ডাক্তারি
এক বছরের ইন্টার্নশিপের জন্য ডিউটি ভাগ করা হয়ে গেছে। যে কোনও একটি বিষয়ে ফিক্সড ডিউটি করতে হয়। যে বিষয়টিকে আমি প্রধান বলে মনে করি, সেই বিষয়ে। বেশির ভাগ মেয়েরা স্ত্রীরোগ ও প্রসূতি বিভাগে ফিক্সড ডিউটিটি নিয়েছে। মেডিসিন সার্জারি এক মাস করে হলেও স্ত্রীরোগে চার মাস। যৌনাঙ্গ ঘাঁটাঘাঁটি করা আমার বিশেষ পছন্দের ছিল না ছাত্রী থাকাকালীন, কিন্তু এই বিষয়টিকেই আমি প্রধান বিষয়ে হিসেবে নির্বাচন করে ফিক্সড ডিউটি নিই এই বিভাগে। চারমাসে চার মিনিট ফাঁকির কোনও সুযোগ নেই। ফাঁকি দেওয়া মানে নিজেকে ফাঁকি দেওয়া। ডাক্তারি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে প্রতি বছর বিদেশের মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার আসে। এ দেশে চাকরি করতে গেলে এ দেশে ডাক্তারি প্রশিক্ষণ নিতে হয়, নিয়ম এমন। প্রথম দিনই পরিচয় হয় মস্কো থেকে পাশ করে আসা দিবালোক সিংহের সঙ্গে। দিবালোক কমরেড মণি সিংহের ছেলে। সুসং দুর্গাপুরের মণি সিংহ। হাজং বিদ্রোহের মণি সিংহ। দুঃস্থ দরিদ্র মানুষের জন্য পুরো জীবন উৎসর্গ করা মণি সিংহ। সাধারণত বিদেশ থেকে পাশ করে আসা ডাক্তারদের আহামরি কিছু ভাবা হয় না। ভাবা হয় না কারণ তাদের মাথায় বিদ্যে থাকলেও হাতে দক্ষতা কম। বিদেশে এদেশের মত বেওয়ারিশ লাশও পাওয়া যায় না ইচ্ছেমত কেঁটে ছিঁড়ে বিদ্যেটি শেখার। এমন দরিদ্র রোগীর ভিড়ও নেই অন্য দেশে যে নির্ভাবনায় যখন তখন রোগির শরীরে গুঁতোগুঁতি করা যাবে, কোনও রোগী টুঁ শব্দ করবে না। আর অপারেশন থিয়েটারে সার্জনদের সহযোগিতা করার যে সুযোগ চতথুর্ বর্ষ থেকে আমাদের মেলে সেই সুযোগ তারা বিদেশের হাসপাতালে পায় না। খোদ বিলেত থেকে ডাক্তারি পাশ করে আসা এক মেয়েকে অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন যখন জিজ্ঞেস করলেন, কি মেয়ে, সিজারিয়ানে এসিস্ট করতে পারবা? মেয়ে মাথা নাড়ে, পারবে না। কোনওদিন করেনি। হেসে, জোবায়েদ হোসেন দেশি কাউকে ডাকেন। বিদেশিগুলোর পড়া বিদ্যে, দেখা বিদ্যে, করা বিদ্যে নেই। দিবালোক সিংহের পড়া বিদ্যে দেখা বিদ্যে থাকলেও আমি তাকে খাতির করি। প্রসব কক্ষে রোগির কাটা যৌনাঙ্গ কি করে পরতে পরতে সেলাই করতে হবে হাতে ধরে শিখিয়ে দিই তাকে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজটিতে ভাল লেখাপড়া হয়, এ কলেজ থেকেই প্রতিবছর ছাত্রছাত্রীরা দেশের অন্য যে কোনও কলেজের ছাত্রছাত্রীর চেয়ে পরীক্ষায় ভাল ফল করে। আমাদের আগের বছরে রাজিব আহমেদ হয়েছিলেন প্রথম। আমাদের বছরে এম-ষোল ব্যাচের প্রতিটি প্রফেশনাল পরীক্ষায় প্রথম হয়েছে মনসুর খলিল। এ কলেজটি ভাল হলেও এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে বেশির ভাগ সময় ছাত্র আন্দোলনের কারণে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া কম হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ বিলেতি পরিদর্শকদের অনুমোদন পেয়েছে, এ কলেজ পায়নি। পরিদর্শকবৃন্দ আসার আগে এই কলেজ হাসপাতাল দুটোই ধুয়ে মুছে তকতক করা হয়েছিল, ডাক্তার ছাত্রছাত্রী সবাই ধোয়া কাপড় পরে পরিপাটি হয়ে নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলেছিল সেদিন, তারপরও মহামূল্যবান অনুমোদন জোটেনি, কারণ পরিদর্শকবৃন্দ একটি নেড়ি কুকুরকে বসে থাকতে দেখেছেন হাসপাতালের বারান্দায়। অনুমোদন পাওয়া মানে এ কলেজ থেকে পাশ করে বিলেতের কলেজে বাড়তি লেখাপড়া করার অনুমতি পাওয়া। অনুমোদন পাওয়া হয়নি বলে আমরা খুব একটা মুষড়ে পড়িনি। মনসুর খলিল তো নয়ই। যে ছেলে বাড়ি আর কলেজ ছাড়া আর কোথাও নড়তে চায় না, তার জন্য বিলেত কোনও স্বপ্ন নয়। মনসুর খলিল দেখতে আস্ত একটি পাহাড়। ওজন দুশ কিলোর মত। খায় আর লেখাপড়া করে। শরীরটির লজ্জায় সে বাইরে কোথাও বেরোয় না, কোনও মেয়ের সঙ্গে কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমি যেচে কথা বলি মনসুরের সঙ্গে। অবশ্য বেশির ভাগই মজা করতে। করি সাফিনাজ সঙ্গে থাকলে। আমাদের দেখতে ভাল লাগে কথা বলতে গিয়ে মনসুর খলিলের ফর্সা মুখ টি যখন পাকা আমের মত লাল হয়ে ওঠে। হাসপাতাল এলাকাটিতে আমি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি নিজের পরিচয় নিয়ে। এখানে আমার মধ্যে আর একটি ডাক্তার-ছেলের মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই। আমি যদি মেধায় দক্ষতায় ছেলেটির চেয়ে ভাল হই, এখানে আমি মর্যাদা পাবো ছেলের চেয়ে বেশি। এখানে আমরা নারী পুরুষের যৌনাঙ্গ নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করে অভ্যস্ত, ঘেঁটে অভ্যস্ত যে শব্দ মুখে উচ্চারণ করা এই এলাকার বাইরে মানা সে সব শব্দ উচ্চারণ করতে এই এলাকায় লজ্জা বা দ্বিধার লেশমাত্র কারও জিভে থাকে না। ইন্টানির্ হয়েই হাসপাতালের ডক্টরস ক্যান্টিনে আমি যেতে শুরু করেছি। ডিউটির ফাঁকে ক্ষিধে লাগলে চা সিঙ্গারা খাই। সময় থাকলে আড্ডা আর টেবিল টেনিস দুটোই চলে। এখানে পুরুষ ডাক্তারের গায়ে যদি আমার গা লাগে বা হাতে হাত লাগে তবে আমি নষ্ট হয়ে গেছি বলে মনে করা হয় না। আমার বাইসেপ ব্র্যাকিতে ওর ট্রাইসেপ ব্র্যাকির টাচ লেগেছে বলেই বলা হয়। এখানে সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি একজন ডাক্তার। মাঝে মাঝে ওয়ার্ডের রোগীরা ভুল করে সিস্টার ডাকলে অবশ্য শুধরে দিতে হয়, যে আমি নাসর্ নই। আর্কিটেকচারে পড়তে না পারার জন্য যে আফসোসটি ছিল আমার, সেটি ডক্টরস ক্যান্টিনের চায়ের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে যায়। ডাক্তার হয়ে আমি ভুল করিনি, এ বিশ্বাসটি শক্ত হয়ে মনের মাটিতে গেড়ে বসে, যদিও ডাক্তারি পড়তে গিয়ে আমার সাহিত্য চর্চা গোল্লায় গেছে, শখের যে কবিতা, সেও আর লেখা হয় না। কবিতা লিখে নিজের একার আনন্দ হয়, কিন্তু চিকিৎসা করে হাজার মানুষকে আনন্দ দিতে পারি। হাসপাতালে সব ধরনের রোগী আসে, উচ্চজ্ঞবত্তরা কেবিন ভাড়া করে, মধ্যবিত্তরা সামর্থ হলে করে, দরিদ্র থাকে ওয়াডের্। হাসপাতালে ওষুধের অভাব, সব ওষুধ সরকার দেয় না। সেই ওষুধগুলো রোগীদের কিনে আনতে হয় বাইরে থেকে। কিন্তু দরিদ্র রোগীর পক্ষে বাইরে থেকে ওষধু কেনা সম্ভব নয়। উচ্চজ্ঞবত্ত বা মধ্যবিত্ত রোগিকে যখন কেনার জন্য ওষুধের নাম লিখে দিই কাগজে, একটির দরকার হলে লিখি পাঁচটি। পাঁচটির দরকার হলে লিখি দশটি। লিখি, কারণ উচ্চজ্ঞবত্তর জন্য ব্যবহারের পর বাকি যা থাকবে তা দেব দরিদ্র রোগিকে। কোনও রোগিকে জানানো হয় না যে আমরা ডাক্তাররা গোপনে গোপনে এই কাজটি করি, দরিদ্র বাঁচাই। দরিদ্রদের জন্য সন্ধানীতেও দৌড়োই। দরিদ্ররা রক্তের ব্যাংক থেকে টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে পারে না, দরিদ্রদের রক্ত লাগলে সন্ধানী থেকে এনে নিই। কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা সন্ধানী নামের এই সংস্থাটি দরিদ্রদের সাহায্য করতেই খুলেছে। একদিন সন্ধানী আপিসে গিয়ে আমি চোখ দান করে আসি। মৃত্যুর পর চোখদুটো যেন কাজে লাগে কোনও অন্ধের। ওদের বলি, আমি দেহদান করব। মৃত্যুর পর আমার দেহ যেন মেডিকেল কলেজের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে পাঠানো হয়। সন্ধানীতে দেহদানের কোনও কাগজপত্র নেই যে দান করতে পারি। সম্ভবত বেওয়ারিশ লাশের আধিক্য বলে এই প্রয়োজনটির কথা সদস্যরা উপলব্ধি করে না। আমার এপ্রোনের পকেটে ঝুনঝুন করে প্রচুর অ্যাম্পুল। ধনীর টাকায় কেনা ওষুধ পকেটে জমছে। ওষধু কোম্পানির প্রতিনিধিদের দিয়ে যাওয়া ওষধু জমছে। একদিকে জমছে, আরেকদিকে যাচ্ছে, দরিদ্র রোগীর হাতে যাচ্ছে। সব ডাক্তারের পকেটেই দরিদ্রকে সাহায্য করার জন্য কিছু না কিছু ওষধু থাকে। কেউ কেউ ওষুধ না থাকলে নিজের পকেট থেকে টাকা দেয় ওষধু কিনে আনতে। এমন উদারতা আর সততার মধ্যে আমার ডাক্তারি চর্চা চলে। কেউ কেউ আবার ওষুধের ভেতর ডুবে থেকে মাঝে মাঝে উদ্ভট সব কাণ্ড করে ফেলে। আমারই ক্লাসের ছেলে রিজওয়ান দেখতে বুদ্ধিতে তুখোড়, রোগির জন্য সরকারি ওষুধের ভাণ্ডার থেকে পেথিডিন নিয়ে নিজে মজা করতে গিয়ে একদিন নিজের শরীরেই পেথিডিন ঢুকিয়ে মজা পেয়ে বার বারই পেথিডিন ঢোকাচ্ছে এখন। এ তো আটকে যাওয়া জালে। নেশার জালে। অনেক ডাক্তার আবার নিজেরাই নানা উদ্ভট কাজে নিজেদের আটকাতে চেষ্টা করে। সার্জারি ওয়াডের্ ডিউটি আমার তখন। মস্তিষ্কের অপারেশন করছেন অধ্যাপক। মাথার খুলি খোলা। খুলি খুলে রেখেই অধ্যাপক হাত ধুয়ে ফেললেন। কেন? নামাজ পরবেন তিনি। কোনও নামাজই তিনি বাদ দেন না। অপারেশন চলাকালীন সময়ে আযান পড়লে রোগিকে পনেরো মিনিট বেশি অজ্ঞান রেখে নামাজ সারেন। ডাক্তার হয়ে কি করে ধমের্ বিশ্বাস করেন, আমি বুঝে পাই না। মস্তিষ্কের মত জটিল জিনিস যে অধ্যাপকের মাথায় এত পরিষ্কার ঢোকে, তাঁর কেন এ জিনিসটি মাথায় ঢোকে না যে ধর্ম একটি যুক্তিহীন ব্যাপার। কি করে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন আল্লাহ নামের একজন বসে আছেন সাত আসমানের ওপর, তিনি এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন, তিনি নিজের হাতে গড়া এই পৃথিবী ধং্ব স করে ফেলবেন একদিন, তারপর শেষ বিচারের দিন সব মানুষকে আবার জীবিত করবেন, সকলেই কুড়ি বছরের বয়সের মত দেখতে হবে, হাশরের মাঠে জিন এবং মানুষের বিচার হবে, তারপর অনন্ত কালের জন্য মানুষেরা বাস করবে বেহেসত অথবা দোযখে, যারা আল্লাহকে মানেনি তারা দোযখে যাবে, যারা মেনেছে তারা বেহেসতে,এরকম উদ্ভট রূপকথা!আসলে রূপকথাগুলোকেও আমার এত অবাস্তব ঠেকে না, যত ঠেকে ধমর্গু লোকে। ব্যাঙ থেকে রাজকুমার বেরোতে পারে, মুরগির ঠ্যাংয়ের ওপর ডাইনির বাড়ি থাকতে পারে, কিন্তু এই জীবনের পরে আরও কোনও জীবন থাকতে পারে না। কিছু কিছু ডাক্তার ওই জটিল অ−স্ত্রাপচার করতে করতে বিশ-্ব ইস্তেমায় যাওয়ার কথাও বলেন। টঙ্গীতে ইস্তেমা হচ্ছে, মুসল্লিরা যাবে, ওয়াজ মাহফিল শুনবে, বিশাল জমায়েতে নামাজ পড়বে। তিন দিনের ছুটি নিয়ে টুপি পরা ডাক্তাররা যায় ইস্তেমায়। টুপিঅলা ডাক্তারের সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। কিন্তু তাই বা হবে কেন! কেনই বা একজন ডাক্তার মাথায় টুপি পরবে! আর কেউ ধর্ম বিশ্বাস করলে আমি বলি যে শিক্ষা নেই দীক্ষা নেই, বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানে না, তাই ধর্ম বিশ্বাস করে। কিন্তু ডাক্তারদের বেলায় আমি কোনও কারণ দেখি না এসব বিশ্বাসের। ইস্তেমা যাষনী বাবুলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি কারণে আল্লাহ বিশ্বাস কর?
কি কারণে করব না?
খুব সাধারণ যুক্তির কারণে। চিকিৎসা বিজ্ঞানে তো মাথা ঢের খাটিয়েছো। ধর্মের ব্যাপারে খাটাও না! দুনিয়ার সব কিছু তো যুক্তি দিয়ে বঝু তে চেষ্টা করো, কোরান হাদিসের কথাগুলো কি একবার যুক্তি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছো?
বাবুল নিজেই বলে সে তা করেনি। সে করতে চায় না। কারণ সে মনে করে যুক্তি এক জিনিস, বিশ্বাস আরেক। দুটোকে সে মেলাতে চায় না। বাবুল, আমার বিশ্বাস, জানে যে ধর্ম সম্পণূর্ যুক্তিহীন একটি ব্যাপার। সে ভাল জানে যে এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ছদিনে সৃষ্টি হয়নি। জানে যে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে না। জানে যে পাহাড়গুলো আল্লাহ কিলকের মত আটকে রেখেছেন বলে পৃথিবী ডানে বামে হেলে পড়ছে না এই তথ্য মিথ্যে। মিথ্যে যে পৃথিবীর প্রথম মানুষ আদম, দ্বিতীয় মানুষ আদম থেকে সঙ্গিনী হাওয়াকে তৈরি করা হয়েছে, মিথ্যে যে গন্দম ফল খেয়েছে বলে আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়ে পৃথিবীতে নিক্ষেপ করেছেন। বাবুল জানে বিং ব্যাং এর কথা, জানে যে কোটি কোটি বছর ধরে মহাশূন্যে কোটি কোটি গ্রহ উপগ্রহ, নক্ষত্র ঘুরে চলছে। মানুষ নামক প্রাণীর কি করে উৎপত্তি জানে সে, জানে বিবর্তনের তত্ত।্ব কিন্তু তারপরও সে নামাজ রোজা করছে, ইস্তেমায় যাচ্ছে। এর কারণটি হল, সে লোভী। লোভী বলেই ইহজগতও চায়, পরজগতও চায়। ইহজগতে ডাক্তার হয়ে সমাজে উঁচু স্তরের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল, এতে তো সুখ আছেই। আর যদি আল্লাহ বলে কিছু থাকে, পরকাল বলে কিছু থাকে, তবে পাঁচবেলা নামাজ, এক মাস রোজা আর বছরে একবার ইস্তেমায় গিয়ে যদি বেহেসত জোটে, তবে মন্দ কি!
বাবুলের মত ছেলের সঙ্গে তর্কে গিয়ে কোনও লাভ নেই। বাবুল কোনও তর্কে যেতেও চায় না। সে তার বিশ্বাস নিয়ে থাকতে চায়।
আজকাল কোরান হাদিসএর অনেক বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করলে জৎু সুই উত্তর মার মুখে খেলে না। মা যখন কোরান শরিফ সামনে নিয়ে দুলে দুলে পড়েন, সামনে বসি। কোরান পড়তে পড়তে দোযখের আগুনের কথা মনে করে মার মুখ টি যখন বিবণর্ হয়ে থাকে, আমার ওই বসে থেকে মার কোরান পড়া শোনাটিকে আমার সুমতি হয়েছে বলে ধরে নিয়ে মুখের আদি বণর্ ফিরে আসে মার। মা স্নিগ্ধ হেসে বলেন, কি,পড়বা কোরান শরিফ?
আমি হেসে বলি, আমি তো পড়ছিই। একটা বই আর কতবার পড়তে হয়?
আমার যে মোটেও সুমতি হয়নি, তা আঁচ করেন মা।
আচ্ছা মা, এই যে ছেলেরা টুপি পরে, কেন পরে?
সুন্নত পালন করে। হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়েসসাল্লাম যেই পোশাক পরতেন, সেই পোশাকই পরাটা সুন্নত। দাড়ি রাখাটা সুন্নত।
নবীজিরে অনুকরণ করতে চায় কেন?
বাহ! করবে না কেন। উনি তো শেষ নবী। শ্রেষ্ঠ নবী। আল্লাহর পেয়ারা রসুল। নবীজির গুণের শেষ নাই, তাই না?
তাঁর মত গুণ আর কারও নাই। তিনি মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মানুষ।
কোলে একটি বালিশ নিয়ে বালিশে দু কনুইয়ের ভর দিয়ে বসে হেসে উঠি আমি।
তুমিই বল আল্লাহর পেয়ারা রসুলের, শ্রেষ্ঠ নবীর, শ্রেষ্ঠ মানুষের আমাদের নবীজির কি ছয় বছর বয়সের আয়শারে বিয়া করা উচিত হইছিল?
তিনি অনেক মেয়েরে বিয়ে করছেন মেয়েদের দারিদ্র থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য। অসহায় মেয়েদের একটা গতি করছেন তিনি।
ছয় বছরের মেয়ে আয়শার কি গতিটা করছেন শুনি? যদি তিনি আয়শার গতি করতে চাইতেন সত্যিকারের, তাইলে তারে ওই বয়সে বিয়া করতেন না, পালক মেয়ে হিসাবে পালতে পারতেন। গরিব মেয়েদের উপকার করতে চাইলে তাদের টাকা পয়সা দিয়া সাহায্য করতে পারতেন। বিয়া কইরা না। বিয়াই যদি অত দরকার হইতো, নিজের বন্ধু বান্ধব যারা বিবাহিত না, তাদের সাথে বিয়া দিতে পারতেন। নিজের বিয়া করার দরকার কি ছিল, দেশে কি আর পুরুষ মানুষ ছিল না নাকি?
উনারে পছন্দ করছেন মেয়েরা.. তাই উনারে..
পছন্দ করছে? কারও পছন্দের ধার কি উনি ধারছেন নাকি? নিজের ছেলের বউ জয়নব কি উনারে পছন্দ করছিল? নাকি ছেলের বাড়িত গিয়া বউরে দেইখা পাগল হইয়া বিয়া কইরা ফেলছেন! কি কইরা ছেলের বউরে মানুষ বিয়া করে কও তো! বাবা যদি এহন দাদারে বলে, হাসিনারে তালাক দে, আমি ওরে বিয়া করাম। কিরকম হইব? দাদা বাপের আদেশে হাসিনারে তালাক দিল। আর বাবা হাসিনারে বিয়া করল। ছি ছি ছি।
নবীজির নিজের কোনও ছেলে ছিল না। জাইদ পালক ছিল।
পালক থাকুক। পালক হইছে বইলা কি ছেলে না? মানুষ তো ছেলে মেয়ে পালক রাখলে নিজের ছেলে মেয়ের মতই মানুষ করে। ধর তুমি যদি একটা মেয়ে পাইলা টাইলা বড় কর, তারপরে কি বলতে পারবা যে এইডা তোমার মেয়ে না? পারবা ওই পালক মেয়ের স্বামীরে বিয়া করতে? পারবা না তো। ওই ছেলের বউরে বিয়া করার পরই তো আইন পাইল্টা গেল। পালক পুত্র কন্যা সত্যিকার পুত্র কন্যা নহে। সুতরাং তাদেরে উত্তরাধিকার থেইকা বঞ্চিত কর। নিজের স্বার্থের জন্য কেউ এমন নির্মমতা করে?
স্বার্থ না। স্বার্থ না। না বুইঝা কথা কইস না।
স্বার্থ ছিল বইলাই তো ধনী খাদিজারে বিয়া করছিলেন। খাদিজার ধন লইয়া ব্যবসা করলেন। তহন অন্য মেয়ের দিকে নজর দেন নাই। যেই খাদিজা মারা গেল, সমানে বিয়া করতে লাগলেন।একটার পর একটা। কেন? খাদিজা বাইচা থাকতে তো ওই সাহস হয় নাই! স্বার্থ না তো কি? যুদ্ধে শত্রুসম্পত্তি তো দখল করছেনই, শত্রুপক্ষের মেয়েদেরও ভোগ করছেন। করেন নাই? নিজের জন্য সুন্দরীগুলারে রাইখা বাকিগুলা বন্ধুদের বিলাইছেন। কোরানেও তো লেখা আছে, নবীরে ভোগ করতে দাও এই সব মেয়ে!! ছি!! কোনও বিবেকবান মানুষ এই জঘন্য কাজ করে? কোনও সুস্থ লোক চৌদ্দটা বিয়া করে?
চৌদ্দটা না, তেরোটা।
কি পার্থক্য? চৌদ্দটা না কইরা তেরোটা করলে তোমার কাছে ভাল মনে হয়? বাবা দুইটা বিয়া করছে, খবর শুইনা ত তুমি বাবারে অমানুষ বইলা গাল দেও। তোমার নবীজিরে গাল দেও না কেন?
তখনকার সময় আর এখনকার সময় এক না। তখন সমাজের অবস্থা অন্যরকম ছিল।
এহন সমাজের অবস্থা কি রকম? এহন তো চারটা বিয়া করতে পারে পুরুষ মানুষ! বাবা যদি তিনটা বউ আইনা বাড়িত রাখে, তুমি কি করবা? থাকতে পারবা তিন সতিন নিয়া?
মা মুখ বিষ করে কোরান বন্ধ করে রেখে বলেন, নবীজি কাউরে এক বাড়িতে রাখেন নাই।
এক বাড়িতে রাখেন নাই, তাতে কি হইছে? এক বাড়ি থেইকা আরেক বাড়িতে তো গেছেন। বিবিদের চাকরানিদেরও ওপর তো লোভ করছেন! তাদেরও তো ভোগ করছেন। কাউরে তো ভোগ করতে বাদ রাখেন নাই!
যা করছেন আল্লাহর হুকুমে করছেন।
আল্লাহ এইরকম জঘন্য হুকুমই বা দিছেন কেন? প্রেরিত পুরুষ! মহানবী! সকলের শ্রদ্ধার মানুষ! তার চরিত্রটা তো আল্লাহ একটু ভাল বানাইতে পারতেন।
নাসরিন, তুই নবীজিরে নিয়া বাজে কথা বলতাছস। তর তো দোযখেও স্থান হইব না। তর যে কি হইব? তর কপালে যে কি আছে!
মার সঙ্গে এরকম কথা হওয়ার পর মা বারান্দায় একলা বসে থাকেন অথবা জানালার দিকে মুখ করে চুপচাপ শুয়ে থাকেন। আমি অনুমান করি মা ভাবছেন প্রেরিত পুরুষের কথা, কেন আল্লাহর প্রেরিত পুরুষটি কোনও আদর্শ চরিত্রের হলেন না! কেন তিনি সমালোচনার উর্ধে ওঠার মত হলেন না! এধরনের কথা হওয়ার পর মা অনেকক্ষণ পর আমার কাছে এসে আমার বুকে মুখে সুরা পড়ে ফুঁ দেন। নরম গলায় বলেন, তওবা করো আল্লাহর কাছে। বল যে ভুল হইছে তোমার। ভুল করছ। আল্লাহ ক্ষমা কইরা দিবেন। আল্লাহ থাকলে তো ক্ষমা করবেন?
যদি থাকেন! যদি থাকেন! যদি আল্লাহ থাকেন? তাইলে কি করবি? তাইলে কি অবস্থা হইব তর, একবার চিন্তা করছস?
মা যখন খুব মন দিয়ে ফরজ সুন্নত নফল সব রকমের নামাজ পড়তে থাকেন, আর আমি যখন বলি, কেন যে এইসব পড়! কি লাভ? মরার পর দেখবা আর জীবিত হইতাছ না। ফক্কা। কোনও দোযখও নাই। কোনও বেহেসতও নাই। তহন?
মা বলেন, হ যদি দেখি কিছু নাই, তাইলে তো নাইই। আমার সব ইবাদত বথৃা গেল। কিন্তু, যদি থাকে? যদি থাকে সব?
মা এই যদির ওপর আশঙ্কা করে নামাজ রোজা করেন। যদি শেষ বিচারের দিন বলে কিছু থাকে, তবে যেন ভাল ফল পান। আমার মনে হয় কেবল মা নন, আরও অনেকে এই যদি র কারণেই আল্লাহ রসুল মেনে চলে। মার সঙ্গেও তর্কে বেশিদূর এগোয় না।
হাসপাতালের রোগীদের ওপর, যেহেতু রোগিরা আল্লাহর পরই যে মানুষকে বিশ্বাস করে, সে হল ডাক্তার, খানিকটা কঠোর হই। ডাক্তারদের আদেশ উপদেশ তারা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। করলে কি!বালিশের নিচে মৌলানার ফুঁ দেওয়া গাছের শেকড় রাখে, অসুখ ভাল হলে ডাক্তারের চিকিৎসায় নয়, শেকড়টির কারণে অসুখ ভাল হয়েছে বলে বিশ্বাস করে। এক রক্তশূন্যতার রোগিকে সন্ধানী থেকে যোগাড় করে চার ব্যাগ রক্ত দিয়ে আর ওষধু দিয়ে যায়-যায় হৃদপিণ্ডকে ভাল করে তোলার পর রোগিকে উঠে বসতে বলি। উঠতে গিয়ে লোকের বালিশ সরে যায়। বালিশের তলে একটি শেকড়।
এইটা কি?
দোয়া পড়া শেকড়।
এইটা কাছে রাখছেন কেন?
রোগি হেসে বলে, এইটা রাখলে রোগ বালাই দূর হয়, তাই রাখছি।
কি মনে হয় ডাক্তারের ওষুধে ভাল হইছেন নাকি ওই শেকড়ে?
রোগী বলে, এবারও হেসে, ওষধু দিয়া চেষ্টা করছেন ভাল করতে। কিন্তু আল্লায় ভাল করছে। আল্লাহ ছাড়া কেউ কি বাচাইতে পারে? শেকড়ডাতে আল্লাহর কালাম পইড়া ফুঁ দেওয়া আছে।
এরপর যে রোগিই আসে, আগে দেখি হাতে পায়ে কোমরে বাধাঁ কোনও তাবিজ আছে কি না, কোনও শেকড় আছে কি না। থাকলে ওগুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পরে চিকিৎসা শুরু করি। বলে দিই তাবিজ কবজ কাছে রাখলে চিকিৎসা পাইবেন না। ওইসব যদি রোগ ভাল করে বইলা মনে করেন তাইলে বাড়ি যান। বাড়ি গিয়া শেকড় বালিশের নিচে রাইখা শুইয়া থাকেন। তাবিজ কবজ শরীরে বান্ধেন। যত মৌলবি আছে সবার ফুঁ লন। পড়া পানি খান। রোগ কি কইরা ভাল হয় দেখব।
এক এক ওয়ার্ডের এক এক দিন ভর্তির তারিখ থাকে। ওদিন নাগাড়ে রোগী আসতে থাকে। বিছানা ভরে যায়, এমন কি মেঝেও। প্রতিটি রোগীর হিস্ট্রি লেখা, প্রতিটি রোগীর মাথা থেকে পা অবদি পরীক্ষা করা, রোগ নির্ণয় করা, প্রতিটি রোগীর জন্য প্রাথমিক ওষধু লিখে দেওয়া,মরো মরো রোগী এলে নিজে সামলাতে না পারলে বড় ডাক্তারদের খবর দেওয়া ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। পুরুষ রোগীর চেয়ে মেয়ে রোগীর সংখ্যা কম হাসপাতালে। মেয়েরা মৃত্যপু থযাষনী হওয়ার আগে তাদের কেউ হাসপাতালে আনে না। বিষ খেয়ে মরছে কোনও মেয়ে, শরীরের কোথাও ছোট্ট কোনও পলিপ থেকে না- চিকিৎসায় না-চিকিৎসায় ক্যান্সার ঘটিয়ে আসা মেয়ে—প্রতিটি মেয়ের শরীরে রক্তশূন্যতা, পুষ্টিহীনতা। আমি এদের কাছ থেকে, কেবল ডাক্তার যেটুকু জানলেই চলে, তার চেয়ে, অধিক জানতে আগ্রহী। সংসারের সবাইকে ভাল খাইয়ে নিজেরা এঁটো কাঁটা খায়! অসুখ বিসুখ পুষে রাখে শরীরে। মেয়েদের অসুখ হলে সংসার চলে না, তাই। অসুখের কথা জানালেও বাড়ির লোকেরা তেমন গা করে না। অসুখ দেখতে গিয়ে ডাক্তাররা ছোঁবে মেয়েদের, এ জিনিসটিতে বাড়ির পুরুষেরা সায় দেয় না। তাই অসুখ পোষা ছাড়া মেয়েদের আর করার কিছু থাকে না। নিজেরা একা চলে আসবে হাসপাতালে এই সাহস তাদের নেই। বিবাহিত মেয়েরা অসুখ নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে বাপের বাড়ি বেড়াতে গেলে, সাধারণত বাপের বাড়ি থেকেই তারা আসে হাসপাতালে, বাপের বাড়ির আত্মীয়রা নিয়ে আসে।
কেবল যে আমার ডিউটি থাকে ওয়াডের্, তা নয়,অন্য ডাক্তারদেরও থাকে। গুরুতর জখম হওয়া এক রোগীর হিস্ট্রি লিখতে গিয়ে এক ডাক্তার বন্ধু লিখেছে, শি ওয়াজ বিটেন। সেটি কেটে দিয়ে নতুন কাগজে হিস্ট্রি লিখে দিই রোগীর ঘটনা বিস্তারিত জেনে।শি ওয়াজ ব্রুটালি হিট বাই হার হাজবেন্ড। দ্যা ক্রুয়েল ম্যান ইউজড অ্যাক্স এন্ড বাম্বু অন হার বডি। হি ওয়াণ্টেড টু কিল হার। হি ইভেন সেইড তালাক টু হার। হার ক্রাইম ওয়াজ দ্যাট হার ফাদার কুডনট পে দাউরি মানি ইন টাইম। ওষুধের লিষ্টিতে একটি এন্টি ডিপ্রেসেন্ট যোগ করে দিই। ডাক্তার বন্ধুটি আমার হিস্ট্রি লেখা দেখে মন্তব্য করে, কে মারল কি দিয়ে মারলো কেন মারল সেটা আমাদের জেনে কি দরকার! আমাদের কাজ হল চিকিৎসা করা। তা ঠিক, এ কথা সব ডাক্তারই বলবে আমি জানি। বাড়তি যে হিস্ট্রিটুকু লিখেছি আমি, লিখে আমার একধরনের তৃপ্তি হয়, মেয়েটিকেও বলেছি, লেইখা রাখলাম যে আপনের স্বামী আপনের এই অবস্থা করছে। হাসপাতালে কাগজে মেয়েটির করুণ দশার কথা লিখে মেয়েটির জীবনের কোনও পরিবর্তন হবে না জানি। তবু লিখলে ক্ষতি কি? ডাক্তারদের যে একেবারে কোনও সামাজিক দায়িত্ব নেই তা নয়। অপারেশনের পর রোগীদের ব্যথা কমাতে পেথিডিন দেওয়া হয়। পেথিডিন পেয়ে শরীর এমন ভাল-লাগায় ভগু তে থাকে যে ব্যথা কমে গেলেও রোগীরা কোঁকাতে থাকে পেথিডিন পেতে। রোগির যেন পেথিডিনে আসক্তি না হয়, ডাক্তার ডি-ডব ্লু ইনজেকশন দিতে নার্সকে ডাকেন। নার্স সিরিঞ্জে ডিসটিল্ড ওয়াটার ভরে রোগীর নিতম্বের মাংসে সুঁই ফুঁটিয়ে আসে। রোগিদের কোঁকানো আর থেকে থেকে নাসর্ বা ডাক্তারকে ডাকা বন্ধ হয়, এভাবেই পেথিডিনের নেশা হওয়া থেকে রোগীদের বাঁচায় ডাক্তার। এ নিশ্চয়ই সামাজিক দায়িত্ব।
ডাক্তার বটে আমি, ওয়াডের্ দিন রাত পড়ে থেকে রোগীদের চিকিৎসা করছি বটে, তবে সব রোগের চিকিৎসা করার অধিকার আমার নেই। গাইনিতে কেবল দিনে নয়, রাতেও ডিউটি পড়ে। সপ্তাহে তিন থেকে চার রাত কাটাতে হয় হাসপাতালে। তো এক রাতের ডিউটিতেই দুটো ঘটনায় আমার ওপর সমন জারি হয়। রাত বারোটায় রোগী এল রিটেইন্ড প্লাসেন্টা নিয়ে। বাচ্চা হয়েছে দুদিন আগে, জরায়ুর ফুল পড়েনি এখনো। রিটেইনন্ড প্লাসেন্টা এলে নিয়ম বড় ক্লিনিক্যাল এসিস্ট্যান্ট বা রেজিস্টারকে ডাকা। কাউকে না ডেকে আমি নিজে চেষ্টা করি ফুল বের করতে। জরায়ুর বন্ধ মুখ ধীরে ধীরে হাতে খুলতে চেষ্টা করে ঘন্টা খানিক পর সফল হই, ফুল বেরিয়ে আসে। সে রাতেই রাত আড়াইটার দিকে এক রোগী আসে, বাচ্চা বেরোচ্ছে না, পানি ভেঙে গেছে দুপুরে, বাচ্চার মাথা জরায়ুর মুখের কাছে এসে আটকে আছে ঘন্টা কয়েক। ভেতরে বাচ্চার অবস্থা যায় যায় প্রায়। যদি বড় ডাক্তারদের খবর দিতে যাই, ওরা ডক্টরস কোয়ার্টার থেকে হাসপাতাল অবদি আসতে আসতে বাচ্চা বেঁচে থাকবে না বলে আমার আশঙ্কা হয়। নিজেই হাতে ফরসেপ নিই। এতকাল অন্যকে দেখেছি ফরসেপ-ব্যবহার করতে, নিজে কখনও ব্যবহার করেনি। আমার সঙ্গে যে ডাক্তারদের ডিউটি ছিল, নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আমার কাণ্ড দেখেছে। কাণ্ডটি ঘটার সময়ই একজন দৌড়ে গিয়ে সিএকে কল দিয়ে এসেছে। সিএ যখন এসেছে, বাচ্চাকে অক্সিজেন দিয়ে স্বাভাবিক শ্বাস নেওয়ানো হয়ে গেছে। আমি তখন সেলাই করছি ফরসেপের জন্য প্রশস্ত করা যোনিদেশ। সকাল আটটায় অধ্যাপক আসেন। তিনি পৌঁছোনোর দুমিনিটের মধ্যেই তাঁকে ঘটনা জানানো হয়। ক্যান্টিন থেকে চা খেয়ে চাঙ্গা হয়ে অধ্যাপকের সঙ্গে ওয়ার্ড রাউন্ড দিতে এসেছি, দিয়ে চলে যাবো বাড়িতে, ঘুমোতে। যদিও ডাক্তার হয়ে গেছি, জোবায়েদ হোসেনের সামনে কিন্তু আগের মতই, ছাত্রী। তাঁর পেছন পেছন ওয়াডর্গু লো ঘুরতে হয় সকাল বেলা, ঘোরার সময় ছাত্রী অবস্থায় বুক কেঁপেছে, ডাক্তার হয়েও কাঁপে। বাঘের সামনে দাঁড়ানো আর জোবায়েদ হোসেনের সামনে দাঁড়ানো এক কথা। অধ্যাপক জোবায়েদ হোসেন রাউন্ড দিতে শুরু করে দিয়েছেন। আমি রাউন্ডে ঢুকতে গেলেই তিনি আমার দিকে এগোন। চশমার তলে বাঘের দৃষ্টি। আমাকে এক্ষুনি ভক্ষণ করার মত কি কাণ্ড ঘটেছে, তা ঠাহর করার আগেই তিনি বললেন, তুমি রিটেইন্ড প্লাসেন্টা ম্যানুয়েলি রিমুভ করছ? হ্যাঁ স্যার।
জোবায়েদ হোসেনের পেছনে থেকে পঁচিশ জোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সুন্দরবনের মাচায় বসে বাঘের হরিণ খাওয়া দেখতে যেমন উৎসুক চোখ, সে রকম। আবারও জোবায়েদ হোসেনের গলা থেকে হালুম হালুম,তুমি ফরসেপ ডেলিভারি করেছ?
হ্যাঁ স্যার।
কেন করেছ?
বাচ্চার অবস্থা খারাপ ছিল।
রিটেইন্ড প্লাসেন্টা ম্যানুয়ালি রিমুভ করছ কেন?
রোগির অবস্থা খারাপ ছিল। তাই..
যদি কোনও এক্সিডেন্ট হত?
রোগি ভাল আছে। একটু আগে দেখে এসেছি। বাচ্চাও ভাল আছে।
রোগি ভাল আছে, এটা কোনও এক্সকিউজ না।
আমাকে বাহা−ন্নাটি চোখের সামনে মাথা নত করতে হয়। সেই সকালেই জোবায়েদ হোসেন বড় একটি নোটিশ ঝুলিয়ে দেন প্রসুতি কক্ষে, ইন্টানির্ ডক্টরস আর নট এলাউড টু ডু এনিথিং উইদ ফরসেপ ডেলিভারি এন্ড রিটেইন্ট প্লাসেন্টা।
সেই জোবায়েদ হোসেনই, পরদিন প্রসুতিকক্ষে এক রোগী এপিসিওটমির জন্য বসে ছিল অপেক্ষায়, ডাক্তার নেই ডাক্তার নেই! কোথায় ডাক্তার! হাতের কাছে একজনকে পাওয়া গেলেই খপ করে ধরে রোগী পড়ে আছে কেন লেবার রুমে জিজ্ঞেস করতেই ডাক্তার ইতিউতি তাকিয়ে ঢোক গিলতে গিলতে যখন বলল, স্যার তসলিমার কথা ছিল এপিসিওটমি করার, তিনি দাঁত খিঁচিয়ে বললেন,তসলিমাকে দোষ দিতে চাও তো! শোনো, ওরই সাহস আছে কিছু করার। কারেজিয়াস মেয়ে। সেই পারবে ডাক্তারি করে খেতে। তোমার মত মূষিক পারবে না।
ফিক্সড ডিউটিতে ব্যস্ত থাকার সময়ই মা একদিন বলেন, বাজানের শইলডা বালা না। কেন, কি হইছে?
চলতে ফিরতে পারে না। উল্ডা পাল্ডা কথা কয়।
কেন, সেইদিন না জাম্পার লইয়া আইল!
নানা পকেটে করে বা প্যাকেটে করে কিছু না কিছু আনেন,সামান্য হলেও আনেন, যখন আসেন। মেয়ের হাতে একটি বিস্কুট হলেও দিয়ে বলেন, মা, তুমি খাইও। একগাদা লান্ডির জাম্পার দিয়ে গেছেন, ওগুলো দিয়েই আমাদের অনেকগুলো শীত চলে যাবে। নানা কেন অসুস্থ হবেন! মাত্র দু সপ্তাহ আগে নানিবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, তিনি দিব্যি সুস।্থ খাচ্ছেন। পাতে মাছের ঝোল ঢেলে দিতে দিতে নানি বলছেন, দোকানে তো আয় তেমন হইতাছে না। নানার দাতা হাতেমতাই স্বভাব আর যারই পছন্দ হোক, নানির মোটেই পছন্দ নয়।
আয় লাগব না, যা আছে তাই ভাল। কই একটু নুন দেও ত! শীতল পাটিতে আসন করে বসে ভাত মাখতে মাখতে মাখতে বললেন নানা।
নানি নুনের বয়াম নানার দিকে ঠেলে দিয়ে বললেন, আয় না করলে চলব! পুলাপান খাইব কি!
পুলাপান কি না খাইয়া থাকে নাকি?
দোকানের বাবুর্চিরা নিজেরা বড় বড় দোকান দিয়া হাজার টাকা ঘরে নিতাছে। আপনের তো পসার কিছু হইল না।
ওরা চুরি করলে আমিও কি চুরি করুম নাকি?
আপনেরে চুরি করতে কইতাছি না। ব্যবসাডায় মন দিতে কইতাছি।
ব্যবসায় যে মন নেই নানার, সে নানি বেশ ভাল জানেন। সেদিনও দোকানে হুট করে ঢুকে দেখলেন রাস্তার তিনটে পাগল চেয়ারে ঠ্যাং তুলে হাপুস-হুপুস খাচ্ছে। নানা পাশে বসে পাগলদের পাতে বড় বড় মাংস তুলে দিচ্ছেন। নানি বললেন, গাহেকের খবর নাই, পাগল খাওয়াইতাছেন বওয়াইয়া? নানা ভেংচি কেটে বললেন, আমার দোকান, আমি যারে ইচ্ছা খাওয়াইয়াম। তোমার কি? যাও যাও বাড়িত যাও।
দুটো গ্রাস মুখে দিয়েছেন কি দেননি, নানি গেলেন কলতলায়, ঠিক পেছন পেছন তিনি ভাতের থাল হাতে উঠে পুরো পাতের ভাত ঢেলে দিলেন উঠোনে।
কী ব্যাপার ভাত ফালাইছেন কেন? কলতলা থেকে চেঁচিয়ে নানি বলেন।
কুত্তা টুত্তা আছে খাইব নে!
নানির কাছে এ নতুন নয়। প্রায়ই তিনি দেখেন নানা জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো করে পাউরুটি ছুঁড়ছেন।
কি ব্যাপার পাউরুটি বাইরে ফেলতাছেন কেন?
নানা বলেন, পিপঁ ড়া পপু ড়া আছে, খাইব নে।
পুলাপান পাউরুটি পায় না, আর আপনে পিপঁ ড়ারে পাউরুটি দেইন!
খায়রুন্নেসা, ওরাও তো আশা করে। নানা মধুর হেসে বলেন।
পকেটের বাতাসাও পুকুর পাড় দিয়ে আসার সময় পুকুরে ছুঁড়ে ফেলেন।
কেন?
মাছ টাছ আছে, খাইব। ওরাও তো আশা করে।
অবকাশেও এরকম ঘটে। মা ভাত বেড়ে দিলেন, বড় রুই মাছের টুকরো পাতে দিয়ে ডাল আনতে গেলেন বাটি করে। এসে দেখেন নানার পাতের মাছ পাতে নেই, পাতে শাদা শুকনো ভাত। রুই মাছ টেবিলের তলায়, বেড়ালে খাচ্ছে।
কি বাজান,মাছ বিলাইয়ে খায় কেন?
নানা হেসে বললেন দেখি তো তুমার ডাইলডা। কেমন রানছ দেখি।
ডাইল দিতাছি। কিন্তু মাছ ফালাইয়া দিছেন কেন?
আরে ফালামু কেন? বিলাইয়ের কি পছন্দ অপছন্দ নাই! ওদের কি কাঁটা খাইতে ইচ্ছা করে! মাছ টাছ ওরাও তো আশা করে!
কলতলা থেকে ফিরে এসে গামছায় মুখ মুছতে মুছতে নানি বললেন, মানুষের খবর নাই, আছে কুত্তা বিলাই লইয়া। রাস্তার পাগলা খাওয়াইয়া দোকানের বারোডা বাজাইছে। শান্তি আর এ জীবনে হইল না।
ততক্ষণে নানা নকশি কাথাঁর তলে। বিছানায়। ঘুমোচ্ছেন। দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর নানা লম্বা ঘুম দেন, ঘুম থেকে উঠে আবার দোকান। নতুন বাজারের মুখে পৌঁছলেই নানার পেছন পেছন ও পাড়ার যত পাগল আর ভিখিরি পিছু নেবে। টাকা পয়সা পাউরুটি বাতাসা বিলিয়ে হাঁটতে থাকবেন তিনি, দোকান অবদি পৌঁছলে পকেটে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না, তখন হাত দেবেন ক্যাশবাক্সে, মুঠি ধরে দেবেন দবির পাগলকে। দবির পাগল নানার খুব প্রিয় পাগল। ওই দবির পাগলের জন্যই নানা একবার খালি গায়ে বাড়ি পৌঁছেছিলেন।
কি ব্যাপার, পাঞ্জাবি কই?
দবিরডার পরনের জামা নাই। রাস্তায় আধা ল্যাংডা খাড়োইয়া রইছে।
তাই বইলা নিজের পরনের পাঞ্জাবি খুইলা দিয়া আইছেন?
না দিলে এই শীতের মধ্যে ও বাঁচব কেমনে!
আর এই শীতের মধ্যে আপনে কেমনে খালি গায়ে রইছেন?
আরে শীত কই তেমন! হাইটা আইছি ত। হাঁটলে শরীর গরম থাকে খায়রুন্নেসা।
নানি আর কথা বাড়ান না। লাভ নেই বলেই বাড়ান না। নানাকে তিনি চার যগু হল চেনেন। টিনের এই চৌচালা ঘরে সংসার পেতেছিলেন সেই কবে, ছেলে মেয়ে হল, তাদের বিয়ে হল, নাতি নাতনি হল, পুতিও হল, কিন্তু চালা ঘর ঠিক তেমনই আছে, যেমন ছিল। একটি খুঁটিও পাল্টোনি। চোখের সামনে ধাঁ ধাঁ করে এ বাড়ির চাকর বাকররাও বড়লোক হয়ে গেছে, রীতিমত দালান তুলেছে বস্তিতে। নানির অবশ্য দালানের লোভ নেই। কোনওভাবে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাকেই তিনি যথেষ্ট মনে করেন। নানির ভাবনা টুটুমামা আর শরাফ মামাকে নিয়ে। এ দুজন লেখাপড়া ছেড়ে পীরবাড়িতে ভিড়েছিল। সংসার চালানোর কোনও ক্ষমতা না থাকলেও হুট করে বিয়ে করেছেন, কদিন পর পর এখন নানির কাছে হাত পাতেন। শেষ পর্যন্ত দুই ছেলের হাত পাতার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে নানি নিজে গিয়ে আমিরুল্লাহকে ধরেন, কিছু একটা গতি করুইন বেয়াই সাব, টুটু আর শরাফ আল্লাহর পথে আইছিল দুনিয়াদারির লেহাপড়া ছাইড়া। এহন তো চাকরি বাকরি পাওনের যোগাড় নাই। পয়সাকড়ি না থাকলে খাইব কি! আপনে একটা ব্যবস্থা কইরা দেন।
আমিরুল্লাহ পান খাওয়া খয়েরি দাঁতে হেসে বললেন, ব্যবস্থার মালিক আল্লাহ তায়ালা। আমি তো তাঁর নিরীহ বান্দা। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন, সব ঠিক হবে।
আল্লাহর উপর আমার ভরসা আছে বেয়াই সাব। কিন্তু ছেলে দুইডা তো বিয়া শাদি কইরা বিপদে পড়ছে। এই দুইজনরে আপনি চাকরির ব্যবস্থা কইরা দেন। আপনি চাইলেই পারেন দিতে।
আমিরুল্লাহ বললেন, ওই চাকরি ফাকরি দেবার মালিকও তিনি। রিজকের মালিক আল্লাহ। তিনিই চাকরি যোগাবেন।
নানি নামাজ পড়েন, রোজা করেন, কিন্তু ঘোরতর দুনিয়াদারির মানুষ। তিনি জানেন, জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে মোনাজাতের হাত তুলে চাকরির জন্য কেঁদে পড়লেও চাকরি হবে না। আমিরুল্লাহর কাছে কাঁদলে বরং কিছ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আবু বকরের স্টিলের ইন্ডাস্ট্র্রির এখন আমিরুল্লাহই হর্তকর্তা, বাছাই করে পীরের ভক্তদের কেবল চাকরি দেওয়া হচ্ছে, ভক্ত ক অক্ষর গোমাংস হলেও সই। তদবিরে কাজ হয়। আমিরুল্লাহ অনেকক্ষণ আল্লাহর ওপর সব ঝামেলা চাপিয়ে দিলেও নাছোড়বান্দা নানিকে তিনি শেষে এই বলে বিদেয় করেন, ঠিক আছে ওরাও আকবরিয়া ইন্ডাস্ট্রিতে কারখানায় লেগে পড়ুক। কিন্তু শতর্ একটিই, সুন্নত পালন করতে হবে, দাড়ি রাখতে হবে, আর ওই দুনিয়াদারির পোশাক খুলে পাজামা পাঞ্জাবি পরতে হবে, মাথায় টুপি।
নানি পীর বাড়ি থেকে ফিরে বলেন, আই এ পর্যন্ত পইরা তো কোনও অফিসে কেরানির চাকরিও পাওয়া যায় না। পোশাক পাল্ডাইয়া, দাড়ি রাইখা যদি কারখানায় কাম কইরা টাকা পয়সা রোজগার করতে পারে, তাইলে তাই করুক।
টুটু আর শরাফ মামা পোশাক পাল্টো দিব্যি ঢুকে গেলেন কারখানায়। ছটকু পীর বাড়ির পোশাক আশাক বহু আগেই ছেড়েছে। মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে নাসিরাবাদ ইশকুলে কিছুদিন পড়েছিল কিন্তু মেট্রিক পাশ করার আগেই ইশকুল ছেড়ে দিয়ে নানার ভাতের দোকানে বসতে শুরু করেছে। নানা এদিক ওদিক গেলে ছটকু দেখাশোনা করে দোকান। টুটু মামা আর শরাফ মামার বিয়ের পর বিয়ের হিড়িক লাগে নানিবাড়িতে। একদিন শুনি ফেলু মামাও বিয়ে করবেন, পাড়াতেই এক সুন্দরী মেয়েকে দেখে পছন্দ হয়ে গেল, বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর পর মেয়ের মা বাবা রাজি হয়ে গেলেন, তিন গজ দূরের শ্বশুরবাড়ি থেকে মেয়েকে রিক্সা করে বউ নিয়ে এলেন বাড়িতে। ফেলু মামার বিয়ের পরই ছটকু বলল সেও বিয়ে করবে। জিলা ইশকুলের উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে এক সুন্দরী কিশোরীকে আসা যাওয়ার পথের ধারে দেখতে দেখতে কিছু হাসি এবং কিছু চিরকুট ছুঁড়ে দিয়ে পটানোর চেষ্টা করেছে যথেষ্ট। হাসি বা চিরকুটে কাত না হওয়া কিশোরীটিকে চিঠি লেখার জন্য ছটকু প্রায়ই অবকাশে আসত, আমাকে অথবা ইয়াসমিনকে যাকেই সামনে পেত, বলত, খুব ভাষা টাষা দিয়া একটা চিঠি লেইখা দে তো! ছটকুর আবদারে আমরা প্রেমের চিঠি লিখে দিতে থাকি। চিঠি বুকপকেটে পুরে ছটকু বেরিয়ে যেত, পরে সুযোগ বুঝে মেয়ের কাছে পাচার করত। সেসব চিঠি পেয়ে মেয়ে গলে গেল, গলে চৌদ্দ বছর বয়সেই ছটকুর গলায় লটকে গেল। ফকরুল মামার বিয়ে আর সব ভাইদের মত এরকম সহজে ঘটেনি। নিজে তিনি যুবইউনিয়নের নেতা। বড়মামার কাছ থেকে ছোটবেলাতেই কম্যুনিস্ট হওয়ার দীক্ষা পেয়েছিলেন। দলের আর সব নেতাদের বাড়িতে অবাধ যাতায়াত ছিল ফকরুল মামার। ওই করে করেই এক নেতার বউএর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে দাঁড়াল। বউটি ফকরুল মামার চেয়ে বয়সে বড় পরন্তু দুই বাচ্চার মা। সম্পর্কে অনেকদূর পৌঁছেছিল। যেদিন নেতাটি হাতে নাতে ধরে ফেলেন দুজনকে, বউকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দিলেন বউএর বাপের বাড়িতে। ফকরুল মামা সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি বিয়ে করবেন বউটিকে, ওর এই অবস্থার জন্য দায়ি যখন তিনিই। কিন্তু বড়মামা রাজি নন। তিনি ফকরুল মামাকে ছলে বলে কৌশলে ময়মনসিংহে নিয়ে এসে আদেশ এবং উপদেশের রশি দিয়ে বাধঁ লেন। সেই রশি ছিঁড়ে ফকরুল মামা বেরিয়ে গেলেন দুদিন পর। ওই দুই বাচ্চার মাকে বিয়ে করে নিজের ঘরে তুললেন। বিয়েতে কোনও আত্মীয় স্বজন যায়নি। ছ ফুট লম্বা, ছিপছিপে গড়ন, সুদর্শন যুবক ফকরুল মামা বিয়ে করছেন কালো এক ধুমসি বুড়িকে। আত্মীয় স্বজন যাবে কেন বিয়েতে!
ছটকুর বউও এল বাড়িতে, নানাও অসুখে পড়লেন। কিছুর দিশা পাননা তিনি। নতুন বাজারের রাস্তা ভুলে গেছেন। পথ হারিয়ে ফেলেন। বিছানা ভিজিয়ে ফেলেন পেচ্ছাব করে। পেচ্ছাব পায়খানা কিছুরই খোঁজ রাখতে পারেন না। বিছানাতেই সারেন সব। নিজের হাতে নিজের মল তুলে তুলে জানালা দিয়ে ফেলেন। নানি আঁচলে নাক চেপে বলেন, গুগুলা ফিইক্যা মারে ক্যা? এইগুলাও কি কুত্তা বিলাইরে বিলাইতাছে না কি? বাবা একদিন দেখে এলেন নানাকে, ওষধু লিখে দিয়ে এলেন। ওষুধে কাজ হয় না। কি হয়েছে নানার? বাবা বললেন ডায়বেটিস। ডায়বেটিসের ওষুধ কখনও তিনি খাননি। কেবল জানতেন মিষ্টি খাওয়া বারণ। নানা বারণ মানেননি কোনওদিন। আমি নতুন ডাক্তার, নানার গায়ের চামড়া চিমটি দিয়ে তুলে ডিহাই−ড্রশন দেখি। শরীরে পানি নেই। মহাসমারোহে স্যালাইন দেওয়ার ব্যবস্থা করি। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলেন, সুঁই ফোটালে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কেবল বলেছেন, ইস কি কষ্টটা দিল রে! যেদিন স্যালাইন দিই, সেদিনই নানা মারা যান। রাতে।
বাবাকে নানার মৃত্যুর কারণ জিজ্ঞেস করলে বললেন, রেসপিরেটরি ফেইলুর। শুনে আমার আশঙ্কা হয় স্যালাইন বেশি পড়ার কারণেই ফুসফুসে পানি জমে গেছে, নানা আর শ্বাস নিতে পারেননি।
স্যালাইন দেওয়াটা কি ভুল হইছে?
বাবা মাথা নাড়েন, ভুল হইছে। কিন্তু আমার ভুলের জন্য আমার ওপর কোনও রাগ বা নানার মরে যাওয়ার জন্য কোনও দুঃখ বা নানাকে কোনওদিন ডায়বেটিসের ওষধু না দেওয়ার জন্য বাবার কোনও অনুতাপ হয় না। ছোট্ট একটি আহা শব্দও উচ্চারণ করেন না। স্যালাইন না দিলে কি নানা বেঁচে থাকতেন! অসম্ভব নির্লিপ্তিতে উত্তর দেন, না! আমার তবু মনে হতে থাকে আমার দোষেই নানাকে মরে যেতে হয়েছে। গা নিথর করা একটি আতঙ্ক আমার মনের দখল ছাড়ে না। নিজেকে খুনী মনে হতে থাকে। হাসপাতালে কোনওদিন কোনও রোগীর এ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি আমার দ্বারা হয়নি, আর নিজের নানার মৃত্যুর কারণই কি না আমি! আমার সাদাসিধে নানা, আমার ভালমানুষ নানা, সাতেনেইপাঁচেনেই নানা, প্রকাণ্ড একটি হৃদয়ের নানা। এই অপরাধের কোনও ক্ষমা নেই, ক্ষমা হয় না। স্তব্ধ উদাস বসে থাকি সারাদিন, সারারাত অন্ধকারের দিকে মুখ করে অবিন্যস্ত রাত পার করি। নিজেকে আমি ইচ্ছে করেই ক্ষমা করি না। নিজের ওপর এত রাগ হয় আমার, ইচ্ছে করে না নানিবাড়ি যেতে—নানির আর মামা খালাদের রোরুদ্যমান মুখ গুলো দেখতে। মেঝেয় গড়িয়ে বাজান গো আমার বাজান কই গেল বলে কেঁদেছেন মা, মা ই নানার অমন চলে যাওয়ায় সবচেয়ে বেশি কেঁদেছেন। যার চোখে এক ফোঁটা জল ছিল না, তিনি ফজলিখালা। ফজলিখালা জানেন, আল্লাহর মাল আল্লাহ উঠিয়ে নিয়েছেন, এ নিয়ে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। কাঁদতে যদি হয়ই, আল্লাহর জন্য কাঁদো, আল্লাহর কাছে ভিক্ষে চাও, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও। কি কারণে ভিক্ষে, কি অপরাধের জন্য ক্ষমা—তা আমার বোঝা হয় না। ফজলিখালা কি অনেক পাপ করেছেন জীবনে যে প্রতিদিন তাকে ক্ষমা চাইতে হয় আল্লাহর কাছে!
নানারে স্যালাইন দেওয়া উচিত হয় নাই—মার ফুলে থাকা চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আমি আর এই স্বীকারোক্তিটি করতে পারি না। ইয়াসমিনকে আড়ালে ডেকে বলি। নিজেকে বারবার বলি, নিঃশব্দে চেঁচাই। মার দুপুরগুলো বিষণ্নতার রোদে পুড়তে থাকে, দেখি। কেউ আর শান্ত স্নিগ্ধ হাসি মুখে নিয়ে দুপুরগুলোকে শীতল করতে আসেন না। অনেকদিন নানির বাড়িতে এরপর আমি যাইনি। মা সেধেছেন যেতে, এ কাজ ও কাজের ছুতোয় এড়িয়ে গেছি। মাঝে মাঝেই বিকেলে ইচ্ছে করে নানি বাড়ি যাওয়ার, ইচ্ছেজ্ঞটকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে রাখি কড়িকাঠে। কিন্তু মা আমাকে তর নানি কইছে যাইতে, বার বারই কইতাছে নাসরিনডা তার নানার লাইগা কত কষ্ট করছে, হাসপাতাল থেইকা দৌড়াইয়া দৌড়াইয়া আইছে, স্যালাইন দিছে। চল চল তর নানিরে একটু সান্ত্বনা দিয়া আয় বলে আমাকে এক দুপুরবেলা ও বাড়িতে নিয়েই যান। নানিবাড়িটি যেরকম অনুৃমান করেছিলাম, থমথমে, সবাই কাঁদছে, মন খারাপ করে বসে আছে ওরকম মোটেও নয়। নানি রান্না করছেন ইলিশ মাছ। বাড়ির বাচ্চারা হই চই করছে। উঠোনে খেলার ধুম। মামারা ঘরে সেঁধিয়ে আছে নতুন বউ নিয়ে। ঘরগুলো থেকে হা হা হিহি ভেসে আসছে। বাড়িটিতে একটি মানুষ ছিল, এখন নেই, কেউ আর তাঁর না থাকার জন্য কাঁদছে না, কেউ আর নানার না থাকা জুড়ে বসে নেই। বাড়িতে, আমি অনুমান করি, একধরণের স্বস্তি এসেছে। মাথা-পাগল উদাসীন লোকটি নেই। পরের জন্য নিজের যা আছে সব বিলিয়ে দেওয়ার বোকা লোকটি আর নেই।
নানি ভাত বেড়ে দেন পাতে, পাতের কিনারে ইলিশ মাছের টুকরো। বাজান ইলিশ মাছ বড় পছন্দ করতেন বলে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকেন মা, চোখের জল টপু টপু পড়তে থাকে ভাতের ওপর। নানি খাচ্ছেন। এক ফোঁটা জল নেই নানির চোখে। নানির সময় নেই পেছনের কারও কথা ভেবে চোখের জল ফেলার। আমার গলায় ফুটে থাকে মাছের কাঁটা। কাঁটাটি গলায় নিয়ে উঠোনে বসে থাকা ক্ষুধাতর্ কুকুরটির মুখের সামনে এক থাল ভাত ফেলে দিয়ে কলতলায় গিয়ে আমি হাত ধুয়ে ফেলি।
হাসপাতালে আরও মৃত্যু আমার দেখা হয়। প্রশ্ন করতে থাকি নিজেকে, কি অর্থ এই জীবনের। মৃত্যু আমার চারদিকে উদ্বাহু নৃত্য করে। মৃত্যু আমার কানে তারস্বরে গান শোনাতে থাকে। কি অর্থ এই জীবনের, নিজেকে প্রশ্ন করি। বারবার করি। এত মায়া এত ভালবাসা এত স্বপ্ন নিয়ে এই যে জীবন, যে কোনও মুহূর্তে জীবনটি ফুরিয়ে যাবে। কি লাভ!কি লাভ বেঁচে থেকে! পনেরো বিলিয়ন বছর আগে কিছু একটা ঘটে মহাশূন্যে ছিটকে পড়ল কিছু, সেই ছিটকে পড়া কিছু থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র, নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম, সেইসব নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে শামুকের মত পেঁচানো একটি পুঞ্জে চারশ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবী নামের এক গ্রহের জন্ম হল। এই পৃথিবীতে এক সময় প্রাণের জন্ম। এক কোষি থেকে বহুকোষি, ধীরে ধীরে বিবর্তনে বিবর্তনে মানুষ। এই মানুষ নামক প্রাণীও হয়ত ডায়নোসোর যেমন নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে ছশ আশি লক্ষ বছর আগে, তেমন একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। তার আগেই হয়ত যাবে। অথবা যাবে না, বিবর্তনে বিবর্তনে অন্য কিছু। পৃথিবী পৃথিবীর মত থেকে যাবে। সূর্য তারা সূর্য তারার মত। কোনও একদিন আমাদের এই সূর্যটিও তাপ হারাতে হারাতে কালো একটি পিণ্ড-মত হয়ে যাবে। কোনও একদিন এই যে গ্রহনক্ষত্রগুলো প্রসারিত হচ্ছে হচ্ছেই—মহাশূন্যে হয়ত চপু সে যাবে। হয়ত যাবে না। হয়ত অনন্তকাল ধরে প্রসারিত হতেই থাকবে। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের এই খেলায় মানুষ কি আদৌ সামান্য কোনও ঘটনা? এই বিশাল মহাজগতে ক্ষণজীবী এই মানুষ নামক প্রাণীর জীবন ও জগতের কোনও ভূমিকাই নেই। মহাজগতের কোথাও নিজের এই ক্ষুদ্র অস্তিত্বটুকু এক পলকের জন্যও দেখি না। নানার রুহু ফজলিখালা বলেন দেখেছেন উড়ে যেতে। রুহু নাকি উড়ে গিয়েছে আসমানে, আল্লাহর কাছে। এই রুহুগুলো আল্লাহর কাছে জমা থাকবে, আল্লাহ সব রুহুকে আবার মানুষে রূপান্তরিত করবেন। তারপর তো সেই বিচারসভা। আল্লাহ বিচারকের আসনে বসে সমস্ত মানুষের বিচার করবেন। প্রতিটি মানুষের দুই কাঁধে দুই ফেরেসতা বসা, মুনকার আর নাকির, তারা ভাল মন্দের হিশেব লিখে রাখছে। সেই হিশেব দেখে আল্লাহ কাউকে বেহেসতের ঝরনার তলে পাঠাবেন, কাউকে দোযখের আগুনে। জীবন এমনই সরল অঙ্ক তাঁদের কাছে। দুই আর দুইএ চার। ফজলিখালা বিশ্বাস করেন নানার সঙ্গে তাঁর দেখা হবে আবার। নানা যেহেতু আল্লাহর নাম জপেছেন, রাতে রাতে উঠে জায়নামাজে বসে আল্লাহ ছাড়া কোনও মাবুদ নাই লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে জিকির করেছেন, নিশ্চিত তিনি বেহেসতে যাবেন। আর ফজলিখালা যখন বেহেসতে যাচ্ছেনই, তখন দেখা তো হবেই। ফজলিখালা তাই কারও মৃত্যুতে কোনও দুঃখ পান না। জীবনের অর্থ তাঁর কাছে আছে। মার কাছেও আছে। জীবন হচ্ছে আল্লাহর পরীক্ষা। আল্লাহ জীবন দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, কড়া নজর রাখছেন কে কি করছে না করছে, মৃত্যুর পর তিনি সবাইকে কর্মফল দেবেন। সরল অঙ্কে বিশ্বাসী সবকটা মানুষই একধরনের নিশ্চিন্তি বা সন্তুষ্টি নিয়ে থাকে। আমারই কেবল অস্থিরতা, অস্বসি।্ত উল্টো বিশ্বাস, মরে যাওয়া মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া, কোনও ফল পাওয়ার নেই, আবার জন্ম নেই, কিছু নেই, সব ফাঁকা। জীবনের কোনও মানে নেই, অর্থ নেই। এই বিশ্বাস আমাকে ভয়াবহ বিষণ্নতা দেয়, জীবনবিমুখ করে। বাবাকে যদি প্রশ্ন করি জীবনের মানে কি, তিনি বলবেন জীবনের মানে হচ্ছে সংগ্রাম। পৃথিবীতে সংগ্রাম করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোই হচ্ছে জীবনের সার্থকতা। তিনি শৈশব কৈশোর যৌবন ও বার্ধক্যকে ভাগ করে ফেলেন খুব সহজে। প্রথম শিক্ষাজীবন, তারপর কর্মজীবন, তারপর অবসরজীবন। শিক্ষা অর্জনে বা কর্মের কোনও রকম হেরফের হলে তার ফল ভোগ করতে হবে এই জীবনেই। স্বাচ্ছন্দ্য আর সচ্ছলত!র মধ্যেই তিনি ভাবেন জীবনের সাফল্য। জীবন অর্থপূণর্ হয় জীবনের সাফল্যে। কিন্তু জীবন যদি ফুরিয়েই যায় একদিন, জীবন সফল হল বা ব্যর্থ হল, তাতে কি ই বা যায় আসে! ব্যর্থতা আর সাফল্যের সংজ্ঞাও তো ভিন্ন মানুষের কাছে। এক দার্শনিক বলেছেন জীবনের কোনও অর্থ নেই, কিন্তু জীবনকে অর্থ দিতে হবে আমাদের। আমার মনে হয় না কোনও কিছু করেই আসলে আমরা জীবনের কোনও অর্থ দাঁড় করাতে পারি। এ কি নিজেকেই নিজের ফাঁকি দেওয়া নয়! অর্থ তৈরি করছে বলে জীবনকে গুরুত্বপণূর্ ভাবতে যেন পারে। যে লিখতে জানে ভাল তাকে লিখে, যে খেলতে জানে ভাল তাকে খেলে জীবনকে অর্থ দিতে হবে। আসলে কি অর্থ দেওয়া হয় না কি সুখ পাওয়া হয়? নিজের জন্য এক ক্ষণস্থায়ী সুখ । আমার মন বলে অর্থহীন জীবনকে অর্থপ ণূর্ করার শক্তি মানুষের নেই। মানুষ বড়জোর যা করতে পারে যতদিন প্রাণ আছে ততদিন কোত্থেকে এসেছি কোথায় যাবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে ক্ষণিকের এই জীবনের সধুারসটুকুর শেষ বিন্দুটুকওু পান করতে পারে। কিন্তু পান করেই বা কিছু লাভ হয় কি? আমি যদি পান না করি, তাতে কি? আমি যদি আজ বেঁচে থাকি তাতেই বা আমার কি, আজ মরে গেলেই বা কি! এক ঘোর বিষণ্নতা আমাকে আচ্ছত করে রাখে।