তেইশ
টিভিতে তিনজনের বক্তব্য শুনল অনীকা। তার ঘুম আসছিল না। টিভির সামনে বসে সে বিস্ময়ে হতবাক। একটু একটু করে সরকার থেকে কি সুন্দরভাবে আকাশলালের অসুস্থতা থেকে মৃত্যুসংবাদ প্রচার করে দিল। বিশেষ করে আকাশলালের কাকাকে হাতের কাছে রেখে তাঁকে দিয়ে ভাইপো সম্পর্কে বলানোর মধ্যে ভাল পরিকল্পনা আছে। সন্ধের পরে সে তার কাগজে যে খবর পাঠিয়েছিল তাতে উৎসবের বর্ণনার চেয়ে আকাশলালই অনেকখানি জুড়ে ছিল। মানুষটার অসুস্থতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করেছিল সে। এখন মৃত্যুসংবাদ পাঠানোর কোনও উপায় নেই।
হঠাৎ অনীকার মনে হল ওরা আজ রাত্রেই আকাশলালকে কবর দেবে। দিনের আলোয় কারফিউ থাকা সত্ত্বেও মৃতদেহ বের করার ঝুঁকি নিশ্চয়ই নেবে না। কিন্তু এই ব্যাপারটা আকাশলালের সঙ্গীরা আগাম জানল কি করে? নইলে কেউ কবরের জায়গা দেখতে যায়? ওই মেয়েটি এবং তার সঙ্গী যদি আকাশলালের দলের হয় তবে কবরখানা দেখে তাদের কি লাভ। পুলিশের খাতায় নিশ্চয়ই তাদের নাম আছে এবং পুলিশ নেতার মৃতদেহ হাতছাড়া করবে না। তাহলে কবরখানা দেখে ওদের কি লাভ? অস্বস্তি প্রবল হয়ে উঠল অনীকার। তার মনে হচ্ছিল আজ রাত্রে সেই কবরখানায় যেতে পারলে ও এমন কিছুর সাক্ষী হবে যা অন্য কোনও খবরের কাগজের লোক ভাবতেও পারবে না কাল। কিন্তু কি ভাবে যাওয়া যায় সেখানে? একেই এখন গভীর রাত। তার ওপর কারফিউ চলছে। যে কোনও মানুষকে রাস্তায় দেখলে পুলিশের গুলি করার অধিকার আছে। কারফিউ-এর মধ্যে মারা গেলে কারও সহানুভূতিও পাওয়া যাবে না। কিন্তু সেই ভয়ে বসে থাকলে খবরটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।
অনীকা চিরকালই একটু ডানপিটে। তার এই স্বভাবের জন্যে সাংবাদিকতার চাকরিতে যথেষ্ট সুবিধে হয়েছে। মেয়ে হিসেবে যারা তাকে গুরুত্ব দেয় না তারাই পরে বোকা হয়ে যায়। এই রাত্রে অনীকা ঠিক করল কবরখানায় যাবে। সে তৈরি হল জিনস আর জ্যাকেট পরে। পায়ে কেডস, যাতে দৌড়ানো সহজ হয়। ঘর থেকে বেরিয়ে দেখল টুরিস্ট লজের করিডোরে আলো জ্বলছে। যেহেতু এখন কারও জেগে থাকার কথা নয় তাই একটুও শব্দ নেই। সে নিঃশব্দে নীচে নেমে এসে দেখল সদর দরজা বন্ধ। সেখানে তালা পড়েছে। তালা খোলাতে গেলে যে ডাকাডাকি করতে হয় সেটা অভিপ্রেত নয়। এক মুহূর্ত চিন্তা করে সে পেছন ফিরল। তার ঘরের ব্যালকনি থেকে নীচে নামার চেষ্টা করতে হবে।
নিজের ঘরে এসে অনীকা ব্যালকনিতে গেল। এই উচ্চতা লাফিয়ে নামা বিপজ্জনক হবে। তাছাড়া এদিকটা একদমই খাড়া। সেইসময় যদি টহলদারি ভ্যান আসে তাহলে দেখতে হবে না। তার মনে হল লজে ঢোকার জন্যে নিশ্চয়ই পেছনেও একটা দরজা আছে। সেখানেও কি তালা থাকবে? সে আবার ঘর থেকে বের হল।
‘ম্যাডাম! আপনার কি কোনও অসুবিধে হচ্ছে?’
চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে অনীকা দেখল লজের সেই কর্মচারীটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘হ্যাঁ। আমার একটু বাইরে যাওয়া প্রয়োজন। দরজায় তালা থাকায় যেতে পারছি না। আপনি এখানে কি করছেন?’
‘আমার কথা ছেড়ে দিন। কিন্তু এত রাত্রে কারফিউ-এর মধ্যে আপনি কোথায় যাবেন?’
‘ব্যাপারটা একদম ব্যক্তিগত।’
‘আমি আপনাকে বলতে পারি এখন বের হলে বেঁচে ফিরে নাও আসতে পারেন। তাছাড়া এই সময়ে গেট খুলে দিলে সেটা পুলিশকে জানানো কর্তব্য। এই লজ সরকারি।’ লোকটি বলল।
অনীকা ঠোঁট কামড়াল।
লোকটি হাসল, ‘অবশ্য তেমন প্রয়োজন পড়লে আপনি পুলিশের কাছে কারফিউ পাশ চাইতে পারেন।’
‘অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু ব্যাপারটা আমি পুলিশকে জানাতে চাই না।’
লোকটির মুখচোখে পরিবর্তন এল যেন, অন্তত তাই মনে হল অনীকার। একটু ভাবল যেন। তারপর বলল, ‘আপনি এ দেশের মানুষ নন। তাহলে পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় যাচ্ছেন কেন?’
‘আমি সাংবাদিক। সংবাদ নেওয়া আমার কাজ। পুলিশ যদি সেটা গোপন রাখতে চায় তাহলে আমি তাদের এড়িয়ে যাব, এটাই স্বাভাবিক।’ অনীকা বলল।
‘আপনি এখানকার পথঘাট চেনেন?’
‘আমি যেখানটায় যাব সেখানে আজ বিকেলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে চিনে যেতে পারব।’ খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলল অনীকা।
‘আপনি নিশ্চয়ই বড় রাস্তা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেইভাবে যেতে চাইলে একশ গজও এখন এগোতে পারবেন না। ঠিক আছে, চলুন, আমি আপনাকে সাহায্য করছি।’
‘আপনি সাহায্য করবেন মানে? আপনি আমার সঙ্গে যাবেন নাকি?’
‘আপনার সঙ্গে যাব না। কারণ আপনি কোথায় যেতে চাইছেন তা আমাকে বলেননি। আমি আমার কাজে যাব। আপনাকে গলির পথ চিনিয়ে দিতে পারি যেখানে সহজে পুলিশের দেখা পাবেন না। আসুন।’ লোকটি নীচে নামতে লাগল।
সন্দেহ হচ্ছিল খুব কিন্তু অনীকা কোনও প্রশ্ন করল না। লোকটি রহস্যজনক। এই প্রায় শেষ রাত্রে এমন বাইরে যাবার পোশাক পরে লজের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিল কেন? সে কোনও শব্দ করেনি। শব্দ শুনে জেগে ওঠার সম্ভাবনাও ছিল না।
লোকটি তাকে পেছনের দরজায় নিয়ে এল। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। খোলার আগে লোকটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোন দিকে যেতে চাইছেন?’
কি বলবে অনীকা? কবরখানার কথা তো না বলে উপায় নেই। সে বলল, ‘একটু আগে টিভি শুনে মনে হল পুলিশ আজ রাত্রেই আকাশলালের কবরের ব্যবস্থা করবে। আমার মনে হওয়া ঠিক কিনা তাই জানতে চাইছি।’
‘ও, তাই বলুন। আপনি কবরখানায় যাবেন। সেখানে যদি ওরা আপনাকে দেখতে পায় তাহলে কি ঘটবে অনুমান করছেন?’
‘আমাকে ভয় দেখাবার চেষ্টা করবেন না।
লোকটি কাঁধ নাচাল। তারপর নিঃশব্দে দরজা খুলে বলল, ‘রাস্তার মুখে গিয়ে দুপাশ দেখে নিয়ে এক দৌড়ে পেরিয়ে যাবেন। ঠিক ওপাশে যে গলি আছে তার ভেতর ঢুকে অপেক্ষা করবেন। এগোন।’
অনীকা প্যাসেজটা দ্রুত হেঁটে এল। রাস্তাটা নির্জন। কোথাও কোনও প্রাণের চিহ্ন নেই। সে দৌড় শুরু করল। রাস্তাটা পার হতে কয়েক সেকেন্ড লাগল। গলির মুখে ঢুকেই সে দাঁড়িয়ে পড়ল। এই গলিতে কোনও আলো নেই।
‘চলুন।’ লোকটি এসে গেল।
অনীকা নিঃশব্দে সেই অন্ধকারে অনুসরণ করল। মনে হচ্ছিল লোকটি বিপজ্জনক নয়।
তিনটে গাড়ি যখন কবরখানার সামনে এসে দাঁড়াল তখন একটা কুকুরও ধারেকাছে জেগে নেই। কবরখানায় ঢোকার মুখে অফিসঘরের কর্মচারীকে একজন পুলিশ অফিসার তুলে নিয়ে এসেছিল কিছুক্ষণ আগে। ডাক্তারের দেওয়া ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী খাতায় আকাশলালের নাম ওঠার পর পুলিশরাই কফিনটা নামাল। অন্ধকার কবরখানায় আলো জ্বালিয়ে সেই কফিনটিকে নিয়ে আসা হল নির্দিষ্ট জায়গাটিতে, যেখানে আকাশলালের পূর্বপুরুষরা মাটির নীচে শুয়ে আছেন।
কয়েকজন লোক হ্যাজাক জ্বালিয়ে মাটি খুঁড়ছিল। সেই বৃদ্ধ তদারকি করছিলেন। খোঁড়ার সময় যাতে পূর্বপুরুষের কোনও কফিনে আঘাত না পড়ে তা খেয়াল রাখছিলেন তিনি। অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ঘড়ি দেখছিলেন। এবার তাগাদা করলেন, ‘তাড়াতাড়ি।’
কেউ কিছু বলল না। কফিনের ঢাকনা সরানো হল। পাদরি পারলৌকিক কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বৃদ্ধ নিচু গলায় খননকারীদের বললেন, ‘আট ফুট গর্ত হয়ে গেছে। আর খোঁড়ার দরকার নেই। তোমরা ওপরে উঠে এসো।’ তারা আদেশ পালন করল।
আকাশলালের কাকা হ্যাজাকের আলোয় ভাইপোর মুখ দেখছিলেন। পরম প্রশান্তিতে ঘুমাচ্ছে আকাশ। বেঁচে থাকতে খুব জ্বলতে হয়েছে ওর জন্যে। এই বৃদ্ধ বয়সে বিছানায় না শুয়ে আসতে বাধ্য হওয়া, তাও ওরই জন্যে। অথচ ছেলেটা একসময় কি শান্ত ছিল!
পাদরির অনুমতি পাওয়ামাত্র ধীরে ধীরে কফিনটাকে ভাল করে বন্ধ করে মাটির নীচে নামিয়ে দেওয়া হল। আকাশলালের কাকা এবং উপস্থিত অনেকেই মাটি ফেলতে লাগল কফিনের ওপর। তারপর খননকারীরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মিনিট দশেকের মধ্যেই গর্ত বুজে গেল এবং জায়গাটা সমান হয়ে গেল।
তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার বললেন, আপনার ভাইপোর জন্যে যে স্মৃতিসৌধ তৈরি করবেন তাতে লিখবেন মরার পর একটুও জ্বালায়নি।’
কাকা বললেন, ‘মরার পর কে আর সেটা করে বলুন।’
তরুণ অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার বললেন, ‘আমরা সেইরকম আশঙ্কা করেছিলাম। ব্যাপারটা গোপনে না সারলে এতক্ষণ এখানে গোলাগুলি চলত।’
‘হুঁ। এবার আমাকে দয়া করে আমার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দিন। আমার স্ত্রী সেখানে একা আছেন। বেচারা খুব ভয় পেয়ে গেছে।’ কাকা হাতজোড় করলেন।।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কবরখানা খালি হয়ে গেল। শুধু তার বাইরের রাস্তায় একটি পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে রইল সশস্ত্র সেপাইদের নিয়ে। হালকা বাতাস বয়ে যাচ্ছিল কবরখানার গাছগাছালিকে ঈষৎ কাঁপিয়ে দিয়ে। প্রায় একঘণ্টা সময় একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা অনীকা ভেবে পাচ্ছিল না এখন কি করবে। তার চোখের সামনে ওরা আকাশলালের মৃতদেহ নিয়ে এল, কবর দিল এবং চলে গেল। ঘটনাটির বর্ণনা সে টুরিস্ট লজে ফিরে গিয়ে দারুণ ভাষায় লিখে তার কাগজের কাছে পাঠাতে পারবে। কিন্তু তেমন কোনও নাটকীয় ঘটনা তো ঘটল না।
সকাল হলেও কারফিউ চলবে। সকালের আর বেশি দেরিও নেই। সামনের রাস্তা দিয়ে কবরখানা থেকে বের হওয়া মুশকিল। যে লোকটি তাকে টুরিস্ট লজ থেকে বের করে এনেছিল সে কবরখানার কাছাকাছি এসে সরে গিয়েছিল নিঃশব্দে। লোকটার আচরণ খুবই রহস্যময়।
অনীকা কবরখানায় ঢুকেছিল রেলিং টপকে। ভেতরে ঢোকার পর সাপ বা বিষাক্ত প্রাণী ছাড়া অন্য কোনও ভয় ছিল না। তার এখন মনে হচ্ছে মানুষের চেয়ে বিষাক্ত প্রাণী কিছু নেই।
অনীকা ধীরে ধীরে আড়াল ছেড়ে বের হল। এবং তখনই সে একটি ছায়ামূর্তিকে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসতে দেখল। মূর্তিটি আসছে মাঝখানের পথ দিয়ে। অনীকা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এখন লুকোবার সুযোগ নেই কিন্তু না নড়াচড়া করলে হয়তো চোখ এড়িয়ে থাকা যাবে এই অন্ধকারে। মূর্তিটি প্রায় হাত দশেক দূরে এসে সদ্য খোঁড়া কবরের দিকে এগিয়ে গেলে অনীকা চিনতে পারল। সেই বৃদ্ধ ফিরে এসেছে। লোকটার হাঁটার ধরনের জন্যেই মনে হচ্ছিল দুলতে দুলতে আসছে। বৃদ্ধ চারপাশে তাকাল। তারপর সন্তর্পণে খোঁড়া মাটি এড়িয়ে পাঁচিলের দিকটায় পৌঁছে ঘাসের ওপর উবু হয়ে বসল।
অনীকা দেখল বৃদ্ধ প্রথমে মাটিতে হাত দিল। তারপর ধীরে ধীরে শুয়ে পড়ে একটা কান ঘাসের উপর চেপে ধরল। এমন অদ্ভুত আচরণের কোনও ব্যাখ্যা পাচ্ছিল না অনীকা। যে মানুষ মরে গিয়েছে যাকে কফিনে শুইয়ে মাটির নীচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে তার কোনও হৃদস্পন্দন শুনতে চাইছে বৃদ্ধ।
হঠাৎ পিঠে স্পর্শ অনুভব করতেই চমকে ফিরে তাকাল অনীকা। দুজন মানুষ তার পেছনে কখন এসে দাঁড়িয়েছে? টুরিস্টলজের কর্মচারীটি বলল, ‘ম্যাডাম, আশা করি আপনি যা দেখতে চেয়েছিলেন তার সবই দেখা হয়ে গেছে। এবার ফিরে চলুন।’
‘আপনি এখানে?’ বিস্ময় চেপে রাখতে পারল না অনীকা।
‘আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুকুম হয়েছে আমার ওপর।’
কে হুকুম করেছে?’
‘আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। ভোর হয়ে আসছে, চলুন।’
‘দাঁড়ান। আমি ওই বৃদ্ধকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করব।
‘না। আমরা চাই না কেউ ওঁকে বিরক্ত করুক। আসুন।’ লোকটা যে-গলায় কথা বলল তা অমান্য করতে পারল না অনীকা। ধীরে ধীরে সে ওকে অনুসরণ করে পেছনের পাঁচিলের দিকে চলে এল। এখন পাতলা অন্ধকার পৃথিবীতে জড়িয়ে। পাঁচিল টপকে দৌড়ে রাস্তা পার হবার সময় দূর থেকে চিৎকার ভেসে এল।।
লোকটি বলল, ‘তাড়াতাড়ি গলির মধ্যে ঢুকে পড়ুন, ওরা দেখতে পেয়ে গেছে।’ কথা শেষ হওয়ামাত্র গুলির আওয়াজ ভেসে এল। পর পর কয়েকবার। ততক্ষণ গলিতে ঢুকে পড়েছে ওরা। লোকটি বলল, ‘জোরে হাঁটুন।’
হাঁপাতে হাঁপাতে হাঁটছিল অনীকা। কিন্তু তার মাথা থেকে বৃদ্ধের কান পেতে শুয়ে থাকার দৃশ্যটি কিছুতেই যাচ্ছিল না। বৃদ্ধ কি শুনতে চাইছিলেন? আর এই লোকগুলোই বা ওখানে গিয়েছে কেন? শুধু তাকে ফিরিয়ে আনতে? আর একজন তো ওখানেই থেকে গেল! অনীকার মনে হচ্ছিল এর মধ্যে রহস্য আছে। এবং রহস্যটি কি তা জানতে হলে আজ তাকে আর একবার কবরখানায় আসতে হবে। একা।
মাথার ওপর যে রাস্তা সেগুলো পড়ে আছে মরা সাপের মতো। যেহেতু ভার্গিস সাহেব কারফিউ জারি করেছেন তাই শহর আজ মৃত। মাঝে মধ্যে দু-একটি পুলিশের ভ্যান অথবা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছে গন্তব্যে। এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কাজ করতে ওদের সুবিধে হচ্ছিল।
কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে মাটির নীচে যারা সুড়ঙ্গ খুঁড়ে চলেছিল তারা আজ উত্তেজিত। ডেভিড এবং ত্রিভুবন শেষ তদারকির কাজে ব্যস্ত। কোদালের কোপ পড়ছে মাটিতে। ঝুড়িতে উঠছে মাটি। মাথায় মাথায় সেই ঝুড়ি চলে যাচ্ছে অনেক পেছনে। এত মাটি বাইরে ফেলার কোনও সুযোগ নেই। ফলে রাস্তার ওপাশে যে বিশাল বাড়ির মাঝখানের ঘরের মেঝে ফুঁড়ে সুড়ঙ্গ তৈরি হয়েছিল তার ঘরে ঘরে জমছে সেগুলো। ওই নির্দিষ্ট ঘরটিকে বাদ দিয়ে অন্যগুলোতে এখন সামান্য বাতাস ঢোকার জায়গা নেই। জানলা বন্ধই ছিল, এখন দরজাও। বাড়িটার ওজন বেড়ে গেছে প্রচুর পরিমাণে। ডেভিডের ভয় হচ্ছিল, যে কোনও মুহূর্তেই বাড়িটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে।
কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। দিনের পর দিন অনেক ভেবেচিন্তে যে পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে তার শেষ পর্যায় এখন। প্রথম দিকে ঠিক ছিল সুড়ঙ্গ হবে চার ফুট বাই চার ফুট। সামান্য ঝুঁকে এগিয়ে যাওয়া যাবে। খাটো চেহারার শক্তপোক্ত মানুষেরা এই কাজটি করছিল। এখন বাড়িটিতে যেহেতু জায়গা অবশিষ্ট নেই তাই শেষ মাটি ফেলা হচ্ছে সুড়ঙ্গের ভেতরেই। তার ফলে কোমর আরও বেশি বেঁকাতে হচ্ছে।
রাস্তা পার হয়ে কবরখানার ভেতরে ঢুকে খোঁড়ার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছিল। খোঁড়ার কাজ যারা করে যাচ্ছিল তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওই বাড়ির নির্দিষ্ট ঘরটিতে আটকে রাখাও একটা সমস্যা ছিল। আকাশলালের প্রতি ভালবাসাই সেই সমস্যার সমাধান করে এসেছে এতদিন। ডেভিড পেছনে তাকাল। কালো অন্ধকারে দূরে দূরে ব্যাটারির সাহায্যে যে আলো জ্বলানো হয়েছে তা পর্যাপ্ত নয় কিন্তু দেখা যায়। মাথার ওপরে যে পৃথিবী তার সঙ্গে এই সুড়ঙ্গের কোনও মিল নেই। যথেষ্ট সতর্কতা সত্ত্বেও খুঁড়তে খুঁড়তে অন্য পথে চলে যাওয়া বিচিত্র নয়। অনুমানের ওপর ভাবা হচ্ছে আকাশলালের কবর এখন প্রায় সামনে। ম্যাপ এঁকে মেপেঝুকে চললেও যেহেতু প্রকাশ্যে যাচাই করার সুযোগ নেই তাই শেষ মুহূর্তে ডেভিডের বুকে ভয় জমছিল।
ইতিমধ্যে বারো ঘণ্টা চলে গেছে। আকাশলালের শরীর এখন কবরের নীচে কফিনে শুয়ে আছে। আর বারোটা ঘণ্টা অতিক্রান্ত হলে আর কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। এখনও হৃৎপিণ্ডের কাছে একটি পাম্পিং স্টেশন ওর শরীরের কয়েকটি মূল্যবান অঙ্গে রক্ত সঞ্চালনের কাজ অব্যাহত রেখেছে। সেই সঞ্চালন অত্যন্ত সীমিত। ডাক্তারের হিসেবমতো চব্বিশ ঘণ্টায় সেটাও থেমে যাবে।
কি করবে ডেভিড? নিজের সঙ্গে লড়াই করে সে ক্লান্ত। সিদ্ধান্তে আসা তার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। যে মানুষ একটা দেশকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেও পারেনি, শেষের দিকে যাকে প্রায় ইঁদুরের মতো লুকিয়ে থাকতে হয়েছে সে নতুন জীবন ফিরে পেয়ে কতটা সফল হবে? ইদানীং ডেভিডের বারংবার মনে হচ্ছে এদেশে বিপ্লব সম্ভব নয়। আকাশলাল কিছুতেই বিদেশিদের কাছ থেকে সরাসরি সাহায্য নিতে চায়নি। ওর ধারণা বিদেশিদের কাছে নিজের ইজ্জত বন্ধক রেখে স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। টাকার ব্যবস্থা হলে অস্ত্র কেনা হয়েছে, এইমাত্র। কিন্তু সেই অস্ত্র নিয়ে বোর্ডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জেতার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে এসেছে। এদেশের বেশির ভাগ মানুষ চায় তারা স্বাধীনতা নামক ফলটিকে পেড়ে ওদের হাতে তুলে দেবে এবং ওরা সেটাকে উপভোগ করবে। আকাশলাল যতই মানুষকে উদ্দীপিত করুক বেশির ভাগ মানুষই তাদের নিজেদের কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে কখনই চাইবে না। হ্যাঁ, আকাশলালকে সে নিজেও শ্রদ্ধা করে, ভালবাসে। কিন্তু আসল আকাশলাল যখন ব্যর্থ তখন পরিবর্তিত আকাশলাল কি করে সফল হবে? আর পরিবর্তিত আকাশলালকে ছেড়ে তার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সে নিজের অন্ধকার ভবিষ্যৎ যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল। এ থেকে মুক্তির উপায় হল ইন্ডিয়ায় পালিয়ে যাওয়া। কিন্তু আকাশলাল বেঁচে থাকতে সেটা সম্ভব নয়। বারোটা ঘণ্টা কেটে গেলে এই দ্বিধা তার থাকবে না।
‘কি হল?’ ঠিক পেছনে ত্রিভুবনের গলা শুনল ডেভিড। সুড়ঙ্গের প্রায় শেষ প্রান্তে সে উবু হয়ে বসে ছিল। তার সামনে তিনজন কর্মী আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। ত্রিভুবনের গলার স্বরে চৈতন্য ফিরল যেন।
ত্রিভুবন বলল, ‘আর মাত্র সাড়ে এগার ঘণ্টা বাকি। কাজ শুরু করে দাও।’
‘ওপরের অবস্থা কি?’
‘এখন ভোর হয়ে গেছে। কবরখানায় কেউ নেই। শুধু একজন মহিলা রিপোর্টার লুকিয়ে কবরখানায় ঢুকেছিল তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে।’
‘মহিলা রিপোটার? ডেভিড অবাক।
‘হ্যাঁ। কিন্তু এখন সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না।
‘আমার ভয় হচ্ছে। যদি সুড়ঙ্গটা ঠিকঠাক জায়গায় না এসে থাকে!’
‘ওঃ। আমি অনেক পরীক্ষা করেছি। আমি নিশ্চিত, কোনও ভুল হয়নি।’
অতএব ডেভিডকে আদেশ দিতে হল। কোদালের কোপ পড়তে লাগল সামনে। মাটি পাথর উঠে আসতে লাগল সমানে। শব্দ হচ্ছে। অবশ্য এই শব্দ বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। কোনও ধাতব বস্তু বা পাথর বা কাঠের গায়ে আঘাত লাগলেই থেমে গিয়ে সেটাকে পরীক্ষা করা হচ্ছে।
সকাল আটটায় সুড়ঙ্গের বাতাস ভারী হয়ে গেল। অক্সিজেন কমে যাচ্ছে দ্রুত। সেই সময়ের খুব দেরি নেই যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। সুড়ঙ্গ খোঁড়ার প্রাথমিক সময়ে যে ভয় ছিল এখন সেটা তেমন নেই। তখন মনে হত যে কোনও মুহূর্তেই ওপরের মাটি নীচে নেমে এসে মৃত্যুফাঁদ তৈরি করে দেবে অথবা পুলিশ উদয় হবে। সুড়ঙ্গের মুখ বন্ধ করে দিলে কর্মরত সবাই আর পৃথিবীর আলো দেখবে না। সতর্ক করে দেবার জন্যে পাহারাদার থাকলেও ভয়টা মনে চেপে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন সেরকম কিছুই ঘটছিল না, তখন ভয়টাও মনের এক কোণে নেতিয়ে রইল।
সামনের খননকারীদের মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। কোদালের ডগায় কাঠের অস্তিত্ব। না, দিকভ্রান্ত হয়নি তারা। জমি মেপে মেপে রাস্তার তলা দিয়ে পাঁচিল ওপরে রেখে ঠিকঠাক কবরখানায় ঢুকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যেতে পেরেছে। ত্রিভবন গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল, ‘এবার সাবধান। আর কোদাল নয়। হাত চালাও ভাই সব। মাটি নরম আছে। সাবধানে কফিনটাকে টেনে নিয়ে এসো।’ বলাটা যত সহজ কাজটা ততটা ছিল না। আকাশলালের বন্ধ কফিন বাক্সটিকে বের করে সুড়ঙ্গে নিয়ে আসতে অনেক ঘাম বের হল খননকারীদের।
কোমর যেখানে সোজা করা যাচ্ছে না সেখানে এত লম্বা কফিন বহন করে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর। ডেভিড বলল, ‘আমাদের স্ট্রেচার আনা উচিত ছিল।’
‘কি উচিত ছিল তা এখন ভেবে লাভ কি। সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। কফিনটাকেই নিয়ে যেতে হবে ঘর পর্যন্ত। এসো ভাই, হাত লাগাই।’ ত্রিভুবন বলল।
‘কফিনটাকে এখানেই রেখে শরীরটাকে নিয়ে যাই।’
ডেভিড ইতস্তত করছিল।
কিন্তু ততক্ষণে কফিনটাকে কোনও মতে টেনে নিয়ে যাওয়া শুরু হয়েছে। শরীরগুলো বেঁকেচুরে সেই ছোট্ট সুড়ঙ্গে একটা ভারী কফিনকে একটু একটু করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল পরম মমতায়। সামান্য ঝাঁকুনি হলে ভেতরের মানুষটির শরীরে যে প্রতিক্রিয়া হবে সে সম্পর্কে তারা অত্যন্ত সচেতন ছিল।
প্রায় আধঘণ্টা সময় পরে ওরা কফিনটাকে বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসতে পারল।
কফিনের ডালা খুলল ত্রিভূবন। আকাশলাল যেন পরম নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। শরীরটাকে অত্যন্ত সাবধানে বাইরে বের করে নিয়ে আসা হল। আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অ্যাম্বুলেন্স আসবে।
ত্রিভুবন ডেভিডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ।’
ডেভিড মাথা নাড়ল। আগে থেকেই এই ব্যাপারটা পরিকল্পনায় ছিল। কফিনটাকে রাখা হবে কফিনের জায়গায়। সুড়ঙ্গের ভেতরটায় মাটি ফেলে আবার ভরাট করে দেওয়া হবে। আজ অথবা আগামী কাল যেন কেউ না বুঝতে পারে এখানে এমন কর্মকাণ্ড ঘটেছে।
ডেভিড় খালি কফিন এবং খননকারীদের নিয়ে নেমে গেল সুড়ঙ্গে। এখন কাজ সারতে হবে খুব দ্রুত। বাড়িটার সমস্ত ঘর থেকে মাটি বের করে নিয়ে যেতে হবে সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে। খালি কফিন বলেই এবং কারও আঘাতের সম্ভাবনা না থাকায় ওরা অনেকটা সহজেই চলে আসতে পারল সমাধিস্থলে। কিন্তু কফিনটাকে টেনে বের করার সময় কেউ লক্ষ করেনি জায়গা ফাঁকা পাওয়ায় ওপরের নরম মাটি নীচে নেমে এসেছে ভরাট করতে। এখন এই কফিনটাকে ঠিকঠাক রাখতে গেলে আবার মাটি সরাতে হবে। কাজটা শুরু করতেই আর একটা বিপদ হল। সামান্য জায়গা ফাঁকা হতেই ওপরের মাটি তাকে ভরাট করছে। এবং এইভাবে কিছুক্ষণ চললে সমাধিস্থল অনেকটাই বসে যাবে। কারখানার ওপরে দাঁড়ালে সেটা পরিষ্কার দেখা যাবে। আচমকা অতখানি জমি কেন বসে গেল সেই সন্দেহ পুরো ব্যাপারটাকে আর গোপনে রাখবে না। ডেভিড মরিয়া হয়ে উঠল।
ঠিক সেইসময় ওপরের রাস্তা দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স ছুটে যাচ্ছিল। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে আকাশলাল শুয়ে আছে আর কয়েকঘণ্টার সম্ভাবনা নিয়ে। তার পাশে বসে আছে ত্রিভুবন, উদ্বিগ্ন এবং বেপরোয়া।
ঠিক সেইসময় কবরখানার একজন কর্মচারী সরু পথ দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না সে। গতরাত্রে পুলিশ আকাশলালকে যেখানে কবর দিয়ে গিয়েছে সেই জায়গার মাটি নড়ছে। চিৎকার করতে করতে.সে অফিসঘরের দিকে ছুটে গেল।