অধ্যায় তেইশ – বিষয়ী জীবন
১. বংশগত দুর্বলতা
যাকে বলা হয় বাস্তব বিষয় বুদ্ধি’, কাণ্ডজ্ঞান’ কমনসেন্স’, সেটার কিছু-কিছু অভাব বোধ হয় পাইয়াছিলাম বাপ-দাদার কাছ হইতেই। ছেলেবেলা শুনিতাম, আমার বাপ-দাদাকে প্রায় সকলেই সরল-সিধা-মানুষ’ বলিত। আহম্মক বলিত না বোধ হয় সম্মান করিয়া। মাঠ হইতে কামলারা একদিন উত্তেজিত হইয়া আসিয়া দাদাজীর কাছে নালিশ করিল, ফলানারা অমুক ক্ষেতের বাতর কাটিয়া আমাদের প্রায় এক হাত জমি তাদের ক্ষেতভুক্ত করিয়াছে। দাদাজী ক্ষেত দেখিতে গেলেন। ভিড় করিয়া বহু হিতৈষী প্রতিবেশী সঙ্গে গেল। সকলেই দাদাজীকে উস্কানি দিতে লাগিল : এমন বাড়াবাড়ি কিছুতেই সহ্য করা যায় না। আজ বেটাদেরে আক্কেল দিতেই হইবে। কিন্তু দাদাজী উল্টা আক্কেল দিলেন নিজের কামলাদেরে। কোথায় একহাত জমি কাটিয়া লইয়াছে? আমাদের ক্ষেত উঁচা অপর পক্ষেরটা নিচা। আমাদের আইলটাই কালক্রমে ধসিয়া-ধসিয়া ওদের ক্ষেতে পড়িয়াছে। কোদালে ক্ষেতের কানি সাফ করিবার সময় ঐটুকুই মাত্র কাটিয়াছে। প্রতিবেশীদের মধ্যে যারা একটা বড় রকমের দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখিবার আশা করিতেছিল, তারা নিরাশ হইয়া বাড়ি ফিরিল। ফরাযীরা আসলে ভীরু কাপুরুষ।
আরেকটা ঘটনা বাপজীর আমলের। বাড়ি হইতে দূরে এক ক্ষেতের মধ্যে বড় একটা আমগাছ ছিল। খুব আম ধরিত। একবার চাকর আসিয়া নালিশ করিল পাড়ার পুলা-পানে সব কাঁচা আম পাড়িয়া ফেলিতেছে। উপস্থিত সকলেই আশা করিল ব্যাপার একটা কিছু ঘটিবেই। ঘটিলও। বাপজী চাকরকে ধমক দিলেন : কাঁচা আম পুলা-পানে খাইব না ত বুড়ারা খাইব? যা তুই দেখ গিয়া পুলাপান যাতে আম পাড়িতে গিয়া নালিয়া ক্ষেত পাড়াইয়া ভাঙ্গে।
পরে সকলেই মন্তব্য করিয়াছিল, এমন দিনে-দুপুরে অত্যাচার অবিচারেরও যদি প্রতিকার না করে, তবে ফরাযীরা গ্রামে থাকিতেই পারিবে না। বাপ-দাদার এই দুর্বলতাকে আমি নিজেও ছেলে-বেলা পছন্দ করিতাম না। পরে পছন্দ করিয়াছিলাম। বয়স হইলে বুঝিয়াছিলাম আমার বাপ-দাদার কথাই ঠিক। কী হইত ঐ তুচ্ছ ব্যাপার লইয়া মানুষের সাথে ঝগড়া করিয়া? বরঞ্চ উল্টা ক্ষতিই হইতে পারিত। সত্যই তাই। এক-আধ-ইঞ্চি জমির দখল লইয়া দু-চারটা আম-কাঁঠাল লইয়া কত মামলা মোকদ্দমা দেখিয়াছি। উকিল হইয়া আরো বেশি দেখিয়াছি। হাজার-হাজার টাকা খরচ হইতে দেখিয়াছি। দশ-বিশজন খুন-জখম হইতে দেখিয়াছি। দু-দশজনের জেল-জরিমানা হইতে দেখিয়াছি। গোড়াতে একপক্ষ সবুর করিলে এ সব হইত না।
.
২. উস্তাদের শিক্ষা
হক-নাহক জ্ঞানও পাইয়াছিলাম বাপ-দাদার নিকট হইতেই। আই-এ পড়ার সময় নিতান্ত অভাবের দিনেও রাস্তায় বাইশ টাকা পড়িয়া পাইয়া টাকাটা হজম করিতে পারিলাম না ত ঐ কারণেই। ও-টাকা যে আমার নয় পরের, এটা বুদ্ধি-বিবেচনা, চিন্তা-ভাবনা করিয়া বুঝি নাই। এমনি স্বভাবতই আপনা হইতেই উৎপ্রেরণা বশেই বুঝিয়াছিলাম।
বাপ-দাদার-দেওয়া এই মতিগতি আরো জোরদার হয় মৌলবী মুজিবর রহমানের সংশ্রবে আসিয়া। তিনি তখন দি মুসলমান দৈনিক করিবার আশায় টাকার জন্য বর্মা-বাংলা দৌড়াদৌড়ি করিতেছেন। তবু যথেষ্ট টাকা উঠিতেছে না। তেমনি একদিনে তৎকালীন মন্ত্রী নবাব মোশাররফ হোসেন মৌ, সাহেবের নিকট প্রস্তাব দেন, যদি দি মুসলমান নবাব সাহেবের মন্ত্রিত্ব সমর্থন করেন, তবে তিনি দি মুসলমান-এ পঞ্চাশ হাজার টাকার শেয়ার কিনিবেন। এই মুহূর্তে পঁচিশ হাজার। সমর্থনে একটা এডিটরিয়েল লেখার পরই বাকি পঁচিশ হাজার। প্রস্তাবটা তিনি সোজাসুজি মৌলবী সাহেবের কাছে করেন নাই। তিনি মৌলবী সাহেবকে ভাল করিয়াই জানিতেন। প্রস্তাব করেন দি মুসলমান-এর ম্যানেজার মৌলবী সাহেবের কনিষ্ঠ চাচাত ভাই মি. রফিকুর রহমান সাহেবের কাছে। রফিকুর রহমান সাহেব এমএ। দু চারটা ভাল-বেতনের চাকুরি ইচ্ছা করিলেই তিনি পাইতে পারিতেন। কিন্তু মৌ. সাহেবের অনুপ্রেরণায় তিনিও আমাদের সমান অল্প বেতনে দি মুসলমান-এর ম্যানেজারি করিতেছিলেন। সততা-সাধুতায় তিনিও প্রায় মৌলবী সাহেবের অনুসারী। তবু বিষয়-জ্ঞানে তিনি আমাদের মতই বাস্তব। জ্ঞানী ও হিসাবি লোক। কিন্তু মৌলবী সাহেবের কাছে নবাব সাহেবের প্রস্তাব লইয়া তিনি নিজে যাইতে সাহস পাইলেন না। নবাব সাহেব নিজের এই প্রস্তাবের সৎ ব্যাখ্যা দিয়া মৌ, সাহেবের সামনে উপস্থিত করিবার মত সুন্দর যুক্তি-তর্কও দিয়াছিলেন। নবাব সাহেব কস্মিনকালেও এটাকে ঘুষ রূপে দিতেছেন না। তিনি সত্যি-সত্যি মুসলমানদের একটা ইংরাজি দৈনিকের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করিতেছেন। মৌলবী সাহেবই এ কাজের একমাত্র উপযুক্ত ব্যক্তি। দি মুসলমান-এর তিনি একজন পুরা সমর্থক। সেই হিসাবেই তিনি দৈনিক মুসলমান তহবিলে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য করিতেছেন। তবে কিনা একটু…ইত্যাদি। রফিক সাহেব আমাকে সব কথা। বলিলেন এবং আমাকেই এ কাজের দায়িত্ব দিলেন। আমাকে মৌলবী সাহেব অতিশয় স্নেহ করিতেন বলিয়া যা-তা বলিবার সাহসও আমার ছিল। আমি যথাসম্ভব গোছাইয়া নবাব সাহেবের যুক্তিগুলি পুরাপুরি বরঞ্চ রং লাগাইয়া মৌলবী সাহেবের কাছে বলিলাম। একদিন দুইদিন নয়, বেশ কয়েক দিন তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। তিনি অনড়-অটল। আমার সব যুক্তির জবাবে তিনি বলিলেন ও সব যুক্তিই তার জানা। সব জানিয়া শুনিয়াও নিরুপায়ের নীরব থাকা সম্পর্কে কলিকাতায় সর্বজন পরিচিত একটা প্রবাদ চালু আছে : “নিমতলার ঘাটও চিনি, কাশী মিত্তিরের ঘাটও চিনি। কিন্তু কথা বলতে পারি না। আমি যে মরে আছি।” মৌলবী সাহেব হাসিয়া এই প্রবাদটি আমাকে শুনাইলেন। এর পরেও আমি পরাজয় মানিলাম না। এই অভাবের দিনে এমন হাতে-পাওয়া পঞ্চাশ হাজার টাকা লোকসান হইয়া যাইতেছে এর উত্তরে তিনি বলিলেন : “দেখ আবুল মনসুর, এক-একজনের এক-একটা নেশা থাকে। মদ-মেয়ের নেশাতেই কত ধনী ও বিদ্বান লোক কত ধন-দৌলত নষ্ট করিতেছে। হাজার সদুপদেশ দিয়াও তাদেরে ফিরান যায় না। ধর এ অবাস্তব সাধুতা আমার একটা নেশা। এ নেশা ছাড়াইবার চেষ্টা করিয়া তোমরা সফল হইবে না। এরপর পরাজয় স্বীকার করিতেই হইল।
.
৩. সাধু থাকা কঠিন না
এমন দৃষ্টান্ত নিশ্চয়ই আমার জীবন প্রভাবিত করিয়াছিল। টাকা পয়সার প্রতি আমার খুব বেশি আগ্রহ ছিল না। তার মানে প্রয়োজন-মাফিক টাকা পাইলেই আমার হইয়া যাইত। উঠন্ত বয়সের অবিবাহিত স্বাধীন কলিকাতা প্রবাসী যুবকদের অনেকের যেসব দোষ ছিল, আমার সে সব দোষের একটাও ছিল না; এই কারণেই কলিকাতায় পঞ্চাশ-ষাট টাকার সাংবাদিকতা করিয়াও সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করিতে পারিয়াছিলাম। পাঁচ-ছয় টাকা মেসের খোরাকি, এক টাকা সিট-রেন্ট দিয়া থাকিতে পারিলে কতই বা টাকার দরকার? পোশাক-পরিচ্ছদ? এক টাকা আঠার আনার একটা খদ্দরের ধুতি কিনিয়া একটা তহবন্দ ও একটা পাঞ্জাবি বানাইতাম। কাটি-কুটিতে একটা গান্ধী টুপি হইয়া যাইত। সিলাই লাগিত পাঞ্জাবিতে ছয় আনা, তহবন্দ ও টুপিতে এক কানা করিয়া দুই আনা। এমনি করিয়া দুই খানা ধুতিতে সোওয়া দুই টাকা ও সিলাইয়ে এক টাকা খরচ করিলে বছরের পোশাক হইয়া যাইত। ধুপা-লনড্রি খরচ ছিল না। পাঁচ আনায় দু’সের এক নম্বর নূতন ঢাকাইয়া সাবান কিনিতাম। সপ্তাহে দুইবার নিজ হাতে কাপড় ধুইতাম। তাতেই পনের দিন যাইত। শীতবস্ত্র হিসাবে বউ-বাজার চোরা বাজার হইতে তিন-চার টাকায় একটা সেকেন্ড হ্যান্ড গরম কোট কিনিয়া আমি পাঁচ বছর চালাইতাম। উড়নার জন্য খদ্দরের একটা মোটা শাল’ কিনিতাম আড়াই-তিন টাকায়। সেটাও চার-পাঁচ বছর নিতাম। যাতায়াত খরচা বেশি ছিল না। পারতপক্ষে ট্রামে উঠিতাম না, হাঁটিয়াই আফিস করিতাম। উঠিতে হইলেও সেকেন্ড ক্লাসে উঠিতাম। ভাড়া ছিল তিন পয়সা। ‘অপব্যয়ের মধ্যে ছিল দুইটা। একটা সিনেমা দেখা। রোজ সিনেমা দেখিতাম। মাঝে-মাঝে দিনে দুইবারও দেখিতাম। কোনও কোনও দিন তিনবারও দেখিতাম। কিন্তু টিকিট কিনিতাম সর্বনিম্ন ক্লাসের। চৌরঙ্গী অঞ্চল হইলে চার আনা। উত্তর কলিকাতা হইলে তিন আনা। এতেই মাসে পনের টাকা যাইত। আরেকটা বাতিক ছিল পুরাতন বই কিনা। কলেজ স্কোয়ারের বড়-ছোট পুরাতন পুস্তকের দোকান, তথাকার ফুটপাথ ও ধর্মতলা-ফ্রিস্কুল স্ট্রিটের ফুটপাথের দোকানের সবগুলিতে আমি ছিলাম একটা পরিচিত উৎপাত। দু-চার ঘণ্টায় দোকানের সব-পুস্তক ঘাঁটিয়া কিনিতাম দু’চার আনার একখানা বই। কিন্তু কিনিতাম। সেজন্য কোনও দোকানদারই আমার সাথে অভদ্রতা করিত না। ইচ্ছামত বই ঘাঁটিতে দিত। কারণ তারা জানিত, শেষে একখানা আমি কিনিবই। ফলে পয়সা যাইত আমার সারাদিনে হয়ত ছয় আনা-আট আনা। কিন্তু সময় যাইত আমার চার-পাঁচ ঘণ্টা। বন্ধুরা বলিত আমি সময়ের অপচয় করিতেছি। কিন্তু আমি জানিতাম তাদের ধারণা ভুল। কারণ এই সব পুরাতন পুস্তকের দোকান ছিল আমার ফ্রি রিডিং রুম।
আমি ইচ্ছা করিয়া সঞ্চয় কখনও করি নাই। কিন্তু সঞ্চয় আমার অমনি হইয়া গিয়াছে। অত অল্প আয়ের সব টাকা আমি খরচ করিয়া সারিতে পারিতাম না। কারণ সব জিনিসই আমার কাছে অসাধারণ টিকসই হইত। কাপড়-চোপড় ছিড়িতেই চাইত না। ১৯১৩ সালে সতের টাকায় একটা সাইমা লন্ডন হাতঘড়ি ও আড়াই টাকায় একটা ব্ল্যাকবার্ড ফাউন্টেন পেন কিনিয়াছিলাম। ১৯২৭ সালেও দুইটাই চালু ছিল। এই সালে জানালার ফাঁক দিয়া চোর আমার কোটটা চুরি করে। সেই কোটের পকেটে আমার হাতঘড়ি ও ফাউন্টেন পেন ছিল। চুরি না হইলে ওরা কতদিন চলিত আমিও বলিতে পারি না। ১৯১১ সালে আমি একটি ছাতা কিনিয়াছিলাম। ১৯২৬ সালে সেটা কোনও এক দোকানে ফেলিয়া আসি। আর পাই নাই।
.
৪. নবাব সাহেবের উপদেশ
বুদ্ধি ও বিশ্বাসের সংঘাত সম্পর্কে অতি মূল্যবান কথা বলিয়াছিলেন নবাব মোশাররফ হোসেন সাহেব। তিনি তখন মন্ত্রী। তাঁর এক কাজের সমালোচনা করিতে গিয়া দি মুসলমানএর সম্পাদকীয়তে নবাব সাহেবের কাজকে নির্বুদ্ধিতা (ফুলিশনেস) বলিয়াছিলাম। এতে নবাব সাহেব রাগিয়া আমাদের অফিসে আসিয়া আমার কৈফিয়ত তলব করিলেন। বলিলেন : তুমিও বি এল, আমিও বি-এল। তুমি মাসে পঁচাশি টাকা রোযগার কর। আমার বার্ষিক ইনকাম চার লাখ। তুমি আমাকে “ফুল” বলিয়া গাল দাও কোন মুখে?’ নবাব সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করিতেন। সুতরাং শক্ত কথা বলার অধিকার তাঁর ছিল। আমিও তাকে শক্ত বলিতে পারিতাম। বলিলাম : চার লাখ টাকা আয়ের শ্বশুরের মেয়ে বিয়া করিলে আমারও ঐ ইনকাম হইত। শ্বশুরের খুঁটা দেওয়ায় নবাব সাহেব চটিলেন না। বরঞ্চ হাসিয়া বলিলেন : তেমন শ্বশুরের মেয়ে বিয়া বুদ্ধিমানরাই করিতে পারে, নির্বোধরা পারে না। তর্কে-তর্কে নবাব সাব বলিলেন : যে নিজেকে সবার চেয়ে বুদ্ধিমান মনে করে, তার মত নির্বোধ আর নাই। তোমাকে লোকে অত ঘন-ঘন ঠকায় কেন? যেহেতু তুমি নিজেকে মস্তবড় বুদ্ধিমান মনে কর। তোমাকে কেউ ঠকাইতে পারিবে না এই বিশ্বাসেই তুমি সবাইকে বিশ্বাস কর। ঐ বিশ্বাসের সুযোগ নিয়াই সবাই তোমাকে ঠকায়। আমি স্পষ্টই দেখিতেছি, তুমি জীবন-ভর ঠকিবে। জীবনে কোনও দিন সফল হইতে পারিবে না। যদি জীবনে সফল হইতে চাও, তবে আমার কথা শোেন। জীবন রং-এন্ডে’ নয়, ‘রাইট-এন্ডে’ শুরু কর। অর্থাৎ সকলকে বিশ্বাস করিয়া নয়, অবিশ্বাস করিয়া শুরু কর। যারা কাজে-কর্মে তোমার বিশ্বাস অর্জন করিবে তাদেরই শুধু বিশ্বাস কর। অন্য সবাইকে অবিশ্বাস কর। দেখিবে কেউ তোমাকে ঠকাইবে না। অবশেষে সবাই তোমার বিশ্বাসী হইবে। আর তা না করিয়া তুমি যদি ঐ ‘রং-এন্ডে’ আরম্ভ করিতেই থাক, তবে সবাই তোমাকে ঠকাইবে। অবশেষে তোমার কারো উপর বিশ্বাস থাকিবে না। চারদিকে কেবল অবিশ্বাসী-বিশ্বাসঘাতক দেখিবে। শেষ জীবন তোমার বড় দুঃখে কাটিবে। আমি তোমাকে বদ-দোওয়া করিতেছি না। শুধু হুঁশিয়ার করিয়া দিতেছি মাত্র।
চল্লিশ বছর আগের কথা। মাঝে-মাঝেই মনে হইয়াছে, নবাব সাহেবের কথাই বোধহয় ঠিক। কিন্তু মৌলবী মুজিবর রহমানের মূর্তি নবাব সাহেবের মূর্তিকে পিছনে ঠেলিয়া দিয়াছে। আমি এই সান্ত্বনা দিয়াছি মনকে : পরকে ঠকাইতে পারার আনন্দের চেয়ে নিজে ঠকিতে পারার আনন্দে মজা অনেক বেশি। একবার এক হোস্টেল মেটের হাতে পাঁচ টাকা ঠকিয়া যে সম্পদ অর্জন করিয়াছিলাম, প্রতিশোধ নিতে গিয়া তাকে দশ টাকা ঠকাইবার আগুনে সে সম্পদ পোড়াইয়া ছারখার করিয়াছি। তারপরেও আগুন নিবে নাই। জীবন সায়াহ্নে আজো আমি বিশ্বাস করি : অবিশ্বাস করিয়া ঠকার চেয়ে বিশ্বাস করিয়া ঠকা ভাল।
অর্থনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা আমার যৌবন হইতেই সীমাবদ্ধ ছিল। মনে করি, আজো তাই আছে। মনে আছে, ছাত্র-জীবনে একবার ত্রিপুরা স্টেট লটারির টিকিট কিনিয়াছিলাম। তৎকালে ওর প্রথম পুরস্কার ছিল এক লাখ। টিকিট কিনিয়া আমার ঘুম নষ্ট হইল। যদি ফার্স্ট প্রাইয পাই, তবে ঐ লাখ টাকা দিয়া আমি করিব কী? আমি যৌবনের সোনালি স্বপ্নের অনেক চিত্র মনে-মনে। আঁকিলাম। কিন্তু লাখ টাকা খরচের কোনও উপায় বাহির করিতে পারিলাম না। রূপান্তরে সে মনোভাব আমার আজো আছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাকে আমি সত্যই ভয় পাই। পাকিস্তান সরকারের শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রী হওয়ায় আমার চার কোটি টাকার বদনাম হইয়াছে। এ নিয়া কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুসহ ডন-এর এডিটার আলতাফ হোসেনের সাথে আমার রম্য আলাপ হইতেছিল। বন্ধু বলেন : ‘শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রিত্ব একটা সাংঘাতিক ক্ষমতার পদ। এই দুইটা গদিতে একই ব্যক্তি বসিলে তার কাছে চার কোটি কেন, তার চেয়ে বেশি টাকার অফার আসিতে পারে। তুমি কি বলিতে চাও তোমার কাছে কোনও অফার আসে নাই?’ আমি সত্য কথা সরলভাবে স্বীকার করিলাম : নিশ্চয় আসিয়াছে, পরোক্ষভাবে।
বন্ধু বলেন : ‘ঘুষের অফার ইনডিরেকটলিই আসে। সোজা আসে না। তুমি কি এতই একটা ফেরেশতা যে ঐ সব লোভ তুমি সম্বরণ করিয়াছ শুধু সাধুতার খাতিরে?’ আমি সরলভাবে বলিলাম : সাধুতার খাতিরে নয়, অফারের বিশালতার ভয়ে।
.
৫. অর্থম-অনর্থম
মানুষের আর্থিক প্রয়োজন সম্পর্কে আমার মনের কথা বাহির হইয়া পড়িয়াছিল একদা আকস্মিকভাবে। আলাপ হইতেছিল এক জজ সাহেবের সাথে। তখন আমি ময়মনসিংহে উকালতি করি (অনুমান ১৯৩৫-১৯৩৬ সাল)। শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু প্রবীণ সাব-জজ। খুব কড়া ও যশস্বী বিচারক। আইনের পোকা। আমার মত জুনিয়র উকিল ত দূরের কথা তার কোর্টে দাঁড়াইতে অনেক সিনিয়র উকিলেরও হাঁটু কাঁপিত। আমার বাসায় যাইতে এই জজ সাহেবের বাসার সামনে দিয়াই যাইতে হইত। কোর্ট-ফেরতা প্রায়ই এক সঙ্গে যাইতাম। উকিল হিসাবে জুনিয়র হইলেও কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির নেতা হিসাবে আমি গণ্যমান্য লোক ছিলাম। নগেন বাবু রাজনীতির ‘রা’ও জানিতেন না বটে, কিন্তু অন্য সব ব্যাপারে সদালাপী ছিলেন। বাসায় ফিরিতে এই সবই আলোচনা হইত।
বাসায় ফিরিবার পথে প্রায় প্রতিদিনই তিনি নিজে বাজার করিতেন। বাজার মানে দুই আনা-দশ পয়সার গুড়া মাছ, কয়েক আনার তরি-তরকারি। কলাপাতা বা কচু পাতার ঠোঙ্গায় মাছ বাম হাতে এবং তরি-তরকারি ডান হাতে লইয়া নূতন বাজার হইতে বাহির হইতে নগেনবাবুকে প্রায়ই দেখা যাইত।
একদিন আমি তাকে বলিলাম : এত টাকা মাহিয়ানা পান, খাওয়ায় এত কৃপণতা করেন কেন?
দুঃখিত হইয়া নগেনবাবু বলিলেন : অত টাকা মাহিয়ানা দেখিলেন কই?
আমি যখন স্মরণ করাইয়া দিলাম, তার মাহিয়ানা সাড়ে তেরশ টাকা, তখন তিনি বলিলেন : ঐ শুনিতেই শুধু তেরশ।
অতঃপর তিনি ইনকাম ট্যাক্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, সেভিং ব্যাংক ইত্যাদির সঠিক অঙ্ক উল্লেখ করিয়া দেখাইলেন যে, শেষ পর্যন্ত তাঁর হাতে আসে মাত্র আড়াইশ টাকা। আমি জবাবে বলিলাম যে, এক ইনকাম ট্যাক্স ছাড়া আর সব খরচই তার ইচ্ছাধীন। তাঁর অত-অত টাকা জমা করার কোনও আবশ্যকতা নাই। তিনি তখন সঞ্চয়ের আবশ্যকতা বুঝাইলেন। অসুখ-বিসুখ, আপদ-বিপদ কতটাই ত আছে।
আমি তখন মৌলিক কথায় চলিয়া গেলাম। বলিলাম: তাহা হইলে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইল যে, আপনার মাসিক প্রয়োজন মাত্র আড়াইশ টাকা। এর বেশি যে টাকা আপনি বেতন পান, সেটা বাহুল্য।
সেটা কৃষক-প্রজা আন্দোলনের যুগ। জমিদারি উচ্ছেদ, মন্ত্রী-বেতন হাজার টাকা, শাসন-ব্যয় হ্রাস, সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমান, তৎকালে প্রাত্যহিক স্লোগান। রাস্তা-ঘাটের আলাপের এবং খবরের কাগজের আলোচনার বিষয়। নগেনবাবু আমার কথার বাস্তব অর্থ করিলেন। ব্যগ্রতার সঙ্গে বলিলেন : আপনারা কি সত্য-সত্যই অফিসারদের বেতন কমাইতে চান? বিচার বিভাগের লোকেরও?
আমি যখন বলিলাম ‘নিশ্চয়ই’, তখন তিনি আন্তরিক ব্যাকুলতার সঙ্গে মুনসেফ-জজদের রাতদিন গাধার খাটুনির তুলনায় বেতনের স্বল্পতা, দেড়শ টাকায় মুনসেফি শুরু করিয়া তেরশতে পৌঁছাতক প্রায় কুড়ি বছরের দুঃখ কষ্ট, অভাব-অনটনের কথা বিস্তারিত বলিলেন। তিনি অন্তত মুনসেফ-সাব জজদের বেতন না কমাইবার জন্য আমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিলেন। এটা তিনি এমনভাবে করিলেন, আমিই যেন কমানের কর্তা এবং আজই যেন সে অর্ডার দিতেছি।
আমিও সরলভাবে আমাদের প্রোগ্রামের যৌক্তিকতা তাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিলাম। আমাদের ন্যাশনাল ইনকাম, পার-ক্যাপিটা ইনকাম, সে ইনকামের সাথে সরকারি কর্মচারীদের আনুপাতিক পার্থক্য, মাথাভারী শাসন ব্যয়ের জন্যই আমাদের দেশের স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব ইত্যাদি উচ্চ পলিটিক্যাল-ইকনমিকসের উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতা করিলাম। উপসংহারে বলিলাম : ব্যাংক ব্যালেন্স, ইনশিওরেন্স, প্রভিডেন্ট ফান্ড, জুয়েলারি, গহনা-পত্র, অনাবশ্যক সম্পত্তি, বাড়ি-ঘর, সাজ-সরঞ্জাম যার যত আছে সব সরকারে বাযেয়াফত করাই আমাদের প্রোগ্রাম।
আলাপে-আলাপে নগেনবাবুর বাসার সামনে আসিয়া পড়ায় আদাব দিয়া বিদায় হইলাম। কিন্তু বাসায় ফিরিয়া কাপড়-চোপড় ছাড়িতে-না-ছাড়িতেই নগেনবাবু আমার বৈঠকখানায় ঢুকিয়া ‘উকিল সাব’ ‘উকিল সাব’ বলিয়া ডাকাডাকি শুরু করিলেন। রাজা-মহারাজা, লাট-মন্ত্রী হইলেও এ সময়ে নাশতা-চা না খাইয়া বাহির হইতাম না। কিন্তু এ যে হাকিম। ঐ অবস্থায়ই বাহির হইয়া আসিলাম। নগেনবাবু সোজাসুজি বলিলেন : ‘এ ব্যাপারে একটা হেস্তনেস্ত না করিলে আজ আমার আহার-নিদ্রা হইবে না। তাই একটা ফয়সালা করিতে আসিলাম।’
ক্ষুধায় আমার মেজাজ গরম হইয়াছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু পরম দক্ষতার সহিত তা গোপন করিয়া হাসি মুখে বলিলাম : আপনারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে টাকা পান, তা আপনারা জমা করেন ভবিষ্যৎ অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদে খরচ করিবার জন্য, এই ত? কিন্তু আপনারা কি জানেন না যে, ঐ সঞ্চয়ের দ্বারাই আপনারা নিজেদের অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদ ডাকিয়া আনেন?
নগেনবাবু : সেটা কেমন?
আমি : আপনি ভগবানে বিশ্বাস করেন?
নগেনবাবু দাঁতে জিভ কাটিয়া বলেন : কন কি মনসুর সাব? আমি ভগবান মানি না?
বলিয়া তিনি জোড়হাত কপালে ঠেকাইলেন। আমি বলিলাম : আপনি চিত্রগুপ্তের নাম শুনিয়াছেন?
নগেনবাবু যেন অপমানিত হইলেন। বলিলেন : আমি হিন্দু, চিত্রগুপ্তের নাম শুনি নাই আমি?
আমি : বেশ। তা হইলে এই চিত্রগুপ্তের কাজটা কি তাও আপনি জানেন। চিত্রগুপ্ত ভগবানের ফাইন্যান্স মিনিস্টার, চ্যান্সেলার-অব-দি-এক্সচেকার, প্রজেক্ট ডাইরেক্টর, একাউন্টেট-জেনারেল ও অডিটর-জেনারেল। তিনি চতুর্দশ, যমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যম। মানেন আপনি?
নগেনবাবু জীবন ফাটাইয়াছেন মোকদ্দমার ফাইল ও আইনের পুস্তক পড়ায়। অত কথা তিনি জানেন না। তবু আমার মত আইনজ্ঞের কাছে সে কথা স্বীকারও করিতে পারেন না। তাই শুধু সম্মতিসূচক মাথা ঝুকাইলেন।
.
৬. চিত্রগুপ্তের বাজেট
আমি বলিতে লাগিলাম : মানুষের জীবন-মৃত্যু, অসুখ-বিসুখ, সুখ-সম্পদ ও আপদ-বিপদের মালিক এই চিত্রগুপ্ত। ভগবান এই চিত্রগুপ্তকে কনসাল্ট করিয়াই এ সব বিলি-বণ্টন করিয়া থাকেন। আমাদের গবর্নমেন্ট যেমন বছরের গোড়াতে ফাইনান্স মিনিস্টারের মারফত বাজেট রচনা ও ঘোষণা করিয়া থাকেন, ভগবানও তেমনি প্রতি বছর শিবরাত্রিতে চিত্রগুপ্তের মারফত এটা করিয়া থাকেন। মুসলমানদের আল্লাহ এ বাজেট করেন শবে-বরাতে। অসুখ-বিসুখ ও আপদ-বিপদের কথাটাই ধরা যাউক। শিবরাত্রে ভগবান সভাসদ লইয়া বাজেট করিতে বসেন। চিত্রগুপ্ত বসেন তাঁর খাতা-পত্র লইয়া। ভগবান চিত্রগুপ্তকে ডাকিয়া বলেন : দেখ ত অমুক মহারাজের অসুখ-বিসুখের তহবিলে কত টাকা আছে। চিত্রগুপ্ত খাতা দেখিয়া বলিলেন : এক লাখ। ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা ক্যানসার। ভগবান বলেন : দেখ ত অমুক রাজা-বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলেন : পঞ্চাশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা করোনারি থ্রম্বসিস। এরপর দেখ ত অমুক রায় বাহাদুরের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : বিশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা টিবি। তারপর দেখ ত সাব-জজ নগেনবাবুর ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত খাতার পাতা উল্টাইয়া বলেন : দশ হাজার। ভগবান বলেন : দেও তারে একটা ডায়েবেটিস। তারপর দেখ ত সরকারি উকিল সতীশ দত্তের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত বলিলেন : মাত্র পাঁচ হাজার সার। ভগবান বলিলেন : দেও তারে একটা টায়ফয়েড। তারপর দেখ ত উকিল উপেন দের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত দুই-তিনবার পাতা উল্টাইয়া আঙুলে গনিয়া বলেন : মাত্র পাঁচ শ টাকা মহারাজ। ভগবান ঘাড় ও মাথা চুলকাইয়া অবশেষে বলেন : কি আর দিবে ওকে? দেও একটা সর্দি-জ্বর। তারপর দেখ ত অশ্বিনী মোখতারের ঐ তহবিলে কত আছে? চিত্রগুপ্ত অত বড় খাতাটার এক মলাট হইতে অপর মলাট পর্যন্ত দুই-তিনবার উল্টাইয়া অবশেষে বলিলেন : এক পয়সাও নাই, ভগবান। ভগবান তখন সকলের দিকে চাহিয়া মুচকি হাসিয়া বলেন : দেও, ও-হতভাগাকে ছাড়িয়াই দেও।
আমি গোড়াতে ক্ষুধার মেজাজে রাগ করিয়া নগেনবাবুকে উত্ত্যক্ত করিবার জন্যই বোধহয় কথাগুলি শুরু করিয়াছিলাম। কিন্তু অল্পক্ষণেই অনুপ্রেরণার উচ্চস্তরে উঠিয়া গেলাম। ক্ষিধা বেশি লাগিলে আমার বক্তৃতা ভাল জমে। সেদিনও বোধ হয় তাই হইয়াছিল। দেখিলাম নগেনবাবু হাঁ করিয়া আমার কথাগুলি গিলিতেছেন।
আমার কথা শেষ হইলে তিনি গম্ভীর মুখে বলিলেন : আপনি যে সব কথা বলিলেন, তা সত্যি-সত্যি শাস্ত্রের কথা নাও হইতে পারে কিন্তু কথাগুলি সত্য। নিজের জীবনেই আমি তার ফল পাইয়াছি। আপনার কথা শুনিবার পর আজ তা বুঝিলাম। আপদ-বিপদ অসুখের নামে যত বেশি জমাইয়াছি, সত্য-সত্যই আপদ-অসুখ তত বাড়িয়াছে। তার এক ছেলে যে মারা গিয়াছে, তার এক মেয়ে যে বিধবা হইয়াছে, তার সঙ্গে নিজের ঐ সময়ের সঞ্চয়ের কার্য-কারণ সম্পর্কে দেখাইলেন।
নগেনবাবু চলিয়া গেলে নিজের কথাগুলিই অনেকক্ষণ পর্যালোচনা করিলাম। চা-নাশতা করিতে করিতে ঐ লইয়া স্ত্রীর সাথে রসিকতা করিবার চেষ্টাও করিলাম। বাধ-বাধ ঠেকিল। বুঝিলাম, রসিকতা করিতে গিয়া অন্তরের কথাই বলিয়াছি। এই কারণেই বোধহয় জীবনে টাকা সঞ্চয় করিলাম না। ব্যাংকের একাউন্ট খুলিলাম না। যেমন আয় তেমনি ব্যয়। এই জন্যই আমি সঞ্চয়কে আহাম্মকি মনে করিয়া থাকি। নিজে না খাইয়া টাকা জমাইয়া যারা বাড়ি-ঘর, ধন-সম্পদ করে, তাদেরে বিদ্রূপ করিয়া আমি অনেক রচনা লিখিয়াছি। কলিকাতা চিত্তরঞ্জন এ্যাভিনিউ-এর সুরম্য প্রাসাদগুলিতে বাস করেন ভোগ-বিলাসী ভাড়াটিয়ারা। আর বাড়িওয়ালা বাস করেন বড় বাজারের তুলাপট্টির কবুতরের খোপে। মাসে লাখ-লাখ টাকা তারা রোযগার করেন, জমা করেন। কিন্তু কাগজের চেক, সোনার মোহর বা রুপার টাকা নয়। ব্যাংকে যা জমা হয় তাও সোনা-রুপা নয়, শুধু ফিগার : লাখের পর কোটি, কোটির পর পরার্ধ্ব। মিলিয়নের পরে বিলিয়ন, তারপর ট্রিলিয়ন। এমনিভাবে কোটিপতি তুলাপট্টির কবুতরের খোপেই মারা যান। পুত্র যদি বাপের মত সাধু-সজ্জন হয়, তবে সে কোটিকে করে পরার্ধ্ব। পরে বাপের মতই মারা যায়। আর সে যদি বুদ্ধিমান হয় তবে মদে-মেয়েলোকে ও রেসে সব উড়াইয়া দেউলিয়া হয়। এইই সঞ্চয়ের পরিণাম। এই সঞ্চয়েরই যারা প্রাণপাত করে, তারা আমাকে নির্বোধ বলিতে পারে, কিন্তু আমিও তাদেরে বুদ্ধিমান বলি না।
সব মতবাদের নৈতিক ও অর্থনৈতিক দুইটা দিকই আছে। ধনতান্ত্রিক সমাজে এই সঞ্চয়কে ক্যাপিটেল কর্মেশন বলে। আমি বলি এটা হোর্ডিং। সব দ্রব্য হোর্ডিং-এর মত এটাও আমার মতে পাপ।
কিন্তু বাড়ি করা সম্পর্কে আমার মতামত আরো অদ্ভুত। ওটা নিছক অর্থনীতিক। ওর কোনও নৈতিক দিক নাই। আমি নিজে বাড়ি না করিয়া ভাড়াটিয়া বাড়িতে থাকার পক্ষপাতী। হিতৈষীরা আমাকে নিজের বাড়ি তৈরি করিতে বহু হিতোপদেশ দান করিয়াছেন। কিন্তু আমাকে রাজি করিতে পারেন নাই।
.
৭. নিজের বাড়ি
নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে আমার কোনও নৈতিক আপত্তি ছিল না। আপত্তিটা ছিল নিছক বিষয়-বুদ্ধির হিসাব-নিকাশের কথা। আমার যুক্তিটা ছিল এইরূপ : আমি বর্তমানে পঞ্চাশ টাকা ভাড়া দিয়া সে বাড়িতে আছি তা তৈয়ার করিতে কম-সে-কম পঁচিশ হাজার টাকা লাগিয়াছে। এই রকম সুবিধার নিজস্ব বাড়ি তৈয়ার করিতে বর্তমানে আরো বেশি টাকা লাগিবে। তেমন আর্থিক ক্ষমতা আমার নাই। যদি থাকিতও, তবু আমি ঐ টাকা খরচ করিয়া নিজস্ব বাড়ি করিতাম না। কারণ তার অর্থ এই হইত যে, মাসে-মাসে বাড়ি ভাড়া না দিয়া আমি পঞ্চাশ বছরের ভাড়া অগ্রিম দিয়া একটি বাড়ি ভাড়া করিলাম। তাতেও রক্ষা নাই। কোয়ার্টারে-কোয়ার্টারে মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স, বছর-বছর জমির খাযনা, বছর-বছর হোয়াইট ওয়াশ, কিছুদিন পরে-পরে তাতেও এ সব খরচা আমাকে করিয়া যাইতেই হইত। ভাড়াটিয়া বাড়িতে। এসব খরচা আমার নাই। পক্ষান্তরে পঁচিশ হাজার টাকা না থাকা সত্ত্বেও যদি আমাকে নিজের বাড়িতে থাকার গৌরবলাভ করিতে হয়, তবে অল্প টাকা খরচ করিয়া শহরতলিতে ছোট বাড়ি করিয়া থাকিতে হয়। শুধু নিজ বাড়িতে থাকিবার নিছক মানসিক ও কল্পিত অহংকারের খাতিরে আমাকে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, যাতায়াতের সুবিধা, শহরের অভ্যন্তরের সুন্দর বাড়ি ছাড়িয়া অসুবিধাজনক বেকায়দায় অসুন্দর বাড়িতে থাকিবার কষ্ট সহ্য করিতে হয়। বন্ধুরা বলিতেন : ‘তবু ত নিজের বাড়ি। আমি বলিতাম : ভাড়াটিয়া বাড়িইবা আমার নিজের বাড়ি নয় কেন? আমি ত ভাড়াটিয়া বাড়িকেই নিজের বাড়ি মনে করি। ফুলের বাগান করি শাক-সবজির গাছ লাগাই। এমনকি ফলের গাছ লাগাই। ছোটখাটো মেরামত নিজে করাই। কই, কখনও ত মনে হয় না পরের বাড়িতে আছি!’ বন্ধুরা বলিতেন : মাসে-মাসে ভাড়া দাও যখন, তখন কি তোমার মনে পড়ে না পরের বাড়িতে আছ? ভাড়া না দিলেই ত বাড়িওয়ালা তোমাকে উঠাইয়া দিবে। আমি বলিতাম : ‘বছর বছর নিজের বাড়ির ট্যাক্স ও জমির খানা দিতে হইবে। ঐ খাযনা-ট্যাক্স না দিলেও ত জমিদার বা সরকার বাড়ি নিলাম করিয়া আমাকে উঠাইয়া দিবেন। পক্ষান্তরে রীতিমত ভাড়া দিলে কোনও বাড়িওয়ালাই আমাকে উঠাইতে পারিবেন না। আমি পুরুষানুক্রমে এই বাড়িতে থাকিতে পারি। আমার ‘পুরুষানুক্রমে’ কথায় বন্ধুরা বলিতেন : নিজের জন্য না হউক ছেলে-পিলের জন্য তাদের মাথা খুঁজিবার আশ্রয়স্থল হিসাবে একটা বাড়ি নিশ্চয়ই থাকা উচিৎ। তুমি চোখ বুজিলে ছেলে-পিলেরা দাঁড়াইবে কোথায়? আমি হাসিয়া বলিতাম : ‘আমার নিজের জন্য তা হইলে তোমাদের আর ভাবিবার নাই। ছেলেদের কথা? আমার ছেলেরা, সব বাপের ছেলেরাই, মাত্র তিন রকমের হইতে পারে। হয় তারা আমার মত হইবে, নয় আমার চেয়ে ভাল হইবে, অথবা আমার চেয়ে খারাপ হইবে। এই তিন অবস্থার কোনও অবস্থাতেই আমার-তৈরি বাড়ি তাদের কাজে লাগিবে না। প্রথমত, তারা যদি আমার মত হয়, তবে তারাও আমারই মত ভাড়াটিয়া বাড়িতে আমারই মত সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকিতে পারিবে। সুতরাং তাদের জন্য আমার বাড়ি করার দরকার নেই। দ্বিতীয়ত, তারা যদি আমার চেয়ে ভাল ও বড় হয়, তবে তারা কেউ ঢাকায়, কেউ করাচিতে, কেউ বিদেশে থাকিবে। ময়মনসিংহের মত ছোট শহরে থাকিয়া তারা সুখ পাইবে না। সুতরাং তাদের জন্য আগে হইতে বাড়ি করিয়া রাখা বেকার। তৃতীয়ত, আমার ছেলেরা যদি আমার চেয়ে খারাপ হয়, তবে মূর্খ হইতে পারে, চরিত্রহীন হইতে পারে, নির্বোধ হইতে পারে, চোর-গাঁজা-খোর হইতে পারে। তা হইলে তারা কেউ আমার তৈরি বাড়িতে থাকিবে না। ভাই-এ ভাই-এ মারামারি করিয়া, ভাগাভাগি করিয়া, বিক্রয় করিয়া অথবা বন্ধক দিয়া অন্যত্র নিম্নমানের বাড়িতে থাকিবে। সুতরাং এদের জন্যও আমার বাড়ি করার দরকার নাই। নিজস্ব বাড়ির এই শোচনীয় ভষ্যিৎ দেখাইয়া আমি উপসংহার করিতাম : ‘যে টাকায় বাড়ি করিব, সেই টাকা খরচ করিয়া ছেলেদেরে পড়া-শোনা করাইব, দুধ-ঘি খাওয়াইয়া স্বাস্থ্যবান করিব। আত্মমর্যাদাবান, ভদ্র ও চরিত্রবান করিব। তা যদি করিতে পারি, তবে ভষ্যিতে তাদের মাথা পুঁজিবার ঠাইয়ের জন্য এখন হইতে আমাকে চিন্তা করিতে হইবে না।’
.
৮. নিজের বাড়ি বনাম ভাড়াটিয়া বাড়ি
বলা বাহুল্য এর একটাও নীতিবাক্য নয়, নিছক বিষয়-বুদ্ধির কথা। আমি প্রেরণা-বশে বা নিজের বুদ্ধি-বিবেচনায় এই সত্য আবিষ্কার করিয়াছিলাম তা নয়। আমার পরম শ্রদ্ধেয় তিনজন চিন্তাবিদের কথা ও কাজ হইতে এই প্রেরণা আমি লাভ করিয়াছিলাম। এই তিন মনীষী হইতেছেন, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মি, অতুলচন্দ্র গুপ্ত এবং ডা. নরেশ চন্দ্র সেন। পরবর্তী দুই মনীষী সাহিত্য সেবায় এবং কৃষক-প্রজা আন্দোলনে আমাকে প্রচুর প্রেরণা দিয়াছেন। উকালতি করিয়া এঁরা বিপুল টাকা রোযগার করিতেন। বহু টাকা ভাড়া দিয়ে সুন্দর-সুন্দর প্রাসাদ-তুল্য বাড়িতে পরম বিলাস-ব্যসনে থাকিতেন। কিন্তু নিজের বাড়ি তৈরি করিবার কল্পনাও তারা করিতেন না। মওলানা সাহেবেরও টাকা-পয়সার অভাব ছিল না। তিনি অনেক টাকার ভাড়ার বাড়িতে থাকিতেন। বিপুল পুস্তকরাজির বিশাল লাইব্রেরি ছিল তাঁর। মাসে-মাসে তিনি হাজার-হাজার টাকার বই কিনিতেন। নিত্য-নূতন ট্যাক্সিতে চড়িতেন। নিজে মোটর কিনিতেন না। বিশ্ববিখ্যাত চিন্তা-নায়ক বার্ট্রান্ড রাসেলেরও এই মত। তাঁর পুস্তক পড়িয়াই সর্বপ্রথম জ্ঞান লাভ করি যে, ইউরোপ মার্কিন মুল্লুকের বহু কোটিপতির নিজস্ব কোনও বাড়ি-ঘর নাই। তারা পুরুষানুক্রমে হোটেলে ও জাহাজে বাস করিয়া আসিতেছেন। লর্ড রাসেল লিখিয়াছেন, নিজস্ব বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে সাধারণ লোকেরা যে পার্থক্য করিয়া থাকে, সেটার ভিত্তি শুধু পযেসরী ইনসৃটিংক্ট। ওটা অবৈজ্ঞানিক সংস্কার মাত্র। অতঃপর এই মতবাদ আমার ঈমানের অঙ্গ হইয়া উঠে। বই-পড়া এই মতবাদ ছাড়াও আমার স্বতঃপ্রণোদিত একটা অভ্যাস ছিল। ভাড়াটিয়া বাড়িইে আমি সত্য-সত্যই নিজের মনে করিতাম। ছোট খাটো অল্প-ব্যয়সাধ্য মেরামত আমি নিজেই করিতাম, বাড়িওয়ালার করার অপেক্ষায় বসিয়া থাকিতাম না। জানিতে পারিয়া বাড়িওয়ালা খরচাটা দিলে নিতাম, না দিলে চাহিতাম না। ধরুন, ঝড়ে আমার বাড়ির একটা জানালার পাল্লার কবৃজা খুলিয়া পড়িয়াছে; কিম্বা পানির কলটা খারাপ হইয়া গিয়াছে। আমি বহুবার দেখিয়াছি ঐরূপ ঘটনায় আমার প্রতিবেশী বাড়িওয়ালাকে মেরামতের জন্য মুখে, টেলিফোনে তাগাদা করিতেছেন। শেষ পর্যন্ত ভাড়া বন্ধ করিবার ও উকিলের নোটিস দিবার ভয় দেখাইতেছেন। ইতিমধ্যে ভাঙ্গা জানালা দিয়া বৃষ্টির পানি আসিয়া তাঁর বিছানা ভিজিতেছে, খোলা-কলে পানি পড়িয়া ছাদের উপরস্থ টাংকির পানি শেষ হইয়া গিয়াছে। বাথরুমের পানির অভাবে রান্না ও গোসলের ভয়ানক অসুবিধা হইতেছে। ভিস্তিওয়ালাকে দিয়া রাস্তার কল হইতে পানি আনাইয়া তিনি কাজ চালাইতেছেন। বাড়িতে ভিজা বিছানা-বালিস রোজ রোদে দিতেছেন। তবু ঐ সামান্য মেরামতের কাজটুকু নিজে করিতেছেন না। পক্ষান্তরে এইরূপ ঘটনায় আমি তৎক্ষণাৎ একটা প্লাম্বারকে চার আনা ও একটি সূতার মিস্ত্রিকে আট আনা দিয়া ঐ কল ও জানালার পাল্লা মেরামত করাইয়া ফেলিয়াছি এবং দিব্যি আরামে জানালা ও পানির কল ব্যবহার করিয়াছি।
আমার এই মনোভাব কোনও নৈতিক আদর্শের মনোভাব নয়, নিতান্ত বিষয়-বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা। কাজেই এটা বুঝা সহজ হওয়া উচিৎ সকলের পক্ষেই। তাই প্রতিবেশী বন্ধুকে এটা বুঝাইবার চেষ্টা করিতাম। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখিতাম, মানুষের মালিকানাবোধ, বার্ট্রান্ড রাসেল যাকে পযেসরী ইনসৃটিংক্ট বলিয়াছেন তা অতিশয় প্রবল। ভাড়া দিয়া যে বাড়িতে থাকেন, সে বাড়ি যে তার নয় অপরের, এই বোধ সব ভাড়াটিয়ার মনে অতিশয় তীব্র। পরের বাড়িতে তিনি নিজের এক পয়সাও খরচ করিবেন কেন? এ বুদ্ধি তাদের টন-টনা। কিন্তু আমার মত তাঁরা বার আনা পয়সা ব্যয় না করিয়া যে বৃষ্টিতে ভিজিলেন, রান্না-গোসলের কষ্ট ভোগ করিলেন, সে কষ্ট ও দুর্ভোগের দাম যে বার আনার চেয়ে অনেক বেশি, সে কথাটা তাঁদের আক্কেলে ধরা দেয় না। এই নিজস্ব মালিকানা-বোধের অভাবে এবং পরস্ববোধের প্রভাবে তারা ভাড়াটিয়া বাড়িতে ফলের গাছ। লাগান, ফুলের বাগান করা, টব বসানো বা অন্য প্রকারে সাজানকে পরের বাড়িতে অর্থের অপব্যয় মনে করেন। বাগানের ফুলের খোশবু যে তিনিই ভোগ করিবেন; বাড়িওয়ালা করিবেন না, বাড়ির সাজসজ্জা যে তারই নিজের ও তার পরিবারের মনে আনন্দ দান করিবে, বাড়িওয়ালার মনে করিবে না, এটাও বুঝিতে চান না। এই পরস্ববোধের জন্যই এই শ্রেণীর ভাড়াটিয়ারা বাড়ির এখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলিয়া থাকেন, দা হাতুড়ি দিয়া মেঝের সিমেন্ট ও দেয়ালের আস্তর বিনষ্ট করিয়া থাকেন, ছেলে-মেয়েরা কয়লা ও পেনসিল দিয়া দেওয়ালে ‘চিত্র আঁকিয়া থাকে, চাকর-চাকরানিরা দেওয়ালে হাঁড়ি-পাতিলের কালি মাখিয়া রাখে। পরের বাড়ির এই ধরনের অনিষ্ট করিয়া তাঁরা যেন একটা আনন্দ পান। অথচ এই কদর্যতা, অপরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যহীনতা বাড়িওয়ালা ভোগ করেন না। করিতে হয় ভাড়াটিয়ার নিজেরই। এটাই হইয়া থাকে ঐ পযেসরী ইনসটিংক্ট হইতে। অথচ এ মালিকানাবোধ যে কত ভ্রান্ত, পণ্ডিত রাসেল তা সুন্দররূপে বুঝাইয়া দিয়াছেন। একটু ধীরচিত্তে বিবেচনা করিলেই বুঝা যাইবে শেষ পর্যন্ত আমি যেখানে যখন আছি, তখনকার জন্য সেই স্থানটিই আমার বাসস্থান। আমার সুখ-সুবিধা ও আনন্দের জন্য যা করা দরকার তাই আমাকে করিতে হইবে। এমনকি পথিকও রাস্তার ধারে গাছতলায় বিশ্রাম করিতে বসিলে বসার জায়গাটি ঝাড়িয়া-পুছিয়া পরিচ্ছন্ন করিয়া লয়। জায়গাটি নিজের নয় পরের, সে কথা তার মনেও পড়ে না। আমার বিশ্বাস এই মামুলি কাণ্ডজ্ঞান থাকিলে মানুষ নিজের বাড়ি ও ভাড়াটিয়া বাড়ির মধ্যে। পার্থক্য করিতে পারে না। ভাড়াটিয়া বাড়ির জন্য যেমন ভাড়া দিতে হয়। নিজের বাড়ির জন্যও তেমনি খাযনা-ট্যাক্স দিতে হয়। ওটা না দিলে যেমন বাড়ি থাকে না, এটা না দিলেও তেমনি থাকে না। কাজেই নিজের বাড়িতে বাস করার স্বপ্নে সারা জীবন কষ্ট করার চেয়ে পরের-তৈরি ভাড়াটিয়া বাড়িতে যারা জীবন কাটায়, তারাই বুদ্ধিমান। আহাম্মকেরা ভোজের আয়োজন করে, বুদ্ধিমানেরা তা খায়, ইংরাজি এই প্রবাদটি বাড়ির ব্যাপারেও সত্য।
.
৯. জ্ঞান ও বুদ্ধি
শুধু বাড়ি করার ব্যাপারে নয়, সব ব্যাপারেই বন্ধুরা আমাকে বুদ্ধিমান-জ্ঞানী বলিতেন। আমিও মনে-মনে তৃপ্তি, এমনকি গর্ব বোধ করিতাম। এই বুড়া বয়সে বার্ধক্যের জ্ঞান আমার কিছুটা থাকিলেও বিষয়-বুদ্ধি নাই। জ্ঞান ও ‘বুদ্ধি’ দুইটা গুণকে এক করিয়া ভাবাতেই এই বিভ্রান্তি ঘটিয়াছে। আসলে দুইটা এক নয়। জ্ঞানটা জানায় সীমাবদ্ধ। বুদ্ধিটা করায় প্রসারিত। বিষয়ী জীবনের জন্য থিওরেটিক্যাল জ্ঞান যথেষ্ট নয়। প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিও দরকার। এমনকি বিষয়ী জীবনের সাফল্যের জন্য জ্ঞান অত্যাবশ্যক নয়, শুধু বুদ্ধি থাকিলেই চলে। বুদ্ধিমানেরা জ্ঞানীর’ জ্ঞান ধার করিয়া শুধু বুদ্ধির জোরে জীবনে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, সমাজের সকল স্তরে এর ভূরি-ভূরি দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। সাংবাদিক হিসাবে কলিকাতা জীবনে আমি যখন মেসে থাকি, তখন আমার রুমমেট ও আমি এক বেকার বন্ধুকে আমাদের রুমে বিনা ভাড়ায় থাকিতে দিয়াছিলাম। বেকার বন্ধুর তখতপোশ ও বিছানা-পত্র কিনিবার সাধ্য ছিল না। সারাদিন কাজের তালাশে ঘুরিতেন। রাত্রে মেঝের মাদুরে শুইয়া থাকিতেন। আমরা তাঁকে স্বাধীন ব্যবসার উপদেশ ও ব্যবসায় চালাইবার জ্ঞান দান করি। দরকারি কাগজ-পত্র মুসাবিদা করিয়া দেই। আমরা কলিকাতা থাকিতেই ঐ বন্ধুর দু’তলা বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলাম। থিওরেটিক্যাল জ্ঞান ও প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধির পার্থক্য এইখানে। আসলে প্র্যাকটিক্যাল না হইলে জ্ঞানও পূর্ণ হয় না।
আমি যে মোটেই প্র্যাকটিক্যাল নই, এ কথা বলিলেও নিজের উপর অবিচার করা হইবে। সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আরাম-আয়েশ ও আর্থিক সচ্ছলতায় আমি মোটেই উদাসীন ছিলাম না। কিন্তু সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও বিলাসিতা, আর্থিক সচ্ছলতা ও ধনী হওয়া, এক জিনিস নয়, এ বিষয়েও সচেতন ছিলাম। আমি সন্ন্যাস, ফকিরি, কৃপণতা, কৃচ্ছ-সাধনা ও অপরিচ্ছন্নতার বিরোধী। সুস্থ দেহ ও সৎ মন যা খাইতে, পরিতে এবং যেভাবে থাকিতে চাহিবে, সেভাবেই খাওয়া-পরা-থাকার আমি পক্ষপাতী। সুস্থ মনের কোনও স্ট্যান্ডার্ড নাই, এ কথা আমি মানি না। যে মন নিজের ও অপরের প্রয়োজনের সীমা সরহদ্দ চিনে, সেটাই সুস্থ মন। কড়ার ফকির হাজার টাকার মালিক হইলে সে লক্ষ টাকা চাহিবে, লক্ষ পাইলে কোটি চাহিবে, মিলিয়ন পাইলে বিলিয়ন চাহিবে এটা সাধারণ ব্যাপার হইলেও সুস্থ মনের পরিচায়ক নয়। সুস্থ মন জানে, খাওয়া-পরার মতই মানুষের সব ভোগের একটা সীমা আছে। টাকা-পয়সার প্রয়োজনেরও সীমা আছে। এ সীমা লঙ্ঘনের ফলেই অর্থে অনর্থ ঘটিয়া থাকে।
তবে এই সীমার যেমন ম্যাক্সিমাম আছে, তার একটা মিনিমামও আছে। এই মিনিমাম চিনিতে হইলে জ্ঞান ও বুদ্ধির সমন্বয় দরকার। নিজস্ব বাড়ি করার ব্যাপারে আমার থিওরির জ্ঞানে বুদ্ধির বেড়া দেন আমার স্ত্রী। তারই প্রাধান্যে আমি আজ শহরে বাড়ির মালিক হইয়াছি। নিজের বাড়িতে পুতনাতি লইয়া সপরিবারে পরম সুখে বাস করিতেছি। বার্ট্রান্ড রাসেলের আদর্শ আমার নিজস্ব বাড়ি নির্মাণ ঠেকাইতে পারে নাই। এটা ঘটিয়াছে বুদ্ধির জোরে। সে বুদ্ধিটাও আমার নয়, আমার স্ত্রীর। ১৯৫৭ সালে তৎকালীন সিএন্ডবি মিনিস্টার আমার পরম বন্ধু কফিলুদ্দিন চৌধুরীর সাথে একরূপ ষড়যন্ত্র করিয়াই আমার স্ত্রী আমার অজ্ঞাতে ও অনুপস্থিতিতে ধানমন্ডিতে জমি বন্দোবস্ত নেন। পরে হাউস বিল্ডিং হইতে টাকা নিয়া বাড়ি করা হয় তাঁরই উদ্যোগে ও আমার সক্রিয় সহযোগিতায়। ততদিনে আমার আদর্শের জোর ও আমার ব্যক্তিগত প্রভাব কমিয়া গিয়াছে। স্ত্রীরও জোর বাড়িয়াছে। ছেলেরা বড় হইয়াছে। আমি তখন বড় পরিবারের অনেকের একজন মাত্র। ক্যাবিনেট সিস্টেমে আমি তখন নাম্বার ওয়ান এমাংস্ট ইকুয়ালস মাত্র। তাছাড়া ততদিনে আমার এই বোধধাদয় হইয়া গিয়াছে যে, সুফি-দরবেশ ও বিজ্ঞানী দর্শনীর জন্য যাই হউক, বিষয়ীর জন্য জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে একটু কাণ্ডজ্ঞান থাকা ভাল।
.
১০. আহাম্মকের পাহারাদার তকদির
বিষয়ী জীবনের টাকা-পয়সার ব্যাপারে আমি খানিকটা বুদ্ধিহীন ছিলাম ঠিকই কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তকদির আমার পাহারাদারি করিয়াছে। অসাবধানতায় যা হারাইয়াছি, বরাত তা ফিরাইয়া দিয়াছে। হারানো বস্তু ফেরত পাওয়া সৌভাগ্যের লক্ষণ–এমন একটা প্রবাদ আমাদের দেশে চালু আছে। আমার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। কাজেই আমাকেও ভাগ্যবান বলা যাইতে পারে। সাধারণ অবস্থা ছোট-খাটো বস্তু হারাইয়া ফিরিয়া পাওয়া খুব উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। কিন্তু তৎকালে পঞ্চাশ লক্ষ বাসেন্দার ভিড়ের শহর কলিকাতায় ট্রামে-বাসে হাজার টাকা-ভরা মানিব্যাগ পকেটমার যাওয়ার পরও তা ফিরিয়া পাওয়া সত্যই একটা অসাধারণ ব্যাপার। এটাও বরাতে ঘটিয়াছিল। ব্যাপারটা ঘটে এই ভাবে :
ইত্তেহাদ-এর সম্পাদকরূপে প্রথম মাসের বেতন পাইয়াছি হাজার টাকা। এত টাকা একসঙ্গে বেতন পাই নাই কোনও দিন এর আগে। প্রথম সুযোগেই বাসায় ফিরিলাম। বিবির হাতে টাকাটা দিলাম। তিনি নোটগুলি খানিক হাতাইয়া সেগুলি আমার হাতে দিলেন। বলিলেন : উকালতির টাকাতেই কিছুদিন চলিয়া যাইবে। বেতনের টাকা দিয়া একটা ব্যাংক একাউন্ট খোলো।
ব্যাংক একাউন্ট একটা ভোলাই ছিল। কৃষক-এর সম্পাদকতাকালে অধ্যাপক হুমায়ুন কবির কংগ্রেস নেতা মি. ধীরেন মুখার্জির সদ্যপ্রতিষ্ঠিত হুগলি ব্যাংকে আমাকে দিয়া একটা সেভিং একাউন্ট খুলান। ঐ খুলা তকই। বহুদিন পরে ঐ একাউন্টের কথা মনে পড়িল। বিবির হুকুম-মত পরদিন সকালে আফিসে কিছুক্ষণ কাজ করার পরই ব্যাংকে রওয়ানা হইলাম।
কলিকাতা তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-বিধ্বস্ত। ট্রাম বন্ধ। বাসও আংশিক বন্ধ। শুধু বিশেষ বিশেষ রুটে কিছু বাস চলে। কলুটোলা ও পার্ক সার্কাসের মধ্যে মুসলিম প্রধান-এলাকায় যোগাযোগ রক্ষার জন্য যে সার্ভিসটি চালু ছিল, তা বরাবরের লোয়ার সার্কুলার রুটে না গিয়া ইলিয়ট রোড, রয়েড স্ট্রিট, ওয়েলেসলি, ধর্মতলা, বেন্টিক স্ট্রিট, লোয়ার চীৎপুর দিয়া যাকারিয়া স্ট্রিটে নাখোদা মসজিদ পর্যন্ত যাইত। হুগলি ব্যাংক ধর্মতলা স্ট্রিটে। কাজেই আমি পার্ক-সার্কাস হইতে এই বাস ধরিলাম। ধর্মতলায় হুগলি ব্যাংকের কাছাকাছি গিয়া বাস হইতে নামিলাম। দুতলাস্থ ব্যাংকে গেলাম। কাউন্টারে টাকা দিতে গিয়া দেখিলাম পকেটে মানিব্যাগ নাই। ধরিয়া নিলাম বাসেই পকেটমার গিয়াছে। বুঝিলাম, ওটা ফেরৎ পাওয়ার চেষ্টা পাগলামি। কিন্তু কিসের তাড়নায় পাগলামিটাই করিলাম। দুতলা হইতে ছুটিয়া রাস্তায় নামিলাম। দেখিলাম, অদূরেই বাসটি তখনও দাঁড়াইয়া আছে। দু-চারজন বাসযাত্রী উঠিতেছে। আমি সেদিকে ছুটিতেই বাসটি স্টার্ট দিল। আমি চিৎকার করিতে-করিতে বাসের পিছনে ধাওয়া করিলাম। ধরিলাম। বাসে উঠিলাম। দরজায় দাঁড়ানো কন্ডাকটরকে হাঁপাইতে-হাঁপাইতে ব্যাপারটা বলিলাম। সে আমার এ পাগলামিতে একটু হাসিল। কিন্তু তার মনে দয়া হইল। সে চিল্লাইয়া বলিল : এ বাসে একজনের পকেট-মার গিয়াছে। যারা নামিবেন, তাদেরে আমরা সার্চ করিব। কন্ডাকটরের সহকারী ছিল দুইজন। তারাও এমনি ঘোষণা করিল। পথে অনেক স্টপেজে বাস থামিল। অনেক যাত্রী উঠিল। কিন্তু দু-একজন ছাড়া কেউ নামিল না। যারা নামিল, তারা নিজেরাই নিজ-নিজ পকেট-টকেট দেখাইয়া গেল। তাদেরই খালি করা সিটের একটিতে আমাকে বসাইল। শেষ পর্যন্ত বাসটি নাখোদা মসজিদের সামনে অস্থায়ী টার্মিনালে থামিল। যাত্রীরা নামিতে লাগিল। কন্ডাকটরদের নামমাত্র তল্লাশি করিতে হইল। কারণ সবাই স্বেচ্ছায় পকেট-টকেট দেখাইতেছিল। আমার বুকের ধড়ফড়ানি দ্রুত বাড়িয়া অবশেষে প্রায় শেষ। আর আশা নাই। পাথরের মত বসিয়া আছি। সবাই নামিয়া গেল। আমার মানিব্যাগ উদ্ধার হইল না। কন্ডাকটররা আমাকে সমবেদনা জানাইতে আসিয়া দেখিল আমার পাশেই একজন যাত্রী বসা। তাদের সন্দেহ হইল। তাকে ধাক্কাইয়া তুলিল। দেখা গেল, তার পাছার নিচেই আমার মানিব্যাগ। ব্যাগটা আমাকে দিল। কাঁপা হাতে খুলিয়া দেখিলাম সব ঠিক আছে। আমি শোকরানার মোনাজাত করিলাম। কন্ডাকটররা লোকটাকে বেদম মারপিট করিতে লাগিল। আমি তাকে ছাড়িয়া দিতে কাকুতি-মিনতি করিলাম। ততক্ষণে বাস ঘেরিয়া বিপুল জনতা। অনেকে আমার সমর্থন করিল। লোকটাকে ছাড়িয়া দেওয়া হইল। কন্ডাকটররা ও জনতার অনেকে সব শুনিয়া আমাকে কংগ্রেচুলেট করিলেন। আনন্দ পুলকে আমার চোখে পানি দেখা দিল। আমি শুধু মেহেরবান আল্লাহকে দেখিলাম না। কন্ডাকটররাও আমার নজরে ফেরেশতা মনে হইল। আমাকে হেফাযত করিতে আল্লাই ওঁদেরে পাঠাইয়াছেন। আমি তাদেরে বখশিশ ত নয় নজরানা দিতে চাহিলাম। নিদান পক্ষে চা-নাশতা খাওয়াইতে চাহিলাম : তারা কিছু গ্রহণ করিল না। বরঞ্চ একজন বিশ্বস্ত ট্যাক্সিওয়ালা ডাকিয়া আমাকে বাসায় পৌঁছাইবার ব্যবস্থা করিল। বাসায় পৌঁছাইবার পর ট্যাক্সিওয়ালাও মিটারে উঠা ভাড়া ছাড়া একপয়সা অতিরিক্ত নিল না আমার সাধাসাধি সত্ত্বেও। ট্যাক্সিটা ফিরিয়া গেল। আমি রাস্তার মোড় না ফেরা পর্যন্ত সেদিকে চাহিয়া রহিলাম। মনে হইল আল্লাহর পাঠানো ফেরেশতাদের মধ্যে ঐ ট্যাক্সি ড্রাইভারটিও একজন।
.
১১. ‘অজাতশত্রু’
জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞানের কথা বলিতে গিয়া আমার আরেকটা কথা মনে পড়িয়া গেল। কথাটা মামুলি। তরুণদেরও জানা কথা। জ্ঞানীর পক্ষে অহংকারী হওয়া অস্বাভাবিক নয়। আত্মসম্মান, গর্ব, অহংকার, সেলফ-রেসপেক্ট, প্রাইড ও ভ্যানিটির পার্থক্য এত সূক্ষ্ম যে বিভ্রান্তি ঘটার সম্ভাবনাই বেশি। খারাপ অর্থে দম্ভ, অহংকার ও তুকাব্বরির দুইটা রূপ : এক, নিজেকে বড় মনে করা। দুই, অপরকে ছোট মনে করা। দুইটাই খারাপ। জ্ঞানীর জন্য ও বিষয়ীর জন্য প্রথমটার মধ্যে অপর’ অনুপস্থিত অপরকে ছোট মনে না করিয়াও, তার মানে, আর কারো কথা মোটেই চিন্তা না করিয়াও নিজেকে। ‘বড়’ মনে করা সম্ভব। স্থূল দৃষ্টিতে মনে হইবে, এটা মন্দের ভাল। কারণ এ মনোভাবেরও দুইটা মুখ আছে। একটা সুন্দর, অপরটা অসুন্দর। অহংকারের এই রূপে মানুষ নিজেকে অজাত শত্রু মনে করে। আমি এত বড়, এত ভাল, এত গুণবান যে আমাকে সবাই শ্রদ্ধেয় মনে করে। আমি সমাজের একটা সম্পদ। কাজেই আমার কোনও শত্রু নাই। আমি অজাত শত্রু। এটাও যে নিরর্থক দম্ভ তা আমি বুঝিয়াছিলাম অধিক বয়সে। বিনয়ী, শিষ্টাচারী ও আদব-কায়দা-দুরস্ত হওয়ার শিক্ষা পাইয়াছিলাম শৈশব হইতেই। মুরুব্বি, গুরুজন, শিক্ষক-অধ্যাপকরা সবাই এসব গুণের জন্য আমার তারিফ করিতেন। ভাল’ বলিতে-বলিতে মানুষ সত্য-সত্যই ভাল হইয়া যায়, এটা অংশত সত্য হইলেও পূর্ণ সত্যটা এই যে যাকে ভাল’ বলা যায় সে নিজেকে ভাল মনে করিয়া বসে। বিশ্বাস করে। আমিও বিশ্বাস। করিলাম। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ঐ তারিফের পুরামাত্রায় যোগ্য হইবার চেষ্টাও করিতে লাগিলাম। সর্বদা হুঁশিয়ার থাকিলাম, লোকমুখের ঐ তারিফের কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। লোকে নিন্দা করিতে পারে, ভদ্রতার খেলাফ হইতে পারে, এমন কোনও কাজই করিতাম না।
আচার-ব্যবহারের এই বাহ্যিক রূপ নিশ্চয়ই অন্তরেও সংক্রমিত হইয়াছিল। বাহিরে কারো অনিষ্ট ত করিতামই না, অন্তরেও অনিষ্টের চিন্তা করিতাম না। বাহিরে যাঁকে যত শ্রদ্ধা-ভক্তি দেখাইতাম, অন্তরেও তাঁকে ততখানি ভাবিবার চেষ্টা করিতাম। এইভাবে আমার মনে এই ধারণা ও বিশ্বাস জন্মিল যে আমি যখন কারো ক্ষতি বা অনিষ্ট করি নাই, তখন অপরেও আমার ক্ষতি বা অনিষ্ট করিবে না। আমি যখন কারো অনিষ্ট চিন্তা করি না, তখন অপরেও আমার অনিষ্ট চিন্তা করে না। এ সবেরই যোগফলে আমার বিশ্বাস হইল আমি ‘অজাতশত্রু’। এ বিশ্বাস আমার এতই দৃঢ় ছিল যে আমি পাড়াগাঁয়ে অন্ধকার রাতেও একা-একা পথ চলিতে ভয় পাইতাম না। লোকেরা বা বন্ধু-বান্ধব ভয় দেখাইলে বলিতাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই। ভয় কিসের?
এই মনোভাবটায় যে আসলে সাহসের চেয়ে অহংকারই ছিল বেশি, সেটা আমাকে বুঝাইয়াছিলেন সুভাষবাবু। তিনিই সর্বপ্রথম আমার এই অহংকারে প্রচণ্ড আঘাত হানিয়াছিলেন। সেটা ছিল ১৯৩৮ সালের শেষ দিক। তিনি তখন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা। এলগিন রোডের বাসায় পারিষদবর্গের সঙ্গে আলোচনা। পারিষদদের মধ্যে আমিও একজন। তর্কে তর্কে কথার পিঠের কথায় আমি বড়াই করিয়াছিলাম : ‘আমার কোনও শত্রু নাই।’ তাঁর সুন্দর মুখখানিতে মৃদু হাসি ফুটাইয়া সুভাষবাবু বলিয়াছিলেন : আপনার ধারণা ভুল। বোবারই শত্রু নাই। আপনি বোবা নন।
সুভাষবাবুর কথায় তখন বেজার হইয়াছিলাম, পরে বুঝিয়াছিলাম, তার কথাই সত্য। কিন্তু বুঝিতে বেশ সময় লাগিয়াছিল। তখন আরো বুঝিয়াছিলাম যে কথাটা সুপ্রাচীন বলিয়াই আমরা উহার সংকীর্ণ অর্থই করিয়া থাকি। আসলে ও-বাবার অর্থ শুধু ‘বোবা’ নয়। কালাও। অজাতশত্রু হইতে গেলে শুধু বোবা হইলেই চলে না, কালাও’ হইতে হয়।
.
১২. সততা ও তুকাব্বরি
সৎ-সাধু হওয়ার দরুন গর্ববোধ করা, টন-টনা আত্মসম্মানবোধ থাকা দোষের নয়। সততা-সাধুতার ওটা পুরস্কার। কিন্তু সে সততা-সাধুতার গর্ব যদি দম্ভ অহংকারে প্রসারিত হয়, সে অহংকার যদি অপরকে ঘৃণা-অবজ্ঞা করিতে শিখায়, তবে সেটা হয় তখন আযাযিলের তুকাব্বরি। এই তুকাব্বরি মহৎ মানুষকে নীচ করে, বড় মনকে ক্ষুদ্র করে। ফলে সৎ-সাধু লোকেরা নিতান্ত স্পর্শকতার হইয়া পড়েন। সমালোচনাকে তারা নিন্দা মনে করেন। হিতোপদেশ-দাতাদের তারা অশিষ্ট ধরিয়া লন। এটা নিজের দিক। অপরদিকে পরের উপর তারা অবিবেচক, অসহিষ্ণু, নিষ্ঠুর ও হৃদয়হীন হইয়া পড়েন। মহাপুরুষদের এই মহাকাব্য, ‘পাপকেই ঘৃণা করিও, পাপীকে ঘৃণা করিও না’, বেমালুম ভুলিয়া যান তাঁরা। নিজের সততা-সাধুতার অন্ধ অহংকারে তারা গুনাহে-সগিরা ও গুনাহে-কবিরার পার্থক্য ভুলিয়া যান। লঘু গুরুর জ্ঞান হারাইয়া ফেলেন।
আমার জীবনেই এটা ঘটিয়াছিল। প্রয়োজনবোধের সীমাজ্ঞান হইতেই হক-নাহকের নীতিবোধের জন্ম। ছেলেবেলা হইতেই আমি জমিদার মহাজনদের প্রয়োজনাতিরিক্ত অর্থ-লালসার মতই ঘুষ রেশওয়াতেরও প্রচণ্ড নিন্দুক হইয়া উঠিয়াছিলাম। জমিদারদের মাথট-আবওয়াব, মহাজনদের চক্রবৃদ্ধি সুদের মতই মোল্লা-মৌলবীদের দান-খয়রাত, পীর-ফকিরদের নজরানাকেও অন্যায় যুলুম ও নাজায়েয উশুল বলিতাম। পরবর্তীকালে উকিল হইয়া কোর্টে-আদালতে আসিয়া কেরানি-পেশকার ও পিয়ন চাপরাশিদের উপরি বখশিশকেও ঘুষ আখ্যা দিতাম। ধুচিয়া গাল পাড়িতাম। শুধু মুখে গাল দিতাম না। অন্তরেও ঘৃণা করিতাম। মাত্র বিশ টাকা মাহিয়ানায় পিয়ন-চাপরাশির, আর মাত্র চল্লিশ টাকা বেতনে কেরানি পেশকারের চলে না। কিছু উপরি পাওনা ওদের দরকার। এসব যুক্তি আমি মানিতাম না। অবস্থা ভেদের মাত্রাজ্ঞান আমার ছিল না। পান হইতে চুন খসিলেই আমি ক্ষেপিতাম। মামলা-মোকদ্দমার টাউটদের আমি দু’চক্ষে দেখিতে পারিতাম না। তাদেরে আমি আমার বৈঠকখানায় ঢুকিতে দিতাম না। লোকাল বোর্ড, ডিসট্রিক্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান-মেম্বরদের তৎকালে বদনাম ছিল। লোক-মুখে তাঁদের দুর্নীতির কাহিনী শুনিয়াই তাঁদের নিন্দা শুরু করিলাম। শহরে টাউন হল প্রাঙ্গণে এবং মফস্বলে মাঠে-ময়দানে সভা করিয়া তাঁদের নিন্দায় প্রস্তাব গ্রহণ করিতে লাগিলাম। আমার এই অভিযানে কারো কোনও ক্ষতি বা আর্থিক লোকসান হইয়াছিল বলিয়া শুনি নাই।
কিন্তু অন্তত একজনের বস্তুত একটা পরিবারের সত্য-সত্যই এতে বিপুল ক্ষতি হইয়াছিল। আমার জীবনে এটা একটা অনুশোচনার স্মৃতি। সেটা ১৯৩২-৩৩ সালের ঘটনা। লাহোর হাইকোর্টের জনৈক বিচারপতি মি. রবার্ট ইয়ং এই সময়ে কোর্টে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্যে একটি ‘এন্টি-কোরাপশান’ সংঘ গঠন করেন এবং সারা ভারতের হাইকোর্টে ও তাদের অধীনস্থ আদালতসমূহে তার শাখা স্থাপনের প্রস্তাব দেন। তদনুসারে ময়মনসিংহেও একটি শাখা স্থাপিত হয়। মি. হেন্ডারসন (পরে কলিকাতা হাইকোর্টের জজ) এই সময়ে ময়মনসিংহের জিলা জজ। তারই উদ্যোগে হাকিম-উকিলদের যুক্ত সভায় একটি কমিটি গঠিত হয়। অন্যতম মুনসেফ মি. মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম (পরে জুডিশিয়াল সেক্রেটারি ও খান বাহাদুর) এই কমিটির সভাপতি ও আমি সেক্রেটারি নির্বাচিত হই। ঐ কমিটির রিপোর্টে একজন কেরানি প্রথমে সাসপেন্ড ও পরে ডিসমিস হন। সাসপেন্ড থাকাকালে তিনি ছেলেমেয়েসহ সপরিবারে আমার বাসায় আসেন। তিনি নিজে আমাকে এবং তার স্ত্রী আমার স্ত্রীকে অনেক অনুরোধ-উপরোধ ও কাকুতি-মিনতি করেন। নিজেদের ও ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের দোহাই দেন মর্মস্পর্শী ভাষায়। তিনি এও জানাইলেন যে, তার উপরওয়ালারা তাকে আশ্বাস দিয়াছেন যে আমার। একটা ভাল রিপোর্ট পাইলেই জজ সাহেব তার চাকরি বহাল রাখিবেন। এর পরেও আমার মন গলিল না।
পরবর্তীকালে এই নীতিবাগিশতাই আমার অনুশোচনার কারণ হইয়াছে। কিন্তু চরম শাস্তি আমার তখনও পাওয়া হয় নাই। ১৯৪৭ সালে আমার এই অহংকারের গালে প্রচণ্ড চপেটাঘাত করেন শেরেবাংলা হক সাহেব। তার সাথে তর্কে-তর্কে কথার পিঠে কথার বড়াই করিয়াছিলাম : কই, আমার নিন্দা ত কেউ করে না। হক সাহেব হো হো করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিলেন : ‘শেওড়া গাছে কেউ ঢিল মারে না। আম গাছেই মারে।
এরও দশ বছর পরে আমার দর্প চূর্ণ হইয়াছিল। নিজেই দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হইয়াছিলাম। সত্য-সত্যই গায় ঢিল পড়িয়াছিল। তখন দশ বছর আগে কওয়া হক সাহেবের কথা হইতে আম গাছের তসল্লি পাইবার চেষ্টা করিয়াছিলাম কিন্তু যতবার সে চেষ্টা করিয়াছি ততবার সে তসল্লি ঠেলিয়া পঁচিশ বছর আগের ময়মনসিংহ কোর্টের সেই কেরানি ও তাঁর অসহায়। ছেলেদের মুখ আমার দিকে চাহিয়া শেখ সাদীর বয়েত আওড়াইয়াছে : তাকাব্বর আজাজিলেরা খাবে কর্দ।
খোদাকে ধন্যবাদ। আমার তুকাব্বরি আমাকে খোয়ার করে নাই। হুঁশিয়ার করিয়াছে মাত্র।