নিজের অফিসে এসে মূহ্যমান সোমনাথ পাথরের মতো বসে রইলো। জন্মদিনের শুরুটা ভালোই হয়েছে। বউদির কাছে কী করে মুখ দেখাবে সে?
শান্তভাবে একটু বসে থাকবারও উপায় নেই। মিস্টার মাওজী ফোনে ডাকছেন। এখনই যেতে বললেন।
বউদির দেওয়া নতুন হাত-ঘড়িটার দিকে তাকালো সোমনাথ। হঠাৎ মনে পড়লো তপতীর আসবার সময় হয়েছে। সেনাপতিকে ডেকে বললো, এক দিদিমণি আসতে পারেন। তাকে যেন সেনাপতি বসতে বলে। জরুরী কাজে সোমনাথ বেরিয়ে যাচ্ছে।
সিড়ির মুখেই কিন্তু দিদিমণির সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। তপতী বললো, “বাসে বড় ভিড়। দেরি হয়ে গেলো।”
সোমনাথ কিছুই বললো না। সময়ের বাজারেও বোধহয় আগুন লেগেছে যার যত সময় দরকার সে তত সময় পাচ্ছে না।
তপতীর বোধহয় একটু বসবার ইচ্ছে। কিন্তু সোমনাথের সময় কই? মিস্টার মাওজী তার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
তপতী তো জন্মদিনে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে না। আজ যে ১লা আষাঢ় তা কি ওর মনে নেই?
এই ক’দিনে তপতী যেন শুকিয়ে অর্ধেক হয়ে গেছে। চোখের কোলে কালো দাগ পড়েছে তপতীর। মোটা ফ্রেমের চশমাও সে-দাগ ঢাকতে পারছে না। তপতী একটা অতি সাধারণ সাদা শাড়ি পরেছে। ফিকে নীল রংয়ের ব্লাউজটাও ভালোভাবে ইস্তিরি করা নয়। তপতী বেচারা হাঁপাচ্ছে। প্রায় কাঁদ-কাঁদ হয়ে সে এবার সোমনাথকে বললো, “তুমি আমার কথা ভাবো না।”
কী হলো তপতীর? একটা সমর্থ ছেলের সামনে একটা কমবয়সী মেয়েকে এমন অসহায়ভাবে কাঁদতে দেখলে, রাস্তার লোকেরা কী ভাববে?
তপতী কাতরভাবে বললো, “তুমি চিঠি লেখো না, খবর নাও না, আমার সঙ্গে দেখাও করো না। অফিসটাইমে একটা মেয়ের পক্ষে এই চিৎপুর রোডে আসা যে কী কষ্টের। লোকগুলো সব জন্তু হয়ে গেছে। ভিড়ের মধ্যে বাসের দরজার কাছে মেয়েদের চেপে ধরবার জন্য যা করে।”
চুপ করে আছে সোমনাথ। তপতী ওর মুখের দিকে তাকিয়ে করুণভাবে জিজ্ঞেস করলো, “কই? তুমি তো রাগ করছো না? আমার শাড়ির আঁচল ছিঁড়ে দিয়েছে। আর একটু হলে গাড়ি চাপা পড়তাম।”
সোমনাথের মুখ লাল হয়ে উঠলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, “কলকাতা শহরটা জগলের অধম হয়ে যাচ্ছে তপতী। বিশেষ করে এই অঞ্চলটায় কিছু গরিলা আছে।”
তপতী স্তব্ধ হয়ে ওর মুখের দিকে অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, “ঘড়ি দেখছো কেন? তোমার সঙ্গে যে অনেক কথা আছে।”
“যে-লোকটার কাছে আমি বিজনেস পেতে পারি সে আমার জন্যে ওয়েট করছে, তপতী।”
তপতী বললো, তাহলে তোমাকে আটকে রাখা যাবে না। শোনো, বাড়িতে ভীষণ বিয়ের জন্যে চাপ দিচ্ছে। আমার জন্যে পরের দুটো বোন অযথা কষ্ট পাচ্ছে—ওদের বিয়ের সময় হয়ে গেছে।
যে-লোকের চাকরি নেই, রোজগার নেই, নিজস্ব আশ্রয় নেই—তাকে এসব কথা বলে অপমান করে কী লাভ? সোমনাথ বললো, “বিয়ে করে ফেলো তপতী।”—”তুমি এখনও আমাকে এইভাবে কষ্ট দিতে চাও?” তপতী কাতরভাবে বললো। বাড়িতে তুমুল ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে শ্রীরামপুরে মাসির বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। সোম, আমাদের ব্যাপারটা পাকা করে ফেলা ভালো। চলো, আমরা বিয়েটা রেজিস্ট্রি করে ফেলি। বাড়ির লোকরা তখন চাপ দিয়েও আমার কিছু করতে পারবে না। প্রতিদিনের এই অশান্তি আমার আর ভালো লাগে না।
সোমনাথের হ্যাঁ বলবার ক্ষমতা নেই। আজ এই জন্মদিনে, লক্ষ লক্ষ মানুষের সামনে, হে ঈশ্বর, পরাশ্রিত বেকার সোমনাথকে কেন এমনভাবে অপদস্থ করছো? আমাকে শাস্তি দিতে চাও দাও, কিন্তু একটা নিষ্কলঙ্ক মেয়ের প্রথম পবিত্র প্রেমকে কেন এমনভাবে অপমান করছে, হে ঈশ্বর?”
কিন্তু কার কাছে প্রার্থনা করছে সোমনাথ? কোথায় ঈশ্বর?
সোমনাথের মুখের দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে তপতী। গাঢ় স্বরে সে অনুরোধ করলো, “কই? কিছু বলো।”
কোথাও যদি সামান্য একটু আশার আলো দেখতে পেতো সোমনাথ, তাহলে এখনই তপতীকে এই অসহ্য অপমান থেকে মুক্তি দিতো। আর তো চুপ করে থাকা চলে না। সোমনাথ কাতরভাবে বললো, “আমায় কিছু সময় ভিক্ষে দিতে পারো তপতী?”
“তুমি আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছো, সোম?” কাঁদ-কাঁদ গলায় তপতী বললো, “বাবা মা ভাই বোন কেউ আমার দলে নেই। এখন তুমি পিছিয়ে গেলে আমার আর কী রইলো?
যার চাকরি নেই, রোজগার নেই, তাকে এই সমাজে যে মানুষ বলা চলে না—সে যে নিভরের অযোগ্য—-এই সামান্য কথাটকু বুদ্ধিমতী তপতী কেন বুঝতে পারছে না?
তপতী বললো, “আমি তো তোমার কাছে কিছুই চাইছি না। শুধু আমাকে নিয়ে একবার রেজিস্ট্রি অফিসে চলো।”
“তপতী, স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্বটা পুরুষমানুষের-হাজার-হাজার বছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে।” সোমনাথ কথা শেষ করতে পারলো না।
তপতী কিন্তু অবিচল। সে বললো, “ওসব আমি কিছুই বুঝতে চাই না, আগামীকাল আমি আবার আসবো।”