তেইশ
সন্ধ্যে পার হয়ে গেলে এই ঘরে অদ্ভুত শান্তি বিরাজ করছিল। মাধবীলতা রান্না শেষ করে খাটের ওপর বাবু হয়ে বসেছিল। অনিমেষ বালিশে কনুই রেখে একটু তফাতে। নিচে দেওয়ালে হেলান দিয়ে অর্ক বই মুখে। সন্ধ্যের মুখেই পরমহংস চলে গিয়েছে। কথা হয়েছে আগামীকাল বিকেলে মাধবীলতা এবং অর্ক গ্রে স্ট্রীট চিৎপুরের মুখে পরমহংসের সঙ্গে দেখা করে বাড়ি দেখতে যাবে। পছন্দ হলে কালকেই পাকা কথা হয়ে যাবে।
অনিমেষ মাধবীলতার মুখের দিকে তাকাল। একটু যেন অন্যরকম দেখাচ্ছে এখন। একটা চাপা খুশির জ্যোতিতে মাখামাখি চিবুক, ঠোঁটের কোণ, চোখের কোল। সে কথা তুলল, ‘তাহলে আমাদের বস্তিজীবন শেষ!’
‘দাঁড়াও। না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’
‘না। পরমহংস যখন নিজে থেকে বলে গেল তখন নিশ্চিন্ত থাকতে পার।’
‘কিন্তু এত সস্তায় কলকাতায় ফ্ল্যাট পাওয়া যায়? কি জানি। অবশ্য অন্য রকম মানুষ এখনও আছে। সেদিন একটা ঘটনা শুনলাম স্কুলে। আমার এক কলিগের হাসব্যাণ্ড তিন কাঠা জমি কিনবেন বলে কলকাতা চষে বেড়াচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই দরে পেরে উঠছেন না। ছ’ মাসের মধ্যে বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে ওঁদের। এই সময় ভদ্রলোক খবর পেলেন লেক টাউনে একজন জমি বিক্রি করবে। যেহেতু ওখানকার জমির দর সত্তর আশী হাজার কাঠা তাই ওপথে মাড়ালেন না ভদ্রলোক। দিন পনের বাদে দমদম পার্ক থেকে একটা জমি দেখে ফেরার পথে কি মনে করে লেক টাউনে নামলেন উনি। কিনতে পারবেন না তবু জমিটা না হয় চোখেই দেখা যাক, এইরকম ভাব। গিয়ে শুনলেন জমিটা দিন পাঁচেক আগেই বিক্রি হয়ে গিয়েছে। যাঁর জমি তিনি বৃদ্ধ। স্ত্রী মারা গেছেন। দুই ছেলে বিদেশে থাকে, তারা বুড়ো বাবাকে সেখানে নিয়ে যেতে চায়। অতএব এখানকার সব সম্পত্তি বিক্রি করে দিচ্ছেন ভদ্রলোক। তিন কাঠা দেওয়াল-ঘেরা জমি, রাস্তার গায়ে। খুব ক্যাজুয়ালি উনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কি রকম দরে দিলেন?’
‘দর?’ বৃদ্ধ নাকি মাথা নেড়েছিলেন, ‘দর আবার কি? যে দরে কিনেছিলাম সেই দরেই দিয়েছি। পাঁচ হাজার পার কাঠা। আমি তো আর জমি নিয়ে ব্যবসা করতে বসিনি যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা চাইবো? তাছাড়া টাকা নিয়ে আমি করবই বা কি?’ শুনে আমার কলিগের হাসব্যাণ্ডের এত আফসোস হচ্ছিল যে ভদ্রলোক দু’রাত ঘুমোতেই পারেননি। মাধবীলতা ঘটনাটা বলে হাসল, ‘তাহলে বোঝ, এখনও অন্য রকম মানুষের অস্তিত্ব আছে পৃথিবীতে। এই বাড়িওয়ালাও বোধ হয় সেইরকম।’
অনিমেষ মাথা নাড়ল, ‘আসলে পরমহংসের বিশেষ পরিচিত বলে আমরা এত কমে পাচ্ছি। নইলে আট দশ হাজার সেলামি চেয়ে বসত।’
মাধবীলতা মুখ ফিরিয়ে অর্ককে দেখল। শোভাবাজারে গেলে এবার ওর পড়াশুনার দিকে ভাল করে নজর রাখতে হবে। একটা বছর নষ্ট হয়েছে, কুসঙ্গে পড়ে মন বেশ অনেকখানি বিক্ষিপ্ত হয়েছে। স্কুলের ধরা বাঁধা নিয়মে ফিরে যাওয়া বেশ মুশকিল। কিন্তু ছাত্র হিসেবে অর্ক বুদ্ধিমান, ধরিয়ে দিলে চটপট বুঝে ফেলে। মাধবীলতার মাথায় অন্য একটা পরিকল্পনা এল। কিন্তু এখন নয়, শোভাবাজারে গিয়ে সেটা চিন্তা করা যাবে। আর তখনই অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর স্কুলের কি করবে?’
‘সেটাই ভাবছি। এখন, এই বছরের মাঝখানে কোন স্কুলে ওকে নেবে না। তা শোভাবাজার এমন কিছু দূরে নয়, যাতায়াত করবে।’ মাধবীলতা অন্যমনে বলল।
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘কিন্তু কিভাবে ম্যানেজ করবে?’
‘মানে?’ মাধবীলতা চোখ তুলল।
‘কদিনে বেশ ভাল খরচ হয়েছে, অ্যাডভান্সের টাকা দেবে কি করে? তাছাড়া মাসে মাসে একশ পঁচাত্তর, কি করে পারবে?’
‘সে হয়ে যাবে। সুপ্রিয়ার লোনটা শেষ হয়ে গেলে আর চিন্তা করতাম না। যাহোক করে হয়ে যাবে। তুমি এ নিয়ে ভেবো না।’
‘আমি একটা উপায় ভেবেছি।’
‘কি?’
‘শোভাবাজার তো মোটামুটি ভদ্র এলাকা। আমি যদি বাড়িতে বসে টিউশনি করি। এই ধরো সাধারণত যা রেট তার চেয়ে কম নিলে মনে হয় ছাত্রছাত্রী পাওয়া যেতে পারে। প্রথম প্রথম অসুবিধে হবে কিন্তু, কিন্তু তুমি আমাকে হেলপ করো।’
‘তুমি পড়াবে?’ মাধবীলতার মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
‘হ্যাঁ। আরে বাবা এম-এ পর্যন্ত তো পড়েছিলাম, পড়িনি?’
এবার মাধবীলতার মনে হল অনিমেষ ঠিকই বলছে। এইভাবে ঘরে বসে থাকলে শরীর এবং মন দ্রুত ভেঙ্গে পড়বে। তার চেয়ে একটা কাজ নিয়ে থাকলে ওরও সময়টা ভাল কাটবে, মনও ব্যস্ত থাকবে আর যদি তা থেকে কিছু আসে তাহলে সংসারের সাশ্রয় হবে। মাধবীলতা হাসল, ‘বেশ।’
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘আজকাল টিউশনির রেট কি রকম?’
মাধবীলতা জোরে হেসে উঠল। অনিমেষ কিঞ্চিত অপ্রস্তুত চোখে তার দিকে তাকাল। অর্কও ঘাড় ফিরিয়েছে। হাসতে হাসতে মাধবীলতা হাত নাড়ল, ‘তোমার জন্যে নয়, কথাটা শুনে আমার আর একটা কথা মনে পড়ল। শ্যামবাজারে যে মেয়েটি বাড়ির রান্নাবান্নার কাজ করে সে পায় পঞ্চাশ টাকা। বালিগঞ্জ আলিপুরে তার দক্ষিণা দুই আড়াইশো। তাই শুনে একজন টিচার বলেছিল, চল ভাই, আমরা দল বেঁধে সাউথের স্কুলে চাকরি খুঁজি, চার পাঁচগুণ মাইনে বেড়ে যাবে নির্ঘাৎ।’
হাসি সংক্রামিত হল। এবং তার মধ্যেই অর্ক বলে উঠল, ‘আমাদের ক্লাশের একটা ছেলেকে ইংরেজির স্যার পড়ান, মাসে দুশো নেন, সপ্তাহে দুদিন।
অনিমেষ বলল, ‘অত চাই না, বাড়িতে এসে পড়লে আমি যদি ষাটও নিই তাহলে তিনজনেই বাড়িভাড়াটা উঠে আসবে। কি বল?’
মাধবীলতা হাত নাড়ল, ‘আচ্ছা, তুমি কি! যখন কল্পনাই করছ তখন বেশ বড় করে কল্পনা করতে পার না? এই ধরো তুমি প্রত্যেকটা ছাত্রের কাছ থেকে দেড়শ করে নেবে, সকাল বিকেলে দশজন করে ছাত্র তিন দিন পড়বে। তার মানে চল্লিশজন মাসে। অর্থাৎ তোমার ইনকাম মাসে ছয় হাজার টাকা। আমাকে আর চাকরি করতে হবে না, ঝি চাকর রেখে পায়ের ওপর পা তুলে সংসার করব।’
অর্ক ফুট কাটল, ‘গাড়ি কিনবে না?’
‘ওটা তোর টাকায় কিনব।’ মাধবীলতা ছেলের দিকে তাকিয়ে কপট গলায় বলল, ‘পড়াশুনা বাদ দিয়ে আমাদের কথা শোনা হচ্ছে?’
এই সময় বাইরে কেউ ডেকে উঠল, ‘অর্ক, অর্ক আছ?’
ওরা তিনজনেই দরজার দিকে তাকাল। বয়স্ক কণ্ঠস্বর এবং বেশ ভদ্র। অর্ক এক লাফে দরজার কাছে পৌঁছে পাল্লা খুলল। সতীশদা দাঁড়িয়ে।
‘তোমার বাবা আছেন অর্ক?’
‘হ্যাঁ। কি ব্যাপার? বেশ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অর্ক। এই বস্তির কেউ কখনও কোন প্রয়োজনে অনিমেষের সঙ্গে দেখা করতে আসে না। কারণ সেই প্রয়োজনটাই কারো হয় না। সতীশদার সঙ্গে বিকেলে দেখা হয়েছিল। তখনও এই বাড়িতে আসার কথা বলেনি।
‘ওঁর সঙ্গে আমার কথা ছিল। উনি কি শুয়ে পড়েছেন?’
ভেতর থেকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, ‘কে রে?’
অর্ক মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘সতীশদা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে।’
মাধবীলতা খাট থেকে নেমে বলল, ‘নিয়ে আয়, বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিস কেন? আসুন।’ বাইরে চটি ছেড়ে সতীশদা ঘরে ঢুকতে মাধবীলতা চেয়ারটা বাড়িয়ে দিল। যেন দুজনকেই একসঙ্গে নমস্কার করল সতীশদা, ‘আমাকে বোধহয় আপনারা চিনবেন না।’
মাধবীলতা বলল, ‘আপনাকে দেখেছি, নাম শুনেছি আলাপ হয়নি।’
সতীশ হাসল, ‘সেটা অবশ্য আমার দোষ। আমি অনিমেষবাবুর কথা ভাসা ভাসা শুনেছিলাম। ভেবেছিলাম, আমার আসা হয়নি।’
মাধবীলতা বলল, ‘গেল ভোটের সময় অবশ্য আপনার দলের ছেলেরা এসেছিল। আমি অবশ্য জানি না আপনি কি শুনেছেন।’
অনিমেষের এই ধরনের কথাবার্তা পছন্দ হচ্ছিল না। সে বলল, ‘বসুন।’
সতীশ বসল। তারপর অনিমেষের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমি জানি না, আমাদের সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি রকম।’
‘কি রকম মানে?’ অনিমেষ সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করল।
‘আমি আমাদের দলের কাজকর্মের কথা বলছি।’
‘ও। দেখুন, আমি ইনভ্যালিড লোক। ঘর থেকে বের হতে কষ্ট হয়। খবরের কাগজ পড়ে আর এদের কথাবার্তা শুনে যেটুকু ধারণা করা সম্ভব তার বেশী হতে পারে কি করে!’ অনিমেষ সতীশের মুখের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল। হঠাৎ ও কেন এল তা বোধগম্য হচ্ছিল না।
‘হ্যাঁ, আমি আপনার শরীরের কথা শুনেছি আপনি কি একেবারেই চলাফেরা করতে পারেন না? গলিতে তো বের হন।’
‘ওইটুকুই। বাতিলের দলে ফেলতে পারেন।’
সতীশ একটু ভাবল, ‘খবরের কাগজ যে সব সময় সত্যি কথা লিখবে তা আমরা আশা করতে পারি না। তাছাড়া আপনি জানেন, এদেশের খবরের কাগজগুলো বুর্জোয়া মালিকদের সম্পত্তি। ওরা আমাদের সমর্থন করবে এ আশা করা অন্যায়। তাই কাগজ পড়ে আপনার সঠিক ধারণা নাও হতে পারে।’
অনিমেষ হেসে বলল, ‘আপনারা তো অনেক বছর ক্ষমতায় এসেছেন, তা একটা স্বাধীন সত্যনিষ্ঠ কাগজ বের করতে পারছেন না কেন?’
‘চেষ্টা চলছে। কিন্তু এতদিনের যে সিস্টেম তা রাতারাতি পাল্টানো যাবে কি করে! মানুষ একবার যাতে অভ্যস্ত হয়ে যায় তা থেকে সরে আসতে চায় না। আমাদের সামাজিক জীবনে এমন অনেক কাণ্ড করি যার কোন মানে নেই, কোনও উপকার হয় না তবু অভ্যেস করে যাই। এই যেমন ধরুন, তারকেশ্বরে জল নিয়ে হেঁটে যাওয়া। আপনি বোঝাতে গেলে হই হই পড়ে যাবে, ধর্মে হাত দিচ্ছেন বলে। প্রচণ্ড খরার সময় যদি বলি তারকেশ্বরে না গিয়ে হাঁড়িতে জল বয়ে বর্ধমান বীরভূমের মাটিতে ঢেলে দাও তাহলে কেউ শুনবে না। ভেবে দেখুন, লক্ষ লক্ষ হাঁড়ির জল খরার মাটিতে পড়লে পরের বছর বাজারে চালের অভাব হত না। আসলে ওই অভ্যেস, সংস্কার। এর মধ্যে আমরা, যারা কিছু করতে চাই তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। যাঁরা সমালোচনা করছেন তাঁরা তো কিছুই করছেন না।’ সতীশ কথা শেষ করে ঝোলা ব্যাগটাকে কোলের ওপর টেনে নিল।
অনিমেষ বলল, ‘এসব কথা আমাকে বলছেন কেন আমি বুঝতে পারছি না।’
‘কারণ আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’
‘আমার সাহায্য?’ হেসে উঠল অনিমেষ, ‘আপনি সুস্থ তো?’
‘ঠিক বুঝলাম না!’ সতীশের মুখে ছায়া ঘনালো।
‘আমার মত একটা বাতিল অথর্ব মানুষকে আপনি সাহায্য করতে বলছেন! ব্যাপারটা কি হাস্যকর শোনাচ্ছে না?’ অনিমেষ মুখ ফেরালো।
সতীশ হেসে ফেলল এবার, ‘আপনি অযথা নিজেকে ছোট করছেন। আপনার শরীর সুস্থ নয় কিন্তু বোধবুদ্ধি তো একটা সাধারণ মানুষের চেয়ে বেশী, সেই কারণেই আপনার সাহায্য আমাদের প্রয়োজন।’
‘কি করে বুঝলেন?’ অনিমেষের গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।
‘কারণ আপনি আঘাত পেয়েছেন, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন। অনেক কিছু দিয়ে আপনি অভিজ্ঞ হয়েছেন। আমি শুনেছি আপনি নকশাল আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছিলেন। মার্কসিজমে বিশ্বাস করতেন। এখন এভাবে নিজেকে ফুরিয়ে না ফেলে আমাদের পাশে দাঁড়ান।’
অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাল। মাধবীলতা একপাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ শুনছে। সতীশ একটু থেমে আবার বলল, ‘বস্তি এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা আমরা পাল্টাতে পারিনি। এখানকার ছেলেদের আচার আচরণ কথাবার্তা মাঝে মাঝে অসহনীয় হয়ে ওঠে। পার্টির সঙ্গে সামাজিক মানুষের এখনও বেশ দূরত্ব রয়ে গেছে। সেইটে দূর করতে চাই।’
অনিমেষ অলস গলায় বলল, ‘আপনার কথা শুনলাম, ভেবে দেখব।’
সতীশ খানিকটা সন্দিগ্ধ চোখে অনিমেষকে দেখল। তারপর একটু ইতস্তত করে বলল, ‘আপনার কাছে আর একটা ছোট্ট অনুরোধ আছে।’
‘বলুন।’
‘আজ ন’টা নাগাদ একবার আমাদের পার্টির অফিসে আসতে হবে। বেশী দূর নয়, আপনি যদি বলেন আমরা রিক্শা করে নিয়ে যেতে পারি।’
কথাটা শুনে মাধবীলতা অবাক হয়ে বলল, ‘এই রাত্রে?’
‘হ্যাঁ, ন’টার সময়, বেশী রাত তো নয়।’
অনিমেষ বলল, ‘কেন, আমাকে পার্টি অফিসে যেতে বলছেন কেন?’
সতীশ এবার নড়েচড়ে বসল, আজ রাত্রে একজন মন্ত্রী কয়েকটা ব্যাপারে কথা বলবেন বলে পার্টি-অফিসে আসবেন ঠিক ছিল। উনি যদিও পাশের এলাকার এম এল এ কিন্তু ওঁকে আমাদের প্রয়োজন আছে। হঠাৎ খানিক আগে আমাকে খবর দিয়েছেন যে উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান। আপনার সমস্ত হদিস দেখলাম উনি জানেন।’
প্রচণ্ড অবাক হয়ে গেল অনিমেষ। কোনরকমে বলতে পারল, ‘কে?’
‘সুদীপবাবু।’
নামটা শোনামাত্র অনিমেষ চকিতে মাধবীলতাকে দেখল। মাধবীলতার মুখেও বিস্ময়। অনিমেষ যেন নিজেকেই জিজ্ঞাসা করল, ‘সুদীপ আমার সঙ্গে দেখা করতে চায় কেন?’
‘আমি জানি না।’ সতীশ উঠে দাঁড়াল, ‘আপনারা কি সহপাঠী ছিলেন?’
‘না। তবে য়ুনিভার্সিটিতে এক সঙ্গে য়ুনিয়ন করতাম।’
‘আচ্ছা!’ সতীশের গলায় বিস্ময়।
মাধবীলতা এবার কথা বলল, ‘মন্ত্রীমশাই ওঁর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন, এটা খুব আনন্দের কথা কিন্তু ওঁর পক্ষে তো যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘কেন? সতীশ ঘুরে দাঁড়াল।
‘দিনের বেলায় অন্য কথা, রাত্রে হাঁটা অসম্ভব ওঁর পক্ষে।’
‘হাঁটতে বেশী হবে না, গলির মুখ পর্যন্ত গেলেই চলবে।’
‘না আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না।’
‘আপনারা কি ইচ্ছে করেই যেতে চাইছেন না?’
‘দেখুন, মন্ত্রীমশাই যদি ওঁকে বন্ধু মনে করেন তাহলে নিজেই আসতে পারেন।’
‘মন্ত্রী এখানে আসবেন? সতীশের গলায় উষ্মা।
‘কেন? আমরা মানুষ নই?’
‘এভাবে কথা বলছেন কেন? এরকম বস্তির মধ্যে কোন ভি আই পি নিয়ে এলে রিস্ক বাড়ে। কার কি মতলব আছে আমরা জানি না। সেরকম কিছু হয়ে গেলে সামলাবে কে? সতীশ বোঝাতে চাইল।
মাধবীলতা আর কথা বলল না। অনিমেষ সতীশকে বলল, ‘আপনি এক কাজ করুন। সুদীপ এলে বলবেন আমার পক্ষে অতদূর যাওয়া সত্যিই কষ্টকর। নিতান্ত বাধ্য না হলে আমি যেতে চাই না। ওর দরকার যদি খুব বেশী হয় তাহলে চিন্তা করা যেতে পারে।’
কথাটা বোধহয় সতীশের পছন্দ হল। সে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বেশ, তাই বলব। চলি তাহলে, আমার আগের প্রস্তাবটা ভেবে দেখবেন। চলি অর্ক।’
সতীশ বেরিয়ে যাওয়া মাত্র অর্ক এগিয়ে এসে খাটে বসল, ‘বাবা, মন্ত্রী তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে কেন?’
‘আমি কি করে বলব?’ অনিমেষ হাত ওল্টালো।
মাধবীলতা বলল, ‘তুমি আবার ঝুলিয়ে রাখলে কেন। সোজাসুজি না বলে দিলেই হত। কি দরকার না জানালে যাবে কেন?’
অনিমেষ তখন অন্য চিন্তা করছিল। ওর মনে হল, সতীশ যে এসে তার কাছে সাহায্য চাইছে সেটার পেছনে হয়তো সুদীপ আছে। কিংবা এমনও হতে পারে, সুদীপের বন্ধু ভেবেই সতীশ তাকে খানিকটা খাতির করে গেল। কথাটা বলতে গিয়েও সে মাধবীলতাকে বলতে পারল না। সতীশ এসে তাকে কিছুক্ষণের জন্যে এই দুজনের কাছে মূল্যবান করে দিয়ে গেছে। পেছনে লুকানো কোন কারণকে টেনে বের করে ধরলে সেই বড়ত্বটা মুছে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। হঠাৎ অর্ক বলে উঠল, ‘কাল থেকে পাড়ায় আমাদের প্রেস্টিজ বেড়ে যাবে। মন্ত্রী বাবার সঙ্গে দেখা করেছে শুনলে অনেকের হিংসে হবে।’
মাধবীলতা সে কথায় কান না দিয়ে বলল, ‘তুমি কি পার্টি অফিসে যাবে?’
‘তুমি কি বল?’
এবার হেসে ফেলল মাধবীলতা, ‘বাঃ, আমি কি বলব? আমি রাজনীতির কিছু বুঝি?’
কথাটা, ওই রাজনীতি শব্দটা যেন অনিমেষের কানে ঠং করে বাজল। হয়তো মাধবীলতা খুব সরল মনে শব্দটাকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু অনিমেষের ফেলে আসা দিনগুলোকে যেন মুহূর্তেই নড়িয়ে দিয়ে গেল। সেই সি পি এমের হয়ে নির্বাচনী প্রচার করা, য়ুনিভার্সিটিতে ছাত্র ফেডারেশন করা এবং মোহমুক্ত হয়ে নকশাল আন্দোলনে যোগ দেওয়ার ছবিগুলো চোখের ওপর ভাসতে লাগল। সেই সময় সুদীপদের ও মনেপ্রাণে ঘৃণা করত। ওইভাবে হাত পা গুটিয়ে নিরাপদ দূরত্বে বাস করে আগুন পোয়ানো তাদের কাছে সুবিধাবাদীর নামান্তর ছিল। উগ্র-আন্দোলনের ঝাঁঝে ওরা তখন এমন মশগুল ছিল যে যে কোন নরম ব্যাপারকেই নস্যাৎ করে দিতে বাধতো না। ওই মুহূর্তে বিপ্লবই একমাত্র পথ ছিল। অর্থাৎ সুদীপের রাজনীতির থেকে তার রাজনীতি বিপরীত মেরুতে অবস্থান করত। কিন্তু তারপর, ঘরটা যখন হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল, পায়ের তলা থেকে যখন বালি ঝুরু ঝুরু সরে গেল, মুখ থুবড়ে পড়ল সব উত্তেজনা তখন আর কোন রাজনীতি সে আঁকড়ে ধরতে পারে? যে ভুলগুলো হয়েছিল তা শুধরে নতুন উদ্যমে কিছু করার মত শক্তি তার নেই। হয়তো মাধবীলতা রাজনীতি বলতে তার নতুন উপলব্ধির কথা বোঝাতে চাইল, কিন্তু—। সত্যি উপলব্ধিটাই স্পষ্ট হয়নি তার কাছে। আমরা ভুল করেছিলাম। কিন্তু ভুল শুধরে নিতে গেলে যে যোগ্যতা থাকা দরকার, যা যা করা দরকার তা করার ক্ষমতা আমাদের নেই। অন্তত অনিমেষের নেই। অতএব সেই উপলব্ধি থেকে কোন সঠিক পথ বেরিয়ে আসছে না। সুতরাং এমন উপলব্ধি তো মূল্যহীন হয়ে পড়ছে। তাই এই মুহূর্তে তার কোন রাজনীতি থাকতে পারে না। অনিমেষ চোখ বন্ধ করল, ‘যেতে পারব না তো বলে দিলাম, সুদীপের যদি গরজ থাকে তাহলে সে নিজেই আসবে।’
দিনটা ছিল ছুটির। বিকেল তিনটে নাগাদ মাধবীলতা অর্ককে নিয়ে বের হল। যেতে আসতে বড় জোর ঘন্টা দুয়েক। গলির মুখেই সতীশের সঙ্গে দেখা, ‘দাদা আছেন?’
মাধবীলতা বলতে যাচ্ছিল কোথায় আর যাবেন কিন্তু বলল, ‘হ্যাঁ।’
‘কাল এত রাত হয়ে গেল যে খবর দিতে পারিনি। সুদীপবাবু একটা গোলমাল মেটাতে কলকাতার বাইরে যেতে বাধ্য হয়েছেন, আমাদের অফিসে আসতে পারেননি।’
‘ও।’ মাধবীলতা ছোট্ট শব্দটি উচ্চারণ করল। তারপর মাথা নেড়ে এগিয়ে গেল। সতীশ অর্কর দিকে তাকিয়ে হাসল, ‘তুমি আসছ তো?’
‘দেখি।’ অর্ক জবাবটা দিয়ে মায়ের পাশে যাবার জন্য পা বাড়াল। এই সময় ঈশ্বরপুকুর লেনের ঝিমুনি কাটেনি। ফুটপাথে যারা দিবানিদ্রা দিচ্ছিল তারা সবে উঠে বসেছে। চিৎকার চেঁচামেচি এখন কম।
ডিপো থেকে বের হওয়া একটা চার নম্বর ট্রামে ওরা উঠে বসল। একদম ফাঁকা ট্রাম। মাধবীলতা উঠে পেছন দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল অর্ক তাকে ডাকল, ‘মা, সামনে এসে বসো।’ বলে নিজে একটা ডাবল সিটের জানলার ধারে বসে পড়ল। মাধবীলতা একটু ইতস্তত করে শেষমেষ অর্কর পাশে এসে বসল, ‘ওদিকে তো লেডিস সিট ফাঁকা ছিল। এখানে বসা মানে আর একজন ভদ্রলোককে অসন্তুষ্ট করা।
অর্ক বলল, ‘এটা কি জেন্টস সিট? সবাই বসতে পারে।’
মাধবীলতা হাসল, ‘ওগুলো তর্ক করার জন্যে বলা। লেডিস সিট খালি থাকলে এখানে বসাটা অশোভন।’
অর্ক বলল, ‘ছাড়ো তো, তোমার না সব কিছুতেই বেশী বেশী।’
মাধবীলতা আড় চোখে ছেলের দিকে তাকাল। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মত কথা বলল অর্ক। যেভাবে বসে আছে তাতে আর কিশোর বলে মনে হয় না। কিন্তু কথা বলার ধরনটা তার ভাল লাগল না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে টিকটিক করাও ভাল দেখায় না, ভালও লাগে না।
পরমহংস দাঁড়িয়ে ছিল। মাধবীলতা ট্রাম থেকে নেমে দেখল মেঘ করেছে আকাশে। ওদের দেখা মাত্র পরমহংস ছুটে এল, ‘রাইট টাইমে এসে গেছ। চল, খুব বেশী দূরে নয় এখান থেকে।’
মাধবীলতা স্মিত হেসে বলল, ‘অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছো?’
‘না, না। পাঁচ মিনিট।’
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পরমহংস অর্ককে বলল, ‘তোমার মনে হচ্ছে আমাকে ঠিক পছন্দ হয়নি। অবশ্য আমাকে কারোরই পছন্দ হয় না।’
অর্ক তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘না, না, অপছন্দ হবে কেন?’
‘তাহলে চুপ করে আছ কেন? কথা বল। চুপ করে থাকাটা খুব বিচ্ছিরি।’ গোল মুখটা তো দাঁতের জন্যে সবসময় হাসি হাসি দেখায়, পরমহংস এই মুহূর্তে হাসছে কিনা বুঝতে পারল না অর্ক। কিন্তু এই বেঁটেখাটো মানুষটাকে তার বেশ ভাল লেগে গেল। বাবার বন্ধু কিন্তু উচ্চতায় তার বুকের কাছাকাছি। কিন্তু এরকম হাসিখুশি মানুষ সে এই প্রথম দেখল।
পরমহংস মাধবীলতার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এদিকে কখনও এসেছ?’
‘না। মাধবীলতা মাথা নাড়তে গিয়ে মনে করল প্রথম দিন পরমহংস দেখা হওয়া মাত্র উচ্ছাসে তাকে তুই বলে ফেলেছিল। কিন্তু তারপর আবার তুমিতে উঠে এসেছে সে।
‘খারাপ জায়গা নয়। আগে অবশ্য খুব বোমাবাজি হত। এখনও হয় তবে সেটা কোথায় হয় না। একটু এগিয়ে গেলেই গঙ্গা পাবে। ডুবটুব দিতে পারো।’
‘না, বাবা, আমার পুণ্যি করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।’
‘এই বাড়ি।’ পরমহংস দাঁড়িয়ে গেল আচমকা। তারপর চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ‘মুকুন্দদা, মুকুন্দদা।’
কিছুক্ষণ বাদেই এক ভদ্রলোক চোখে চশমা আঁটতে আঁটতে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন, ‘ওঃ, দাঁড়াও, আসছি।’
বাড়িটা বেশ পুরোনো। বহুদিন রঙ করা হয়নি। কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় মজবুত। ভেতরে ঢুকে দেখেশুনে পছন্দ হয়ে গেল মাধবীলতার। রান্নাঘরটায় ভাল ব্যবস্থা আছে, তিনটে তাক। ঘরগুলো খুব বড় নয় কিন্তু কোন অসুবিধে হবে না। রোদ আসে বোঝা যাচ্ছে।
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের নাম মুকুন্দ দাস। বললেন, ‘পরমহংসের কাছে আমি সব শুনেছি। আপনাদের মত ভাড়াটে আমি খুঁজছিলাম। বেশী টাকা নিয়ে অন্য ঝামেলায় পড়তে চাই না। ওপাশের মিত্তিরবাবুদের সঙ্গে আপনাদের কল পায়খানা শেয়ার করতে হবে। ওরাও ভাল মানুষ, কোন অসুবিধে হবে না।’
মাধবীলতা বলল, ‘ওঁদের দেখলাম না।’
‘খিদিরপুরে গিয়েছে। আপনারা কবে আসছেন?’
পরমহংস বলল, ‘কবে আবার, মাস শেষ হলেই চলে আসবে।’
মুকুন্দবাবু ইতস্তত করলেন, ‘ব্যাপারটা হল খালি আছে জেনে অনবরত মানুষ আসছে, বেশী দেরি করলে ঠেকাতে পারব না। আপনি টাকাটা দিয়ে রসিদ নিয়ে যান।’
মাধবীলতা সঙ্কোচে পড়ল। সে পরমহংসের দিকে একবার তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে দুদিন সময় দেবেন?’
পরমহংস হেসে উঠল, ‘ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না তোমাকে। মুকুন্দদা, কাল সকালে অফিসে যাওয়ার সময় আমি তোমাকে টাকা দিয়ে যাব।’
‘ঠিক আছে। আমি রসিদ করে রাখব। কি নামে হবে?’
পরমহংস বলল, ‘কার নাম দেবে, তোমার, না—।’
মাধবীলতা তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘ওর নামেই হবে। তারপর মুকুন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অনিমেষ মিত্র।’