২৩. জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছর

যদি বর্ষে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।।
(খনা)

জিয়াউর রহমানের পাঁচ বছরের শাসনে প্রতি মাঘের শেষে বর্ষণ হয়েছিল কি না তার হিসাব কেউ রাখে নি, তবে এই পাঁচ বছরে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয় নি। অতি বর্ষণের বন্যা না, খরা না, জলোচ্ছাস না।

দেশে কাপড়ের অভাব কিছুটা দূর হলো। দ্রব্যমূল্য লাগামছাড়া হলো না। বাংলাদেশের নদীতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়তে লাগল।

বাংলাদেশের মানুষ মনে করতে রু করল অনেকদিন পর তারা এমন একজন রাষ্ট্রপ্রধান পেয়েছে যিনি সৎ। নিজের জন্যে কিংবা নিজের আত্মীয়স্বজনের জন্যে টাকাপয়সা লুটপাটের চিন্তা তার মাথায় নেই। বরং তার মাথায় আছে দেশের জন্যে চিন্তা। তিনি খাল কেটে দেশ বদলাতে চান।

জিয়া মানুষটা সৎ ছিলেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। লোক দেখানো সৎ না, আসলেই সৎ। তার মৃত্যুর পর দেখা গেল জিয়া পরিবারের কোনো সঞ্চয় নেই। বাংলাদেশ সরকার জিয়া পরিবারের সাহায্যে তখন এগিয়ে এল। বাংলাদেশ সরকার যা করল তা হলো—

১. জরুরি ভিত্তিতে দশ লক্ষ টাকা নগদ মঞ্জুরি।

২. এক টাকা দামে ঢাকায় অভিজাত এলাকায় বিশাল বাড়ি বিক্রি।

৩. ২৫ বৎসর না হওয়া পর্যন্ত জিয়াউর রহমানের দুই পুত্র তারেক এবং কোকোর দেশের ভেতর কিংবা দেশের বাইরের পড়াশোনার সমস্ত খরচ সরকারের। এই সময় দুই ছেলে মাথাপিছু পনের শ’ টাকা ভাতাও পেতে থাকবে।

৪. সরকার বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দুই পুত্রের দেশের ভেতর ও বাইরের সমস্ত খরচ বহন করবে।

৫. সরকার এই পরিবারের জন্যে একটি গাড়ি দেবেন। গাড়ির ড্রাইভার ও পেট্রোল খরচ সরকার বহন করবেন।

৬. এই পরিবারকে একটি টেলিফোন বরাদ্দ করা হবে। টেলিফোনের খরচ সরকার বহন করবে।

৭. খালেদা জিয়ার বাড়িতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির খরচ সরকার বহন করবে। বাড়ি পাহারার ব্যবস্থাও সরকার করবে।

৮. খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত সহকারী এবং পাঁচজন গৃহভৃত্যের খরচ সরকার বহন করবে।

এগুলি হলো জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরের ব্যবস্থা। তার আগে ফিরে যাই। অর্থনৈতিকভাবে অতি সৎ একজন মানুষের দেখা পেয়ে বাংলাদেশের মানুষ আনন্দিত হলো। মূল কারণ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে এই ধরনের মানুষ তারা আগে দেখে নি।

বুদ্ধিজীবী এবং কবি-সাহিত্যিকরা জিয়াকে বিশেষ করে, তার খালকাটা প্রকল্পকে সমর্থন জানালেন। কবি শামসুর রাহমানকে এক খাল কাটা উৎসবে লাল টাই পরে ঘুরে বেড়াতে দেখা গেল।

প্রচারমাধ্যমগুলি জিয়াউর রহমানের সততার গল্প প্রচার করতে শুরু করল। যেমন, এই মানুষটির দুটি মাত্র শার্ট। উনি যখন বিদেশে যান তখন আলাদা বিমানে যান না। সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানে যান। বিমানের খাবার খান না। টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার নিয়ে যান।

জিয়াউর রহমান বিদেশে বেশকিছু ভালো বন্ধু পেলেন। যেমন, সৌদি আরবের বাদশাহ। বাদশার নিমন্ত্রণে জিয়া সৌদি আরব গেলেন। সঙ্গে করে বাদশার জন্য উপহার হিসেবে পাঁচ শ’ নিমগাছের চারা নিয়ে গেলেন। ব্যতিক্রমী এই উপহার দেখে বাদশাহ অবাক এবং আনন্দিত হলেন। বিশেষ তত্ত্বাবধানে পাঁচ শ’ চারা লাগানো হলো। সৌদি আরবের জন্যে গাছগুলি আশীর্বাদের মতো হলো। ধূসর মরুভূমিতে নিয়ে এল সবুজের মায়া। সৌদি আরবে নিমগাছের নাম জিয়া গাছ।

বেলজিয়ামের রাজা ও রানির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হলো। তিনি তাদের জন্যে বাংলাদেশের দুটি হস্তিশাবক উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই দুই হস্তিশাবকের স্থান হলো রানির ব্যক্তিগত চিড়িয়াখানায়। জিয়ার আমন্ত্রণে রাজা-রানি বাংলাদেশ সফরে এলেন।

জিয়াউর রহমান অতি ভাগ্যবান মানুষদের একজন। মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি বাংলাদেশের সপ্তম প্রেসিডেন্ট। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম এক ঘোষণায় জানান—

‘আমি, সাদাত মোহম্মদ সায়েম শারীরিক অসুস্থতার কারণে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়ে পড়েছি। সুতরাং আমি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত করেছি এবং তার কাছে প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব অর্পণ করছি।’

শারীরিক অসুস্থতায় কাতর হয়ে প্রেসিডেন্ট সায়েম জিয়াকে প্রেসিডেন্ট বানান নি। জিয়া এই ঘোষণা দিতে তাঁকে বাধ্য করেছিলেন।

রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা হাতে নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বৈরশাসক হয়ে গেলেও বাংলাদেশের অনেক মানুষ ব্যাপারটা বুঝতে পারল না। তারা ভাবল, কী শক্তিমান প্রেসিডেন্ট! এমন মানুষই আমাদের প্রয়োজন।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কঠিন যুদ্ধাপরাধীদের (গোলাম আযম) পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব দিলেন এবং বিশেষ ক্ষমতায় বসালেন। সামরিক শৃঙ্খলার অজুহাতে সেপাই ও অফিসারদের গোপন সামরিক আদালতে বিচার হতেই থাকল। এদের দীর্ঘনিঃশ্বাস জমা হলো চট্টগ্রামের সার্কিট হাউজে। তারিখ ৩০ মে রাত এগারোটা। জিয়া প্রাণ হারান তার একসময়ের সাথী জেনারেল মঞ্জুরের পাঠানো ঘাতক বাহিনীর হাতে।

জেনারেল মঞ্জুরের পরিচয় দেওয়া যেতে পারে। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী অফিসারদের একজন। মাত্র ২০ বছর বয়সে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের শিয়ালকোটে বন্দি ছিলেন। সেখান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। শিয়ালকোট থেকে তাঁর সঙ্গে আরও একজন পালিয়েছিলেন, তার নাম কর্নেল তাহের। এই দুজনই মুক্তিযুদ্ধে বীরত্ব প্রদর্শনের জন্যে ‘বীর উত্তম’ খেতাবধারী।

বলা হয়ে থাকে, জেনারেল মঞ্জুর তার রূপবতী স্ত্রী দ্বারা পরিচালিত ছিলেন। এই স্ত্রী মঞ্জুরের শেষ দিন পর্যন্ত তার সঙ্গী ছিলেন।

সেনা অভ্যুত্থান ঘটানো এবং জিয়া হত্যার পেছনে প্রলয়ংকরী স্ত্রী বুদ্ধি কাজ করে থাকতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *