২৩. বংশী চলে গেল

বংশী চলে গেল।

ভূতনাথ তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিলে। আজ সকাল বেলাই যেতে হবে ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে। বাইরে সারা বাড়ি রং করা শেষ হয়ে গিয়েছে। এখন জানালা দরজায় রং হচ্ছে। শ্যামসুন্দর জল তুলছে ভিস্তিখানায়। লোচনের কাজ অনেক বেড়েছে। অনেক হুঁকো কল্কে আর তামাকের সরঞ্জাম সংগ্রহ হয়েছে। বিয়ে [ড়ির আয়োজন চলছে। ভূতনাথকে দেখে বললে–প্রেণাম হই শালাবাবু।

-কী খবর লোচন?

—আজ্ঞে, ফুরসত আর নেই আজকাল তেমন, সমস্ত তামাকের ব্যাপারটা তো একা আমাকে সামলাতে হবে, হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি একেবারে, একটা নতুন তামাক তৈরি করেছি আজ্ঞে, গয়া মিঠেকড়া বালাখানার সঙ্গে ছটাক আন্দাজ কাশী মিশিয়ে বেশ নতুন রকমের সোয়াদ এনেছি—খেয়ে দেখবেন নাকি?

ভূতনাথের মুখের ভাব লক্ষ্য করে বললেন, না, ভয় পাবেন না-–পয়সাটয়সা চাইনে, আধলাও নয়, এমনিই আপনাকে খেতে দিচ্ছি। মতিবাবু তো জহুরী লোক, তিনি পর্যন্ত খেয়ে ধরতে পারেন না আজ্ঞে–জিজ্ঞেস করলাম—কী তামাক বলুন দিকি মতিবাবু? —মতিবাবু খানিকক্ষণ ভাবলেন, দু’চার বার টানলেন, এদিক ওদিক সাত পাঁচ সব ভেবে বললেন—আট আনা ভরির অম্বুরি যেন মনে হচ্ছে লোচন…

ভূতনাথ বললে–তারপরে?

তারপরে আর কী ঘটনা ঘটলো তা লোচন বললে না। নিজের কাজে মন দিলে কিছুক্ষণ। তারপর বললে—ওই মতিবাবু, মেজবাবু, ভৈরবাবুর মতো দু’একজন লোক এখনও আছে বলে পৃথিবীটা টিকে আছে—নইলে য়্যাদিনে কবে কলিযুগ এসে যেতো… দেখতেন।

—তা তো বটেই লোচন–আচ্ছা আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে—আসি-বলে ভূতনাথ ভিস্তিখানায় ঢুকে পড়লো।

 

বেরোতে বেরোতে বেশ বেলা হয়ে গেল। মাধববাবুর বাজারের পাশে বেশ ভিড় জমেছে। সিনেট হল-এর সামনে গাড়িঘোড়া পুলিশের ভিড়। চারদিকে য়ুনিয়ন জ্যাক উড়ছে। ভিড়ের ঠেলায় কাছে ঘেঁষা যায় না। সামনে লাল কাপড়ের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা রয়েছে–কনভোকেশন’।

বেশ মনে আছে বোধহয় ২১শে ফেব্রুয়ারী ১৯০৫ সাল।

ভিড় কাটিয়ে চলে যাওয়ারই কথা। চলেই যাচ্ছিলো ভূতনাথ। হঠাৎ চারদিকে বেশ গুঞ্জন শুরু হলো। পুলিশের দল বেশ সন্ত্রস্ত হয়ে উঠলো। হট যাও—হট যাও শালে লোক—এই উল্লঃ—

পাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো—ওই বড়লাট আসছে।

বড়লাট! ভূতনাথও দাঁড়িয়ে পড়লো। বড়লাটকে কখনও দেখেনি ভূতনাথ। সামনে পেছনে মাউন্টেড পুলিশ। গাড়ি থেকে নেমে বড়লাট উঠতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। .

ভূতনাথের তখন দাঁড়াবার সময় নেই। বি-এ পাশ করলে সে-ও এইখানে এসে ডিগ্রি নিতে বড়লাটের হাত থেকে। কালো গাউন পরে গিয়ে বসতে সকলের সঙ্গে।

–ভূতনাথ-দা’ না?

পেছন ফিরে দেখলে ভূতনাথ। অচেনা লোক। কাঁধে হাত দিয়েছে। হাসি-হাসি মুখ।

–চিনতে পারছেন আমাকে?

চিনতে পারা যায় না। কোথায় যেন দেখেছে।

—আমি নিবারণ, ‘যুবক সঙ্ঘে’র কথা মনে আছে? আপনি আর গেলেন না ওখানে? কেমন আছেন? প্রায় দু’বছর পরে দেখা আপনার সঙ্গে—একসঙ্গে অনেক কথা বলে গেল নিবারণ।

–কী খবর তোমাদের? তারপর হঠাৎ জিজ্ঞেস করলে হ্যাঁ ভালো কথা, ব্ৰজরাখাল কোথায় জানো? তোমাদের যুবক সঙ্ঘে’র প্রেসিডেন্ট?

–কেন, আপনি জানেন না?

-না, এই তো সবে ক’দিন হলো উঠে বেড়াচ্ছি, অনেকদিন তো শয্যাশায়ী ছিলাম, ঘা বিষিয়ে গিয়েছিল। উঠে বেড়ানো বারণ করেছিল ডাক্তার। আরো এক বছর কাটলো বিশ্রাম নিতে, এখনও বেশি পরিশ্রম করলে মাথা ধরে। কোথা দিয়ে যে সময়গুলো হু হু করে কেটে যায় টের পাওয়া যায় না, মনে হচ্ছে এই যেন সেদিন তোমাদের ওখানে ছিলাম!

—এখন কোথায় যাচ্ছেন?

—সেই ‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসে, কতদিন আপিসে যাইনি, চাকরি বোধহয় আমার নেই, মাঝখানে শুধু দু’তিনখানা চিঠি লিখে ওদের জানিয়েছিলাম যে এখনও পুরোপুরি সারিনি। সেরে উঠলেই যাবো। আজ কর্তা একবার ডেকে পাঠিয়েছেনযাই দেখে আসি।

নিবারণ বললে—বড়দা’ও আসবে কলকাতায় দু’একদিনের মধ্যে।

—কে? ব্রজরাখাল? এতদিন কোথায় ছিল সে?

নিবারণ বললে—তিনি তো সেই তখন থেকেই বাইরে—অনেকদিন পর্যন্ত আমরা কোনো খবর পাইনি, স্বামিজীর আলমোড়ার আশ্রমে অনেকদিন ছিলেন, সেখান থেকে একবার খবর আসে তিনি অসুস্থ। তারপর শুনলাম তিনি তিব্বতে চলে গিয়েছেন। এই সেদিন আবার শুনলাম তিনি নাগপুরে এসেছেন প্লেগের জন্যে, খুব প্লেগ হচ্ছিলো, সেই শুনে তিনি কারো বারণ না শুনে প্লেগরুগীদের সেবা করতে এসেছিলেন। এবার সিস্টার নিবেদিতা ওঁকে ডেকে পাঠিয়েছেন—লিখেছেন—মোক্ষ নিতে দৌড়চ্ছে৷ ব্ৰজরাখাল, কিন্তু যারা লাফাতে পারে না তারা পার হবে লঙ্কা! দুটো মানুষের মুখে অন্ন দিতে পারে না, দুটো লোকের সঙ্গে একবুদ্ধি হয়ে একটা সাধারণ হিতকর কার্য করতে পারো না—মোক্ষ নিতে দৌড়চ্ছে। বৌদ্ধের ঐখানটায় গুলিয়ে ফেলে যত উৎপাত করে ফেললে আর কি! সিস্টার নিবেদিতা বলেন—অহিংসা ভালো কিন্তু নিঃশত্রু হওয়া আরো বড় কথা, আতোয়িনমায়ান্তং ইত্যাদি, অর্থাৎ হত্যা করতে এসেছে এমন ব্ৰহ্ম বধেও পাপ নেই, তোমাদের মনুই তো বলেছেন—বীরভোগ্যা বসুন্ধরা–বীর্য প্রকাশ করে, সাম, দান, ভেদ, দণ্ডনীতি প্রকাশ করে, ভোগ করো, পৃথিবী ভোগ করে, তবে তুমি ধার্মিক—আর ঝাটা লাথি খেয়ে চুপটি করে ঘৃণিত জীবন যাপন করলে ইহকালেও নরক ভোগ, পরকালেও তাই–কথা বলতে বলতে নিবারণ থামলে।

ভূতনাথ বললে—ব্রজরাখাল সে-চিঠির কিছু উত্তর দিয়েছে?

–দিয়েছেন আমাদের কদমদা’কে একটা চিঠি। লিখেছেন–আমি যাচ্ছি শিগগির, তোমরা তৈরি হও। সিস্টার নিবেদিতা সেদিনও আমাদের যুবক সঙ্ঘে’ এসে বলে গেলেন—স্বামিজী বলে গিয়েছেন—অজুন ওই তমোগুণে পড়েছিলেন বলেই তো ভগবান অত করে বোঝাচ্ছেন গীতায়—প্রথম ভগবানের মুখ থেকে বেরুলো —‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’–জৈন বৌদ্ধদের পাল্লায় পড়ে আমরাও ওই তমোগুণের মধ্যেই পড়েছি—কেবল ডাকছি ভগবানকে ভগবান শুনবেনই বা কেন, আহাম্মকের কথা মানুষই শোনে না— তা ভগবান! এখন আমাদের একমাত্র উপায় হচ্ছে ভগবানের উপদেশ শোনা—ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’—তস্মাত্ত্বমুত্তিষ্ঠ যশোলভস্ব’: আমাদের যুবক সত্যে’গীতা-ক্লাশ হয়—একদিন যাবেন না বেড়াতে?

—যাবো একদিন, আর সেই তোমাদের অনুশীলন সমিতি’ —তা শুরু হয়েছে?

—হয়েছে, সব বলব আপনাকে, একদিন আসুন আপনি। সারা কলকাতায়, সারা বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে ব্রাঞ্চ খোলা হবে, কুস্তি শেখানো, গীতা পড়া, ড্রিল করা অনেক কাজ এগিয়েছে— কদমদা’ বড়দা’কে লিখে দিয়েছে চলে আসতে, বড়দা’ও লিখেছে রওনা হয়েছে, দু’একদিনের মধ্যেই হয় তো এসে পড়বে। আমি এখন চলি, পরে দেখা হবে।

আর কিছু না বলে ভূতনাথও চলে এল।

‘মোহিনী-সিঁদুর’ আপিসের সামনে এসে কেমন যেন অবাক হয়ে গেল ভূতনাথ। সামনের সে সাইন-বোর্ডটা নেই আর সেখানে। সামনের দরজাটা দিনের বেলাও বন্ধ। এমন তো হয় না। সারাদিন তো লোকজনের আনাগোনা থাকে। অথচ আজ এ-রকম কেন।

দরজার কড়া নাড়তেই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলে বৈজু। ভূতনাথকে দেখে সে-ও যেন অবাক হয়ে গিয়েছে।

ভূতনাথ জিজ্ঞেস করলে—বাবু আছেন?

—আছেন, ওপরে যান।

ভূতনাথ একটু দ্বিধা করে আবার জিজ্ঞেস করে—ওরা কোথায় সব, পাঠকজী, ভরত, মিশির—

বৈজু বললে—পাঠকজী আছে। অন্য সবাই চলে গিয়েছে।

—কেন? এখন সিঁদুরের প্যাকেট তৈরি করে কে?

—সিঁদুর আর তৈরি হয় না, কারবার বন্ধ করে দিয়েছে বাবুজী।

সেকি!

বাড়ির ভেতরে সোজা চলতে গিয়ে মুখোমুখি এসে পড়ে গেল জবা। ভূতনাথকে দেখে জবা যেন হঠাৎ একটা আশ্রয় পেয়ে গিয়েছে এমনি করে সামনে এগিয়ে এল। আরো অবাক হলে ভূতনাথ। চোখ নামিয়ে নিতে চাইলে। সেদিনকার জ্বরের ঝোকে যে কাণ্ড সে করে ফেলেছিল তারপর সোজাসুজি চোখ তুলে চাইবারও যেন অধিকার নেই আজ তার।

জবাই সামনে এসে পড়লো। বললে—ভূতনাথবাবু—আপনি এসে গিয়েছেন—কাল থেকে আপনার অপেক্ষা করছি।

অনেকদিন পরে দেখা। তবু ভূতনাথের মনে হলো জবা যেন আরো অনেক বড় হয়ে উঠেছে এরই মধ্যে। আরো শ্ৰীমতী, আরো প্রীতিময়ী হয়েছে। শরীরের রেখায় আরো প্রখরতা! হঠাৎ চোখ তুলে চাইলে ধাঁধা লাগে! মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে।

জবা বললে—বাবা আপনাকে চিঠি লিখেছিলেন—পেয়েছিলেন আপনি!

ভূতনাথ বললে—পেয়েছি, অসুখের পর আজ এই প্রথম এতদূর বেরুলাম।

জবা বললে—বাবা আজ সকালেও বলেছেন—ভূতনাথবাবু এল না—আমার ওপর নিশ্চয় অপরাধ নিয়েছে সে।

–বাঃ রে, অপরাধ কিসের তার—অপরাধ তো আমারই হয়েছে। তারপর জবার মুখের দিকে চেয়ে বললে-নিজের অপরাধেই এতদিন এত জ্বলেছি যে চিঠি না পেলে আসতেই সাহস হচ্ছিলো না। ভাবছিলাম এ-বাড়ির দরজা আমার কাছে চিরদিনের জন্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তোমার বাবার স্নেহের সুযোগ নিয়ে আমি তার বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।

জবা হঠাৎ যেন আবার পুরোনো দিনের সুরে বললে—এবার আর আপনাকে কেউ পাড়াগাঁয়ের মানুষ বলে ভুল করবে না। শুধু নামটা আপনার বদলে ফেলুন এবার।

ভূতনাথ কিন্তু হাসতে পারলো না। বললে–আমি ভাবতেও পারিনি যে এ-বাড়ি থেকে আবার আমার ডাক আসবে—আমি আবার চাকরি ফিরে পাবো।

জবা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে উঠললা—কিন্তু চাকরি তো আপনার নেই ভূতনাথবাবু।

জবা রসিকতা করছে কি না দেখবার জন্যে জবার মুখের দিকে ভালো করে তাকাবার প্রয়োজন হলো এবার।

জবা তেমনি কঠিন স্বরে বললে—-শুধু যে আপনারই নেই, তা নয়। কারোর চাকরিই আর নেই। বাবা কারবার তুলে দিয়েছেন।

-কেন?

—সেই কথার জবাব দেবেন বলেই হয় তো বাবা আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন, ভাবছিলেন, হয় তো আপনি নিজে থেকেই একদিন আসবেন, যখন এতদিন ধরেও এলেন না, তখন বাবাই যেতে চাইছিলেন আপনার কাছে। আমিই কেবল বারণ করেছি— বলেছি—যিনি নিজে থেকে চলে গিয়েছেন, আমাদের সমস্ত আদর যত্ন সত্ত্বেও যিনি এখানে থাকতে চাইলেন না, আপনি নিজে গিয়ে ডাকলেও তিনি হয় তো আসতে নাও পারেন—কিন্তু সেটাও আসল কথা নয়, বাবা যেতে চেয়েছিলেন তার নিজেরই গরজে।

ভূতনাথ বললে—আমি আবার একটা মানুষ, এতখানি বয়েস পর্যন্ত যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারলে না—তার জন্যে আবার কারো গরজের প্রশ্ন উঠতে পারে এইটেই তো অবাক লাগে!

—আপনার কাছে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু বাবা কাউকে কোনোদিন ছোট ভাবতে পারেন না। আমার বাবাকে আপনি এখনও চিনতে পারলেন না। সেদিন সমাজে গিয়ে হঠাৎ তার মনে হয়েছে তিনি এতদিন যা করে এসেছেন সব ভুল করে এসেছেন, কেবল গোঁজামিল দিয়ে এসেছেন। লোক ঠকিয়ে এসেছেন—এখন নাকি তাই সব হিসেব মিটিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করবেন।

—সে কি?

—বাড়ি এসেই সাইন-বোর্ডটা খুলিয়ে ফেললেন। সব কর্মচারীদের বিদায় দিলেন। সকলকে হাত জোড় করে বললেন— —তাকে যেন সবাই ক্ষমা করে। বললেন—যা করেছি সব ভুল, সব মেকি, এতদিন যে চলেছে সে কেবল বাজারের চলা, কিন্তু এখন ব্যাঙ্কের পোদ্দারের কাছে আমার সব খাদ ধরা পড়ে গিয়েছে।

—তার মানে?

—তার মানে কি আমিই জানি ছাই, মা’র মৃত্যুর পর থেকেই তো ওইরকম সব বলতে শুরু করেছিলেন। এখন আরও বেড়েছে, প্রতি রোববারে সমাজে যান, বেশিক্ষণ একলা চুপ করে বসে থাকেন, ‘সঞ্জীবনী কাগজখনা নিয়ে খুলে বসেন—কিন্তু মনে হয় কিছুই যেন নজরে পড়ছে না।

ভূতনাথ বললে—চলো বাবার কাছে যাই।

জবা বললে—চলুন।

ভূতনাথ বললে—তা ছাড়া এমন চালু-ব্যবসা এভাবে হঠাৎ নষ্ট করে দেওয়াও তো উচিত নয়। এতগুলো লোকের জীবিকা তোমার ভবিষ্যৎ।

জবা কিছু উত্তর না দিয়ে চলতে লাগলো সিঁড়ি বেয়ে।

সুবিনয়বাবু তখন একখানা সঞ্জিবনী নিয়ে পড়ছিলেন।

ভূতনাথ সামনে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে।

সুবিনয়বাবু মুখ তুলে চেয়ে চিনতে পেরে বললেন—আমার চিঠি পেয়েছিলে ভূতনাথবাবু। তোমার কথা আমি দিবারাত্রি ভাবি, ব্ৰজরাখালবাবু নিজে এসে তোমাকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন। আমি তোমার কিছু করতে পারলাম নাসার জীবন ধরে কারই বা কী করতে পেরেছি।

ভূতনাথ পাশের চেয়ারে বসে রইল চুপ করে। জবাও গিয়ে বসলো বাবার চেয়ারের হাতলের ওপর।

তারপর জবার দিকে চেয়ে বললেন—মা জবা, তা হলে ভূতনাথবাবুকে বলল সেই কথাটা–বলো সেই কথাটা।

জবা বললে—আপনিই বলুন।

সুবিনয়বাবু বললেন—আমিই বলবো মা, আমিই বলবোকিন্তু তার আগে তোমার কাছে আমার ক্ষমা চাওয়া দরকার ভূতনাথবাবু। আমি তোমার কিছু করতে পারিনি-ব্ৰজরাখালবাবু নিজে আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছেন তোমাকে।

ভূতনাথ হাত জোড় করে বলে উঠলো—আমাকে অপরাধী করবেন না মিছিমিছি।

—সে কি কথা, অপরাধ তো আমার, সেই বিশ্বনিয়ামক যিনি, সমস্ত তিনি জানেন, তাঁর প্রতি আমি অবিচার করেছি, সমাজের প্রতি অবিচার করেছি, সমস্ত বিশ্বের ওপর অপরাধ করেছি অপরাধ কি আমার সামান্য ভূতনাথবাবু, অথচ এই অপরাধ সম্বন্ধেই এতদিন অজ্ঞান ছিলাম আমি। সেদিন সচেতন করে দিলেন আমার বাবা।

–আপনার বাবা? ভূতনাথ অবাক হয়ে গিয়েছে।

–হ্যাঁ, সেদিন স্বপ্নে আমাকে দেখা দিলেন। আমার বাবা ছিলেন গোঁড়া হিন্দু, কালীভক্ত, তোমাকে তো বলেছি। বাবা বললেন—খোকা, আমি মুক্তি পাচ্ছি না, আমাকে তুই মুক্তি দে।

শেষ জীবনে বাবা আমার মুখদর্শন করেন নি। আমি ধর্মত্যাগী বলে আমার হাতে এক গণ্ডুষ জলও পাননি তিনি। বললেনতেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে খোকা, আমি মুক্তি পাচ্ছিনে—আমাকে তুই মুক্তি দে। তারপরেই আচমকা আমার ঘুম ভেঙে গেল ভূতনাথবাবু, আমি চারদিকে চোখ মেলে দেখলাম কেউ কোথাও নেই। বিদ্যাসাগর মশাই অবশ্যি লিখে গিয়েছেন—’স্বপ্ন সত্য নহে—‘ আমিও ভালো রকম তা জানি। কিন্তু সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনে শান্তি পেলাম না। সারাদিন কাজকর্ম করতে মন গেল না। জবাকে বললাম—একটা ব্ৰহ্মসঙ্গীত করতে—তবু যেন ভুলতে পারলাম না কথাটা। শেষে সন্ধ্যেবেলা আমাদের সমাজে গেলাম। মনে হলো যেন ওখানে গেলে শান্তি পাবে!

ভূতনাথ বললে—তারপর?

—সেদিন আচার্যদেব বক্তৃতা দিলেন যাজ্ঞবল্ক্যর ব্ৰহ্মবাদ সম্বন্ধে। মন দিয়ে শুনতে শুনতে মনে হলো এ তো আমারই কথা। যাজ্ঞবল্ক্য যখন গৃহত্যাগ করবার সময় তাঁর দুই স্ত্রীকে তার সমস্ত ঐেশ্বর্য দিয়ে গেলেন তখন মেত্রেয়ী বললেন—যে নাহং অমৃতস্যা কিমহং তেন কুর্যাম্যা দিয়ে অমরত্ব লাভ করতে পারবে না তা নিয়ে আমি করবো কী! বড় ভালো কথা! মন দিয়ে শুনতে লাগলাম ভূতনাথবাবু, অমৃতের মধ্যেই যে সত্য আছে, অমৃতের মধ্যে দিয়েই যে ব্রহ্মের সাক্ষাৎ পাই এ উপলব্ধি আমরা কখন করি? যখন আমার কোনো পরমাত্মীয়ের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়। যাকে আমরা ভালোবাসি, মৃত্যুতে যে সে থাকবে না, একথা ভাবতে আমাদের সমস্ত চিত্ত অস্বীকার করে। যে-মানুষকে আমরা অমৃতলোকের মধ্যে দেখেছি তাকে মৃত্যুর মধ্যে দেখবো কেমন করে! তখন ভাবি—প্রেম কি কেবল আমারই? কোনো বিশ্বব্যাপী প্রেমের যোগে কি আমার প্রেম সত্য নয়? তোমরা ঠিক বুঝতে পারবে ভূতনাথবাবু, তুমি বুঝবে না, জরাও বুঝবে না।

ভূতনাথ বললে—আপনি বলুন আমি বুঝতে চেষ্টা করবো।

দাড়িতে হাত বুলাতে বুলোতে সুবিনয়বাবু বলতে লাগলেন— বাবার মৃত্যু আমি দেখিনি! শুনেছি। কিন্তু জবার মায়ের মৃত্যু আমি প্রতিদিন পলে পলে অনুভব করেছি ভূতনাথবাবু—মন বড় চঞ্চল হয়ে উঠতো। কিন্তু যতই চঞ্চল হতো ততই কাজের মধ্যে ড়ুবিয়ে দিতুম নিজেকে—তোমরা কিছু হয় তো জানতে পারেনি। কিন্তু এই বলে সান্ত্বনা পেতাম যে, ‘পিতা নোহসি’—হে আমার অনন্ত পিতামাতা তুমি আছো, তাই আমার পিতাকে কোনো দিন হারাবার জো নেই। মনে মনে বলতাম—

মধু বা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ–

মনে হতে পৃথিবীর ধুলো থেকে আকাশের সূর্য পর্যন্ত সমস্ত কিছু অমৃতে অভিষিক্ত হয়ে মধুময় হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ উপলব্ধি বেশিক্ষণ থাকতো না—প্রতিদিনের দুঃখ-কষ্ট রোগ-যন্ত্রণা আমাকে আবার এই মাটির পৃথিবীতে টেনে নামিয়ে নিয়ে আসতো। সে ভাব চিরস্থায়ী হতো না।

সমাজে আচার্যদেব বলছিলেন—ভোগই প্রেমের একমাত্র লক্ষণ নয়। প্রেমের একটি প্রধান লক্ষণ হচ্ছে এই যে, প্রেম আনন্দে দুঃখকে স্বীকার করে নেয়—কেননা দুঃখের দ্বারা ত্যাগের দ্বারাই প্রেমের পূর্ণ সার্থকতা!…কিন্তু একথা আমাকে আর একজন বলে গিয়েছেন।

তারপর জবাব দিকে ফিরে বললেন—একথা তোমাকেও বলা হয়নি মা, তোমার মায়ের মৃত্যুর দিনের কথা—আজ শোনো।

স্থির হয়ে এল সুবিনয়বাবুর দুই চোখ। চোখ বুজে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর বললেন—সেদিন রাত দুটো বেজেছে। তোমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ, তুমি পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছা মা, আমি একলা তোমার মায়ের পাশে বসে আছি। হঠাৎ মনে হলো যেন চোখ মেলে চাইলেন। আমি এক দাগ ওষুধ খাইয়ে দিলাম। তখন সেই মরণাপন্ন রোগী আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আমার হাত দুটো ধরলেন। যে মানুষ চিরকাল অসংলগ্ন কথা বলে এসেছেন, সেদিন সেই রাত দুটোর সময় তিনি যা বললেন, খুব জ্ঞানী লোকও তেমন জ্ঞানের কথা বলতে পারে না। আজও আম কথা মনে পড়ছে ভূতনাথবাবু।

—আমার হাতটা বুকের কাছে টেনে নিয়ে বললেন—তুমি এখনও জেগে আছো?

জিজ্ঞেস করলাম—কষ্ট হচ্ছে খুব?

তিনি বললেন—খুব কষ্ট হচ্ছে—কিন্তু আর হবে না।

–কেন?

—আর বেশিক্ষণ বাঁচবো না আমি।

তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। তার চোখ দি জল পড়তে লাগলো।

একবার জিজ্ঞেস করলাম—জবাকে ডাকবো এখন?

বললেন–না।

বললাম—তবে কী করলে তোমার কষ্ট কমবে—বলো?

তিনি বললেন—তোমাকে আমি যা বলবো করতে পারবে?

বললাম–বলো।

তিনি হঠাৎ বললেন আমাকে তুমি মুক্তি দাও।

-কেমন যেন চমকে উঠলাম। সেদিন স্বপ্নে বাবা যা বলেছিলেন, জবার মা-ও সেই এক কথাই বললেন। তবে কি আমি সবাইকে আমার কাছে আবদ্ধ করে রেখেছি। যেখানে প্রেমের সম্পর্ক সহজ, সেখানে তো বন্ধনের প্রয়োজন বাহুল্য। প্রেম মানেই তো মুক্তি। আবার জিজ্ঞেস করলাম—একথা কেন বলছো তুমি?

তিনি বললেন—আমাকে মুক্তি না দিলে, নিজেও মুক্তি পাবে। তোমার মুক্তির জন্যেই আমার মুক্তি চাইছি— জবাকেও তুমি মুক্তি দাও–পারবে?

—আর তারপরেই তার হাতটা শিথিল হয়ে গেল। তিনি চলে গেলেন।

জবা হঠাৎ বলে উঠলো–বাবা।

ভূতনাথ দেখলে জবার চোখেও জল নেমেছে।

সুবিনয়বাবু বললেন–এর এক বর্ণও অসত্য নয় মা-–সব সত্যি–প্রথমটা কী করবো বুঝতে পারলাম না। শেষে নিজের মনকে দৃঢ় করলাম। চিত্তকে স্থির করলাম। তখন মনে পড়লো বাবা বলেছিলেন—সচ্ছলতাটুকু হলেই ধন্য মনে করবে নিজেকে-দৈক আশীর্বাদে বিলাসিতা করবার জন্যে কালীর অনুগ্রহ নয়। মনে আছে—সচ্ছল হয়ে খেয়ে পরে বাঁচবার পর যেটুকু উদ্ব ও থাকতো বাবা সব দান করতেন। মোহিনী-সিঁদুর’ নিয়ে বিলাসিতা করতে তিনি বারণ করেছিলেন—দেবীর নাকি নিষেধ ছিলো। আমারও মনে হলো—আমার যে ঐশ্বর্য এ তো বিলাসিতারই নামান্তর।

পরদিনই ‘মোহিনী-সিঁদুরে’র সাইন-বোর্ডটা খুলে ফেলে দিলাম। চিঠি লিখে দিলাম সর্বত্র। তোমাকেও সেই সঙ্গে চিঠি লিখে দিলাম ভূতনাথবাবু। এখন আমি মন স্থির করে ফেলেছি—এতদিন যে অন্যায় করেছি তারই প্রায়শ্চিত্ত করে যাবো সারাজীবন। ধুলোয় আমার সর্বাঙ্গ মলিন হয়ে উঠেছে। উপনিষদে সেই প্রার্থনা আছে—‘আবীরাবীৰ্ম এধি’—হে প্রকাশ, আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক—তোমার হাল তুমি ধরো, এই তোমার জায়গায় তুমি এসো, আমার ইচ্ছে নিয়ে আমি আর পেরে উঠলুম না— মৈত্রেয়ীর সেই প্রার্থনা—’অসতো মা সদগময়, তমসো মা জ্যোতির্গময়, মৃত্যোর্মামৃতং গময় মনে হলো জবার মা-ও যেন উপনিষদের যাজ্ঞবল্ক্যর স্ত্রীর মতো সেই প্রার্থনাই করে গেলেন মরবার সময়–উপনিষৎ ব্ৰহ্মজ্ঞানের বনস্পতি আমিই জবার মাকে উপনিষৎ পড়িয়েছিলাম একদিন আর আজ আমাকে তিনি শিখিয়ে গেলেন। আজ আমি বুঝেছি ভূতনাথবাবু, আমি যা চাই তা এ নয়। টাকা আরো চাই, খ্যাতি আরো দরকার, ক্ষমতা আরো না হলে আর চলছে না। এই ভেবে ভেবেই দিন কাটিয়েছি—কিন্তু ‘আবীরাবীম এধি’ হে রুদ্র তোমার যে প্রসন্ন সুন্দর মুখ তাই আমাকে দেখাও, আমাকে বাঁচাও—সেই প্রসন্নতাই আমার অনন্তকালের পরিত্রাণ। তাই আমি ঠিক করেছি আমার সমস্ত উদ্ব ও সম্পত্তি আমি সমাজকে দিয়ে দেবো—সমস্ত সঞ্চয়ের বোঝা মাথা থেকে নামিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণের মধ্যে অবগাহন করি—সমস্ত ত্যাগ করে শান্ত হবে, পবিত্র হবে।

জবা ভূতনাথের দিকে তাকালে এবার।

ভূতনাথ বললে—আপনি ‘মোহিনী-সিঁদুরের ব্যবসাও তুলে দেবেন?

–তুলে দেবো নয়, তুলে দিয়েছি ভূতনাথবাবু।

তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন—একটু বোসো ভূতনাথবাবু, আমি আসছি—বলে পাশের ঘরে চলে গেলেন।

ভূতনাথ জবার দিকে চেয়ে বললে—আচ্ছা, বাবা যা বললেন সব সত্যি?

জবা বললে—বাবা মিথ্যা কথা বলেন না।

–-কিন্তু তুমি তো বারণ করতে পারতে—তোমার ভবিষ্যৎ–

জবা কিছু উত্তর দিলে না। তারপর বললে—ভবিষ্যতের কথা তো অনেক দূরে, বর্তমানই আমার কাছে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। এ থেকে বাঁচবার কোনো উপায়ই আর দেখতে পাচ্ছি না।

—তুমি কিছু বলেনি বাবাকে?

জবা বললে–বাবাকে আপনি এখনও তা হলে চিনতে পারেননি ভূতনাথবাবু। যেদিন ধর্মত্যাগ করেছিলেন সে গল্প তো শুনেছেন আপনি, সেদিন যেমন কোনো কিছুর টানই তাঁকে ভোলাতে পারেনি। আজও যখন সঙ্কল্প করেছেন সমস্ত ত্যাগ করবেন, এ-সঙ্কল্প থেকেও কেউ তাকে টলাতে পারবে না।

ভূতনাথ বললে—আমি অবশ্য বাইরের লোক, আমার কিছু বলা শোভা পায় না, কিন্তু তোমার কথা ভেবে বলছি।

জবা হাসলো এবার। বললে—আমার কথা অত ভাববেন না।

উত্তরটা শুনে ভূতনাথও লজ্জায় মাথা হেঁট করলো। কী মনে করে জবা কথাটা বলেলে কে জানে। তবু সেদিনের সেই ঘটনাটা যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেল ভূতনাথের। বললে—আমাকে তুমি ক্ষমা করো জবা।

জবা বললে—কিন্তু কথায় কথায় যারা এমন অপরাধ করে, তাদের কি কথায় কথায় ক্ষমা করা যায় নাকি?

—কিন্তু অনেকদিন আমি সে-ঘটনার জন্যে মনে মনে অনুতাপ করেছি জানে।’

জবা বললে—কিন্তু কেন আপনি অনুতাপ করতে গেলেন মিছিমিছি, আপনার চাকরি তো চলেই গিয়েছে।

-–চাকরিই কি আমার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য মনে করো নাকি?

–আপনার জীবনের লক্ষ্য কী তা তো আমার ভাববার কথা নয়। আপনার কথা আমি বসে বসে ভাবি এই আপনি ভাবেন বুঝি?

-কিন্তু যত অধমই হই আমি, ক্ষমা চাইবার অধিকারও কি নেই আমার।

জবা বললে—ক্ষমা আদায় করবার ক্ষমতা সকলের থাকে না ভূতনাথবাবু, সকলের কি সব ক্ষমতা থাকে? তা নিয়ে কোনো দুঃখ করবেন না আপনি।

ভূতনাথ বললে আমার দুঃখ যদি তুমি বুঝতে, তবে আমায় এত দুঃখ দিতে পারতে না জবা!

জবা বললে—দুঃখ কথাটা সবাই-এর মুখে বড় বেশি শুনি ভূতনাথবাবু, সত্যি বলুন তো সত্যিকার দুঃখটা কি?

ঠিক সেই মুহূর্তে সুবিনয়বাবু একগাদা কাগজপত্র হাতে ফিরে এলেন। বললেন—এই দেখো ভূতনাথবাবু-বলে কাগজপত্র খুলে দেখাতে লাগলেন। অনেক হিসেব অনেক রসিদ। অনেক পাওনা অনেক দেনা। বললেন–সকলের সব পাওনা মিটিয়ে দিয়েছি, যাদের পাওনা এখনও মেটাতে পারিনি, তাদের খবর দিয়েছি। তোমার পাওনাটা আজ শোধ করে দিতে চাই ভূতনাথবাবু। তুমি প্রাণ দিয়ে কাজ করেছো, তোমার যা প্রাপ্য তার চেয়ে অনেক কম দিয়েছি তোমায়। এই দেখো তোমাকে আমি বেশি দিতে পারিনি, তুমি আমার এখানে কাজ করেছে। সবসুদ্ধ·..

ভূতনাথ কেমন সঙ্কুচিত হয়ে উঠলো মনে মনে। বললে— আপনি আর একবার ভেবে দেখুন।

সুবিনয়বাবু একবার চাইলেন ভূতনাথের দিকে। বললেনকী ভেবে দেখবো ভূতনাথবাবু?

ভূতনাথ বললে—এতদিনের ব্যবসা, তা ছাড়া জবার ভবিষ্যৎ…

—সব ভেবেছি ভূতনাথবাবু, আজ পনেরো বছর ধরে ভেবেছি, ভেবো না এ-সঙ্কল্প আমার হঠাৎ হয়েছে। তোমরা ভাববে আমি বঝি পাগল হয়ে গিয়েছি, কিন্তু পনেরো বছর আগে থেকে এ-সঙ্কল্প শুরু হয়েছে আমার যখন জবা এতটুকু মেয়ে। কিন্তু তখন আমার যৌবন ছিল, কিছু গ্রাহ্য করিনি, তখন যাতে আমার তৃপ্তি ছিল, এখন তাতেই বিতৃষ্ণা হয়ে গিয়েছে-মনের জোয়ার-ভাটা আছে এটা তো বিশ্বাস করো, যেমন নিয়ে একদিন হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছি, সেই মন নিয়েই আজ আমি সমস্ত পার্থিব ঐশ্বর্য ত্যাগ করতে চলেছি—আর জবার ভবিষ্যতের কথা বলছে—ওদের দুজনের অনুরাগ হয়েছে, আমি ধনীই হই আর নিঃস্বই হই তাতে কিছু এসে যায় না, ওদের অনুরাগ যদি তাতে কিছু কমে তো বুঝতে হবে কোথাও ত্রুটি আছে সে অনুরাগের মধ্যে। কী বলল মা জবা? তোমার কি মনে হয় মা?

জবা চুপ করে রইল।

সুবিনয়বাবু আবার বললেন—সুপবিত্রকে কি তুমি সব বলেছো?

জবা মাথা নাড়লো।—না, তাকে কিছুই বলিনি বাবা।

—তুমি তাকে বলে দিও মা, সাধনার পথে প্রত্যয়ের বাধাই তো বড় বাধা, অনুরাগের ক্ষেত্রেও তাই। তোমরা দুজনে দুজনকে গ্রহণ করবে সমস্ত সংস্কার মুক্ত হয়ে। আমি চাইনে মা যে কোনো আবিলতা থাকুক সেখানে, তোমরা হয় তো আমায় অপ্রকৃতিস্থ ভাববে, ভাববে তোমাদের হয় তো বঞ্চিত করছি আমি। কিন্তু আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করছি মা যে, ‘মোহিনী-সি দুরে’র উপার্জন থেকে আজ পর্যন্ত আমি যা সঞ্চয় করেছি, তার ওপর তোমাদের বা আমার আর কোনো অধিকার নেই। শুধু জীবনধারণ করার জন্যে যেটুকু সামান্য প্রয়োজন, সেটুকু ছাড়া। যে-অসত্যকে আশ্রয় করে আমি বেঁচেছিলাম—তার জন্যে আমি বিশ্বপিতার কাছে মার্জনা ভিক্ষা করেছি বারবার। বিশ্বানি দুরিতানি পরাসুব—আমার পাপ —বিশ্বের সকলের পাপ মার্জনা করো—প্রার্থনা করি বার-বার।

ভূতনাথ বললে–কিন্তু আমাদের মোহিনী-সিঁদুরে’ একজনের খুব উপকার হয়েছে জানি।

—কে সে?

—আমাদের বড়বাড়ির ছোটবৌঠান।

সুবিনয়বাবু হাসলেন। বললেন—উপকার তার কতটুকু হয়েছে জানি নে, কার্য-কারণ সম্পর্ক এখানে কতটুকু তা-ও বলতে পারবো না ভূতনাথবাবু, তবে আমাকে যদি প্রশ্ন করে এ কেমন করে হলো, আমি বলবো নিষ্ঠায় সবই সম্ভব, বিশ্বাসে সবই সম্ভব—সে-বিশ্বাস যদি তোমাদের বড়বাড়ির ছোটবৌঠানের থাকে তো ফল তিনি পাবেন, আমার মোহিনী-সিঁদুর’ই নিন আর অন্য কিছুই তিনি নিন। মোহিনী-সিঁদুরে’র গুণ হয় তত এককালে ছিল। বাবা তা বিশ্বাস করতেন বলেই গুণ ছিল। আমি তার অযোগ্য সন্তান, যৌবনেই মন্ত্রে-তন্ত্রে বিশ্বাস হারিয়েছি, কিন্তু ব্যবসাবুদ্ধি হারাইনি, তখন থেকে এই এতদিন সেই ব্যবসাবুদ্ধিতে চালিত হয়েই এসেছি, কিন্তু হঠাৎ জবার মায়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমি আমার চরম সত্যকে দেখতে পেয়েছি, আজ আমি আর নিজেকে ক্ষমা করবো না ভূতনাথবাবু, নিজে মুক্তির স্বাদ পেয়েছি, জবাকেও আমি মুক্তি দিয়ে যাবে। কী মা জবা তোমার কিছু বলবার আছে?

জবা বললে—আপনি যা ভালো বুঝবেন করবেন বাবা, আমি তাই-ই ভালো বলে মানবব।

সুবিনয়বাবু বললেন-“তা হলে এবার সুপবিত্র এলে তাকে সব খুলে বলো মা তুমি।

-বলবো বাবা।

—বোলো এতদিনে-ঐশ্বর্যশালী হলাম, বিত্তবান হলাম। এতে অগৌরবের কিছু নেই মা, দেখবে মনে জোর পাবে, সাহস পাবে, তোমাদের দুজনের অনুরাগ যদি খাঁটি হয় তো এ-ঘটনায় তা ছিন্ন হবে না, তা আরো গাঢ় হবে। সুপবিত্র তো অবুঝ নয়, তাকে আমি যতদূর জানি সে ভুল বুঝবে না, আর ভূতনাথবাবু

ভূতনাথ বললে–বলুন।

–তোমার আমি কিছুই করতে পারলাম না, ব্ৰজরাখালবাবুকে কথা দিয়েছিলাম তোমাকে জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেবো, তা-ও হলো না। অবশ্য অনেক বন্ধুবান্ধবকে আমি চিঠি লিখেছি তোমার সম্বন্ধে, হয় তো তারা একদিন তোমাকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করবেন। তা সে যা হোক, আজ তোমাকে এই সামান্য পারিশ্রমিকটুকু নিতে হবে ভূতনাথবাবু—নিতে দ্বিধা করো না।

ভূতনাথের হাতে সুবিনয়বাবু একটা টাকার তোড়া তুলে দিলেন।

সুবিনয়বাবু আবার বললেন—পাঁচ শ’ টাকা আছে এতে ভূতনাথবাবু, সামান্য এ-দান, তবু প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করো, করে আমায় মুক্তি দাও, একে একে আমি ঋণ মুক্ত হতে চাই। জানো—এমনি করে সকলের সব ঋণ শোধ করে যাবতীয় সম্পত্তি আমি সমাজকে দিয়ে যাবে।

ভূতনাথের চোখে জল এসে গিয়েছিল। মনে আছে প্রথম ব্ৰজরাখালের সঙ্গে যেদিন এ-বাড়িতে এসেছিল ভূতনাথ, সেদিন কত দ্বিধা সঙ্কোচের ফণা তুলেছিল মন। ভেবেছিল হয় তো তার ধর্মত্যাগ করতে হবে। অখাদ্য খেতে হবে। কিন্তু কিছুই হয়নি। সমস্ত আশঙ্কা ভার মিথ্যেই হয়েছিল।

অনেকক্ষণ সবাই চুপচাপ। জবা এক মনে চুপ করে বসে আছে। সুবিনয়বাবুও চোখ বুজে রয়েছেন। এই শান্ত পবিত্র পরিবেষ্টনীর মৌনতা ভাঙতে যেন কেমন দ্বিধা হলো ভূতনাথের। দুই হাতের অঞ্জলিতে তখনও সুবিনয়বাবুর দেওয়া টাকার তোড়াটা যেন কাটার মতো ফুটছে। হঠাৎ ভূতনাথ আর্তনাদের মতো বলে উঠলো—আমি এ-টাকা নিতে পারবো না সুবিনয়বাবু।

সুবিনয়বাবু সুপ্তোখিতের মতন চোখ খুললেন। জবাও চোখ তুলে চাইলে।

–আপনি ফিরিয়ে নিন এ-টাকা, আমি নিতে পারবো না।

—কেন? কেন নেবে না ভূতনাথবাবু?

–আমি অন্যায় করেছি—আমাকে ক্ষমা করুন।

–কী অন্যায় তুমি করেছে ভূতনাথবাবু? কোনো অন্যায়ই তুমি করোনি।

–করেছি, জবা জানে—বলে ভূতনাথ মাথা নিচু করলে।

–কই মা, ভূতনাথবাবু কী অন্যায় করেছে জানো তুমি?

জবা হয় তো কী একটা উত্তর দিতে যাচ্ছিলো—কিন্তু ঠিক সেই সময় ঘরে কে যেন প্রবেশ করলো। বেশ সুদীর্ঘ চেহারা। গায়ে কালো আলপাকার কোট, কয়স অল্প। ভূতনাথ কখনও দেখেনি একে।

সুবিনয়বাবু তাকে দেখেই বলে উঠলেন—এই যে সুপবিত্রবাবু, এসো বাবা, এসো, এসে পড়েছে ভালোই হয়েছে, তোমার আসা দরকার ছিল। আজ জবা মাকে এই একটু আগে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলাম। তোমার সঙ্গে অনেক কথা আছে। তারপর ভূতনাথের দিকে চেয়ে বললেন–ও কি ভূতনাথবাবু উঠলে কেন? বোসো, তোমার সামনে কথা বলতে আমার কোনো অসুবিধে হবে না।

জবাও বললে—আপনি যাবেন না ভূতনাথবাবু, বসুন।

–না, অনেক বেলা হয়ে গেল, আর একদিন আসবে বলে হন হন করে সোজা বাইরে বেরিয়ে এল ভূতনাথ।

রাস্তায় বেরোতেই রতন পেছন থেকে ডাকলে—কেরানীবাবু।

–কী রে?

—একবার শুনে যান, দিদিমণি ডাকছেন।

বাইরে ঝাঁ ঝাঁ করছে রদ্দুর। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। ভূতনাথ আবার ফিরলো। জবা দরজার সামনেই দাঁড়িয়েছিল। ভূতনাথ কাছে আসতেই বললে চলে যাচ্ছেন যে, টাকাটা নিয়ে গেলেন না?

ভূতনাথ বললে—এই জন্যেই আমায় ডাকছিলে?

—আপনি টাকাটা ফেলে গেলেন—ভাবলাম ভুলে গেলেন বুঝি। ভূতনাথ জবার মুখের দিকে চেয়ে বললে—ঠিক ভুলে যাইনি আমি।

—ভুলে যদি না যান তো ফেলে যাবার মানে?

–ওটা আমি তোমাকেই দিয়ে গেলাম।

-–আমাকে? আমাকে দান করবার অধিকার আপনার আছে বলে মনে করেন নাকি? বাবা সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন বলে ভেবেছেন আপনার দানের ওপর বুঝি নির্ভর করতে হবে আমাকে?

–-তা কেন ভাবতে যাবো জবা, তাতে যে সুপবিত্রবাবুকে অপমান করা হয়, তা ছাড়া আমি দান করতে পারবে এমন সামর্থ্য আমার কোথায়?

—সামর্থ্য থাকলে আমাদের এই দুরবস্থার সময় আমায় ঋণী করে রাখতে পারতেন, তাই না?

ভূতনাথ হঠাৎ হেসে উঠলো। বললে—আমি এত কথাই যদি বলতে পারবো জবা, তাহলে কবে তোমার সমাজে গিয়ে পৈতে টিকি ফেলে দিয়ে ব্রাহ্ম হয়ে যেতাম। আমি তোমার সঙ্গে তর্ক করতে পারবে এমন ক্ষমতা আমার নেই। আমি ও-টাকাটা তোমাকে যৌতুকই দিলাম।

—যৌতুক, কীসের যৌতুক?

ভূতনাথ বললে—তোমাদের বিয়েতে ও-টাকাটা তোমাকে যৌতুক দিলাম মনে করে।

—আপনার কাছ থেকে যৌতুক নেবো কেন আমি? তাছাড়া আপনার সঙ্গে আমার কীসের সম্পর্ক, আপনি এক সময়ে চাকরি করতেন এ-বাড়িতে, সম্পর্কটা বন্ধুত্বেরও নয় কিম্বা…

—কিম্বা…?

জবা হাসলো এবার। বললে–কথাটা আমার মুখ দিয়ে না বলিয়ে ছাড়বেন না দেখছি।

ভূতনাথ বললে—না বলতে চাও বলো না, তোমার ওপর আমার জোরও নেই, কিন্তু এমন কী আমাদের সম্পর্ক যাতে উপহার দেওয়াও যায় না?

—উপহার দেওয়া হয় তো যায়, কিন্তু উপহার নিতে বাধে। আপনার চাকরি নেই; পরের বাড়িতে আশ্রিত আপনি, আপনি তো সব বলেছেন আমাকে। আমার চেয়ে আপনার প্রয়োজন কি কিছু কম?

—টাকার প্রয়োজন হয় তো আমার বেশিই। হয় তো কেন, সত্যিই তাই, কিন্তু টাকার চেয়েও আরো বড় জিনিষ আছে পৃথিবীতে যার কাছে টাকা তুচ্ছ।

জবার মুখ কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বললে—সে জিনিষটা কী? বলতে আপত্তি আছে?

ভূতনাথ বলতে যাচ্ছিলো। কেমন যেন সঙ্কোচ হলো। কথাটা জবা কেমনভাবে গ্রহণ করবে কে জানে। আসলে তত জবার সঙ্গে সম্পর্কটা ঠিক সহজবোধ্য নয়, আর সমানে সমানেও নয়। উত্তর দিতে গিয়ে ভূতনাথের মুখটা কেমন কালো হয়ে উঠলো। কান দুটো গরম হয়ে এল। জবার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো পায়ের তলার মাটি যেন সরে যাচ্ছে। বললে—আজ নয় জবা, আর একদিন বলবো।

–কিন্তু আর যদি বলবার অবকাশ না আসে?

—সে অবকাশ আমি করে নেবে।

—কিন্তু আমার যদি শোনবার অবকাশ না হয় আর?

ভূতনাথ আবার, বিপদে পড়লো। বললে—না-ই বা শুনলে, না হয় আমার কথা আমারই মনে থাক, একদিন ভুল করে তোমাকে অপমান করে ফেলেছিলুম, না-হয় সারা জীবন তারই প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। তোমাদের সাত টাকা মাইনের কেরানীর মুখে এর চেয়ে বেশি কথা না-ই বা শুনতে চাইলে।

—খুব টাকার খোঁটা দিয়ে কথা বলতে পারেন আপনি, কিন্তু সে যাক—এখন থেকে তো টাকার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল আপনার সঙ্গে—আর যেদিন আঁচল ধরে টেনেছিলেন, তখন সহ্য করিনি স্বীকার করি, কিন্তু এখন আমি শুনবই–বলুন।

ভূতনাথ বললে–কিন্তু সুপবিত্রবাবু ওদিকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছেন—তোমার দেরি দেখে হয় তো রাগ করতে পারেন।

—সুপবিত্রবাবুর ওপর ভারি হিংসে আপনার, না?

ভূতনাথ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বললে—রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক মিনিটে এর উত্তর দেওয়া যায় না জবা, দিলেও তুমি তা বুঝবে, আমিও ঠিক বোঝাতে পারবে না। সুতরাং সে-চেষ্টা করবো না আমি। আমি শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করি তোমায়। আজ তো আর আমি এ-বাড়ির কর্মচারী নই। হয় তো এ-বাড়িতে আর আসার অধিকারও থাকবে না, কিন্তু যে-প্রশ্ন করবে, তার ঠিক-ঠিক উত্তর দেবে?

জবা বললে—দেবো, কী বলুন?

কিন্তু ভূতনাথ কথা বলবার আগেই রতন দৌড়ে এসেছে হাঁফাতে হাঁফাতে।

—দিদিমণি, বাবু কেমন করছেন যেন।

জবা চঞ্চল হয়ে উঠলো—কেমন করছেন রতন?

–খোকাবাবু শিগগির আপনাকে ডাকতে পাঠালেন—আপনি চলুন এখুনি।

জবা এক নিমেষে ছুটে চললো আগে আগে। রতনও গেল পেছন পেছন। ভূতনাথও হতবুদ্ধির মতো একমনে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। একবার মনে হলো ফিরে যাবে। কিন্তু এমন দুঃসংবাদ শোনবার পর চলে যাওয়াই বা যায় কী করে? আস্তে আস্তে আবার গিয়ে উঠলো ওপরে। সুবিনয়বাবু আরাম কেদারায় যেমন ভাবে বসেছিলেন, তেমনি ভাবেই হেলান দিয়ে রয়েছেন। চোখ দুটি বোজা, বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে যেন তাঁর। মাঝে মাঝে ছটফট করে উঠছেন।

সুপবিত্র মাথার ওপর ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলে একবার আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে নাকি বাবা?

সুবিনয়বাবুর যেন সে-কথার উত্তর দেবার সামর্থ্যটুকুও নেই।

সুপবিত্র ভূতনাথকে ডেকে বললে—আসুন তো একটু ধরাধরি করে ওঁকে শুইয়ে দিই।

তারপর সুপবিত্র আর ভূতনাথ দুজনে মিলে ধরে সুবিনয়বাবুকে শোবার ঘরে নিয়ে গেল।

তারপর জবার দিকে চেয়ে বললে—জবা, তুমি একটু দেখো—আমি আমাদের ডাক্তারবাবুকে খবর দিই গে—বলে বেরিয়ে গেল সুপবিত্র।

ভূতনাথ নিষ্কর্মার মতো একমনে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। মনে হলো যেন এই সময়ে তারও একটা কিছু উপকারে লাগা উচিত। কিছু কাজ! সুবিনয়বাবুর এই আকস্মিক বিপদে তাদের কিছুটা উপকার করতে পারলে যেন বাচা যেতো।

নিজের বিছানায় শুয়ে সুবিনয়বাবু একবার চোখ খুললেন। তারপর অভিভূতের মতন চারদিকে চাইতে লাগলেন। একবার ভূতনাথের দিকে চেয়ে বললেন—সুপবিত্র কোথায়, চলে গিয়েছে?

জবা বাবার মুখের ওপর নিচু হয়ে বললে তিনি ডাক্তারবাবুকে ডাকতে গিয়েছেন, এখুনি আসবেন।

সুবিনয়বাবু খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন।

জবা জিজ্ঞেস করলে—এখন কেমন লাগছে বাবা?

সুবিনয়বাবু যেন হাসলেন মৃদু মৃদু। একটু বিকৃত হয়ে এল মুখটা। খানিক পরে বললেন-সমাজের ওঁদের একবার খবরটা দাও মা।

জবা আবার বললে—আপনি ভালো হয়ে যাবেন বাবা, আপনি ভাববেন না।

–আর রূপচাঁদবাবুকে একবার খবর দাও, আর ধর্মদাসবাবুকেও খবর দিও ওই সঙ্গে—তারপর খানিকক্ষণ চুপচাপ। তার মধ্যে সুবিনয়বাবু আর একবার বললেন—আচার্যদেবকেও, খবর পাঠাও না মা।

তারপর আবার তন্দ্রা। তন্দ্রাচ্ছন্ন সুবিনয়বাবু নিথর নিস্পন্দ হয়ে পড়ে রইলেন খানিকক্ষণ। তারপর আবার চোখ খুললেন। আবার তন্দ্রা। তারপর তন্দ্রা আর জাগরণের দোলায় জীবন-মৃত্যুর নৌকো এপাশ-ওপাশ করতে লাগলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *