২৩
বনগাঁয়ের জমাটি অঞ্চলে নয়, খানিকটা দূরে, গরিব পাড়ায় তার দুঃখী ঘরখানা। উঠোন ছাপিয়ে বর্ষার জল ঘরে ঢুকতে চাইছে। কয়েক আঙুল মোটে বাকি। ঘরের মাটির ভিত গলে যাচ্ছে জলে। এখানে সেখানে গর্তের মুখ যাচ্ছে খুলে। সাপ, ইঁদুর, ব্যাঙ, উচ্চিংড়ে, বিছে ঢুকে পড়ছে ঘরে। সারা দিন একরকম জলবন্দী হয়ে আছে তারা। বীণাপাণি আর নিমাই। শুধু বীণা জানে, যতটা দেখায়, ততটা গরিব সে আর নয়। জালার নিচে, মাটির গভীরে প্লাস্টিকে মোড়া অনেক ডলার।
লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। তাই বুঝি আজকাল তার অম্বল বেড়েছে তিনগুণ! হাতে পায়ে জোর নেই। অল্প পরিশ্রমেই হাঁফ ধরে। কড়ার নিচে ব্যথা হয়।
নিমাই আর সে কথা ফুরিয়ে ফেলেছে। ঘরে মাত্র দুটি প্রাণী, বাইরে দুর্যোগ, টানা বৃষ্টি, জল। যাত্রার রিহার্সাল বন্ধ, কোথাও যাওয়ার নেই। দুদিন তারা ঘর থেকে বেরোয়নি। আজ তৃতীয় দিনেও সকালবেলাটা ভেজা, স্যাঁতানো। বৃষ্টি পড়েই যাচ্ছে। নিমাই বসে আছে দরজার কাছে। হাতে একটা কঞ্চি। জল মাপছে। চৌকাঠের নিচেই জল। বীণাপাণি বসে আছে তাদের স্যাঁতানো বিছানায়।
তিন দিন আগে রিহার্সালে গিয়ে সন্ধেবেলায় শুনল, রিহার্সাল হবে না। কাকার বাজারের ঘরখানা থমথমে। লোকজন নেই। কাকা বসে বসে লম্বা খাতায় পালা লিখছে।
এই শান্ত বিভোর চেহারাটা দেখে বোঝাও যাবে না যে, এর একটা অন্য চেহারাও আছে। সেই চেহারাটা কেমন তা অবশ্য বীণাপাণি জানে না। জেনে কাজও নেই। এই বিভোর চেহারাটাই সে মনে রাখতে চায়। অন্য চেহারাটার কথা ভাবলে তার ভয় করে। সেদিন ভোরবেলায় তার বাড়িতে গিয়ে যখন দলবল নিয়ে হাজির হয়েছিল কাকা, তখন সেই অন্য চেহারার একটা ছায়া দেখেছিল বীণা। ধরা পড়লে কাকা তাকে কী করত? মারত? তাড়িয়ে দিত? ভগবান বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। কিন্তু তার পরও কয়েকটা দিন সে কাকার মুখখামুখি হলে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করেছে।
কাকার সামনে একটা বেঞ্চে বসে বীণা চুপ করে চেয়ে ছিল।
কাকা খাতা থেকে মুখ না তুলেই বলে, কি খবর বীণা?
খবর আর কি? পালা কবে নামবে তাই ভাবি। বসে বসে আর ভাল লাগছে না।
কাকা মৃদু গলায় বলে, সময় হোক। এই বাদলার সময়টায় আমাদের খুব আকাল।
তা জানি। এ সময়টায় অন্য কোনও কাজ পেলে হত।
কেন, তোমার কি ঘরসংসারের কাজ নেই?
বীণা একটু লজ্জা পেয়ে বলে, গরিবের সংসারে আর কত কাজ থাকবে বলো তো!
ছেলেপুলে হোক, তখন দেখবে কাজ করে কূল পাবে না।
বীণা মুখটা ঘেন্নায় ফিরিয়ে নিল। ছেলেপুলের কথা এখন সে ভাবতেই পারে না। ওসব ঝঞ্ঝাট আর পোষাবে না।
কাকা ভাঁড়ের চা আনাল।
বীণা চা খেতে খেতে বলল, অন্তত রিহার্সালটা হলেও একটু সময় কাটে।
জানি। সাত আটটা দিন বাদ দিয়ে রিহার্সাল ফের শুরু হবে। এখনও সেই ঝঞ্ঝাটটা যাচ্ছে। তাই বন্ধ রেখেছি।
কোন ঝঞ্ঝাট?
নতুন করে আর কী শুনবে! সবাই তো জানে। পগা খুন হওয়ার পর থেকে পাপা সিং নানা গণ্ডগোল পাকাচ্ছে, জানো না?
বীণার বুকটা ধক করে ওঠে। পগা নামটাই আজকাল তার শত্রু। সে আবছা শুনেছে বটে, পাপা সিং হল পগার মহাজন। বিরাট পয়সা, দুর্দান্ত মানুষ। পগা ছিল তার বিশ্বাসী লোক। তার ওপর অতগুলো ডলার আর পাউন্ড খোয়া যাওয়াতে লোকটা ক্ষেপে গেছে।
বীণা বিবর্ণ মুখে বলে, এখনও মেটেনি?
এগুলো মেটে কখন জানো? পাল্টি দু-একটা লাশ পড়ার পর। তার আগে নয়।
মা গো! বীণার ভিতরটা যেন অবশ হয়ে যায়। এ সবের জন্য কি সে-ই দায়ী?
বিবশ গলায় বীণা স্বগতোক্তির মতো বলে, খুন হবে!
কাকা চায়ের ভাঁড়টা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিয়ে বলে, সেরকমই মনে হচ্ছে। মনটা তাই ভাল নেই।
বীণা সম্মোহিতের মতো কাকার দিকে চেয়ে থাকে অপলক। এ লোকটা তার অন্নদাতা, এ লোকটা তার শরীর চায়নি কখনও, এ লোকটা তাকে পাঁচজনের চোখের সামনে তুলে ধরেছে। আজ এর বিপদের সময় কি বীণার কিছু স্বার্থত্যাগ করা উচিত?
বীণা সামান্য হাঁফসানো গলায় বলে, পাপা সিং কী চায় বলো তো!
কাকা বাইরের দিকে চেয়ে থেকে মৃদু গলায় বলে, কি আর চায়। ডলার আর পাউন্ডগুলো ফেরত চায়, তার বিশ্বাসী লোকের খুনের বদলা চায়।
বনগাঁ তোমার এলাকা, এখানে ও লোকটা তোমার কী করতে পারে?
কাকা ম্লান হেসে বলে, ওসব বাইরে থেকে মনে হয়। হিসেবটা অত সহজ নয়। এই এলাকায় বহু লোক আছে যারা দু-চার হাজার টাকায় দু-তিনটে খুন হাসতে হাসতে করে যাবে। পাপা সিং-এর অনেক টাকা।
বীণার বুকটা হিম হয়ে গেল কথাটা শুনে। সে কাকার দিকে অর্থহীন চোখে চেয়ে থেকে স্খলিত গলায় বলে, আমার ভয় করছে কাকা। কী হবে তাহলে!
কাকা উদাস চোখে বীণার দিকে চেয়ে বলে, দুনিয়াটা বড় কঠিন ঠাঁই বীণা। আমার রাস্তায় সবসময়েই বিপদ।
বীণা দুর্বল গলায় বলে, মিটমাট করে নেওয়া যায় না?
কাকা বিষন্ন মুখে বলে, মিটমাট করতেই তো চেয়েছিলাম। খুনটা যারা করেছে, তারা দুজন আমার ডান হাত আর বাঁ হাত। তারা এখন ফেরার। ফলে কাজ-কারবার বন্ধ হওয়ার মুখে। আমাকে মুশকিলে পড়ে যেতে হয়েছে। তারা খুব কাজের ছেলে ছিল। মিটমাট করে ফেলতে পারলে দুজন ফিরে এসে কাজে হাত দিতে পারত। কিন্তু পাপা সিং বিগড়ে আছে। শুনছি এখানে অনেকের সঙ্গে কথাটথা বলছে, প্রায়ই আসছে, যাচ্ছে। কিন্তু আমার সঙ্গে আর দেখা করছে না। তাইতেই বুঝতে পারছি যে একটা কিছু করবে। ভয়টা পাপা সিংকে নয়, ভয় এখানকার ছেলে-ছোকরাদের। এদের মধ্যে অনেকেই পগার বন্ধু ছিল। তারা পাপার সঙ্গে গা ঘষাঘষি করছে।
এ কথায় আরও বিহুল হয়ে গেল বীণা। লটারিওয়ালা পল্টুও তো পগার বন্ধু ছিল। পল্টু কি জানে? পল্টুকে যেন আজকাল কেমন কেমন লাগছে বীণার। মুখে তেমন কিছু বলছে না, কিন্তু যেন একটু ইশারা ইঙ্গিত দিচ্ছে। পগা কি সেই রাতে ওকে কিছু বলে গিয়েছিল! পল্টু কি পাপা সিংকে বলে দেবে?
বুকের ভেতরটা এমন তোলপাড় করতে থাকে যে, একটা ব্যথাই চাগাড় দিয়ে ওঠে যেন। বীণা ‘উঃ’ বলে মুখে হাত-ঢাকা দিয়ে শক্ত হয়ে থাকে কিছুক্ষণ।
কাকা একটু উদ্বেগের গলায় বলে, কি হল তোমার? অম্বলের ব্যথাটা নাকি?
বীণা একটু থম ধরে থেকে মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ।
তাহলে বাড়ি চলে যাও। চা না খেলেই পারতে। অম্বলের অসুখে চা-ফা খেতে নেই।
অম্বলের ব্যথার চেয়েও অনেক বড় ব্যথা ঘনিয়ে আসছে বীণার কপালে। ঠাকুর না করুন, কাকা যদি খুন হয়, তাহলে বীণার ভাত জুটবে না। আলেয়ার মতো মিলিয়ে যাবে যাত্রার মদির মায়াময় আলোর রোশনাই। দর্শকের হাততালি। এই একটা লোকের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে তার অদৃস্ট। আষ্টেপৃষ্ঠে।
মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছিল তার। একথা ঠিক যে, যাত্রায় নেমে তার আরো দুটো হাত গজায়নি বা টাকাপয়সার ছড়াছড়িও হয়নি। তবে পায়ের নিচে একটু দাঁড়ানোর মতো জমি পেয়েছে, আর ভবিষ্যতের একটা রঙিন ছবি টাঙাতে পেরেছে চোখের সামনে। সব যাবে। কাকা যদি যায়, তো সব ভেসে যাবে বীণার। উঠে যাবে বিশ্ববিজয় অপেরা। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো মানুষ এ যুগে তো বেশী নেই!
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে বীণা। মাথাটা এমন হয়ে আছে যে, পরিষ্কার করে কিছু ভাবতেই পারছে না। তার মন প্রম্পটারের মতো বলছে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না। কাজটা ঠিক হচ্ছে না।
বীণা শুধু একটা কথাই জিজ্ঞেস করতে পারল, অনেক কষ্ট করে বলতে হল যেন। ধরা গলায় বলল, তাহলে কি হবে কাকা?
কাকা তার দিকেই চেয়ে ছিল। বলল, সেটা নিয়েই তো ভাবছি। তবে ঝঞ্ঝাট তো আর চিরকাল থাকবে না। এই দেখ, এবার নিজে পালা লিখছি। মনের মতো করে। খুব জাঁকজমক করে নামাবো। প্রথম শো করব কলকাতায়। কলকাতাকে দেখিয়ে দিতে হবে যে, মফস্বলেও ভাল জিনিস হয়।
কথাগুলো বীণার কানে ঢোকে, কিন্তু তাকে চেতিয়ে তুলতে পারে না। সে বিহ্বলভাবে চেয়ে থাকে শুধু। কাজটা সে ভাল করছে না। তার জন্যই যদি খুনখারাপি হয় তবে সেই পাপ কি তাকেও অর্শাবে না? তার চেয়েও বড় কথা, পল্টু যদি বলে দেয়? পল্টু যদি শত্রুতা করে?
বীণা দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আসি কাকা।
এসো। কয়েকদিন বিশ্রাম করে শরীরটা ঠিক করে নাও। আট দশ দিন বাদে রিহার্সাল শুরু হবে।
বীণা বেরিয়ে আসে। রাস্তায় পড়ে একটু এগিয়ে যেতেই পল্টুর লটারির দোকানটা চোখে পড়ে। লোডশেডিং-এ হ্যাজাক জ্বেলে বসে আছে। দু-তিনটে ছেলেছোকরা আড্ডা দিচ্ছে।
পা ভারী লাগছিল বীণার। পল্টু শত্রুপক্ষের লোক কিনা তা সে বুঝতে পারছে না। কিন্তু দিদি বলে ডাকে, ভদ্র ব্যবহারও করে। আবার এমনভাবে তাকায় যে, নানা সন্দেহে বুকটা দুরদুর করে ওঠে বীণার।
একটু দূর থেকেই বীণা অভিনয়ের গলায় বলল, এই পল্টু!
পল্টু হ্যাজাকের আলো থেকে অন্ধকারে ভাল দেখতে পেল না তাকে। চোখটা হাত দিয়ে আড়াল করে বলল, কে! বীণাদি?
হ্যাঁ।
কি খবর?
খবর তো তোর কাছে। আমার টিকিটে প্রাইজ উঠেছে কিনা দেখেছিস?
পল্টু হাসল, তোমার আর লটারির প্রাইজের দরকার কী?
বীণার কয়েক সেকেন্ড লাগল কথাটা বুঝতে, তারপর হঠাৎ তার মনে হল, এ-কথাটার দু’নম্বর একটা অর্থ আছে। বুকটা কেঁপে গেল। গলাটা শুকিয়ে গেল।
পল্টু খুব হালকা গলায় বলল, আর একটা টিকিট নেবে? এক কোটি টাকা প্রাইজ। খেলা পরশু!
না, আজ নয়।
ছেলেগুলো না থাকলে বীণা পল্টুর সঙ্গে একটু কথা বলত। আর কথা বাড়াল না সে, বাড়ি ফিরে এল। তখন নিমাই ঘরে ছিল না। বীণা ঘরে এসে আলো জ্বেলে ঠাকুরের আসনে একটু ধূপ দীপ জ্বেলে, জল বাতাসা দিয়ে চুপ করে বসল বিছানায়। অনেক ভাবতে হবে তাকে এখন। ভেবে একটা কিছু ঠিক করতে হবে।
বীণা চোখ বুজে সব ঘটনাটা মনে মনে ঝালিয়ে নিল। বৃষ্টির মধ্যে পগার আসা, চলে যাওয়া। তারপর তার খুনের খবর। তারপর অনেক কিছু। সেই থেকে বীণার জীবনে শান্তি নেই। বুকে শব্দ হয়, মনে সবসময়ে ভয়-ভয় ভাব। তার তেমন অন্তরঙ্গ আর বিশ্বাসী কেউ যদি থাকত, তাহলে তাকে সব বলে, পরামর্শ নিতে পারত বীণা। কিন্তু কেউ নেই তার। নিমাই আছে বটে। কিন্তু ও বড় বেশী সৎ আর বোকা। শুনলেই চেঁচামেচি করবে, ভয় খাবে, টাকা ফিরিয়ে দিতে বলবে। কে জানে, হয়তো পাঁচজনকে বলেও বেড়াবে।
সেদিন কলকাতায় গিয়ে বড়দাকে পেলে খুব ভাল হত। বিদেশী টাকা দিয়ে স্বদেশী টাকা নিয়ে আসতে পারত। তা হল না।
এখন তার কী করা উচিত? কাকাকে যদি বাঁচাতে হয় তবে বান্ডিলটা তার ফেরত দেওয়া উচিত। গল্প একটা বানিয়ে বললেই হবে। তাই কি করবে বীণা?
তার ততদূর হিসেবনিকেশ জানা নেই, যাতে কত ডলার আর পাউন্ডে কত টাকা হয়, তা হিসেব করে দেখবে। আসলে কত পাউন্ড আর ডলার বান্ডিলে আছে তাই সে আজ পর্যন্ত ভাল করে গুনে দেখেনি। তবে অনেক আছে। ভাঙালে যা হবে তাতে সারা জীবন চলে যাবে বীণার। শুধু চলেই যাবে না, আরও কিছু বেশীই ভাল থাকতে পারবে তারা। কাকার হাত-তোলা হয়ে, অন্নদাস হয়ে থাকতে হবে না তাদের। উঞ্ছবৃত্তি শেষ হবে।
নিমাই একটু বেশী রাতেই ফিরল। হাবড়ায় গিয়েছিল কীর্তন করতে। ভাত খেতে বসে বলল, আজ তোমাকে খুব ভাবিত দেখাচ্ছে।
ভাবিত! তাহলে আমার মুখের দিক তাকাও মাঝে মাঝে?
নিমাই হেঁ হেঁ করে বিনয়ী হাসি হেসে বলে, শোনো কথা! তোমার চন্দ্রবদনটি ছাড়া আর কোনও মেয়েমানুষের মুখের দিকে তাকাই নাকি কখনও?
মাঝে মাঝে তাকালেই পারো। কেউ তো বারণ করবে না। তাতে একঘেয়েমিটাও কমবে।
খুব হাসল নিমাই। হেসে-টেসে বলল, এ মুখ কি একঘেয়ে হয় কখনও! নিত্যি নতুন লাগে যে।
ভালবাসারই কথা, তবু বীণার ভিতরটা যেন রি-রি করে কথাটা শুনে। বলে, আর মুখের গুণ গাইতে হবে না। খাও। তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।
নিমাই একবার বীণার মুখের দিকে চেয়ে বলে, খারাপ কথা নাকি? গুরুচরণ কিছু?
ধরো তাই।
নিমাই খেয়ে উঠল। আঁচিয়ে এসে বিছানায় মশারির মধ্যে বসল দুজন।
নিমাই মুখখানা খুব গম্ভীর করে বলল, বলো বীণাপাণি।
বীণা নিমাইয়ের দিকে চেয়ে রইল। হ্যারিকেনের আলোয় মুখটা খুব আবছা। কিন্তু ওই মুখ এবং ওই মুখের পিছনে চরিত্রটাকে বীণা খুব ভাল করে চেনে।
একটু আদুরে গলায় সে বলে, আচ্ছা, এটা যে কলিকাল তা তো জানো!
নিমাই হেসে বলে, শোনো কথা! এটা কোনও গুরুচরণ ব্যাপার হল?
দাঁড়াও, কথাটা তো এখনও ফেঁদে বসিনি। বলছি, তুমি কলির ধর্ম মানো কিনা!
কলির তো ধর্ম নেই। সবই অধর্ম। দু’চারজন যারা ধার্মিক, কলির শেষে তারাই টিকে থাকবে, বাদবাকি সব ফৌত হয়ে যাবে।
ফৌত একদিন সবাই হবে। সাধুও হবে, চোরও হবে। সত্য ত্রেতায় কি কেউ মরেনি নাকি?
তা অবশ্য ঠিক। তবে কিনা—
দাঁড়াও। তোমার মতো অতটা না জানলেও আমি কিন্তু রামায়ণ মহাভারত অনেক শিখেছি। পৌরাণিক পালার পার্ট করি। অনেক ভাল কথা জানা আছে। আমাকে যা খুশি বোঝাতে পারবে না।
নিমাই সঙ্গে সঙ্গে একমত হয়ে বলে, সে আর বলতে! তুমি অনেক শিখেছো এ ক’দিনে।
তাই বলছি, কলিযুগের ধর্মটা হল বেঁচে থাকা। তাই নয়?
নিমাই মাথা চুলকে বলে, প্রথমেই বড্ড পাঁয়তারায় ফেলে দিলে। আসল কথাটায় আসছো না।
আসল কথাটা তোমার মাথায় ঢোকাতেই আজ বাসর বসিয়েছি। বুঝলে?
বুঝেছি। এবার বলো।
বলি, ওরকম সাধু-সাধু ভাব করে থাকলে কি আমাদের পেট চলবে? নাকি টিকে থাকা যাবে?
টিকে তো আছি। চলেও যাবে। দোকানটা বসাতে পারলে আর চিন্তা নেই। এখানে সবাই আমাকে ভাল লোক বলে জানে।
বীণা একটু হেসে তরল গলায় বলে, তুমি কেমনতরো ভাল লোক? তোমার বউ তো যাত্রা থিয়েটার করে বেড়ায়। তাহলে তুমি ভাল লোক হলে কিভাবে? লোকে বলে, তুমি একজন যাত্রাওয়ালীর স্বামী। আর সবাই জানে যাত্রাওয়ালীর স্বামী মানেই একটা মেরুদণ্ডহীন লোক।
নিমাই একটু চুপ করে থেকে হতাশ গলায় বলে, কথাটা হয়তো মিথ্যে নয়। তবে বাজে লোকের কথায় কিই বা আসে যায় বলো।
বাজে লোক হোক, আর যাই হোক, লোকে বলে তো?
লোকের মুখ বন্ধ করতে চাও নাকি?
চাই। আমার অভিনয়ের নেশা আছে বটে, এরকমভাবে আর থাকতে ইচ্ছে করে না। একটু ভালভাবে থাকলে বেশ হত।
নিমাই মাথা চুলকে বলে, প্রসঙ্গটা ধরতে পারছি না। কলিযুগ নিয়ে শুরু করেছিলে। কথাটা কোথায় দাঁড়াল?
আমার মাথায়। আচ্ছা হাঁদারাম বাবা!
নিমাই ভারি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, কথাটা যে বড্ড সাঁটে বলছো। ভাল করে বুঝতে পারছি না। জানোই তো, আমি বড় বোকাসোকা মানুষ।
অত বোকা হলে কি কাজ হয় বাপু? কলিযুগটা বোকাদের জন্য নয়।
তাই দেখছি।
শোননা, এ যুগে একটু পাপ-টাপ করলেও ভগবান ক্ষমা করে দেন। বুঝতে পারলে?
নিমাই পারল। উজ্জ্বল হয়ে বলল, তা ক্ষমা করবেন না কেন? তিনি যে পতিতপাবন! পাপীকে উদ্ধারের জন্যই আসেন। তবে কথাটা হল, পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। পাপ করলে লোকে পথভ্রষ্ট হয়। প্রায়শ্চিত্ত হল পুনরায় চিত্তে গমন।
ও বাবা! প্রায়শ্চিত্তের কথা আসছে কেন?
আসবে না? পাপ করলে অনুতাপ, খ্যাপন এইসব করতে হয়।
তোমাকে নিয়ে আর পারি না। আচ্ছা, এই যে আমি যাত্রা-টাত্ৰা করি, এটাও তো পাপ! নাকি?
নিমাই একটু ধন্ধে পড়ে বলে, পাপ করলেই পাপ। নইলে নয়।
ধরো যদি আমি লটারিতে টাকা পাই, সেটা কি পাপ?
না তো! পেয়েছো নাকি?
না গো! তবে যদি ওরকমই কোনও পড়ে-যাওয়া টাকা কখনও পেয়ে যাই, তাহলে কি সেটা নেওয়া অধর্ম হবে? তোমার মন কি বলে?
নিমাই ফাঁপড়ে পড়ে বলে, এ তো গাছের মগডালে জল। টাকাটা পাচ্ছো কোথায়?
ধরো, যদি পাই?
আমি তো বাপু কিছু বুঝতে পারছি না। বড্ড গণ্ডগোলে ফেলে দিচ্ছো আমাকে!
আমি তোমার আপনজন তো!
একশোবার।
কথাটা মনে রেখো। পাপে-তাপে, দোষে-ঘাটে, আমি কিন্তু সর্বদাই তোমার আপনজন।
খুব ঠিক কথা।
আমাকে কখনো ঘেন্না কোরো না পাপী বলে।
শোনো কথা। বলে নিমাই খুব হাসল।
সে রাতে বেশ একটু ভালবাসাবাসি হয়েছিল তাদের মধ্যে। একটু বেশী মাখামাখি। কিন্তু বীণা তবু সাহস করে কবুল করতে পারেনি। নিমাইয়ের ওপর সে নির্ভর করতে পারে না। বড্ড ভয় হয়। লোকটা ধর্মভীরু, লোকটা বড় দুর্বল। এসব লোক ভাল হলে কি হয়, এরাই বিপদ ডেকে আনে।
আজ বর্ষাকাতর দিনে, তিন দিন বাদেও বীণা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। তার সামনে সবটাই ভারি আবছা, ভারি সন্দেহজর্জরিত। বুকে বুকজোড়া ভয়।
তার কি বুকের ব্যামো দাঁড়িয়ে যাবে?
নিমাই মুখ ফিরিয়ে বলল, ডুবল গো!
কী ডুবল?
আর এক আঙুল বাকি। জল ঢুকছে।
হাঁড়িকুড়ি, বাক্স-প্যাঁটরা যেটুকু আছে তাদের সব ওপরে তোলা, উনুন জ্বলেনি। বীণা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ডুবুক। সব ভেসে যাক!