২৩. ভর আছে, ওজন নেই
যারা টেলিভিশন দেখে তারা নিশ্চয়ই কখনো না কখনো স্পেস শাটল বা অন্য কোনো মহাকাশযানের ভেতরের ভিডিও দেখেছে যেখানে দেখা যায় মহাকাশচারীরা ভাসছে। একজন মানুষের কোনো ওজন নেই, সে বাতাসে ভাসতে পারে, এর চাইতে চমকপ্রদ দৃশ্য কী হতে পারে?
এর কারণটা কী সেটা নিয়েও নিশ্চয়ই কৌতূহল হয়। আমার ধারণা বেশিরভাগ মানুষের ধারণা মহাশূন্যে এরকমই হওয়ার কথা। পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে থাকলে মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্যে আমরা ওজন অনুভব করি–যদি আকাশে বা মহাকাশে উঠে যাই তখন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায়, তাই আমরা আর কোনো ওজন অনুভব করি না, ওজনশূন্য অবস্থায় ভেসে বেড়াই।
আসলে আমাদের এই ধারণাটা পুরোপুরি ভুল। মহাশূন্যে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি মোটেও শূন্য নয়। যারা আমার কথা বিশ্বাস করে না তারা ইচ্ছে করলে এখনই হিসেব করে দেখতে পারে। একটা জিনিসের ভর যদি হয় m তাহলে তার ওজন হচ্ছে mg; এখানে g বলতে বোঝানো হচ্ছে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ, যার মান পৃথিবীর পৃষ্ঠে 10 m/s2-এর কাছাকাছি। চাঁদে এর মান ছয় গুণ কম তাই সেখানে কোনো একটা বস্তুর ওজন ছয় গুণ কম। বৃহস্পতি গ্রহের পৃষ্ঠে এটা আড়াই গুণ বেশি, তাই সেখানে একটা বস্তুর ওজন হবে আড়াই গুণ বেশি। কাজেই যদি দেখা যায় একটা বস্তুর ওজন শূন্য তাহলে বুঝতে হবে সেখানে মাধ্যাকর্ষণজনিত তৃরণও শূন্য। (অনেক সময় বলা হয় ভরশূন্য পরিবেশ–এটি কিন্তু ভুল কথা–ভর কখনো শূন্য হতে পারে না, শুধুমাত্র ওজন শূন্য হতে পারে!)
এবারে তাহলে আমরা মহাশূন্যে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ কত হয় সেটা বের করতে পারি–তবে তার আগে জানা দরকার মহাশূন্য বলতে আমরা কী বুঝি। শুনে অবাক লাগতে পারে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে পঞ্চাশ মাইল উপরে উঠলে সেটাকেই রীতিমতো মহাশূন্য বলা যেতে পারে। স্পেস শাটলের কক্ষপথ সাধারণত দুশো মাইল উচ্চতার কাছাকাছি থাকে। মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে দূরত্বের বর্গের হারে কমতে থাকে। পৃথিবীর ব্যাসার্ধ প্রায় চার হাজার মাইল, কাজেই মহাশূন্যে–অর্থাৎ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে চার হাজার দুইশত মাইল উপরে মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ মাত্র দশ শতাংশ কম। অর্থাৎ এই উচ্চতায় কোনো কিছুর ওজন কমবে মাত্র দশ শতাংশ। অর্থাৎ স্পেস শাটলে মহাকাশচারীদের ওজন শূন্য নয়–মহাকাশচারীদের ওজন তাদের সত্যিকার ওজনের নব্বই শতাংশ!
কিন্তু আমরা সবাই দেখেছি স্পেস শাটলে মহাকাশচারীরা ওজনহীন অবস্থায় ভেসে বেড়াচ্ছেন। যদি সত্যি সত্যি তাদের ওজন থেকে থাকে তাহলে তারা ভেসে বেড়াচ্ছেন কেন?–আসলে তাদের ভেসে বেড়ানোর কারণটা সস্পর্ণ ভিন্ন, এর সাথে মহাশূন্যের কোনো সস্পর্ক নেই। সত্যি কথা বলতে কী মানুষ ইচ্ছে করলে পৃথিবীর পৃষ্ঠেও ওজনহীন অনুভব করতে পারে। কেউ যদি মাত্র চার হাজার ডলার খরচ করতে রাজি থাকে তাহলে তারা বিশেষ এক ধরনের প্লেনে করে ওজনহীন হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাটুকু অর্জন করতে পারবে। কিছুদিন আগে বিশ্ব বরেণ্য বিজ্ঞানী স্টিফান হকিং এ ধরনের একটা বিমানে করে উড়ে ওজনহীন হওয়ার অনুভূতি অনুভব করেছিলেন–সেই ছবি সারা পৃথিবীর সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
ওজনহীন হওয়ার অনুভূতিটি খুবই সহজে পাওয়া যায়–কেউ যদি মুক্তভাবে পড়তে থাকে তাহলেই সে ওজনহীন অনুভব করবে। যারা ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারছে না তাদের জন্যে এরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করে নেয়া যায় : একজন মানুষের ঘাড়ে আরেকজন মানুষ চেপে বসেছে। নিঃসন্দেহে যে মানুষটির ঘাড়ে আরেকজন চেপে বসেছে সে চেপে বসা মানুষটির ওজনটুকু পুরোপুরি অনুভব করবে! এবারে কল্পনা করে নেয়া যাক মানুষটি তার ঘাড়ে চেপে বসা অন্য মানুষটিকে নিয়ে এগারো তলা একটা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে–যখন দুজন নিচে এসে পড়বে তখন কী অবস্থা হবে সেটার কথা আমরা আপাতত ভুলে যাই আমরা দেখার চেষ্টা করি যখন তারা নিচে পড়ছে তখন কী হচ্ছে। যতক্ষণ এগারোতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে মানুষটি দাঁড়িয়ে ছিল ততক্ষণ সে তার ঘাড়ে বসে থাকা মানুষটির ওজন অনুভব করেছে কিন্তু যখন দুজনেই মুক্তভাবে পড়তে শুরু করেছে তখন মানুষটি কিন্তু তার ঘাড়ে চেপে বসে থাকা অন্য মানুষটির ওজন আর অনুভব করবে না। দুজনে ঠিক একইভাবে নিচে পড়ছে–একজন অন্যজনের ওজন কীভাবে অনুভব করবে?
কাজেই ওজনহীন অনুভব করা খুবই সোজা–তার জন্যে মুক্তভাবে নিচে পড়তে হবে! ছেলেবেলায় আমরা যখন পাঁচিলের উপর থেকে লাফ দিয়েছি নিচে পড়ার সময় আমরা মুহর্তের জন্যে নিজেদের ওজনহীন অনুভব করেছি। তবে সময়টা এত কম যে ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার আগেই আমরা মাটিতে সজোরে আছড়ে পড়েছি!
এবারে আরো একটা জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া যাক। ধরা যাক আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা মানুষটিকে নিয়ে অন্য মানুষটি সরাসরি নিচে লাফিয়ে পড়ে অন্য একটা কাজ করল। সে ছাদের অন্য মাথায় গিয়ে সেখান থেকে ছুটে এসে লাফ দিল, তাহলে আমরা দেখব সে সরাসরি নিচে পড়ছে না–সে নিচে পড়ার সাথে সাথে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ তার গতির দুটো অংশ রয়েছে, একটা অংশ সরাসরি নিচের দিকে, আরেকটা অংশ সামনের দিকে। এবারেও কিন্তু দুজন মানুষই ওজনহীন অনুভব করবে, তারা যে মুক্তভাবে নিচে পড়ার সাথে সাথে সামনে খানিকটা এগিয়ে যাচ্ছে তার জন্যে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হবে না। সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ওজনহীন অনুভূতির কোনো পার্থক্য হচ্ছে না।
এবারে আমরা স্পেস শাটলের মহাকাশচারীদের ওজনহীন অনুভব করার বিষয়টি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করতে পারি, কিন্তু সেটা করার আগে আমরা একবার চট করে নিউটনের অভিজ্ঞতাটুকুর কথা বলে নিই। সত্য-মিথ্যা জানা নেই, গল্প প্রচলিত রয়েছে যে একবার নিউটন আপেল গাছের নিচে বসে ছিলেন তখন তার সামনে টুপ করে একটা আপেল এসে পড়ল। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী তিনি ভাবতে লাগলেন আপেলটি উপরে উঠে না গিয়ে নিচে কেন পড়ল এবং সেখান থেকেই তিনি মাধ্যাকর্ষণ শক্তির বিষয়টি আবিষ্কার করলেন। তার এই ভাবনার কথা বিশ্বাসযোগ্য নয় বরং যেটা হতে পারে সেটা এরকম : যখন আপেলটি নিচে এসে পড়ল তখন তিনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন সেখানে একটি চাঁদ। তিনি ভাবলেন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের কারণে আপেলটি টুপ করে নিচে এসে পড়ছে। পৃথিবী তো চাঁদটাকেও টানছে, তাহলে আকাশ থেকে চাঁদটা টুপ করে না হলেও ধপাস করে নিচে এসে পড়ছে না কেন?
আসলে এটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। পৃথিবী যেভাবে আপেলটাকে নিচে টানছে, চাঁদটাকেও সেভাবে নিচে টানছে। আপেলটা মাটিতে পড়ে যায় কিন্তু চাঁদটা পড়ে যায় না, এর মাঝে রহস্যটা কী?
আসলে এর মাঝে কোনো রহস্য নেই–চাঁদটাও কিন্তু পৃথিবীতে পড়ে যাচ্ছে। আপেল যেরকম মুক্তভাবে পড়ে, চাঁদটাও হুবহু সেভাবে পৃথিবীতে পড়ে যাচ্ছে। আমি জানি সকল পাঠক এবারে ভুরু কুঁচকে বলছেন সেটা যদি পড়েই যাচ্ছে তাহলে আমরা সেটা দেখাত পাচ্ছি না কেন? উত্তরটা খুবই সহজ, আমরা এটা দেখতে পেতাম যদি কেউ চাঁদটাকে থামিয়ে দিতে পারত–চাঁদটা শুধু যে পৃথিবীর দিকে পড়ে যাচ্ছে তা নয় একই সাথে সেটা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। যদি সেটা না হতো তাহলে আপেলের মতোই চাঁদটা পৃথিবীতে ধপাস করে পড়ত।
ব্যাপারটা বোঝার জন্যে আমরা 23.3 নং ছবিটা দেখতে পারি। ছবির প্রথম অংশে দেখানো হচ্ছে যদি পৃথিবী চাঁদটাকে নিজের দিকে না টানত–অর্থাৎ চাঁদটা যদি শুধু সামনের দিকে এত তাহলে কী হতো। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাহলে চাঁদটা ই থেকে ঈতে এসে পৌঁছাত। এর পরের ছবিতে আমরা দেখতে পাচ্ছি যদি চাঁদটার সামনের দিকে কোনো গতি না থাকত (অর্থাৎ চাঁদটাকে থামিয়ে দেয়া যেত) তাহলে কী হতো। আমরা দেখতে পাচ্ছি তাহলে চাঁদটা ঈ থেকে উতে এসে পৌঁছাত। তৃতীয় ছবিটাতে আমরা দেখাচ্ছি যদি চাঁদটা একই সাথে সামনের দিকে অগ্রসর হয় এবং নিচের দিকে নেমে আসে তাহলে কী হতো, আমরা দেখছি সেটা ই থেকে ঈ এবং ঈ থেকে উতে এসে পৌঁছাত! যেটা হচ্ছে পৃথিবীকে ঘিরে একটা গোলাকার কক্ষপথের ক্ষুদ্র একটা অংশ। চাঁদটা আবার একইভাবে সামনে এগিয়ে যেতে যেতে নিচে পড়তে থাকবে এবং সম্মিলিতভাবে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঋ বিন্দুতে পৌঁছাবে। অর্থাৎ সেটা বৃত্তাকারে পৃথিবীকে তার কক্ষপথে ঘুরতে থাকবে! স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান জানলেই আমরা এক মিনিটের মাঝে হিসেব করে বের করে ফেলতে পারব কোন কক্ষপথে থাকার জন্যে চাঁদকে কত বেগে ঘুরতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি!
কাজেই আমার ধারণা সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করতে শুরু করেছে স্পেস শাটলে কেন মহাকাশচারীরা ওজনহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়ায়। স্পেস শাটল যখন পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরতে থাকে তখন তার অবস্থা ঠিক চাঁদের মতোন, এটা আসলে প্রতি মুহূর্তেই পৃথিবীর আকর্ষণে পৃথিবীর দিকে মুক্তভাবে পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু যে সময়টাতে এটা মুক্তভাবে পড়ে যাচ্ছে সেই সময়টাতে এটা আবার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে, সে কারণে এটা সত্যি সত্যি নিচে না পড়ে গোলাকার কক্ষপথের নূতন একটা বিন্দুতে হাজির হয়! এভাবে ব্যাপারটা চলতেই থাকে–আমরা দেখতে পাই স্পেস শাটল পৃথিবীকে ঘিরে ঘুরছে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় এটা মুক্তভাবে পৃথিবীর দিকে পড়ার চেষ্টা করছে!
আমরা জানি কেউ যখন মুক্তভাবে পৃথিবীতে পড়ার চেষ্টা করে তখন সে ওজন অনুভব করে না। (বিজ্ঞানী স্টিফান হকিংসের সেই ছবিটি সবাই দেখেছে। তিনি ভাসছেন।) স্পেস, শাটলের ভেতরে যে মহাকাশচারীরা থাকেন তারাও সেই জন্যে কোনো ওজন্য অনুভব করেন না–কারণ স্পেস শাটলের সাথে সাথে তারাও আসলে মুক্তভাবেই পড়ছেন!
কাজেই ওজনহীন হবার জন্যে আসলে মহাশূন্যে যেতে হয় না–পৃথিবীর মাটিতেই ওজনহীন হওয়া সম্ভব–তার জন্যে শুধু একটা উঁচু জায়গা থেকে লাফ দিয়ে মুক্তভাবে পড়তে হয়–আর কিছু নয়!