শাহানা ঢাকায় রওনা হবে দুপুরের পর। সন্ধ্যা বেলায় ঠাকরোকোনা থেকে ঢাকা যাবার ট্রেন ধরবে। ঠাকরোকোনা পর্যন্ত যাবার জন্যে ইঞ্জিনের নৌকা আনানো হয়েছে। সকাল থেকেই নৌকায় তোষক বিছিয়ে বিছানা করা হচ্ছে। নীতুর খুব মন খারাপ। জায়গাটা তার মোটেও ভাল লাগে নি। এই দশদিন নিজেকে সত্যি সত্যি বন্দিনী মনে হয়েছে। এখন যাবার সময় হয়েছে এখন শুধু কান্না পাচ্ছে। সে শাহানাকে গিয়ে বলল, আপা এই যে আমরা চলে যাচ্ছি, তোমার খারাপ লাগছে না?
শাহানা বলল, না খারাপ লাগছে না। ভাল লাগছে।
আমার খুব খারাপ লাগছে আপা। আমার মনে হয় যাবার সময় আমি দাদাজানকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলব। কি বিশ্রী কাণ্ড হবে।
বিশ্রী কাণ্ড হবে কেন?
মোহসিন ভাই নিশ্চয়ই এই নিয়ে পরে আমাকে ক্ষ্যাপাবে।
সেই সম্ভাবনা তো আছেই। পৃথিবীর সব দুলাভাইরা মনে করে শালীদের ক্ষ্যাপানো তাদের পবিত্র দায়িত্ব।
আপা, তুমি কি শেষবারের মত আজ বেড়াতে বের হবে না, সুখানুপুকুর হেঁটে হেঁটে দেখবে না?
দেখতে পারি। সম্ভাবনা আছে।
নীতু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপা দাদাজান আজ সকাল থেকে কিছু খাননি। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে আছেন, তা কি তুমি জান?
জানি।
দাদাজানের খুব মন খারাপ।
মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক। এতদিন এক সঙ্গে ছিলাম হৈ চৈ করেছি–এখন আবার খালি হয়ে যাবে। তিনি বিশাল খালি বাড়ি একা একা পাহারা দেবেন।
শাহানা শেষবারের মত সুখানপুকুর দেখতে বের হবে। মোহসিন বলল, আমি কি তোমার সঙ্গে থাকতে পারি। প্রিন্সেসের সঙ্গে এসকর্ট থাকবে না তা কি করে হয়। আসব তোমার সঙ্গে?
অবশ্যই আসবে। একটু অপেক্ষা কর আমি দাদাজানের সঙ্গে বিদায় দেখাটা করে আসি।
মোহসিন বলল, এখন তো বিদায় নিচ্ছ না। বিদায় নিতে তো দেরী আছে।
শাহানা হাসতে হাসতে বলল, ঐ পর্বটা আমি আগেই সেরে রাখতে চাই। আমার ধারণা বিদায় মুহূর্তে নীতু দাদাজানকে জড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকবে। তাকে দেখে আমি কাদতে থাকব। সুন্দর করে বিদায় নেয়া হবে না।
তোমরা তিন বোনই খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টর। আমি লেখক হলে তোমাদের তিনজনকে নিয়ে চমৎকার একটা উপন্যাস লিখতাম। নাম দিতাম old man and these grand daughters.
শাহানা ইরতাজুদ্দিন সাহেবের ঘরে ঢুকল। দরজা ভেজানো ছিল। শাহানা ঘরে ঢুকে আগের মত দরজা ভিজিয়ে দিল।
ইরতাজুদ্দিন ইজিচেয়ারে শুয়ে ছিলেন। পুরানো দিনের ভারী ইজিচেয়ার। হাতলে অনায়াসে বসা যায়, শাহানা ইজিচেয়ারের হাতলে বসল। ইরতাজুদ্দিন বললেন, কিছু বলবি?
শাহানা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ইরতাজুদ্দিন বললেন, বল কি বলবি।
দাদীজানের যে ছবিটা আপনি আলমিরায় বন্ধ করে রাখেন ঐ ছবিটা দেখব। শুনেছি দেখতে অবিকল আমার মত। না দেখলে বিশ্বাস হবে না।
ইরতাজুদ্দিন ছবি বের করে আনলেন। শাহানা অবাক হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে রইল। আশ্চর্য মিল তো।
এত সুন্দর একটা ছবি লুকিয়ে রাখেন কেন দাদাজান?
দেখতে কষ্ট হয় এই জন্যে আড়াল করে রাখি অন্য কিছু না। তুই এই ছবিটা নিয়ে যা–তোর বাবাকে দিস সে খুশী হবে। আমি যতদূর জানি তার কাছে তার মার কোন ছবি নেই।
আপনার এত প্রিয় একটা ছবি দিয়ে দিচ্ছেন?
প্রিয়জনকেতো প্রিয় জিনিস দিতে হয়। প্রিয়জনকে কি অপ্রিয় জিনিস দেয়া যায়?
বাবা খুব খুশী হবে।
তোর বাবাকে আরেকটা ব্যাপার বুঝিয়ে বলবি, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি একটা ভুল করেছিলাম। অনিচ্ছাকৃত ভুল। সব সময় একা থাকতাম। কেউ আসত না আমার কাছে। এই সময় গানবোট নিয়ে একদল মিলিটারী উঠে এল…।
ঐ প্রসঙ্গটা থাক দাদাজান।
না, প্রসঙ্গটা শুনে রাখ। মিলিটারীদের আমার বাড়িতে উঠতে দেখে আমি খুশীই হয়েছিলাম। ভাবলাম কিছুদিন বাড়িটা গমগম করবে। ওরা যে এই ভয়ংকর কাণ্ড করবে আমি চিন্তাও করি নি। তোর বাবাকে বলিস আমি আমার অপরাধ স্বীকার করি।
বাবাকে আমি অবশ্যই বলব।
ইরতাজুদ্দিন ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তোকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তুই অসাধারণ একটা মেয়ে হয়ে পৃথিবীতে এসেছিস।
এই কথা কেন বলছেন দাদাজান।
এই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আমাকে ঘৃণার চোখে দেখতো। তোর কারণে সেই ঘৃণাটা এখন নেই। যে মানুষের এমন চমৎকার একটা নাতনী সেই মানুষকে ঘৃণা করা যায় না।
এমন করে বলবেন না তো দাদাজান। আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
তুই আমার কাছে কিছু একটা চা। তুই যা চাইবি তাই তোকে দেব।
বর দিচ্ছেন?
হ্যাঁ, বর ভাবলে বর।
একটা বরতো দেয়া যায় না দাদাজান–তিনটা করে বর দিতে হয়। আমি তিনটা জিনিস চাইব আপনি আমাকে দেবেন–রাজি আছেন?
আচ্ছা যা দেব। ক্ষমতায় থাকলে অবশ্যই দেব।
এক–আপনি ঢাকায় এসে আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
এটা পারলাম না। এই বাড়ি ছেড়ে আমি কোথাও যাব না।
দুই–গ্রামের সব মানুষকে ডেকে আপনি যে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় একটা করেছিলেন সেই ভুলের কথা বলবেন। তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবেন।
এটাও সম্ভব না।
তিন–আমাদের এই বাড়িটাকে আপনি দান করে দেবেন। এস্থানে একটা সুন্দর আধুনিক হাসপাতাল হবে।
এটাও সম্ভব না। পৈতৃক বাড়ি–আদি ঠিকানা। এই ঠিকানা নষ্ট হতে দেয়া যায় না। তুই অন্য কিছু চা।
আমার আর কিছু চাইবার নেই। দাদাজান আপনি বিশ্রাম করুণ আমি শেষবারের মত সুখানপুকুর দেখে আসি।
ইরতাজুদ্দিন কিছুই বললেন না।
শেষবারের মত সুখানপুকুর ঘুরে দেখবে বলে শাহানা বের হয়েছিল। মোহসিন ক্যামেরা হাতে সঙ্গে আছে। কয়েক পা এগিয়েই শাহানা বলল, চল বাড়ি চলে যাই।
মোহসিন বিস্মিত হয়ে বলল, কেন?
ভাল লাগছে না।
মোহসিন হাসতে হাসতে বলল, তোমার সঙ্গে জীবন যাপন করা খুব যন্ত্রণার ব্যাপার হবে। তুমি দারুণ মুডি। অন্য কোথাও যেতে না চাইলে যেও না, চল তোমার প্রিয় জায়গাটার একটা ছবি নিয়ে আসি–অশ্রু দীঘি।
না, না। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না।
মোহসিন লক্ষ্য করল শাহানার চোখ ভেজা। সে এই অদ্ভুত মেয়েটির গভীর আবেগের কোন কারণ ধরতে পারল না।
শাহানাদের নৌকায় তুলে দিতে এসে ইরতাজুদ্দিন হতভম্ভ হয়ে গেলেন। নৌকা ঘাট লোকে লোকারণ্য। সুখানপুকুরের সবাই কি চলে এসেছে? একি অস্বাভাবিক কাও।
নীতু ফিস ফিস করে বলল, আপা তুমি যদি এখান থেকে ইলেকশান কর নির্ঘাৎ তোমার বিপক্ষে যারা দাঁড়াবে সবার জামানত বাজেয়াপ্ত হবে।
শাহানা হাসতে হাসতে বলল, তাই তো দেখছি।
মোহসিন বিস্মিত গলায় বলল, শাহানা তুমি এতগুলি মানুষকে মুগ্ধ করলে কোন কৌশলে? মাই গড! এরা সবাই তোমাকে সি অফ করতে এসেছে ভাবতেই কেমন লাগছে। তুমি কি এদের সবার চিকিৎসা করেছ। এই ভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেক না। ওদের দিকে তাকিয়ে হাত টাত নাড়। নেতারা যে ভঙ্গিতে হাত নাড়েন সেই ভঙ্গিতে।
শাহানার চোখে পানি এসে গেছে। সে চোখের পানি সামলাতে গিয়ে আরো, বিপদে পড়ল। এখন মনে হচ্ছে চোখ ভেঙ্গে বন্যা নামবে।
ইরতাজুদ্দিন শাহানার দিকে তাকিয়ে ছিলেন, তিনি হয়তবা শাহানাকে অস্বস্তি থেকে রক্ষা করার জনেই উঁচু গলায় বললেন–আপনারা সবাই আমার নাতনীদের জন্যে একটু দোয়া করবেন। ওর খুব ইচ্ছা আমার বাড়িটায় একটু হাসপাতাল হোক। ইনশাআল্লাহ হবে। আমি কথা দিলাম।
আপনাদের কাছে আরেকটা কথা–স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি একটা অন্যায় করেছিলাম। মিলিটারীদের আমার বাড়িতে থাকতে দিয়েছিলাম। আমি ভয়ংকর অপরাধ করেছিলাম। আমি হাত জোড় করে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাই।
ঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলির মধ্যে একটা বড় ধরনের গুঞ্জন উঠল। সেই গুঞ্জনও আচমকা থেমে গেল। ইরতাজুদ্দিন শাহানার দিকে তাকিয়ে বললেন–তোর তিনটা বরই তোকে দিলাম–এখন কান্না বন্ধ কর।
শাহানা কান্না বন্ধ করতে চেষ্টা করছে পারছে না।