অনেকদিন আগে এই বৈঠকেই কথাসাহিত্যিক সুবোধ ঘোষ সম্পর্কে কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলাম যে শেষ মুহূর্তে শারদীয়া সংখ্যায় একটি গল্প লিখে আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন। আর সে কী গল্প! থিরবিজুরী। যেগল্প সে বছরের শারদ সাহিত্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প বলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। সে-গল্প লেখার পিছনে যে কাহিনী আছে তা যেমন কৌতূহলোদ্দীপক তেমনি বিস্ময়কর। আর সুবোধবাবুর স্থৈর্য ও সংকল্পের যে পরিচয় সেদিন পেয়েছিলাম তা আজও আমার কাছে অবিশ্বাস্য ঘটনা বলে মনে হয়, অলৌকিকও বলতে পারেন। সেই কাহিনীই আপনাদের কাছে আজ বলতে বসেছি।
ভাদ্র মাস হতে চলেছে, তখনও শেষ বর্ষণের পালা চোকে নি। বর্মণ স্ট্রীটের অফিসের এক প্রান্তে সুবিশাল কদম গাছে প্রস্ফুটিত কদম্বের সমারোহ। সেদিকে মাঝে মাঝে দৃষ্টি যে যেত না তা নয়, কিন্তু পরক্ষণেই সে-দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হত পুঞ্জীভূত প্রুফের গাদায়। পূজা সংখ্যার কাজের তাড়া ও দুশ্চিন্তা যখন ঘাড় ও মগজে বোঝার মত চেপে আছে তখন কলকাতা শহরের বড় বাজারে বসে কদম ফুল আর সজল মেঘের ছায়া দেখাটা ধৃষ্টতা ছাড়া আর কিছুই নয়। পূজা সংখ্যার কাজ তখন চরমে উঠেছে। প্রায় একমাস ধরে সকাল দশটা থেকে রাত দশটা কাটে একটা প্রবল উত্তেজনার মধ্যে। অমুক লেখকের লেখা এখনও এসে পৌঁছল না। লেখা এসে পৌঁছল তো কম্পোজ দিতে দেরি করছে। ওদিকে আর্টিস্টের কথা ছিল আজ বিকেল পাঁচটার মধ্যে গল্পের ছবি ও হেপী দিয়ে যাবার, তারও দেখা নেই। এদিকে গৌরাঙ্গ প্রেসের ম্যানেজার প্রভাতবাবু টেলিফোনে তারস্বরে চিৎকার করে বলছেন—এখনও ফর্মা পাঠালেন না? মেশিন খালি বসে আছে, ফর্মা ঠিক মতন না পেলে এত ইম্প্রেশন আমি কী করে দেব? পূজা সংখ্যা আর বেরবে না।
সারাদিনের ধকলের পর আমাদের সকলেরই মেজাজ প্রায় সপ্তমে চড়ে থাকে। তার উপর গৌরাঙ্গ প্রেসের এই ভয় আর আতঙ্ক মিশ্রিত গেল গেল রব শুনলে কার না খারাপ লাগে। অগত্যা প্রভাতবাবু যে পর্দায় গলা চড়িয়ে চিৎকার করছেন প্রায় তার কাছাকাছি আমার গলাটা চড়িয়ে বললাম–
আমাকেই বারবার ফর্মার জন্য তাগাদা দিচ্ছেন কেন? আগে তো আপনারা মেল ট্রেনকেই পাস করবেন, তার পরে তো এক্সপ্রেস। আনন্দ বাজারের কি সব দেওয়া হয়ে গিয়েছে?
সঙ্গে সঙ্গে প্রভাতবাবুর সুর নেমে গেল। বললেন–
জানেন তো সব। সুবোধবাবুর গল্প এখনও লেখা হয় নি। আজ রাত্রে বসে গল্প লিখবেন, সারারাত কম্পোজ হবে, মেক-আপ হবে, কাল ভোরে ফর্মা পাঠাবেন। ইতিমধ্যে আপনার একটা ফর্মা পেয়ে গেলে কাজ এগিয়ে রাখতে পারতাম।
আমি কি আর জানি না? হাড়ে হাড়ে জানি, মজ্জায় মজ্জায় জানি। আজকের মতন পূজা সংখ্যা বা সাপ্তাহিক সংখ্যা সেদিন রোটারি মেশিনে ছাপা হত না। আট পৃষ্ঠার ফর্ম কম্পোজ ও মেক-আপ করে গৌরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠাতে হত, তাঁরা ফ্ল্যাটবেড মেশিনে তা ছেপে দিতেন। একালের মত একসঙ্গে বত্রিশ পাতা রোটারি মেশিনে ছাপা হত না বলে ঠিক সময় মত লেখা, কম্পোজ, ইলাস্টেশন ব্লক ও বিজ্ঞাপনের যোগান না পেলে কাজ যেত বানচাল হয়ে এবং প্রেসের সঙ্গে নিত্য ঝগড়া লেগেই থাকত।
তখন রীতি ছিল আনন্দবাজার পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যার শেষ ফর্মা প্রেস-এ পাঠাবার চব্বিশ ঘণ্টা পর, অর্থাৎ তার পরের দিন দেশ-এর শেষ ফর্মা প্রেসে পাঠানো হত। এই দুটি পত্রিকারই শেষ ফর্মা ছিল গোড়ার দিকে সুবোধবাবুর গল্পের আট পৃষ্ঠা। সুবোধবাবুর ছিল ওই এক অভ্যেস, শেষ মুহূর্তের চাপ না পড়লে গল্প লিখতেই পারতেন না। কম্পোজিটর, প্রিন্টার, মেক-আপ ম্যান ছাপাখানা প্রভৃতি সবারই জানা ছিল যে শেষ ফর্মা ধরা আছে সুবোধবাবুর জন্যে এবং শেষ মুহূর্তে সুবোধবাবুর লেখা নিয়ে দুই পত্রিকায় দৌড়-ঝাপ শুরু হয়ে যাবে। প্রতি বছরেই পূজা সংখ্যার হিড়িক শুরু হবার আগেই সুবোধবাবুকে গিয়ে বলি এবার কিন্তু আপনাকে আগেই গল্প দিতে হবে।
সঙ্গে সঙ্গে সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে সুবোধবাবু, জানিয়ে দেন-নিশ্চয়, নিশ্চয়। এবার আগেই লিখব। শেষ মুহূর্তে লিখি বলে আপনাদের অসুবিধা, আর আমিও গল্পটা যেভাবে গুছিয়ে লিখব বলে আরম্ভ করি তা আর হয় না, কোন রকমে শেষ করতে হয়।
আমরা জানি, সুবোধবাবুর সদিচ্ছা থাকলেও শেষ পর্যন্ত আর আগে গল্প লেখা হয়ে ওঠেনা। অন্তত গত বাইশ বছর ধরে এই নিয়মের ব্যতিক্রম একবারও হয় নি।
সে-সময়ে প্রন-বি আনন্দবাজার পত্রিকায় সহকারী সম্পাদকের কাজ করতেন। পূজার লেখার কথা স্মরণ করিয়ে যখন তাকে বলতাম—বিশীদা, আপনার লেখাটা কবে দিচ্ছেন?
বরাভয়ের মুদ্রায় দক্ষিণ হস্ত প্রসারিত করে বলতেন-ভয় নেই, সুবোধের আগে পাবে।
আজও বিশীদার কাছে যখনই পূজা সংখ্যার লেখা চাই–ওই একই উত্তর দিয়ে থাকেন। পূজা সংখ্যার কাজের শেষ দিনটা সুবোধবাবুকে যেমন উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয়, তার চেয়ে বেশী উদ্বেগের মধ্যে কাটাতে হয় আমাদের।
পত্রিকার সাকুলেশন ম্যানেজার সদাব্যস্ত ভূপেনদা ঝড়ের মত ঘরে ঢুকেই ফেটে পড়লেন। চুল উস্কোখুস্কো, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। বললেন–
আপনাদের জন্যই পূজার আগে পূজা সংখ্যা বেরোবে না। ফর্মা পাঠান নি, প্রেসের মেশিন খালি বসে আছে, এদিকে দশটা দপ্তরীকে কাজ দিয়েছি, তারাও হাত গুটিয়ে বসে। আমার কেবল ছুটোছুটি করাই সার।
ওদিকে পত্রিকার স্বত্বাধিকারী সুরেশচন্দ্র মজুমদার মশাই সাফ জবাব দিয়েছেন, মহালয়ার আগের দিন যদি পূজা সংখ্যা না বেয়োয় সে পত্রিকা তিনি আর বাজারে বের করবেন না, অফিসের গেট-এর সামনে ডাঁই করে পেট্রল দিয়ে সব কাগজ পুড়িয়ে ফেলবেন।
সে-যুগে প্রতি বৎসর শারদীয়া সংখ্যা নিয়ে শেষ দিনে এই ধরনের হই-হল্লা, চেঁচামেচি, লম্ফঝম্ফ, শোরগোল বাঁধা বরাদ্দ ছিল। আর এ-সব না হলেও যেন ভাল লাগত না। শারদীয়া সংখ্যার কাজ অথচ চেঁচামেচি নেই, এ-যেন সেদিন আমরা কল্পনাই করতে পারতাম না। বিয়ে বাড়িতে শোরগোল না হলে যেমন তা বিয়ে-বাড়ি বলে মনে হয় না, আমাদের পূজা সংখ্যার কাজ খানিকটা ছিল সেই জাতের। এরও একটা উত্তেজনার দিক ছিল এবং সে উত্তেজনারও একটা নেশা ছিল। আজকের মত ঘড়ি-ধরা নিয়মবধা নির্বি পূজা সংখ্যার কাজ সেদিন ছিল না বটে, কিন্তু সেদিনের উন্মাদনার যে একটা আনন্দ ছিল আজ আমরা তা থেকে বঞ্চিত।
আবার সুবোধবাবুর কথাতেই ফিরে আসি। সুবোধবাবু আগেই আমাদের জানিয়ে দিয়েছিলেন, (যেমন প্রতি বৎসরই দেন) যে ওঁর গল্পের জন্য আট পৃষ্ঠা অর্থাৎ এক ফর্মা জায়গা রেখে দিতে। কম্পোজ করার পর যদি দেখা যায় গল্প আট পৃষ্ঠার ছোট হয়ে যাচ্ছে, বাড়িয়ে দেবেন, বড় হয়ে গেলে কেটে ছোট করে দেবেন। এদিকে রাম না জন্মাতেই রামায়ণ লেখা হয়ে আছে। গল্পের দেখা নেই কিন্তু আর্টিস্টকে দিয়ে হেডপীসের ছবি ও গল্পের নাম আঁকিয়ে ব্লক পর্যন্ত তৈরী।
গৌরাঙ্গ প্রেসের প্রভাতবাবুর টেলিফোন পাবার পর উদ্বেগ বেড়ে গেল। ওদিকে আনন্দবাজারের গল্প লেখা শেষ না হলে দেশ-এর গল্পে হাত দেবেন না—এটা জানা কথা। তাই আনন্দবাজার পূজা সংখ্যার সম্পাদক মন্মথবাবুকে টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম—আপনার কতদূর?
মন্মথবাবু বললেন–সুবোধবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করছেন তো? আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় লেখা শেষ করে সন্ধ্যের পর পূজার গল্পে হাত দেবেন।
আমি অবাক হয়ে বললাম-সে কী, এখনও গল্পে হাত দেন নি? তা হলে তো আজ সারারাত আপনার দুর্ভোগ আছে।
মন্মথবাবু হেসে বললেন–কোন্ বছরই বা না থাকে। কাল ভোর ছটার মধ্যে ফর্মা পাঠাতে হলে সারারাত সুবোধবাবুর সঙ্গে জেগে কাটাতে হবেই।
আমি বললাম-আপনারই যখন এই অবস্থা তখন আমার কী হবে বলুন তো?
মন্মথবাবু হেসে বললেন–আমি একাই শুধু রাত জাগব আপনি জাগবেন, তা কি হতে পারে?
আমিও মনে মনে ভাবলাম কথাটা ঠিক। শেষ দিনের অহোরাত্র জাগরণ দুজনের ভাগ্যে লেখা যখন আছে-খণ্ডন করবে কে? সেদিনের মত পূজা সংখ্যার কাজ চুকিয়ে রাত নটার সময় উঠে পড়লাম।
বাড়ি ফেরার পথে একবার ভারতী সিনেমায় ঘণ্টা তিনেক কাটাতে হবে। তানসেন সংগীত সম্মেলন চলেছে, বড় বড় ওস্তাদদের গানবাজনার আসর। সংগীত সম্মেলনের মরসুমে এ-ধরনের আসরে প্রতিরাত্রে একবার টু মারা আমার বরাবরের অভ্যাস।
অফিস থেকে বেরোবার সময় তিন তলায় মন্মথবাবুর ঘরে উঁকি মেরে দেখি সুবোধবাবু বসে আছেন, টেবিলের উপর সাদা প্যাড, তাতে একটিও কালির আঁচড় পড়ে নি। কলমটা ভোলা অবস্থাতেই পাশে শোয়ানো। একটা সিগারেট ধরিয়ে রাত্রির আকাশের দিকে উদাস দৃষ্টি মেলে চুপচাপ বসে। ঠোঁটের কোণায় ধরে রাখা সিগারেটটা আপনিই পুড়ে চলেছে। পাশের টেবিলে মন্মথবাবু ও তার সহকারী কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী একমনে কি একটা লেখার পেজ প্রুফ দেখছেন। ঘরের এক কোণে কয়েকটা মাটির ভাড় আর শালপাতা দেখেই অনুমান করলাম আমজাদিয়া হোটেল থেকে মাংসর চাপ আর রুটি এসেছিল, তিনজনেরই রাত্রের আহার সমাধা হয়েছে। আমার তাগাদা নিয়ে এই সময় সুবোধবাবুর কাছে উপস্থিত হওয়াটা সমীচীন বোধ করলাম না। নিঃশব্দে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
পরদিন একটু তাড়াতাড়িই অফিসে হাজির হয়েছি। বেলা প্রায় দশটা হবে। অফিসে ঢুকেই দেখি গেট-এর কাছে মন্মথবাবু দাঁড়িয়ে। উভ্রান্ত চেহারা। চোখের কোণে কালি পড়ে গেছে, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মুখে চোখে থমথমে গাম্ভীর্য। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে রিকশায় ফর্মা ভোলাচ্ছেন গোরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠাবার জন্য।
আমাকে দেখেই মন্মথবাবু যত রাগ আর বিরক্তি এতক্ষণ পুষে রেখেছিলেন তা প্রকাশ করে ফেললেন।
দেখুন মশাই, এই গৌরাঙ্গ প্রেস সকাল থেকে টেলিফোন করে করে আমাকে পাগল করে তুলেছে।
আমি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম—ওদের তো ওই এক কথা, ফর্মা চাই এবং এক্ষুনি চাই।
মনে মনে আমিও প্রমাদ গণলাম। কাল সকালে ঠিক সময়ে ফর্মা না। পাঠাতে পারলে আমাকেও তো একই অবস্থায় পড়তে হবে। রাত্রি জাগরণ, মানসিক উদ্বেগ, সব মিলিয়ে মন্মথবাবুর চেহারা দেখে আগামীকাল সকালের আমার অবস্থাটা কল্পনা করে শঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। রিকশা করে ফর্মা রওনা করে দিয়ে মন্মথবাবু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। মুক্তির নিশ্বাস ছেড়ে বললেন–
যাক, কন্যাদায় এ বছরের মত চুকল। এবার গঙ্গাস্নান করে বাড়ি যাওয়া যাক।
কাতরকণ্ঠে আমি বললাম-আপনি তো ভালয় ভালয় চুকিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার কি উপায় হবে বলুন তো?
মন্মথবাবু এখন মুক্তপুরুষ, তাই আমার প্রতি প্রচুর সহানুভূতি আর সান্ত্বনা ঢেলে বললেন—ও কিছু ভাববেন না। সুবোধবাবু ভোর ছটায় ওঁর গল্পের ফাইন্যাল প্রুফ দেখে দিয়ে বাড়ি চলে গেছেন। ঘণ্টা তিন চার ঘুমিয়ে চান-খাওয়া করেই আবার অফিসে আসবেন। আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় কিছু লিখবার যদি থাকে তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চুকিয়ে দিয়েই আপনার গল্প লিখতে বসবেন একথা বলে গেছেন।
চব্বিশ ঘণ্টা আগে মন্মথবাবুর মানসিক উদ্বেগের অবস্থাটা আমার জানা আছে। সুতরাং ওঁর অভয়বাণীতে খুব বেশী ভরসা করতে পারছিলাম না। প্রচণ্ড উদ্বেগ নিয়েই নিজের ঘরে গিয়ে বসলাম। পূজা সংখ্যার আর যা-কিছু টুকিটাকি কাজ তা চুকিয়ে রেখে শুধু সুবোধবাবুর প্রত্যাশিত গল্পের আট পৃষ্ঠার গোড়ার দিকের ফর্মাটা জগদ্দল পাথরের মত গলায় ঝুলে রইল।
বেলা একটার সময় সুবোধবাবু অফিসে এসে হাজির। তিনতলায় নিজের ঘরে যাবার আগে দোতলার পূর্ব প্রান্তে আমার ঘরে কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলেন। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ, সকালে কিছুক্ষণ যে ঘুমোতে পেরেছেন, মনে হল না।
আমি বললাম—অপিনার চেহারা বড়ই ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কাল সারারাত পরিশ্রম করেছেন, সকালে ঘুম হয় নি বোধ হয়?
সুবোধবাবু বললেন—কি করে হবে। আনন্দবাজারের গল্পটা যে ভাবে ফেঁদে ছিলাম, লিখতে লিখতে বড় হয়ে গেল। ওদিকে হেডপী আর কিছু বিজ্ঞাপন আছে, আটপাতায় ধরে না। শেষকালে অনেক বাদছাদ দিয়ে ধরাতে হল। তাই মনে একটা খুত থেকে গেছে, সেই চিন্তাতেই ঘুম আর হয় নি।
চোরের মন যেমন বোঁচকার দিকে থাকে, আমার চিন্তা কেবল দেশ পত্রিকার গল্পের জন্য। আমি বললাম-দেশের গল্পটা আজ বিকেলেই লিখতে শুরু করবেন তো? আমি প্রিন্টারকে বলে কম্পোজের সব বন্দোবস্ত করে রেখেছি, এখন কপি দিলেই হয়।
সুবোধবাবু বললেন–যাই, তেতালায় গিয়ে দেখি দৈনিকের জন্য আমার কি লেখা আছে। যদি যৎকিঞ্চিৎ লিখতে দেয় তাহলে বেঁচে যাই। তাড়াতাড়ি শেষ করেই আপনার লেখায় হাত দেব।
এক কাপ চা আর সিগারেট খেয়েই সুবোধবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন—আমিও খানিকটা নিশ্চিন্ত হলাম যে আজ বিকেল থেকেই প্রেস-এ কপি ধরাতে পারব। রাত বারোটা একটার মধ্যেও যদি সুবোধবাবু লেখা শেষ করে দেন তাহলে কাল ভোর ছটার মধ্যে গৌরাঙ্গ প্রেস-এ ফর্মা পাঠাতে বেগ পেতে হবে না।
বিকেল পাঁচটার সময় আমার ঘরের টেলিফোন বেজে উঠল। সুবোধ বাবুর টেলিফোন। বললেন—একবার উপরে আসতে পারবেন?
টেলিফোন রেখেই তিন তলায় ছুটলাম। তা হলে গল্প লেখা শুরু হয়ে গেছে, প্রেস-এ কপি দেবার জন্যই ডাকছেন। ঘরে ঢুকে দেখি সুবোধবাবুর মুখ গম্ভীর, থমথমে, চোখ দুটো লাল হয়ে উঠেছে। বুঝলাম আমার অনুমান সম্পূর্ণ মিথ্যে।
সুবোধবাবু কাতর কণ্ঠে বললেন–কি করি বলুন তো?
–কেন, কী হল?
–আমাদের এখানে আজ অমলেন্দুবাবুর অফ ডে, ব্ৰজেনবাবু অসুস্থতার জন্য আসতে পারেন নি। চপলাবাবুর আজ আবার কোথায় সভা আছে, সেখানে গেছেন আমার উপর প্রথম সম্পাদকীয় লেখার ভার দিয়ে। কোনও রকমে সেটা এইমাত্র শেষ করেছি, কিন্তু মাথা অত্যন্ত ভার হয়ে আছে, যন্ত্রণাও হচ্ছে। আপনার গল্প শুরু করব বলে এতক্ষণ ভাবছিলাম, কিন্তু মাথার এমন অবস্থা যে কিছুই ভাবতে পারছি না। আপনিই একটা উপায় বলে দিন।
একথা শোনার পর নিজেই যখন অগাধ জলে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি তখন আরেকজন হাবুডুবু খাওয়া লোককে উদ্ধার করি কী প্রকারে। কিন্তু সুবোধ বাবুর চেহারার ওই অবস্থা দেখে ওর উপর জোরজবরদস্তি করতে নিজেরই মায়া হল।
আমার সমস্যা হল সুবোধবাবুর গল্প আজই যদি কম্পোজ করতে না দিতে পারি তাহলে গল্পই বাদ যায়। তার পরিবর্তে বিকল্প ব্যবস্থাই বা শেষ মুহুর্তে করি কি ভাবে। সামনের দিকের ফর্মা, সেখানে একজন অখ্যাত লেখকের লেখা দেওয়াটা দৃষ্টিকটু। তাছাড়া বিজ্ঞাপনে আমরা ঘোষণা করেছি সুবোধ বাবুর গল্প শারদীয়া সংখ্যায় প্রকাশিত হবে। বিজ্ঞাপিত লেখা না দিতে পারাটা সম্পাদনা কাজের অমার্জনীয় অপরাধ। পাঠকরা লেখককে ক্ষমা করতে পারেন, সম্পাদককে করবেন না। সে-সময়ে সুবোধবাবু বেশী লেখা। লিখতেন না। শারদীয়া সংখ্যায় দুটি মাত্র গল্প লিখতেন। একটি আনন্দবাজারে, অপরটি দেশ পত্রিকায়। সুতরাং দেশ পত্রিকায় এবারে সুবোধবাবুর গল্প থাকবে না—এটা আমার কাছে শুধু বেদনাদায়ক নয়, অকল্পনীয়ও বটে। আমার অবস্থাটা সুবোধবাবুর কাছে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলার পর সুবোধবাবু বললেন–তা হলে এক কাজ করি। আমি এখনই বাড়ি চলে যাই। মাথার যে-রকম অবস্থা, এখানে বসে শত চেষ্টা করলেও এক লাইন লেখা হবে না। বাড়ি গিয়ে, স্নানটান করে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিয়ে তারপর লিখতে বসব। নির্জন রাত্রে লেখাও হবে ভালই। কী বলেন?
কী আর বলব। সুবোধবাবুর প্রস্তাবে রাজি না হয়ে আমার আর উপায় কি। কিন্তু একটা প্রশ্ন দেখা দিল। বাড়িতে বসে রাত্রে যদি লেখেনও সেলেখা কম্পোজ হবে কখন? সুবোধবাবুকে আর আটকে রাখলাম না, বাড়ি চলে গেলেন। দুশ্চিন্তার বোঝা নিয়ে নিজের ঘরে এসে বসেছি, যথারীতি দু-চারজন সাহিত্যিক বন্ধুর সমাগম হয়েছে। কোন কাজে মন বসছে না, আর বন্ধুদের সঙ্গে জমিয়ে দু-দণ্ড রসালাপ করব সে মেজাজও আর নেই। আমার মাথায় তখন এক চিন্তা সুবোধবাবু যদি রাত্রে বাড়িতে বসে লেখেনও, সে-লেখা কম্পোজ হবে কখন?
এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন আরেকজন, তিনি আমাদের প্রিন্টার সুরেনবাবু। এই প্রিন্টারই একদিন সুবোধবাবুর হাতের লেখা কপি এনে আমাকে বলেছিলেন—এই লেখককে বলবেন স্পষ্টাক্ষরে ধরে ধরে লিখতে, কোন কম্পোজিটারই এই লেখা কম্পোজ করতে চায় না। খর্বকায়, শীর্ণদেহ, বয়স ষাট-এর কাছাকাছি। আশুতোষ মুখার্জি প্যাটার্নের একজোড়া পাকা গোঁফ ও পাকা ভুরু হচ্ছে ওঁর চেহারার প্রধান আকর্ষণ। পূর্ববঙ্গীয় ভাষায় এত দ্রুত কথা বলেন যে, এক বর্ণও বোঝা যায় না। কথা বলার সময় গোঁফ আর ভুরু সমানতালে নাচতে থাকে। এই ভুরু ও গোঁফ-নৃত্যের মুদ্রা যদি আমার জানা থাকত তাহলে কাজটা অনেক সহজ হত। আমি অবশ্য সেই চেষ্টাই করতাম। কথা বলার সময় সুরেনবাবুর গোঁফ ও ভুরুর নাচন দেখে খানিকটা অনুমান করবার চেষ্টা করতাম ওঁর বক্তব্য বিষয়টি কী।
এখন সুরেনবাবুর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই জেনে কাজকর্ম চাপা দিয়ে চলে গেলাম প্রেস্-এ। সুরেনবাবুকে মুশকিলের কথাটা সবিস্তারে বলার পর আসানের ফিকির শুনবার জন্যে সতৃষ্ণ নয়নে ওঁর গোঁফ ও ভুরু জোড়ার দিকে তাকিয়ে আছি। লক্ষ্য করলাম, খুবই দ্রুত গোঁফ ও ভুরু নেচে উঠল, আর সেই সঙ্গে মুখ থেকে ততোধিক দ্রুত একটি শব্দ বেরিয়ে এল :-
ক্যাচ্ছিরিয়স্।
বিচ্ছিরি একটা উচ্চারণ শুনে প্রথমে আমি হকচকিয়ে গেলাম। সন্ধিবিচ্ছেদ করতেই অর্থ উদ্ধার হল-কেস সিরিয়। সুবোধবাবুর গল্পের কপি মধ্যরাত্রে পেলেও উপায় নেই, ভোর ছটার মধ্যে ফর্মা তৈরী করা অসম্ভব। সুতরাং বিষয়টা খুবই সিরিয়। দ্বিতীয়ত, শারদীয়া সংখ্যায় সুবোধবাবুর গল্প থাকবে না—সেটাও কম সিরিয় ব্যাপার নয়।
মিনিট কুড়ি যাবং অনেক গোঁফ আর ভুরু নাচানাচির পর সুরেনবাবু আমাকে আশ্বাস দিয়ে জানালেন যে ঘাবড়াবার কিছু নেই। রাত্রি আড্ডাইটার পর দৈনিকের কাজ শেষ হলেই পাঁচটা মেশিনে পাঁচ হাতে কম্পোজ ধরিয়ে দেবেন, সেই অনুসারে কম্পোজিটরদের বলে কয়ে আটকে রাখবেন। যেকরেই হোক আমাকে শুধু রাত আড্ডাইটার মধ্যে বেশ কিছু কপি এনে হাজির করতে হবে। আর ওদিকে গৌরাঙ্গ প্রেসকে বলে রাখতে হবে ভোর ছটায় ফর্মা যাবে না, বেলা ১টার আগে ফর্মা পাঠানো সম্ভব নয়।
সুবোধবাবুর গল্প পূজা-সখ্যা থেকে বাদ যাবে-এটা যেন কম্পোজিটরপ্রিন্টার থেকে শুরু করে গৌরাঙ্গ প্রেসের ম্যানেজার পর্যন্ত কারোরই মনঃপুত নয়। গৌরাঙ্গ প্রেস-এর ম্যানেজার যে-প্রভাতবাবু এতক্ষণ ফর্মা চাই, ফর্মা চাই বলে তারস্বরে চিৎকার করে গলা ভেঙ্গে বসে আছেন সেই প্রভাতবাবুও সহসা সব বৃতান্ত শুনে সুর পালটে ফেললেন। বললেন–কুছ পরোয়া নেই। বেলা একটা কেন, বেলা দুটোর মধ্যেও যদি আপনি ফর্মা পাঠাতে পারেন আমি দিনরাত মেশিন চালিয়ে ঠিক সময়ে কাগজ বার করে দেব।
যাক, মোক্ষম দুটো ঘটি তো ম্যানেজ করা গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তার ভারও নেমে গেল অনেকখানি। কিন্তু আসল সমস্যা থেকে গেল সুবোধবাবুর লেখা এবং তা রাত দুটোর মধ্যে প্রেস-এ কম্পোজের জন্য ধরিয়ে দেওয়া।
রাত তখন নটা। সাহিত্যিক বন্ধুরা একে একে প্রায় সবাই বিদায় নিয়েছেন, শুধু ধরে রেখেছি কবি ও কথাসাহিত্যিক বন্ধু সুশীল রায়কে। ওদিকে রজগতের সমালোচক শৌভিক আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছেন। ভারতী সিনেমায় সংগীত সম্মেলনে একসঙ্গে যাবার কথা। আপৎকালে সুশীলবাবুর পরামর্শ আমার কাছে সর্বদাই এহ। সে সময়ে সুবোধবাবু থাকতেন কাকুলিয়া রোডের দক্ষিণপ্রান্তে, সুশীলবাবুর বাড়ির কাছেই। সুশীলবাবুই প্রস্তাব করলেন যে, এখন বেরিয়ে গিয়ে পাঞ্জাবী দোকান থেকে রুটি মাংস খেয়ে সংগীত সম্মিলনীতে বসা যাক। রাত দুটো পর্যন্ত ওখানে সময় কাটিয়ে একটা ট্যাক্সি নিয়ে সুবোধবাবুর বাড়ি গেলেই হবে। ততক্ষণে নিশ্চয় অনেকখানি লেখা এগিয়ে থাকবে।
সুশীলবাবুর প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সুবোধবাবুর কথা অনুসারে যদি রাত দশটা থেকেও লেখা শুরু করে থাকেন তাহলে রাত দুটোর মধ্যে অন্তত অর্ধেক লেখা তৈরী থাকবে, সে-লেখা নিয়ে ওই ট্যাক্সিতেই প্রেস-এ চলে এলেই হবে। বাকীটা আবার ভোর বেলা গিয়ে নিয়ে এলেই হল। সমস্যার কত সহজ সমাধান।
অফিস থেকে বেরিয়ে ভবানীপুরের এক পাঞ্জাবীর দোকানে বসে তিনজনে তড়কা মাংস আর রুটি খেয়ে ভারতী সিনেমায় গিয়ে গাট হয়ে বসলাম, তখন রাত দশটা হবে। কার যেন একটা কথক নাচ হয়ে যাবার পর ওস্তাদ বিলায়েৎ খাঁ আসরে এসে বসলেন। এমদাদ খাঁ-এনায়ৎ খর ঘরানার বিখ্যাত খাম্বাজ ধরলেন সেতারে। মন্ত্রমুগ্ধের মত বাজনা শুনছি, সুরের মায়াজাল বিস্তার করে আলাপের পর গৎ বাজিয়ে যখন শেষ করলেন তখন রাত দেড়টা। জনাকীর্ণ প্রেক্ষাগৃহ সমস্বরে আবেদন জানাল ঠুংরি, ঠুংরি। মৃদু হেসে আবার সেতারটি কোলের উপর তুলে নিলেন ওস্তাদ বিলায়েৎ খা। সবাইকে চমকে দিয়ে সুর ধরলেন রবীন্দ্রনাথের গানের-ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। গানের প্রথম ছত্রের সুরটি নিয়ে কত রকমের কাজ, কত বিচিত্র নক্শা তুলে বিস্ময়ের পর বিস্ময় সৃষ্টি করে চললেন যাদুকরের মত।
খাঁ সাহেবের বাজনার সুর ও ছন্দে যখন সবকিছু ভুলে যেতে বসেছি, সুশীল রায় কানের কাছে মুখ এনে বললেন—দুটো বাজতে আর দশ মিনিট বাকি, এবার উঠতে হয়।
চমকে উঠেছি। তাই তো! সেতারের তান-কর্তবের সঙ্গে তখন কেরামউল্লার তবলার কেরামতি চলেছে, উত্তর প্রত্যুত্তর। তবু উঠে আসতে হল। সুশীলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে এসেই ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। গোল পার্ক পার হয়ে ঢাকুরিয়া লেভেল ক্রসিং-এর দিকে কিছুটা এগিয়ে এসেই বাঁদিকের রাস্তাটা শেষ হয়েছে কাকুলিয়া রোডের উপর পড়েই। ট্যাক্সিটা ওখানে দাড় করিয়ে রেখে দুজনে ডানদিকে এগিয়ে গেলাম। নিস্তব্ধ নিঝুম পাড়া, অস্পষ্ট চাদের আলো গাছ পালার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এলে, পড়েছে।
সুবোধবাবু থাকতেন একটা দোতলা বাড়ির উপর তলায়। পুব দিকের ঘরটা রাস্তা থেকেই দেখা যায়, সেই ঘরে বসেই লেখাপড়া করেন। পুব দিকের জানালা ছুঁয়ে একটা পেয়ারা গাছ, গরাদের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়ালেই কচি পাতার স্পর্শ পাওয়া যায়।
ট্যাক্সি থেকে নেমেই কল্পনায় একটা মধুর ছবি ফুটে উঠল। চারদিকে গভীর রাত্রির স্তব্ধতা, সুবোধবাবু লিখবার টেবিলে শান্ত সমাহিত চিত্তে লিখে চলেছেন। পুব জানালা দিয়ে ইলেকটিকের আলোটা এসে পড়েছে পেয়ারা গাছটার কচি পাতার উপর।
সুবোধবাবুর বাড়ির সামনের সরু গলিটার ভিতর মোড় নিয়েই দোতলা বাড়িটার পুব দিকের খোলা জানালাটার দিকে তাকালাম। অন্ধকার জানালা। সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির সব অন্ধকার যেন আমার উপর পাথরের মত জমাট বাঁধতে লাগল। বিশ্রী একটা আশঙ্কায় আমার সমস্ত শরীর শিথিল হয়ে এসেছে। সুশীলবাবুর দিকে তাকালাম, তাঁর চোখে-মুখেও সন্দেহের ছায়া। সন্দেহ আর কিছুই নয়, সুবোধবাবু কি তাহলে কিছুই লেখেন নি?
একতলায় সিঁড়ির দরজার কড়াটা খটখট করে কয়েকবার নাড়লাম, উপর থেকে কোন সাড়া শব্দ নেই। অবশেষে মরিয়া হয়ে ডাক ছাড়লাম–
সু বো ধ বা বু—
নাম ধরে ডাক নয়, যেন বুক ঠেলে একটা হাহাকার রুদ্ধশ্বাস কষ্ট ঠেলে বেরিয়ে এল। পাড়ার লোক মনে করল হয়তো কোন সদ্যমৃত আত্মীয় বন্ধুর সংবাদ নিয়ে কেউ ডাকাডাকি করছে।
বার তিন চার ডাকাডাকির পর হঠাৎ দোতলার ভিতর থেকে আলোর রেখা দেখা দিল পেয়ারা গাছটার কচি পাতার উপর। পরমুহূর্তেই দোতলার সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নেমে-আসা চটিজুতোর আওয়াজ পাওয়া গেল। একতলার সিঁড়ির দরজাটা খুলেই সুবোধবাবু আমাদের দুজনকে দেখে চমকে উঠলেন, যেন ভূত দেখছেন। পরনে লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। সুবোধবাবু কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে।
রাত দুটোর সময় এমন অতর্কিতে ওঁর বাড়িতে হানা দিতে পারি এটা যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। উভয়ের মুখে কোন কথা নেই, সুশীলবাবুও স্তব্ধ হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে।
সুবোধবাবুই মুখ খুললেন। বললেন—রাস্তার মোড়ে চলুন সব বলছি।
মোড়ে ট্যাক্সিটাকে যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম সেখানে তিনজন নিঃশব্দে এসে দাঁড়ালাম। সুবোধবাবু বেদনাভরা চাপা গলায় বললেন–এবার আমাকে ক্ষমা করুন। আমি পারব না, পারলাম না।
আমি নিরুত্তর। মনে হচ্ছিল আমার পায়ের তলা থেকে যেন মাটি সরে যাচ্ছে। কত আশা ভরসা উৎসাহ নিয়ে এসেছিলাম, ফুংকারে তা নিবে গেল।
ট্যাক্সির শিখ ড্রাইভার অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে, ছাড়া পাবার জন্য ব্যস্ত। সুবোধবাবুর কথার কোন জবাব না দিয়ে আমি ড্রাইভারের ভাড়া চুকিয়ে দিলাম। ট্যাক্সি ধরে রেখে আর কী লাভ। ততক্ষণে মনে মনে একটা সংকল্প করে ফেলেছি। কাছেই তো লেক। ঘণ্টা দুই সময় লেকের ধারে কাটিয়ে দিয়ে শেষ রাত্রের প্রথম ট্রাম ধরে অফিসে ফিরে যাব। আগের যা কম্পোজ ম্যাটার দু-একটা আছে তাই দিয়ে পাতা ভরাট করে সকাল বেলায় ফর্মা গৌরাঙ্গ প্রেস-এ পাঠিয়ে দিয়ে এ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি নেব। সুবোধবাবুর মুখের দিকে তাকালাম। লজ্জায় ও বেদনায় ওঁর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কথা না রাখতে পারার যন্ত্রণায় যে ওঁর মন কতখানি ক্লিষ্ট তা বুঝবার অবকাশ পাই নি। পরাজয়ের গ্লানিতে আমার মন আচ্ছ, ওঁর দিকটা ভেবে দেখবার মত বিচারবোধ তখন আমি হারিয়েছি।
লেখা যখন পেলামই না এবং পাবার আর কোন সম্ভাবনাও যখন নেই তখন এই মাঝরাতে সুবোধবাবুর ঘুম ভাঙ্গিয়ে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখার কোন অর্থ হয় না। এই অপ্রীতিকর অবস্থা থেকে এঁকে রেহাই দেবার জন্য বললাম-আপনি যান সুবোধবাবু, অসময়ে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে অপরাধ করেছি, কিছু মনে করবেন না।
আমার বলার ধরনটায় বোধ হয় একটু প্রচ্ছন্ন অভিমান ছিল। সুবোধবাবু বেদনাহত কণ্ঠে বললেন–আমাকে ভুল বুঝবেন না সাগরবাবু। আপনাকে লেখা দিতে না পারার যন্ত্রণা আমার কিছু কম নয়। কিন্তু কী যে হল, কিছুই ভাবতে পারছি না, লিখতে পারছি না। কতবার লিখবার সংকল্প নিয়ে বসেছি, এক লাইনও লিখতে পারি নি। আবার অনুরোধ করছি, আমাকে আপনি ভুল বুঝবেন না।
এরপরে আর কী বলা যায়। সুবোধবাবুর অসহায় অবস্থাটা এতক্ষণে হৃদয়ঙ্গম করলাম। আমরা দুজনে আবার ওকে বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছি, এবার সুশীলবাবুর কাছ থেকে আমার বিদায় নেবার পালা। কিন্তু এই গভীর রাত্রে আমাকে একলা কিছুতেই ছাড়তে চাইলেন না। জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন ওঁর বাড়িতে। বসবার ঘরে আমার জন্য বিছানার বন্দোবস্ত করে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন, যাবার সময় শুধু বলে গেলেন–
সকালে না জানিয়ে এবং চা না খেয়ে কিন্তু চলে যাবেন না।
রাত তখন তিনটা। চোখে ঘুম নেই। গত একমাস ধরে শারদীয়া সংখ্যার জন্য যে চিন্তা ভাবনা পরিশ্রম করে এসেছি, শেষ দিনের এই নিষ্ফল হতাশা সব ব্যর্থ করে দিয়েছে। মনের মধ্যে ধিক্কার দেখা দিল। ছি ছি ছি—শেষকালে সামনের দিকের ওই আটটা পৃষ্ঠা কিনা কতকগুলো বাজে ম্যাটার দিয়ে ভরাতে হবে? ওদিকে প্রিন্টার আমার অনুরোধে পাঁচটা কম্পোজিটরকে বসিয়ে রেখেছেন। আশা করে আছেন এই মুহূর্তেই আমি লেখা নিয়ে হাজির হব। ওদের কাছেই বা সকালে মুখ দেখাব কী করে? আর গৌরাঙ্গ প্রেসের প্রভাতবাবু? টেলিফোনে গলা ফাটিয়ে বলবেন—
সুবোধবাবুর গল্পই যদি আদায় করতে না পারলেন তাহলে ফর নাথিং ফর্মা আটকে রাখলেন কেন? অর্থাৎ আমি যে এতবড় একটি পত্রিকার সম্পাদনা কার্যের দায়িত্ব গ্রহণে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত এদের সবার কাছে তা আরেকবার প্রমাণিত হয়ে যাবে।
ঘরের দেওয়াল-ঘড়িটায় & ঢং করে চারটে বাজল, যেন চার বার হাতুড়ির ঘা পড়ল আমার মাথায়। এক ফোঁটা ঘুম নেই চোখে, ব্যর্থতার জ্বালায় আমার চোখ জ্বলছে! ঘুম আসবে কেন?
আরেকজন? যাকে মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে রাস্তায় টেনে এনে আবার বাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছি তিনিও আমারই মতন আর এক যন্ত্রণায় ঘরময় শুধু পায়চারি করছেন আর ঘুমাতে পারেন নি। ঘরে ফিরেই গৃহিণীকে দিয়ে খবরের কাগজ পুড়িয়ে চা তৈরী করিয়ে ছিলেন, চা খেয়ে যদি লেখায় মন বসে। এ কথা আমি পরদিন শুনেছিলাম সুবোধবাবুর কাছেই।
দেয়াল ঘড়িটা আবার ঢং করে বেজে উঠল। সাড়ে চারটা বেজেছে। এবার আমাকে যেতে হবে। ট্যাক্সি যদি না পাই তবে শেষ রাতের প্রথম ট্রামটা ধরেই রওনা দিতে হবে অফিসের পথে। দুঃখের রাত্রির অবসানই আমি তখন চাইছিলাম।
সুশীলবাবুর বাড়ির বুড়ি ঝি সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠে উঠোনে উনুন ধরাবার তোড়জোড় করছে দেখতে পেয়ে নিঃশব্দে কাউকে কিছু না জানিয়ে বৈঠকখানা ঘরের দরজা খুলে রাস্তায় নেমে পড়লাম।
গড়িয়াহাট বাজারের সামনে এসে এসপ্ল্যানেডগামী প্রথম ট্রামটাই পেয়ে গেলাম। গঙ্গাস্নানার্থী বৃদ্ধের দল সমস্বরে এবং তারস্বরে চৌতালে শ্যামাসঙ্গীত গাইতে গাইতে চলেছেন। এটা তাদের নিত্যকর্ম।
এসপ্ল্যানেড থেকে ট্রাম বদলি করে যখন বর্মণ স্ট্রীটে এসে পড়েছি তখন সোয়া পাঁচটা বেজেছে। ভোরের আলোয় সবেমাত্র মহানগরী জেগে উঠেছে, রাত্রি জাগরণ-ক্লান্ত শরীরটা কোন রকমে বয়ে নিয়ে এসেছি। চোখে-মুখে জল পর্যন্ত দেওয়া হয় নি, চুল অবিন্যস্ত, জামাকাপড়ের দিকে তাকানো যায় না। গতকাল সকালে মন্মথবাবুকে আনন্দবাজার পত্রিকা অফিসের গেট এর সামনে ঠিক এই অবস্থাতেই দেখেছিলাম। কিন্তু তার অন্তর ছিল সকল সার্থক শ্রমের আত্মতৃপ্তিতে ভরা। আর আমার? গেট দিয়ে ঢুকেই বাঁ-হাতে প্রেস। না। প্রেস-এ নয়, প্রেস-এ এখন যাব না। রাত দুটো থেকে প্রিন্টার বোধ হয় পাগলের মত আমার খোঁজ করেছেন। এখন দেখা করলেই ভুরু আর গোঁফের দ্বৈত তাণ্ডবনৃত্য শুরু হয়ে যাবে। তার চেয়ে মেক-আপ ম্যানকে ডেকে পাঠিয়ে যা করণীয় তাকেই বুঝিয়ে দেব। একতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে একটা সাঁকো পার হতে হয়। সেই সাঁকো পার হবার সময় পূর্ব প্রান্তে আমার ঘরের দরজাটা দেখা যায়। বরাবরের অভ্যাস মত সেদিকে চোখ ফেরাতেই চমকে উঠলাম। আমার ঘরের দরজা খোলা। কেন?
সাঁকোর মাঝখানে স্তব্ধ-বিস্ময়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করলাম এত ভোরে কে আসতে পারে। আমার ঘরের ছোকরা অমরের সকালে আসবার কথা, কিন্তু এত ভোরে তো নয়! তাহলে প্রিন্টার সুরেনবাবু কি আমাকে ধরবার জন্যে গ্যাঁট হয়ে আমার ঘরেই বসে আছেন?
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন আর পরিশ্রান্ত দেহ আমার ক্লান্ত পা দুটোর উপর ভর করে লম্বা করিডর পার হল। এবার আমার ঘরের সামনে এসে হাজির। একটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতির সম্মুখীন হবার জন্য নিজের মনকে প্রস্তুত করে দরজায় পা দিতেই আমি চমকে উঠলাম। এ কী, এ কাকে দেখছি! এ যে আমার কল্পনার অতীত! সুবোধবাবু আমার পাশের টেবিলটায় বসে একাগ্রচিত্তে খখস করে লিখে চলেছেন, ঘরের এক কোণায় অমর চুপচাপ বসে।
গভীর আবেগে আমার সমস্ত দেহমন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে, একটা পুলক শিহরণ বিদ্যুতের মত আমার শরীরের ভিতর দিয়ে খেলে গেল। সুবোধবাবুর দিকে আমি তাকিয়ে আছি, সুবোধবাবুও একবার মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। স্নিগ্ধ মধুর প্রসন্ন হাসিতে সে-মুখ ভোরের আলোর মতই উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। আবার তিনি লেখায় ডুবে গেলেন। কোন বাক্য বিনিময় নয়, সেই প্রশান্ত হাসিতেই জানিয়ে দিলেন—আর ভাবনা নেই, লেখা আপনি পাবেনই।
বিগত রাত্রির যত গ্লানি আর ব্যর্থতা আমার অন্তরকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল তা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে গেল এক মুহূর্তে, বিপুল আনন্দের আবেগ আমার দুই চোখ দিয়ে অশ্রুধারায় নেমে এল। আনন্দা কথাটার সঙ্গে পরিচিত ছিলাম, তাকে অন্তর দিয়ে অনুভব এর আগে কখনও করি নি।
এই আবেগোচ্ছাস আমি দমন করতে পারি নি। ঘরে ঢুকেই সুবোধবাবুকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি, আমার দুই চোখে জলধারা।
এ কি, আপনি যদি এরকম সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েন তাহলে আমার অবস্থাটা ভাবুন, আমি লিখব কি করে? একটা আবেগবুদ্ধ চাপা গলায় সুবোধবাবু বললেন।
পুব দিকের খোলা জানালা দিয়ে শরতের নির্মেঘ নীলাকাশে চোখ পড়ল, সোনার আলোয় চারিদিক উদ্ভাসিত।
অমরকে দুটো টাকা দিয়ে বললাম-যা, দৌড়ে গিয়ে গরম গরম সিঙ্গাড়া কচুরি আর মিষ্টি কিনে আন, সেই সঙ্গে চা-ও বলে আসবি।
অমর প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল, যাবার সময় সুবোধবাবুর কাছ থেকে ১৫ নম্বর পিটাও নিয়ে গেল প্রেস-এ দেবার জন্যে।
অমর চলে যেতেই সুবোধবাবু বললেন–রাত সাড়ে চারটার সময় জামা-কাপড় পরে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। বাড়িতে বসে কিছুই যখন লিখতে পারলাম না, তখন অফিসে গিয়ে একবার শেষ চেষ্টা করা যাক। গোলপার্কে এসে একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। অফিসে এসে আপনার ঘরে দেখি টেবিলে পত্রিকার ফাইল মাথায় দিয়ে অমর শুয়ে আছে।
আমি বললাম-অমরকে সকাল সাতটায় আসতে বলেছিলাম। কিন্তু ও শুনে গিয়েছিল যে রাত দুটোর সময় আপনার বাড়ি থেকে লেখা নিয়ে প্রেস-এ দেব। পাছে আমার কোন অসুবিধা হয় সেই জন্যেই বোধ হয় বাড়ি গিয়ে এ-ঘরেই শুয়েছিল।
সুবোধবাবু আবার লেখায় ধ্যানস্থ হলেন। একটা করে স্লিপ লেখা হয়, অমর সেটা তৎক্ষণাৎ প্রেস-এ দিয়ে আসে। প্রিন্টার সুরেনবাবুর অবস্থা যেন একটা ভূতে পাওয়া মানুষ। পাচ হাতে কম্পোজ ধরিয়ে প্রেসময় ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন। দেখতে দেখতে বেলা দশটা বাজল, অফিসে শোরগোল শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘনঘন গৌরাঙ্গ প্রেস থেকে টেলিফোন আসছে। প্রভাতবাবুর ওই এক কথা—দুটোর মধ্যেই ফর্মা কিন্তু চাই।
ওদিকে ঝড়ের মত হইহই করতে করতে ঘরে ঢুকলেন সাকুলেশন ম্যানেজার ভূপেনদা।
এই যে সাগরময়বাবু, তুমি তো দেখছি ভাই ডুবিয়ে দিলে। এখনও ফর্মা ছাড় নি, দপ্তরীরা হাত গুটিয়ে বসে আছে। লেট যদি হয় কাগজ এক কপিও বিক্রি হবে না।
বেলা যতই বাড়ছে ঘরে জনসমাগমও বেড়ে চলেছে। কেউ সহানুভূতি, কেউ বিস্ময়, কেউ আশঙ্কা জানাচ্ছেন, তারি মধ্যে কাজও চলেছে পুরোদমে। সুবোধবাবু লিখেই চলেছেন। পর্বতের মত ধীর স্থির অচঞ্চল, কলম চলেছে বিদ্যুৎগতিতে।
বেলা বারোটার সময় গল্পের শেষ স্লিপটা প্রেস-এ দিয়ে যখন অমর ফিয়ে এল তখন আর তার দাঁড়াবার শক্তি নেই। বেচারি নব্বইবার সিঁড়ি ভেঙ্গে প্রেস-এ গিয়েছে আর এসেছে। সুবোধবাবু সেবার নব্বই স্লিপ লিখেছিলেন।
থির বিজুরী গল্প লেখার ইতিহাস হচ্ছে এই। যে সময়ের মধ্যে, যে মানসিক অবস্থায় এবং পরিবেশে এ গল্প লেখা হয়েছিল তাকে আমি সুবোধবাবুরু পক্ষে অলৌকিক কীর্তি ছাড়া আর কী বলতে পারি।