ফরিদের এখন দিন কাটছে চিঠি লিখে। পোস্টাপিসের সামনে সে বল পয়েন্ট নিয়ে বসে। মনি অর্ডার লিখে দেয়, চিঠি লিখে দেয়। মানি অর্ডারে দুটািকা এনভেলাপের চিঠি এক টাকা, পোস্ট কার্ড আট আনা।
ফরিদ একা নয়। খুব কম করে হলেও পনেরো বিশজন মানুষ এই করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের একটা সমিতিও আছে- পত্র লেখক সমিতি। শুরুতে সমিতির লোকজন মারমুখো হয়ে ফরিদের দিকে এসেছিল। ফরিদের চেহারা এবং স্বাস্থ্য দেখে পিছিয়ে গেছে। ফরিদ তাদের সঙ্গে কোন খারাপ ব্যবহার করে নি। বরং মধুর স্বরে বলেছে, বেআইনী কোন কাজ আমি করব না। ভাইসাহেব। সমিতির সদস্য হব। চাঁদা কত বলুন?
তারা সমিতির সদস্য সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে কোন আগ্রহ দেখায় নি। বরং চোখ গরম করে বলে গেছে। এই জায়গায় হবে না। অন্য জায়গা দেখেন। পুরান পাগল ভাত পায় না। নতুন পাগল।
অন্য জায়গা দেখার ব্যাপারে ফরিদ কিংবা কাদের কাউকে তেমন উৎসাহী মনে হল না। এই জায়গাই চমৎকার। কাজটাও ভাল। চিঠি লিখতে তার ভাল লাগে। চিঠি যারা লেখাতে আসে তাদের সঙ্গে অতি দ্রুত ফরিদের ভাব হয়ে যায়। ভাবের একটা নমুনা দেয়া যাক।
খালি গায়ের বুড়ো এক লোক চিঠি লিখাতে এসেছে। বুড়ো বলল- লোহেন পর সমাচার, আমি ভালই আছি।
ফরিদ বলল, পর সমাচার লিখব কেন? পর সমাচার মানেটা কি?
মানেতো বাবা জানি না।
যার কাছে লিখছেন তার নাম কি?
লতিফা।
আপনার কি হয়?
আমার ছোট মাইয়া।
তাহলে এই ভাবে লিখি— মা মনি লতিফা, তুমি কেমন আছ?
জ্বি আচ্ছা বাবা লেহেন। তারপর লেহেন আমি ভালই আছি। তবে তোমাদের জন্য বড়ই চিন্তাযুক্ত।
ফরিদ বলল, আমি একটু অন্য রকম করে লিখি? লিখি— আমার শরীর ভালই আছে তাবে সারাক্ষণ তোমাদের জন্যে চিন্তা করি বলে মন খুব খারাপ থাকে। লিখব?
জি জি লেহেন। আপনের মত কইরা লেহেন। এই মেয়ে আমার বড় আদরের।
আর কি লিখব বলুন?
আপনার মত কইরা লেহেন— ভাল-মন্দ মিশাইয়া।
ফরিদ তরতর করে লিখে চলেছে। এক পৃষ্ঠার জায়গায় তিন পৃষ্ঠা হয়ে যায়। সেই চিঠি পড়ে শুনানোর পর বৃদ্ধ বলে, বড় আনন্দ পাইলাম বাবাজী। বড় আনন্দ। মনের সব কয়টি কথা লোহা হইছে।
বৃদ্ধের আনন্দ দেখে ফরিদ আনন্দ বোধ করে। তার কাস্টমারের সংখ্যা দ্রুত বাড়ে। তবে তার নিয়ম হচ্ছে দিন চলার মত টাকা হয়ে গেলেই লেখালেখি বন্ধ। পার্কের কোন বেঞ্চিতে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা।
এই ব্যাপারটা কাদেরের খুব অপছন্দ। সে চায় লেখালেখি রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত চলুক। মামার অকারণ আলস্যামী দুচোখে বিষ। লিখলেই যখন টাকা আসে তখন এই রকম না লিখে বেঞ্চিতে চুপচাপ শুয়ে থাকবে কেন? ফরিদের এই বিষয়ে যুক্তি খুব পরিষ্কার যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই উপার্জন করতে হবে তার বেশি না। সাধু সন্ন্যাসীরা যে পদ্ধতিতে ভিক্ষা করতেন। সেই পদ্ধতি। যেই এক বেলার মত খাবারের চাল পাওয়া গেল ওমি ভিক্ষা বন্ধ।
আপনের কথার মামা কোন আগাও নাই। মাথাও নাই।
মহা বিরক্ত হয়ে কাদের সিগারেট ধরায়। ফরিদ ক্ৰ কুঁচকে তাকালেই বলে এমন কইরা চাইয়েন না মামা। অখন আপনের সামনে সিগারেট খাইলে দোষের কিছুই নাই। বাড়ির বাইরে আপনেও পাবলিক, আমিও পাবলিক।
তুই পাবলিক ভাল কথা, আমার ঘারে বসে বসে খাচ্ছিস তোর একটু লজ্জা সরমা নেই? রোজগার পাতির চেষ্টা কর।
কী চেষ্টা?
রিকশা চালালে কেমন হয়? পারবি না?
কাদের কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, সৈয়দ বংশের পুলা হইয়া রিকশা চালামু? আপনে কন কি? বংশের একটা ইজ্জত আছে না?
ফরিদ কিছু বলল না। আসলে কথাবার্তা বলার চেয়ে বেঞ্চিতে শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতেই তার ভাল লাগছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের পাল। এই সৌন্দর্য এতদিন চোখের আড়ালেই ছিল। ভাগ্যিস সে পথে নেমেছিল। পথে না নামলে কি এই দৃশ্য চোখে পড়ত? পড়ত না।
মামা?
কী।
চুপচাপ আপনের ঘাড়ে বইসা খাইতেও খারাপ লাগে। কি করি কন দেহি।
ভেবে কিছু একটা বের কর।
ছিনতাই করলে কেমন হয় মামা?
কি বললি?
ছিনতাই।
রিকশা চালানোয় আপত্তি আছে। ছিনতাই-এ আপত্তি নেই?
রিকশা চালাইলে দশটা লোকে দেখব মামা। আর ছিনতাই করলে জানিব কেন্ডা? কেউ না।
তুই আমার সাথে কথা বলবি না।
কি কইলেন মামা?
বললাম যে তুই আমার সথে কথা বলবি না। No talk কথা বললে চড় খাবি।
জে আচ্ছা।
দ্বিতীয় কথা হচ্ছে তুই আমার সঙ্গে হোটেলে খেতেও আসবি না। চোরদের প্ৰতি আমার কোন মমতা নেই।
কাদের ক্রদ্ধ দৃষ্টিতে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপরই হন হন করে হাঁটতে শুরু করল। মনে হল বিশেষ কোন কাজে যাচ্ছে। তার প্রায় মিনিট পনেরো পরে তাকে দৌড়তে দৌড়াতে এদিকে আসতে দেখা গেল। তার হাতে নতুন একটা শ্ৰীফকেইস। পেছনে জনা দশেকের একটি দল। ধর ধর আওয়াজ উঠছে।
ফরিদ ধড়মড় করে উঠে বসল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ব্যাপার কি রে? কাদের হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, দৌড় দেন মামা।
তার কণ্ঠস্বরে এমন কিছু ছিল যে ফরিদ তৎক্ষণাৎ উঠে। ছুটতে শুরু করল। ছুটিতে ছুটতে বললেন, ব্যাপার কি রে?
ছিনতাই করেছি মামা।
সে কি?
চাইয়া দেহেন নতুন ব্রীফকেইস। এখন ধরা পড়লে জানে শেষ করব। আরো শক্ত দৌড় দেন।
ফরিদ হতভম্ব হয়ে বলল, তুই ছিনতাই করেছিস। আমি দৌড়াচ্ছি কেন?
কাদের দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, পাবলিক বড় খারাপ জিনিস মামা। বড়ই খারাপ। এ দুনিয়ায় পাবলিকের মত খারাপ জিনিস নাই।
বিলু এবং আনিসকে স্টীমারে তুলে দিয়ে এসে সোবাহান সাহেব খবর পেলেন যে থানা থেকে টেলিফোন এসেছে। দুজন ছিনতাইকারী ধরা পড়েছে। তারা বলছে সোবাহান সাহেব তাদের চেনেন। তিনি যদি থানায় আসেন। তাহলে ভাল হয়। একটাকে দেখে মনে হচ্ছে গ্যাং লিডার- ইয়া লাস। সোবাহান সাহেব তৎক্ষণাৎ থানায় ছুটলেন। ফরিদ এবং কাদেরকে ছাড়িয়ে আনতে তাঁর বিশেষ বেগ পেতে হল।
স্টীমারে প্রথম শ্রেণীর যে কামরাটা রিজার্ভ করা হয়েছে তাতে দুটি বিছানা। দুর্সীটের কামরা দেখে বিলুর মুখ শুকিয়ে গেল। আনিস কি তার সঙ্গে এই কামরাতেই থাকবে? তা কি করে হয়? টিকিট আনিস করেছে। এই কাজটা কি ইচ্ছা করেই করা? ভদ্রলোক কি একবারও ভাবলেন না। একজন কুমারী মেয়ের সঙ্গে এক কামরায় সারারাত যাওয়া যায় না। বিলু। তার বাবার উপর রাগ করল। বাবার উচিত ছিল, কিভাবে যাওয়া হচ্ছে- এই সব জিজ্ঞেস করা। তিনি তাঁর কিছুই করলেন না। তাদের স্টীমারে উঠিয়ে দিয়ে অতি দ্রুত নেমে গেলেন।
এখন বিলু কি করবে?
আনিসকে ডেকে বলবে- আমরা দুজনেতো একসঙ্গে যেতে পারি না। সেটা শোভন নয়। আপনি অন্য কোথাও ব্যবস্থা করুন। এই কথাও বা কিভাবে বলা যায়?
মানুষটা তো নির্বোধ নয়।
সে এমন নির্বোধের মত কাজ কিভাবে করল? না-কি এই কাজ নিবোঁধের নয়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করা?
স্টীমার পাঁচটায় ছাড়ার কথা, ছাড়ল সাতটায়। আনিস জিনিসপত্র রুমে ঢুকিয়ে সেই যে উধাও হয়েছে আর দেখা নেই। স্টীমারেই কোথাও আছে নিশ্চয়ই। বিলুইচ্ছা করলেই তাকে খুঁজে বের করতে পারে। ইচ্ছা করছে না।
স্টীমারে বিলু কখনো ঘুমুতে পারে না। আজকের এই বিশেষ পরিস্থিতিতে তো ঘুমানোর প্রশ্নই উঠে না। বিলু তিন চারটা গল্পের বই বের করল। জানিতে একটা গল্পের বই কখনো পড়া যায় না। কিছুক্ষণ পর পর বই বদলাতে হয়এখন যে পড়েছে রেমার্কের নাইট ইন লিসবন। নাটকীয় মুহুর্তে সোয়াৎস জার্মানিতে তার স্ত্রীর ঘরে লুকিয়ে আছে। স্ত্রীর বড় ভাই নাৎসী পার্টির সদস্য। আগে সে একবার সোয়ৎিসকে কনসানট্রেশান ক্যাম্পে পাঠিয়েছিল। আবারো ধরা পড়লে মৃত্যু ছাড়া উপায় নেই। এমন সব নাটকীয় মুহুর্ত তবুও বইয়ে মন বসছে না। চাপা এক ধরনের অস্বস্তিতে মন ঢাকা।
খাওয়া দাওয়া হয়েছে?
বিলু বই থেকে মুখ তুলল। আনিস দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। বিলু, শুকনো গলায় বলল, জ্বিনা, এখনো খাওয়া হয়নি।
রাত কিন্তু অনেক হয়েছে, খেয়ে নিন। দশটা পাঁচ বাজে।
আপনি খাবেন না?
আমি খেয়ে নিয়েছি।
কোথায় খেলেন? স্টীমারে?
জ্বি।
আমি কিন্তু সঙ্গে দুজনের মত খাবার এনেছিলাম।
কোন অসুবিধা নেই। আপনি খেয়ে নিন। খাওয়া-দাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে শুয়ে ঘুম দিন।
যে চাপা অস্বস্তি বিলুকে চাড়া দিচ্ছিল তা কেটে গেল। ভাগ্যিস যে নিজ থেকে কিছু বলেনি।
বললে খুব লজ্জায় পড়তে হত।
আনিস বলল, এক বেডের কামরা ছিল না বলে দুই বেডের কামরা নিতে হয়েছে। অনেকগুলো টাকা খামাখা বেশি গেল। আপনি খাওয়া দাওয়া সেরে নিন। ওদেরেকে বলেছি। এগারোটার সময় আপনাকে চা দিয়ে যাবে।
চা?
আমি একদিন লক্ষ্য করেছি। রাতের খাবারের পর পর আপনি চা খান, সেই কারণেই বলা।
আপনি ঘুমুবেন কোথায়?
ট্রেন, বাস এবং স্টীমারে আমি ঘুমুতে পারি না। প্লেনের কথা জানি না। প্লেনে কখনো চড়িনি। আমি তাহলে যাচ্ছি।
বিলুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আনিস চলে গেল। আর ঠিক তখন বিলুর মনে হল এই কামরায় গল্প করতে করতে দুজন রাতটা কাটিয়ে দিতে পারত। তাতে অসুবিধা কি হত? কিছুই না। আমরা আধুনিক হচ্ছি। কিন্তু মন থেকে সংস্কারের বাঘ তাড়াতে পারছি না। কি মূল্য আছে এইসব সংস্কারের?
বিলু চমকে উঠল, কি সব আজে বাজে কথা সে ভাবছে? তাহলে সে কি মনের কোন গভীর গোপনে আশা করেছিল আনিস থাকবে এই ঘরে? রাতটা কাটিয়ে দেবে গল্প করতে করতে? ছিঃ কি লজ্জার কথা। এমন একটা গোপন বাসনা তার কি সত্যি আছে? এই লজা সে কোথায় রাখবে? ভাগ্যিস একজন মানুষ অন্য একজন মানুষের মনের গোপন জায়গাগুলো দেখতে পায় না। দেখতে পেলে পৃথিবী আচল হয়ে পড়তো।
রাতের খাবার বিলু খেতে পারল না। তার অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। টি-পটে করে চা দিয়ে গেল এগারোটার দিকে। তখন বিলুর মনে হলে দুজন মিলে এক সঙ্গে বসে চা তো খেতে পারে। এর মধ্যে তো অন্যায় কিছু নেই। এটা হচ্ছে সাধারণ ভদ্রতা। এই সাধারণ ভদ্রতাকে আনিস সাহেব নিশ্চয়ই অন্য কিছু ভেবে বসবেন না।
বিলু দরজা লক করে আনিসের খোজে বের হল।
আনিস দোতলায় ডেকে চাদর পেতে চুপচাপ বসেছিল। তার দৃষ্টি অন্ধকার নদীর দিকে। নদীতে টিমটিমে আলো জ্বলিয়ে মাছ ধরা নৌকা বের হয়েছে। আকাশের নক্ষত্রের মতো মাছধরা নৌকার আলোগুলো ঔজ্জ্বল্য বাড়ছে কমছে। আনিসের দৃষ্টিতে আত্মমগ্ন একটা ভাব যা দূর থেকে দেখেতে ভাল লাগে। কি ভাবছে। এই মানুষটি? তার স্ত্রীর কথা? কতটুকু ভালবাসতো সে তার স্ত্রীকে? সেই রকম ভাল কি অন্য কাউকে বাসা যায় না? না-কি এক জীবনে মানুষ একজনকেই ভালবাসতে পারে?
আচ্ছা সে যদি এখন আনিসের পাশে গিয়ে বসে তাহলে তা কি খুব অশোভন হবে? সে-কি বসবে তার পাশে? হালকা গলায় বলবে আপনার সঙ্গে গল্প করতে এলাম। আপনি কি ভাবছেন?
আনিস সাহেব নিশ্চয় লজ্জা পাওয়া গলায় বলবেন, কিছু ভাবছি নাতো। সে বলবে, কি দেখছেন? তিনি বলবেন, কিছু দেখছি না, তাকিয়ে আছি। সে বলবে, আপনাদের এদিকে খুব হাওয়াতো।
ভেবে রাখা কথাবার্তা কিছুই হলো না। আনিস এক সময় হঠাৎ লক্ষ্য করল বিলু দাঁড়িয়ে। সে উঠে এল। বিলু বলল, আপনার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে একটু উঠে আসুনতো। আনিস উদ্বিগ্ন গলায় বলল, কোন সমস্যা হয়েছে না-কি?
হ্যাঁ সমস্যা হয়েছে।
কি সমস্যা?
কেবিনে আসুন তারপর বলব। স্টীমারে কেবিনে দুজন মুখোমুখি বসল। বিলু বলল, আগে চা শেষ করুন তারপর বলছি। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে কি-না কে জানে; অনেকক্ষণ আগে দিয়ে গেছে।
আনিস নিঃশব্দে চা শেষ করল। বিলুর আচার-আচরণ ভাবভঙ্গি সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। তাকে খানিকটা বিভ্রান্ত, খানিকটা উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বারবার শাড়ির আঁচলে সে কপাল মুছছে। আনিস বলল, ব্যাপার কি বলুন তো?
বলছি। ব্যাপার কিছু না। আপনাকে চা খাবার জন্যে ডেকেছি। না-কি এক কেবিনে আমার সঙ্গে বসে চা খেতে আপনার আপত্তি আছে?
আনিস বিস্মত হয়ে বলল, আপত্তি থাকবে কেন?
আমাকে এখানে রেখে হুট কর পালিয়ে গেলেন সেই জন্যে বলছি।
আনিস নিজেও এবার খানিকটা বিভ্ৰান্ত হল। এই মেয়েটি এ রকম কেন?
বিলু বলল, চুপ করে বসে আছেন কেন? গল্প করুন।
কি গল্প করব?
আপনার স্ত্রীর কথা বলুন।
তার কোন কথা?
আচ্ছা তাকে কি আপনি খুব ভালবাসতেন।
এখনো বাসি।
খুব বেশি?
হ্যাঁ খুব বেশি।
আচ্ছা আপনার যদি অনেক টাকা পয়সা থাকতো তাহলে আপনি কি আপনার স্ত্রীর জন্যে তাজমহল জাতীয় কিছু বানাতেন?
না।
না কেন?
ভালবাসা খুবই ব্যক্তিগত ব্যাপার। ঢাক ঢোল পিটিয়ে তার প্রচার করার কোন কারণ দেখি না।
আচ্ছা আপনাদের বিয়ে কিভাবে হয়?
কোর্টে হয়। ওর বাবা মা আমার মত ভ্যাগবন্ডের কাছে বিয়ে দিতে রাজি ছিল না। এদিকে ও নিজেও খুব অস্থির হয়ে উঠেছিল কাজেই….
আপনি কিছু মনে করবেন না একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞেস করছি— আমি তোমাকে ভালবাসি। এই বাক্যটা আপনাদের দুজনের মধ্যে কে প্রথম ব্যবহার করল?
আমার স্ত্রী।
আমিও তাই ভেবেছিলাম। বিয়ের প্রসঙ্গ কে প্রথম তুলল, আপনি না উনি?
সেই তুলল! সে খুব লাজুক ধরনের মেয়ে ছিল কিন্তু নিজের কথা বলার ব্যাপারে সে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ করেনি।
বিলু আবারো শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল ঘসল। উদ্বিগ্ন চোখে এদিক ওদিক তাকাল তার পরপরই আনিসকে সম্পূর্ণ হতচকিত করে বলল, আমি আপনাকে ভালবাসি এবং আপনার সঙ্গে আমার বিয়ে হোক এটা আমি মনেপ্ৰাণে চাই। এই কথাগুলো অনেকদিন আমার মনের মধ্যে ছিল বলতে না পেরে কষ্ট পাচ্ছিলাম। আজ বলে ফেললাম। আপনি যদি আমাকে বেহায়া ভাবেন তাতেও আমার কিছু যায় আসে না।
আনিস কিছুই বলল না।
অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। এত বিস্মিত সে এর আগে কখনো হয় নি।
বিলু মাথা নিচু করে বলল, আপনি যদি এখন চলে যেতে চান চলে যেতে পারেন। আর যদি চান আমরা দুজনে মিলে সারা রাত গল্প করি তাও করতে পারেন।
আনিস দেখল বিলুর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এই কারণেই সে মাথা নিচু করে বসে আছে।
আনিস বলল, বিলু তোমার কি দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বরিশালে আছে?
হ্যাঁ আছে।
তাহলে বরিশালে নেমেই আমরা যে কাজটা করব তা হচ্ছে ঐ দুজনকে নিয়ে ম্যারেজ রেজিস্টারের কাছে যাব। কি বল?
আচ্ছা।
আমার মত অবস্থায় লোকজনকে জানিয়ে পাগড়ি টাগড়ি পরে বিয়ে করার অর্থ হয় না। এইবার তুমি চোখ মুছে আমার দিকে তাকাও তো। কাঁদবার মত কিছু হয় নি। আমার মত একজন অভাজনের জন্যে তোমার মত একটা মেয়ে কাঁদবে তা হতেই পারে না। তাকাও আমার দিকে।
না। আমি তাকাতে-টাকাতে পারব না।
বিলু বলল, তাকাতে পারবে না। কিন্তু জলভরা চোখে তাকাল। এই কয়েকটি মুহুর্তের জন্যে বিলুকে কি সুন্দর যে দেখাল তা সে কোনদিন জানবে না।