দুটি মৃত্যুসংবাদ দাবানলের মতো ছড়িয়েছে। দিল্লীর সিংহাসনের অধিকর্তা ইসলাম শাহ্র মৃত্যু এবং বাবরপুত্র হুমায়ূনের মৃত্যু।
ইসলাম শাহ’র উত্তরাধিকারী তিনজন। তারা সিংহাসনের দখল নেওয়ার চেষ্টায় আছেন। জায়গায় জায়গায় তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ছোট রাজ্যের রাজারা কোন পক্ষ নেবেন ঠিক করতে ব্যস্ত।
হুমায়ূনের উত্তরাধিকারী শিশু আকবর। মোগল শিবির শান্ত। আমীরদের মধ্যেই যা কিছু অস্থিরতা। তারা জানতে চান হুমায়ূনের মৃত্যুসংবাদ কতটুকু সত্যি!
হুমায়ূন গুরুতর অসুস্থ এটা সত্যি। রাজমহিষীরা সবাই চলে এসেছেন এটাও সত্যি। অসুস্থ হুমায়ূন রাজমহিষীদের তত্ত্বাবধায়নে আছেন। তাঁরা হুমায়ূন সম্পর্কে কোনো তথ্যই জানাচ্ছেন না। সম্রাটের ব্যক্তিগত মৌলানাকে তাঁবুতে ঢুকে চিন্তিত অবস্থায় বের হতে দেখা গেছে। সম্ভবত তিনি শেষ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে তওবা করিয়েছেন।
আমীররা বৈরাম খাঁ’র সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। বৈরাম খাঁ’র কাছ থেকে ভেতরের খবর যদি কিছু পাওয়া যায়।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমার ধারণা সম্রাট হুমায়ূন মৃত। রাজমহিষীদের কাছ থেকে ইঙ্গিত সে রকম পাচ্ছি।
আমীরদের একজন (সালার খাঁ) বললেন, এই অবস্থায় আমাদের করণীয় কী?
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনারা চিন্তা করে বের করুন কী করবেন। সত্যি সত্যি সম্রাটের মৃত্যু হয়ে থাকলে আমি আছি। যুবরাজ আকবরের পেছনে।
আকবর একজন শিশু।
বৈরাম খাঁ বললেন, শিশু বড় হবে। ততদিন আপনারা থাকবেন। শিশুর অভিভাবক। আর আপনারা যদি মনে করেন এমন বিশৃঙ্খল অবস্থায় না থেকে মীর্জা কামরানের সঙ্গে যোগ দেবেন। সেই পথও খোলা। মীর্জা হিন্দাল নিহত—এই খবর আপনারা জানেন। তিনি বীরের মতো ভাইয়ের জন্যে যুদ্ধ করে মরেছেন। মীর্জা আসকারি আমাদের সঙ্গেই বন্দি অবস্থায় আছেন। মীর্জা কামরান শক্তি সংগ্রহের চেষ্টায় আছেন। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি তার হাত শক্তিশালী করতে চান, করতে পারেন।
আরেক আমীর বললেন, কেউ যদি অন্য শিবিরে যেতে চায় তাকে বাধা দেওয়া হবে না?
বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট অসুস্থ। তিনি এই বিষয়ে কোনো ফরমান জারি করতে পারছেন না। আমি শুধু সেনাবাহিনীর প্রধান, আমার পদমর্যাদা আমীরদের নিচে।
বৈঠকের শেষে তিনজন আমীর জানালেন, তাঁরা হুমায়ূনের শিবিরে থাকবেন না, তবে মীর্জা কামরানের দলেও যোগ দেবেন না। তাদের রাজনীতির প্রতি বৈরাগ্য চলে এসেছে। তারা মক্কায় হজ করতে যাবেন। সেখান থেকে ফেরার সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
বৈরাম খাঁ বললেন, এমন যদি হয়, আমাদের সম্রাট সুস্থ আছেন এবং ভালো আছেন তাহলে কি আপনারা হজে যাওয়ার বাসনা ত্যাগ করবেন?
আমীররা মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন। বৈরাম খাঁ ঠিক কী বলতে চাচ্ছেন বোঝা যাচ্ছে না। যতই দিন যাচ্ছে বৈরাম খাঁ’র আচার-আচরণ ততই রহস্যময় হয়ে উঠছে।
বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট হুমায়ূন সম্পূর্ণ সুস্থ। স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তিনি চিল্লায় ছিলেন। চিল্লার মেয়াদ আগামীকাল ফজর ওয়াক্তে শেষ হবে। তিনি তখন সবাইকে দর্শন দেবেন।
আমীররা সবাই একসঙ্গে বললেন, মারহাবা।
বৈরাম খাঁ বললেন, আপনাদের মধ্যে যারা মক্কায় যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন তারা সম্রাটের দর্শন পাবেন না। তাদেরকে কিছুক্ষণের মধ্যে মক্কার দিকে যাত্রা শুরু করতে হবে।
প্রধান আমীর ফৈয়জ খাঁ বললেন, এই সিদ্ধান্ত আপনি নিতে পারেন না।
বৈরাম খাঁ বললেন, এই সিদ্ধান্ত আমার না। সম্রাট হুমায়ূনের। তিনি অবিশ্বস্ত আমীরদের আলাদা করার দায়িত্ব আমাকে দিয়েছেন। এই দায়িত্ব আমি ভালোমতো সম্পন্ন করেছি। সম্রাটের মিথ্যা মৃত্যুসংবাদ রটানো আমার একটি কৌশল মাত্র।
ফজরের নামাজ শেষ হয়েছে। প্রধান আমীরকে নিয়ে বৈরাম খাঁ নদীর কাছে গেছেন। পাথরের উপর বসে হুমায়ূন বই পড়ছেন। আমীরের কুর্নিশের জবাবে তিনি মাথা ঝাঁকালেন।
ফৈয়জ খাঁ বললেন, ইনি আমাদের সম্রাট না। আপনি তাকে ঠিকমতো শিখিয়ে দেন নাই কুর্নিশের জবাবে কী করতে হয়।
বৈরাম খাঁ বললেন, এই কাজটা আমি আপনার জন্যে রেখে দিয়েছি। আপনি শেখাবেন।
সম্রাট কি তাহলে ইন্তেকাল করেছেন?
না। তবে তাঁর অবস্থা সঙ্গিন। যে-কোনো মুহুর্তে আমরা তার মৃত্যুসংবাদ পাব।
হায় আল্লাহ। কী দুঃসংবাদ!
বৈরাম খাঁ বললেন, প্রতিটি দুঃসংবাদের সঙ্গে একটি সুসংবাদ থাকে। সুসংবাদ শুনুন। পাঞ্জাবের রাজা সুলতান আদম গক্করের হাতে মীর্জা কামরান বন্দি হয়েছেন। সম্রাট হুমায়ূনের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তিনি বন্দি কামরানকে হস্তান্তর করতে চান।
শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। এখন আপনার পরিকল্পনা কী?
বৈরাম খাঁ বললেন, সম্রাট হুমায়ূন জীবিত থাকুন বা মৃত থাকুন আমি দিল্লী দখল করব। এই সুযোগ দ্বিতীয়বার আসবে না। সুলতান শাহ’র তিনপুত্র নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু করেছে। এরা কেউ আমার বাহিনীর সামনে দাড়াতে পারবে না।
ফৈয়জ খাঁ বললেন, সিকান্দর শাহ’র কিন্তু বিশাল বাহিনী।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমি পাঞ্জাব দিয়ে ঢুকব। সিকান্দর শাহ’র কল্পনাতেও নাই কেউ পাঞ্জাব দিয়ে ঢুকে তাকে আক্রমণ করতে পারে।
যুদ্ধযাত্রায় নকল হুমায়ূন থাকবেন?
অবশ্যই। সে থাকবে হাতির পিঠে। আপনি অন্য আমীরদের নিয়ে তাকে ঘিরে থাকবেন। যাতে নকল হুমায়ূনকে স্পষ্ট দেখা না যায়।
আপনার সাহসের তারিফ করছি।
বৈরাম খাঁ বললেন, বুদ্ধির তারিফ করছেন না?
অবশ্যই।
বৈরাম খাঁ বললেন, আমার প্রিয় সম্রাট পবিত্র কোরানের একটি আয়াত প্রায়ই পাঠ করতেন। সেই আয়াতে আল্লাহপাক বলছেন, আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব। দেখা যাক সম্রাট হুমায়ূনের ভাগ্যে কী লেখা।
বৈরাম খাঁ শেষ মুহুর্তে হাতির পিঠে করে নকল হুমায়ূনের যাত্রা বাতিল করলেন। তিনি ঘোড়সওয়ার বাহিনী নিয়ে অতি দ্রুত অগ্রসর হবেন। হাতি যথেষ্ট দ্রুতগামী হলেও ঘোড়ার অনেক পিছনে পড়ে থাকবে।
হুমায়ূনের জীবনের আশা সবাই ত্যাগ করেছেন। আগে বেদানার রস খানিকটা মুখে নিতেন, পুরো এক দিন এক রাত্রি পার হয়েছে বেদানার রসও মুখে নিতে পারছেন না। তার চোখ বন্ধ। আগে ডাকলে অস্ফুট শব্দ করে সাড়া দিতেন। এখন সাড়াও দিচ্ছেন না। হুমায়ূন-মাতা মাহিম বেগমকে চিকিৎসক পুত্রের আরোগ্য লাভের আশা ছেড়ে মন শক্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন। মাহিম বেগম অর্ধমৃত অবস্থায় আছেন। তিনি খাদ্য গ্রহণ বন্ধ করে দিয়েছেন।
এখন মধ্যরাত্রি। বহু বছর আগের একটি ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। হুমায়ূনের বিছানার চারপাশ দিয়ে হামিদা বানু হাঁটতে হাঁটতে বলছেন, আমার প্রাণের বিনিময়ে হে আল্লাহপাক তুমি সম্রাটের জীবন ভিক্ষা দাও।
চতুর্থবোর ঘূর্ণন শেষ করে হামিদা বানু চমকে তাকালেন, হুমায়ূন চোখ মেলে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মায়াময় হাসি হাসি চোখ। হুমায়ূন বললেন, হামিদা! বিড়বিড় করে কী বলছ? হামিদা বানু ছুটে এসে সম্রাটকে জড়িয়ে ধরে বললেন, কিছুক্ষণ আগে খবর এসেছে বৈরাম খাঁ সিকান্দর শাহকে পরাজিত করে দিল্লী দখল করেছেন। আপনি এখন হিন্দুস্থানের সম্রাট।
হুমায়ূন ক্ষীণ গলায় বললেন, এই সংবাদ আমি পেয়েছি।
কীভাবে পেয়েছেন?
আমার কন্যা আকিকা বেগম স্বপ্নে এসে আমাকে বলেছে। গরম পানির ব্যবস্থা করতে বলো। আমি স্নান করে শোকরানা নামাজ পড়ব।
উঠে বসার সামৰ্থ্য কি আপনার আছে?
হ্যাঁ আছে। ইনশাল্লাহ। আমি সম্পূর্ণ সুস্থ।
আচার্য হরিশংকর তার ঘরে। বিছানায় শুয়ে আছেন। তার হাতের কাছে মালশায় আগুন জ্বলছে। তিনি মালশার আগুনে মাঝে মাঝে হাত সেঁকছেন। আগুনের উত্তাপে তার খানিকটা আরাম বোধ হয়। ঘরে পচা মাংসের বিকট দুৰ্গন্ধ। হরিশংকর ফুট-ফরমাস খাটার জন্যে যে ছেলেটিকে রেখেছিলেন, সে পালিয়েছে। মালশায় আগুন অনেক কষ্টে হরিশংকর নিজেই জ্বলিয়েছেন। হরিশংকরের প্রচণ্ড পানির পিপাসা পেয়েছে। পানি দেওয়ার কেউ নেই। খাট থেকে নেমে পানির সন্ধান করবেন। সেই শক্তি পাচ্ছেন না।
ব্যাধি সারা শরীরে ছড়িয়েছে। এতদিন যন্ত্রণাবোধ ছিল না। এখন হঠাৎ হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণার চেয়ে মৃত্যু অনেক ভালো। মৃত্যু আসছে না।
আমার বাবা কোথায় জানেন?
হরিশংকর তাকালেন, আকিকা বেগম নামের প্রেতিটা আবার এসেছে। রোগ থেকে তাঁর যেমন মুক্তি নেই, প্রেতের হাত থেকেও মুক্তি নেই।
আকিকা বেগম বলল, আমার বাবা এখন হিন্দুস্থানের সম্রাট।
হরিশংকর বললেন, এই যা যা। না গেলে তোর গায়ে আগুন ছুঁড়ে মারব।
আকিকা বেগম খিলখিল করে হাসছে। হরিশংকর আগুনের মালশা ছুঁড়ে মারলেন। জ্বলন্ত কয়লা ঘরময় ছড়াল। কাপড়ে লাগল। দেখতে দেখতে ঘরে আগুন ধরে গেল। আগুন এগিয়ে আসছে হরিশংকরের দিকে। হরিশংকর নড়লেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আগুনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।