২৩. যক্ষ্মা ঘোষণা করেন ডাক্তার

যক্ষ্মা। ঘোষণা করেন ডাক্তার। যক্ষ্মা।

শুভদীপ জানত। বিশ্বদীপ জানত না। সে বিশ্বদীপের মুখের দিকে তাকায় এবং কোনও কিছু ভেঙে পড়ার প্রচণ্ড শব্দ শোনে। মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে নেয় সে। আর দেখতে পায় স্বপ্নের অসংখ্য ভাঙ টুকরো ছড়ানো মেঝেময়। বিশ্বদীপের দীর্ঘলালিত স্বপ্ন।

ডাক্তারের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ম্লান হেসে বিশ্বদীপ বলে, সাধ্যাতিরিক্ত দিয়েও সাধ্যাতীতকে জয় করা যায় না শেষ পর্যন্ত। সাধ্যাতীত ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকে চিরকাল।

সে বিশ্বদীপের হাতে চাপ দেয়। ভেঙে পড়ার মতো কোনও ব্যাপার নয় বলে। আজ বাবা বাড়িতে ফিরে এসেছে বলে খুশি থাকতে অনুরোধ করে। বিশ্বদীপ একটু সময় চায় তখন। বাড়িতে ঢোকার আগে একটু সামলে নিতে চায় নিজেকে। দু’ভাই পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার দিকে যায়। একটি চায়ের দোকানে বসে। স্থির করে, কিছুই জানাবেনা আর কারওকে এখন। বলবে ভাইরাসঘটিত জ্বর। সারতে সময় লাগবে। প্রয়োজন না হলে কোনও দিন জানাবে না।

বিশ্বদীপ চায়ে চুমুক দিয়ে সিগারেট ধরায়। হাত চেপে ধরে শুভদীপ। অনুরোধ করে না খাবার জন্য। সিগারেট ফেলে দেয় বিশ্বদীপ। নিভে যাওয়া গলায় বলে, এইবার মিঠু তাকে ছেড়ে চলে যাবে।

কষ্টে বুকে চিড় ধরে যায় শুভদীপের। তার হাত কাঁপে। এ প্রসঙ্গে কোনও সান্ত্বনার ভাষা তার মুখে আসে না। সে চুপ করে থাকে। বিশ্বদীপ হাসে তখন। নিপ্রাণ হাসি। প্রলাপের মতো বলে, সেব্যর্থ হল। শুভদীপের পাশে দাঁড়াতে পারল না। উল্টে রোগ বাঁধিয়ে বোঝা হয়ে গেল। ঘেরা স্নানঘরও আর বানানো হল না তার।

শুভদীপ তাকে বোঝায়। যক্ষ্মা এখন আর কোনও সমস্যাই নয়, বোঝায়। আর বোঝাতে বোঝাতে দু’জনে বাড়ি ফেরে

বাবার কাছে বসে, আছে শুচু। বিশ্বদীপ নিজের জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। শুভদীপ বসে থাকে পাশে। বিশ্বদীপের কী হয়েছে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে না মা। বরং চা বানাতে বানাতে একটি সুসংবাদ পেশ করে হাসিমুখে। জানায়, শুভদীপ-বিশ্বদীপ মামা হতে চলেছে।

সব ভুলে লাফিয়ে ওঠে বিশ্বদীপ। লাফিয়ে ওঠে শুভদীপও। যতখানি আনন্দে তার চেয়ে অনেক বেশি—বিস্ময়ে। শুচু তা হলে…শুচ তাঁ হলে…তখন সে স্তব্ধ হয়ে যায় আর ঘৃণা এসে ঠুকরে দেয় বুক। কেন যায় দেন? তবে কেন যায়? সে স্থির করে দেবনন্দনকে প্রশ্ন করবে এর

মধ্যেই।

তখন চা নিয়ে পাশের ঘরে যায় মা আর শুচু হাতে চায়ের কাপ নিয়ে তাদের মধ্যে বসে। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে খুশির সঙ্গে জানায় বাবার শয্যাক্ষত ছোট হতে হতে প্রায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তার চোখ-মুখ খুশিতে উপচানো দেখায়। শুভদীপের বড় মায়া হয় ওর জন্য। খাঁচার মধ্যে থেকে সুবল চিৎকার করে—শুচু, ছোলা দে। লংকা দে। শুচু কলকল করে কথা বলে। নদামাসির কথা বলে। দেবনন্দনের কথা বলে। কত দিন মহীনের। ঘোড়াগুলি শোনা হয়নি বলে আর বলতে বলতে হঠাৎ বাক্য অসমাপ্ত রেখে থেমে যায়।

চোখের পলক পড়ে না। মুখের হাসি মাঝপথে আটকে যায়। কয়েক সেকেন্ড হাতের কাপ হাতে–তারপর খসে পড়ে মেঝেয়। টুকরো টুকরো হয়ে যায়। শুভদীপ-বিশ্বদীপ কোনও কিছু বোেঝার আগেই শুচু এলিয়ে পড়ে। চলে যায়। পরিবার, পরিজন, স্বামী, সংসার, সম্ভাব্য সন্তান–সবাইকে ছেড়ে মহাপৃথিবীর পথে পাড়ি দেয় শুচু। জগৎসংসার স্তব্ধ হয়ে থাকে।

শুধু সুবল একটানা বলে যায়—শুচু, ছোলা দে লংকা দে। শুচু, ছোলা দে সং দে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *