মনোয়ারা অবাক হয়ে বললেন, রফিক একে বিয়ে করেছে? তুমি এসব কী বলছ বৌমা।
নীলু মনোয়ারার হাত ধরল।
মা, আপনি আমার সঙ্গে আসুন, আমি আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি। আসুন আমার সঙ্গে।
আমাকে কিছুই বুঝিয়ে বলতে হবে না। আমি সবই বুঝতে পারছিা! রফিক কোথায়?
ও একটু বাইরে গেছে। আসবে। মা আপনি একটু আসুন আমার সঙ্গে।
তুমি বৌমা আমার হাত ধরে টানাটানি করবে না। আমি এই মেয়ের সঙ্গে কথা বলব।
শারমিন তেজা-চোখে তাকাল মনোয়ারার দিকে। হোসেন সাহেব বললেন, কথা বলার জন্যে এত ব্যস্ত কেন? এই মেয়ে তো আর চলে যাচ্ছে না। তুমি যাও বৌমার সঙ্গে।
মনোয়ারা কড়া চোখে তাকালেন। হোসেন সাহেব থিতামত খেয়ে থেমে গেলেন। মনোয়ারা কড়া গলায় বললেন, বৌমা, তুমি সবাইকে নিয়ে এ ঘর থেকে যাও, আমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলব। একা কথা বলব।
নীলু সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। হোসেন সাহেব দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, বড়ো ঝামেলা হয়ে গেল তো বৌমা। শফিক এসেছে?
জ্বি-না।
বাজে কটা?
আটটা।
কাণ্ডটা রফিক কী করল!
বাবা, আপনি টুনী আর বাবলুকে নিয়ে বসেন।
হ্যাঁ, বসছি। তুমি যাও, তোমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে দেখ, কিছু করা যায়। কিনা। মেয়েটার জন্য বড়ো মায়া লাগছে।
হোসেন সাহেব টুনী এবং বাবলুকে নিয়ে বারান্দায় চলে গেলেন। শাহানা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে ফিসফিস করে বলল, কী হবে, ভাবী?
কিছুই হবে না। হবে। আবার কি?
মাযে কী করছেন! তুমি লক্ষ করেছ ভাবী, মা রাগে কাঁপছিলেন। রফিক ভাই আবার কোথায় গেল?
কী জানি কোথায়?
শাহানা চাপা গলায় বলল, আমার এমন রাগ লাগছে ভাইয়ার উপর। কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে। শাহানা সত্যি সত্যি কেঁদে ফেলল।
মনোয়ারা কড়া গলায় বললেন, তুমি বস এখানে!
শারমিন বসল। তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন।
তুমি আমাকে বল, তুমি কেমন মেয়ে? বাবা-মাকে কিছুই না বলে বিয়ে করে ফেললে?
শারমিন নিঃশ্বাস চাপতে চেষ্টা করল। পারল না।
চাকরি নেই, কিছু নেই, এমন এক জন অপদার্থকে বিয়ে করে ফেললে! যার নিজের থাকার জায়গা নেই। তুমিও তার মতোই অন্যের ঘাড়ে বসে খাবে। চক্ষুলজ্জাও তোমার নেই?
নীলু এসে মনোয়ারাকে প্রায় টেনে ঘর থেকে বের করে নিয়ে গেল! শারমিন শুকনো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। তার মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছে। চারদিকে কি ঘটছে না-ঘটছে কিছুই বুঝতে পারছে না। পরিচিত কেউ নেই যে এসে তার পাশে দাঁড়াবে। আশা ও সত্ত্বনার কিছু বলবে। জীবন এত কঠিন কেন?
চমৎকার একটি চাঁদ উঠেছে আকাশে। শফিক বারান্দায় বসে সিগারেট টানছে। নাটকীয় এই সংবাদ সে শুনেছে। সে কোনো কথা বলে নি। রাতে নীলু যখন তাকে খাবার জন্যে ডাকল, সে বলল, আমার কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না নীলু।
শারমিনও কিছু খায় নি। সে রফিকের ঘরে মাথা নিচু করে বসে আছে। রফিক তাকে শান্ত করার চেষ্টা করেছে, কোনো কাজ হয় নি। সে, একটিও কথা বলে নি। রফিক বলল, আমাদের জীবনটা শুরু হল খুব খারাপভাবে। তাই না? শারমিন জবাব দিল না।
তবু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এক দিন সব ঠিক হয়ে যাবে শারমিন।
বল।
খুব সুন্দর জোছনা হয়েছে বাইরে। চল না একটু ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
তুমি যাও। আমার ইচ্ছা করছে না।
শারমিন, প্লিজ।
রফিক, আমাকে বিরক্ত করবে না।
এত সুন্দর একটা রাত নষ্ট করব?
শারমিন জবাব দিল না। কিন্তু উঠল। রফিক ছুটে গেল নীলুর কাছে। তার খুব শখ, ভাবীকে দিয়ে একটা গান যদি গাওয়াতে পারে। অনেক দিন আগে এ-রকম এক জোছনা-রাতে তারা সবাই মিলে ছাদে হাঁটছিল। হঠাৎ কী মনে করে ভাবী গুনগুন করে গেয়েছিল-চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে। ভাবীকে চেপে ধরলে সে কি তাদের নতুন জীবনকে সুসহ করবার জন্যে একটা গান গাইবে না? ভাবীর পক্ষে কি এতটা নির্দয় হওয়া সম্ভব?
জোছনার ফিনিক ফুটেছে চারদিকে। আকাশ ভেঙে পড়ছে আলোয়। কি উথািলপাথাল জোছনা! ছাদে একটি পার্টি পাতা হয়েছে। শারমিন মাথা নিচু করে বসে আছে পাটিতে। শাহানা টী-পট ভর্তি করে চা নিয়ে এসেছে। নীলু মৃদুস্বরে বলল, মন-খারাপ করো না শারমিন। দেখ, কী সুন্দর একটা রাত! এমন চমৎকার জোছনা কখনো দেখেছ?
শারমিন কোনো জবাব দিল না।
তাদের অবাক করে দিয়ে নীলু গুনগুন করে উঠল, আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে। তার গলা তেমন কিছু আহামরি নয়।
কিন্তু তবু কী অপূর্বই শোনাল সেই গান!
অবাক হয়ে চিলেকোঠার ঘর থেকে বেরিয়ে এল আনিস।
হোসেন সাহেব ফিসফিস করে বললেন, কে গাইছে? আমাদের বড় বৌমা? বড়ো মিঠা গলা তো আমার মার।
গাইতে গাইতে নীলু, শাড়ির আঁচলে তার চোখ মুছল। শারমিনের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়তে লাগল। তার মন বলছে, আজকের এই চোখের জলে জীবনের সমস্ত দুঃখ ও বেদনা ধুয়ে-মুছে যাবে। সে হাত বাড়িয়ে রফিককে স্পর্শ করল। ভালবাসার স্পর্শ, যার জন্যে প্রতিটি পুরুষ হৃদয় তৃষিত হয়ে থাকে। রফিক তাকাল আকাশের দিকে। আহ, কী চমৎকার জোছনা। এত সুন্দর কেন পৃথিবীটা?