২৩. ধনু শেখ পালকি নিয়ে পাখি শিকারে

ধনু শেখ পালকি নিয়ে পাখি শিকারে বের হয়েছেন। হাওরে শীতের হাঁস নেমেছে। দেশান্তরী পাখির মাংস তিনি খান না। বহুদূর দেশ থেকে উড়ে আসে বলে এদের পাখা শক্ত, মাংসও শক্ত। মাংসে বালি বালি স্বাদ বলে এইসব বিদেশী পাখির আরেক নাম বালিহাস। এত ঝামেলা করে বালি খাওয়ার কোনো মানে হয় না। ধনু শেখ হরিয়াল শিকারে বের হয়েছেন। হরিয়াল ঘুঘু সাইজের পাখি। গায়ের রঙ সবুজ মেশানো হলুদ। এই পাখি বটগাছের পাতার আড়ালে লুকিয়ে থাকে। বটফল খায়। অন্যসব পাখি মাছ খায়, শামুক ঝিনুক খায়। হরিয়ালের খাদ্য ফল বলেই এর মাংস অতি সুস্বাদু। মাখনের মতো নরম।

ধনু শেখের সঙ্গে যাচ্ছেন ইমাম করিম। গুলিবিদ্ধ পাখিকে তিনি ‘আল্লাহু আকবর’ বলে জবেহ করবেন, তখনি শুধু মাংস হালাল হবে।

পালকির দরজা খোলা। ইমাম দরজার পাশে আছেন। ধনু শেখ গল্প করছেন। ইমামকে হ্যাঁ  ই দিতে হচ্ছে। বড় মানুষদের সঙ্গে গল্পগুজবের কিছু নেই। বড় মানুষরা গল্প করবেন অন্যরা শুধু ই দিবে। ধনু শেখের গন্তব্য তিন বটের মাঠ। বান্ধবপুর থেকে পাঁচ ছয় ক্রোশ দূরে। যেতে সময় লাগে। তিন বটের মাঠে বটগাছের সংখ্যা কিন্তু তিন না, চার। এই চার বটগাছ চক্রাকারে বড় হয়েছে। অতি দর্শনীয় ব্যাপার।

ধনু শেখ বললেন, বটগাছের সংখ্যা চার। কিন্তু নাম তিনবটের মাঠ। কারণ কী ইমাম?

করিম বলল, জানি না জনাব।

ধনু শেখ বললেন, জগতের বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর একটাই— জানি না। আফসোসা। তুমি কখনো তিনবটের মাঠে গিয়েছ?

জি-না।

বড়ই সৌন্দর্য। ভাদ্র মাসে সেই মাঠে হাওরের পানি উঠে। চারটা বটগাছের মাথা শুধু দেখা যায়। আর কিছু না। এই দৃশ্য একবার যে দেখবে সে ভুলবে না। পানির উপরে বটগাছের মাথা। সেই মাথায় কিচিরমিচির করছে হরিয়াল। এক গাছ থেকে উড়ে অন্যগাছে বসছে। মনে হয় বেহেশতেও এত সুন্দর দৃশ্য নাই।

করিম বললেন, বেহেশতের সৌন্দর্য বুঝার ক্ষমতা মানুষের নাই জনাব। পৃথিবীর সৌন্দর্য একরকম, বেহেশতের সৌন্দর্য অন্যরকম।

তাও ঠিক। বেহেশতে তো যেতে পারব না। পৃথিবীর যা কিছু সুন্দর তা দেখাই আমার জন্যে যথেষ্ট। এখন বলো, তোমাকে এত চিন্তাযুক্ত লাগছে কেন?

করিম জবাব দিল না।

ধনু শেখ বললেন, মনে ফুর্তিা রাখা আমাদের কর্তব্য। মাসে কমপক্ষে একবার রক্ত দর্শন করলে মনে ফুর্তি আসে। মেয়েছেলেদের মনে ফুর্তি থাকে বেশি, কারণ তারা প্ৰতি মাসে একবার রক্ত দেখে। আমাদের পুরুষদের এই সুবিধা নাই বিধায় আমাদের পশুপাখি শিকার করতে হয়। পশুপাখির রক্ত দেখতে হয়। বুঝেছ?

জি।

তোমার স্ত্রীর হিল্লা বিবাহের কিছু কি হয়েছে?

এখনো হয় নাই।

কিছুই বুঝলাম না! কেন কেউ আগায়া আসতেছে না? শুনেছি তোমার স্ত্রী রূপবতী, বয়সও অল্প।

করিম জবাব দিলেন না। ধনু শেখ বললেন, মন দিয়া শোন কী বলি। আমি এক রাতের বিবাহে রাজি আছি। তোমার একটা উপকার হবে এইজন্যেই রাজি। এই বিবাহ হৈচৈ আমোদ-ফুর্তির বিবাহ না। একরাতের মামলা। বিবাহ তো তুমি নিজেই পড়াতে পার। ঠিক না?

জি।

পাখি শিকারের পর পালকি নিয়া তোমার বাড়িতে যাব। তুমি বিবাহ পড়াবে। পালকিতে বউ নিয়া আমি আমার ঘরে যাব। পরের দিন সকালে পালকি দিয়া কন্যা তালাক দিয়া ফেরত পাঠাব। তুমি নিজের স্ত্রী ফেরত পাইবা। সুখে ঘরসংসার করবা। ঠিক আছে?

করিম জবাব দিল না। হরিয়াল শিকারে ধনু শেখ কেন তাকে নিয়ে এসেছেন তা এখন স্পষ্ট হয়েছে। ধনু শেখ বললেন, চুপ করে আছ কেন বুঝলাম না। এমন কোনো নিয়ম কি আছে যে যার সঙ্গে হিল্লা বিবাহ হবে তার ঠ্যাং থাকতে হবে? লুলা পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হবে না।

এরকম কোনো নিয়ম নাই।

তাহলে তো তোমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। মুখ ভোতা করে রাখছি কেন? হাসো। স্ত্রীর অন্য পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হবে এইজন্যে মন খারাপ? এক রাতের মামলা।

তিনবটের মাঠের বটগাছ দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। চারদিকে খোলা প্রান্তর, মাঝখানে হঠাৎ ঝুড়ি নামানো চারটা বিশাল বটগাছ। হরিয়াল পাখির ঝাক এক গাছ থেকে আরেক গাছে যাচ্ছে, এই দৃশ্য এতদূর থেকেও দেখা যাচ্ছে।

ধনু শেখ বললেন, আমি শুনেছি বিসমিল্লাহ বলে যদি গুলি করে পাখি মারা হয় তাহলে সেই পাখি হালাল।

ভুল শুনেছেন। পশুপাখি শিকার কিংবা যুদ্ধের শুরু বিসমিল্লাহ বলে করা যাবে। न।

তাহলে যুদ্ধ শুরু করব কীভাবে?

তখন বলতে হবে ‘আল্লাহ আকবর’। আল্লাহই শ্ৰেষ্ঠ।

ধনু শেখ প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন, তুমি কি তাবিজকবচ দিতে পার? যদি পাের আমার মেয়ে আতরকে একটা তাবিজ দিবা। তার ঘুরাফিরা রোগ হয়েছে। এইখানে ওইখানে ঘুরে। কোনো একদিন জিন-ভূতের নজরে পড়বে। আমি অস্থির থাকি।

 

আমগাছের নিচে শিবশংকর বসে আছে। তার সামনে আতর। আতরের হাতে অ্যালুমিনিয়ামের বাতিটে বড়ই ভর্তা। ঢেঁকিতে বড়ই কুটে ঝাল কাঁচামরিচ দিয়ে তাকে এই ভর্তা বানিয়ে দিয়েছে হামিদা। ভর্তাটা খেতে এতই ভালো হয়েছে যে শিব শংকরের জন্যে খানিকটা নিয়ে এসেছে। আতর নিশ্চিত ভোরবেলায় আমগাছের কাছে এলেই শিব শংকরের দেখা পাওয়া যাবে।

শিবশংকর বলল, আমি বড়ই ভর্তা, আম ভর্তি এইসব খাই না।

আতর বলল, খান না কেন?

ঝাল দেয়া হয় এইজন্যে খাই না। আমি কাঁচামরিচ খেতে পারি না।

আশ্চর্য তো!

আশ্চর্যের কিছু নাই। অনেকেই অনেক কিছু খেতে পারে না। তুমি কি জানো ভারতবর্ষে কাঁচামরিচ ছিল না?

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি। তারা তরকারি ঝাল করত আদা দিয়ে আর গোলমরিচ দিয়ে।

কাঁচামরিচ কোথেকে এসেছে?

পর্তুগীজরা নিয়ে এসেছে। শুধু কাঁচামরিচ না, তারা আলু এনেছে। এই দেশে আগে আলু ছিল না। তুমি আলু খাও?

হুঁ। তবে আমার পছন্দ কাঁঠালের বিচি। আচ্ছা, কাঁঠালও কি পর্তুগীজরা এনেছে?

না।

আতর ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ইশ কাঁঠাল যে কেন পর্তুগীজরা আনল না!

শিবশংকর বিস্মিত হয়ে বলল, পর্তুগীজরা কাঁঠাল আনলে কী হতো?

আতর বলল, আমার ভালো লাগত।

কেন?

জানি না কেন।

শিবশংকর বলল, এক টুকরা কাগজ আর একটা কলম হাতের কাছে থাকলে তোমাকে মজার একটা জিনিস দেখাতাম।

আতর চোখ উজ্জ্বল করে বলল, কী দেখাতেন?

প্রমাণ করতাম যে, এক সমান দুই।

এক সমান দুই হবে কেমনে?

এখানেই তো মজা।

আতর বলল, আমি একটা কাঠি নিয়ে আসি, আপনি মাটিতে লিখে দেখান।

আতর কঞ্চি নিয়ে এসেছে। শিবশংকরের পাশে উবু হয়ে বসেছে। শিবশংকর উৎসাহ নিয়ে আঁকাআঁকি করছে। আতর দেখছে মুগ্ধচোখে।

মনে করা,

x = y এখন আমি উভয়পক্ষকে y দিয়ে গুণ করলাম। তাহলে কী হবে?

xy = y2

এখন আমি উভয়পক্ষ থেকে x2 বাদ দিলাম। তাহলে কী হবে?

xy – x2 = y2 – x2 এসো এখন উৎপাদকে বিশ্লেষণ করি। তাহলে কী হবে?

х (у-x) = (у-х) (у+x)

এখন উভয়পক্ষকে (y-x) দিয়ে ভাগ দেব।

х (у-х) / (y-x) = (у-х) (у+x) / (y-x)

কাটাকুটি করার পর কী থাকবে?

x = y+x

যেহেতু y এবং x সমান

X = x+x

x = 2x

এখন x দিয়ে ভাগ দিলে হবে।

1 =2

শিবশংকর আনন্দিত গলায় বলল, আতর, বুঝতে পেরেছ? এক সমান দুই যে প্রমাণ করলাম।

আতর বলল, না।

খুব সহজ অংক, তুমি বুঝতে পারলে না কেন?

বুঝতে না পারলে আমি কী করব?

তোমার তো বুদ্ধি কম।

আতর উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আপনারও বুদ্ধি কম।

শিবশংকর বলল, কেন বলছি আমার বুদ্ধি কম?

আপনি কাঁচামরিচ খান না। এইজন্যে আপনার বুদ্ধি কম। যারা কাঁচামরিচ খায় না তাদের বুদ্ধি কম হয়।

কে বলেছে?

এটা সবাই জানে। আপনার বুদ্ধি কম। এইজন্যে আপনি জানেন না। আপনি প্রমাণ করেছেন এক সমান দুই। আমি প্রমাণ করব আপনার বুদ্ধি নাই। করব?

কর।

একটা পাখির নাম বলেন যার ঠ্যাং তিনটা। এরকম পাখি সত্যিই আছে?

আছে।

এ দেশের পাখি?

হুঁ।

আমি জানি না।

হুঁ।

আতর বলল, প্রমাণ হয়েছে না। আপনার বুদ্ধি কম?

পাখিটার নাম বলে।

আপনি অনুসন্ধান করে বের করেন।

আতর চলে যাচ্ছে। শিবশংকর মন খারাপ করে তাকিয়ে আছে। তার খুব ইচ্ছা করছে আতরকে বলে, তুমি যে পাখির কথা বলেছ সেই পাখি আসলে নাই। তারপরেও ধরে নিলাম। এরকম পাখি আছে। ধরে নিলাম আমি বোকা। তুমি চলে যেও না। আরো কিছুক্ষণ থাক। আমার সঙ্গে গল্প কর। আমি অনেক মজার মজার জিনিস জানি। সব তোমাকে বলব।

 

ধনু শেখ শরিফাকে বিবাহ করে স্ত্রী নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। শরিফা জড়সড় হয়ে আছে। অকারণে চমকে চমকে উঠছে। আতর তার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করছে। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছে। সহজ স্বাভাবিক গলায় বলেছে, কলিকাতা থেকে কলের গান আনায়েছি। আপনি কি গান শুনবেন? জুলেখার একটা থাল আছে। একপিঠে উনার গান, অন্যপিঠে কৃষ্ণভানুর গান।

শরিফা ক্ষীণ গলায় বলল, গান শুনব না।

আতর বলল, কাপতেছেন কেন?

শরিফা বলল, ভয়ে কাপতেছি। খুব ভয় লাগতেছে আতর।

ভয় পাবেন। মেয়ে হয়ে জন্মানোর এটা শাস্তি।

ধনু শেখ প্রচুর মদ্যপান করে এক রাতের স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমুতে গেলেন। জড়ানো গলায় বললেন, বৌ শরিফা, তুমি বড়ই ভাগ্যবতী। ঠ্যাংওয়ালা স্বামীর সঙ্গে সংসার করলা, আবার ঠ্যাং ছাড়া স্বামীর সাথেও সংসার করলা। হা হা হা।

শরিফা আতঙ্কে এবং ভয়ে শিউরে উঠল।

 

ফজরের নামাজ পড়েই করিম ধনু শেখের বাড়িতে চলে এসেছে। ধনু শেখ ঘুম থেকে উঠলেন দুপুরবেলায়। করিমকে বাংলাঘরে ডেকে পাঠালেন। দরাজ গলায় বললেন, প্রচুর মদ্যপান করে রাতে শুয়েছি। শুয়েই ঘুম। স্ত্রীর সঙ্গে ভাবভালোবাসা, আদর-সোহাগ কিছুই হয় নাই। কাজেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আজ আর তালাক দিব না। তালাক ফালাক যা হবার কিছুদিন পরে হবে।

করিম বলল, এসব কী বলেন?

ধনু শেখ গলা উঁচিয়ে বললেন, কী বলি মানে? তোমার সঙ্গে কি দলিল করেছি যে একদিন পরে স্ত্রী তালাক দিব? বলো কোনো দলিল করেছি?

করিম হতভম্ব গলায় বলল, আমি শরিফার সঙ্গে কথা বলব।

ধনু শেখ বললেন, অন্যের স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাও, এটা কেমন কথা? পর্দাপুষিদা বিস্মরণ হয়েছ? যাও বিদায় হও। অনেক ত্যক্ত করেছ, আর না।

ধনু শেখ বাংলাঘর ছেড়ে অন্দরের দিকে রওনা দিলেন। তাকে উৎফুল্ল এবং আনন্দিত মনে হচ্ছে। পাখির মাংস রাতে খাওয়া হয় নি। রোধে রাখা হয়েছে। পাখির মাংস বাসি করে খাওয়া নিয়ম। এখন লুচি এবং পাখির মাংস দিয়ে নাশতা করবেন। এটা ভেবেও ভালো লাগছে। স্ত্রীর জন্যে শাড়ি গয়নার ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়া বৌ’র ফকিরনীর মতো বেশভূষা থাকবে কেন? গলা হাত খালি দেখতেও খারাপ। নেত্রকোনায় লোক পাঠানো দরকার, লাল শাড়ি কিনে আনবে। বৌ মানুষকে লাল শাড়ি ছাড়া মানায় না।

 

গত দুদিন ধরে মীরা চুপচাপ। তার মুখে রামনাম নেই। সে কোনো শব্দও করছে না। শ্ৰীনাথ বিব্রত অবস্থায় আছেন। মীরাকে দেখতে আসা দর্শনাথীদের বলছেন, মা কুপিত হয়েছেন। কারো ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়েছেন।

নয়া বাজার থেকে বড় বাড়ির এক বৌ এসেছে মীরাকে দিয়ে কপালে সিঁদুর দেয়াতে। বৌটির নাম সরাজুবালা। বারবার তার গর্ভ নষ্ট হচ্ছে। যদি মীরাকে দিয়ে সিঁদুর দেয়ালে গর্ভ রক্ষা হয়। মীরার হাতে সিঁদুরের কোটা দেয়া মাত্র সে কোটা দূরে ফেলে দিল। শ্ৰীনাথ হাহাকার করে উঠলেন, যা ভেবেছি তাই। দেবী কুপিত। পূজার ব্যবস্থা করতে হবে। দেবীর রাগ কমাতে হবে। সরাজুবালা নামের বেঁটি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল।

মীরার দর্শনার্থীদের মধ্যে একজন পুরুষ— একাকড়ি সাহা। যুদ্ধের কারণে তাঁর ব্যবসা ফুলে ফেপে উঠেছে। চালের দাম এতটা বাড়বে তিনি চিন্তাও করেন নি। বাৰ্মা থেকে চাল আসা বন্ধ এটা ঠিক। দেশের চাল গেল কোথায়? এককড়ি খবর পেয়েছেন কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ভুখা মানুষের না-কি ঢল নেমেছে। তারা ভাত চায় না। তাদের একটাই আকুতি— একটু ফ্যান দেন। অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে মনে হয় না। ফ্যানও পাওয়া যাবে। ঘরে ভাত রান্না হলে তবেই না। ফ্যান হবে।

এককড়ি চাল ভালোই মজুদ করেছেন। বাড়ির একটি গোলা আগেই পূর্ণ করেছেন। তাড়াহুড়া করে বানানো দ্বিতীয় গোলাটিও পূর্ণ। ঠিক কত চাল আছে হিসাব না থাকলেও পাঁচশ মণের বেশি ছাড়া কম হবে না। এককড়ি এখন ঝুকেছেন কেরোসিন, সাবান এইসবের দিকে। অভাব আসে মিছিল করে। চালের অভাবের সঙ্গে এখন যুক্ত হবে অন্য অভাব। তেল, সাবান, কাপড় কিছুই পাওয়া যাবে না। নুনের মতো সামান্য জিনিসও না। ব্যবসার এমন সুযোগ সব সময় আসে না। সুযোগ হঠাৎ হঠাৎ আসে। সুযোগের ব্যবহার করতে হয়। এককড়ি সুযোগের ব্যবহার করছেন। কোলকাতার ছোটবাজারে তার দোকান আছে। সেখানে চাল এবং কাপড় মজুদ করছেন। বিশ্বাসী লোকজন সেই দোকান দেখছে। তারপরেও এককড়ি দারুণ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। রাতে ভালো ঘুম হয় না। চোখ বন্ধ হলেই নানান দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে। স্বপ্নগুলির কোনো আগামাথা নাই।

একরাতে স্বপ্ন দেখলেন কোলকাতার ছোটবাজারের কাপড়ের গুদাম লুট হয়েছে। শত শত মানুষ কাপড় নিয়ে নিচ্ছে। তারা সবাই নগ্ন, কিন্তু কেউ কাপড় গায়ে দিচ্ছে না। ছিড়ে ছিড়ে খাচ্ছে। এককড়ি হতভম্ব হয়ে বললেন, এই তোমরা করছ কী? তারা বলল, হুদা কাপড় খাইতে পারি না গো। লবণ দেন, লবণ দিয়া খাই। স্বপ্নে অস্বাভাবিক ব্যাপার খুবই স্বাভাবিকভাবে দেখা দেয়। তিনি এক ধামা লবণ এনে তাদের সামনে রাখলেন। তারা সবাই লবণের ধামার ওপর ঝাপ দিয়ে পড়ল। স্বপ্নের পরের অংশ আরো ভয়াবহ। এক চশমা পরা বুড়ো লবণ মাখিয়ে এককড়ির গায়ের কাপড় ছিড়ে ছিড়ে খাওয়া শুরু করল। এককড়ি দৌড়ে পালাতে গেলেন, শত শত মানুষ তার পেছনে দৌড়াতে শুরু করল। তার ঘুম ভেঙে গেল। বাকি রাত আর চোখের পাতা এক করতে পারলেন না।

এ ধরনের বিকট স্বপ্ন প্রতি রাতে দেখলে মন দুর্বল হয়। এককড়ির বেলাতে তাই ঘটেছে। তিনি ঠিক করেছেন রাধাকৃষ্ণের মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। মন্দিরে রোজ পূজা হবে। এই দুই দেবদেবী তাকে সর্ব বিপদ থেকে রক্ষা করবেন। তিনি এসেছেন বিষয়টা নিয়ে শ্ৰীনাথের সঙ্গে পরামর্শ করতে। মীরার জন্যে তিনি রুপার পায়ের মল নিয়ে এসেছেন। লোকজন বলাবলি করছে— এই মেয়েতে দেবী প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনা। যদি সত্যি সেরকম হয় তাহলে ছোট্ট দেবীকে তুষ্ট রাখা প্রয়োজন।

এককডি শ্রীনাথকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গলা নামিয়ে বললেন, তোমাকে একটা কাজ দিব শ্ৰীনাথ।

শ্ৰীনাথ জোড়হস্ত হয়ে বলল, ব্যবসা বাণিজ্যের কাজ তো আমারে দিয়ে হবে না কর্তা। নিষেধ আছে।

নিষেধ কে করেছে?

বললে বিশ্বাস করবেন না। এইজন্যে বলব না।

এককড়ি বললেন, বিশ্বাস যাব না কেন? তুমি অনেক দিনের বিশ্বাসী মানুষ।

শ্ৰীনাথ চাপা গলায় বলল, দেবী সীতা স্বয়ং বলেছেন। তিনি বলেছেন, দিনরাত রাম-সীতা নাম জপবি। অন্যকিছু মনে স্থান দিবি না। এখন তাই করি।

এই বিষয়েই তোমার সঙ্গে কথা বলব। আমি মন্দির বানাবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মন্দিরে দিনরাত নামজপ হবে। তোমার পরামর্শ দরকার।

মন্দির কার হবে? রামমন্দির হলে বিবেচনা করতে পারি।

আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব। আগে আলোচনা পরে সিদ্ধান্ত।

এককড়ি ফিরে যাবার আগে লাবুসের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। লাবুস এখন অঞ্চলের বিশিষ্টজন। বিশিষ্টজনদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হয়।

লাবুস শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে ছিল। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। কিছুক্ষণ আগে পাঁচটা বিমান পাখির মতো ঝাক বেঁধে উড়ে গেছে। সবার সামনে একটা, বাকি চারটা পেছনে। মানুষ। শুধু যে পাখির মতো উড়তে শিখেছে তা-না, পাখির স্বভাবও আয়ত্ব করেছে।

লাবুস, ভালো আছেন? আমাকে চিনেছেন? আমি এককড়ি।

আপনাকে চিনেছি। বসুন। তামাক খেলে খান। হাদিস উদ্দিন রোজ আমাকে তামাক বানিয়ে দিয়ে যায়। আমি খাই না। তারপরেও দেয়। আপনি ইচ্ছা করলে খেতে পারেন। আমি নিলে মুখ দেই নাই।

এককড়ি বললেন, নলে মুখ দিলেও অসুবিধা নাই। মহাবিপদে কোনো হিন্দু মুসলমান নাই। সব সমান। দেশের এখন মহাবিপদ। চূড়ান্ত অভাব। শুনেছি কলিকাতার রাস্তায় এখন ফ্যানের জন্যে মিছিল। আপনিও নিশ্চয়ই শুনেছেন?

আমি এই বিষয়ে কিছু জানি না।

আমি জানি। আমার কাছে কাগজ আসে। কলিকাতা সমাচার। আপনি যদি চান কাগজ পড়ার পর আপনার কাছে পাঠায়ে দিব।

লাবুস বলল, পাঠাতে হবে না।

এককড়ি তোমাক টানতে টানতে বললেন, ঠিকই বলেছেন, খারাপ সংবাদ যত কম জানা যায় ততই ভালো। এদিকে রাশিয়া তো শেষ। হিটলার স্টালিনগ্রাদ দখল করে বসে আছে। স্টালিনগ্রাদ দখল মানে রাশিয়া দখল। নাম শুনেছেন স্টালিনগ্রাদের?

জি না।

বিরাট শহর। রাশিয়ার কলিজা। হিটলার সেই কলিজা চাবায়ে খেয়ে ফেলেছে। বাপক ব্যাটা। রাশিয়ার যিনি প্ৰধান তার নাম স্টালিন। হিটলারের নাম শুনেই তিনি এখন মুতে দিচ্ছেন। দিনের মধ্যে কয়েকবার তার কাপড় নষ্ট হয়।

ও আচ্ছা।

এদিকে আবার মরুভূমির শিয়াল শুরু করেছে হক্ক হুয়া।

বুঝলাম না।

হিটলারের সেনাপতি রুমেলকে আদর করে সবাই ডাকে মরুভূমির শিয়াল। শিয়ালের মতো বুদ্ধি, এই কারণে শিয়াল ডাকে। সে আফ্রিকা খেয়ে ফেলেছে। চার পাঁচ মাসের মামলা, দেখবেন সারা পৃথিবী চলে যাবে হিটলার বাবাজির দখলে।

লাবুস অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, যাবে না।

এককড়ি বললেন, কী বললেন?

হিটলার পরাজিত হবে।

আপনাকে কে বলেছে?

লাবুস চুপ করে রইল। তাকে কেউ কিছু বলে নাই। কিন্তু সে জানে। কীভাবে জানে সেটা এক রহস্য। এই রহস্য নিয়ে কারো সঙ্গে আলাপ করা দরকার। কার সঙ্গে আলাপ করবে?

এককড়ি দুই দফা তামাক খেয়ে হৃষ্টচিত্তে বিদায় নিলেন। আজ তাঁর মন ভালো। মন্দির প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। রাধাকৃষ্ণের মন্দির বানাবেন। রামমন্দিরে তাঁর পুষিবে না। রাম কোনো কাজের দেবতা না। দুর্বল দেবতা। যে তার স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারে না সে দেবতাদের মধ্যেই পড়ে না। মন্দিরের পেছনে একসঙ্গে অনেকগুলি টাকা বের হয়ে যাবে। তা যাক। মন্দিরের জন্যে দেবদেবী তাকে রক্ষা করবেন। সবার রক্ষাকর্তা দরকার। ইউরোপের রক্ষাকর্তা হিটলার। তাঁর রক্ষাকর্তা রাধাকৃষ্ণ। তিনি ভক্তিভরে রাধাকৃষ্ণের উদ্দেশে প্ৰণাম করলেন।

 

সন্ধ্যা অনেক আগে মিলিয়েছে। পুকুর থেকে ধোঁয়ার মতো বোনকা দিয়ে কুয়াশা উঠছে। লাবুস আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। হঠাৎ হঠাৎ কিছু দৃশ্য খুব মনে লেগে যায়। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

মাওলানা ইদরিস মেয়েকে কোলে নিয়ে পুকুরঘাটে এসে বসলেন। লারুস বলল, কিছু কি বলবেন?

ইদরিস বললেন, আমি কয়েকদিনের জন্যে বাইরে যাব। তোমার বোনকে দেখেশুনে রাখবে।

লাবুস বলল, অবশ্যই রাখব। আপনি কোথায় যাবেন?

বগুড়া যাব। মহাস্থান বলে একটা জায়গা। তুমি কি আমাকে হাতখরচ দিতে পারব?

পারব।

জমিদার শশাংক পালের কাছে আমি একটা ওয়াদা করেছিলাম। ওয়াদা রক্ষা করতে যাব। কী ওয়াদা জানতে চাও?

না।

তোমার বিষয়ে হাদিস উদ্দিন কিছু অদ্ভুত কথা বলেছে।

কী কথা?

সে একদিন সন্ধ্যায় দেখে পুকুরঘাটে দুইজন ল্যাকুস বসে আছে।

লাবুস সহজ গলায় বলল, মানুষ অদ্ভুত কথা বলতে পছন্দ করে। সাধারণ জীবন তার পছন্দ না। এর মধ্যেও সে রহস্য নিয়ে আসতে চায় বলেই এইসব বলে।

ইদরিস বললেন, রহস্য সে কেন আনতে চায়?

লাবুস বলল, যে জিনিস নাই তার জন্যে মানুষ থাকে ব্যস্ত। রহস্য বলে কিছু নাই, কিন্তু মানুষ রহস্য বিশ্বাস করে,।

ইদরিস বলল, রহস্য নাই কথাটা ঠিক বললা না। মেরাজের সময় আল্লাহপাকের সঙ্গে নবীজির সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে যে সব কথাবার্তা হয় তার ষােটভাগ জাহোৱী। চল্লিশভাগ বাতেনী, অর্থাৎ রহস্যের কথা।

লাবুস বলল, পুষ্পরানিকে নিয়া ভিতরে যান। তার ঠান্ডা লাগবে।

ইদরিস উঠে দাঁড়ালেন, লাবুস বলল, বগুড়া-থেকে ফিরে আপনি অদ্ভুত একটা বিষয় দেখবেন। খুবই আনন্দ পাবেন।

ইদারিস অবাক হয়ে বললেন, কী দেখব?

লাবুস বলল, আপনি দেখবেন পুষ্পরানি কথা বলা শুরু করেছে। সে দিনরাত কথা বলকে।

তুমি জানো কীভাবে?

লাবুস হাসতে হাসতে বলল, এটা একটা বাতেনী কথা।

 

ধনু শেখ আজ মদ্যপান করেন নি। মদ্যপান করলে মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। ঘুম পায়। নয়া স্ত্রী পাশে নিয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমাতে হয়। আজ রাতে তিনি এই সমস্যার ভেতর দিয়ে যাবেন না। ধনু শেখ বাংলাঘরে তামাক খাচ্ছেন। অতিরিক্ত জর্দা দিয়ে পান খাবার কারণে মাথা ঘুরছে। তিনি মাথার ঘূর্ণন কমানোর জন্যে অপেক্ষা করছেন। শরীরটা সুস্থ হলেই তিনি শোবার ঘরে যাবেন। শরিফাকে ডাকবেন। এক ঘর থেকে আরেক ঘরে নেবার জন্যে ভালো ব্যবস্থা হয়েছে।

ধনু শেখের মেজাজ বেশ খারাপ। তিনি খবর পেয়েছেন ইমাম করিম তাঁর বাড়ির সামনের কদম গাছের নিচে বিকাল থেকে বসে আছে। এখন রাত বাজে দশটা। হারামজাদা এখনো আছে। করিমকে তিনি ডেকে পাঠাবেন না-কি পাঠাবেন না। এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। দেখা হলে অতিরিক্ত রাগারগি করে ফেলতে পারেন। কবিরাজ আশু ভট্টাচাৰ্য তাকে রাগারগি করতে নিষেধ করেছেন। তাঁর মাথার রাগ না-কি দুর্বল হয়ে গেছে। বেশি রাগােরাগি করলে ব্লগ ছিড়ে মৃত্যুও হতে পারে।

ধনু শেখ মনে মনে তিনবার বললেন, আমি কোনো রাগার।াগি করব না। আমি কোনো রাগারগি করব না। আমি কোনো রাগারগি করব না। তিন প্ৰতিজ্ঞার পর ধনু শেখ করিমকে ডেকে পাঠালেন।

কালো চাদর গায়ে দিয়ে করিম দাঁড়িয়ে আছে। তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। তার চোখ ডেবে গেছে। চোখের কোণে কালি। চোখ টকটকে লাল।

ধনু শেখ বললেন, শুনলাম সন্ধ্যা থেকে তুমি কদম গাছের গোড়ায় বসে আছ?

জি।

মসজিদের মাগরিবের নামাজ পড়ায়েছ?

না।

এশার নামাজ পড়ায়েছ?

না।

তোমার ইমামের চাকরি আমি নট করে দিলাম। মসজিদের জন্যে নতুন ইমাম আসবে।

করিম বলল, জনাব, শরিফার বিষয়ে কী সিদ্ধান্ত নিলেন?

ধনু শেখ হুকায় লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমার কোনো পুত্রসন্তান নাই। মন বলতেছে এইবার পুত্রসন্তান হবে। পুত্রসন্তান না হওয়া পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নাই।

বুঝলাম না। আপনি হিল্লা বিবাহ করেছেন।

হিল্লা ফিল্লা বুঝি না। বিবাহ করেছি। এইটা বুঝি। তুমি বিদায় হও। আইজ রাইতের পরে আমার ঘরের আশেপাশে তোমারে যদি দেখি তোমার ঠ্যাং আমি ভেঙে দেব। শরিফার বর্তমান স্বামীর ঠ্যাং ভাঙা, আগের স্বামীরও ঠ্যাং ভাঙা। বিদায় হও।

ইমাম বাংলাঘর থেকে বের হলো, কিন্তু চলে গেল না। কদম গাছের নিচে বসে রইল। প্রচণ্ড শীত পড়েছে। কিন্তু তার শীত লাগছে না। শরীর দিয়ে গরম ভাপ বের হচ্ছে। চাদরের নিচে করিমের হাতে ধারালো একটা ছুরি। আসরের নামাজের পর থেকেই সে ছুরি হাতে ঘুরছে।

 

শরিফা আতরের ঘরের রেলিং দেয়া খাটে জড়সড় হয়ে বসে আছে। তার গায়ে জরি বসানো লাল শাড়ি। ধনু শেখ এই শাড়ি নেত্রকোনা থেকে লোক পাঠিয়ে আনিয়েছেন। তার গলায় চন্দ্রহার। হাতে বালা। পায়ে রুপার মল। গয়না সবই বেদানার, ধনু শেখের নির্দেশে আতর পরিয়ে দিয়েছে।

খাটের মাঝখানে কলের গান। আতর বলল, নয়া মা, গান দিব? গান শুনবেন।

শরিফা মাথা নাড়ল। মাথা নাড়া থেকে হ্যাঁ না কিছু বোঝা গেল না। আতর ঘুরন্ত রেকর্ডে পিন রাখল। গান শুরু হয়েছে। জুলেখার কিন্নর কণ্ঠ। যদিও রেকর্ডে লেখা ‘চান বিবির পল্লী গান’।

আমার গায়ে যত দুঃখ সয় ।
বন্ধুয়ারে করো তোমার মনে যাহা লয়।
নিঠুর বন্ধুরে
বলেছিলে আমার হবে
মন দিয়াছি এই ভেবে
সাক্ষী কেউ ছিল না সেই সময়
সাক্ষী শুধু চন্দ্ৰতারা
একদিন তুমি পড়বে ধরা
ত্ৰিভুবনের বিচার যেদিন হয়

শরিফা ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর গান!

আতর বলল, এই মেয়ে আমাদের অঞ্চলের কেউ চিন্তা করবে?

শরিফা বলল, কেউ চিন্তা করবে না। তার সঙ্গে দেখা হইলে সামনে বসায়া দুইটা গান শুনতাম।

সত্যই দেখা করতে চান?

শরিফা হাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আতর বলল, আমগাছে সুতা ঝুলায়া আসবেন, মনের ইচ্ছা পূর্ণ হবে। আমি একটা সুতা ঝুলাইছি।

কী জন্যে ঝুলাইছ?

আতর সামান্য ইতস্তত করে সহজ গলায় বলল, সুতা ঝুলাইছি যেন একজনের সঙ্গে আমার বিবাহ হয়। আমগাছের সুতা ছাড়া এই বিবাহ হবে না। আমার ব্যাপজান যদি শুনে, গাঙ্গে ড়ুবায়া আমারে মাইরা ফেলবে।

শরিফা অবাক হয়ে তাকাচ্ছে।

আতর বলল, আমি একটা হিন্দু ছেলেরে বিবাহ করতে চাই। তার নামের প্রথম অক্ষর শ। বলেন দেখি তালিব্য শ দিয়া কী নাম হয়?

বলতে পারব না। আমি বাংলা লেখাপড়া জানি না। কোরান মজিদ পড়তে পারি। বাংলা পারি না।

শিখতে চান?

না।

না কী জন্যে?

মেয়েছেলে লেখাপড়া শিখলে স্বামীর হায়াত কমে।

আমার বাপের হায়াত কমলে তো আপনার জন্য ভালো। উনি মানুষ মন্দ। আপনেরে কোনোদিন ছাড়বে না।

শরীফা তাকিয়ে আছে। আতর হালকা গলায় গল্প করছে। মেয়েটার গল্প শুনতে এত ভালো লাগছে। কেমন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে কথা বলে।

আতর বলল, বাপজানরে বিবাহ কইরা আপনি কিন্তু বান্ধা পড়ছেন।

শরিফা বলল, আমারও সেইরকম ধারণা।

আতর বলল, এখন না ছাড়লেও কোনো একদিন ছাড়ব। যখন আপনের কোনোখানে যাওনের জায়গা থাকব না। তখন ছাড়ব। তখন আপনের না থাকব ঘর, না থাকব খাওন। আমার বড় মার এই দশা। আমার বড় মা যে জীবিত আছে জানেন?

না।

তাঁর নাম আমিনা। আমার এক সৎভাই আছে, তার নাম বাহাদুর। বড়ই সুন্দর।

আতরের গল্প শেষ হলো না। ধনু শেখ স্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন।

 

ধনু শেখের মেজাজ খুবই খারাপ। তিনি পাঞ্জাবিতে সামান্য আতর দিয়েছিলেন। আন্তরের গন্ধে এখন গা গুলাচ্ছে। বমি আসি আসি করছে। মনে হচ্ছে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ পরিচয় আজও হবে না। বমি করে পালংক ভাসাবেন। বমির মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বেন। অতিরিক্ত মদ্যপান করলে এই অবস্থা হয়। আজ বোতল হাতে পর্যন্ত নেন নি। জর্দা দিয়ে পান খেয়েছেন। আতর মেখেছেন।

শরিফা পালংক ধরে দাড়িয়ে আছে। লাল শাড়িতে তাকে সুন্দর লাগছে। ধনু শেখ বমি চাপতে চাপতে বললেন, শাড়ি পছন্দ হয়েছে?

শরিফা জবাব দিল না। ধনু শেখ বললেন, একটা জিনিস খেয়াল রাখবা। প্রশ্ন করলে উত্তর দিবা। উত্তর না দিলে চড় খাবা। শাড়ি পছন্দ হয়েছে?

হইছে।

এখন শাড়ি খুঁইল্যা ফেল। মেয়েছেলের সৌন্দর্য শাড়ি পরায় না। শাড়ি না পরায়। বুঝেছ?

শরিফা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। ধনু শেখ হামাগুড়ি দিয়ে শরিফার কাছে এগিয়ে এলেন। শরিফার গালে আচমকা চড় বসিয়ে বললেন, প্রশ্ন করেছি জবাব দেও নাই, এইজন্যে চড় খাইলা। বুঝেছ?

বুঝেছি।

স্ত্রীকে স্বামী বরাবর হইতে হয়। আগে তোমার স্বামী ছিল মাওলানা, তুমি ছিলা। মাওলানা। এখন তোমার স্বামী মদ খাউরা। তুমিও হবা মদ খাউরা। বুঝেছ?

শরিফা ক্ষীণ গলায় বলল, বুঝেছি।

ধনু শেখ বলল, এক দুই চুমুক কইরা খাইলেই হবে। বোতল সাফা করতে হবে না। বোতল আমি সাফা করব। ঠিক আছে?

জি।

আইজ থাইকা শুরু হউক। তোমার ডাইন দিকের আলমিরাতে বোতল আছে। বোতল আন।

শরিফা বোতল আনতে রওনা হলো।

ধনু শেখ হুঙ্কার দিলেন।

অনেক আগে তোমারে ন্যাংটা হইতে বলছি। হও নাই। এখন হও। ন্যাংটা অবস্থায় বোতল আনবা। লজ্জা ভাঙা দরকার।

শরিফ থরথর করে কাঁপছে। গা থেকে শাড়ি খোলার চেষ্টা করছে। শাড়ি খুলছে না, আরো যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে।

ধনু শেখ বমি করছেন।

 

আতর চাঁন বিবির রেকর্ডটা আবার ছেড়েছে। সে বুকে আছে রেকর্ডের ওপর। গান শুনতে শুনতে এক চোখে পানি আসবে। এক ফোঁটা পানি রেকর্ডে পড়বে। গ্রামোফোনের পিন যখন অশ্রুভেজা জায়গাটা পার হবে তখন গান আরো মধুর। লাগবে। ব্যাপারটা আতরের পূর্বপরীক্ষিত।

 

আতর এক ফোঁটা চোখের পানি ফেলে রেকর্ডের দিকে তাকিয়ে আছে। একই সময় ব্রিটিশ ফিল্ড মার্শাল তার ক্যাম্পে একটি রেকর্ড বাজাচ্ছেন। রেকর্ডে Waltz মিউজিক হচ্ছে। তিনি এক বোতল রেড ওয়াইন খুলেছেন। কর্ক খুলতে গিয়ে কিছু রেড ওয়াইন ছিটকে পড়েছে রেকর্ডে। তিনি গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে বললেন, The wine will make the music sweeter.

তারিখ ৫ই নভেম্বর ১৯৪২ সন। মন্টোগোমারীর আনন্দের দিন। কারণ তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছেন ট্যাংক যুদ্ধের কিংবদন্তি জার্মান ফিল্ড মার্শাল রোমেল। যুদ্ধ হয়েছে মিশরের আল আমিনে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মন্টোগোমারী জয়ের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।

রেডওয়াইনের গ্লাস উঁচু করে ধরে মন্টোগোমারী বললেন, রোমেলের সাহসের তারিফ করে একটা টোস্ট যদি করি খুব অন্যায় কি হবে?

উপস্থিত চারজন ব্রিগ্রেডিয়ারের ভেতর মাত্র একজন হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মন্টোগোমারী বললেন, ঠিক আছে, নাম না হয় উচ্চারণ নাই করলাম। বলি শুধু সাহসের প্রতি সম্মান।

এবার তিনজনই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন। মন্টেগোমারী বললেন, To the Courage.

গ্লাসে গ্লাসে ঠোকাঠুকির ঝনঝন শব্দ হলো।

অন্যদিকে জার্মান সেনাবাহিনী ঢুকে পড়েছে স্টালিনগ্রাদে। সোভিয়েত সৈন্যরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছে। তাদের দিয়ে যুদ্ধ করানো যাচ্ছে না। সোভিয়েত নেতা স্টালিন কাপুরুষতার জন্যে ১৩ হাজার সোভিয়েত সেনাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এই খবরে জার্মান জেনারেল এরিখ ভন ম্যানষ্টেইন যথেষ্টই আনন্দ পেলেন। তিনি রাশিয়ান ভদকা দিয়ে টোস্ট করলেন। বললেন, To the cowards.

সাহস এবং কাপুরুষতার জন্যে একই সময় পৃথিবীর দুই প্রান্তে টোস্ট করা হলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *