২৩. দিব্যদৃষ্টি

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ
দিব্যদৃষ্টি

বাদশাহের নাল্‌কী যখন মহলে প্রবেশ করিল, তখন হজরৎ মমতাজ-ই-মহল আরজ মন্দ বাণু বেগম রৌশন জহানী আঙ্গুরীবাগের চত্বরে দাঁড়াইয়া লাল মাছকে আহার দিতেছিলেন। বাদশাহ্‌ নাল্‌কী হইতে অবতরণ করিলেন এবং বেগমের হস্ত ধারণ করিয়া রঙ্গমহলে প্রবেশ করিলেন। রঙ্গমহলের সম্মুখে বাঁদীর সর্‌দারণী মেহেদী বিবি ও খোজা হিম্মৎ খাঁ য়াকুৎ নিতান্ত অপরাধীর ন্যায় দাঁড়াইয়াছিল। বাদশাহ তাহাদিগের অবস্থা দেখিয়া বেগমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আলিয়া, ইহাদিগের কি হইয়াছে?”

বেগম বাদশাহের হস্তধারণ করিয়া যমুনাতীরস্থিত একটি কক্ষে লইয়া গেলেন এবং কহিলেন, “জহান্‌পনা, আমার আমলে মহলসরায় যাহা হয় নাই তাহাই হইয়াছে।”

“কি হইয়াছে?”

“আপনি সুস্থ হউন, তাহার পরে বলিব।”

“আমি বেশ সুস্থ আছি, তুমি বল।”

“বড় ভীষণ কথা, মহলসরায় দুই জন পুরুষ ধরা পড়িয়াছে।”

“পুরুষ? কি জাতি?” “বাঙ্গালী।” “বাঙ্গালী?”

“হাঁ, জহান্‌পনা, একজন সুন্দর বলিষ্ঠ যুবক, আর একজন বৃদ্ধ; কিন্তু তাহার দেহে জীনের মত অসীম বল।”

“কোথায় ধরা পড়িল?”

“শিশ্‌মহলের নীচে ফাঁসীখানায়।”

“কে ধরিল?” “আমি।” “তুমি?”

“হাঁ, জহান্‌পনা, সন্ধ্যার সময়ে য়াকুৎ বাঁদী গুলজার আমাকে বলিল যে গুলরুখ্‌ রঙ্গমহলে এজন পুরুষ আনিয়াছে। আমি অন্ধকারে তাহার সন্ধান না পাইয়া গুলজারের কথা মিথ্যা মনে করিয়াছিলাম। আপনি আজ যখন দরবার আমে তখন গুল্‌জার আসিয়া বলিল যে ফাঁসীখানায় জহানারা ও গুলরুখ্‌ একজন পুরুষকে কতল করিতেছে। আমি ফাঁসীখানার উত্তরের দেওয়াল সরাইয়া দেখিলাম যে সত্য সত্যই জল্লাদ হিলাল্‌ খাঁ একজন মরদকে কতল করিতেছে। জহানারা বলে তাহার নাম সরওয়ার্‌ খাঁ, সে গুলরুখের স্বামী, কিন্তু সে এক কাফের্‌ণীর জন্য গুলরুখকে পরিত্যাগ করিয়া কাফের হইয়াছে। সে বলে যে তাহার নাম ময়ূখ, সে হিন্দু এবং গুলরুখ্‌ তাহার কেহ নহে। কি করিব স্থির করিতে পারিতেছি না।”

সহসা নবাব দেখিলেন আলিয়া বেগমের আকর্ণবিশ্রান্ত নীলনয়নদ্বয় জলে ভরিয়া উঠিল, তিনি বাদশাহের উভয় হস্তধারণ করিয়া বলিলেন, “জনাব, আমার একটি অনুরোধ রাখিবে?”

শাহ্‌জহান সাদরে নয়নাশ্রু মুছাইয়া কহিলেন, “আলিয়া, হিন্দুস্থানের এক সীমা হইতে অপর সীমা পর্য্যন্ত তোমার আদেশ প্রতিপালিত হয়, তুমি যখন যাহা আদেশ কর আমি তাহাই করিয়া থাকি, এখনও করিব। তবে তোমার চোখে জল আসিল কেন?”

“দিলের, তাহার মুখখানি দারার মতন, তাহাকে প্রাণে মারিও না। যদি সে অপরাধী হয়, তাহা হইলে তাহাকে মোগল বাদশাহী এলাকা ছাড়াইয়া নির্ব্বাসিত করিও।”

“তাহাই হইবে, সে যদি অপরাধী হয় তথাপি তোমার নয়নাশ্রুর অনুরোধে তাহাকে মুক্ত করিব।”

বেগম আনন্দে আত্মহারা হইয়া বাদশাহের হস্তচুম্বন কুরিলেন, বাদশাহ্‌ হাসিয়া কহিলেন, “আলিয়া, অনেক দিন পরে ‘দিলের’ বলিয়া ডাকিয়াছ, আপনি বলিলে না, জহানপনা বলিলে না?” লজ্জায় আরজ মন্দ বাণুবেগমের মুখ রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, তিনি বাদশাহের বক্ষে মুখ লুকাইয়া কহিলেন, “সকল সময়ে মনে থাকে না।”

“তবে বল কেন?”

“এখন যে তুমি বাদশাহ্‌ হইয়াছ, দিলের?”

“তখ্‌তে বসিয়া কি পর হইয়া গিয়াছি আলিয়া?” “তাহা কেন? চল তাহাদিগকে দেখিবে।”

নিকটে অন্য এক কক্ষে ময়ূখ, ভুবন ও দুইজন খোজা বসিয়াছিল। বাদশাহ্‌ কক্ষে প্রবেশ করিয়া ময়ূখকে দেখিয়া বলিয়া উঠিলেন, “মন্‌সবদার, তুমি এখানে?”

শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ময়ূখকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল; তিনি ধীরে ধীরে উঠিয়া দাঁড়াইয়া অভিবাদন করিলেন এবং কহিলেন, “শাহান্‌শাহ, তক্‌দির।”

তখন বাদশাহ্‌ বেগমকে কহিলেন, “আলিয়া, এ আমার নূতন মনসবদার, ইহার পিতার ন্যায় বিশ্বাসী ভৃত্য জহাঙ্গীর বাদশাহের বোধ হয় আর ছিল না।

এত মুসলমান নহে, বাঙ্গালী। কে তোমাকে রঙ্গমহলে আনিয়াছে?”

ময়ূখ যাহা জানিতেন তাহা বলিলেন। তখন হিম্মৎ খাঁ ও মেহেদী বিবির তলব পড়িল। তাহারা বলিল যে, গুলজার বাঁদী এই কাফেরকে লইয়া আসিয়াছিল, জহানারা বেগম বলিয়াছিলেন যে ইহা হজরৎ বাদশাহ্‌ বেগমের হুকুম। তখন বাদশাহ্‌ গুলরুখ্‌কে তলব করিলেন।

স্থির শান্ত তুষারশীতল ধবল মর্ম্মরমূর্ত্তির ন্যায় গুলরুখ্‌ ধীরে ধীরে কক্ষে প্রবেশ করিলেন। রক্তবর্ণপাষাণনির্ম্মিত কক্ষ যেন উষার উজ্জ্বল কান্তিতে শুভ্র হইয়া উঠিল। তরুণী রমণীর রূপ জগদ্বিজয়ী, শাহ্‌জহানের কঠোর সঙ্কল্প সহসা কোমল হইয়া গেল, হৃদয় দ্রবীভূত হইল, বাদশাহ্‌ উদ্দেশ্য বিস্মৃত হইয়া সস্নেহে জিজ্ঞাসা করিলেন, “গুলরুখ্‌, এ কে মা?”

সুন্দর ওষ্ঠযুগল ঈষৎ কম্পিত হইল, গুলরুখ্‌ বলিল, “শাহনশাহ্‌, ইনি আমার দেবতা।”

“তুমি ইঁহাকে মহলসরায় আনিয়াছিলে?”

“আনিয়াছিলাম।”

“স্বেচ্ছায় আনিয়াছিলে মা?”

“শাহানশাহ্‌ পিতা কেমন তাহা দেখি নাই, আপনার নিকটে ও নবাব সাহেবের নিকটে জীবনে প্রথম পিতৃস্নেহ পাইয়াছি। মিথ্যা বলিব না, অনেক মিথ্যা কহিয়াছি, আরাধ্য দেবতাকে বহু যন্ত্রণা দিয়াছি। মোহের বশে কুপরামর্শে শয়তান ও শয়তানীর সাহায্যে, ইঁহাকে মাতার বাসস্থানে আনিয়াছিলাম।”

“কাহার পরামর্শে আনিয়াছিলে গুলরুখ্‌?”

“এই চক্ষুর, পিতা, এই চক্ষুই আমার কাল। কেহ অপরাধী নহে। গুল্‌জার, ইরাদৎ, হিম্মৎ, হিলাল, মেহেদী বা শাহ্‌জাদী কেহ অপরাধী নহে। অপরাধ আমার চক্ষুর। সুদূর সপ্তগ্রামে ঐ দেবদুর্ল্লভ রূপ আমার নয়ন অন্ধ করিয়া দিয়াছিল, সেই অন্ধতার বশবর্ত্তী হইয়া বহু অপরাধ করিয়াছি। শাহান্‌শাহ, আজি আপনার সাক্ষাতে দোষীর দগুবিধান করিব।”

গুলরুখ্‌ ক্ষিপ্র হস্তে বস্ত্রমধ্য হইতে দুইটি তীক্ষ্ণধার লৌহ শলাকা বাহির করিয়া নয়নদ্বয়ে বিদ্ধ করিল, মুহূর্ত্ত মধ্যে নীলেন্দীবরতুল্য উজ্জ্বল নয়নদ্বয় হীনপ্রভ হইয় গেল। তখন যুবতীর পাণ্ডুবর্ণ মুখমণ্ডলে ম্লান হাস্যের ক্ষীণ রেখা ফুটিয়া উঠিল, গুলরুখ্‌ বলিল, “আর দেখিব না, কিন্তু, প্রভু, অন্ধের নয়নপথে তোমার শান্ত স্নিগ্ধ সুন্দর মূর্ত্তি সতত বিরাজ কৱিবে।“

দৃষ্টিশক্তিহীনা রমণী আরজ্‌ মন্দ বাণু বেগমের দিকে হস্তদ্বয় প্রসারিত করিল এবং কহিল, “মা, তুমি কোথায় মা?”

বেগম গুলরুখের রক্তাপ্লুত দেহ আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করিয়া রোদন করিয়া উঠিলেন। বাদশাহ্‌ স্তম্ভিত হইয় দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি ফিরিয়া দেখিলেন যে ময়ূখের গণ্ডস্থলে স্রোতের ন্যায় অশ্রুধারা বহিতেছে।

সেই মুহূর্ত্তে আগ্রার এক দরিদ্র পল্লীর প্রান্তভাগে জনৈক দীর্ঘাকার গৌরবর্ণ সন্ন্যাসী দ্রুতবেগে পথ চলিতেছিল। সেই পল্লীর এক ক্ষুদ্র গৃহের বহির্দ্দেশে এক গতযৌবনা রমণী কাহার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়াছিল। সন্ন্যাসী তাহাকে দেখিয়া চমকিত হইয়া দাঁড়াইল। রমণীও সন্ন্যাসীকে দেখিল, তাহার সর্ব্বাঙ্গ, কম্পিত হইল। সন্ন্যাসী দূর হইতে ডাকিল, “বিনোদিনী!”

কণ্ঠস্বর শুনিয়া রমণী মূর্চ্ছিতা হইল। তখন সন্ন্যাসী ঊর্দ্ধশ্বাসে সেই স্থান পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করিল।

সেই দিন অপরাহ্নে সেইরূপ একজন গৌরবর্ণ দীর্ঘাকার প্রৌঢ় গুম্ফশ্মশ্রু জুটাজুট মণ্ডন করিয়া কাশেমখাঁর আহদী সেনাদলে প্রবেশ করিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *