২৩. মাকে দেখে আতাহার ফিরে যাচ্ছিল

মাকে দেখে আতাহার ফিরে যাচ্ছিল। হাসপাতালের টানা বারান্দা, রাত বেশি বলেই বাবান্দা নির্জন। হাসপাতালের নিজন টানা বারান্দায় হাঁটতে আতাহারের গা সব সময়ই ছমছম করে। মনে হয়, এই বুঝি মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কুঁজে বিকটি-দর্শন এক বৃদ্ধ যার চোখে কোন পাতা নেই বলে পলক পড়ে না। যার গলার স্বর তীব্র, তীক্ষা ও হিম-শীতল। কথা বলার সময় এই বৃদ্ধের মুখ দিয়ে দুৰ্গন্ধ লালা পড়ে। হাসপাতালের নির্জন বারান্দায় হাঁটার সময়ই শুধু আতাহারের মনে হয় মানুষের মাথার পেছন দিকে দুটা চোখ থাকলে ভাল হত। পেছনে কেউ আসছে কিনা বোঝা যেত।

আতাহার থমকে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরল। যদিও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। পেছন থেকে কবি সাহেব বলে যে তাকে ডাকছে সে আর যাই হোক মৃত্যু নয়।

এপ্রণ পরা হাসি হাসি মুখের তরুণী আতাহারকে পেছন ফিরতে দেখে বলল, এ রকম চমকে উঠলেন কেন? ভয় পেয়েছেন?

আতাহার বলল, পেছন থেকে কেউ ডাকলেই আমি চমকে উঠি। তার উপর আপনি কবি সাহেব ডাকলেন।

মাকে দেখে ফিরছেন?

জ্বি।

আতাহার এই ডাক্তার মেয়েটিকে চেনে। কয়েকবার দেখা হয়েছে। কখনোই মেয়েটিকে তেমন রূপবতী মনে হয়নি। আজ হচ্ছে। রূপ সম্ভবত সময় ও পরিবেশনির্ভর। হাসপাতালের নির্জন টানা বারান্দায় সাধারণ রকম সুন্দর মেয়েকেও হয়ত অসাধারণ মনে হয়।

মাকে কেমন দেখলেন?

আগে যেমন দেখেছি এখনো তাই। জ্ঞান নেই–ডাকলে সাড়া দেন না। আজ কি আপনার নাইট ডিউটি?

জ্বি।

সারারাত জেগে থাকবেন?

তা তো থাকতেই হবে।

সারারাত জেগে থেকে কি করেন?

যখন কাজ থাকে কাজ করি। যখন কাজ থাকে না–গল্পের বই পড়ি। বাসা থেকে গল্পের বই নিয়ে আসি।

কবিতা পড়েন না?

না, কবিতা পড়ি না।

আজ কোন বইটা পড়বেন?

আজ একটা ইংরেজি উপন্যাস নিয়ে এসেছি–Death in the maiden. আপনি পড়েছেন?

জ্বি না।

এর ছবিও হয়েছে। রোমান পলিনস্কি ছবি করেছেন। ভিসিআর-এ প্রিন্ট পাওয়া যায়। আমি অবশ্যি এখনো দেখিনি। আপনি দেখেছেন?

জি-না। আমাদের ভিসিআর নেই।

ডাক্তার মহিলা চলে যাবার মত ভঙ্গি করেও আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। আতাহার নিজেও অবাক হচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতগুলি কথা ডাক্তার মেয়েটা কেন বলল। মনে হয় সে রোগীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ক্লান্ত। কিংবা কে জানে এই মেয়েটিরও হয়ত মৃত্যুর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবার ভয় আছে। একা বারান্দায় হাঁটতে গিয়ে ভয় পাচ্ছিল বলে আতাহারকে দেখে এতগুলি কথা বলছে।

আতাহার বলল, আপনার যখন ঘুম পায় তখন কি করেন?

নাইট ডিউটি যখন থাকে তখন ঘুম পায় না। তারপরেও ঘুম পেলে চা-কফি খাই।

নিজেই বানিয়ে নেন, না বাইরে থেকে আনান?

নিজেই বানাই। ইলেকট্রিক কেটলি আছে–আপনার কি চা বা কফি খেতে ইচ্ছে করছে?

জ্বি-না। চা-কফি কোনটাই খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করতে ইচ্ছে করছে।

ডাক্তার মেয়েটির চোখ তীক্ষু হতে গিয়ে হল না। রাগ করতে গিয়ে সে রাগ করল না। খানিকটা গম্ভীর গলায় বলল, আসুন। আমি তিন তলায় বসি। আপনার মার সঙ্গে আমার প্রায়ই কথা হত। সেটা কি আপনি জানেন? আপনার মা কি আপনাকে কখনো বলেছেন?

জ্বি-না।

আপনি যে একজন কবি সেটা আপনার মার কাছ থেকেই শোনা।

মা আমাকে বটু ডাকেন, সেটা কি জানেন?

হ্যাঁ জানি। তাও জানি।

আপনার নাম কি জানতে পারি?

আমার নাম হোসনা। এর মানে হচ্ছে সৌন্দর্য। নামকরণের সার্থকতা বিষয়ে কিছু লিখতে বললে আমার বাবা-মা বিপদে পড়বেন। আমি সুন্দর নই। আমার আরেকটা নাম আছে বুড়ি। এই নামটা মোটামুটি সার্থক বলতে পারেন। আমাকে দেখে বুড়ি-বুড়ি লাগছে না?

জ্বি লাগছে।

হোসনা ইলেকট্রিক কেটলিতে চা চাপিয়েছিল। আতাহারের কথায় চমকে গিয়ে তাকাল। আতাহার বলল, আপনাকে ঘাবড়ে দেয়ার জন্যে বললাম–লাগছে।

হোসনা চা বানিয়ে নিয়ে এসেছে। ইলেকট্রিক কেটলিতে পানি অতি দ্রুত ফুটে। চা তৈরি হচ্ছে–তার অপেক্ষায় যে আনন্দ তা পাওয়া যায় না।

আতাহার বলল, আমার মার অবস্থাটা কি বলবেন?

উনি উীপ কমায় আছেন।

তার থেকে উদ্ধারের সম্ভাবনা কতটুকু?

সম্ভাবনা কম। মেডিকেল সায়েন্স এই ডীপ কমা বিষয়ে তেমন কিছু বলতে পারে না। কেউ কেউ ফিরে আসেন। কেউ কেউ ফিরে আসে না। আট বছর কমাতে থেকে রোগীর জ্ঞান ফিরেছে, সে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে, জীবন শুরু করেছে–এ রকম নজির আছে।

যে কমায় থাকে তার কি কোন কষ্ট হয়?

আমি জানি না।

যে ভদ্রলোক আট বছর কমায় থেকে নতুন জীবন পেয়েছেন তিনি এই বিষয়ে কিছু বলেননি?

বললেও আমি পড়িনি।

যে রোগী কোমায় আছে তার পাশে বসে আমি যদি কথা বলি সে কি শুনবে?

আমি বলতে পারছি না।

আপনার এখানে সিগারেট খেতে পারি?

হ্যাঁ, খেতে পারেন।

আতাহার সিগারেট ধরাল। হোসনা বলল, আপনি আপনার মায়ের পাশে বসে গুনগুন করে প্রচুর কথা বলেন। তাই না?

জ্বি বলি। আপনি জানেন কিভাবে?

আমরা অনেকেই জানি। আপনি আপনার মাকে কি বলেন?

কিছু বলি না। গল্প করি।

গল্প করেন?

জ্বি। আমি নানান কথা বলি, মা জবাব দেন।

হোসনা বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার কথা বুঝতে পারছি না–উনি জবাব দেন মানে কি?

মার জবাবগুলি আমি কল্পনা করে নেই।

ও, আচ্ছা।

এই টেকনিকটা আমি শিখেছি নীতুর কাছে।

নীতু কে?

নীতু আমার এক বন্ধুর বোন। ও করে কি জানেন? টিভি নাটক দেখার সময় সাউন্ড অফ করে দেয়–এবং পাত্র-পাত্রীদের ডায়ালগ কল্পনা করে নেয়। এতে নাকি গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং করা যায়।

নীতু কি আপনার প্রমিকা?

আরে না। সামনের মাসের ১১ তারিখ নীতুর বিয়ে হচ্ছে। আরো আগেই হত। হঠাৎ নীতুর শরীর খারাপ করায় ডেট পৌঁছানো হয়েছে।

আজ আপনি আপনার মার সঙ্গে কি গল্প করলেন?

ঢাকায় কি ঘটছে না ঘটছে সব তাকে বললাম। দুটা মজার রসিকতা করলাম। তারপর মাকে জিজ্ঞেস করলাম–তার কষ্ট হচ্ছে কি-না।

আপনার মা কি বললেন?

মা বললেন, হচ্ছে।

আপনি যখন আবার কোনদিন আপনার মার সঙ্গে কথা বলবেন তখন কি আমি পাশে থাকতে পারি?

হ্যাঁ, পারেন।

আরেক কাপ চা খাবেন?

জ্বি-না। আজ উঠি।

আতাহার উঠে দাঁড়াল। হোসনা বলল, আসুন আমি একটা শর্টকাট পথে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। মেয়েটির ভদ্রতায় আতাহার অবাক হয়ে গেল। মনে মনে সে বলল, বাহ, চমৎকার তো!

 

আতাহার হেঁটে হেঁটে ফিরছে। বড় মামার কারখানায় ফেরার ব্যাপারে কখনোই সে তেমন আগ্ৰহবোধ করে না। যত দেরিতে ফেরা যায় ততই ভাল। টিফিন কেরিয়ারে তার জন্যে খাবার টেবিলে থাকে। প্রতিদিন একই খাবার। ঠাণ্ডা। কড়কড়া একগাদা ভাত। ডাল। একটা তরকারি। ভাতের উপর বিশাল এক টুকরা পেঁয়াজ। পেঁয়াজটা কেন দেয়া হয় কে জানে। আতাহারের ঘরে আরো একজন থাকেন, অফিসের ম্যানেজার পরিমল বাবু। তিনি সারারাত কাশেন। রাত-কানা মানুষ আছে, রািত-কাশি লোকও যে আছে আতাহার জানত না। পরিমল বাবুকে দেখে জানল। দিনের বেলা ভদ্রলোক একবারও কাশেন না। তার কাশি শুরু হয় সূর্য ডোবার পর পর। এক একবার আতাহারের মনে হয়–কাশতে কাশতে ভদ্রলোকের ফুসফুসের টুকরা-টাকরা বোধহয় বের হয়ে পড়বে। কাশির বেগ প্রচুর বেড়ে গেলে ভদ্রলোক বিছানায় উঠে চোখ বড় বড় করে বলেন–আতাহার, দীর্ঘ জীবন ভগবান দিয়েছেন। জীবনটা ছোট হলে বাঁচতাম।

সম্পূর্ণ উল্টো ধরনের কথা। তারাশংকরের উপন্যাসের এক নায়ক বলত–

জীবন এত ছোট কেনে? কে জানে কোনটা সত্য।

দুটোই বোধ হয় সত্য। আতাহার পাঞ্জাবি খুলে বিছানায় বসল। গরম লাগছে। সিলিং ফ্যানটা বন্ধ। আতাহার ফ্যান ছাড়তে গেল। পরিমল বাবু বললেন, প্লীজ, নো নো।

আতাহার বলল, না কেন?

বাতাসে বুকে ঠাণ্ডা বসে যায়। ঠাণ্ডা একবার বসে গেলে আমি আর বাঁচবনা ব্রাদার।

বেঁচে থেকে করবেন কি? দীর্ঘ জীবন নিয়ে কি হবে? মরে যাওয়াটা ভাল না? দেই। ফ্যান খুলে?

নো নো। প্লীজ নো।

জানালাও দেখি বন্ধ করে রেখেছেন। দমবন্ধ হয়ে আমি নিজে মারা যাবো।

আমার দিকে তাকিয়ে একটু কষ্ট করুন।

পরিমল বাবু কাশতে শুরু করেছেন। তার চোখ ঠিকরে বের হবার উপক্রম হয়েছে। তিনি হপাতে হাঁপাতে বললেন–আতাহার এই দীর্ঘ জীবন আর সহ্য হচ্ছে না। জীবনটা ছোট হলে বাঁচতাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *