বানপ্রস্থ
১৯৯৩ সনের জুলাই মাসে আমার অবসরজীবন শুরু হল। অক্সফোর্ডের সঙ্গে যোগসূত্র রয়ে গেল সেন্ট অ্যান্টনিস কলেজে এমেরিটাস ফেলোশিপ মারফত। আর অবসরটা অবশ্যি প্রথম দিকটা নামেই। কারণ আগের থেকেই ঠিক হয়ে ছিল পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া আর সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক এক মাস করে কালক্ষেপ করতে হবে। তারপর ওয়াশিংটনে স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটে এক বছর। তবে আমন্ত্রণগুলি নিজের গবেষণা সংক্রান্ত কাজ করার। সুতরাং কর্তব্যটা গুরুভার নয়। ভাবলাম এবার চেপে কাজ করে দীর্ঘদিনের পরিকল্পিত বাঙালি মানস বিষয়ে বইটি লিখে ফেলব। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউটের খরচায় আমার নিজের শ’তিনেক বই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওঁরা একজন সাহায্যকারীর খরচাও দিয়েছিলেন। ফলে অনেক আশা নিয়ে কাজটায় হাত দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই কাজ আজও শেষ হয়নি। আশা ছাড়িনি, তবে যতক্ষণ খাস, আশাটা ততক্ষণই চালু থাকতে পারে। লেখাটা আগে শেষ হবে, না অন্তিম নিশ্বাস আগে নিষ্ক্রান্ত হবে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা মুশকিল।
পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে বসে আর একটি কাজ করি। আমার বন্ধু এবং সহকর্মী নিউ ইয়র্ক স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিস্টিংগুইসড প্রফেসর জেরান্ডিন ফর্বস-এর (উনি বাঙালি তথা ভারতীয় নারীর ইতিহাস লিখে প্রসিদ্ধ হয়েছেন) কাছে একটি বাংলা হস্তলিপির ফোটো কপি দেখেছিলাম। লেখাটি উনিশ শতকে জাতা একটি মহিলার আত্মকথা, নাম–হৈমবতী সেন। নয় বছর বয়সে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক এক লম্পটের সঙ্গে ওঁর বিয়ে হয়। ভদ্রলোক বালিকা বধূতে তৃপ্ত না হওয়ায় শয়নকক্ষেই গণিকা নিয়ে আসতেন। দশ বছর বয়সে মেয়েটি বিধবা হন। তারপর অনেক ঝড়ঝা সয়ে বহু লম্পটের লুব্ধ দৃষ্টি থেকে বহু কষ্টে আত্মরক্ষা করে পঁচিশ বছর বয়সে উনি পুনর্বিবাহ করেন। তারপর নিজের চেষ্টায় ডাক্তারি কিছুটা শিখে কালে উনি চুঁচুড়ায় লেডি ডাক্তার হয়ে বসেন এবং সত্যিকার প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন। আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় ভারতীয় তথা বাঙালি গার্হস্থ্যজীবনের এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ আর কোথাও নেই। এবং আমাদের তথাকথিত ভদ্র সমাজের সত্যিকার চেহারা কী তার এমন নগ্ন চিত্রও আর কোথাও পাইনি। আমি বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করব ঠিক করি। স্থির হয় যে আমি অনুবাদ করব আর জেরান্ডিন সম্পাদনার বাকি কাজটা করবেন। পার্থে বসে আমি এই অনুবাদের প্রথম খসড়াটি তৈরি করি। বইটি ২০০০ সনে প্রকাশিত হয়। প্রকাশক বাছার ব্যাপারে আমরা ভুল করেছিলাম। ফলে বইটির সত্যিতে কোনও প্রচার হয়নি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঘরে বসে কমপিউটারে এই কাজটি করতাম। ক্লান্ত লাগলে পাশেই সোয়ান নদীর পারে গিয়ে বসতাম। নদীর জল সত্যিতে ঘন নীল দেখায় এ অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর একবারই হয়েছে ওরছায় বেতোয়া নদী দেখে। আমার স্ত্রী স্যান্ডউইচ নিয়ে এসে যোগ দিতেন। আর কিছু সি-গাল আমাদের আহার্যর অংশ পাওয়ার তালে থাকত। একটি বিশিষ্ট রকমের বজ্জাত সি-গাল আর সবাইকে তাড়িয়ে নিজে সবটা খাওয়ার চেষ্টা করত। হাড় বজ্জাত শুধু মনুষ্য প্রজাতির মধ্যেই পাওয়া যায়–এটা আমাদের নিতান্তই ভুল ধারণা। তবে মানুষের তুলনায় পশুপাখিরা ভদ্রলোক এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম। কালোবাজার, ঘুষ খাওয়া, মিথ্যা ভাষণ এইসব ব্যাপারে সাধারণত কোনও শুয়োর বা ছাগলকে দেখতে পাবেন না। ওদের নীতিবোধ আমাদের থেকে উন্নত।
অস্ট্রেলিয়াতেই আমাদের নতুন ভ্রাম্যমাণ জীবন শুরু হল। আসলে অবসর নেওয়ার সময়ই আমার বাড়ি কেনার জন্য ঋণটা শোধ হয়ে যায়। আরও দু-একটা কারণে আমাদের হাতে খরচ করার মতো টাকা একটু বেশি আসতে শুরু করে। ফলে বিশ্বভ্রমণের পুরনো ইচ্ছেটা রীতিমতো চাড়া দিয়ে ওঠে। আমরা কয়েক বছরের মধ্যে কেনিয়া, দক্ষিণ ভারত, শ্রীলঙ্কা, উজবেকিস্তান, কাম্বোডিয়া, ব্রহ্মদেশ, কানাডা (পুবে টরন্টো থেকে শুরু করে ট্রেনে প্রশান্ত মহাসাগরের পারে ভ্যাঙ্কুভার অবধি), আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড (উদ্দেশ্য অবোরা বোরিয়েলিস দেখা) গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ, ইটালি আর পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, চিন (দুং হুয়ার গুহাচিত্র পর্যন্ত), ইরান, রাশিয়া (জলপথে মস্কো থেকে ভলগা নদী বেয়ে এবং দুটি বৃহৎ হ্রদ পার হয়ে সেন্ট পিটারসবার্গ পর্যন্ত) প্রভৃতি বহু দেশ ঘুরে বিপুলা এ পৃথিবীর বেশ খানিকটা দেখে নিই। তবে এই ভ্রমণ ট্যুরিস্টের ভ্রমণ। এতে অ্যাডভেঞ্চারের স্বাদ কম। ধুলোবালি ঝেড়ে প্যাকেটে মুড়ে ট্র্যাভেল কোম্পানি আনন্দের খিলি হাতে তুলে দেন। এতে আরাম জেয়াদা, উত্তেজনা থোড়া কম। সাতষট্টি বছর বয়সে অবসর নিয়েছি। এখন আর পিঠে বোঁচকা বয়ে হট্টমন্দিরে শয়ন করে না জানা ভাষায় পথের সন্ধান নিয়ে বিশ্বভ্রমণের তাকত নেই। সুতরাং প্যাকেজ টুর তো তাই সই। এই নিরাপদ ভ্রমণের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে পাঠক/পাঠিকার ধৈর্যচ্যুতি ঘটাব না। তবে এই ভ্রমণও সম্পূর্ণ বিপদশূন্য ছিল না। সেসব কথা যথাস্থানে বলব।
আমাদের স্বামী-স্ত্রী দু’জনেরই লম্বা ট্রেন যাত্রা খুব ভাল লাগে। পার্থে ইন্ডিয়া-প্যাসিফিক ট্রেনে তিন দিন তিন রাতের জন্য উঠে বসলাম। শয়ন ও আহারের ব্যবস্থা অনবদ্য। যাত্রার অপর প্রান্তে আছে সিডনি। আর মাঝখানে বেশির ভাগ পথটাই মরুভূমির ভিতর দিয়ে।
সওয়া ঘণ্টার জায়গায় সওয়া তিন দিনের পথ বটে, তবে রাস্তা নিতান্তই সোজা, সুকুমার রায় বর্ণিত কলকাতা থেকে তিব্বতের রাস্তার মতো। এতই সোজা যে এক জায়গায় দুশো কিলোমিটার পথ এক ইঞ্চিও এদিক-ওদিক বাকেনি।
শরৎচন্দ্র বর্ণিত নিশীথের রূপের মতো মরুভূমিরও এক অপূর্ব রূপ আছে, যা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। ধূসরতাও বর্ণহীন নয়। মাঝে মাঝেই তার রূপ বদলায়। আর তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন যেন নেশা ধরে। মাঝে মাঝে ঘাস চোখে পড়ে। তার রং সত্যিই নীলাভ। কচিৎ কখনও দেখি–একপাল ক্যাঙারু অবাক হয়ে চলমান ট্রেনটার দিকে তাকিয়ে আছে। ট্রেন বা মানুষ কিছুতেই তাদের ভয়ের চিহ্ন নেই।
এ যাত্রা এক মাস সিডনি বাসের পর অস্ট্রেলিয়ার আধা-ট্রপিকাল উত্তরাঞ্চল দেখতে গেলাম। আর সেখান থেকে জগদ্বিখ্যাত গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। উত্তরের কেয়ার্নস শহরের গাছপালা পুষ্পসম্ভারে বঙ্গ প্রকৃতির ছায়া পেলাম। সমুদ্রের পাড় ধরে পলাশের সমারোহ। শুধু তাই না, বিরাট বটগাছ ঘিরে দোলনচাপার উচ্ছ্বসিত আত্মপ্রকাশ। সমুদ্রের হাওয়া তার মদির গন্ধে সুরভিত। এই উত্তরাঞ্চল এক ব্যাপারে কিন্তু নিতান্তই আপোসহীনভাবে অষ্ট্রেলিয়া। এখানকার চতুষ্পদরাও সবাই প্রায় মার্ক্সপিয়াল, অর্থাৎ তারা মাতৃগর্ভ থেকে সোজা মাটিতে না নেমে কিছুকাল মা’র উদরসংলগ্ন থলিতে বাস করে। প্রায় ইঁদুরের সাইজের প্রাণীও আছে যাদের জন্ম-ইতিহাস এইরকম। আমার মনে হয়, অস্ট্রেলিয়ায় খুঁজলে মার্ক্সপিয়াল মানুষও পাওয়া যেতে পারে। ওখানকার সবচেয়ে থপথপে আহ্লাদে প্রাণী কোয়ালা। লোকে বলে কোয়ালা বেয়ার কিন্তু ভালুকের সঙ্গে এদের কোনও আত্মীয়তা নেই। এরাও মাসঁপিয়াল। তবে দেখে যত আহ্লাদে মনে হয় আসলে তারা অত সুবিধের লোক না। এদের স্বাভাবিক প্রকৃতি শুনেছি হিংস্র, কিন্তু এদের একমাত্র খাদ্য ইউক্যালিপ্টাসের পাতায় নাকি মাদক রস আছে তাই এরা সব সময় নেশায় বুদ হয়ে থাকে। কোলে নিলেও অসহায়ভাবে আঁকড়ে ধরে থাকে। তবে ঘুমের সময় এঁদের নাসিকাগৰ্জন সিংহগর্জনের মতো শোনায়। তা ছাড়া বন্য অবস্থায় এদের ধরতে গেলে মাথায় পুরীষোৎসর্গ করে মনুষ্যজাতির প্রতি এদের গভীর অবজ্ঞা প্রকাশ করে। আর জীবজগতে প্রকৃতির সব চেয়ে অদ্ভুত পরীক্ষা বিবর্তনের মাঝপথে থেমে যাওয়া প্রাণী হংসচঞ্চু প্ল্যাটিপাসেরও এ যাত্রা সাক্ষাৎ পেলাম। নয় পাখি নয় পশু এই হাঁসজারুও প্রজাতি হিসেবে মার্ক্সপিয়াল। অমিতাভ সেনের অনবদ্য কাব্যে সে অমরত্ব পেয়েছে :
কিছু ঘাস, কিছু বাঁশ, কিছু প্ল্যাটিপাস
ভাবার্থ : কবি বলিতে চাহিতেছেন–প্রকৃতির কোলে বদ লোককে বাঁশের সাহায্যে তাড়িয়ে ক’টি প্ল্যাটিপাস নিয়ে বাস চতুর্বর্গ ফললাভের শামিল। কারণ ওই পোয্য ডিম, দুধ, মাংস–তিনই জোগাবে।
এবার সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য দেখলাম–গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ। প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে ২৫০০ মাইল জুড়ে এই প্রবালদ্বীপপুঞ্জ ভূতলবাসী মানুষের চোখে অনন্ত বিস্ময়ের আকর। সমুদ্রের নীচে গিয়ে সেই বিস্ময়কর জগৎ দেখার সাহস বা শিক্ষা দুটোর একটাও নেই। কিন্তু চোখে ঠুলি লাগিয়ে উপুড় হয়ে ভেসে ভেসে অর্থাৎ সুৰ্কেলিং করে যা দেখলাম তারও তুলনা নেই। প্রবালদ্বীপের বর্ণাঢ্যতার শেষ নেই। একটি ক্ল্যাম বা মহাঝিনুক দেখলাম, মুখব্যাদান করে আছে। বহু ক্ষুদ্রকায় অবোধ প্রাণী সেই বিবরে প্রবেশ করছে। কিন্তু যে পথে তারা যাচ্ছে, সে পথে তারা আর ফিরছে না। এই প্রাণীরই ক্ষুদ্র সংস্করণ অনেক খেয়েছি। অতি সুস্বাদু। কিন্তু এই এক টন ওজনের সুন্দর নীলবর্ণ ক্ল্যাম মনে হল আমাকে খেয়েও একই কথা বলবে। আরও শুনলাম রিফের ওই অঞ্চলে একটি সহৃদয় হাঙর মাঝে মাঝেই আসে। সে নাকি কাউকে কামড়ায় না। হয়তো তার সঁতে ব্যথা। কিন্তু আর জলে থাকা সমীচীন মনে হল না।
অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে ওয়াশিংটন। সেখানে স্মিথসোনিয়ানের এক মিনারে একটি ঘর পেয়েছি। সামনে সযত্নরক্ষিত বাগান দেখা যায়। চারপাশে সব বিখ্যাত মিউজিয়াম। আমার আশঙ্কা ছিল–এই বিরাট শক্তিশালী দেশের রাজধানী দিল্লিরই আর এক চকচকে সমৃদ্ধ সংস্করণ হবে। অর্থাৎ আমলা, কুটনৈতিক আর নানা সুযোগসন্ধানীতে ভরা। সবাই কোনও কোনও তালে আছে। কিন্তু ঠিক তা নয়। ওয়াশিংটন সংস্কৃতির আলোয় উজ্জ্বল। পৃথিবীর সব শ্রেষ্ঠ মিউজিয়ামে সমৃদ্ধ এই শহর। কাজ করতে করতে কখনও একঘেয়ে লাগলে দু’পা হেঁটে গেলেই স্পেস মিউজিয়াম থেকে শুরু করে এশিয়ার শিল্পসম্পদের আকর স্যাকলার গ্যালারি অবধি বিভিন্ন জাদুঘর বিশ্বের বিজ্ঞান আর সংস্কৃতির ঐতিহ্যের নানা উদাহরণ বক্ষে ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। সুন্দর বিরাট বিরাট দুটি ঘরের ফ্ল্যাট পেয়েছি পোটোম্যাকের পারে। আর ওই নদীর পার ধরে হেঁটে সামান্য একটু চড়াই উৎরে স্মিথসোনিয়ানে যাওয়া-আসা করি। যে বই বা প্রবন্ধের প্রয়োজন হয়, আমার ইন্টার্ন বঙ্গকন্যা পূরবী চক্রবর্তী লাইব্রেরি অফ দ্য কংগ্রেস থেকে চটপট সংগ্রহ করে দেন। স্মিথসোনিয়ানের ফেলোরা নানা দেশের নানা বিষয়ের পণ্ডিত। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে একজন ঔপন্যাসিকও আছেন। আমাদের কাজ নিজের নিজের গবেষণা করে যাওয়া আর দুটি বক্তৃতা দেওয়া, একটি শিক্ষিত সাধারণের জন্য আর দ্বিতীয়টি সহকর্মী এবং বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে। মানবিক আবহাওয়া খোলামেলা, মার্কিন সামাজিক সংস্কৃতির দক্ষিণ মুখ তাকে আলোকিত করছে। ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কে কাজ করছেন কয়েকজন দক্ষিণ এশিয়াবাসীর সঙ্গে পরিচয় হল। এঁদের কেউ কেউ আমার বা আমার স্ত্রীর পুর্বপরিচিত। এঁরা কেউই মামুলি অর্থে আমলা সংস্কৃতিতে শামিল না। মা সরস্বতীর আঁচল কেউই ছাড়েননি। বাঙালি গেটো থেকে ওয়াশিংটনও মুক্ত না। তবে এঁরা কেউ তার উৎসাহী সভ্য নন। শহরটির খাদ্যজগৎ পৃথিবীর সব দেশের রেস্তোরাঁয় সমৃদ্ধ। পোটোম্যাকের পারেই মাছের বাজার। সেখানে আর সব ছাড়াও ইলিশ মাছের পশ্চিমি সংস্করণ শ্যাড সুলভ্য। বেশি কাঁটা বলে সাদা সাহেবরা প্রায় ছোঁন না। ফলে আমাদের মতো ভেতো বাঙালির পোয়াবারো।
এই দুগ্ধ আর মধুতে প্লাবিত শহর কিন্তু নির্ভেজাল সুখের আকর না। ওয়াশিংটনে কালো মানুষের সংখ্যাধিক্য। আর তাদের অধিকাংশই হতদরিদ্র। দারিদ্র মানেই অপরাধপ্রবণতা। কিন্তু কার্যকারণ হিসাবে ও দুটি জিনিস সম্পূর্ণ সম্বন্ধহীনও না। ওয়াশিংটন শহরে অপরাধের ঘটনা সংখ্যায় খুব বেশি। পথে যেতে অনেক বারই দেখেছি কোনও রাস্তা সশস্ত্র পুলিশ ঘেরাও করে রেখেছে। দু-চারটে গুলির আওয়াজও শুনেছি। শুনতাম কোথাও ‘হোন্ড আপ’ হয়েছে। একবার বাড়ির কাছের সুপার মার্কেটে গিয়েছি। হঠাৎ শুনি পটাপট গুলির আওয়াজ। সবাই দেখলাম উপুড় হয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়ছে। কয়েকটি লোক একটা সিকিউরিটি ভ্যান পাকড়াও করেছে। বাইরে এসে দেখি আকাশে পুলিশের হেলিকপ্টার। শুনলাম এ জাতীয় ঘটনায় ওখানকার জীবনের ছন্দ-লয় বিঘ্নিত হয় না। এসব দৈনন্দিতারই অঙ্গ।
অপরাধপ্রবণতা ওদেশে কতটা বেড়েছে একটা ব্যাপার দেখে বুঝতে পারি। কোনও চেক সহ চিঠি পোস্ট করলে তা না পৌঁছবার সম্ভাবনা প্রবল। ভাড়া বাবদ আমার তিনটি চেক সহ চিঠি এইভাবে হারায়। আর চেক বন্ধ করার খেসারত চেক প্রতি পঁচিশ ডলার। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম যখন আমার ইংল্যান্ডে পাঠানো একটি রেজিস্টার্ড চিঠি, যা নাকি আমি নিজের হাতে গিয়ে পোস্ট আফিসে দিয়ে এসেছিলাম, সেটা যখন ইংল্যান্ড পৌঁছয়, ভিতরকার মালমশলা তখন রহস্যজনকভাবে বদলে গিয়েছে। আমি একটা জরুরি ফর্ম ভর্তি করে পোস্ট করেছিলাম। তার জায়গায় ছিল ওয়াশিংটনের পাতাল রেলের একটি ম্যাপ। আর আমার বইপত্র ফেরত আসার সময় একটি বাক্সে ছিল আমার বইগুলির বদলে অন্য কিছু বই, একটি হাসপাতালে ব্যবহৃত ট্রে আর একটি মার্কিন-আফ্রিকান পরিবারের ফোটোগ্রাফ। এই রহস্যের অন্ত আমি আজ অবধি পাইনি। লিখতে বাধ্য হচ্ছি–দীর্ঘদিন ইংল্যান্ডে বাস করে সেখানে কখনও অনুরূপ অভিজ্ঞতা হয়নি।
আরও একটি ব্যাপারে আমি বেশ নিরাশ হয়েছি। আমি খোঁজখাঁজ করে এক ডাক্তারের শরণাপন্ন হলাম। কারণ আমি যেসব ওষুধ খাই তার জন্য প্রেসক্রিপশন দরকার। তিনি বললেন, কোনও প্রেসক্রিপশন লিখতে হলে ওঁকে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে। সেগুলি করতে দু-তিন হাজার ডলার খরচা হল। ভাগ্যের কথা–খরচটা ইনসিওরেন্স কোম্পানির। ইংল্যান্ড ফিরে যখন সেসব রিপোর্ট দেখালাম, আমাদের ডাক্তাররা হতবাক। তারা জিগ্যেস করলেন, এসব কেন করেছিল? আমাদের কি কিছু হয়েছিল? উত্তরে বলি–কিছু হয়ে থাকলে আমরা তা জানতে পারিনি। একবার এক রেস্টুরেন্টে বাইরের ঠান্ডা থেকে হঠাৎ গরমের মধ্যে ঢাকায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। অ্যাম্বুলেন্স ডাকায় এক মাইল পথ যেতে ১৬৮ ডলার খেসারত দিতে হয়েছিল। আমাদের এক পরিচিত মার্কিন যুবকের ব্যয়সংক্ষেপনীতির ফলে লাইব্রেরি অফ দ্য কংগ্রেস থেকে চাকরি যায়। চাকরি না থাকা মানে মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স না থাকা। তার মানে এই ডায়াবেটিক ছেলেটির ওষুধ কেনারও ক্ষমতা ছিল না। চিকিৎসা করাবার উপায়হীন লোকের সংখ্যা মার্কিন মুল্লুকে ৩৯ মিলিয়ন। চিকিৎসা ব্যাপারটা আমেরিকায় এক দিকে খুব উন্নত ঠিকই। কিন্তু আর এক দিক থেকে ওর ভিতর যে অকারণ অর্থশোষণের বিচিত্র সব ব্যবস্থা আছে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ক্লিনটনদের হেনস্থা করার জন্য ওখানকার মেডিক্যাল ইন্সিওরেন্স বিশেষ সক্রিয় ছিল। কারণ মিসেস ক্লিনটন ওদেশে দরিদ্র মানুষদের কথা ভেবে বিলেতে চালু ন্যাশনাল হেলথ জাতীয় কোনও ব্যবস্থার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি যদি সফল হতেন, তা হলে ইন্সিওরেন্স কোম্পানিগুলি কোথায় দাঁড়াত?
মার্কিন চিকিৎসায় আমি আস্থা হারাই আরও অন্য কারণে। আমার রক্তচাপের উচ্চতা ইত্যাদি নিয়ে কিছু কিছু স্বাস্থ্যগত সমস্যা ছিল। সেজন্য আমি নিয়মিত ওষুধ খেতাম। নানা পরীক্ষা করে আমার মার্কিন ডাক্তার বললেন, আমার কোনও সমস্যা নেই। ওষুধ বন্ধ করে দিলাম। পরিণাম ইংল্যান্ডে ফেরার পর ছ’ মাসের মধ্যে তিন-তিনটি রক্তবাহী শিরা বাধামুক্ত করার জন্য ট্রিপল বাইপাস সার্জারি করাতে হয়।
ওয়াশিংটন বাসের সময়েই আমার জীবনে একটি বড় ঘটনা ঘটল। আমার কন্যা দ্বিতীয়বার বিবাহ করলেন–শ্রীলঙ্কার তামিল ছেলে গণেশন বিঘ্নরাজাকে। গণেশন শ্রীলঙ্কার বনেদি ঘরের ছেলে। ওর দাদামশায় ভারতবর্ষে হাইকমিশনার ছিলেন এবং যত দূর জানি ব্রিটেনের ইতিহাসে একমাত্র অশ্বেতবর্ণ নাইট অফ দা গার্টার। বিয়ের সময় গণেশন অর্থনীতিতে অক্সফোর্ডে ডক্টরেট করছিল। বিয়েটা দিতে হল একটু অস্বস্তিকর অবস্থায়। আমার বাড়িটা তখন এক বছরের জন্য ভাড়া দেওয়া। ফলে আমাদের বন্ধু সাইমন অল্টম্যানদের বাড়িতে থেকে মেয়ের বিয়ে দিলাম। তারপর ওয়াশিংটন প্রত্যাবর্তন।
১৯৯৪ সনে ইংল্যান্ড ফিরে আসি। তার পরের বছর আবার আমেরিকা যাই কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে। বক্তৃতাপর্ব শেষ করে আবার ভ্রাম্যমাণ হই। এবার দীর্ঘ যাত্রা কানাডার পূর্ব থেকে পশ্চিমে। রকি পর্বতমালা পার হয়ে ভ্যাঙ্কুভার শহরে আমাদের যাত্রা শেষ। কানাডার প্রকৃতি অতি রূপবতী। সে রূপ বর্ণনা করে অন্ত পাওয়া ভার। মেঘমুক্ত নীল আকাশ, বিরাট বিরাট সব হ্রদ, তার পাড় ঘিরে মহীরুহের মহোৎসব। বনের ভিতর থেকে বিরাট শিংওয়ালা মুস বা এলক জাতীয় হরিণ কখনও উঁকি মারে। এক একবার মনে হয় ভালুকরাও ক্ষণিকের জন্য দেখা দিচ্ছে। অবশ্যি তাদের সঙ্গে এর চেয়ে ঘনিষ্ঠ পরিচয় আলাস্কায় হয়েছিল। সে কথা পরে বলব।
১৯৯৭-৯৮ সনে বার্লিনের বিসেনশাফট কলেগ-এর আমন্ত্রণে এক বছর ওই শহরে কাটাই। অনেক দেশেই এক বা একাধিক উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠান থাকে যেখানে স্বদেশি এবং বিদেশি পণ্ডিতদের একত্র কাজ করার এবং আলাপ-আলোচনার সুযোগ দেওয়া হয়। কলেগ কথাটি ইংরেজি কলেজেরই জার্মান প্রতিশব্দ। হিটলারি আমলে জার্মানির শিক্ষাব্যবস্থা নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। একটা বিরাট ক্ষতির দিক—অন্য উন্নত দেশগুলির সঙ্গে শিক্ষা-সংস্কৃতিগত সম্পর্কে সম্পূর্ণ ছেদ ঘটা। সেই সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য নানামুখি চেষ্টারই অন্যতর ফল বিসেনশাফট কলেগ। প্রতি বছর কতগুলি বিষয় বেছে সেইসব ক্ষেত্রে কিছু বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করা হয়। উদ্দেশ্য এবং আশা এই যে পারস্পরিক আলোচনার ভিতর দিয়ে তাদের গবেষণা সমৃদ্ধ হবে আর জার্মান পণ্ডিতদের সঙ্গে আদানপ্রদান মারফত সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ছিন্ন সূত্রগুলি আবার জোড়া লাগবে।
এই প্রতিষ্ঠানটির আতিথ্য নিয়ে এক নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা হল। বারোটি গ্রাম একত্র করে বার্লিন শহর গড়ে উঠেছিল। যেখানে কলেগটির অবস্থান সেই গ্রামটির নাম গ্রুনেওয়ালড। এক সময় এই অঞ্চলটিতে অবস্থাপন্ন ইহুদিরা বাস করতেন। স্থানীয় স্টেশনের গায়ে একটি রিলিফ ছবি আছে। তার পাশে লেখা—–এই স্টেশন থেকে হিটলারি আমলে ৫০,০০০ ইহুদিকে আউসউইংসের মৃত্যুশিবিরে পাঠানো হয়। সেই সময়কার কয়েকটি ভিলা নিয়ে কলেগের ক্যাম্পাস। আর আমন্ত্রিত অতিথিরা সবাই ওইসব ভিলায় বাস করেন। যে ভিলাটিতে আমাদের বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল সেটি দুই হ্রদের মাঝখানে। প্রাতরাশ আর দ্বিপ্রহরিক ভোজন কলেগের ক্যান্টিনে। মাঝে মাঝে নৈশভোজনও। আর তার উপরে এই যে স্বল্পস্থায়ী গোষ্ঠীজীবন, তার একটি প্রধান উপজীব্য ছিল খাওয়াদাওয়া আর পরস্পরকে খাওয়ানো। মনে হত যেন একটা চলমান উৎসবের মধ্যে বাস করছি। ভিন্ন বিষয়ের লোকের সঙ্গে আলোচনা থেকে যে নিজের বিষয় সম্বন্ধে নতুন অস্তদৃষ্টি পাওয়া যায়, বার্লিনবাস থেকে সেই জ্ঞান আমি অর্জন করি। এখানে আমার সঙ্গে যাঁদের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয় তারা অধিকাংশই এভোলিউশনারি বায়োলজি অথবা দর্শনের পণ্ডিত। দুটি নতুন বন্ধুত্ব দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে—ইস্রায়েলের এভা ইয়াবলঙ্কা আর সুইডেনের লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ অধ্যাপক অস্ট্রেলিয়ার মানুষ এরিক ওয়ারেন্ট। দু’জনেরই বিষয় এভোলিউশনারি বায়োলজি।
এই প্রসঙ্গে একটি চমকপ্রদ বিভ্রান্তির কথা উল্লেখ করি। বার্লিনের বিখ্যাত দৈনিক ‘বার্লিনের ৎসাইতুং’ আমাদের কলেজটি নিয়ে কয়েকটি কলাম লিখছিলেন। তার প্রধান উপজীব্য ওখানে যারা এসেছেন তাদের জীবন ও কর্ম। আমাকে যে তরুণীটি সাক্ষাৎ করতে এলেন তাঁর সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় সামান্য একটু অসুবিধে ছিল। তার ইংরেজি জ্ঞান আর আমার জার্মান জ্ঞান ঠিক এক স্তরের অর্থাৎ অস্তিত্বহীন। এই অসুবিধে অতিক্রম করে সাক্ষাৎকার সম্ভব না। কিন্তু মহিলা নাছোড়বান্দা। সাক্ষাৎকারের ঠিক আগে ভদ্রমহিলা দেখেছেন আমি এক দল বায়োলজিস্টের সঙ্গে বসে লাঞ্চ খাচ্ছি। উনি ধরে নিয়েছেন আমিও বায়োলজিস্ট। কথাটা যে ঠিক না, পরস্পর আদানপ্রদানের ভাষার অভাবে সেকথা কিছুতেই বোঝাতে পারলাম না। শেষাশেষি প্রায় আকার-ইঙ্গিতে আলোচনা চলছিল। কিন্তু কী যে আলোচনা হচ্ছিল তা ঈশর ভিন্ন আর কারও জানার কথা না। এক সময় বুঝলাম আমার গবেষণার বিষয় কী মহিলা তা জানতে চাইছেন। বললাম–বাঙালিদের সামাজিক ইতিহাস। মহিলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এবার প্রশ্ন, বাঙ্গালি? ভার্টিব্রেটস? ওই যে আমাকে বায়োলজিস্টদের সঙ্গে ঘুরতে দেখেছেন। তাই আমার গবেষণার বিষয় হয় মেরুদণ্ডবান নয়তো মেরুদণ্ডহীন হবেই। আকার-ইঙ্গিতে বোঝালাম–এ প্রশ্নের উত্তর। আমার অজ্ঞাত।
আমার বই লেখার কাজ এখানেও এগোচ্ছিল না। তার অন্যতম কারণ হঠাৎ প্রচণ্ড হাঁপানির আক্রমণ। রূপকথার রাজকন্যারা ফুলের ঘায়ে মূছা যেতেন। ফুলের গন্ধেও যে মানুষ মূৰ্ছা যেতে পারে, তা নিজে ঠেকে শিখলাম। গ্রুনেওয়ালড গ্রাম সুগন্ধি ফুলের গাছ আর লতায় ভর্তি। গ্রীস্মাগমে নানা সুগন্ধে প্রাণমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে এল। কিন্তু শুধু প্রাণমন, তৎসহ ফুসফুসও যে বিকল হয়ে আসছিল, তা ক্রমে টের পেলাম। নিদারুণ অ্যালার্জির প্রকোপে নিশ্বাস নেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠল, দু’পা হাঁটলেই প্রাণ ওষ্ঠাগত। কাজকর্ম সব বন্ধ হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে পুরনো লেখাগুলি ঘাঁটতে বসলাম। দেখলাম গত পাঁচ-ছ’ বছরে গোটা পচিশেক প্রবন্ধদ্র বক্তৃতা কলম থেকে বের হয়েছে। আমার ছাত্ৰীস্থানীয় একদা অক্সফোর্ডের রোডস স্কলার, তখন কলেগের ফেলো এবং বর্তমানে জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্বের অধ্যাপিকা শালিনী রনধেরিয়াকে ধরলাম–এর থেকে কিছু প্রকাশযোগ্য লেখা খুঁজে বের কর। উনি চোদ্দোটি লেখা অনুমোদন করলেন। সেই সংকলনটিই ‘পারসেপশনস, ইমোশনস, সেন্সিবিলিটিস’ নাম দিয়ে ক’বছর পর ছাপা হল।
আধুনিক জার্মানির সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে একটি বিতর্কিত চিন্তাধারা আমাদের রাজনৈতিক চেতনার দিক থেকে বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। নাৎসি আমলের অমানবিক বীভৎসতার জন্য ওদেশের বর্তমান প্রজন্মের কোনও দায়িত্ব আছে কি না—এ নিয়ে বহুবার উত্তপ্ত আলোচনা শুনতে পেয়েছি। যাঁরা এ প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর দেন তাদের বক্তব্য–হিটলারের অমানুষিকতার জন্য দায়ী শুধু নাৎসিরা না, সমস্ত জার্মান জাতি। অর্থাৎ বর্তমান প্রজন্মের বাপ-পিতামহরা। তাদের দূষিত রক্ত এদের ধমনীতেও বহমান। সেই পাপের সর্বোপায়ে প্রায়শ্চিত্ত প্রয়োজন। অর্থাৎ এ বিষয়ে সকলের অবহিত হতে হবে। কোনও ছিদ্রপথে সেই নারকীয় মনোবৃত্তি যাতে আবার সমাজজীবনে বিষ না ছড়ায় তার জন্য অহোরাত্র সজাগ থাকা প্রয়োজন। তাই জার্মান ইতিহাস-বিষয়ক মিউজিয়ামের একটি অংশ হিটলার ফেন্ডে আউসউইৎসের কমান্ডান্টের ভয়াবহ উক্তি সর্বক্ষণ শোনানো হয়। অবিচলিত কণ্ঠে লোকটা ঘোষণা করে গ্যাসে যে বোজ হাজার হাজার মানুষের প্রাণনাশ হচ্ছে, সে কথা স্থানীয় লোক প্রথমে জানত না। কিন্তু পরে যখন দৈনিক নরহত্যা সংখ্যায় খুব বেড়ে গেল, তখন সারা সময় পোড়া মাংসের গন্ধ নাকে আসায় সবাই বুঝতে পারে কী নারকীয় ব্যাপার তাদের ঘরের পাশেই ঘটে চলেছে। বার্লিন শহরের কেন্দ্রস্থলে একটি পাথরের ফলক আছে। তাতে শুধু কয়েকটি জায়গার নাম খোদাই করা। নামগুলি নাৎসি ডেথ ক্যাম্পের যেখানে ষাট লক্ষ নারী, শিশু, পুরুষকে বিষাক্ত গ্যাস দিয়ে হত্যা করা হয়েছিল।
আমার মনে হয় হিন্দু-মুসলমান-শিখ আমরা সবাই গত ষাট বছর ধরে যে পারস্পরিক হত্যার উৎসবে বারবার মেতে উঠেছি, তার বিস্তৃত বিবরণ শহরে শহরে গ্রামে গ্রামে পাথরে খোদাই করে মানুষের চেতনার অঙ্গীভূত করা প্রয়োজন। আমাদের কথায়, আচরণে মনে হয়–সমাজ হিসাবে আমরা শিশুর মতো নির্দোষ। কিছু খুনে রাজনৈতিক আর কালবাজারি আছে ঠিকই, তবে তাদের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক? ১৯৪৭-এ বহু লক্ষ মানুষ পরস্পর হানাহানিতে খুন হয়েছে। ১৯৪৬-এর দাঙ্গায় এই কলকাতা শহরে দশ হাজারেরও বেশি সংখ্যায় মানুষ নির্বিচারে কচুকাটা হয়েছে। শিশুদের দুই পা ধরে জরাসন্ধ বধের আঙ্গিকে টেনে দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে। জ্বলন্ত আগুনে তাদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে। তাতে আমাদের কী? যদি হিন্দু হই তো দোষটা মুসলমানের। আর মুসলমান হলে হিন্দুর। আর দোষের প্রশ্নই বা ওঠে কেন? গুজরাটে যা ঘটেছে তার তো প্রয়োজন ছিল? (এই অশ্লীল উক্তি একটি উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তির। লোকটা কি মানুষ? কোন নিম্নস্তরের জীব তার তুলনায় অধম?) ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে ব্যবহার করার জন্য এক দিকে কংগ্রেস অন্য দিকে বামপন্থী সরকার মুসলমান তোষণ নীতি অবলম্বন করে ওদের বড় বাড়িয়ে দিয়েছে। এই দেশে বাস করে ওরা বিয়ে-শাদির ব্যাপারে শরিয়তি আইনের আওতায় থাকতে চায়। কী দুঃসাহস! ওদের মসজিদ আক্রান্ত হলে তেড়ে আসে! কোন দেশে বাস করিস তা ভুলে যাস? প্রত্যেকে এক একটি পাকিস্তানি চর। আর পাকিস্তানে? ওখানে যে সংখ্যালঘুরা নির্মূল হয়েছে–যত দূর জানি, এ নিয়ে উদারপন্থীরাও কোনও কথা বলেন না। ১৯৭১ সনে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছিল তা নিয়ে কোনও পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী কি কখনও কিছু বলেছেন?
বাংলাদেশে হিন্দু বিতাড়ন প্রচেষ্টা বিষয়ে এক তসলিমা ছাড়া আর কেউ সোচ্চার বলে শুনিনি। আমাদের হয়েছে কি, কেউ একটু বুঝিয়ে দেবেন আমাকে? আমরা কি সত্যিই মানুষ? কোন চতুষ্পদ প্রাণী আমাদের তুলনায় অপকৃষ্ট? আমি তো ভেবে পাই না।
কিছুদিন হল বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্পর্ক বিষয়ে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি। প্রথম প্রথম ভাবতাম কিছু লোকের মতিভ্রম হয়েছে। তারপর দেখি ইয়োনেসকোর ‘গণ্ডার’ নামক নাটকটির অবস্থায় পৌঁছেছি আমরা। প্রথমে শহরের চকে মাঝে মাঝে একটি-দুটি গণ্ডারকে দেখা যেত। ক্রমে দেখা গেল সবাই গণ্ডার হয়ে গেছে। একজন বিখ্যাত ফোটোগ্রাফার পা ঠুকে ঠুকে বললেন আপনারা বিদেশে থাকেন তাই কোনও ধারণা নেই যে দেশে কী হচ্ছে! মুসলমানদের হয় এ দেশ থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে, নয়তো তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিতে হবে। যদি ভারতবর্ষ পাকিস্তানের অঙ্গীভূত হয় এটাই আমাদের কাম্য না হয়, তবে এ ছাড়া কোনও তৃতীয় পথ নেই। আর একজন পণ্ডিত ব্যক্তি নরাধম মোদীকে আমেরিকা ঢুকতে দেওয়া হয়নি দেখে রীতিমতো উন্মা প্রকাশ করলেন। ক্যালকাটা ক্লাব লোকটাকে ডেকে তার বচনামৃত পান করল, কারণ সকলের মতই তো শোনা উচিত। এই বিশালহৃদয় মানবধর্মী উদারতা থেকে নরপশুরাও বাদ পড়া অনুচিত। মনে হয় হিটলার বা নাথুরাম গডসে জীবিত থাকলে এরা তাদের ডেকেও তাদের বক্তব্য শুনতেন। এবং নিতান্তই তাদের বক্তৃতাভঙ্গির প্রশংসা করে হাততালিতে ছাদ ফাটাতেন, যেমন নরাধম মোদীর বক্তৃতা শুনে ফাটিয়েছিলেন। কপটতা আর কত দূর যেতে পারে!
এক আত্মীয় প্রশ্ন করলেন, তোমার মনে হয় না সারা পৃথিবীটাই ওরা কজা করে নেবে? ওরা অর্থাৎ মুসলমানরা। এক পুরনো বন্ধু, যিনি এককালে বামপন্থী ছিলেন, মাঝে মাঝেই বলেন, সব মুসলমানরা সন্ত্রাসবাদী না, কিন্তু সম্রাবাদী মাত্রেই মুসলমান। আইরিশ স্বাধীনতাসংগ্রামী, তামিল টাইগার, দক্ষিণ আফ্রিকার স্বাধীনতাকামী, ইহুদি বিপ্লবীদের কথা উল্লেখ করলে বন্ধুবর বলেন—আরে সে তো আগের কথা! রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য এক পরিবারের এক মহিলা কাজির অত্যাচারের কাহিনি শোনান। মনেরও অদৃশ্য দুটি কান আছে। তাতে আঙুল দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। আমার ওড়িশাবাসী পাচক পাকিস্তানি কাশ্মীরে ভূমিকম্পে ত্রিশ হাজার মানুষ মারা গেছে শুনে বললেন, বেশ হয়েছে। আরও মরলে ভাল হত।এক বাংলাদেশি কবি লিখেছেন, ফিরে এসো বাংলাদেশ। কোথায় চলেছ তুমি ধেই ধেই করে? আমিও ভাবি-ধেই ধেই করে কোন নরকের পথে আমরা চলেছি? আমি কী করি? দুটো প্রবন্ধ লিখি। দুটো বক্তৃতা দিই। কেউ তা পড়ে বা শোনে বলে মনে হয় না। শুধু সৌভাগ্যের কথা দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়নি। ভাগোয়া ঝান্ডা জাতীয় পতাকা হতে আরও কিছুদিন দেরি আছে।
২০০০ সনে আমার জীবনে আর একবার দুঃসহ দুঃখ নেমে এল। আমার চেয়ে বয়সে সতেরো বছরের ছোট ভাই অপু ওরফে ধূর্জটি অনেক কষ্ট পেয়ে মারা গেল। ১৯৪৩ সনে বাবা আর দাদা যখন জেলে, তখন ওর জন্ম হয়েছিল। দুর্যোগের মধ্যে এসেছিল, তাই বাবা ওর নাম রাখেন ধূর্জটি। পরে ওর নাম শুনে কুমার মন্তব্য করে, এত দেখেও লোকে শেখে না। দেখছ ওই নামের এক ভদ্রলোকের এমন ছেলে হল যে দুশ্চিন্তায় মাথার সব ক’টি চুল পড়ে গেল। তবু তোমরা… বলে বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে দিল। অনেক শিশু থাকে যারা দর্শনমাত্র মানুষের মন কাড়ে। অপু সেই ধরনের শিশু ছিল। কিন্তু বড় হয়ে ওর স্বভাবে একটা অসংযমের প্রবণতা আসে। আমার একটা অযৌক্তিক বিশ্বাস আছে যে, অনেক জমিদার পরিবারেই একটা সময়ে অবক্ষয়ের সব লক্ষণ দেখা দেয়। লোকে বলে রক্তে ঘুণ ধরা। বোধ হয় আমাদের রক্তে সেই প্রবাদোক্ত ঘুণ ধরেছিল। আমি যদি সত্যিই অকপটে আত্মকথা লিখতে পারতাম, তবে আপনাদের কাছে সেই ঘুণের নানা লক্ষণ প্রকট হত। কিন্তু অপুর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে এসব কথা আমার মনে হয়নি। শুধু মনে হচ্ছিল বরিশালে ওকে যখন কোলে করে নদীর পাড়ে নিয়ে যেতাম ও মাঝে মাঝেই বলত, ওরা যদি আমাকে বকে? কারা, কেন বকবে তার কোনও ব্যাখ্যা ছিল না। কিন্তু অনেক লোকের ন্যায্য-অন্যায্য তিরস্কার মাথায় নিয়ে অপু চলে গেল। আমি তখন ছ’ হাজার মাইল দূরে। এই বছরেরই জানুয়ারি মাসে বম্বেতে ওর ছোট মেয়ে পিয়ার বিয়ে হল। আমি কন্যা সম্প্রদান করলাম। বোধ হয় অপু বেঁচে থাকলেও বলত, ‘ছোড়দা, ও কাজটা তুমিই করো।’
অবসর নেওয়ার পর নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা বিষয়ে কিছু লিখব বলে আমি প্রতিশ্রুত—বিশেষত আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুমার মুখার্জির কাছে। তিনি ওগুলি লিখে রাখা প্রয়োজন মনে করেই বারবার এই রচনাটি লিখতে আমাকে প্ররোচনা দিয়েছেন। কিছু পয়সা জোগাড় করে টিকিট কাটলেই তো প্যাকেজ ট্যুরে ঘোরা যায়। এর মধ্যে মাহাত্ম্য কী আছে? তবু পরের মুখে ঝাল খেয়েও যারা ভ্রমণের স্বাদ কিছুটা পান, তাদের কিছু গল্প শোনাব। ধারাবাহিক বিবরণ নয়। যে ঘটনা বা দৃশ্যগুলি স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটেছে, তারই কিছু কিছু বর্ণনা করব। আমার নাতনি শ্রীমতী লীলার গল্প শোনার খিদে অন্তহীন। প্রাণ কণ্ঠাগত হলে তবেই ছাড়া পাই। তখন তিনি সহৃদয় কণ্ঠে হুকুম দেন, দাদু, ইউ ক্যান স্টপ নাউ। তাকে যেভাবে গল্প বলি প্রায় সেই আঙ্গিকেই পরবর্তী অংশটি লিখছি।
কেনিয়া গিয়েছিলাম অবসর নেওয়ার অল্প পরেই। উদ্দেশ্য মামুলি সাফারি। অর্থাৎ নিরাপদে গাড়ি চেপে সিংহ, হাতি, মোষ, জলহস্তী এসব দেখে বেড়ানো। প্রথম যে তরুণ সিংহত্ৰয় দেখলাম, তাদের ব্যবহারে তারা সিংহ, না বেড়াল, বলা কঠিন। বাস তাদের গা ঘেঁষে দাঁড়াল, একটু হর্নও বাজাল। একজন একটা চোখ মেলে দেখে পাশ ফিরে শুল। গাইড বললেন, যারা কিছুটা নিরাশ বোধ করছেন, তাঁদের একটা কথা নিবেদন করি। ওই যে দেখছেন এরা গভীর বৈরাগ্যে মগ্ন, একটু নেমে দাঁড়ান, দেখবেন চেহারা বদলে যাবে। তবে সেটা আমি হতে দেব না। কারণ আমাকে বলা আছে, আপনাদের সব ক’জনকেই নিয়ে হোটেলে ফিরতে হবে। আমার ডিউটি স্লিপে সিংহদের খাওয়ানোর কথা লেখা নেই।
ওই প্রজাতির সক্রিয় চেহারা দেখলাম অন্যত্র। কয়েকটি সিংহী মাতা। সঙ্গে পিলপিল করছে ছেলেপিলে। ঝোঁপ থেকে ঝোপান্তরে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। গাইড বললেন, আজ ওদের পেরেন্ট-টিচার মিটিং।
বিপদের মুখে পড়েছিলাম একদিনই। পাহাড়ের গায়ে একটি অনতিপ্রশস্ত রাস্তা। তার এক দিকে এক পাল বুনো মোষ। এঁদের সবাই একটু সম্ভ্রমের চোখে দেখেন। আর গাড়ির সামনেই একটি হাতির দল। দলটির নারীবাদী নেত্রী আমাদের দেখে খুব প্রসন্ন হননি মনে হল। তিনি শুড় উঁচু এবং বৃংহিত ধ্বনি করে আমাদের আক্রমণ করলেন। বুঝলাম–অন্তকাল সমাগত। কারণ আমাদের ভঙ্গুর জিপ ওঁর পদতলে অকালে ধুলো হয়ে যাবে এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। আর মহিষদের চোখের দৃষ্টিতেও সহৃদয়তার কোনও চিহ্ন ছিল না। কিন্তু যা ঘটল তাতে আমার সমস্ত সহানুভূতি হাতিটির দিকেই চলে গেল। ড্রাইভার গাড়ির ইঞ্জিনটি রেভ করে একটা বিশ্রী আওয়াজ করলেন। আর তা শুনে ওই বিরাট হস্তিনী লেজ গুটিয়ে পালাল। ওই বিরাট প্রাণীকে স্রেফ ধোঁকা দিয়ে তাড়ানো কেন যেন আমার চোখে বড় অপমানজনক বলে মনে হল। ভাবলাম আমার ধূর্ত প্রজাতি এইভাবেই পৃথিবীকে জয় করেছে। মানীর মান রাখার তোয়াক্কা করেনি। আর পৃথিবীতে যেসব ধূর্ত মানুষ সকলের উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, সেও তো একই উপায়ে।
কিন্তু সেই রাত্রে হাতিদের অন্য রূপ দেখে মোহিত হলাম। যে-ট্রি টপ হোটেল-এ থাকার সময় রানি এলিজাবেথ পিতৃবিয়োগ এবং নিজের রানি হওয়ার সংবাদ পান, ওই রাতটা আমরা সেখানে কাটাই। রাতে ফ্লাড লাইট দিয়ে নীচে হ্রদের পাড় আলোকিত। দলে দলে হাতি হ্রদের পাড়ের কাদায় নুনের সন্ধানে এসেছে। আর কী তাদের বক্রীড়া! মনে হল সহজাত ডিগনিটি ওদের বিশাল বিশাল দেহে মূর্তি গ্রহণ করেছে। বিশালতার রূপ আর একবার প্রত্যক্ষ করেছিলাম আলাস্কায়। সেখানেও টিকিট কেটেই নিশ্চিন্ত জলবিহারে গিয়েছিলাম ও অঞ্চলের আইসবার্গ আর তিমি মাছ দেখতে। অন্যতর স্মরণীয় দৃশ্য কাভিং। বিরাট বিরাট আইসবার্গ থেকে পর্বতপ্রমাণ সব বরফের চাঁই জলের মধ্যে ভেঙে পড়ে। আর টুকরো টুকরো ভাসমান বরফের উপর সিলরা নিশ্চিন্তে বসে থাকে। পাশে যে পর্বত ভেঙে পড়ছে, তাতে কুছ পরোয়া নেই। ভোর চারটেয় জাহাজে যে প্রকৃতি-বিশারদ ছিলেন তিনি আমাদের ডেকে তুলে দিলেন। দেখবে এসো। তিমিরা খেলা করছে। আঃ! সে কী খেলা। বিরাট দেহগুলি অ্যাক্রোব্যাটদের মতো জলের উপরে দশ-পনেরো ফুট ছুঁড়ে দিচ্ছে। একটি জুটি দেখলাম বারবারই লাফিয়ে উঠছে আর ডুবছে। ন্যাচারালিস্ট বললেন ওরা মা আর মেয়ে। এই খেলা কোনও প্রয়োজনে না। শুধুই প্রাণপ্রাচুর্য আর সব জীবজীবনের কেন্দ্রে যে আনন্দধারা তারই প্রকাশ। আরও বললেন–যারা তিমি শিকার করে, এই খেলার সময়টায়ই তাদের সুবর্ণ সুযোগ। নির্ভাবনায় খেলায় মত্ত বিরাট প্রাণীগুলির গায়ে হারপুন বিধে সমুদ্রের জল রক্তে লাল হয়ে যায়। শিকারিরা মনে মনে মুনাফার বহর হিসেব করে।
আলাস্কায় ভ্রমণের অন্যতর স্মরণীয় ঘটনা এক ভালুকের সঙ্গে মোলাকাত। শুনেছি হাতি মেরা সাথী’ নামক ছবির অসাধারণ সাফল্যের পর এক বোম্বাইয়া ডিরেক্টর এক ছবি করেছিলেন, যার নাম ভাল্প মেরা লালু। এই নামকরণ সম্পূর্ণ ভুল ধারণার ফল। হাতি যদি বা সাথী হয় ভাল্লুর লাল্লু হওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। সে অতি সাংঘাতিক প্রাণী, মোটেই হেলাফেলা করার জিনিস না। আলাস্কায় জলভ্রমণের সময় একদিন উপকূলে চড়ুইভাতি করা ঠিক হল। অ্যাডভেঞ্চার ফিল্ম দেখেছেন–পাথর ছড়ানো উপকূলে নায়ক-নায়িকা। কেমন অক্লেশে দিব্যি নাচতে নাচতে চলে যায়। মশাই, ও সব ক্যামেরার কারসাজি। তেমন তেমন পাথর ছড়ানো উপকূল তো দেখেননি! দেখলে নাচানাচির কথা মনেও আসত না। আলাস্কা আর গালাপাগোস দুই জায়গায়ই দেখেছি পথহীন পাথর ছড়ানো উপকূল মানুষের ঠ্যাং ভাঙার জন্য ঈশ্বরের সৃষ্টি। ভদ্রলোক স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন–এমুখো হোস না। তা সত্ত্বেও যদি চ্যাংড়ামি করো তো ঠ্যাং ভাঙবেই। আলাস্কার সমুদ্রতীরে নেমে বুঝলাম এখানে কোনও ভদ্রলোকের পক্ষে এক পাও এগোনো সম্ভব না। আমাদের বস্তুত কোলে করে নিয়ে যাওয়া হল। সবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি–দেখি সম্পূর্ণ অ-লাল্লু এক ভাল্লু বনবাদাড় থেকে বের হয়ে এসে বেশ উৎসাহের সঙ্গেই আমাদের দেখছে। সোজা তার মুখোমুখি হয়ে দু হাত মাথার উপর তুলে আস্তে আস্তে পশ্চাদপসরণ করবে, মুখে বলবে হ্যালো মিস্টার বেয়ার (কথাটা ইংরেজিতে বলতে হবে, ওরা বাংলা একেবারেই বোঝে না) ভাল্লুক সাক্ষাৎকারের এই নিয়মগুলি মনে মনে আওড়ালাম। কিন্তু বুঝলাম শিরে এখন সংক্রান্তি। আমাদের কপাল ভাল ছিল। আমাদের সুখাদ্য বা সুবধ্য মনে না হওয়ায় ভাল্লুক জঙ্গলে ফিরে গেলেন।
আমার স্ত্রী প্রকৃতিপ্রেমিক। নানা নচ্ছার পশুপাখি ওঁর কাছে প্রশ্রয় পেয়ে আমার জীবন দুর্বিষহ করে তোলে। কিছুদিন ধরে এক অতি বজ্জাত কাক ঘরের ভিতর ঢুকে আমাকে মুখ ভেঙাত। ভিতরের লোকের উস্কানি না থাকলে এসব বেয়াদবি সম্ভব না–সে কথা যে কেউ বুঝতে পারে। বছর পঁয়তাল্লিশ বিবাহিত জীবনের পর স্বামীর চেয়ে কাক মূল্যবান জীব মনে হওয়া কিছু বিচিত্র না। যাক গে, জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে ঝগড়াঝাটি বিষয়ে শাস্ত্রে নিষেধ আছে। তাই চুপ করে থাকি। উনি যখন ঠিক করলেন গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে যাবেন, কুমার বলল, ‘এবার তোমার সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছে।’ মাথা কার খারাপ হয়েছে, এ নিয়ে আলোচনায় লাভ নেই। গেলাম গালাপাগোস, ইকুয়াডোরের রাজধানী কিটো হয়ে।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে গোটা ত্রিশেক ভাসমান দ্বীপপুঞ্জের নাম গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ। তার বেশির ভাগই মনুষ্যবাস বর্জিত। আরে মানুষ থাকার মতো হলে তো থাকবে। ওগুলি অতি বর্বর জায়গা। থাকার মধ্যে সামুদ্রিক গোসাপ (তিন রঙা মোটা মোটা ল্যাগপেকে চেহারা, অতি বিশ্রী দেখতে), সমুদ্ৰসিংহ অর্থাৎ অত্যন্ত গোলমালপরায়ণ সিলমাছ, এক একটার গোটা পঞ্চাশেক বউ (সব কটা আইনসঙ্গত বিবাহ বলে মনে হয় না)-গাঁক গাক করে চেঁচিয়ে হারেম রক্ষায় ব্যস্ত, আর গোটা কয়েক জাম্বো সাইজের কচ্ছপ। অল্পস্বল্প মানুষ যেসব জায়গায় আছে, সেখানে গেলেই দেখবেন একটি সাদা দাড়িওয়ালা লোকের ছবি নৌকো চেপে গালাপাগোসে নামছে। ওটা নাকি ডারউইনের ছবি। আরে বাবা, ভদ্রলোক যখন ওদেশে গিয়েছিলেন ওঁর তখন বয়স চব্বিশ। অত বড় দাড়ি গজাবে কোত্থেকে? আর যদিবা গজায় তো সাদা হবে কোন দুঃখে? কাকে কে বোঝায়!
একটা দ্বীপে নৌকা ভিড়ল। দেখুন, এসব জিনিস টেলিভিশনে দেখাই ভাল। নৌকা থেকে পাড়ে নামতেই প্রাণান্ত। তারপর সেই উপলবিছানো উপকুল। আহা! উপল বলে উপল! প্রতি পদে আছাড় খেতে হয়। আছাড় খেতে খেতে প্রথম দেখলাম ব্লু ফুটেড বুবি। নামেই বুঝছেন প্রজাতিটি নিতান্ত নির্বোধ। পক্ষীপ্রজাতির মধ্যে বোকামিতে গোন্ড মেডালিস্ট। মানুষ দেখে ভয় পায় না। এই তার মাহাত্ম। আরে বলি, মাথায় কিছু থাকলে তো ভয় পাবে! একটা পাথরের উপর বসে দু’দণ্ড বিশ্রামের চেষ্টা করছি। চারপাশে গোসাপ আর সিল কিলবিল করছে। গাইড বলে দিয়েছে–কোনও জন্তুর গায়ে হাত না দিতে। বিশেষত সিল মাতারা গন্ধ শুকে বাচ্চাদের চেনে। মানুষ ছুঁয়ে দিলে গায়ে মানুষের গন্ধ হয়ে যায়। (প্রকৃতির ভদ্র প্রাণীদের ও গন্ধ সহ্য হয় না। তখন আর সেই হতভাগ্য সিল শাবককে কেউ ঘরে নেয় না। শুনে আমার স্ত্রী বেশ নিরাশ হলেন। বোধ হয় ওঁর প্ল্যান ছিল একটা সিলের বাচ্চা অক্সফোর্ড নিয়ে আসা। ইচ্ছেটা ওদের একজন আন্দাজ করে থপথপে পায়ে ওঁর কাছে এগিয়ে এল। বাচ্চাটা ওঁর কোলে ওঠার তালে ছিল। উনি খুব খুশি। কিন্তু সিলজননী চিন্তিত। গাঁকগাঁক করে তেড়ে এল। গাইড এসে দুটোকেই ভাগিয়ে না দিলে সেদিন একটা এসপার-ওসপার হয়ে যেত।
ওখানে প্রধান দ্রষ্টব্য মরালগ্রীব বিশাল মহাকচ্ছপ। তাদের একটি তার উপপ্রজাতির শেষ প্রতিভূ। মানুষের দেওয়া নাম লোনলি জর্জ। তার নিকটতম উপপ্রজাতি থেকে ক’টি সঙ্গিনী দেওয়া হয়েছিল। সে ফিরেও তাকায়নি। ওই কচ্ছপ দেবদাসের লাইনে শেষ কথা। দেখে ক্যাথারসিসে প্রাণ প্লাবিত হল। মানে ‘টেরর’ আর ‘পিটি’ কীসে আর এর বেশি হতে পারে? শুনলাম মহাকচ্ছপরা মূক। শুধু একসময় তাদের গর্জন দুর হতে শোনা যায়–মানে যখন তারা সঙ্গমস্থ হয়। একজন সহযাত্রী জিজ্ঞেস করলেন–এ ঘটনা মাসে বা বছরে ক’বার ঘটে। শুনলাম–মাত্র বছরে একবার। ভদ্রলোক বললেন–তা হলে তো একটু উল্লসিত হবেই! তা বলে অতটা আওয়াজ! একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না!
.
গালাপাগোস গিয়েছিলাম ইকুয়াডোর হয়ে। ফিরলাম কলাম্বিয়ার রাজধানী বোগোটার পথে। দক্ষিণ আমেরিকার স্পেনিস বিজেতারা এক স্বর্ণমণ্ডিত দেশ বা এল ডোরাডোর কাহিনি শুনেছিলেন। কারও কারও মতে কলাম্বিয়া এবং তার রাজধানীই এল ডোরাডো। এখানকার প্রাচীন সংস্কৃতিতে স্বর্ণের ব্যবহার অপরিমিত। কোনও কোনও বিশেষ উপলক্ষে এদের পবিত্র হ্রদে সোনার নানা অলংকার আর আয়ুধ নিক্ষেপ করা হত। সেইসব উদ্ধার করে এদের বিখ্যাত জাদুঘরে এখন রাখা হয়েছে। তার কিউরেটার আমাদের সেন্ট অ্যাস্টনিস কলেজের ছাত্রী। খুব যত্ন করে সব ঘুরে দেখালেন। একটি ঘরে আলো নেভানো ছিল। হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ওই ঘরে ত্রিশ হাজার স্বর্ণনির্মিত জিনিস রাখা ছিল।
প্রাণিজগতে যদি বিরাটত্বর রূপ দেখি কেনিয়ার হাতি আর আলাস্কার তিমি মাছে, তবে তার সম্পূর্ণ অন্য এক মনোমুগ্ধকর রূপ দেখেছিলাম গ্রিনল্যান্ডে। শৈশবে ভূগোলের বইয়ে অরোরা বেরিয়েলিসের ছবি দেখেছিলাম। সেই সময় থেকে ইচ্ছে হয়েছিল–কখনও প্রকৃতির ওই বিচিত্র লীলা নিজের চোখে দেখতে হবে। সেই সুযোগ জুটল বয়স যখন পঁচাত্তর ছুঁয়েছে। বার্লিনে অস্ট্রেলিয়ান এরিক ওয়ারেন্টের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল সেকথা আগেই লিখেছি। ও-ও দেখলাম ভবঘুরের মতো বেড়াতে ভালবাসে। আমরা মাঝে মাঝেই আলোচনা করতাম যে একবার অরোরা বেরিয়েলিস দেখতে যাব। এরিক থাকে সুইডেনে। ওখান থেকে স্বর্গীয় ওই লীলা দেখার সুযোগ কিছু বেশি। কারণ মনে রাখা ভাল আকাশ মেঘাবৃত থাকলে দেবতাদের এই খেলা মরণশীল জীবদের নয়নগোচর হয় না।
হঠাৎ এক ফেব্রুয়ারি মাসে আমাদের প্রত্যাশিত সুযোগ জুটে গেল। এরিক ফোনে জানালেন–কোপেনহেগেনের এক ট্র্যাভেল কোম্পানি সস্তায় ব্যবস্থা করেছেন গ্রিনল্যান্ড গিয়ে অরোরা বেরিয়েলিস দেখার। তবে একটু ঠান্ডার সময় ফেব্রুয়ারি মাসে, যখন ওখানকার তাপমান–৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড কিংবা তার চেয়ে কিছু নীচে। শরীরে অল্পস্বল্প গোলমাল আছে। আমার ইংরেজ ডাক্তারের পরামর্শ নিলাম। বললেন, যাও, তবে ফিরে আসবে এমন গ্যারান্টি দিতে পারি না। ঠিক আছে। না ফিরলে জানিয়ো। আমরা ভাল করে শোকসভা করব। কোপেনহেগেন থেকে প্লেনে পাঁচ ঘণ্টা উড়ে গ্রিনল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলে কাঙ্গারলুসা নামে এক অস্থানে পৌঁছলাম। সেখান থেকে কানাডার পূর্ব উপকূল আকাশপথে মাত্র দু ঘণ্টার পথ।
প্লেন নামলে দেখলাম সব কিছুই কঠিন বরফে ঢাকা। শরীরে ছ’ প্রস্থ জামা থাকা সত্ত্বেও মনে হল আমাদেরও কঠিন বরফে পরিণত হতে বেশি দেরি নেই। কিন্তু বিবেকবান ট্র্যাভেল কোম্পানি তাঁদের কর্তব্য করতে বদ্ধপরিকর। পৌঁছোনো মাত্র আমাদের ওখানকার প্রাণিসম্পদ দেখাতে নিয়ে গেলেন। এই শীতে প্রাণিসম্পদ? তারা কী খেয়ে বেঁচে থাকে? বরফ ছাড়া আর তো কিছু দেখছি না। আমাদের মতো তাদের খাদ্যও কি কোপেনহেগেন থেকে উড়োজাহাজে এসেছে? পথে দু-একটি খরগোশ আর শেয়াল জাতীয় প্রাণী চোখে পড়ল। গাত্রবর্ণ ওই বরফের মতই দেখলাম। বরফ কুঁড়ে দু-চারটে পত্রহীন আগাছার ডাল বের হয়ে আছে। একটু পরেই চোখে পড়লএকদল মাস্ক অক্স (মানে পুত্ৰকত্রাদি সহ) ওই শুকনো ডাল থেকেই পুষ্টি সংগ্রহের (সম্ভবত ব্যর্থ) প্রচেষ্টা করছেন। ছবি তোলার হিড়িক পড়ল। ওরা বেশ একটু দূরেই আছে। তাই বাস থেকে নেমেই ছবি তোলা হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর একটু কাছে যাওয়া যায়?’ নিস্পৃহ উত্তর, ‘তা যায়’। ‘তাড়া করবে না তো?’ ‘করতেও পারে।’ ‘করলে বাসে ফিরতে পারব তো?’ ‘পারতেও পারো।’ এই অস্তিত্ব এবং সন্দেহবাদী দার্শনিকের পরিবেশিত তথ্য বিচার করে কিংকর্তব্য নির্ধারণ করলাম। বাসেই ফিরে এলাম। নখিশঙ্গীদের থেকে কত হাত দূরে থাকবে এ বিষয়ে চাণক্যমুনির নির্দেশই প্রামাণ্য মনে হল।
হোটেলের ব্যাপারে আমাদের একটা চয়েস দেওয়া হয়–রিটস অথবা হিল্টন। বনেদিয়ানার সম্পর্কে আমার একটু দুর্বলতা আছে। তাই আমি রিটস-এ থাকাই ঠিক করলাম। যথাস্থানে পৌঁছে দেখি দুই খানদানি হোটেলে সত্যিতে কোনও প্রতিযোগিতা নেই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তৈরি প্রিফেব্রিকেটেড ব্যারাক। সেটাকে সারিয়ে-টারিয়ে বাসযোগ্য করা হয়েছে। রসিকতা করে ভারী ভারী নামকরণ করা হয়েছে। ভিতরে স্নানের ব্যবস্থাও আছে। তবে ঘড়ি ধরে দিনে তিন মিনিট। যা হোক, তবুও তো তিন রাত রিক্স-এ থাকলাম। অক্সফোর্ড ফিরে বন্ধুবান্ধবদের খবরটা দিলাম। দেখলাম—সবাই বেশ ঈর্ষান্বিত। হবেই তো। রিন্টু বলে কথা! মাস্টার-পণ্ডিতদের কপালে কি এসব জোটে?
পরপর দুই রাত অরোরা দেখার সুযোগ পেলাম। দেবতাদের সেই লীলা বর্ণনা করার জন্য যে কবিপ্রতিভা প্রয়োজন, বলা বাহুল্য, তা আমার নেই। নেহাতই আটপৌরে ভাষায় সেই অনির্বচনীয় দৃশ্য বর্ণনা করার চেষ্টা করছি। প্রথমে দেখলাম অন্ধকার আকাশের এক দিক জুড়ে স্বচ্ছ অথচ অত্যুজ্জ্বল একটি সবুজ আলোর পর্দা নেমে এল। সেই আকাশজোড়া পদা কখনও থরথর করে কাঁপছে, কখনও তাতে ঢেউয়ের পর ঢেউ উঠছে। হঠাৎ আকাশ জুড়ে নীল রঙের একটি বিশাল রামধনু ছড়িয়ে পড়ল। তার পাশেই আর একটু সবুজ রঙের বলয়। শুধু রামধনুর তুলনায় তাদের বিস্তার অনেক বেশি। অনেক রাত্রে দেখলাম নীল-সবুজ রামধনুরা কখন যেন বিদায় নিয়েছে। সবুজ সিল্কের পর্দাটিও আর দৃশ্যমান নেই। তার জায়গায় আকাশ জোড়া এক লাল রঙের বিশাল বলয়। মনে হল যেন সে মহাপ্রলয়ের সংকেত নিয়ে এসেছে।
গ্রিনল্যান্ডে সত্যিতেই একদিন মৃত্যুর স্পর্শ অনুভব করেছিলাম। আমাদের প্যাকেজ টুরের অঙ্গ হিসাবে একদিন চার ঘন্টা কুকুরে টানা স্লেজে করে বেড়াবার কথা। যদিও তখন সর্বাঙ্গ বহুস্তর জামাকাপড়ে মোড়া থাকবে, বিশেষ করে সর্বোপরি সিলের চামড়ার ওভারকোট এবং বুট জুতো আপাদমস্তক ঢেকে রাখবে, তবুও মুক্ত আকাশের নীচে–৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমান কতক্ষণ সহ্য হবে, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। আমার পত্নীর ভয়ডর কিছু কম। বুঝলাম তিনি যাবেনই। আমি পুরুষমানুষ, কোন মুখে লেজ গুটিয়ে বাড়িতে বসে থাকি? অতএব….
এক একটা স্লেজ এগারো বারোটা হাস্কি নামক লোমশ কুকুরে টানে। এদের বিশেষত্ব সারাক্ষণ এরা হাউ হাউ করে চেঁচাতে থাকে। কীসে এদের এত আক্ষেপ বোঝা মুশকিল। ওই অঞ্চলে দিন-রাত্রের তফাতটা শীতকালে খুব স্পষ্ট না। তবে দু-তিন ঘণ্টা সময় অন্ধকারটা একটু ফিকে হয়ে আসে। সেই আলো-আঁধারির মধ্যে আমরা স্লেজে চড়ে বসলাম। এই চক্ৰহীন যান কতকটা অপ্রশস্ত নৌকার মতো আর তার উপর ঠিক বসা না, আধশোয়া অবস্থায় থাকতে হয়। এক একটি স্লেজে দু’জন করে যাত্রী। চালক বেশির ভাগ সময়টা পাশে পাশে দৌড়তে থাকে। যাত্রার গোড়ায়ই মনে হল এই ঠান্ডা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারব না। আধ ঘন্টার মধ্যে হাত-পা সব হিম হয়ে এল। অতগুলো যে জামাকাপড় পরে আছি, তাতে কিছু তফাত বুঝলাম না। শুনেছি অতিরিক্ত ঠান্ডায় কাপড় বা পশমের তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা চলে যায়। এক ঘণ্টার মাথায় মনে হল শরীরের সব তাপ যেন জলের মতো হাত আর পায়ের আঙুলের ডগা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। হাসিকে বললাম–এ যাত্রা পার পাব বলে মনে হয় না। চালককে বলা হল ফিরে যেতে। ফেরার পথে সত্যিই ভাবলাম মৃত্যু খুব কাছে এসে গেছে। অন্তত শরীরের কোনও কোনও অংশ যে জমে যাওয়ার ফলে কেটে বাদ দিতে হবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না। এই সময় দেখলাম আকাশ আর একটু উজ্জ্বল হয়েছে। দূরের বরফে ঢাকা পাহাড়গুলি সেই বিবর্ণ আলোয় বড় মনোমোহন রূপ নিয়েছে। কিন্তু সেই মুহূর্তে চেতনায় কোনও সৌন্দর্যবোধ ছিল না। মনে হচ্ছিল যেন আর একটি কোনও প্রাণী সব কিছু দেখছে, উপলব্ধি করছে, আর মৃত্যুর কোলে শুয়ে আমি তার অনুভূতিগুলি বুঝতে পারছি। যা ঘটছে তার সঙ্গে আমার কোনও সম্বন্ধ নেই। একটা গভীর নির্লিপ্ততা, চেতনা সত্ত্বেও চেতনাহীনতা আমার সত্তাকে ঘিরে ছিল।
দু ঘণ্টার মাথায় স্লেজ চালকদের আড্ডায় পৌঁছে গেলাম। আগুনের তাপে কয়েক মিনিটের মধ্যে রক্ত চলাচল স্বাভাবিক হয়ে এল। বুঝলাম কোনও স্থায়ী ক্ষতি হয়নি। কোনও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বাদ দিতে হবে না। শুধু ভাবি–ওই এক ঘণ্টার যে অভিজ্ঞতা, সেই কি মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষের চেতনার স্বরূপ?
গ্রিনল্যান্ডে দেখা অরোরা বোরিয়েলিসের সঙ্গে তুলনা হয় এমন অন্য কোনও প্রাকৃতিক দৃশ্য আমি কল্পনা করতে পারি না। কিন্তু সৌন্দর্যচেতনা কতটা মানুষের জীবনে সামগ্রিক অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে–বোধটা কতটা বস্তুনির্ভর আর কতটা ব্যক্তিগত চেতনানির্ভর–তার একটি অসাধারণ উদাহরণ পাই এরিকের সঙ্গে নরওয়ে বেড়াবার সময়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নরওয়ের ফিওর্ড অঞ্চল অসামান্য। বরফ ঢাকা পাহাড়, পাইনের বন, অসংখ্য পাহাড়ে নদী, ঝরনা আর জলপ্রপাত, বিশাল বিশাল হ্রদ আর সমুদ্রের নানা রূপ প্রাণে এক ভাষাতীত তৃপ্তির স্বাদ বয়ে আনে। আমরা গাড়িতে ঘুরছিলাম। রাতে কোনও কাঠের তৈরি লগ ক্যাবিনে আশ্রয় নিতাম। শেষ যে লগ ক্যাবিনে ছিলাম, তার পরিবেশ সব দিক থেকেই অসামান্য। পাইনবনের মধ্যে পাহাড়ের গায়ে একটি বড়সড় নদীর পাড়ে তার অবস্থান। নদীটিকে জলপ্রপাত বললেই ঠিক হয়, কারণ সে গভীর গর্জন সহ ধাপে ধাপে নীচে নেমে সমতলের বিশাল হ্রদটিতে বিলীন হয়েছে। লগ ক্যাবিনের মালিকটিকে এরিক জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি বুঝতে পারো যে তুমি অনির্বচনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে বাস করো?’ লোকটি বলল, দ্যাখো, এখানেই আমার জন্মকর্ম। এখানেই সারাজীবন কাটিয়েছি। লোকে বলে খুব সুন্দর জায়গা। আমি তো তেমন কিছু দেখি না। শুনে মনে হল, নিজেও তো সৌন্দর্যে অসামান্য একটি শহরে বাস করি। রোজ পার্কের পাশ দিয়ে যাই, ব্রড স্ট্রিট হাই স্ট্রিটের মহিমান্বিত সৌধগুলি দেখি। কদিন চুপ করে বসে এই পরিবেশ আত্মস্থ করি, এই অতি সুন্দর শহরে বাস করার সৌভাগ্য বিষয়ে সচেতন হই? দৈনন্দিনতার চাপে অধিকাংশ মানুষের সৌন্দর্যচেতনা আর সজীব থাকে না।
এতক্ষণ ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে গিয়ে প্রকৃতি আর প্রাণিজগতের কথা লিখেছি। এবার একটু সভ্য মানুষের দুনিয়ায় ফিরে আসি। ইউরোপ দিয়ে শুরু করি। পশ্চিম ইউরোপ বারবারই যাওয়া হয়েছে। কিন্তু পূর্ব ইউরোপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় কিছু কম। এবার সেই অভাবটা পুরণের কিছু চেষ্টা করলাম। প্রথম যাই চেকোস্লোভাকিয়ার রাজধানী প্রাগ, স্থানীয় উচ্চারণে প্রাহা। অনেকের মতে এটি ইউরোপের সবচেয়ে সুন্দর শহর। মধ্যযুগ আর আধুনিক ইউরোপ এখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে। আর্ট ডেকোর রাজধানী প্রাগ। এখানেই কাফকা এক ব্যাঙ্কে কেরানির কাজ করতেন। উনি স্বর্ণকারদের গলিতে ছোট্ট বাড়িতে থাকতেন, সেটি দেখতে গিয়েছিলাম। রাস্তার সব বাড়িগুলিই রঙিন এবং রংগুলি বেশ উগ্র। তবে দেখতে ভালই লাগে। কিন্তু আকারে এত ছোট যে ওখানে বাস করা খুব সুখের বলে মনে হয় না। কাফকা তাঁর যাবতীয় রচনা ওঁর এক বন্ধুর হেফাজতে রেখে যান। নির্দেশ ছিল–পুড়িয়ে ফেলার। সে নির্দেশ না মানার ফলে মানুষের সভ্যতা লাভবান হয়েছে। শুধু ভাবি–সত্যিই কি কাফকা তাঁর বিরাট কীর্তি ধ্বংস করে ফেলতে চেয়েছিলেন? অত বড় প্রতিভাবান মানুষ কি তার মূল্য বুঝতে পারেননি? আর নিজের প্রজাতির প্রতি কোন অভিমানে তিনি সাফল্যের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দারিদ্র আর পরিচয়হীনতার জীবন কাটিয়ে গেলেন? কাফকা ছাড়া প্রাগ শহরের আর একটি স্মৃতিই আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। রাত্রে চার্লস নদীর উপরে সারিসারি সেতুর আলোকসজ্জা। এক যুগের রাজকীয় বিলাস অন্য যুগে ট্যুরিস্টদের আনন্দের খোরাক জোগাচ্ছে।
ইউরোপে সারা জীবন অনেক বেড়িয়েছি। সভ্যতা-সংস্কৃতি-প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনুপম এই মহাদেশ। দেখার শেষ নেই। বহু দর্শনেও মন ভরে না। মনে হয় আরও দেখি। এত দেখার মধ্যেও একটি দেখা যেন স্মৃতিতে সব কিছু থেকে স্বতন্ত্র হয়ে আছে। ২০০৪ সনে ওই এক প্যাকেজ ট্যুরেই রাশিয়া যাই। কিন্তু এবার ভ্রমণটা জলপথে। প্লেন দেরিতে ছাড়ায় মাঝরাতে মস্কো পৌঁছে সোজা গিয়ে জাহাজে উঠলাম। জার্মানিতে তৈরি আনকোরা জাহাজটির নাম এম. এস. লেনিন। রাশিয়ার ইতিহাস থেকে স্তালিনের নাম মুছে গেছে, কিন্তু লেনিন এখনও ওদের রাজনৈতিক তথা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মৃতিতে উজ্জ্বল। শহরের পথে পথে এখনও ওঁর মূর্তি বক্তৃতার ভঙ্গিতে মানুষকে প্রেরণা জোগাচ্ছে। একতন্ত্র রাষ্ট্রের নিষ্ঠুর ইতিহাসে ওঁর কোনও দায়িত্ব আছে–একথা রুশ রাষ্ট্রচেতনার অংশ বলে মনে হয় না।
রাশিয়ায় নদীপথে প্রমোদভ্রমণে এত কি ভাল লেগেছিল? এর সহজ উত্তর আমার জানা নেই। সমুদ্রে জাহাজে বেড়ানোর অভিজ্ঞতাটা অন্য ধরনের। অনেক মানুষ একটা বিরাট প্রাসাদের বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে, এ অভিজ্ঞতা কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক। আর এখানে ছোট পরিসরের ভিতর মনে হয় যেন কোনও সহৃদয় ধনীর ভবনে কদিনের জন্য আতিথ্য নিয়েছি। অনেক সেবক-সেবিকা আমাদের যত্ন-আত্তি করছে। আর আমরা মৃত্তিকার শিশুরা জননীর দেখা দিনের পর দিন না পেলে প্রাণ রীতিমতো হাঁপিয়ে ওঠে। এখানে তিনি তো সব সময়েই চোখের সামনে। হাত বাড়ালেই আচল ছোঁয়া যায়। আর রাশিয়ায় প্রকৃতিকে শুধু উদার বলে বর্ণনা করলে তার অসাধারণ রূপ কিছুই ব্যখ্যা করা হয় না। শিল্পায়ন সত্ত্বেও ওই বিরাট দেশ এখনও যেন কৃষি এবং পল্লীপ্রধান। অন্তত দেশের বেশ বড় একটা অংশ। জাহাজ থেকে দেখে এই ধারণাই হয়। মনে হয় যেন নাগরিক সভ্যতা অতি প্রশস্ত নদী, সমুদ্রোপম হ্রদ, খোলা মাঠ, উম্মুক্ত খেত, পাইন আর বার্চের বনে ঢাকা রুশ প্রকৃতিকে শুধু মাঝে মাঝে ছুঁয়ে গেছে, তার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করেনি। সাত দিন ধরে এই জলবিহারে সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছনোর আগে কোনও বড় শহর চোখে পড়েনি। রোজই প্রায় কোথাও না। কোথাও থামা হত। মধ্যযুগের রাজধানী বা পুরনো কাঠের তৈরি গির্জা, অথবা রাষ্ট্রের আওতায় ট্যুরিস্টদের দিকে এক চোখ রেখে কুটিরশিল্পের কেন্দ্র কোনওটাই বিরাট কিছু ব্যাপার না। মনে হত একদা দরিদ্র দেশের সব পুরাকীর্তিতেও দারিদ্রেরই ছাপ।
কিন্তু অন্য এক রাশিয়ার দেখা পেলাম সেন্ট পিটার্সবার্গ পৌঁছে। প্রায় ত্রিশ বছর আগে এই শহর দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তখন এসেছিলাম আলোচনাসভায়। ও বড় রদ্দি জিনিস। সারা দিন একটা বন্ধ ঘরের মধ্যে কেটে যায়। তারপর গড্ডলিকাপ্রবাহের মতো সকলের সঙ্গে ক্যাঁচরম্যাচর করতে করতে পুরাকীর্তি দেখা আর সান্ধ্য প্রমোদের আয়োজনে অংশগ্রহণ। এ জিনিস অনেক করেছি, কিন্তু ও থেকে খুব একটা আনন্দ পেয়েছি কখনও মনে পড়ে না। কিন্তু এবার বেড়াতেই এসেছি, তাই অনেক সময় নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওই অনুপম নগরী দেখার সুযোগ পেলাম।
শহরটি রাজকীয় স্বেচ্ছাতন্ত্রের দান। দেখুন, সভ্যতার সুপ্রভাত থেকেই মানুষ মানুষের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার করে চলেছে। কিন্তু সেই একই ভয়াবহ শোষণের ফল তাজমহলও হতে পারে আর দিল্লির হনুমান মন্দিরও হতে পারে। পিটার দা গ্রেটের তৈরি এই পশ্চিমি ধাঁচের মহানগর সত্যিতেই বড় সুন্দর। মনে হয় আর কোনও রাজধানী, এমনকী প্যারিসও তুলনায় হতমান। তার একটা কারণ এ শহর যদৃচ্ছ বেড়ে ওঠেনি। সম্রাট আদেশ দিলেন আর অভিজাত বোইয়ার সম্প্রদায় ভয়ে বা আনুগত্যে কম্পমান হয়ে তাঁরই নির্দেশমতো রাজধানীতে সব প্রাসাদ বানালেন। দুই নদীর মাঝখানের এই শহরে আমস্টার্ডম প্যারিসের প্রতিধ্বনি, কিন্তু তবু বিশিষ্টভাবেই রুশ। আহা, কী রূপ, কী রূপ! প্রাসাদগুলির মধ্যে সৌন্দর্য আর আভিজাত্যে শ্রেষ্ঠ জারের উইন্টার প্যালেস। ইউরোপের শ্রেষ্ঠ সব শিল্পকীর্তিতে ভরা। ইতালীয় রেনেসাঁসের চিত্রকলা থেকে শুরু করে জারের আমলের ফাব্ৰেজে বা সোনার কাজ করা পোর্সেলিনের সব খেলনা আর দৈনন্দিন ব্যবহারের জিনিস, উনিশ শতকের শেষ আর বিশ শতকের গোড়ায় প্যারিসের বাজারে কেনা ইমপ্রেশনিস্টদের আঁকা সব ছবি আর প্রথম যুগের পিকাসো—সবই এই প্রাসাদে সাজানো রয়েছে। প্রাসাদের ঘরগুলি অ্যাম্বার আর সোনার কাজে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অ্যালাস্টারের অতি সুদৃশ্য সব থাম অনেক উঁচু নানা অলঙ্কারখচিত সিলিং ধরে রেখেছে। জারতন্ত্রের অন্ত্যকাল যখন ঘনিয়ে এসেছে, তখন গৃহসজ্জায় একটু আধুনিকতার ছাপ। সোনার ব্যবহার কিছু কম, তার জায়গায় বিলিতি ধরনে পোর্সেলিনের ব্যবহার। কিন্তু এই নতুন রুচিবোধ পূর্ণ বিকাশের আগেই জারতন্ত্রের অবসান হল।
এ যাত্রায় আগে দেখিনি এরকম একটি প্রাসাদ এবার দেখার সুযোগ পেলাম। জার্মান কন্যা ক্যাথারিন দা গ্রেট সেন্ট পিটার্সবার্গের নিরবিচ্ছিন্ন হট্টগোলে হাঁপিয়ে উঠতেন। তাই বিশ মাইল দূরে ছায়াঘন এক পল্লীতে উনি একখানি বাসা বা নীড় তৈরি করান। নেহাতই ছোট, মাত্র একশো ঘরের একটি কুটির যাতে মহারানির কষ্টেসৃষ্টে চলে যেত। কিন্তু কুটিরটি রূপে অনবদ্য। নীল রঙের এত মনোহারিণী ব্যবহার আমি আর কোথাও দেখিনি। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রেই জানে–সম্রাজ্ঞীর লিবিডো কিছু প্রবল ছিল। শেষজীবনে বয়স যখন সত্তরের ঘরে, তখন উনি এক প্রেমিক জুটিয়েছিলেন। তার বয়স কুড়ি। ওঁর প্রিয় কুটিরটির পাশেই তার জন্যও এক বাসস্থান তৈরি হয়। যাতায়াতের সুবিধের জন্য একটি সাঁকো দুটি প্রাসাদের মধ্যে যোগসূত্রের কাজ করত। ভারী তৃপ্তিকর ব্যবস্থা।
এবার ইউরোপ ছেড়ে এশিয়ায় ভ্রমণের কথা কিছু বলি। এ প্রসঙ্গে তিনটি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে লিখব। তার প্রথমটি হল কাম্বোডিয়া, সংস্কৃত ভাষায় যার নাম ছিল কাম্বোজ। এক সময়ে আমাদের স্বাজাত্যভিমান যখন তুঙ্গে, তখন বৃহত্তর ভারত বলে একটা কথা চালু ছিল। কাম্বোডিয়া সেই বৃহত্তর ভারত-এর একটি দেশ। এই বর্ণনা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। তার প্রধান কারণ এই বর্ণনা শুনলে ওসব দেশের লোক অত্যন্ত বিরক্ত হয়। আমাদের বড় বড় শহর ঘুরে ছেলেছোঁকরাদের চিচি ইংরেজি শুনে আর পশ্চিমি নাচানাচি দেখে কেউ যদি সিদ্ধান্তে পৌঁছয় যে ভারতবর্ষ বৃহত্তর ইংল্যান্ড বা বৃহত্তর আমেরিকার অংশ, তা হলে আমাদের যেমন লাগবে বৃহত্তর ভারত শুনলে ওদেরও ঠিক তেমনই লাগে। আর বর্ণনাটা ভুলও বটে। ফরাসি পণ্ডিত সেডেস এই দেশগুলিকে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার হিন্দুত্বায়িত (ইংরেজিতে হিন্দুআইজড) রাষ্ট্র বলে বর্ণনা করেছেন। ওঁর বক্তব্য স্থানীয় সংস্কৃতির শিকড় সমাজজীবনের গভীরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু তার উপরে ভারতীয় সভ্যতার একটা প্রলেপ পড়ে। কিন্তু কাম্বোডিয়া কাম্বোডিয়াই থাকে, এবং তার সংস্কৃতির কেন্দ্রে রয়েছে স্থানীয় সভ্যতা। ওখানকার পুরাকীর্তি দেখতে গিয়েছিলাম আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দীপক (ওরফে হপন) মজুমদার এবং তাঁর স্ত্রী স্কটল্যান্ডনন্দিনী পলিন-এর সঙ্গে। তিন দিন পইপই করে ঘুরে প্রাচীন শহর সিয়েম রিপের আওতার মধ্যে যত পুরাকীর্তি পড়ে তার সবই দেখেছিলাম। তার মধ্যে তিনটি প্রধান দ্রষ্টব্যর কথা মনে আছে। গোগ্রাসে গিললে যেমন হজম হয় না, তিন দিনে দশ বারোটা অচেনা পুরাকীর্তি দেখলেও তেমনই সবকটার কথা মনে থাকে না।
পুরাকীর্তি হিসেবে আঙ্কোর ওয়াটের তুলনা নেই। তার একটা কারণ মন্দিরটির আয়তন। এতটা জায়গা জুড়ে ধর্মীয় স্থাপত্য পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। কীর্তিটি দীর্ঘদিন জঙ্গল আর ঝোঁপঝাড়ে ঢাকা পড়েছিল। ফরাসি শাসকদের কল্যাণে তার সুপ্তোদ্ধার হয়। কিন্তু ওয়াট বা মন্দিরটির হিন্দু ঐতিহ্য সবাই প্রায় বিস্মৃত হয়েছিল। নবম শতকের গোড়ায় এই মন্দিরনগরের পত্তন হয় আর কয়েক শতাব্দী ধরে নির্মাণের কাজ চলতে থাকে। দীর্ঘদিন যুদ্ধবিগ্রহের পর ওদেশে শান্তি ফিরে এসেছে। আর সেই সঙ্গে আমাদের মতো টুরিস্টের ভিড়। আমাদের সৌভাগ্য–যখন গিয়েছিলাম তখনও ভিড়টা জমেনি। প্রায় সব পুরাকীর্তিগুলিই আমরা বেশ নিরিবিলিতেই দেখতে পেরেছিলাম। কোথাও আর কোনও ট্যুরিস্টের সাক্ষাৎ পাইনি।
আঙ্কোর ওয়াটের মন্দিরগাত্রে হিন্দু দেবদেবী পুরাণকথা ইত্যাদি নানা বিষয়ের রিলিফে ছবি আছে। মন্দিরটি স্তরে স্তরে উঁচুতে উঠে গেছে। তৃতীয় স্তরে সমস্ত মহাভারতের কাহিনির রিলিফচিত্র। বহু যুদ্ধবিগ্রহের সঙ্গে পরিচিত কাম্বোজ শিল্পীর ছেনিতে সংঘাতের ছবিগুলি প্রায় জীবন্ত মনে হয়। অথচ বর্ণাঢ্য সান্ধ্য আকাশের নীচে পরিখার জলে যখন আঙ্কোর ওয়াটের প্রতিফলন দেখা যায়, মনে হয় মন্দিরটি যেন বিশ্বময় গভীর শান্তির মূর্তি। শান্তির সঙ্গে খেমের সভ্যতার পরিচয় সীমিত। সর্বত্রই ওদের পুরাকীর্তির গায়ে নানা আয়ুধ হাতে নরহত্যারই ছবি। যুগ যুগ ধরে মানুষের চোখে নরহত্যাটা অতি সম্মানজনক কাজ মনে হয়েছে বিশেষ করে যদি কীর্তিটা রাজারাজড়ার হয়। এক সময় খেমের রাজ্যের রাজধানী ছিল আঙ্কোর থোম। তার ভগ্নস্তৃপের প্রবেশপথে দেবাসুরের সমুদ্রমন্থনের দৃশ্য বড় বড় মূর্তি দিয়ে দেখানো হয়েছে। কিন্তু বহু পরিশ্রমে, সম্ভবত বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে, পুরাকীর্তি অপহরণকারীরা মাথাগুলি বেশ পালিশ করে কেটে নিয়েছে। ওই বিরাট এক টনি মুন্ডু কে কিনে কোথায় রেখেছে, সে সংবাদ কেউ রাখে না।
টুরিস্ট কৃত্যর এই বিবরণী আর বাড়াব না। একটি দৃশ্য বর্ণনা করে বিষয়ান্তরে যাব। একটি মন্দির যখন বেশ তারিয়ে তারিয়ে দেখছি, হঠাৎ কোথা থেকে পাখা হাতে কিছু সেবিকার আবির্ভাব হল। দিনটা গরম ছিল। তবু এই সেবাটি আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। ভাবলাম এটা একটি অব্যর্থ টুরিস্ট ফাঁদ। ওদের সেবা নিলে একেবারে পথে বসিয়ে দেবে। দেখলাম–ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের চাকুরে দীপক মজুমদার স্বভাবতই এসব বিষয়ে চিন্তা না করে সেবিকাদের পাখার হাওয়া খেতে লাগলেন। আধ ঘণ্টা এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে এসে দেখি শ্ৰীযুক্ত মজুমদার একটা ভাঙা পাথরের থামের উপর বসে বুদ্ধ অমিতাভর মতো নিমীলিত নেত্রে সেবিকাদের সেবা গ্রহণ করছেন। একটু গলাখাঁকারি দিতে বোধিসত্ত্ব নয়ন উন্মীলন করলেন। বললাম, কী ভাবছেন? উত্তর, ভাবছি এদের ওয়াশিংটন নিয়ে যাব। সম্ভবত পলিন আপত্তি করায় এই শুভেচ্ছা ফলবতী হয়নি।
শত্রুর শত্রু তো বন্ধু। সেই সুবাদে পৃথিবীর নৃশংসতম গণহত্যাকারীদের একজন, পল পট আমেরিকার বন্ধু হন। কারণ যে ভিয়েতনামের লাথি আমেরিকাকে নীরবে হজম করতে হয়, সেই ভিয়েতনাম পল পট অধ্যুষিত কাম্বোডিয়া আক্রমণ করেছিল। অতএব পল পটের সাত খুন মাফ। পল পট কাম্বোডিয়ার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি প্রায় নির্মূল করেছিলেন। এদিকে ওদিকে নরকরোটির ছোট বড় স্তম্ভ সেই নিদারুণ কালের স্মৃতি বহন করছে। আমাদের গাইডটি একটি ছোট স্তম্ভ দেখালেন। তার চূড়ায় কিছু মাথার খুলি। বললেন–ওর একটি ওঁর বাবার। ওঁর মাকে পল পট খুন করেনি। তিনি না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মারা যান।
আর দুটি দেশে ভ্রমণের কাহিনি সংক্ষেপে বলে এই নেহাতই অকিঞ্চিৎকর জীবনকাহিনি শেষ করব। তার প্রথমটি চিন। এই বিরাট দেশে পনেরো দিন ভ্রমণের কথাও সবিস্তারে লিখতে গেলে বেশ মাঝারি সাইজের একটি গ্রন্থ রচনা করতে হয়। চিন্তিত হবেন না। সেরকম কোনও সদিচ্ছা আমার নেই। কয়েকটি স্ন্যাপ শট মারফত আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে প্রসঙ্গান্তরে যাব। বেইজিং এখন পৃথিবীর ট্যুরিস্ট বলয়ের মধ্যে এসে গেছে। সুতরাং তিয়ানানমেন স্কোয়ার, চিনের প্রাচীর, সম্রাটদের গ্রীষ্ম কাটাবার প্রাসাদ ইত্যাদির বিবরণী দিয়ে আপনাদের দ্বিপ্রহরিক নিদ্রায় সাহায্য করব না। সত্যি কথা বলতে ওগুলো দেখে একটু নিরাশই হয়েছিলাম। ভারতবর্ষে পুরাকীর্তি মানেই বালুপাথর, গ্রানিট বা শ্বেতপাথরের প্রাসাদ, মন্দির, মসজিদ, মুর্তি ইত্যাদি বোঝায়। চিনের পুরাকীর্তিতে পাথরের ব্যবহার কম, কাঠের ব্যবহার কিছু বেশি। কাঠের তৈরি প্রাসাদ ঠিক অতটা অভিভূত করে না। অবশ্যি অভিভূত হওয়াই যদি দেশ ভ্রমণের উদ্দেশ্য হয়, তবে চিনের সুদীর্ঘ প্রাচীর তো একাই একশো। কিন্তু সুরক্ষাব্যবস্থা চমকে দিতে পারলেও তার নন্দনশক্তি কম। আমাকে অবাক করেছিল চিনের স্বতন্ত্র এক রূপ। আকাশপথে উরুমকি গিয়ে সেখান থেকে ট্রেন আর বাসে দীর্ঘ পথ পার হয়ে দুং হুয়াং-এর সহস্র বুদ্ধমূর্তি শোভিত গুহাচিত্র দেখতে গিয়েছিলাম। উরুমকিতে একটি অভিজ্ঞতা হল যার কথা চিনের শত্রু-মিত্র কারও লেখায় পাইনি। আমাদের সুন্দরী গাউড একটু সাবধান করে দিয়ে বললেন–রাত্রে যেন কোনওক্রমেই দরজা না খুলি। ওই অঞ্চলের মেয়েদের সৌন্দর্যখ্যাতি মহাচিন তথা সারা পৃথিবীর বদমাসদের চুম্বকের মতো টেনে আনে। এখন আমরা সবাই শিখে গেছি যে মনুষ্যসভ্যতার শেষ কথা বাজারের সার্বভৌম রাজত্ব। সুতরাং চাহিদা থাকলে তা মেটাবার ব্যবস্থাও তো থাকবেই। সেই পথেই তো মানবজাতির মঙ্গল। তাই উরুমকির হোটেলে রাত্রে খদ্দের এবং চাহিদা মেটানেওয়ালিদের অথবা তাদের মালিকদের মোলাকাত হয়। ঘরে যাতে অবাঞ্চিত ফোন না আসে, গাইড তার ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু যারা ভিতরে ঢুকে পড়ে তাদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় দরজায় খিল দেওয়া। একটু রাত হলেই দরজায় ধাক্কা পড়তে লাগল। মনে হল ভেঙেই ফেলবে। কোনও মতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। ঘুমের প্রশ্নই উঠল না।
উরুমকি থেকে দুং হুয়াং-এর পথ দুই বিশাল মরুভূমি পার হয়ে। তার প্রথমটি গোবি। আমার ভুল ধারণা ছিল যে গোবি একটি বিশেষ মরুভূমির নাম। আসলে তা নয়। বালুকাহীন শুধু পাথরের অন্তহীন বিস্তারের নাম গোবি। নিষ্করুণ রুক্ষতায় এর সঙ্গে কেউ পাল্লা দিতে পারে না। মরুভূমি আমার ভাল লাগে। মনে হয় বিশ্বপ্রকৃতির সত্য রূপটা এখানে ধরা পড়েছে। প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’র মিসেস মুর তাঁর নিষ্করুণ সত্যদর্শনের মুহূর্তে মনে মনে বলেছিলেন, ‘দা চেন অফ ইটার্নিটি ইস মেড অফ ম্যাগটস৷’ নিশ্চিত ধ্বংসমুখিন এই ব্রহ্মাণ্ডে কোথাও কোনও সান্ত্বনা নেই। দূর থেকে যে গ্রহ-তারা সুদৃশ্য কাব্যময় মনে হয় আসলে তারা সব ভয়াবহ অগ্নিকুণ্ড, নয়তো অসহ্য ঠান্ডা পাথরের চাঁই। আরও কোনও শ্যামল মাটির বসুন্ধরা কি আছে? জানি না। থাকলেও তা আমাদের নাগালের বাইরে। ওই করুণাহীন শ্যামলতাবর্জিত বিস্তার ব্রহ্মাণ্ডেরই প্রতীক। গোবি আমাকে আর একবার সে কথা স্মরণ করিয়ে দিল। গোবির পর টাকলামাকান। এই মরুভূমি আমাদের পরিচিত বালুকাবিস্তার। সব মরুভূমিই চেহারায় স্বতন্ত্র। তবু টাকামাকান আমাকে অস্ট্রেলিয়ার কথা স্মরণ করাল।
টাকলামাকানের পথে আমরা একটি নবম শতকের বৌদ্ধ গ্রামের ধ্বংসাবশেষ দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়িগুলির ছাদ ভেঙে পড়েছে। কিন্তু দেওয়াল দাঁড়িয়েই আছে। এখানে গ্রামীণ চিনের দারিদ্র্য বড় বেশি প্রকট। কিছু বালখিল্য গোরুর গলার ঘণ্টা হাতে আমাদের পিছু নিল। তাদের বক্তব্য ওয়ান ডালার, ওয়ান ডালার অর্থাৎ ওই অমূল্য বস্তু ওরা মাত্র এক ডলারের বিনিময়ে আমাদের দিতে রাজি। গাইড ওদের বকাবকি শুরু করলেন। একটি ছোট মেয়েকে ধরে বোঝাতে লাগলেন–ইস্কুলে না গিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন? সরকার তোমাদের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছে। তোমরা তার সুযোগ নাও না। এর পর তোমার কী হবে? শেষমেশ কোনও চাষাকে বিয়ে করে বাকি জীবন চাষাই থেকে যাবে। মেয়েটার ললাটলিপি সম্ভবত তাই।
দুং হুয়াং চিনা তুর্কিস্তানের অন্তর্গত। মধ্য এশিয়ার এক বিরাট অংশ এক সময় বৌদ্ধসংস্কৃতির আওতায় এসেছিল। দুং হুয়াং সেই সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানেরই অন্যতম ফল। ওইখানে গুহাগাত্রে বুদ্ধের ছবি আর মূর্তি হাজার নয়, বোধ হয় সংখ্যায় দশ হাজার বললে ঠিক হবে। এ বিষয়ে আমি বিশেষজ্ঞ নই। কিন্তু আমার চোখে অন্তত সব ছবি বা মূর্তি এক শৈলীর বলে মনে হয়নি। কিছু কিছু অত্যন্ত চোখধাঁধানো রঙে আঁকা বা রাঙানো মনে হল। প্রকৃতির অনুকরণ থেকে যখন প্রতিকৃতিগুলি সরে গেছে, তখন সেই ব্যতিক্রম মানুষের অবয়বে না, পারিপার্শ্বিকের চিত্রণে। মানুষ বা দেবতা স্বাভাবিক চেহারারই অনুগামী। প্রকৃতির অনুকরণ কয়েকটি আঁচড়ে তার দ্যোতনার ব্যাপারে চিনা শিল্পীরা সিদ্ধহস্ত। কিন্তু ভারতীয় মূর্তি বা চিত্রশিল্পে যে ধ্যানী বুদ্ধের করুণাময় বা অতীন্দ্রিয় অভিব্যক্তির ছবি পাই চিনা শিল্পীর কাজে তার তুলনা আমি পাইনি। একটা অতিসাধারণীকরণ করে বোধ হয় বলা চলে, চিনা সভ্যতার প্রবণতা ইহমুখী। ভারতবর্ষে এর বাইরে হয়তো আরও কিছু আছে, সেই অনিশ্চিত অস্তিত্বের সন্ধানে যেন মগ্ন। কথাটা অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করীর নিদর্শন হতে পারে। কিন্তু আমার সীমিত অভিজ্ঞতায় যা মনে হয়েছে তাই বললাম।
যে শহরটিতে আমরা ঘাঁটি করেছিলাম, সে শহরে চিনার চেয়ে তুর্কিস্থানিই বেশি। চিনে আট রকমের রান্না আছে। এই অঞ্চলের রান্না তার একটি। এর সঙ্গে চিনার চেয়ে মধ্য এশীয়, তুর্কি রান্নারই মিল বেশি। এদের একটি প্রিয় খাদ্য উটের খুর। ওটা না খেলে জীবন বিফলে গেল মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং খেলেই বোধ হয় ভবিষ্যৎ কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে যায়।
দুং হুয়াং দেখে আকাশপথে চিনের প্রাচীন রাজধানী সিয়ানে ফিরে যাই। এইখানে সেই বিখ্যাত পোড়ামাটির তৈরি সৈন্যবাহিনী দেখলাম। জানতাম না যে এ মূর্তিগুলি প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। সেই ভাঙা অবস্থায় কিছু মূর্তি এখনও আছে। তা থেকে যে মূর্তিগুলি কীভাবে উদ্ধার হয়েছে সে কথা চিন্তা করলে চিনে হুনুরির কাছে স্বতঃই মাথা নত হয়ে আসে। প্রতিটি মূর্তির মুখের অভিব্যক্তি স্বতন্ত্র। বিভিন্ন স্তরের সেনাপতিদের পোশাক আর অস্ত্রশস্ত্র আলাদা। কিছু কিছু সৈন্য বহের আকারে সাজানো। সব মিলিয়ে এক অবিশ্বাস্য জিনিস। এ তৈরি করতে কত দিন লেগেছিল জানা নেই।
সিয়ান হুয়েন সাং বা ইউয়ান চোয়াংয়ের শহর। ওখানকার লিটল ডাক মনাস্টারিতে উনি ওঁর সন্ন্যাসজীবনের অনেকটা কাটিয়েছেন। ওখানকার শান্ত নির্লিপ্ত আবহাওয়ায় অতীন্দ্রিয়র অনুরণন। তার কেন্দ্রে নীরবতা। চিনেরা জাপানিরা নানাভাবে নীরবতার সাধনা করেছে। আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনেও কি একই আকুতি? তবে আমরা ব্যবহারিক জীবনে এত চেঁচামেচি করি কেন? পূজায় পেটো না ফাটালে ব্যাপারটা কেন অসম্পূর্ণ মনে হয়?
ইংল্যান্ড ফেরার পথে আবার বেইজিং এলাম। যাওয়ার পথে যে ভোজ শুরু হয়েছিল, এবার তা চরমে উঠল। প্রতিদিন প্রতিবারের আহার এক একটি নতুন রেস্তোরাঁয়। শেষ বিদায়ী ভোজ বিখ্যাত পিকিং ডাক খেয়ে। সে হাঁস স্বর্গীয় কোনও প্রাণী না চিনা পাঁচকের স্পর্শে দেবত্ব লাভ করেছে সে বিষয়ে এখনও নিঃসন্দেহ হতে পারিনি।
চিন ছাড়বার আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ওদের পুরনো গরিব পাড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। যে প্রৌঢ় দম্পতির বাড়িতে আমরা গেলাম, তাঁরা দুজনেই অবসরপ্রাপ্ত প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। একটি ঘরে তাঁদের বাস। কিন্তু তারই মধ্যে টেলিভিশন আর রেফ্রিজারেটার আছে। ঘরটি পরিষ্কার। ওঁরা ওই ছোট পরিসরের ঘরটিতে থেকে অখুশি মনে হল না। কিন্তু শহরের এই এক জায়গায় দেখলাম রাস্তার নোংরা ঢাকবার কোনও চেষ্টা হয়নি। তবে কলকাতার রাস্তার কাছে নোংরার ব্যাপারে ওই গরিব পাড়া নিতান্তই শিশু।
এবার আর একটি দেশে ভ্রমণের কথা বললেই আমার কথাটি ফুরাল। সে দেশটি ইরান। ইরান—কৈশোরে অনেক রোমান্টিক স্বপ্নের দেশ ইরান। ইস্পাহান, সিরাজ নানা গল্পকথা, কাব্যের মদির আবেশে পূর্ণ। হাফিজ, রুমি, ফিরদৌসি আর ভুল করে কবি অঙ্কশাস্ত্রী ওমর খাইয়াম-এর দেশ। শুনেছিলাম মাথায় চুল ঢাকা কাপড়, হাত ঢাকা জামা না পরলে মোল্লাতন্ত্রের হাতে কোতল হতে হয়। কিন্তু সত্যিতে দেখলাম এসব ব্যাপারে মোল্লাশাহি একটু নরম হয়েছে। এমনকী এক রেস্তোরাঁয় এক বরযাত্রীর দল নাচবারই আয়োজন করছিল–যদিও ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। শিক্ষিত সাধারণের ব্যবহার জড়তাহীন, রীতিমতো খোলামেলা, আমাদের গাইড মোল্লাদের দেখিয়ে বললেন, ওই যে দেখছ ওদের জামার পকেট, ওর বিস্তার পা পর্যন্ত। আরও বললেন, ‘ওদের কেউ নির্বাচিত করেনি, ওরা হঠাৎ রাজা। আর ওদের সরাবার কোনও পথ নেই।’ কথাটা অবশ্যি এখন আর সত্যি না। ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট চরম প্রতিক্রিয়াশীল দলের লোক। গণভোটে জয়ী হয়েই তিনি রাজ্যপাট পেয়েছেন।
ইরানের কথা ভাবলে প্রথমেই মনে পড়ে সুন্দর একটি সকাল। ফার্সি কাব্য বুলবুল কুজনে মুখর। হোটেলের বাইরে অসংখ্য বুলবুলের ডাক শুনে বুঝলাম তার কারণ কাব্যিক রোমান্টিকতা না, আটপৌরে সত্য। ওদেশে সত্যিই বুলবুল সংখ্যায় খুব বেশি, প্রায় আমাদের চড়াইয়ের মতো বললে সামান্যই অত্যুক্তি হবে। কয়েক শতাব্দী আগে যখন বাড়িঘর সংখ্যায় কম আর গাছপালা বেশি ছিল, তখন বুলবুলের প্রতাপও আরও বেশি থাকার কথা।
তেহরান আর পাঁচটা তৃতীয় জগতের রাজধানীর মতোই। ওখানকার একটা জিনিসই স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে। ইরান সম্রাটের রত্নসম্ভার এক ব্যাঙ্কে রাখা আছে। পরিমাণে টাওয়ার অফ লন্ডনে রাখা ইংরেজ রাজবংশের রত্নসংগ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। ইস্তাম্বুলে ঢৌপকাপি প্রাসাদের রত্নসম্ভারের চেয়ে কম। কিন্তু এর অনেকাংশই উনিশ শতকে সম্রাটের জহুরিদের হাতের কাজ। তার সৌন্দর্য চোখধাঁধানো। ময়ূর সিংহাসনের অনুকরণে তৈরি একটি সিংহাসনও দেখলাম–হীরামুক্তামাণিক্যের ঘটা। কিন্তু ওর উপর বসা কি খুব সুখের ব্যাপার? রাজকীয় পশ্চাত তো রত্নখচিত হয়ে যাবার কথা।
ট্রেন না, গাড়িতেই আমরা তেহরান থেকে আয়াতোল্লা খোমাইনির ডেরা কোম শহর হয়ে ইস্পাহান যাই। এখানে বিখ্যাত পোলো খেলার মাঠের চারপাশেই রাজকীয় সব প্রাসাদ আর একটি ক্ষুদ্র রত্নের মতো মসজিদ। আমাদের মোগল সম্রাটদের ঐতিহ্যগৌরব প্রকাশ পেয়েছে লাল-সাদা পাথরে, ইরানে ইটের উপর টাইলের কাজই বেশি। একই ধরনের স্থাপত্য সমরকন্দ-বোখারায়ও চোখে পড়ে। মোগল স্থাপত্যে সৌন্দর্যের সঙ্গে আয়তনগত গরিমার উপরও জোর দেওয়া হয়েছে, এখানে প্রাসাদগুলির বিরাটত্ব নিয়ে অত কেউ মাথা ঘামায়নি। বোধ হয় মোগল সাম্রাজ্যের তুলনায় ইরানের শা’র অর্থ-সামর্থ্য কিছু কম ছিল। তাই বিলাসের অভাব না থাকলেও তা ঠিক মোগলাই স্তরে পৌঁছয়নি। মনে রাখা ভাল তাজমহলের স্থপতিও ইরানের লোক। কিন্তু ইরানে কোনও তাজমহল নেই। মোগল স্থাপত্যকীর্তিগুলি সব সময়ই যেন রাজকীয় মহিমা গম্ভীর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে অয়ম অহং ভো! ইরানে সুর একটু চাপা। স্থাপত্যের অন্যতর মহিমা অসংখ্য দেওয়ালচিত্রে–পার্সিয়ান অঙ্কনশৈলীর অসাধারণ সব নিদর্শন ইস্পাহানের প্রাসাদগাত্রে। মোগল প্রাসাদেও ইরান-প্রভাবিত অঙ্কনশৈলীর বহু নিদর্শন ছিল। এক লাহোর ছাড়া বেশির ভাগ প্রাসাদেই সেইসব দেওয়ালচিত্র লুপ্ত হয়ে গেছে। রাজপুত রাজপ্রাসাদ আর ধনীর হাভেলিতে এই ঐতিহ্যের কিছু নিদর্শন রয়ে গেছে। সে সবই ইন্দো-পারসিক সংস্কৃতি সম্মিলনের ফল। ইরানে বিশুদ্ধ পারসিক শৈলীর নিদর্শন। হুমায়ুন বাদশা ইরান থেকে শিল্পী এনেই মুঘল অঙ্কনশৈলীর প্রতিষ্ঠা করেন–ইরানি আর রাজপুত চিত্রকরদের পাশাপাশি বসে কাজ করিয়ে।
ইস্পাহান থেকে শিরাজ। ছোট শহর। এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হাফিজের কবর। তার পাশেই সুন্দর একটি বাগান। চারপাশে দেওয়ালের গায়ে গায়ে কুলুঙ্গি। সর্বক্ষণ হাফিজের কাব্য যন্ত্র মারফত পরিবেশন করা হচ্ছে। কুলুঙ্গিতে বসে এক সময় শিরাজি পান করা হত। সে জায়গায় পানীয় এখন জলীয় চা। গাইডকে জিগ্যেস করলাম–’শিরাজি জিনিসটা কি বরবাদ হয়ে গেছে? মদ্যপান নিষিদ্ধ? সভ্য মানুষ সে আদেশ মেনে চলে?’ গাইড মুচকি হেসে বললেন, ‘পরিবর্তন শুধু একটাই হয়েছে। আগে আমরা নমাজটা গৃহাভ্যন্তরে সেরে, বাইরে শিরাজি খেতাম। এখন শিরাজিটা ঘরে বসেই। খাই। নমাজ পড়ি বাইরে।’
মধ্যযুগের ইরান মনোহর। কিন্তু সত্যি বলতে মোগল পুরাকীর্তির মতো বিস্ময়কর না। তাজমহল, লালকেল্লা, ফতেহপুর সিক্রির তুলনা নেই। আমার চোখে ইউরোপেও না। শুধু মিশরে কারনাক, ভ্যালি অফ কিংস আর আবু সিম্বেলের মন্দির আর স্মৃতিসৌধগুলি তাদের গম্ভীর বিশালতা নিয়ে ক্ষুদ্র মানুষের অকিঞ্চনতা দ্ব্যর্থতাবর্জিত ভাষায় স্মরণ করিয়ে দেয়। তাদেরও তুলনা নেই।
আমাদের অতি প্রাচীন পুরাকীর্তিগুলি মহেঞ্জোদারো বাদ দিলে আর কোথাওই প্রায় মাটির উপর দাঁড়িয়ে নেই। শুধু নাগার্জুনিকোণ্ডায় খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের পুরো একটি শহর পাওয়া গিয়েছিল। অর্থনৈতিক উন্নতির খাতিরে নাগার্জুন সাগরের জলে সেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আমরা ডুবিয়ে দিয়েছি। শুনেছি—এটা সত্যিতে প্রয়োজন ছিল না। বাঁধটা অন্যত্রও করা যেত, শুধু কিছু দেরি হত। কিন্তু ভোটের তাগিদে নাকি স্থানীয় নেতাদের তর সয়নি। মানুষের জীবনে ভোটের চেয়ে দামি আর কি কিছু আছে?
ইরানের প্রাচীন রাজধানী পার্সিপোলিসে কঠিন পাথরে তৈরি রাজপ্রাসাদ কিন্তু মাটির উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদগুলি শুধু ধসে পড়েছে। তাছাড়া সব কিছুই আড়াই হাজার বছর আগে যেমন ছিল তেমনই আছে। খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে সেকেন্দর শাহ মাতাল হয়ে মানুষের এই অনবদ্য সৃষ্টি আগুন লাগিয়ে ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলেন। এই ধ্বংসলীলায় তাঁর সাফল্য যে সীমিত ছিল, পার্সিপোলিশের প্রাসাদ এখনও সে কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে।
সে প্রাসাদের সব কিছুই সম্রাটের মহিমা ঘোষণা করছে। উঁচু চাতালের উপর রাজকীয় সিংহাসন বসানো থাকত। অতি প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে তার কাছে পৌঁছতে হত। সিঁড়ির গোড়ায় দুই সিংহের মূর্তি। বোধ হয় তাদের প্রতীকী বক্তব্য–সাবধান! সিংহের গুহায় প্রবেশ করছ। তোমার ভাগ্যে কী আছে তা নির্ভর করছে রাজকীয় ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর। শিরোপাও পেতে পারো, শিরচ্ছেদও হতে পারে। অতএব বুঝে যেয়ো। সিঁড়ির দু পাশের দেওয়ালে সম্রাটের অধীনস্থ নানা জাতি-উপজাতির ছবি। তাদের অবয়বে জাতিগত পার্থক্যের চিহ্নগুলি স্পষ্ট। তারা নানা উপটৌকন নিয়ে সম্রাটের পদতলে নিবেদন করতে চলেছে। মনে হয়—চারিদিকে যেন গাম্ভীর্য আর ভয়ানক সম্ভাবনার পরিবেশ।
পার্সিপোলিসে একটা জিনিস দেখে অবাক হয়েছিলাম। ওখানকার স্তম্ভগুলি হুবহু অশোকস্তম্ভের মতো। সেই পালিশ, সেই দর্পিত সিংহমূর্তি, শুধু অশোকের ধর্মচক্রটি অনুপস্থিত। পটনার কাছে কদমকুয়ায় মেগাস্থিনিস বর্ণিত প্রাসাদের ভগ্নস্তূপ এখনও রয়েছে। কাঠের তৈরি প্রাসাদ নিশ্চিহ্ন। কিন্তু পাথরের স্তম্ভগুলি ইতস্তত পড়ে আছে। এখানে তারা স্বকীয় মহিমায় সদম্ভে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। এক সময় সাহেব পণ্ডিতরা অশোকস্তম্ভে গ্রিক প্রভাব নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। কিন্তু পারসিক স্তম্ভগুলির সঙ্গে হুবহু মিলের কথা কোথাও পড়েছি বলে মনে পড়ে না। তবে সাম্প্রতিক পুরাতত্ত্বর সঙ্গে আমার পরিচয় নেই।
এতক্ষণে ট্যুরিস্ট হিসাবে পৃথিবীর পথে পথে ঘোরবার বিবরণ দিয়েছি। ২০০০ সালে ট্যুরিস্ট হিসাবেই ৫২ বছর পরে নিজ গ্রাম কীর্তিপাশায় গেলাম। প্রসন্নকুমার ইনস্টিটিউটে কয়েকশো গ্রামবাসী অভ্যর্থনা দিলেন। দুটি মেয়ে গাইল, ঝরা ফুলদলে কে অতিথি, সাঁঝের বেলায় এলে কাননবীথি। দেখলাম পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটা ভগ্নস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। দালানবাড়ির সামনেটা দেখতে একই আছে। পুষ্করিণীও সংস্কারবর্জিত না। শুধু এক হিন্দু ভদ্রলোক কড়ি বর্গা খুলে নিয়ে বিক্রি করে দেওয়ায় বাড়ির দোতলার ছাদ ভেঙে পড়ে বেশিরভাগ ঘর খন্ডহর রূপ নিয়েছে। কিন্তু ধ্বংসোন্মুখ জমিদারভবনের শোক বহু মানুষের অশ্রুসিক্ত আলিঙ্গনে মুছে গেল।
গত দশ-বারো বছরে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছি। তার থেকে কিছু স্ন্যাপশট পাঠক-পাঠিকাদের পরিবেশন করলাম। আমার এই কথাটি ফুরাল। নটে গাছটি মুড়াতে আর একটু দেরি আছে।
আমার জীবনে সব চেয়ে স্মরণীয় দিন ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮। সেদিন দেবতারা স্বর্গ থেকে পুষ্পবৃষ্টি করলেন। দেবদূতরা লম্বা লম্বা ভেঁপু বাজালেন, দ্যুলোক-ভূলোক এক স্বর্গীয় আলোকে প্লাবিত হল। যিনি সেই শুভ দিনে শুভ মুহূর্তে ভূমিষ্ঠা হলেন তার নাম লীলালক্ষ্মী বিঘ্নরাজা। তাঁকে দর্শন করে আমার চতুর্বর্গ ফললাভ হল।
সেই ব্যক্তির বয়স এখন সাত। আমাকে সান্ত্বনাহীন করে লন্ডন ছেড়ে তিনি ম্যানিলা চলে গেছেন। সেখানে মাঝে মাঝে যাই। তবে অনেক দূরের পথ, অনেক খরচা। তাই সামলে-সুমলে বছরে কয়েক সপ্তাহ তার সঙ্গে কাটাতে যাই।
তিনি অতি জ্ঞানী ব্যক্তি, এবং একজন বিশিষ্ট নারীবাদীও বটে। ট্রয়ের যুদ্ধের গল্প বলছিলাম। প্যারিস হেলেনকে নিয়ে পালাচ্ছেন। তার প্রশ্ন, ‘ডিড শি ওয়ান্ট টু গো?’ ট্রয়ের সর্বধ্বংসী যুদ্ধ শেষ হয়েছে। মেনেলাস হেলেনকে নিয়ে ঘরে ফিরছেন। আবার প্রশ্ন, ‘ডিড শি ওয়ান্ট টু গো উইদ হিম?’
সম্প্রতি তিনি পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে চিন্তিত। বললেন, ‘পিপল হ্যাভ টু ডাই। আদারওয়াইজ দেয়ার ইস নো প্লেস ফর নিউ পিপল।’ আশ্বাস দিলাম—আমরা স্বামী-স্ত্রী আমাদের জায়গা দুটো শিগগিরই ছেড়ে দেব।