নির্বাচিত কলাম – আজ না হোক, দুদিন পর
আমার ছোট বোন খুব সাজতে পছন্দ করে। সেদিন নতুন একটি শাড়ি পরবার পর কপালে পরেছিল লাল টিপ, দুহাতে অনন্ত বালা, কানে ও গলায় নানা অলঙ্কার। আমরা দুজন কথা বললেই লোকে বলে চারদিকে অলৌকিক বেজে ওঠে একশ তানপুরা, আমরা হাসলেই পৃথিবীর সব শিশু হেসে ওঠে, বৃক্ষ গা দোলায়, পাতায় পাতায় নেচে ওঠে হলুদ রঙের পাখি।
সেদিন আমরা দুবোন ধানমণ্ডি থেকে গ্রীন রোডের দিকে যাচ্ছিলাম, রিকশায় আসছিলাম, তখন দুপুর সাড়ে বারো। বৈশাখের রোদেলা দুপুরে রিকশার পাল তুলে বসেছি দুজন (রিকশার হুড তোলাকে পাল তোলা বলতেই আমার ভাল লাগে বেশি)। তখন হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ, আমাদের রিকশার সামনে এসে হাত উঁচু করে দাঁড়াল একটি ছেলে, বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। হাত উঁচু করবার অর্থ রিকশা থামানো। চাদ চাইবার জন্য কিছু ছেলে এরকম রিকশা থামায়, বলে—ফুটবল খেলব চাঁদা চাই, মোহরমের উৎসব হবে চাঁদা চাই, অথবা মসজিদ বানাব, মিলাদ পড়াব চাঁদা চাই। আমরা অনুমান করি চাঁদা চাইবার জন্যই আমাদের গতি রোধ করা হল।
অথচ যে ছেলের চাঁদা চাইবার কথা, আমাদের কাছে যে ছেলের বিনীত প্রস্তাব রাখবার কথা—সেই ছেলের হাতে আমরা দু’জনই যুগপৎ লক্ষ্য করি ছাঁইঞ্চি লম্বা একটি ছোরা। যে ছোরা রান্নাঘরে পিঁয়াজের ডালায় অসহায় পড়ে থাকে—ঠিক সে ছোরাই যখন রাস্তায় কোনও মানুষের হাতে উঠে আসে, যে মানুষ পথ আটকায়—তখন সেই সামান্য ছোরাই যে কী ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, আমি সেই মুহুর্তে টের পেলাম। পথ রোধ করেছিল একটি ছেলে, হরণের বেলায় দৌড়ে এল একই রকম ছোরা হাতে একই বয়সের আরেকটি ছেলে। আমাদের তখন অনুমান করবার সময় নেই দ্বিতীয় ছেলেটি কোথায় দাঁড়ানো ছিল অথবা কেথেকে ছুটে এল। কারণ ওদের মুখ থেকে মদের ঝাঁঝাল গন্ধের সঙ্গে ‘যা আছে সব দে’ জাতীয় বাক্য যখন নির্গত হল, আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমাদের যাবতীয় টাকা-পয়সা, ঘড়ি ইত্যাদি খুলে দিতে। আমার চোখের সামনে আমার ছোটবোন এক এক করে খুলে দিল তার শখের সমস্ত জিনিস।
তখন সময় এমন নয় যে রাস্তায় মানুষজন নেই, খুব ফাঁকা; দিব্যি মানুষ হাঁটছে, চলছে—এমন কোনও সরু গলি নয় যে ধু ধু দুপুরে কেবল কাক ছাড়া আর কিছু ডাকে না। ধানমণ্ডি থেকে গ্রীন রোডে যাবার রাস্তা খুব একটা জনাকীর্ণ না হলেও নির্জন নয়। তখন আমাদের সেই ঘটনার সময় কাছে পিঠে কম করে হলেও বারো জন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ দাঁড়ানো ছিল।
ছেলে দুটো পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্কুটারে উঠে দ্রুত চলে গেল। আমি হতবাক ওই দুটো হতভাগ্য ছেলের জন্য নয়, রাস্তায় নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা ওই বারো জন পুরুষের জন্য। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটি নাটক উপভোগ করেছে মাত্র। আর কিছু নয়। আজকাল মানুষ বোধহয় আর মানুষের প্রয়োজনে আসে না।
যদি ওই দুপুরে ডজনখানেক লোকের চোখের সামনে ওই ছেলে দুটো এসে বলত—আয়, ওই স্কুটারে উঠে আয়, আমি জানি খুব বাধ্য মেয়ের মত ধারাল ছোরার মুখে আমাকে উঠে বসতে হত স্কুটারে। স্কুটার সাঁ করে চলে যেত সকলের নাকের ডগা দিয়ে। কেউ কিছুই বলত না।
যদি ওই দুটো ছেলে, রাস্তায় একশ লোকের সামনে বলত— খোল, কাপড় খোল, যদি প্রকাশ্য রাস্তায় কেউ আমাদের চরম অসম্মান করত কে রুখে দাঁড়াত, কে আসত প্রতিবাদ করতে ? কেউ না ।
এতগুলো জলজান্ত মানুষ সেদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখল। কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ এগিয়ে আসে না। নারী নিয়ে ঘরে বাইরে যা কিছুই ঘটে সবই হয় মজার ঘটনা। কেউ মজা করে, কেউ মজা দেখে। নারীর কোনও দুর্ঘটনা মানুষকে যত মজা দেয়, সম্ভবত আর কোনও দুর্ঘটনা মানুষকে অত মজা দিতে পারে না।
কেউ হয়ত মুখে আহা বলে, কেউ হয়ত চিৎকার করে দাবি তোলে কিছু একটার। আসলে কিন্তু সকলেই মজা পায়। পত্রিকাঅলারা হত্যা ও ধর্ষণের খবর ছেপে যত আনন্দ পায়, তত আর অন্য কিছুতে পায় না। অধিকাংশ পাঠক নারী অপহরণ ও নির্যাতনের নিখুঁত বর্ণনা পড়ে যত আনন্দ পায়, তত আর অন্য কিছুতে পায় না। – রাস্তায় সেদিন আমাদের দুরবস্থা দেখে মানুষ কেবল হাততালি দিতে বাকি রেখেছে, এ হাততালি আজ না হোক, দুদিন পর দেবে। এখনও ধর্ষণ ঘটে লুকিয়ে-চুরিয়ে, দুদিন পর প্রকাশ্য রাস্তায় ঘটবে। আজ যারা এ্যাসিড ছেড়ে আড়ালে-আবডালে, দুদিন পর তারা প্রকাশ্যে ছুঁড়বে। আজ হত্যাকাণ্ড ঘটে নির্জন অন্ধকারে, দু’দিন পর ঘটবে প্রকাশ্য দিবালোকে। আজ দর্শক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখে। কাল দর্শক উল্লাস করবে, সিটি বাজাবে।