1 of 2

২৩. নানুভাই তখন তিনজন লোকের কাছে

নানুভাই তখন তিনজন লোকের কাছে কোন কিছুর হিসেব চাইছে। আনন্দকে চোখের কোণায় একবার দেখে নিয়ে তোক তিনটেকে বলল, আমি দুনম্বরী কথায় একদম মাথা ঠিক রাখতে পারি না। অ্যালার্জি, অ্যালার্জি জানো? সেইটে হয় আমার। সোজা ব্যবসা কর আমি তোমার সঙ্গে আছি। যাও, পাশের ঘরে যাও। তোমাদের পনেবো মিনিট সময় দিচ্ছি হিসেব ঠিক করার জন্যে। কথা শেষ করে সে ইঙ্গিত করতে আর একটা লোক এগিয়ে এসে তোক তিনটেকে ইঙ্গিত করল পাশের ঘরে যাওয়ার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে ওদের একজন ভেঙে পড়ল, ভাইসাব, এই রকম হবে না, আমি কথা দিচ্ছি এই রকম হবে না। লোকটার গলায় কান্না এসে গেল। কিন্তু নানুভাই সেসব কথা যেন শুনতেই পেল না। আনন্দর পথপ্রদর্শককে ইঙ্গিত করল ব্যাপারটা জানানোর জন্যে। লোক তিনটে বাধ্য হল পাশের ঘরে চলে যেতে।

পথপ্রদর্শক লোকটি বলল, এই ছোকরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। এখানে ওখানে খোঁজ নিচ্ছিল। বলছে কোন পেপারের লোক।

আঃ! নানুভাই এগিয়ে এল। ওর বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে নির্ঘাৎ। গায়ের রঙ গভীর কালো।

পেপারের লোক! আমার মত সামান্য লোকের কাছে, একি তাজ্জব ব্যাপার। কোন্ পেপার?

আনন্দ সম্প্রতি প্রকাশিত একটি দৈনিকের নাম করল।

নানুভাই সেটার কথা বোধ হয় মনে করার চেষ্টা করল। তারপর বলল, দেখুন ভাই,পেপারের লোক খুব দুনম্বরী হয়। কলকাতার চারটে কাগজে আমাদের দোস্ত আছে। উপকার করার সময় তারা নানান ফ্যাকড়া দেখায়। আপনি কোন ধান্দায় এসেছেন?

আজকের একটা কাগজে আপনার সম্পর্কে কিছু লেখা হয়েছে, আপনি জানেন? খুব সহজ ভঙ্গিতে প্রশ্নটা করল আনন্দ।

সঙ্গে সঙ্গে নানুভাই হাসল, আরে হাতি হাটে আপন মনে আর কুত্তা চেঁচায়। ওই কাগজে কি লেখা হল তা আমি হোড়াই কেয়ার করি।

কিন্তু আপনার সঙ্গে মিনিস্টারের নাম জড়ানো হয়েছে।

এই তো আপনাদের ধান্দা। মিনিস্টার কোন ঝামেলায় থাকেন না অথচ তাকে টানা হল। আমি ইচ্ছে করলে ওই রিপোর্টারকে বস্তির ভিতরে তিরিশ বছর রেখে দিতে পারি। কিন্তু মিনিস্টার চান না আপনাদের গায়ে হাত দিতে। কাগজগুলো বড্ড চেঁচায়। নানুভাই ঘুরে দাঁড়াল, আপনি কি জানতে চাইছেন? স্পষ্ট করে বলুন!

দেখুন, এই খবরটা আমাদের কাগজে বের হয়নি। এই সব খবরের পেছনে সত্যি আছে কিনা বোঝা যায় না। তাই এডিটর চান আপনার সঙ্গে আলোচনা করে তবে রিপোর্ট করতে।

কয়েক পা এগিয়ে নানুভাই টেলিফোনের রিসিভার তুলল। ডায়াল শেষ হলে কান থেকে রিসিভার সশব্দে নামিয়ে বলল, কুত্তাকা বাচ্চা! টেলিফোনের লোকগুলো, কেউ কাজ করতে বলে না কেন? এ কালু! গমগমে গলায় নানুভাই যাকে ডাকল সে তৎক্ষণাৎ চলে এল, মিনিস্টার সাহেবকে টেলিফোনে ধর। রাইটার্স বিল্ডিংস-এ আছে। কালু নামের লোকটা তৎক্ষণাৎ টেলিফোন নিয়ে বসে গেল। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল আনন্দ, নানুভাই একগাল হেসে বলল, আরে, আপনি এতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন। ছি ছি! গোস্তাকি মাপ করবেন। বসুন, কি খাবেন?

কিছু না। আপনি কি আমাকে কিছু সময় দেবেন?

সময়? নানুভাই ঘড়ি দেখল, আধঘণ্টার মধ্যে তিন নম্বর ব্লকে দুটো নলকূপ বসাতে যেতে হবে। লোকগুলো খুব জলের কষ্টে আছে।

এই কাজটা তো কর্পোরেশনের, আপনি করছেন কেন?

বাঃ, আমার মানুষদের জন্যে আমি করব না? কর্পোরেশনকে বলেছি তোমাদের ওপর আমার লোকদের বিশ্বাস নেই। যা করবার আমি করব, তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।

এখানকার লোকগুলো আপনাকে কি মানে?

প্রশ্নটা শুনে ঘর ঝাঁপিয়ে হাসল নানুভাই, এর উত্তর আমি জানি না। আপনি জিজ্ঞাসা করুন। আপনি ওদের কাছে গিয়ে জানুন। মশাই, সব থেকে বড় ধান্দা হল পেটের। এই এলাকার বেশির ভাগ মানুষের পেট আমি ভবাই। ওদের বিপদে আমি পাশে দাঁড়াই। মিলা?

কালু দ্বিতীয় বার ঘাড় নাড়তেই নানুভাই এগিয়ে গিয়ে রিসিভার ধরলেন, নানু, হ্যাঁ, না কোন গোলমাল নেই, আরে আপনি একবার বলুন আমি ও শালা রিপোর্টারের বদলা নেব চুন-চুন করে। ওই তো মুশকিল, হাঁ একজন রিপোর্টার এসেছে আমার কাছে, ওই শালা রিপোর্টার যা লিখেছে সে সম্পর্কে জানতে চায়! হাঁ, ঠিক হ্যায়, রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে নানুভাই জিজ্ঞাসা করল গলা নামিয়ে, কোন্ পেপার বললেন যেন আপনি? আনন্দ নামটা মনে করিয়ে দিতে সে মাথা নাড়ল, ঠিক হ্যায়, আমি কথাবার্তা বলে নিচ্ছি। রাত্রে দেখা হবে।

রিসিভার নামিয়ে রেখে নানুভাই বললেন, আপনি কি চান বলুন তো?

আনন্দ জবাব দিল, শুধু এই রিপোর্টটা সত্যি কি-না তাই জানতে চাই।

বিলকুল ঝুটা। মিনিস্টার আমাকে ভালবাসেন, আমি ভালবাসি পাবলিককে। অ্যান্টি পার্টি বদমাইশি করে এই সব লিখিয়েছে। নানুভাইকে আবার ঘড়ি দেখতে দেখল আনন্দ।

আপনার যা জনসংযোগ, ইলেকশনে দাঁড়ালে তো আপনি এম এল এ হয়ে যেতেন। আপনারও তাহলে অ্যান্টি পার্টি আছে এখানে?

হিন্দুস্থানে কার কবে অ্যান্টি পার্টি ছিল না বলতে পারেন? এ শালা শেটাই হল বেইমানের দেশ। নানুভাই হাসল, ইলেকশনে দাঁড়াবে মিনিস্টার, আমি কে? অতুল্যবাবুকে আমার এই জন্যে খুব পছন্দ। সত্যিকারের শরিফ আদমি। হাঁ, কি জানতে চান বলুন, আমার টাইম নেই।

একটু সিরিয়াস হবার চেষ্টা করে আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, এই এলাকায় আপনার প্রতাপ কি করে হল?

খুব সোজা কথা। পাবলিককে ভালবাসলাম, পাবলিকও ভালবাসল।

আপনি কি খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ?

নিশ্চয়ই! ধর্ম ছাড়া আমার আর কি আছে?

এলাকায় আপনার ধর্মাবলম্বীরাই সংখ্যায় বেশি। অন্য ধর্মের মানুষের আপনার সম্পর্কে কি ধারণা?

একথা তাদের জিজ্ঞাসা করুন ভাই। কার মনে কি আছে তা আমি বলব কি করে!

এই এলাকায় ভারতীয় নয় এমন অনেক লোক আশ্রয় নিয়েছে। তাদের পাসপোর্ট ভিসার বালাই নেই। এই লোকগুলোকে আপনি শেলটার দিচ্ছেন বলে অভিযোগ।

কি ফালতু কথা। এখানকার প্রত্যেকটা লোকের রেশনকার্ড আছে। মাসতিনেক থাকলেই ভোট দিতে পারে। যারা এই সব অধিকার পায় তারা ফোরেনার? আমার এলাকার পাশেই বর্ডার নেই। এখানে আসতে হলে অনেক মাইল পেরিয়ে আসতে হবে। যদি বহুৎ লোক এইখানে আশ্রয় নেয় তাহলে সরকারের পুলিশ ডিপার্টমেন্টটা তুলে দিতে বলুন। লোকগুলো যখন এল তখন আটকাতে পারল না? যারা রেশনকার্ড ইস্যু করল তারা কি দেখে করল? যারা ভোটে নাম তুলল তারা কি অন্ধ? আমি শেলটার দিচ্ছি? আমার কাছে যে এসে আশ্রয় চাইবে আমি তাকে ফিরিয়ে দেব না। এইবার নানুভাইকে উত্তেজিত দেখাল।

অভিযোগ উঠেছে এই এলাকা স্মাগলারদের সাম্রাজ্য। কত টাকার লেনদেন হয় প্রতি মাসে?

ও হিসেব আমি দেব না। তবে প্রত্যেকটা লোক যারা আমার সঙ্গে আছে তাদের দেখভাল করার দায়িত্ব আমার! দেখুন রিপোর্টার ভাই, আজ আমার সময় নেই। আপনি আর একদিন আসুন। তবে একটা শর্ত, আমার বিরুদ্ধে কিছু লিখতে পারবেন না। নানুভাই চিৎকার করল, এ কা-ন! উনলোগকো হিসাব মিল গিয়া? পুছ লেও।

আপনি যদি মানুষের উপকার করেন তাহলে আপনার বিরুদ্ধে লিখব না। কিন্তু আনার মিনিস্টার নাকি বলেছেন আপনার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। কথাটা ঠিক?

হাসিতে মুখ ভরে গেল নানুভাই-এর, এক কাজ করুন। মিনিস্টারের বাড়ি চেনেন?

চিনে নেব।

পরশু সন্ধ্যেবেলায় চলে আসুন। আমিও থাকব সেখানে। তখনই বাতচিত হবে। তার আগে কিছু লিখবেন না। আর একটা কথা, আমার এলাকায় বেশি ঘুরবেন না। দুনম্বরী লোক ভেবে যে কেউ আপনার ক্ষতি করতে পারে। নানুভাই ইঙ্গিত করতে সেই পথপ্রদর্শক সামনে দাঁড়াল।

ওই সরু গলিতে একবার ঢুকলে বের হওয়া নতুন লোকের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। গোলকধাঁধা বললে কম বলা হবে। দুপাশে যে সমস্ত মানুষ দাঁড়িয়ে বসে কথা বলছে তাদের চেহারা সুবিধের নয়। তারা আনন্দর দিকে তাকাচ্ছে কৌতূহলী চোখে, কিন্তু পথপ্রদর্শকটির ওপর নজর পড়ামাত্র শীতল হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ একজন সৌম্য চেহারার বৃদ্ধকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল আনন্দ। তারপর বাংলায় জিজ্ঞাসা করল, আপনি ভোট দেন?

লোকটি মাথা নাড়ল। তারপর চমৎকার হিন্দীতে জানাল, বাংলা ভাল বোঝেন না, হিন্দীতে বল। পথপ্রদর্শক বুঝতে পারছিল না কি করবে? নানুভাই আনন্দকে সমীহ করে কথা বলেছে এবং কোন নির্দেশ দেয়নি তাকে। আনন্দ যতটা সম্ভব কাছাকাছি হিন্দীতে প্রশ্ন করল, কেন ভোট দেন?

এলাকায় থাকব বলে। নানুভাই বলে তাই আমরা দিই।

কাকে দেন ভোট?

লোকটি মন্ত্রীমশাই-এর নাম উচ্চারণ করল। আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, মন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ আছে?

লোকটি হাসল, নানুভাই-এর সঙ্গে আলাপ থাকলেই কাজ হয়, মন্ত্রীকে প্রয়োজন হয় না।

কেন?

এ প্রশ্নের জবাব আমি দেব না। আমি কেন এলাকার কেউ দেবে না। আপনি কে?

আমি খবরের কাগজে কাজ করি। আপনি এখানে কতদিন এসেছেন?

সেভেনটি ওয়ান। ঢাকা থেকে চলে এসেছি।

কি করে চলে?

ডকে নানুভাই-এর বিজনেসে মদত দিই।

লোকটি কথাটা বলামাত্র পথপ্রদর্শক বলল, চলুন সাহেব, আমার অন্য কাজ আছে। অতএব আনন্দ পা চালাল।

পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সে বলল, নানুভাইকে সবাই খুব ভালবাসে, না?

পেটের ধান্দা বড় ধান্দা। লোকটা কথা বলতে পেরে বোধ হয় খুশি হল, ভোটর কথা আপনি বলছিলেন না? এখানে প্রায় সবাই ভোট দেন। মিনিস্টার-ফিনিস্টার সব ফালতু, আসলে নানুভাই যা বলবে তাই হবে। আগে যে এম এল এ ছিল সে নানুভাইকে টেক্কা দিতে চেয়েছিল, এখন একদম আউট! আমাদের এলাকায় পুলিশ পর্যন্ত ঢোকে না। লোকটা কথা বলছিল প্রায় মন খুলেই। হঠাৎ কাউকে দেখে চুপ করে গেল।

বাস স্ট্যান্ডে এসে ট্যাকসি নিল আনন্দ। এই সময় লোকটা মুখ বাড়িয়ে বলল, সাহেব, আপনাকে যেসব কথা বললাম তা কাউকে বলবেন না। এসব বলা ঠিক না।

ট্যাকসিতে আসতে আসতে আনন্দ নানুভাইকে অনেক রকম করে বিশ্লেষণ করতে চেষ্টা করছিল। হঠাৎ ট্যাকসিটা দাঁড়িয়ে যেতেই সামনে তাকিয়ে বুক ধক করে উঠল আনন্দর। সঙ্গে সঙ্গে তার হাত চলে গেল কোমরে। একটা পুলিশের জিপ সামনে দাঁড়িয়ে। একজন অফিসার এবং সেপাই এগিয়ে এসে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করল, ডক থেকে তো? নাম শালা গাড়ি থেকে!

ড্রাইভার কাতর গলায় বলল, না স্যার, ডক থেকে না, এই বাবু একটু আগে ট্যাকসি নিলেন।

অফিসার এবার আনন্দর দিকে তাকালেন, অ্যাই, কি আছে সঙ্গে?

কিছু নেই।

কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

নানুভাই-এর কাছ থেকে। চটজলদি নামটা ব্যবহার করল আনন্দ। অফিসার ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। ভেতরটা মুহূর্তে কেমন ফঁকা হয়ে গেল ওর। কিন্তু নামটা যে ম্যাজিকে মত কাজ করবে তা কল্পনাতেও ছিল না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ইশারা করলেন ড্রাইভারকে এগিয়ে যেতে। একটু ব্যাক করে গাড়িটা বের করে আনছিল যখন ড্রাইভার তখন অফিসার তার বাহিনী নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন জিপের দিকে।

ড্রাইভার বলল, আপনার জন্যে বেঁচে গেলাম দাদা। আনন্দ উত্তর দিল না।

 

বেশ কিছুটা কষা মাংস আর তন্দুরীর রুটি নিয়ে আনন্দ যখন ফিরল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। বৃদ্ধা দরজা খুলে আনন্দকে দেখে একটু থমকে গেলেন, এত রাত কবে বাড়িতে ফেরা আমি মোটেই পছন্দ করি না। আজ ওপরে বসে খাওয়া চলবে না, তাকে বল নিচে আসতে।

আনন্দ মাথা নাড়ল, ঠিক আছে। আমি ঘণ্টাখানেক বাদেই আসছি। সুদীপ এসেছে?

বৃদ্ধা মাথা নাড়লেন, ছেলেটা ভাল। ওর বাপ যা বলেছে তা সত্যি বলে আমি ভাবতেই পারি না। আমার সঙ্গে কালীঘাটে গিয়ে মায়ের কাজ করে আসবে বলেছে। বাপ-ছেলের এই যুদ্ধের কথা কে কবে শুনেছে বল? তোমার বাপের সঙ্গে গোলমাল নেই তো?

আনন্দ মাথা নাড়ল, আমার বাবা বেঁচে নেই।

ও। বৃদ্ধা থমমত হয়ে একটু সময় নিলেন, মা?

মা আছেন, গ্রামের বাড়িতে।

আহা! পিতৃহারা ছেলের দায়িত্ব খুব বেশি। মায়ের দুঃখ দূর করবে তুমি। না হলে সন্তান কিসের?

বৃদ্ধা ঘুরে ঈড়াতেই আনন্দ ওপরে উঠে এল। সুদীপ কল্যাণ জয়িতা গোল হয়ে বসে তাস খেলছে। জয়িতাই বলল, ওই যে, এসে গেছে! উঃ, কি চিন্তা হচ্ছিল।

চুপ কর। মা-মা ভাব করিস না। ওই বস্তুটি আবার আমদানি করলি কেন?

সময় কাটানোর পক্ষে দারুণ জিনিস। তুই শালা নাইনটিন সেঞ্চুরির বিধবা। সিগারেট খাস না, মদ তো প্রশ্নই ওঠে না, কোন মেয়ের সঙ্গে আজ পর্যন্ত প্রেম করলি না, আবার তাসেও অ্যালার্জি! সুদীপ নাটক করে কথাগুলো বলছিল। কল্যাণ এক হাতে তাস খেলছিল। সেটা অবশ্যই মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়।

আনন্দ বলল, কি ব্যাপার, খুব ফুর্তিতে আছিস মনে হচ্ছে!

তাস নামিয়ে রেখে সুদীপ বলল, দারুণ রি-অ্যাকশন। রেসকোর্সের সামনে গিয়ে দেখি গেটের বাইরে পাবলিক দাঁড়িয়ে আছে। এখানে ওখানে ভিড়। কিন্তু কেউ ঢুকছে না। ওপাশে যে মেম্বার্স এনক্লোজারটার সামনে গাড়ির লাইন লাগতো সেখানটা আবও ফাঁকা। আমি একদম নেকু সেজে একটা রেসের বই বিক্রি করা ছোকরাকে কি ব্যাপার জিজ্ঞাসা করতে সে বলল রেসকোর্সে নাকি বোমা পড়বে সেই ভয়ে কেউ ঢুকছে না। পাবলিকের প্যানিক যদি দেখতিস: শেষ পর্যন্ত ভেতর থেকে অ্যানাউন্স করল অনিবার্য কারণে আজ রেস বন্ধ থাকল। পুলিশে পুলিশে রেসকোর্স ভরতি ছিল। হেস্টিংসের স্টেবল থেকে ঘোড়াগুলো নাকি মালিকেরা আনতে চায়নি। এক একটা ঘোড়ার দাম নাকি লাখ দু লাখ। হেভি লস হয়ে গেল গভর্নমেন্টের। তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে পার্ক স্ট্রীটে চলে গেলাম। একটা পাবলিক টেলিফোনে সবকটা কাগজকে যা তুই বলেছিল তাই বলেছি। লোকগুলো প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। বলেছে, আপনি যে ওদের দলে তার প্রমাণ দিন। সুদীপ হাসতে লাগল।

খবরটা খুব পছন্দ হল কল্যাণের। সে আনন্দকে বলল, ব্যাপারটা বেশ, না? ধর, তোর কাছে কাগজপত্র নেই। কিছু লোক তোকে ধরে পরিচয় চাইল। তুই বললি। তারা প্রমাণ দেখাতে বলল। কোন প্রমাণ নেই। তোর পরিচয় সঠিক কিনা সেটা প্রমাণ করবে তোর পারিপার্শ্বিক। তোর আত্মীয় বন্ধু স্কুল কলেজ। কিন্তু তুই না।

আনন্দ কোন জবাব দিল না। তার ভাল লাগছিল। সে এই রকমটাই হবে ভেবেছিল। কাগজে ওই হুমকির খবরটা পড়ে লোকে ভয় পাবে। তারা নিজেদের প্রাণের মায়ায় আজ রেসকোর্সে যাবে না। কিন্তু সেটা আজ অথবা পরের দিন। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা না ঘটলে আবার পিলপিল করে টুকবে তারা। কিন্তু মেম্বার্স এনক্লোজার, সুদীপ যা বলছে, অমন ফাঁকা হবে সে আশা করেনি। তাহলে কলকাতার উচ্চবিত্তরাই বেশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়েছে? কিছু একটা করা দরকার। হুমকিটা যে অহেতুক নয় এটা বুঝিয়ে দেওয়া দরকার। আজ যে লোকটা সংসারকে বঞ্চিত করে রেস খেলতে টাকা নিয়ে এসেছিল সে নিশ্চয়ই হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরে তার কিছু টাকা সংসারের পেছনে খরচ করেছে। কিন্তু এইটুকু তো তাদের পরিকল্পনায় ছিল না।

জয়িতা আনন্দকে লক্ষ্য করছিল। জিজ্ঞাসা করল, তোর কি খবর?

আনন্দ ওদের বিশদ বলল। একটা কাগজে যতটা সম্ভব জায়গাটা এঁকে দেখাল সে। তারপর বলল, নানুভাই লোকটার হাতের পুতুল হল এই মন্ত্রী। দেখলে মনে হবে আচরণে রবিনহুড, চেহারায় গব্বর সিং। কিন্তু ওকে প্রচণ্ড ভয় পায় এলাকার লোক। মানুষ যার কাছে উপকার পায় তাকে ভয় করে না। তাছাড়া ওখানে নানুভাই-এর চর ছড়ানো রয়েছে। একা একা বস্তির ভেতরে ঢোকা বেশ বিপজ্জনক হবে। অতএব নানুভাই-এর মুখোশটার নিচে যে মুখটা রয়েছে তা বীভৎস হতেই হবে। আমি সাহস পাইনি বেশি ঘাঁটানোর। ওখানে যদি আমাকে পুঁতেও রাখতো তাহলে পৃথিবীর কেউ টের পেত না। আমি ভয় পেয়েছিলাম, হয়তো নানুভাই আমার কাছে রিপোর্টারের আইডেন্টিটি কার্ড চাইবে। কিন্তু লোকটার অশিক্ষা এবং রিপোর্টার শব্দটা শোনার পরে এমন কিছু প্রতিক্রিয়া হয়েছিল যার জন্যে ওটা ওর মাথায় আসেনি। ওই এলাকায় পুরো স্মাগলিং-চেনটা কন্ট্রোল করে নানুভাই। শুধু বাংলাদেশ থেকে নয়, পাকিস্তান থেকেও এখানে লোক আসছে বলে আমার ধারণা। একবার এলাকায় ঢুকে পড়লে রেশন কার্ড এমন কি ভোটিং রাইট পর্যন্ত পেতে অসুবিধে নেই। এম এল এ, মন্ত্রী হাতের মুঠোয়। তাদের নির্বাচন নানুভাই দেখাশোনা করে। অদ্ভুত জোট। লোকটা দাঙ্গা তৈরি করতে পারে প্রয়োজন হলে। আর পুলিশের সঙ্গে ওর সম্পর্কের চেহারা তো আসবার সময় দেখলাম। সুতরাং আমার মনে হয় আগামী পরশু আমাদের যাওয়া উচিত।

কল্যাণ চট করে বলে বসল, এত তাড়াতাড়ি?

সুদীপ বলল, মানে? এখানে অনন্তকাল বসে থাকতে তোর ভাল লাগছে। আমি তবু মাঝে মাঝে বেরুচ্ছি, তোদের তো দম বন্ধ হবার কথা। পুলিশের ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকার কোন মানে হয় না। তাছাড়া এই লোকটাকে মিট করতে খুব ইচ্ছে করছে।

জয়িতা বলল, মিনিস্টারটার কথা ভাব। খবরের কাগজ খুললেই ওর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেখা যাবে। ওর দলের লোকেরাই ওকে বলেছে বেশি কথা না বলতে। অথচ এই লোকটাই!

আনন্দ বলল, আমাকে একটু ভাবতে দে কিভাবে এগোবো। লোকটা হঠাৎ আমাকে মন্ত্রীর বাড়িতে যেতে বলল। এটা কোন ট্রাপ কিনা কে জানে। আমাকে দেখে ওর কোন সন্দেহ হয়েছে কিনা বুঝতে পারছি না। তবে খবরের কাগজের ছবির সঙ্গে মেলাতে পারেনি। পারলে আমাকে ছাড়তো না। ওহো, উনি আমাদের খেতে ডেকেছেন। আজ ওপরে খাওয়া চলবে না। তোরা রুটি মাংস খেয়ে নে। সুদীপ চল, নিচে যাই, ওকে ছেড়ে দেওয়া উচিত।

জয়িতা জিজ্ঞাসা করল, তুই রুটি মাংস এনেছিস? ফার্স্ট ক্লাস!

সুদীপ উঠল, বেশ আছিস! আমরা খাচ্ছি নিরামিষ আর তোরা মাংস সাঁটাচ্ছিস! কিছু মাল রেখে দিবি, আমি এসে খাব। চল আনন্দ।

বৃদ্ধা সামনে বসে ওদের খাওয়ালেন। আনন্দর খুব ভাল লাগছিল। মাটিতে বসে খেতে খেতে সে দেখছিল বৃদ্ধা সামনে বসে ওদের সঙ্গে কথা বলছেন। ওঁর হাতের পাখা মাঝে মাঝে তাদের হাওয়া দিচ্ছিল। দেখলেই শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কথা মনে আসে। এই শেষ, এই জেনারেশনের সঙ্গে সঙ্গেই শরৎবাবু শেষ হয়ে যাচ্ছেন। কি ভালই না ছিল সম্পর্কগুলো। বৃদ্ধা কথা বলছিল সুদীপের মায়ের কাজ নিয়ে। কালীঘাটের পুরোহিতকে টাকা ধরে দিলেই সব করে দেবে সে। এখনও হাতে কয়েকটা দিন সময় আছে। বৃদ্ধার আজ মনে হয়েছে, তারও তো কেউ করার নেই। নিজের কাজটা নিজেই করে গেলে কেমন হয়! কি রকম বিষণ্ণ হয়ে গেল পরিবেশটা! এবং তার সঙ্গে মানানসই হল কাপড়ে ওঁর চোখ মোছা। সুদীপ কোন কথা বলছিল না। কিন্তু আনন্দর মনে হল সুদীপটা ভাগ্যবান। নইলে এমন দূরের সম্পর্ক, যাওয়া আসা প্রায় নেই যেখানে সেখানে একজন জীবন থেকে প্রায় সরে যাওয়া মানুষের এই রকম আন্তরিকতার স্পর্শ পাওয়াটা কম কথা নয়।

 

খাওয়া শেষ হয়ে এলে সুদীপ বৃদ্ধাকে উঠে যেতে দেখে আনন্দকে জিজ্ঞাসা করল, কল্যাণদের কথা বলব? এই রকমই কথা ছিল। কিন্তু হঠাৎ নিজের কাছেই বাধোবাধো ঠেকতে লাগল আনন্দব। এই বিশ্বাস এবং সেহ নষ্ট হতে পারত আজ সকালে অবনী তালুকদারের কথা শুনে। কিন্তু হয়নি। এবং এখন ইনি নিজে থেকেই সুদীপের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন। হঠাৎ যদি জানতে পারেন ওঁরই বাড়ির ছাদেব ঘরে দুটি ছেলেমেয়ে গোপনে বাস করছে তাহলে চট করেই অবিশ্বাস আসবে। সুদীপ সম্পর্কে তাঁর এই নরম অনুভূতি দূর হবেই এবং আজ অবনী তালুকদারের কথাগুলো সত্যি বলে বোধ হবে। সে ইশাবা করল সুদীপকে কিছু না বলতে।

এই সময় পাশের দরজায় ক্রমাগত শব্দ শুরু হল। বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে বারান্দায় এলেন, আবার কি জ্বালাতন— এই ধরনের কিছু বলে উঠোনে নেমে গলা তুলবেন, কে? কি চাই? এত রাত্রে কেন?

ওপাশ থেকে চাপা গলায় শোনা গেল, দিদিমা, তাড়াতাড়ি খুলুন সর্বনাশ হয়ে গেছে।

বৃদ্ধা ছুটে গেলেন। ওদের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। শেষ কথাটা কানে আসায় ওরা কোনমতে হাত ধুয়ে উঠোনে নামল। বৃদ্ধা পেছনের দরজা খুলতেই একজন মধ্যবয়স্ক রোগা লোক সামনে এসে দাঁড়াল, দিদিমা আমাকে বাঁচান। ও–ও মনে হয় বিষ খেয়েছে।

কি খেয়েছে? বিষ? বৃদ্ধা আঁতকে উঠলেন, ওমা কি সব্বনেশে কাণ্ড। বিষ খেতে গেল কেন?

আমার দোষ! বিশ্বাস করুন, কিন্তু তাতে যে বিষ খাবে ভাবিনি। একটা কথা শুনে বাড়ি ফিরে ওকে খুব বকেছিলাম। তারপর চুপচাপ ছিল। হঠাৎ দেখি কাতরাচ্ছে। জিজ্ঞাসা করায় বলল ও মরে যেতে চায় বলে বিষ খেয়েছে। আমি এখন কি করি? লোকটি অসহায় গলায় বলছিল।

মরেনি তো! তাহলে হাসপাতালে নিয়ে যাও। দাঁড়িয়ে দেখছ কি? গাড়ি ডাক! বৃদ্ধা ধমকালেন।

আহা আপনি বুঝতে পারছেন না! হাসপাতালে নিয়ে গেলেই পুলিশ কেস হবে। এখন চারপাশে যেরকম গৃহবধূ হত্যার কেস হচ্ছে তাতে আমাকে ফাঁসিয়ে রে ওর ভাইরা। ও তো বলবে আমি বকেছি বলে বিষ খেয়েছি।

লোকটির অবস্থা সত্যি করুণ। সে এবার আনন্দদের দেখতে পেল। বৃদ্ধা বললেন, চল তো, যদি তেমন দেখি তাহলে তো হাসপাতালে নিয়ে যেতেই হবে। তোমার পাশের ভাড়াটে জানে?

না। তাহলে আজ রাত্রে পৃথিবীর সব লোক জেনে যাবে। লোকটি বৃদ্ধাকে অনুসরণ করছিল।

বৃদ্ধা দরজার আড়ালে যেতে যেতে জিজ্ঞাসা করলেন, তেঁতুলজল আছে? আর নুন? নিয়ে এস এখনই।

সুদীপ বলল, কেসটা কি, একবার দেখা দরকার।

আনন্দ আপত্তি করল, না। খামোক জড়াস না। আমাদের অনেক ঝামেলা আছে।

সুদীপ বলল, কে বিষ খেয়েছে বুঝতে পারছিস? পুকুরধারের সেই মেয়েটা, আমার কাছে নিমপাতা চেয়েছিল। এই লোকটা মনে হচ্ছে ওর স্বামী। এমনও তো হতে পারে ও-ই বিষ খাইয়ে এখানে এসে অ্যাক্টিং করছিল! সকালে যাকে দেখেছি সে বিষ খাবে ভাবাই যায় না।

এই সময় বৃদ্ধা চলে এলেন এপাশে। ওদের দিকে তাকিয়ে থতমত হয়ে গেলেন। তারপর না বলে যেন পারলেন না, চোখ উলটে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। আমি বলে দিলাম হাসপাতালে নিয়ে যেতে। ছেলেটার কোন দোষ নেই। নির্দোষীরাই তো মরে।

হঠাৎ সুদীপ জিজ্ঞাসা করল, প্রাণ আছে?

এখনও আছে মনে হচ্ছে।

উনি যদি হাসপাতালে না নিয়ে যান তাহলে তো আরও বিপদ। মারা গেলে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার ডাক্তার পাবেন না। যা হয় তোক, ওর উচিত স্ত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া। আমি একবার দেখতে পারি?

তুমি! তুমি আবার কি দেখবে? তুমি ডাক্তার নাকি? বৃদ্ধা উড়িয়ে দিতে চাইলেন।

আমি ফার্স্ট এইড ট্রেনিংটা নিয়েছিলাম। সুদীপ তার গলায় আত্মবিশ্বাস বোঝাল। বৃদ্ধা যে ধন্ধে পড়লেন। মনে হচ্ছিল ওই ঝামেলায় সুদীপ যেন না জড়ায় সেটাই ওঁর কাম্য ছিল। কিন্তু সুদীপের ট্রেনিং-এর খবরটা শোনার পর সরাসরি না বলতে বাধছে।

তিনি মাথা নেড়ে ডাকলেন, এসো। দুজনেই এসো। যেন শুধু সুদীপকে নিয়ে যেতে তিনি সাহস পাচ্ছেন না। দরজার গায়েই সিঁড়ি। দুই ভাড়াটের অস্তিত্ব একটা পার্টিশন তুলে আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। সামনের ঘরের দরজা ভেজানো ছিল। ভেতরের অল্প আলোর সামান্যই বাইরে আসছে। বৃদ্ধা দরজাটা খুলতেই ওরা একটা টেবিলল্যাম্প জুলতে দেখল। যুবতী শুয়ে আছে খাটেব ওপর। ওর পায়ের কাছে মাথায় হাত রেখে সেই লোকটি কঁদছে যতটা সম্ভব নিচু গলায়। বৃদ্ধা বললেন, কি ঠিক করলে? এরা আমার বাড়িতে এসেছে। খুব ভাল ছেলে। এসবের চিকিৎসা জানে বলল। দ্যাখো তো বাপু, কিছু করতে পার কিনা। না পারলে খামোক এখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোন দরকার নেই।

সুদীপ এগিয়ে গেল বিছানার পাশে। পড়ে থাকা হাতটা তুলে পালস্ দেখল। জীবনের চিহ্ন রয়েছে এবং সামান্য দ্রুত ছাড়া কোন অস্বাভাবিকতা নেই। বিষ খেলে কারও দাঁত লেগে যায় বলে সে জানতে না। কিন্তু মহিলার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে অবস্থা প্রায় শেষেব দিকে। অথচ নাড়ি তার বিপরীত কথা বলছে। সে লোকটিকে বলল, বমি কবনো যায় এমন কিছু আনুন।

বমি? কি খেলে বমি করে? অত্যন্ত নির্বোধের মত প্রশ্নটা করল লোকটা। ঠিক কাকে করল তা সে নিজেই জানে না। বৃদ্ধা বললেন, এসো আমার সঙ্গে, আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আনন্দ চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল আলোর পেছনে। সে লক্ষ করছিল মহিলার সঙ্গে স্বামীর বয়সের পার্থক্যটা অনেক। সেদিন দোতলার জানলা থেকে ভাল কবে নজরে পড়েনি, আজ স্পষ্ট হচ্ছে, এই মহিলার শরীরে ঈশ্বর বাড়াবাড়ি রকমের যৌবন দিয়েছেন। জয়িতা কল্যাণ একে দেখলে সুদীপকে আর একটু বেশি ঠাট্টা সহ্য করতে হত। সুদীপ মহিলার পায়ের তলায় হাত বোলাতে প্রতিক্রিয়া হল। পা নড়ে উঠে স্থান পরিবর্তন করল। সে উঠে চোখের পাতা টেনে দেখল। তারপব আনন্দর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি বুঝতে পারছি না। বিষের লক্ষণ বিশেষ নেই।

আনন্দ বলল, তুই ডাক্তার নস, এই সব ঝামেলায় না জড়ালেই ভাল করতিস।

এই সময় লোকটি ফিরে এল একটা বড় পাত্র নিয়ে, দিদিমা বললেন এটা খাওয়াতে।

সুদীপ বলল, আপনি খাওয়ান।

লোকটিকে খুব নার্ভাস দেখাল, না না, আমি পারব না। আপনি চেষ্টা করুন, প্লিজ। আমার মাথায় কিছু আসছে না। কি যে করি ছাই।

পাত্রটা হাতে নিয়ে সুদীপ হুকুম করল, বালতি আনুন। বমি হলে ফেলবে কোথায়?

লোকটি আবার ছুটে বেরিয়ে গেল। এবার সুদীপ মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় বলল, আপনার কিছুই হয়নি। কিন্তু ওইভাবে পড়ে থাকলে এই তরল পদার্থটি গিলে বমি করতে হবে। ভেবে দেখুন কি করবেন? বেশি সময় নেই।

আনন্দ অবাক হয়ে দেখল পলকের জন্যেই মহিলার দুটো চোখের পাতা খুলে গেল। অদ্ভুত একটা শিরশিরে হাসি ফুটে উঠল ঠোঁটে। তারপর মায়াবী গলায় বলল, আমি ওকে ভয় দেখাতে চাই যাতে জীবনে আর গায়ে হাত না তোলে। ওটা গেলাবেন না, দোহাই!

পায়ের শব্দ পাওয়া মাত্রই চোখ বন্ধ করল যুবতী। লোকটি একটা বালতি হাতে নিয়ে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, কোথায় রাখব? মাথার পাশে রাখি? কিভাবে খাওয়াবেন? শুয়ে শুয়ে কি গিলতে পারবে?

সুদীপ মাথা নাড়ল, না। মনে হচ্ছে ওর আর খাওয়ার দরকার হবে না। বিষটা মনে হচ্ছে বুকের নিচে নামেনি। যেমন শুয়ে আছে তেমন শুয়ে থাকতে দিন।

বিপদ হবে না? মারা যাবে না? লোকটি যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না কথাটা।

কেন? মারা গেলে কি আপনি খুশি হতেন? সুদীপ আনন্দকে ইশারা করে বেরিয়ে যাচ্ছিল।

না না। আমি ওকে প্রচণ্ড ভালবাসি, কিন্তু ঠিক যত্ন করতে পারি না। আপনি বলছেন কোন বিপদ নেই! আঃ বাঁচালেন। তাহলে এইটে ফেলে দিই? লোকটি তরল পদার্থটি দেখাল।

আপনার যা খুশি।

ওরা এপারে এসে দরজা বন্ধ করতেই দেখল বৃদ্ধা চুপচাপ জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে এই পাশে তাকিয়ে আছেন। কেমন ভৌতিক মনে হল আনন্দর। মুখোমুখি হওয়ামাত্র বৃদ্ধা প্রশ্ন করলেন, কেমন দেখলে? কি বুঝলে?

সুদীপ মাথা নাড়ল, ওর কিছুই হয়নি। স্বামীকে জব্দ করার জন্যে বিষ খাওয়ার ভান করছেন। তবে আজ রাত্রে একথা স্বামীকে না বলাই ভাল হবে।

ধীরে ধীরে বৃদ্ধার মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটল। তিনি হাত বাড়িয়ে সুদীপের চিবুক ছুঁয়ে ঠোঁটে আঙুল স্পর্শ করলেন, জিতে গেলে বাবা! ও যে বিষ খায়নি তা আমি দেখেই বুঝেছিলাম। কিন্তু তুমি যখন যেতে চাইলে তখন ইচ্ছে হল পরীক্ষা করে দেখি। না, অবনী খামোকা মিথ্যে দোষ দিয়ে গেল, তুমি সত্যি খাঁটি ছেলে। বৃদ্ধা আর দাঁড়ালেন না। সেই নির্জন জ্যোৎস্নায় প্লাবিত উঠোনে দাঁড়িয়ে সে আনন্দর দিকে মুখ তুলে তাকাতেই তাকে ঝাঁপসা দেখতে পেল। কেন যে ঈশ্বর মানুষের শরীরে এত জল দেন?

 

মোমবাতির আলোয় উপুড় হয়ে শুয়ে আনন্দ নোট করছিল। ওর সামনে ম্যাপটা খোলা। ম্যাপের একটা অঞ্চল ও দাগিয়ে রেখেছে গোল করে। উত্তর বাংলার শেষ প্রান্তে একদিকে সিকিম, ভুটান আর নেপালের জঙ্গলগুলো ছাড়িয়ে ও পর পর কয়েকটা জায়গার ওপর চোখ বোলাচ্ছিল। ট্রেন বা বাসে ওখানে পৌঁছাতে নিউ জলপাইগুড়ি দিয়ে যেতে হবে। অথবা শিলিগুড়ি। মুশকিল হল, এইটেই তার পছন্দ হচ্ছে না। সে দার্জিলিং গিয়েছে। সুদীপ এবং জয়িতাও ছেলেবেলায় ওদিকে গিয়েছে। কিন্তু কেউ বাংলার বাইরে পা দেয়নি। চারজনে একসঙ্গে রওনা হলে আর পৌঁছাতে হবে না। ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন বাগডোগরা পর্যন্ত যায়। সেখান থেকেও ম্যাপের জায়গাটায় পৌঁছাতে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। ওই জায়গাটায় পৌঁছাতে পারলে আর যাই হোক পুলিশের ভয়ে কাটা হয়ে থাকতে হবে না সব সময়। কিন্তু বাস বা জিপ যে পর্যন্ত যায় সেই পর্যন্ত গিয়ে তারপর হাঁটতে হবে। কল্যাণ কি হাঁটতে পারবে? ওর হাত সারতে এখনও অনেক দেরি আছে। কিন্তু কলকাতায় আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না। সুদীপ হঠাৎ উপুড় হল। ম্যাপের গোল দাগানো জায়গাটায় নজর রাখল। তারপর বলল, কি কি জিনিস সঙ্গে নেওয়া দরকার তার একটা লিস্ট বানানো দরকার।

বল তো! আনন্দ ওর দিকে তাকাল।

ওষুধ। সাপে যদি কামড়ায় তার জন্যে। বিষ ব্যাপারটা মাথায় আসার পর থেকেই মনে হচ্ছে। লেখ, পেট খারাপ হলে কম থেকে হাইডোজের সব রকমের ট্যাবলেট এবং ক্যাপসুল। প্রত্যেকটা একশ করে। উলটোদিকে কিছুটা জোলাপ এবং হজমের ট্যাবলেট। জ্বরের ওষুধ। সব রকমের। পোড়া এবং কাটার জন্যে ওষুধ মলম। ঠাণ্ডা লাগলে যা দরকার তাই। বেশ কিছু অ্যান্টিসেপটিক। ট্যাডভ্যাক ইনজেকশন। মাথা ধরার ওষুধ। ব্যান্ডেজ। স্কিন ডিজিজের ওষুধ। বরফে ঘা হলে তার জন্যে যা দরকার। বুকের ব্যথার ওষুধ। রক্ত বন্ধ হবার ইজেকশন। চোখ কান দাঁত-এর লোশন ট্যাবলেট। সব রকম অ্যান্টিবায়োটিক। অর্থাৎ একটা মিনি ডিসপেন্সারি। হাসিস না, এটা খুব কাজে লাগবে। আমরা যদি জনমানবশূন্য জায়গায় পৌঁছাই তাহলে এগুলোই বাচাবে।

যদি অবশ্য ওষুধের ডেটগুলো পার না হয়ে যায়। আর?

প্রত্যেকের দুসেট শক্ত জুতো। শক্ত কিন্তু হালকা। চামড়ার না হলে ভাল হয়। জিনসের প্যান্ট প্রত্যেকের অন্তত ছটা করে। জিনসের জ্যাকেট। গরম ওভারকোট। ওয়াটার প্রুফ। গ্লাভস।

এসব নিয়ে হাঁটতে পারবি?

পারতে হবে। কাল তোতে আমাতে সারাদিন এইসব কেনাকাটি করব। একই দোকানে একসঙ্গে এত মাল চাইলে সন্দেহ করতে পারে। তাই সময় লাগবে। পরশুদিন আমরা ওই নানুভাই-এর সঙ্গে দেখা করতে মন্ত্রীর বাড়িতে যাচ্ছি?

নানুভাই-এর সঙ্গে দেখা করতে নয়, মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করাই উদ্দেশ্য। নিশ্চয়ই যাচ্ছি। উই নিড হিম। কিন্তু যাব তুই আর আমি। তুই যাবি আমার সঙ্গে ক্যামেরাম্যান সেজে। একটা ফালতু ক্যামেরা

আজ ব্যবস্থা করতে হবে। কল্যাণের বের হবার দরকার নেই।

কিন্তু বাইরের গাড়িতে কেউ থাকবে না আমাদের কভার করতে?

জয়িতা থাকবে। সন্ধ্যের পর ওকে আর মেয়ে বলে বোঝা যাবে না। কিন্তু এবার তুই গাড়ি পাবি কোথায়? ট্যাকসিতে যেতে মন চাইছে না।

এটা আমার ওপর ছেড়ে দে। কিন্তু পরশুর অপারেশন যদি সাকসেসফুল হয় তাহলে আমরা রওনা হচ্ছি কবে?

পরশুই এই আস্তানা ছাড়তে হবে আমাদের। আমি আর তুই বাই রোড বেরিয়ে যাব। আর জয়িতা কল্যাণ পরের দিন ফ্লাইট ধরবে এয়ারপোর্টের থেকে। আনন্দ জানাতেই কল্যাণের গলা ভেঙে এল, অপারেশনের সময় আমাকে বাদ দেওয়া চলবে না। আমার একটা হাত এখনও ঠিক আছে। এত আন্ডারএস্টিমেট করছিস কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *