শহর থমথম করছে। যে শহরের রাজপথ গলিপথ সব সময় লোকের ভিড়ে গিসগিস করে, কোলাহলে কান পাতা দায় হয়ে ওঠে, টমটম, জুড়ি গাড়ি, কেরাঞ্চিগাড়ি মানুষজনের ওপর দিয়ে চলে যায়, আল্লার ষাঁড় গাঁদা ফুলের মালা চিবোয়, খেকি কুকুরের দল কশাইয়ের দোকানের সামনে লড়ালড়ি করে, বামুন-মুদ্দোফরাসে ছোঁয়াছুয়ি হয়ে যায় প্রায়ই, সেই কলকাতা আজ প্রায় জনশূন্য। দোকানপাট বন্ধ, অলিন্দে গবাক্ষে দেখা যায় কৌতূহলী, ভীত মুখ, কখনো কখনো এক আধজন লোক এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে তড়িৎগতিতে রাস্তা পার হয়ে অন্য বাড়িতে ঢুকে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে পদভারে পৃথিবী কম্পিত করে টহল দিয়ে যায় গোরা সৈন্যের দল।
আগে শহরের মধ্যে সৈন্যবাহিনী প্ৰায় দেখাই যেত না। এখন অনেকগুলি সরকারী ভবনেই সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে। শহরের একেবারে কেন্দ্ৰস্থলে, পটলডাঙার নিকটবর্তী সংস্কৃত কলেজে গোরা সৈন্যরা আস্তানা গেড়েছে। যে-কোনো দিন বিদ্রোহী সিপাহীরা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা দখল করতে আসবে।
প্ৰায় প্রতিদিনই বন্দরে জাহাজ আসছে, তার থেকে নামছে খাস বিলেতি সৈন্যদল। মাদ্রাজ ও বোম্বাই প্রেসিডেন্সী থেকেও সৈন্যবাহিনী পাঠানো হচ্ছে উত্তর ও পূর্ব ভারতের দিকে। বর্মাদেশের পেগু শহর এবং সিংহল দেশ থেকেও আনানো হচ্ছে ব্রিটিশ ফৌজ।
সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। কিছুদিন ধরেই বিদ্রোহের নানা ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রগুলিতে নানারূপ অতিরঞ্জিত কাহিনী প্রকাশিত হচ্ছিল। এখন সরকার সেনসর প্রথা চালু করায় ফল হলো বিপরীত। গুজব নামক বায়বীয় বস্তুটি নাবিক সিন্দাবাদের কাহিনীর কলসীর দৈত্যের আকার ধারণ করেছে এখন। শিশু হত্যা, নারী হত্যার দারুণ রোমাঞ্চকর কাহিনী সকলের মুখে মুখে। ইংরেজ সংবাদপত্রগুলি এই উপলক্ষে সমগ্ৰ ভারতীয় জাতিকে বর্বর, পিশাচ, মনুষ্যেতর প্রাণী বলে সম্বোধন করতে লাগলো। কিন্তু এসব ছাপিয়েও একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠলো, ইংরেজরা ভয় পেয়েছে। বে-সামরিক ইংরেজরা তো পলায়নের জন্য এক পা তুলে প্ৰস্তুত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ইংরেজ বাহিনীর পরাজয়ের সংবাদই বেশী আসছে। দিল্লি পুনর্দখলের প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। দিল্লির অস্ত্রাগার যাতে সিপাহীদের দখলে না যায়। সেইজন্য ইংরেজ সেনানীরা কত বীরত্বের সঙ্গে সেই অস্ত্রাগার ধ্বংস করে দিয়েছে। এ কাহিনী পল্লবিত করে ছড়ানো হয়েছিল। অস্ত্রাগার বিস্ফোরণের আওয়াজ নাকি চল্লিশ মাইল দূরেও শুনতে পাওয়া গেছে। কিন্তু এ সংবাদও কলকাতায় এসে পৌঁছেচে যে, দিল্লির অপর একটি বৃহৎ অস্ত্রাগার প্রায় বিনা যুদ্ধে সিপাহীদের করায়ত্ত হয়েছে, বিদ্রোহীদের কাছে এখন প্রচুর আগ্নেয়াস্ত্ৰ।
যাতে ত্ৰাস ছড়ানো না হয় সেইজন্য লর্ড ক্যানিং কড়া হুকুম দিয়েছেন জীবনযাত্রা স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে যেতে। অফিস, কাছারি সব খোলা রাখা হয়েছে, কিন্তু কেউ যায় না। বিশেষত আজকের দিনটি পলাশীর যুদ্ধের শতবার্ষিকীর দিন, আজ সর্বত্র একটা কী হয়, কী হয় ভাব।
রামগোপাল ঘোষ কয়েকদিন যাবৎ অসুস্থ, শয্যাশায়ী। তাঁর কয়েকজন বন্ধু তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। গতকাল, তারপর তাঁরা এ বাড়িতেই রয়ে গেছেন। ইদানীং রামগোপালের শরীর প্রায়ই ভালো থাকে না, মদ্যপানের মাত্ৰাও বেড়েছে। প্যারীচাঁদ, রাধানাথ প্রায়ই আসেন এ বাড়িতে, অনেকদিন পর এসেছেন দক্ষিণারঞ্জন। আর কৃষ্ণনগর থেকে রামতনুও এসেছেন। খাটের ওপর রামগোপাল আধো শোয়া, বন্ধুরা বসেছেন। কয়েকটি আরাম কেদারায়। এখন আলোচনার বিষয় একটিই, তবে কাল রাত থেকেই বন্ধুদের সঙ্গে তর্ক বেঁধে যাচ্ছে রামগোপালের।
রামগোপাল মুক্তকণ্ঠে বিদ্রোহী সিপাহীদের সমর্থক। তাঁর ধারণা, এবার ভারতে ইংরেজ রাজত্বের অবসান হবে।
রামগোপালের সবচেয়ে বেশী বিরোধী রাধানাথ! যদিও রাধানাথ অন্য সময় ইংরেজদের কড়া সমালোচক, কিন্তু এখন তিনি পুরোপুরি সিপাহীদের বিপক্ষে। তিনি বারবার জোর দিয়ে বলছেন, তুমি বলো কী হে রামগোপাল, তোমার মাতাটাতা সব গণ্ডগুলো হয়ে গেল নাকি ব্যাধিতে? দুকাঁড়ায় সব তালপাতার সেপাই, তারা লড়য়ে জিতবে ইংরেজদের সঙ্গে? হেঃ! আমি দেকিচি, বুজলে, আমি হিন্দুস্তানের এ মাতা থেকে ও মাতা পর্যন্ত ঘুরিচি, আমি তো দেকিচি এই সাহেবদের। এ ব্যাটাদের ধাতুই আলাদা। সেপাইরা ইংরেজ মাগীদের গায়ে হাত তুলেচে, কানপুরে কুয়োর মদ্যে মেম আর শিশুগুলোনকে ফেলে মেরেচে, এর যে কী শোধ নেবে ওরা তা তো জানে না! ইংরেজরা তাদের ফিমেলদের সম্মানরক্ষার জন্য জান দিতে রাজি। এক খৃষ্টিয়ানকে বাঁচাবার জন্য সব খৃষ্টিয়ান এককাট্টা হয়। হিঁদু কিংবা মোছলমানদের কখনো নিজের জাতের জন্য এককাট্টা হতে দেকোচো?
রামগোপাল বললেন, মাই ডিয়ার রাধু, হিন্দু আর মুসলমান তো এখন এককাট্টা হয়েই লড়চে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। দ্যাট ইজ এ ফ্যাকট। আগে কখনো যা হয়নি, তা যে কখনো হবে না, তার তো কোনো মানে নেই।
রাধানাথ বললেন, ছাই লড়চে! আর একটু গুতো খেলেই দেকবে সব ভয়ে উদি নষ্ট করে ফেলবে, আর তখন হিন্দু দোষারোপ করবে। মোছলমানদের ওপর, আর মোছলমান দুষিবে হিন্দুদের। এ লড়াইয়ের আয়ু আর বড়জোর সাত দিন। আমি বলচি, লিকে রাকো।
রামগোপাল বললেন, না, তা হতেই পারে না। ইংরেজ লড়চে একটা ইমমরাল ওয়ার। একটা জাগ্ৰত জাতিকে তারা দমিয়ে রাকবার চেষ্টা করচে। আর সেপাইরা লড়চে স্বাধীনতার জন্য। শুধু তাই নয়, তোমরা আরো ভালো করে বুঝে দ্যাকে। এ লড়াই শুধু সেপাইরা লড়চে না, সাধারণ মানুষরাও যোগ দিয়েচে, অনেক জায়গায় চাষীরাও সেপাইদের পাশে দাঁড়িয়েচে। ইতিহাসের মর্মে গিয়ে দ্যাকো, যে-দেশে সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে কৃষকরা হাত মেলায়, সে দেশে বিপ্লব সফল হবেই। মনে করো আমেরিকায় ওয়ার অফ ইণ্ডিপেণ্ডেন্সের কতা।
রাধানাথ বললেন, তুমি বিচিত্র কতা বললে। আমেরিকায় লড়াই হয়েছেল সাহেবদের সঙ্গে সাহেবদের। আর এখানে লড়াই হবে সাহেবদের সঙ্গে নেটবদের। সাহেবদের সঙ্গে নেটিব কখুনো পারে?
রামগোপাল ক্লিষ্টভাবে হেসে বললেন, রাধু, আমি যদি ইংলণ্ডে যাই, তখন ইংরেজরাই হবে সে-দেশের নোটিব। আর আমি হবো সাহেব। আমেরিকায় আমেরিকানরাও নোটিব। তুমি নিজেই তো প্রমাণ করেচো যে নোটিব হয়েও তুমি সাহেবদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
প্যারীচাঁদ বললেন, কিন্তু ভাই, রামগোপাল, সিপাহীরা জয়ী হলে আমাদের মঙ্গল হবে, না অমঙ্গলই বেশী হবে? আমরা সবেমাত্র পশ্চিমী সভ্যতার সুফল পেতে শুরু করিচি, আবার আমরা পিছু পানে ছুটিবো? বুড়ো বাহাদুর শাহ করবেন। এই দেশ শাসন? তাঁর ছেলেগুলোও এক একটা অকাল কুষ্মাণ্ড! মোগল শাসনের শেষ দিকে কি এ দেশে অন্ধকার যুগ নেমে আসেনি? এতদিনের মোগল শাসনে আমরা কী পেয়েচি? অশিক্ষা, কুসংস্কার, ভোগ-বিলাসের নক্কারজনক চিত্র, অবিচার, অত্যাচার! মোগল-পাঠানরা কখনো এদেশের সর্বত্র ইস্কুল খোলার কতা ভেবেচে? সর্বক্ষণ ধর্ম ধর্ম করে না। চেঁচিয়েও যে সুস্থ সামাজিক জীবন গড়ে তোলা যায়, সে আদর্শ আমাদের চোখের সামনে রেকেচে? নবাবী আমলের কোনো ভালো দিক তুমি দেকতে পাও? সব তো একেবারে রসাতলে যেতে বসেছেল। আমি ভাই জোরগলায় বলবো, ইংরেজ আমাদের রক্ষাকতা।
রামগোপাল বললেন, শোনো, বিপ্লবের পর একটা বিরাট পরিবর্তন আসে। তখন বাহাদুর শ শাসক হবেন, না কে শাসক হবেন, তা ঠিক করবে। এ দেশের নিয়তি। আর, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে একটা নবযুগ এসেচে, বিশ্বের নানা দিকের জানেলা খুলে গ্যাচে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলো আমাদের দেশেও এসে পৌঁচোতেই। আবার পেচোন পানে ফিরে যাবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। স্বাধীন দেশ নিজে থেকেই এগিয়ে যায়।
রাধানাথ বললেন, এ সব কতা যে বলচো এ সবও তো শিকেচো ইংরেজের লেকা বই পড়েই।
রামগোপাল বললেন, কোনো বই কোনো জাতের নিজস্ব সম্পত্তি নয়।
প্যারীচাঁদ বললেন, সেপাইরা কিন্তু তোমার মতন বই পড়েনি। তোমার ঐ বাহাদুর শা। কিংবা ধুন্ধপন্থও জ্ঞান-বিজ্ঞানের তোয়াক্কা করে না, তারা জিতলে মধ্যযুগই আবার ফিরে আসবে, তারা বর্বরতারই পুনঃপ্রবর্তন করচে।
রাধানাথ অট্টহাস্য করে বললেন, জিতবে? ছেঃ! ছেঃ! এই সেপাইরা জিতবে, এমন কতা স্বপ্নেও ভেবো না।
রামগোপাল একটু আহতভাবে বললেন, তোমরা মহান ডিরোজিওর শিষ্য হয়েও তোমাদের মনে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগে না? বিদেশীর পদানত হয়ে থাকাটাই তোমাদের কাচে সুখের? হেয়ার, বীট্নের মতন দু-চারটে ভদ্র ইংরেজের কতা আলাদা, কিন্তু অধিকাংশ ইংরেজ আমাদের কী চোখে দ্যাকে, তা কি তোমাদের জানতে বাকি আচে?
প্যারীচাঁদ বললেন, মোগল আমলে আমরা হিন্দুরা কি স্বাধীন ছিলুম? তুমি বলো কি রামগোপাল? তখুনো তো আমরা পদানতই ছিলুম। যদি পদানত থাকাই আমাদের নিয়তি হয়, তা হলে একটু ভদ্রগোচের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পায়ের তলায় থাকাটাই ভালো নয়?
এবার দক্ষিণারঞ্জন ওদের কথায় বাধা দিয়ে কথা বলে উঠলেন। তিনি বললেন, তোমরা এই লড়াইটাকে শুধু সেপাই আর ইংরেজদের লড়াই বলেই ভাবচো কেন। এ তো লড়াইয়ের একটা দিক মাত্র। সারা হিন্দুস্তান আজ ইংরেজ শাসনে বিক্ষুব্ধ। দেশটাকে চুষে একেবারে ছিবড়ে করে দিচ্চে ইংরেজ। ভারত এই সেদিন পর্যন্ত ছিল একটা পণ্য উৎপাদনকারী দেশ, আর আজ কী অবস্থা! আগে দেশ-বিদেশে ভারতের দ্রব্যের চাহিদা ছিল আর আজ আমাদের দেশ সারা ইওরোপের কাঁচা বাজার। আমাদের তাঁতশিল্পকে ইংরেজ একেবারে ধ্বংস করে বিলিতি কাপড় এখন চালাচে এদেশে। ভাই প্যারী, আমি একদিক থেকে রামগোপালের সঙ্গে একমত। তুমি মোগল শাসনের সঙ্গে তুলনা করলে, কিন্তু তুলনাটা একটু ভাসা ভাসা হয়ে গেল না? তুমি ইংরেজের ভদ্রগোচের ফস পা দেখেই ভুললে। কিন্তু ঐ পা যে দশ গুণ ভারী সেটা ভেবে দোকলে না? মানচি যে মোগল আমলে অত্যাচার অবিচার ছেল, কিন্তু মোগল শাসকেরা এদেশের ধনরত্ন অপহরণ করে সব দৌলত আরব পারস্যে পাটিয়ে দেয়নি। তারা এদেশেরই লোক হয়ে গ্যাচে। মোগলরা ব্যবসা করতে নামেনি, সাধারণ চাষীর উৎপাদনে হাত দেয়নি। আর দ্যাকো, নীলকরদের জ্বালায় সাধারণ চাষী তার মাঠে ধান না। ফলিয়ে নীল চাষে বাধ্য হচ্চে। পেটের মার সবচে বড় মার। মোগলরা অত্যাচার করতো, নারীহরণ, লুঠপট করতো, কিন্তু ইংরেজ সুকৌশলে গোটা দেশের মানুষকে পেটে মেরে দিচ্চে।
রামগোপাল বললেন, ঠিক বলেচো, দক্ষিণা।
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, এ লড়াই শুধু সেপাইরা লড়চে না। কিচুদিন আগে সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছেল, ইংরেজ তাদের পিটিয়ে অনেকটা ঠাণ্ডা করলেও তারা শান্ত হয়নি, যে-কোনো সময় তারা আবার ফুসে উঠবে। ফরাজীরাও স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেল, তাদের নেতা দুদু খাঁ এখন জেলে, কিন্তু তাঁর হাজার হাজার চ্যালা আচে বলে শুনিচি, তারা যে-কোনো দিন ইংরেজের বিরুদ্ধে আবার অস্ত্ৰ ধরতে পারে। নীল চাষীরাই বা কতদিন এই অত্যাচার মেনে নেবে? লড়াই লাগবে নানা দিক দিয়ে। ইংরেজ কী ভাবে সবাইকে ঠেকবে?
রামগোপাল বললেন, তোমরা বুজতে পাচ্চো না কেন, এটা কত বড় একটা শুভ লক্ষণ যে হিন্দু মুসলমান একসঙ্গে মিলে দেশের স্বাধীনতা চাইচে।
প্যারীচাঁদ বললেন, যদি কোনোক্রমে ইংরেজ এ দেশ ছেড়ে চলে যায়, তা হলেই আবার দেকবে, হিন্দুর ভাগ্যে লবডঙ্কা! হাতিয়ার তো মুসলমানদের হাতে, শাসনভারও তাদের হাতেই থাকচে। রাধানাথ বললেন, যাবে না, যাবে না, ইংরেজ এ দেশ ছেড়ে যাবে না, কোনো চিন্তা নেই। কী বলো, তনু? তুমি চুপ করে রয়েচো, কিচু বলচো না?
স্বল্পভাষী রামতনু বললেন, আমি শুনচি তোমাদের কতা। তবে আমার মত যদি জিজ্ঞেস করো, তা হলে বলি, আমি ইংরেজ শাসনের পক্ষে। এ দেশ সবেমাত্র জেগে উঠেচে, এখনো স্বাবলম্বী হবার মতন ঠিক উপযুক্ত হয়নি।
রামগোপাল উত্তেজনার সঙ্গে উঠে বসে বললেন, তোমরা যাই বলো, আজ যদি সেপাইরা কলকাতায় এসে পড়ে, আমি নিজে তাদের স্বাগতম জানাবো, তাদের বুকে জড়িয়ে ধরবো।
প্যারীচাঁদ বললেন, তার আগেই সেপাইরা তোমায় কচুকাটা করবে!
রাধানাথ আবার হেসে উঠলেন।
রামগোপাল বললেন, কেন? সেপাইরা নিজের দেশের লোকদের মারচে, এমন তো শুনিনি। প্যারীচাঁদ বললেন, বাঙালীদের ওপর তাদের ভারি রাগ। তুমি তো প্যান্টালুন না। পরে রাস্তায় বেরোও না, প্যান্টালুন পরা লোক দেকালেই নাকি সেপাইরা ঠ্যাঙাচ্চে।
রাধানাথ বললেন, আর মেদনীপুর থেকে রাজনারায়ণ চিঠিতে কী লিখেচে, বলো?
প্যারীচাঁদ বললেন, রাজনারায়ণ বড় মজার কতা লিকেচে। ও তো মেদিনীপুরের হেড মাস্টার। ওকে স্কুল আওয়ারে সর্বদা প্যান্টালুন-কোট পরে থাকতে হয়। এদিকে মেদিনীপুরে সেপাইদেরও একটা ছাউনি আচে। কখুন সেপাইরা বিদ্রোহী হয়ে রে-রে করে ছুটে আসবে তার ঠিক নেইকো। তাই রাজনারায়ণ প্যান্টালুন কোটের নিচে ধুতি আর পিরান পরে থাকে। সেপাইদের আসতে দেকালই প্যান্টালুন-কোট ছেড়ে ভিড়ে মিশে যাবে।
রাধানাথ বললেন, একদিন শুধু হুজুকেই নাকি ইস্কুলের সব মাস্টাররা প্যান্টালুন-কোটি খুলে একেবারে…
প্যারীচাঁদ বললেন, দু দিন আগে বিদ্যাসাগর মশায়ের বাড়ি গোসলুম। তিনিও মুখ চুন করে বসে আচেন, দেকলুম।
রামগোপাল বললেন, কেন? বিদ্যাসাগর মশাই তো প্যান্টালুন পরেন না!
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, হ্যাঁ, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের ভয়ের কারণ আচে বটে, এমন আমিও অনুমান করিচি।
রামগোপাল আরও বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, বিদ্যাসাগর মশাই বিধবা আইনের প্রবক্তা। এ কতা সারা ভারতে কারুরই অবিদিত নেই। সেপাইরা বিধবা বিবাহের ব্যাপারটা খুবই কু-নজরে দেকেচে। তারা মনে করে, সতীদাহ নিবারণ, বিধবার বিবাহ, এই সব আইন পাশ করে ইংরেজ আমাদের ধর্মে আঘাত হেনোচে। আর কলকাতার ইংরেজী-জানা বাঙালীরা ইংরেজকে মদত দিয়েচে। তাই শিক্ষিত বাঙালীদের ওপর তাদের রাগ।
প্যারীচাঁদ বললেন, শুনচি নাকি বিদ্যাসাগর মশাই সরকারের কাচে গিয়ে বলবেন, বিধবা বিবাহ আইন আবার রদ করে দিতে।
রামগোপাল গলা চড়িয়ে বললেন, কক্ষনো না। তা হতে পারে না। বিদ্যাসাগর একটা মহৎ কাজ করেচেন, আবার সেটা বন্ধ হবে? যারা বিধবা বিবাহের বিপক্ষে ছেল, তাদেরই মধ্যে কিছু মতলববাজ সেপাইদের নামে এ সব রটাচ্ছে।
রাধানাথ বললেন, তবেই বোঝে, রামগোপাল, তুমি তো খুব সেপাইদের নামে সাফাই গাইছেলে। তারা ইংরেজদের হটালে এই সব ভালো ভালো কাজ রদ করে দেবে। ইংরেজী পড়ার ইস্কুলগুলোও বন্ধ করে দিয়ে আবার আরবী-ফাসী পড়াবে।
রামগোপাল দক্ষিণারঞ্জনের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা ডিরোজিওর শিষ্যরা নানান ব্যাপারে আমাদের মত প্ৰকাশ করেচি, উপযুক্ত আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েচি, আর এখন দেশে এত বড় একটা কাণ্ড হচ্চে, আমরা কোনো কতা বলবো না? কোনটা মন্দ তাও জানাবো না?
দক্ষিণারঞ্জন বললেন, ইংরেজ শাসনের দোষ-ত্রুটি ও অবিচার ব্দেকিয়ে আমাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের চেষ্টা করতে হবে তো বটেই। কিন্তু আমার মনে হয়, এই সঙ্কটের সময় প্রকাশ্যে ইংরেজের বিরোধিতা না করাই ভালো। ঘটনার গতি কোন দিকে যায়, সেদিকে আমাদের এখন শুধু লক্ষ্য রাখাই উচিত কাজ হবে।
জোড়াসাঁকোর সিংহ বাড়িতেও এই একই সময় একই বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে। বিদ্যোৎসাহিনী সভার কয়েকজন সভ্য এ বাড়িতেই কিছুদিনের জন্য বসতি নিয়েছেন। নাটক অভিনয়ের নেশা এমনই লেগে গেছে যে কিছুতেই আর মহলা বন্ধ করতে তাদের মন চায় না। মাঝে মাঝেই অবশ্য বিদ্রোহের কথা ওঠে।
অনেক আলোচনার পর বিদ্যোৎসাহিনী সভার সভ্যরাও সিদ্ধান্ত নিল যে বর্তমান সময়ে ইংরেজ শাসনকে সমর্থন করাই সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। ইংরেজদের অনেক দোষ আছে সত্য, তবু ইংরেজরা এদেশে মোটামুটি সুশৃঙ্খল, সভ্য শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছে, তার বদলে শিক্ষাহীন, নীতিহীন সিপাহীদের শাসন চালু হলে দেশের চরম দুদিন আসবে, চরম অরাজক অবস্থা চলবে। যদুপতি গাঙ্গুলী ও নবীনকুমার সিপাহীদের এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষে দু-চারটি কথা বলতে গিয়েছিল, কিন্তু হিন্দু প্যাট্রিয়টের সম্পাদক হরিশ মুখুজ্যে যুক্তিপূর্ণ, তীব্র ভাষায় তাদের একেবারে নিরস্ত করে দিল। হরিশের কথাই শেষ পর্যন্ত মেনে নিল সকলে।
সেদিন ওদের বৈঠক শেষ হলো অনেক রাতে। পলাশীর যুদ্ধের শতবার্ষিকীর দিনটিতে কলকাতা শহরে কিছুই ঘটলো না। অন্যরা সকলে খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়লো মজলিশ কক্ষে, নবীনকুমার গেল নিজের ঘরে।
মধ্যরাতে ঘুম ভেঙে গেল নবীনকুমারের। পাৰ্থে শায়িত সরোজিনীকে ঠেলা দিয়ে ডেকে নবীনকুমার বললো, সরোজ, সরোজ, ওঠে, ওঠে।
সরোজিনী ধড়ফড় করে জেগে উঠে বললো, কী, কী হয়েচে?
নবীনকুমার বললো, আমি বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেকলুম। স্বপ্ন কিনা কে জানে। তুমি বাইরে রাস্তায় কোনো শোরগোল শুনতে পাচ্চো? আমি যেন এখুনো শুনচি!
সরোজিনী বললো, কই, কোনো শব্দ নেই তো! সব তো একেবারে শুনশান!
নবীনকুমার বললো, তা হলে স্বপ্নই। আমি কী দেকলুম জানো, সেপাইরা এসে পড়েচে আর কলকেতা শহর একেবারে কত্তজ করে নিয়েচে এক লহমায়।
সরোজিনী বললো, ওমা, এ কী সৰ্ব্ববুনেশে কতা! এমন স্বপন কেউ দ্যাকে? সেপাইরা এলে আমাদেরও মেরে কুটে শেষ করবে না?
নবীনকুমার বললো, হ্যাঁ, হরিশ তো তাই বললে। সবাই বললে। আমি স্বপ্ন দেকলুম একেবারে সত্যের মতন। সেপাইরা সব সাহেব মেমদের কচুকাটা কচ্চে। তারপর একটা অদ্ভুত কাণ্ড হলো।
-না?
—আমি তো বুঝে গেচি যে ইংরেজই আমাদের পক্ষে ভালো। সেপাইরা বর্বর। ইংরেজ শাসন না থাকলে আমাদেরই বিপদ। কিন্তু স্বপ্নে যখন দেকলুম, সেপাইরা ইংরেজদের মারচে, ইংরেজরা ভয়ে হাউ মাউ কচ্চে আর পোঁ পোঁ দৌড়চ্চে, তখন আমার খুব আনন্দ হলো। আমি আনন্দে নাচতে লাগলুম। বলো, ভারী আশ্চর্য না?