রানুরা নতুন বাসায় উঠে এসেছে। অফিসের ফ্ল্যাট। দু’টি বেড রুম দু’টি বারান্দা, ড্রইং কাম ডাইনিং। একটি ছোট্ট স্টোর রুমের মত আছে। বাসায় ঢোকার সময় আনন্দে রানুর চোখে পানি এসে গেল। এটি তার নিজের বাসা, সম্পূর্ণ নিজের মত করে সাজানো যাবে। স্বাধীনভাবে থাকা যাবে। খালা খবরদারি করতে আসবে না। টগরের জন্যে সুন্দর করে একটা রুম সাজিয়ে দেয়া যাবে। তার নিজের থাকার একটি ঘর। অপলা নেই, এটি একদিকে দিয়ে ভােলই হয়েছে। অপলা থাকলে ঘর ভাগ করা একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াত। কিছুদিন থেকে অপলার সঙ্গে সম্পর্কও খুব খারাপ হয়ে পড়েছিল। কেন জানি তাকে আর সহ্য হত না।
সে এখন মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে সিট পেয়েছে। তার পড়ার খরচ যে মামা দিতেন। তিনি এই বাড়তি খরচ কিভাবে দেবেন তা রানু জানে না। ওটা তাদের ব্যাপার। অপলাকে সে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, খরচ কি ভাবে চালাবি?
সে শান্ত গলায় বলেছে, ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। দরকার হলে প্রাইভেট টুৰ্যশনি করব। বেশ কিছুদিন তুমি আমাকে থাকতে দিয়েছ তার জন্যে মেনি থ্যাংকস।
তুই এমন করে কথা বলছিস কেন?
আমি একটা খারাপ মেয়ে আপা! কী করব বল। যা মনে আসে বলে ফেলি। ক্ষমা করে দাও।
রানু ভাবেনি সত্যি সত্যি। অপলা শেষ পর্যন্ত হোস্টেলে যাবে। তার ধারণা ছিল শেষ পর্যন্ত টগরের জন্যেই যাওয়া হবে না। টগর যখন বলবে, তুমি যেতে পারবে না খালামণি। তখন তার পক্ষে যাওয়া অসম্ভব হবে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার টগর কিছুই বলল না। অপলা চোখ মুছতে মুছতে যখন বলল, টগার যাচ্ছি রে। সে কিছুই বলল না। যেন চলে যাওয়াটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অপলা বলল, কাঁদিস না। ব্যাটা ছেলের কান্না খুব খারাপ।
টগর অবাক হয়ে বলল, কই কাঁদছি না তো। অপলা একাই কেঁদে বুক ভাসিয়ে রিকশায় গিয়ে উঠল। রানু একবার ভাবল বলবে, থাক যেতে হবে না। কিন্তু তা বলা হল না।
অপলার এভাবে থাকতে অসুবিধা হবে। সমস্যা হবে। সব সমস্যারই সমাধান আছে। এই সমস্যারও নিশ্চয়ই কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।
একটি কাজের মেয়ে পাওয়া গেছে। সে টগরের দেখাশুনা করতে পারবে। তা ছাড়া খুব বেশি সময় দেখাশোনা করতেও হবে না। টগরের স্কুল ছুটি হবে বারটায়। দুটোর সময় রানুর অফিস ছুটি হয়। দু-তিন ঘণ্টার ব্যাপার। টগর কোন অবুঝ ছেলে নয়। কেউ না থাকলেও সে দু-তিন ঘণ্টা সময় অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে। ঘর-দুয়ার গুছিয়ে বসতে তার পাঁচ-ছদিন লাগল। নিজেই ঘুরে ঘুরে কিছু ফার্নিচার কিনল। একটা কার্পেট কেনার খুব সখ ছিল। কিন্তু কেনা গেল না। অনেকগুলি টাকা একসঙ্গে বেরিয়ে যায়।
রানুর নতুন বাড়িতে ঘন ঘন আসল শুধু আলম। যতবারই সে এল এতবাই রানু বিরক্ত হল। ততবারই মনে হল তার নিজের একটি সংসারে সে জোর করে ঢুকে পড়তে চাইছে। একেকবার তার বলন্তে ইচ্ছা হল প্লিজ বার বার এসে আমাকে বিরক্ত করবে না, আমার ভাল লাগে না। একজন ডিভোর্স মহিলার কাছে একজন পুরুষ মানুষের বারবার আসা ভাল দেখায় না। লোকজন খারাপ চোখে দেখে।
মনের কথা প্ৰায় কোনো সময়ই বলা যায় না। বলা গেলে সংসারের জটিলতা কমত। কিন্তু সংসার জটিলতা পছন্দ করে। নয়ত অপলার সঙ্গে এই ঝামেলাটা হত না।
বুধবার, টগর খুব উৎকণ্ঠায় কাটাল। বাবা কী আসবে? তাদের নতুন বাসা সেকি চেনে? তার উৎকণ্ঠার কথা সে অবশ্যি মাকে বলল না। বেশির ভাগ সময়ই বারান্দায় কাটাতে লাগল। সন্ধাবেলা একবার এসে মাকে জিজ্ঞেস করল, বাবা এই বাসা চেনে?
রানু হালকা গলায় বলল, চেনে না। তবে ঠিকানা দিয়ে এসেছি, খুঁজে বের করতে অসুবিধা হবে না।
টগর, ইতস্তত করে বলল, বাবা আর খালামণি কী একসঙ্গে আসবে?
রানু চমকে উঠল। টগরের এ ধরনের কথা বলার মানে কী? ওদের দু’জনকে নিয়ে সে কী কোন কিছু কল্পনা করে?
টগর।
কী?
ওরা দু’জন একসঙ্গে আসবে, এটা তুমি কেন বলছ?
টগর কিছু বলল না।
তোমার খালামণি কী তোমাকে কিছু বলেছে?
টগর মাথা নাড়াল। কিছু বলেনি। প্রশ্নটি করে রানু নিজেও লজ্জিত হয়ে পড়ল। এ জাতীয় প্রশ্ন টগরকে করার কোনোই মানে হয় না। কেন সে করল?
ওসমান সাহেব বুধবার এলেন না। তবে তাঁর একটি চিঠি এল। নতুন বাসায় কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। প্রয়োজন মনে করলে আকবরের মাকে নিয়ে যেতে। বিশ্বাসী পুরনো মানুষ। ও কাছে থাকলে সুবিধা হবে। তিনি আসতে পারছেন না। কারণ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। পুরনো অসুখঅনিদ্ৰা।
ওসমান সাহেবের চিঠির সঙ্গে অপলারও একটি চিঠি এল। দীর্ঘ চিঠি। সব মিলিয়ে এগারো পৃষ্ঠা। শুরু হয়েছে এ ভাবে –
আপা, হোস্টেলে থাকতে আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু নিজে থেকে ফিরে আসতেও লজ্জা লাগছে। তুমি এসে আমাকে নিয়ে যাও। আর শোন আপা, আমাকে নিয়ে তুমি যে সন্দেহ করছ এটা ঠিক না। দুলাভাইকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু তার মানে এই না যে আমি তাকে বিয়ে করবার জন্যে পাগল হয়ে আছি। অবশ্যি এটা ঠিক যে তার মত কোনো ছেলের সঙ্গে যদি আমার দেখা হয় তাহলে…। আজ আমার লিখতে লজ্জা লাগছে। তা ছাড়া একটা কথা। আপা, যদি দুলাভাইকে আমার খুব বেশি ভাল লাগে সেটা কী আমার অপরাধ? কেন তুমি আমার ওপর ঐ দিন এত রাগ করলো? ঐদিন সকাল সকাল আমার কলেজ ছুটি হল। আমি ভাবলাম হঠাৎ করে দুলাভাইকে গিয়ে চমকে দেব। গিয়ে দেখি দুলাভাই নেই। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। এমন সময় তুমি উপস্থিত হলে, আমাকে দেখে ভাবলে, আমি রোজ এখানে এসে বসে থাকি। আমি কী ঠিক করেছিলাম জানো? তোমার সঙ্গে বাসায় যাব। তারপর একা একা ছাদে উঠে ছাদ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ব।
আপা, তুমি দুলাভাইকে জিজ্ঞেস করে দেখ আমি আর কোনোদিন যাইনি। উনি তো মিথ্যা কথা বলেন না। তার এই গুণটি তো তুমি নিজেও স্বীকার কর। কর না?
গুটি গুটি করে লেখা চিঠি শেষ করতে রানুর আধঘণ্টা লাগল। সেই দিনই বিকেলে গিয়ে অপলাকে নিয়ে এল। এই কদিনই আপলা রোগা হয়ে গেছে। তাকে কেমন লম্বা লম্বা লাগছে।