এমন বলা যায় না। অপত্যপ্রীতি স্বাভাবিক বৃত্তি, এই জন্য ইহা করিয়া থাকে। অপত্যস্নেহ যদি স্বতন্ত্র স্বাভাবিক বৃত্তি হয়, তবে তাহা সাধারণ প্রতিবৃত্তির বিরোধী হইবার সম্ভাবনা। অনেক সময়ে হইয়াও থাকে। অনেক সময়েই দেখিতে পাই যে, অনেকে অপত্যস্নেহের বশীভূত হইয়া পরের অনিষ্ট করিতে প্রবৃত্ত হয়। যেমন জাগতিক প্রীতির সঙ্গে আত্মপ্রীতির সঙ্গে আত্মপ্রীতির বিরোধ সম্ভাবনা কথা পূর্ব্বে বলিয়াছিলাম, জাগতিক প্রীতির সঙ্গে অপত্যপ্রীতিরও সেইরূপ বিরোধের শঙ্কা করিতে হয়।
কেবল তাহাই নহে। এখানে যে আত্মপ্রীতি আসিয়া যোগ দেয় না, এমন কথা বলা যায় না। ছেলে আমার, সুতরাং পরের কাড়িয়া লইয়া ইহাকে দিতে হইবে। ছেলের উপকারে আমার উপকার, অতএব যে উপায়ে হউক, ছেলের উপকার সিদ্ধ করিতে হইবে। এরূপ বুদ্ধির বশীভূত হইয়া অনেকে কার্য্য করিয়া থাকেন।
অতএব এই অপত্যপ্রীতির সামঞ্জস্যজন্য বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন।
শিষ্য। এই সামঞ্জস্যের উপায় কি?
গুরু। উপায়-হিন্দুধর্ম্মের ও প্রীতিতত্ত্বের সেই মূল সূত্র-সর্ব্বভূতে সমদর্শন। অপত্যপ্রীতি সেই জাগতিক প্রীতিতে নিমজ্জিত করিয়া, অপত্যপালন ও রক্ষণ ঈশ্বরোদ্দিষ্ট; সুতরাং অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম জানিয়া, “জগদীশ্বরের কর্ম্ম নির্ব্বাহ করিতেছি, আমার ইহাতে ইষ্টানিষ্ট কিছু নাই,” ইহা মনে বুঝিয়া, সেই অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম করিবে। তাহা হইলে এই অপত্যপালন ও রক্ষণধর্ম্ম নিষ্কাম ধর্ম্মে পরিণত হইবে। তাহা হইলে তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্মেরও অতিশয় সুনির্ব্বাহ হইবে; অথচ তুমি নিজে এক দিকে শোকমোহাদি, আর এক দিকে পাপ ও দুর্ব্বাসনা হইতে নিষ্কৃতি পাইবে।
শিষ্য। আপনি কি অপত্যস্নেহ-বৃত্তির উচ্ছেদ করিয়া তাহার স্থানে জাগতিক প্রীতির সমাবেশ করিতে বলেন?
গুরু। আমি কোন বৃত্তিরই উচ্ছেদ করিতে বলি না, ইহা পুনঃ পুনঃ বলিয়াছি। তবে, পাশব বৃত্তি সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। পাশব বৃত্তিসকল স্বতঃস্ফূর্ত্ত। যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত, তাহা দমনই অনুশীলন। অপত্যস্নেহ পরম রমণীয় ও পবিত্র বৃত্তি। পাশব বৃত্তিগুলির সঙ্গে ইহার এই ঐক্য আছে যে, ইহা যেমন মনুষ্যের আছে, তেমনি পশুদিগেরও আছে। তাদৃশ সকল বৃত্তিই স্বতঃস্ফূর্ত্ত, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি। অপত্যস্নেহও সেই জন্য স্বতঃস্ফূর্ত্ত। বরং সমস্ত মানসিক বৃত্তির অপেক্ষা ইহার বল দুর্দ্দমনীয় বলা যাইতে পারে। এখন অপত্যপ্রীতি যতই রমণীয় ও পবিত্র হউক না কেন, উহার অনুচিত স্ফূর্ত্তি অসামঞ্জস্যের কারণ, যাহা স্বতঃস্ফূর্ত্ত তাহার সংযম না করিলে অনুচিত স্ফূর্ত্তি ঘটিয়া উঠে। এই জন্য উহার সংযম আবশ্যক। উহার সংযম না করিলে, জাগতিক প্রীতি ও ঈশ্বরে ভক্তি, উহার স্রোতে ভাসিয়া যায়। আমি বলিয়াছি, ঈশ্বরে ভক্তি ও মনুষ্যে প্রীতি, ইহাই ধর্ম্মের সার, অনুশীলনের মুখ্য উদ্দেশ্য, সুখের মূলীভূত এবং মনুষ্যত্বের চরম। অতএব অপত্যপ্রীতির অনুচিত স্ফুরণে এইরূপ ধর্ম্মনাশ, সুখনাশ, এবং মনুষ্যত্বনাশ ঘটিতে পারে। লোকে ইহার অন্যায় বশীভূত হইয়া ঈশ্বর ভুলিয়া যায়; ধর্ম্মাধর্ম্ম ভুলিয়া, অপত্য ভিন্ন আর সকল মনুষ্যকে ভুলিয়া যায়। আপনার অপত্য ভিন্ন আর কাহারও অন্য কিছু করিতে চাহে না। ইহাই অন্যায় স্ফূর্ত্তি। পক্ষান্তরে, অবস্থাবিশেষে ইহার দমন না করিয়া ইহার উদ্দীপনই বিধেয় হয়। অন্যান্য পাশব বৃত্তি হিতে ইহার এক পার্থক্য এই যে, ইহা কামাদি নীচ বৃত্তির ন্যায় সর্ব্বদা এবং সর্ব্বত্র স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে। এমন নরপিশাচ ও পিশাচীও দেখা যায় যে, তাহাদের এই পরম রমণীয়, পবিত্র এবং সুখকর স্বাভাবিক বৃত্তি অন্তর্হিত। অনেক সময়ে সামাজিক পাপবাহুল্যে এই সকল বৃত্তির বিলোপ ঘটে। ধনলোভে পিশাচ পিশাচীরা পুত্র কন্যা বিক্রয় করে; লোকলজ্জাভয়ে কুলকলঙ্কিনীরা তাহদের বিনাশ করে; কুলকলঙ্কভয়ে কুলাভিমানীরা কন্যাসন্তান বিনাশ করে; অনেক কামুকী কামাতুর হইয়া সন্তান পরিত্যাগ হইয়া যায়। অতএব এই বৃত্তির অভাব বা লোপও অতি ভয়ঙ্কর অধর্ম্মের কারণ। যেখানে ইহা উপযুক্তরূপে স্বতঃস্ফূর্ত্ত না হয়, সেখানে অনুশীলন দ্বারা ইহাকে স্ফুরিত করা আবশ্যক। উপযুক্তমত স্ফুরিত ও চরিতার্থ হইলে ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন আর কোন বৃত্তিই ঈদৃশ সুখদ হয় না। সুখকারিতায় অপত্যপ্রীতি ঈশ্বরে ভক্তি ভিন্ন সকল বৃত্তির অপেক্ষায় শ্রেষ্ঠ।
অপত্যপ্রীতি সম্বন্ধে যাহা বলিলাম, দম্পতিপ্রীতি সম্বন্ধেও তাহা বলা যায়। অর্থাৎ (১) স্ত্রীর প্রতিপালন ও রক্ষণের ভার তোমার উপর। স্ত্রী নিজে আত্মরক্ষণে ও প্রতিপালনে অক্ষম। অতএব তাহা তোমার অনুষ্ঠেয় কর্ম্ম। স্ত্রীর পালন ও রক্ষা ব্যতীত প্রজার বিলোপ সম্ভাবনা। এজন্য তৎপালন ও রক্ষণ জন্য স্বামীর প্রাণপাত করাও ধর্ম্মসঙ্গত।
(২) স্বামীর পালন ও রক্ষণ স্ত্রীর সাধ্য নহে, কিন্তু তাঁহার সেবা ও সুখসাধন তাঁহার সাধ্য। তাহাই তাঁহার ধর্ম্ম। অন্য ধর্ম্ম অসম্পূর্ণ, হিন্দুধর্ম্ম সর্ব্বশ্রেষ্ঠ এবং সম্পূর্ণ; হিন্দুধর্ম্মে স্ত্রীকে সহধর্ম্মিণী বলিয়াছে। যদি দম্পতিপ্রীতিকে পাশব বৃত্তিতে পরিণত না করা হয়, তবে ইহাই স্ত্রীর যোগ্য নাম; তিনি স্বামীর ধর্ম্মের সহায়। অতএব স্বামীর সেবা, সুখসাধন ও ধর্ম্মের সহায়তা, স্ত্রীর ধর্ম্ম।
(৩) জগৎ রক্ষার্থ এবং ধর্ম্মাচরণের জন্য দম্পতিপ্রীতি। তাহা স্মরণ রাখিয়া এই প্রীতির অনুশীলন করিলে ইহাও নিষ্কাম ধর্ম্মে পরিণত হইতে পারে ও হওয়াই উচিত। নহিলে ইহা নিষ্কাম ধর্ম্ম নহে।
শিষ্য। আমি এই দম্পতিপ্রীতিকেই পাশব বৃত্তি বলি, অপত্যপ্রীতিকে পাশব বৃত্তি বলিতে তত সম্মত নহি। কেন না, পশুদিগেরও দাম্পত্য অনুরাগ আছে। সে অনুরাগও অতিশয় তীব্র।
গুরু। পশুদিগের দম্পতিপ্রীতি নাই।
শিষ্য।-
মধু দ্বিরেফঃ কুসুমৈকপাত্রে
পপৌ প্রিয়াং স্বামনুবর্ত্তমানঃ।
শৃঙ্গেণঃ চ স্পর্শনিমীলিতাক্ষীং
মৃগীমকণ্ডূয়ত কৃষ্ণসারঃ ||
দদৌ রসাৎ পঙ্কজরেণুগন্ধি
গজায় গণ্ডূষজলং করেণুঃ।
অর্দ্ধোপভুক্তেন বিসেন জায়াং
সম্ভাবয়ামাস রথাঙ্গনামা ||
গুরু। ওহো! কিন্তু আসল কথাটা ছাড়িয়া গেলে যে!
তং দেশমারোপিত পুষ্পচাপে
রতিদ্বিতীয়ে মদনে প্রপন্নে-ইত্যাদি।
রতি সহিত মন্মথ সেখানে উপস্থিত, তাই এই পাশব অনুরাগের বিকাশ। কবি নিজেই বলিয়া দিয়াছেন যে, এই অনুরাগ স্মরজ। ইহা পশুদিগেরও আছে, মনুষ্যেরও আছে। ইহাকে কামবৃত্তি বলিয়া পূর্ব্বে নির্দ্দিষ্ট করিয়াছি। ইহাকে দম্পতিপ্রীতি বলি না। ইহা পাশব বৃত্তি বটে, স্বতঃস্ফূর্ত্তি, এবং ইহার দমন অনুশীলন। কাম, সহজ; দম্পতিপ্রীতি সংসর্গজ; কামজনিত অনুরাগ ক্ষণিক, দম্পতিপ্রীতি স্থায়ী। তবে ইহা স্বীকার করিতে হয় যে, অনেক সময়ে এই কামবৃত্তি আসিয়া দম্পতিপ্রীতিস্থান অধিকার করে। অনেক সময়ে তাহার স্থান অধিকার না করুক, দম্পতিপ্রীতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়। সে অবস্থায় যে পরিমাণে ইন্দ্রিয়ের তৃপ্তি, বাসনার প্রবলতা, সেই পরিমাণে দম্পতিপ্রীতিও পাশবতা প্রাপ্ত হয়। এই সকল অবস্থায় দম্পতিপ্রীতি অতিশয় বলবতী বৃত্তি হইয়া উঠে। এ সকল অবস্থায় তাহার সামঞ্জস্য আবশ্যক। যে সকল নিয়ম পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, তাহাই সামঞ্জস্যের উত্তম উপায়।
শিষ্য। আমি যত দূর বুঝিতে পারি, এই কামবৃত্তিই সৃষ্টিরক্ষার উপায়। দম্পতিপ্রীতি ব্যতীত ইহার দ্বারাই জগৎ রক্ষিত হইতে পারে। ইহাই তবে নিষ্কাম ধর্ম্মে পরিণত করা যাইতে পারে। দম্পতিপ্রীতি যে নিষ্কাম ধর্ম্মে পরিণত করা যাইতে পারে, এমন বিচারপ্রণালী দেখিতেছি না।
গুরু। স্মরজ বৃত্তিও যে নিষ্কাম কর্ম্মের কারণ হইতে পারে, ইহা আমি স্বীকার করি। কিন্তু তোমার আসল কথাতেই ভুল। দম্পতিপ্রীতি ব্যতীত কেবল পাশব বৃত্তিতে জগৎ রক্ষা হইতে পারে না।
শিষ্য। পশুসৃষ্টি ত কেবল তদ্দ্বারাই রক্ষিত হইয়া থাকে।
গুরু। পশুশসৃষ্টি রক্ষিত হইতে পারে, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্টি রক্ষা পাইতে পারে না। কারণ, পশুদিগের স্ত্রীদিগের আত্মরক্ষার ও আত্মপালনের শক্তি আছে। মনুষ্যস্ত্রীর তাহা নাই। অতএব মনুষ্যজাতিমধ্যে পুরুষ দ্বারা স্ত্রীজাতির পালন ও রক্ষণ না হইলে স্ত্রীজাতির বিলোপের সম্ভাবনা।
শিষ্য। মনুষ্যজাতির অসভ্যাবস্থায় কিরূপ?
গুরু। যেরূপ অসভ্যাবস্থায় মনুষ্য পশুতুল্য, অর্থাৎ বিবাহপ্রথা নাই, সেই অবস্থায় স্ত্রীলোক সকল আত্মরক্ষায় ও আত্মপালনে সক্ষম কি না, তাহা বিচারের প্রয়োজন নাই। কেন না, তাদৃশ অসভ্যাবস্থার সঙ্গে ধর্ম্মের কোন সম্বন্ধ নাই। মনুষ্য যত দিন সমাজভুক্ত না হয় তত দিন তাহাদের শারীরিক ধর্ম্ম ভিন্ন অন্য ধর্ম্ম নাই বলিলেও হয়। ধর্ম্মাচরণ জন্য সমাজ আবশ্যক। সমাজ ভিন্ন জ্ঞানোন্নতি নাই; জ্ঞানোন্নতি ভিন্ন ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান সম্ভবে না। ধর্ম্মজ্ঞান ভিন্ন ঈশ্বরে ভক্তি সম্ভবে না; এবং যেখানে অন্য মনুষ্যের সঙ্গে সম্বন্ধ নাই, সেখানে মনুষ্যে প্রীতি প্রভৃতি ধর্ম্মও সম্ভব না। অর্থাৎ অসভ্যাবস্থায়ে শারীরিক ধর্ম্ম ভিন্ন অন্য কোন ধর্ম্ম সম্ভব নহে।
ধর্ম্মজন্য সমাজ আবশ্যক। সমাজগঠনের পক্ষে একটি প্রথম প্রয়োজন বিবাহপ্রথা। বিবাহপ্রথার স্থূল মর্ম্ম এই যে, স্ত্রীপুরুষ এক হইয়া সাংসারিক ব্যাপার ভাগে নির্ব্বাহ করিবে। যাহার যাহা যোগ্য, সে সেই ভাগের ভারপ্রাপ্ত। পুরুষের ভাগ-পালন ও রক্ষণ। স্ত্রী অন্যভারপ্রাপ্ত, পালন ও রক্ষণে সক্ষম হইলেও বিরত। বহুপুরুষপরম্পরায় এইরূপ বিরতি ও অনভ্যাসবশতঃ সামাজিক নারী আত্মপালনে ও রক্ষণে অক্ষম। এ অবস্থায় পুরুষ স্ত্রীপালন ও রক্ষণ না করিলে অবশ্য স্ত্রীজাতির বিলোপ ঘটিবে। অথচ যদি পুনশ্চ তাহাদিগের সে শক্তি পুনরভ্যাসে পুরুষপরম্পরা উপস্থিত হইতে পারে, এমন কথা বল, তবে বিবাহপ্রথার বিলোপ এবং সমাজ ও ধর্ম্ম বিনষ্ট হইলে তাহার সম্ভাবনা নাই, ইহাও বলিতে হইবে।
শিষ্য। তবে পাশ্চাত্ত্যেরা যে স্ত্রীপুরুষেরা সাম্য স্থাপন করিতে চাহেন, সেটা সামাজিক বিড়ম্বনা মাত্র?
গুরু। সাম্য কি সম্ভবে? পুরুষে কি প্রসব করিতে পারে, না শিশুকে স্তন্য পান করাইতে পারে? পক্ষান্তরে স্ত্রীলোকের পল্টন লইয়া লড়াই চলে কি?
শিষ্য। তবে শারীরিক বৃত্তির অনুশীলনের কথা যে পূর্ব্বে বলিযাছিলেন, তাহা স্ত্রীলোকের পক্ষে খাটে না?
গুরু। কেন খাটিবে না? যাহার যে শক্তি আছে, সে তাহার অনুশীলন করিবে। স্ত্রীলোকের যুদ্ধ করিবার শক্তি থাকে, তাহা অনুশীলিত করুক; পুরুষের স্তন্য পান করাইবার শক্তি থাকে, অনুশীলিত করুক।
শিষ্য। কিন্তু দেখা যাইতেছে যে, পাশ্চাত্য স্ত্রীলোকেরা ঘোড়ায় চড়া, বন্দুক ছোড়া প্রভৃতি পৌরুষ কর্ম্মে বিলক্ষণ পটুতা লাভ করিয়া থাকে।
গুরু। অভ্যাস ও অনুশীলনে যে প্রভেদের কথা পূর্ব্বে বলিয়াছি, তাহা স্মরণ কর। অনুশীলন, শক্তির অনুকূল; অভ্যাস শক্তির অনুকূল; অভ্যাস, শক্তির প্রতিকূল। অনুশীলনে শক্তির বিকাশ; অভ্যাসে বিকার। এ সকল অভ্যাসের ফল, অনুশীলনের নহে। অভ্যাস, প্রয়োজনমতে কর্ত্তব্য, অনুশীলন সর্ব্বত্র কর্ত্তব্য।
যাক। এ তত্ত্ব যেটুকু বলা আবশ্যক, তাহা বলা গেল। এখন অপত্যপ্রীতি ও দম্পতিপ্রীতি সম্বন্ধে একটা বিশেষ প্রয়োজনীয় কথা পুনরুক্ত করিয়া সমাপ্ত করি।
প্রথম, বলিয়াছি যে, অপত্যপ্রীতি স্বতঃস্ফূর্ত্ত। দম্পতিপ্রীতি স্বতঃস্ফূর্ত্ত নহে; কিন্তু স্বতঃস্ফূর্ত্ত ইন্দ্রিয়লালসা ইহার সঙ্গে সংযুক্ত হইলে, ইহাও স্বতঃস্ফূর্ত্তির ন্যায় বলবতী হয়। এই উভয় বৃত্তিই এই সকল কারণে অতি দুর্দ্দমনীয় বেগবিশিষ্ট। অপত্যপ্রীতির ন্যায় দুর্দ্দমনীয় বেগবিশিষ্ট বৃত্তি মনুষ্যের আর আছে কিনা সন্দেহ। নাই বলিলে অত্যুক্তি হইবে না।
দ্বিতীয়, এই দুইটি বৃত্তিই অতিশয় রমণীয়। ইহাদের তুল্য বল আর কোন বৃত্তির থাকিলে থাকিতে পারে, কিন্তু এমন পরম রমণীয় বৃত্তি মনুষ্যের আর নাই। রমণীয়তায় এই দুইটি বৃত্তি সমস্ত মনুষ্যবৃত্তিকে এত দূর পরাভব করিয়াছে যে, এই দুইটি বৃত্তি, বিশেষতঃ দম্পতিবৃত্তি, সকল জাতির কাব্য-সাহিত্য অধিকৃত করিয়া রাখিয়াছে। সমস্ত জগতে ইহাই কাব্যের একমাত্র উপাদান বলিলেও বলা যায়।
তৃতীয়তঃ, সাধারণ মনুষ্যের পক্ষে সুখকরও এই দুই বৃত্তির তুল্যও আর নাই। ভক্তি ও জাগতিক প্রীতির সুখ উচ্চতর ও তীব্রতর, কিন্তু তাহা অনুশীলন ভিন্ন পাওয়া যায় না; সে অনুশীলনও কঠিন ও জ্ঞানসাপেক্ষ। কিন্তু অপত্যপ্রীতির সুখ অনুশীলনসাপেক্ষ নহে; এবং দম্পতিপ্রীতির সুখ কিয়ৎপরিমাণে অনুশীলনসাপেক্ষ হইলেও সে অনুশীলন অতি সহজ ও সুখকর।
এই সকল কারণে এই দুই বৃত্তি অনেক সময়ে মনুষ্যের ঘোরতর ধর্ম্মবিঘ্নে পরিণত হয়। ইহারা পরম রমণীয় এবং অতিশয় সুখদ, এজন্য ইহাদের অপরিমিত অনুশীলনে মনুষ্যের অতিশয় প্রবৃত্তি। এবং ইহার বেগ দুর্দ্দমনীয়, এই জন্য ইহার অনুশীলনের ফল, ইহাদের সর্ব্বগ্রাসিনী বৃদ্ধি! তখন ভক্তি, প্রীতি এবং সমস্ত ধর্ম্ম ইহাদের বেগে ভাসিয়া যায। এই জন্য সচরাচর দেখা যায় যে, মনুষ্য স্ত্রীপুত্রাদির স্নেহের বশীভূত হইয়া অন্য সমস্ত ধর্ম্ম পরিত্যাগ করে। বাঙ্গালির এ কলঙ্ক বিশেষ বলবান্।
এই কারণে যাঁহারা সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বী, তাঁহাদিগের নিকট অপত্যপ্রীতি ও দম্পতিপ্রীতি অতিশয় ঘৃণিত। তাঁহারা স্ত্রীমাত্রকেই পিশাচী মনে করেন। আমি তোমাকে বুঝাইয়াছি, অপত্যপ্রীতি ও দম্পতিপ্রীতি সমুচিত মাত্রায় পরম ধর্ম্ম। তাহা পরিত্যাগ ঘোরতর অধর্ম্ম। অতএব সন্ন্যাসধর্ম্মাবলম্বীদিগের এই আচরণ যে মহৎ পাপাচরণ, তাহা তোমাকে বলিতে হইবে না। আর জাগতিক-প্রীতি-তত্ত্ব বুঝাইবার সময় তোমাকে বুঝাইয়াছি যে, এই পারিবারিক প্রীতি জাগতিক প্রীতিতে আরোহণ করিবার প্রথম সোপান। যাহারা এই সোপানে পদার্পণ না করে, তাহারা জাগতিক প্রীতিতে আরোহণ করিতে পারে না।
শিষ্য। যীশু?
গুরু। যীশু বা শাক্যসিংহের ন্যায় যাহারা পারে, তাহাদের ঈশ্বরাংশ বলিয়া মনুষ্যে স্বীকার করিয়া থাকে। ইহাই প্রমাণ যে, এই বিধি যীশু বা শাক্যসিংহের ন্যায় মনুষ্য ভিন্ন আর কেহই লঙ্ঘন করিতে পারে না। আর যীশু বা শাক্যসিংহ যদি গৃহী হইয়া জগতের ধর্ম্মপ্রবর্ত্তক হইতে পারিতেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের ধার্ম্মিকতা সম্পূর্ণতা প্রাপ্ত হইত সন্দেহ নাই।* আদর্শ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ গৃহী। যীশু বা শাক্যসিংহ সন্ন্যাসী-আদর্শ পুরুষ নহেন।
অপ্রত্যপ্রীতি ও দম্পতিপ্রীতি ভিন্ন স্বজনপ্রীতির ভিতর আরও কিছু আছে। (১) যাহারা অপত্যস্থানীয়, তাহারাও অপত্যপ্রীতির ভাগী। (২) যাহারা শোণিত-সম্বন্ধে আমাদের সহিত সম্বন্ধ, যথা-ভ্রাতা ভগিনী প্রভৃতি, তাহারাও আমাদের প্রীতির পাত্র। সংসর্গজনিতই হউক, আত্মপ্রীতির সম্প্রসারণেই হউক, তাহাদের প্রতি প্রীতি সচরাচর জন্মিয়া থাকে। (৩) এইরূপ প্রীতির সম্প্রসারণ হইতে থাকিলে, কুটুম্বাদি ও প্রতিবাসিগণ প্রীতির পাত্র হয়, ইহা প্রীতির নৈসর্গিক বিস্তার কথনকালে বলিয়াছি। (৪) এমন অনেক ব্যক্তির সংসর্গে আমরা পড়িয়া থাকি যে, তাহারা আমাদের স্বজনমধ্যে গণনীয় না হইলেও তাহাদের গুণে মুগ্ধ হইয়া আমরা তাহাদের প্রতি বিশেষ প্রীতিযুক্ত হইয়া থাকি। এই বন্ধুপ্রীতি অনেক সময়ে অত্যন্ত বলবতী হইয়া থাকে।
ঈদৃশ প্রীতিও অনুশীলনীয় ও উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম। সামঞ্জস্যের সাধারণ নিয়মের বশবর্ত্তী হইয়া ইহার অনুশীলন করিবে।
————
* ‘কৃষ্ণচরিত্র’ নাম গ্রন্থে এই কথাটা বর্ত্তমান গ্রন্থকার কর্ত্তৃক সবিস্তারে আলোচিত হইয়াছে।
————