শামসুর রাহমান: মুকুটহীন জাতীয় কবি
কোনো খেতাবে তিনি বিশ্বাস করতেন না। সরকারী খেতাব তার ভাগ্যে জোটেওনি। যাঁরা বিবেকের কথা বলেন, স্রোতের বিরুদ্ধে চলেন, হুক্কাহুয়ায় শরিক হন না, তাদের জন্যে কোনো খেতাব জোটাও শক্ত। তাই মুকুট তিনি পাননি, মৃত্যুর পর রাষ্ট্ৰীয় সম্মানও নয়। কিন্তু তিনি ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় কবি, নিঃসন্দেহে। জাতীয় কবি–নানা কারণেই। রবীন্দ্ৰ-পরবর্তী তিরিশের দশকের কয়েকজন কবি মিলে নতুন যুগ সৃষ্টি করেছিলেন। জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু— প্ৰত্যেকেই ছিলেন নিজের নিজের বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁরা স্থায়ী আসন পাবেন বলে মনে হয়। তবে তার পরের অর্ধ-শতাব্দী ধরে যারা বাংলা কাব্যের আসরে আবির্ভূত হন, তারা আগের কবিদের তুলনায় কম সাফল্য লাভ করেছেন। তাঁরা কেউ যুগ সৃষ্টি করতে পারেননি। পাঠকরা তাদের কতোদিন মনে রাখবেন, বলা শক্ত। তা ছাড়া, তাদের অনেকে আঞ্চলিক কবি হিশেবে পরিচিত, অখণ্ড বাংলা সাহিত্যের কবি নন। তাঁরা কেউ পশ্চিবঙ্গের কবি, কেউ পূর্ব বাংলার অর্থাৎ বাংলাদেশের কবি। এই আঞ্চলিক সীমানা অতিক্রম করে বাংলা ভাষার একজন প্রধান কবি হয়েছিলেন শামসুর রাহমান। আর বাংলাদেশের কথা উঠলে এক বাক্যে বলতে হয় যে, মোটামুটি দেশ-বিভাগের পর থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত অর্ধ-শতাব্দীর বেশি সময় ধরে তিনি আমাদের সাহিত্যের মধ্যমণি হয়ে বিরাজ করেছিলেন।
কেবল এই ব্যাপ্তি অথবা কবিতার প্রাচুর্যের জন্যে নয়, তাঁর কৃতিত্বকে আরও বড়ো করে দেখতে হয়। এ জন্যে যে, তার কবিতা সত্যি সত্যি হৃদয়কে নাড়া দেয়। কবি তাঁর আবেগকে পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত করতে পারেন জাদুকরের মতো তার নিজস্ব ভাষা, ছন্দ এবং ভঙ্গি দিয়ে। এবং সেটাই তো একজন মহৎ কবির কাজ! তিনি যথার্থই সহৃদয়হৃদয়সংবাদী। তাঁর ভাষা এবং ভঙ্গি এমন বিশিষ্ট রঙে রাঙানো যে, অমনোযোগী পাঠকও চিনতে পারবেন যে, তাঁর কবিতা তারই কবিতা।
আর, সাহিত্যের ইতিহাসের কথা বিবেচনা করলে, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার সাহিত্যের কথা বিবেচনা করলে তাঁকে কৃতিত্ব দিতে হয় একটা নতুন ধারার প্রবর্তক হিশেবে। সত্যি বলতে কি, তিনি কেবল সেই নতুন ধারার প্রবর্তক নন, তার সবচেয়ে বড়ো এক্সপোনেন্টও। পূর্ব বাংলার সাহিত্যে তাঁর আবির্ভাব এমন একটা সময়ে যখন মুসলমান কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে প্রধানত দুটি ধারা প্রচলিত ছিলো। এক, ইসলামী পুনর্জাগরণের ধারা–যার সূচনা নজরুল ইসলাম থেকে এবং যা বিস্তার লাভ করে ফররুখ আহমদ, বেনজির আহমদ, তালিম হোসেন, মোফাখখারুল ইসলাম প্ৰমুখের মধ্য দিয়ে। আর দ্বিতীয় যে-ধারাটি বহমান ছিলো, সেটি হলো পল্লীসাহিত্যের ধারা। এই ধারার প্রবর্তক ছিলেন জসীমউদ্দীন। এবং বন্দে আলি মিঞাদের মতো অনেকেই এ ধারা কমবেশি অনুকরণ করেছিলেন।
সাৰ্বজনিক সাহিত্য হিশেবে সীমাবদ্ধতা যা-ই থাকুক না কেন, এই দুই ধারার কোনোটাকেই কৃত্রিম বলা যায় না। কারণ, পূর্ব বাংলার পিিছয়ে-থাকা মুসলমান সমাজে ইসলামী জাতীয়তাবাদী চেতনা প্ৰবল থাকাই তো স্বাভাবিক! আবার কবিদের সবারই শেকড় যেহেতু প্রোথিত ছিলো গ্রামের মাটিতে, সে জন্যে তাদের পক্ষে পল্লীর উপাদান নিয়ে সাহিত্য রচনাও ছিলো স্বাভাবিক।
হয়তো আরও অনেক কাল চলতো এই দুই ধারার অনুবর্তন। কিন্তু শামসুর রাহমান সেই পরিবেশে এই দুই ধারার ঠিক বিপরীত দিকে গেলেন। তিনি ইসলামী ভাবধারা দিয়ে উদ্ধৃদ্ধ হননি। জসীমউদ্দীনের “পল্লীসাহিত্য” দিয়েও নয়। ছাত্রজীবনেই তিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা পড়ে। জীবনানন্দের ভাষা এবং বৈশিষ্ট্য তিনি দ্রুত কাটিয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু তাঁর সেকুলার মানবিক আবেদনের কবিতা তাঁর অন্তরকে নাড়া দিয়েছিলো। তিনি তাই ধর্মীয় জাগরণমূলক মুসলমানী কবিতা লিখলেন না। তাঁর কাছে হিন্দু অথবা মুসলমানের থেকে মানুষ অনেক বড়ো। তিনি মানুষের কবিতা লিখলেন। আবার, মানুষের কবিতা লিখতে গিয়েও তিনি কুলি-মজুরদের উদ্ধার করার কবিতা লিখলেন না। ধর্ম এবং জাগরণমূলক কবিতার বদলে ব্যক্তিগত অনুভূতির, প্রেমের, প্রকৃতির, দেশের, সৌন্দর্যের কবিতা লিখেছেন তিনি। ধর্মীয় ধারার বদলে তিনি প্রবর্তন করেন একটি সেকুলার রোম্যান্টিক ধারা। সে অর্থে তিনিই পূর্ব বাংলার প্রথম বিশুদ্ধ কবি।
দ্বিতীয়ত, পল্লীসাহিত্যের ধারাও তিনি অনুকরণ করলেন না। তাঁর জন্ম নগরে সেটাই তার একমাত্র কারণ নয়। মন-মানসিকতার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন নাগরিক। পল্লীবাংলার উপাদান, পল্লীর অনুষঙ্গ এবং গ্রামের ভাষা তাকে বিশেষ অনুপ্রাণিত করতে পারেনি। তবে তিনি নাগরিক বিষয়বস্তু নিয়ে কাব্য রচনা করেন–কেবল এই অর্থেই তিনি নাগরিক কবি নয়। তিনি বিদগ্ধ কবি–এই অর্থেও নাগরিক। তার মধ্যে কোনো গ্ৰাম্যতা ছিলো না।
সব কবিই রোম্যান্টিক। কিন্তু শামসুর রাহমান এমন আপাদমস্তক রোম্যান্টিক ছিলেন যে, সেটা আলাদা করে উল্লেখ না-করলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়। রোম্যান্টিক বললে অনেকেই প্রেমের কথা ভাবেন। কিন্তু তিনি তাঁর শৈশব, কৈশোর, যৌবন, তার প্ৰেম, তাঁর আশা-নিরাশা সবই দেখেছেন রঙিন রোম্যান্টিক আলোতে, কঠোর বাস্তবতার খররৌদ্রে নয়। মানুষ দুঃখ নয়, আনন্দের ভিখিরি। কিন্তু তিনি দুঃখ নিয়েও এমন রোম্যান্টিক হয়েছেন যে, তাকে দুঃখবিলাস বললে বাড়িয়ে বলা হয় না। তাঁর “হৃদয়ে-লতিয়ে-ওঠা একটি নিভৃত্যতম গানে / সুখে নিদ্রায় কিবা জাগরণে, স্বপ্নের বাগানে, / অধীরের অধীর চুম্বনে সান্নিধ্যের মধ্যদিনে / … দুর্কিনীত ইচ্ছার ডানায় / আসক্তির কানায় কানায়”–সর্বত্রই দুঃখ তার নাম লেখে।
সত্যি বলতে কি, জীবন এবং মৃত্যু উভয়ের কথা বলতে গিয়েই তিনি তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। জীবনকে তিনি দারুণ ভালোবাসতেন। জীবন তাঁর কাছে ঝাঁ ঝাঁ রোদে লাঙল চালানো, মেঘনার ঢেউয়ে দাড় বাওয়া, শীতার্তা রাতে আগুন পোহানো নিরিবিলি, কারখানার কালি মুছে বাড়ি ফেরা এক শিস দিয়ে, বইয়ের পাতায় মগ্ন হওয়া, সহপাঠিনীর চুলে অন্তরঙ্গ আলো তরঙ্গের খেলা দেখা, মিছিলে এগিয়ে চলা, নিশান ওড়ানো।
মনে আছে, তাঁর ষাট বছর পূর্তি হওয়ার পর আমি বিবিসির জন্যে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তাতে তিনি বলেছিলেন যে, তিনি নিজেকে বৃদ্ধ বলে কল্পনা করেন না। তিনি মনের চোখে দেখতে পান যে, তিনি হাফ-প্যান্ট পরে স্কুলে যাচ্ছেন। চোখের সামনে অনেক লাল-নীল-সবুজ দেখতে পান। তিনি। বয়স যে বাড়ছে, এটা তিনি প্রায় অস্বীকার করতে চেষ্টা করেছেন। “বয়সের ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে দেখি দূরে / বয়স দাঁড়িয়ে থাকে বালকের মতো আলোজ্বালা গলির ভেতরে।” কবি আর ব্যক্তি হুবহু এক হয় না। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি এই রোম্যান্টিক প্ৰেমাকুল মনোভাব বহাল রেখেছিলেন। ভালোবাসায় তিনি উদার ছিলেন। ভালোবাসতেই তিনি ভালোবাসতেন। অনেক জায়গায় তার ভালোবাসা রীতিমতো দেহঘন। “তোমার শরীর কোথাও নিরালা পথ, মসৃণ অথবা তরঙ্গিত, / কোথাও বা সুরভিত ঝোপ, আমার ওষ্ঠ-পথিক / ক্রমাগত আঁকে পদচিহ্ন সবখানে। … তোমার সপ্ৰাণ চুললগ্ন বেলফুল / কী কৌশলে আমার বয়স নিয়েছিল চুরি করে।” “অবৈধ সঙ্গম করে ঘামে নেয়ে উঠতে পারি সহজ অভ্যাসে।” এসব কবিতা তিনি লিখেছিলেন। প্রৌঢ়ত্বে উপনীত হয়ে। তাঁর কবিতায় ভালোবাসাবাসির ছড়াছড়ি নিজেই তা স্বীকার করেছেন। “আমার কবিতা পথপ্ৰান্তে দুঃখীর চোখের মতো / চোখ মেলে চেয়ে থাকে কার পায়ের ছাপের দিকে, / গা ধোয় ঝরনার জলে। স্বপ্ন দেখে বনদেবী তার / ওষ্ঠে ঠোঁট রেখে হু হু জুলছেন সঙ্গম-লিপ্সায়।”
জীবনের প্রতি এই কামরাঙা ভালোবাসা সত্ত্বেও নিজের মৃত্যু নিয়েও তিনি বিলাস করেছেন বহু কবিতায়। তাঁর বয়স যখন চল্লিশের চেয়েও কম, তখন বিবেচনা” বলে একটি কবিতায় ভেবে নিয়েছেন: যেদিন তিনি খাটে নিশ্চেন্তন হয়ে পড়ে থাকবেন, সেদিন হয়তো কাঁদবে কেউ; আত্মীয় স্বজন কেউ কেউ শোকে ধোবে সত্তা, প্রতিবেশীদের কোনো একজন হয়তো বলবে, লোকটা নাস্তিক ছিলো, শরিয়তে মোটেই ছিলো না মন, মসজিদে তার সাথে কখনো হয়নি দেখা, এবং নিষিদ্ধ দ্রব্যে ছিলো তার উৎসাহ প্রচুর। তাঁর মৃত্যুর দিনটা কেমন হবে, আবহাওয়া কেমন থাকল ভালো হয়, তাও তাঁর কল্পনাকে উস্কে দিয়েছে। এমন কি, তিনি যে বলে গেলেন যে, তাকে যেন সমাধিস্থ করা হয় তার মায়ের সমাধিতে–সেও এক করুণ রোম্যান্টিক কল্পনা। দিনের শেষে মায়ের কোলে ফিরে যাওয়ার ভাবনা থেকে ৷ প্ৰসঙ্গত বলতে হয়, মা তাঁর সত্তায় একটা প্রগাঢ় আসন জুড়ে আছেন। প্রতিদিন ধ্যানী প্ৰদক্ষিণে ছায়াবৃত আপন সংসারে তিনি মাকে দেখতে পান। মায়ের অন্তহীন স্নেহের সলিলে সিক্ত তাঁর সমগ্র অস্তিত্ব।
বিষাদ সব মহৎ সাহিত্যেরই সাধারণ লক্ষণ। শামসুর রাহমান তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। তাঁর অনেক কবিতায় বিষাদের ঘন ছায়া চেষ্টা না-করলেও চোখে পড়ে। তা সত্ত্বেও তার কাব্যে গোড়া থেকেই একটা আশাবাদ লক্ষ্য করি। তিনি দ্বিতীয় বার মৃত্যুর আগেও প্রথম গান গেয়েছেন, করোটির ওপরও রৌদ্র দেখতে পেয়েছেন। নিরালোকেও তিনি দিব্যরথে চড়েছেন। তার এই আশাবাদ তাঁর পাঠককে উদ্বোধিত করে, অনুপ্রেরণা দেয়। শেষ পর্যন্ত এই আশাবাদ তিনি বজায় রেখেই কবিতার সঙ্গে গোরস্থালি করে গেছেন। তাঁর শেষ জন্ম দিনের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম, তাতে তিনি হতাশায় অন্ধকার দেশ সম্পর্কে এই আশাবাদের কথা বলেছেন। আস্থা হারাননি। তিনি বলেছেন, তিনি হয়তো দেখে যেতে পারবেন না, কিন্তু বর্তমানের নীরন্ধ অন্ধকারে আবার আলোর বন্যা আসবে। তাঁর এই ইতিবাচক কণ্ঠস্বর দৈববাণীর মতো আশ্বাস দেয়।
শামসুর রাহমানের আর-একটি বৈশিষ্ট্য তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর থেকে আমাদের জাতীয় জীবনের পথ কখনো সমতল ছিলো না। তাতে অনেক চড়াই-উৎরাই ছিলো। সেই পরিবেশে দেশের প্রতি একজন সমাজসচেতন কবির যে দরদের দৃষ্টি থাকবে, সে তো স্বাভাবিক। কিন্তু শামসুর রাহমানের মধ্যে দেশপ্রেম একটু প্রবলভাবেই লক্ষ্য করা যায়। তার ভালোবাসা দেশ এবং মাটির জন্যে, ভাষার জন্যে, নিপীড়িত মনুষ্যত্বের জন্যে, স্বাধীনতার জন্যে। দেশকে তিনি তুলনা করেছেন মায়ের সঙ্গে— তাতে এমন কিছু অভিনবত্ব নেই, কিন্তু তিনি যখন মাকে তুলনা করেছেন দেশের সঙ্গে— স্বদেশের স্বতন্ত্র মহিমা অনন্য উপমা তার–তখন বোঝা যায়, দেশের জন্যে তার ভালোবাসা কতো আন্তরিক। টেলিমেকাস, বর্ণমালা, ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, আসাদের শার্ট, তোমাকে পাওয়ার জন্যে হে স্বাধীনতা, স্বাধীনতা তুমি, দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে, একটি মোনাজাতের খসড়া, বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় ইত্যাদি কবিতায় দেশের নানা স্বপ্ন দেখেছেন তিনি।
বস্তুত, তাঁর কবিতা আমাদের একদিকে যেমন স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে, অন্য দিকে তেমনি তাঁর কবিতা আমাদের স্বাধীনতার ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র বজায় রাখার জন্যে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। তিনি দুঃখিনী বর্ণমালাকে দেখে। যেমন শোকাহত হয়েছেন, তেমনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন উদ্ভট উটের পিঠে স্বদেশকে চলতে দেখে। তাঁর দেশপ্ৰেমমূলক কবিতা তার প্রেমের কবিতার মতোই হৃদয়কে নাড়া দেয়। আমার ধারণা, রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই বাংলা ভাষায় সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে বেশি দেশাত্মবোধক কবিতা রচনা করেছেন। নজরুল ইসলামের কথা আমি ভুলে যাচ্ছি না। এ দুজনের দেশাত্মবোধক কবিতার চরিত্র আলাদা। নজরুলের দেশাত্মবোধক কবিতা বিদ্রোহমূলক, রাজনৈতিক; শামসুর রাহমানের দেশাত্মবোধক কবিতা দেশের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম প্রেমের কবিতা।
ভাষা ব্যবহারে তাঁর বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ না-করলে তাঁর প্রতি সুবিচার করা হয় না। নজরুল ইসলাম থেকে আরম্ভ করে বিশ শতক জুড়ে যে-মুসলমান কবিসাহিত্যিকরা লিখেছেন, তাদের সবার ভাষাতেই মুসলমানী শব্দ অর্থাৎ আরবিফারসি শব্দের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। কারণ ব্যক্তিগত এবং প্রাত্যহিক জীবনেই তাঁরা এ ধরনের শব্দ বেশি ব্যবহার করতেন। কিন্তু শামসুর রাহমানের ভাষায় তাঁর ধর্মীয় চরিত্র প্রাধান্য পায়নি। তিনি আরবি-ফারসি এবং গ্রামীণ শব্দ প্রচুর ব্যবহার করেছেন, কিন্তু প্রয়োজন অনুসারে। এ ক্ষেত্রেও তাঁর মধ্যে এক ধরনের নাগরিকত্ব লক্ষ্য করা যায়। এ প্রসঙ্গে আরও বলা উচিত যে, তিনি ভাষা এবং শব্দ ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন এবং সব সময়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন। ঢাকার কুট্টিদের ভাষায় কবিতা লেখা যায়। কিনা, সে পরীক্ষাও তিনি সফলভাবে করেছেন। ছন্দের ক্ষেত্রে তিনি বৈশিষ্ট্য রেখেছিলেন সেই পুরোনো অক্ষরবৃত্তের মধ্যেই। যদিও তিনি অন্য ছন্দ নিয়েও পরীক্ষানিরীক্ষা করেছেন।
শামসুর রাহমানের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় ছিলো— এর জন্যে আমি সত্যি গর্ব অনুভব করি। এই পরিচয় থেকে একটা জিনিশ সব সময়ই চোখে পড়েছে। তিনি অসম্ভব নিরহঙ্কার লোক ছিলেন। নিজের ঢাক বাজাতে আমরা সবাই আগ্রহী। আমরা অনেকেই মনে করি, নিজের ঢাক নিজে না-পেটালে, আর কে পেটাবে। এবং শূন্যপোত্রই বেশি ঝনঝন করে। কাজেই আমাদের ঢাকই প্রবল শব্দে বাজে। শামসুর রাহমান এর উল্টো ছিলেন। তিনি নিজেকে জাহির করেননি–কী দেশে, কী বিদেশে। সম্প্রতি উইলিয়াম র্যাডিচি একটি প্রবন্ধে বলেছেন যে, শামসুর রাহমান যদি তার কাব্যসমূহের অনুবাদ করানোর ব্যাপারে এবং প্রচারের ব্যাপারে তৎপর হতেন, উদ্যোগী হতেন, বিদেশের সমালোচকদের নজরে আসতেন, তা হলে, তার পক্ষে নোবেল পুরস্কার পাওয়াও হয়তো অসম্ভব হতো না। কিন্তু আত্মপ্রচারে বিমুখ এই লাজুক মানুষটি নিজেকে চিরদিন লুকিয়ে রাখলেন!
কাছের মানুষকে আমরা যথাযথ সম্মান দিই না, সম্মান দিতে শিখিনি। তাদের আমরা নিজেদের প্রতিপক্ষ বলে বিবেচনা করি। তারপর সাধারণত মরার পর আমরা অনুষ্ঠান করে তাদের প্রতি সম্মানের পাত্ৰ উজাড় করে দিই। শামসুর রাহমান যে অতো মহৎ একজন কবি ছিলেন, আমার মনে হয়, আমরা তা বুঝতে পারিনি। তার জীবদ্দশায় জীবনানন্দকে পেরেছিলাম? পারিনি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, শামসুর রাহমান ভবিষ্যতে হারিয়ে যাবেন না। বরং বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা তার কাব্যে আরও গুণ দেখতে পাবেন। তার কাব্য আরও ভালোবাসবেন। তাকে মনে রাখবেন দীর্ঘকাল।
(যুগান্তর, অক্টোবর ২০০৬)