২৩. গ্রন্থশেষ

গ্রন্থশেষ

শ্যামা ঠাকরুণ কিন্তু আজও বেঁচে আছেন। বিশ্বাস না হয় গিয়ে দেখতে পারেন। বেশিদূরে যেতে হবে না–কলকাতার কাছেই, খুবই কাছে থাকেন তিনি। বি-এন-আর দিয়ে গেলে হাওড়া থেকে আট ন মাইলের মধ্যেই। বাসেও যেতে পারেন–বারদুই বাস বদল করতে হবে, এই যা।

সে বাড়িও তাঁর তেমনি আছে। একটুও বদলায় নি। বাইরের জগতে কত কি পরিবর্তন হ’ল, কত এগিয়ে গেল দেশ, জাতি; চারিদিকে উন্নতির, নতুন ক’রে গঠনের কত আয়োজন, চারিদিকে কর্মব্যস্ততা–নতুন আশা আকাঙ্ক্ষা উদ্দীপনা। নতুন কল্পনা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি। কিন্তু সেসব কোন হাওয়াই সে বাড়ির সেই ঘন গাছগাছালিতে পূর্ণ অন্ধকার প্রাঙ্গণে ঢুকতে পারে না। হাওয়াই ঢোকে না। সমস্ত উঠানটা আম কাঁঠাল পেঁপে গাছে এমন জড়াজড়ি আর সেই গাছে- গাছে এমন বিভিন্ন রকমের লতা যে, দিনের বেলা সামান্য আলো যদি বা তার সূক্ষ্ম ফাঁক দিয়ে নিচে নামে–হাওয়া একদম আসে না। অথচ হাওয়ার অভাব নেই, এ বাড়ির বাইরে গেলেই হয়ত এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস আপনি পাবেন। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যখন ঝড়ের মতো দক্ষিণা বাতাস বইতে থাকে তখনও সে হাওয়া এই গাছপাতাগুলোর মাথার ওপর দিয়ে, তাদের মাথার ওপরের পত্র-পল্লব কাঁপিয়ে নুইয়ে চলে যায় কিন্তু নিচের ঘর্মাক্ত মানুষের শ্রান্তি দূর করতে তার এতটুকু আভাস পর্যন্ত মেলে না।

সে বাড়ি খুঁজে বার করতেও আপনার অসুবিধা হবে না। স্টেশন থেকে এগিয়ে সরস্বতীর পুল পার হয়ে রাজবাড়ি বাজার ছাড়িয়ে সিদ্ধেশ্বরীতলা ডাইনে রেখে আরও একটু যদি হাঁটতে পারেন, মাত্র রশিদুই পথ–তাহলেই দেখতে পাবেন–তিনদিকে গভীর পগার বা খানায় ঘেরা দ্বীপের মতো বাড়িটি একভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তবে খুব চট করে দেখতে পাবেনও না। নিবিড় বাঁশঝাড়ে আর তেপল্‌তের ঘন বেড়ায় আড়াল করে রাখবে আপনার দৃষ্টি; আরও বহু গাছপালা–কলাঝাড়ে ডুমুর গাছে হাসনুহানায়-যেন নিবিড় অরণ্য সৃষ্টি করে রেখেছে সামনের দিকটায়। অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখলে ঠাওর পাবেন একটা বেড়া, বেড়ার গায়ে ছোট্ট একটু আগড়। আগড় ঠেলে পয়ে-চলা সরু পথের রেখা ধরে বেশ খানিকটা ভেতরে এগিয়ে গেলে বাড়িটা দেখতে পাবেন ভাল করে। সামনের দিকে ছোট পুকুরও আছে একটা, তার পাড়ে পাড়ে নারকেল-সুপুরি-আমড়া তেঁতুলের অসংখ্য গাছ থাকা সত্ত্বেও তবু সেইখানটাই একটু ফাঁকা। বাড়িটা যে আদৌ দেখা যায়–তার কারণ ঐটুকু খোলা জায়গার আলো। তা নইলে বাড়ির ভেতর বার সবটাই প্রায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার।

এসব গাছপালা শ্যামাই লাগিয়েছেন। এত ঘন গাছপালায় ফল ফসল হয় না তা তিনি ও জানেন–খনার বচন তিনিই শোনান কতজনেকে, ‘গাছ-গাছালি ঘন সবে না, গাছ হবে তার ফল হবে না।’ তবু কোনটাই প্রাণ ধরে ফেলে দিতে পারেন না। বরং এখনও পুঁতে চলেছেন এটা- ওটা। কেউ বলতে এলে বলেন, ‘থাক থাক। খেতে দিতে তো হচ্ছে না।… আমার বরাতে ফলের ভোগ নেই তা তো দেখতেই পাচ্ছ। নইলে নিজের অতগুলো থাকতে–! আমার অদৃষ্টই নিষ্ফলা। মাঝখান থেকে ওদের দুষি কেন?… আর কাটো বললেই কি কাটা যায়– বলে বাড়ির গাছা আর কোলের বাছা দুই-ই সমান।’

কিন্তু নিজেও এক এক সময় ধৈর্য রাখতে পারেন না। বিশেষ যখন পরের বাড়ি কোথাও গিয়ে দেখে আসেন লাউমাচায় বড় বড় লাউ…উঠানে হয়ত মৃদুঙ্গের মতো কুমড়ো, কিম্বা মোটামোটা কালীবৌ কলার কাঁদি বা গাছ ভর্তি কাঁঠাল-আম–তখন বাড়িতে এসে অবশিষ্ট কটা দাঁত কিড়মিড় করে গালাগাল দেন অকৃতজ্ঞ গাছগুলোকে, ‘মরণ তোদের, মরণ! মরণ! পোড়াকপাল হ’লে কি গাছপালাও পিছনে লাগে রে! কেন আমি কি করেছি তোদের? ঐসব চোখখাকী গতরখাকীদের বাড়ি গিয়ে ফসল ঢেলে দিয়ে আসতে পারো–আমাকে একটা দিতেই বুক চড়চড় করে? আমার বেলাই সব আগুন লেগে পুড়ে যায়, ছাতার ধোয়ায় ধুয়ে যায়?’

গাছপালার সেই প্রায় দুর্ভেদ্য আবরণ ভেদ করে যদি বাড়িটাতে আপনার নজর চলে তো দেখবেন, বাড়িটা নেহাৎ ছোটও নয়। বাইরের দিকে বৈঠকখানা ঘর আছে, তার রক আছে। ভেতরে দুটো ঘর-দালান–এছাড়া মাটির বড় রান্নাঘর, তার প্রশস্ত দাওয়া এবং বেশ খানিকটা উঠোন নিয়ে পাঁচিলঘেরা মূল বসত-বাড়ি। বাড়ির চারিদিকে বাগান–যে করেছিল তার রুচিবোধ আছে। কিন্তু সে বাড়ির আসল চেহারাটা আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। ঘন ছায়ার আস্তরণে যেন ঢাকা পড়ে আছে সবটা, দুপুর বেলা ছাড়া সবটা নজরে পড়াই কঠিন। কখনই রোদ নামে না বলে বাড়িটা কেমন স্যাঁতসেঁতে ভিজে-ভিজেও লাগে বারো মাস। একটা ভ্যাপসা গন্ধ ছাড়ে। ভিজে ভিজে হওয়ার আরও কারণ তিনদিকে গভীর খানা বা পগার। এ পগার একেবারে কখনই শুকোয় না, গ্রামের অন্য সব পগার শুকিয়ে খটখট করে যখন তখনও এ-খানাটায় সামান্য জল থাকে। তার ফলে ভাম-ভোঁদড় গো- হাড়গেলের স্থায়ী আড্ডা এখানে। বর্ষাকালে পগারের জল উপচে বাগানে ওঠে। ময়লা নোংরা জল, ঘেন্না হয় সে জলে পা দিতে। তবু শ্যামা তাতে এক সান্ত্বনার সূত্রও আবিষ্কার করেছেন। সে জলের সঙ্গে কিছু কিছু মাছ এসে তাঁর পুকুরে পড়ে–বাগানে বা উঠানে চুপড়ি চাপা দিয়ে ধরাও যায় কিছু কিছু। তিনি খান না, খাবার লোকও কেউ নেই আর, কিন্তু পাড়া-ঘরে বিক্রি করে দুচারটে পয়সা পাওয়া যায়, সেইটেই লাভ।

সাধারণ হিসেবে বাড়িটা বড়ই–তবু তাতে তিলধারণের স্থান নেই। না, ফার্নিচারে বোঝাই নয়, দালান দাওয়া রক রান্নাঘর, এমন কি শোবার ঘরেও কিছুটা অংশ বোঝাই হয়ে গেছে শুকনো পাতায়। খ্যাংরাকাঠি চেঁচে বার করে নেওয়া নারকেল পাতা তো আছেই– তাছাড়াও আছে অসংখ্য গাছের অসংখ্য শুকনো পাতা ও পালা, আমড়া পাতা, বাঁশ পাতা, সুপুরি পাতা, সুপুরির বেদো, বাঁশের গোড়া, কঞ্চি। সারাদিনই ঘুরে ঘুরে এগুলো সংগ্রহ করেন তিনি– একটি একটি করে পাতা কুড়িয়ে বেড়ান–সংগ্রহ করেই চলেছেন। কার জন্যে এখনও তাঁর এই কষ্টস্বীকার উষ্ঞবৃত্তি তা তিনিও জানেন না। তাঁর যা সামান্য রান্না-খাওয়া তাতে বর্তমান সঞ্চয়েই অন্তত বিশ বছর চলবার কথা। আরও অতদিন তিনি বাঁচবেন না এটা ঠিক। তবু সে পাতা জমিয়েই যাচ্ছেন, বিরাম নেই বিশ্রাম নেই। কেউ অনুযোগ করলে কি ঠাট্টা করলে চটে যান। বলেন, ‘থাক না বাছা, পাতায় নজর দাও কেন? কেউ কি আমাকে দরকারের সময় এক মণ কাঠ কি কয়লা দিয়ে উগ্‌গার করবে? ওতে আমার সম্বচ্ছরের জ্বালানির খরচা বেঁচে যায়। আর খাওয়াতে পরাতে তো হচ্ছে না ওদের–উল্টে ওরাই আমার সুসার করছে সংসারে!… পাতার জন্যে আঙ্কাচ্ছেই বা কার কি? কারুর কি থাকার অসুবিধে হচ্ছে?’

তা হচ্ছে না। কারণ কেউই নেই এ-বাড়িতে। অচির অভিষ্যতে কেউ আসবে অথচ থাকবার মতো লোকের অভাব নেই তার। বলতে গেলে হাঁটের ফিরাঙ্গ তার চারিদিকে। মরে হেজে গিয়েও তিন ছেলে তিন মেয়ে ছিল। একটা ছেলে হারিয়ে গেছে আরও দুটো ছেলে বর্তমান। রোজগারও করে তারা। বিয়ে-থা করেছে, ছেলেমেয়েও আছে। মেয়েও আছে দুটো–তাদের ছেলেমেয়ে! নাতি-নাত্নীদেরও ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। জাজ্জ্বল্যমান সংসার। তবু কেউই নেই আজ তাঁর কাছে। ….সন্তান বলতে এখন এইসব গাছপালা, শুকনো পাতা আর টাকার সুদ। চোখে দেখতে পান না, চলেন ভূঁয়ে মুয়ে হয়ে–কোমর ভেঙ্গে গেছে বহুদিনই তবু পাতা জমানোরও যেমন বিরাম নেই, তেমনি টাকা জমানোরও না। তেজারতি কারবার ঠিক চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘটি-বাটি রেখে চার আনা আট আনা পয়সা থেকে শুরু করে গহনা-বন্ধক রেখে বিশ পঁচিশ-পঞ্চাশ টাকাও ধার দেন। সুদও নেন চড়া। চোখে দেখতে পান না বলে কত লোক ঠকিয়ে যায়–আজকাল হিসেব করতেও কেমন গোলমাল হয়ে যায়, সেটা যে বোঝেন না তাও নয়–তবু ছাড়তেও পারেন না কারবার। প্রবল নেশার মতোই ওটা তাঁকে পেয়ে বসে আছে। হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিনিসটা কি অনুভব করে দেখে নেন–তেমনি হাত বুলিয়ে বুলিয়ে সিকি আধুলি টাকা বার করে দেন। আর প্রয়োজন হলে সেই ভূঁয়ে-মুয়ে হয়ে হেঁটেই সুদ আদায় করে বেড়ান। হেঁটে যান হেঁটে আসেন– শিবপুর থেকে পোদড়া শালিমার পর্যন্ত।

তবে আজকাল আর যেতে পারেন না। শক্তিসামর্থ্যর অভাব বলে নয়– বাড়িতে রেখে যাবেন এমন লোক নেই বলে। অথচ–ছিল নয়, আজও আছে সবাই। বড় ছেলে-বৌ থাকে জামালপুরে, ওরা নাকি সেখানে খাপরার বাড়ি তুলে নিয়েছে, সেখানেই থাকবে। শুধু তাঁর কাছে থাকতে হবে বলেই আসবে না এখানে। ছোট ছেলে বাড়ি-ঘর কিছুই করতে পারে নি, টালিগঞ্জের দিকে কোথায় যেন খোলার ঘর ভাড়া করে থাকে। কালা-হাবা মানুষ, সামান্য আয়–এই বাজারে ঘর-ভাড়া দিয়ে অতিকষ্টে দিন কাটে–তবু এখানের এই নিজেদের পাকা বাড়িও পছন্দ নয়।

বিধবা মেয়ে ছিল, এখনও আছে। কিন্তু তার যা স্বভাব, সে মেয়ের আর মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না শ্যামার। বড় মেয়েই যা ন-মাসে ছ-মাসে আসে এক-আধদিন–মায়ের খবর নিয়ে যায়। তবে তারও বৃহৎ সংসার, ফেলে এসে ওঁকে আগলাবে তা সম্ভব নয়।

এ-সব ছাড়াও কিন্তু ছিল একজন।

বলাইটাই ছিল। সে কোনদিন কোথাও যেতে পারবে না– এই ভেবেই নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি, পাখির পাখনা কাটা গেছে, ওড়বার পথ বন্ধ হয়েছে মনে করেছিলেন। সেই ভাবেই জন্তুর মতো করে রেখেছিলেন তাকে। লেখাপড়া শেখে নি–ভদ্রসমাজে বেরিয়েও কারও সঙ্গে কথা কইতে পারতে না। দিনরাত ঘরের কোণে মুখ বুজে বসে থাকত। তবু সেও রইল না। নিজের দোষেই তাকে হারালেন শ্যামা, নিজের বুদ্ধির দোষে। শেষবারের মতো শখ হয়েছিল তাঁর আবার সংসার পাতবার। শেষ শখ জেগেছিল পরের মেয়ের সেবা খাবার। সেই শখেই সব গেল–বেনোজল এসে ঘোরো জল বার করে নিয়ে গেল–মূলে-হাভাত হ’ল। মুখে আগুন তাঁর ইচ্ছে করে নিজের মুখে নিজে নুড়ো জ্বেলে দিতে। লজ্জা-ঘেন্না নেই–তাই আবার ঐ ছেঁড়া চুলে খোঁপা বাঁধতে গিয়েছিলেন। সারাজীবন ধরে দেখেও চৈতন্য হ’ল না–নিজের ভাগ্য বুঝতে পারলেন না তিনি– আশ্চর্য!… বলে, ‘এত সুখ তোর কপালে, তবে কেন তোর কাঁথা বগলে!’ কোন্ লজ্জায় সুখ- স্বাচ্ছন্দ্যের আশা করতে গেলেন তিনি।

বলাই চলে যাওয়ার পর থেকে শ্যামা একাই আছেন। একেবারে নিঃসঙ্গ একক। ভালই আছেন। যারা আসে তাঁর কাছে–অধিকাংশই খাতক–তাদেরও তাই বলেন, ‘বেশ আছি আমি, বেশ থাকি একলা একলা। লোক থাকলেও আমার কোন উপকার হবে না এ আমি বেশ বুঝে নিয়েছি। তবে আর কেন? বরঞ্চ থাকলেই দায়, এ আমি ইচ্ছে হ’লে খাচ্ছি না হয় তো এক ঘটি জল খেয়ে পড়ে থাকছি, অপর কারুর ভাবনা তো ভাবতে হচ্ছে না।’

‘তবুও’, খাতকরা কর্তব্যবোধে উদ্বেগ প্রকাশ করে হয়ত ‘মানুষের শরীর, বলা তো যায় না। রাত-বিরেতে যদি অসুখ-টসুখ হয়ে পড়ে

কথা শেষ করতে দেন না শ্যামা, কী আর হবে তাতে, মরে পড়ে থাকব, এই তো! সে যদি কপালে লেখা থাকে তো ঘুচবে না, লোক থাক আর না-ই থাক। খবর পাবেই ঠিক– বিষয়ের দখল নিতেও অন্তত পচা-মড়াটা বার করতে হবে।… মরবার পর লাশটা কি হবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই!’

না, একাই বেশ আছেন। বেশ থাকেন তিনি। ঊনআশি বছর বয়স চলছে, রোগে ও অনাহারে শীর্ণ শরীর, সামনে ঝুঁকে পড়তে পড়তে প্রায় মাটিতে এসে ঠেকেছে মুখটা। কোমর ভেঙ্গে গেছে অনেকদিন, যদিচ দাঁত এখনও সব পড়ে নি। একটু চললেই কোমর পিঠে যন্ত্রণা হয়, খব কষ্ট হয় যখন মধ্যে মধ্যে একবার কোমরের পিছনে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করেন। সবটা সোজা হয় না, কেমন একটা অদ্ভুত ত্রিভঙ্গ আকার ধারণ করে।

তবু সেই অবস্থাতেই সারাদিন বাগানে ঘুরে বেড়ান প্রেতিনীর মতো। কোথায় এখনও একটা গাছ পোঁতবার মতো আট আঙুল জায়গা খালি আছে–আর কোথায় আছে জ্বালবার মতো একটি শুকনো পাতা–তারই সন্ধানে। অবশ্য দিনের আলো বড় কম। চারটে বাজলেই এ বাড়িতে আলো জ্বালবার প্রয়োজন হয়। মশার গর্জন শুরু হয়ে যায় কোণে কোণে–সেই ভয়াবহ ঝুসি অন্ধকার বাড়িতে একা চুপ ক’রে বসে থাকতে হয় তখন। রাত্রিটাই বড় দুঃসহ। ঘুম হয় না তাঁর আজকাল। কোনদিন এক ঘণ্টা, কোনদিন দু’ ঘণ্টা কোন দিন আদৌ চোখ বুজতে পারেন না। তেল খরচার ভয়ে আলোও জ্বালেন না, মনকে বোঝান–’চোখে যখন দেখতে পাই নে তখন আলো জ্বাললেই বা কি না জ্বাললেই বা!’ দিনের আহার সারতেই বেলা তিনটে বাজে, রাত্রে খাওয়ার প্রয়োজনই হয় না। যদি বা কোনদিন ইচ্ছা হয়, গভীর রাতে উঠে হাতড়ে হাতড়ে টিনের কৌটো থেকে চালভাজা বার করে অন্ধকারেই তাতে একটু তেলহাত বুলিয়ে নিয়ে আরও গভীর রাত পর্যন্ত বসে বসে কুড় কুড় ক’রে চিবিয়ে খান। আর হয়ত নিজের অতীত জীবনের কথা ভাবেন বসে বসে।

এই রাতের বেলাটা একটু ভয় ভয়ও করে আজকাল। আরও সেই জন্যে ঘুম আসে না হয়ত। না, প্রাণের ভয়, অসুখের ভয় নয়। অশরীরী কোন প্রাণীর ভয়ও না। ভয় মানুষের, চোর- ডাকাতের। অবশ্য তার জন্যে সতর্কতারও ত্রুটি নেই। ছাদের কড়ি ও বরগার খাঁজে, রান্নাঘরের মেজে খুঁড়ে–বন্দকী গহনা ও টাকা লুকিয়ে রাখেন তিনি। দুপুরবেলা রান্নাখাওয়ার সময় দোর বন্ধ ক’রে মেজে খোঁড়েন, আবার বসে বসে গোবর-মাটি দিয়ে বার বার নিকিয়ে সে খোঁড়ার চিহ্ন বিলুপ্ত করেন। যতক্ষণ না নিজেই ভুলে যান কোথায় রেখেছেন ততক্ষণ নিকিয়েই যান। ….

তবু কাউকেই ডাকেন না তিনি। কাউকে অনুরোধ করেন না কাছে এসে থাকতে। দিনের পর দিন এমনি নিঃসঙ্গ কাটে তাঁর। একা একা বাগানে ঘুরে বেড়ান আর কোমর ছাড়াবার জন্যে মধ্যে মধ্যে বেঁকে-চুরে সোজা হয়ে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন। শূন্য বাড়িটা খাঁ খাঁ করে। হঠাৎ একটা উড়ো-কাক জোরে ডেকে উঠলেও চমকে ওঠেন শ্যামা। এমনিই নিঃসঙ্গে দিন কাটে তাঁর–এমনিই সর্বপ্রকার শব্দে অনভ্যস্ত হয়ে গেছেন তিনি।

আজকাল অন্ধকার হবার পরও ঘুরে বেড়ান অনেকক্ষণ পর্যন্ত। রাজগঞ্জের কলে পাঁচটার ভোঁ না বাজলে ঘরে ঢোকেন না। ঘুরে বেড়ান আর হিসেব করেন মনে মনে, তাঁর ছেলে মেয়েদের সব ধরলে একুশটা নাতি-নাতনী। আর হিসেব করেন, কার কাছে কত সুদ বাকি আছে, সুদে আসলে কার কোন্ বন্ধকী জিনিসের দাম ছাড়িয়ে গেছে : ‘এবার পাকড়াশী-গিন্নী এলে পষ্ট বলব, না দিতে পারো এলে দিয়ে যাও, আমি আর বসে থাকতে পারব না। এখন বেচলেও আমার ঢের পাওনা থাকবে, সে যা দেবে তুমি তা ঢের বুঝেছি, মিছিমিছি গরিব বিধবার লোকসান করো কেন?’ নিজের মনেই মহড়া দেন কথাটার–হাত-পা নেড়ে।

বলাইয়ের খবর তিনি রাখেন না। শুনেছেন যে সে তাঁর উপদেশই শুনেছে, সত্যিই ভিক্ষে ক’রে খাচ্ছে। তা খাক। কে কি করছে না করছে তা জেনে তাঁর দরকার নেই। কাউকেই দরকার নেই আর।

বেশ আছেন তিনি। একাই ভাল আছেন।

2 Comments
Collapse Comments

এই ট্রায়োলজির তিনটি উপন্যাস‌ই পড়লাম, খুবই দুঃখ পেলাম। ট্রায়োলজির এই শেষ খন্ডটির জন্য লেখক রবীন্দ্র পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু আমি হলে গজেন বাবুকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতাম। এক তো কান্তির সাথে রতনের মিলটা করিয়ে দিতে পারতেন, দ্বিতীয়ত ডাক্তারের সাথে ঐন্দ্রিলার মিল করালেই হত, তারপর অরুণ স্বর্ণার পরিনয় করিয়ে দিলে এমন কি মহাভারত অশুদ্ধ হত, সবজায়গাতেই দুঃখে জর্জরিত করে দিয়েছেন। শ্যামার ছোট ছেলেটির‌ও কোন খোঁজ দিতে পারলেন না। পরিবারের সাথে পুনর্মিলন না হোক অন্তত খোঁজটা একটি ছত্রে কয়েকটি লাইনের ভিতরে দিতে পারতেন। লেখক কেন এরকম করলেন। কান্তির জন্য‌ই বেশি কাঁন্না করলাম। হেম নলিনীকে পেল না মানলাম কিন্তু কান্তি যে রতনকে পেল না এটা আর মানতে পারলাম না! কী বিভৎস!!!

খুব‌ই আশাহত হলাম এই লেখা পড়ে, লেখকের লিখননৈপুণ্যের পরিবর্তে যা পেলাম, তা কেবল সহস্রাধিক লোকের গাদাগুচ্ছের দুঃখের কাহিনী ঠেসে তিনটি উপন্যাসের মধ্যে ভরানোর শুষ্ক প্রয়াস, দুঃখবেচু সাহিত্যিক এভাবে মানুষের চোখের জল বেচে কত কামিয়েছেন বা কত পুরষ্কার যে পেয়েছেন তার হিসাব জানিনা, তবে খুশি হব এইটুকু জানতে পারলে যে এই দুঃখের ভগ্নাংশ‌ও যদি লেখক নিজের ব্যক্তিগত জীবনে ভোগ করে গিয়ে থাকেন। আশাপূর্ণা দেবীর “সুবর্ণলতা” ট্রিলজি ও এই ত্রয়ী উপন্যাস অপেক্ষা যথেষ্ট সাহিত্যগুণসম্পন্ন ও সুখপাঠ্য মনে হয়। ঈশ্বর বা ভগবান বলে যদি জীবের জীবন মরণের নিয়ন্তা কেউ থেকে থাকেন, ভাগ্যে তিনি ঔপন্যাসিক গজেন্দর মিত্তির নয়, তাহলে তাবৎ সংসারের যাবৎ জীবকে খেয়ে পরে বাঁচতে হতো না, এইটিই যা সুখের কথা!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *