ক্রিস্টোফার রোডে বিরাট লম্বা লাইন পড়েছে ভোর থেকে। মঞ্জু-হেনা-সুখুকে নিয়ে মামুন যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি এসেও দাঁড়ালেন প্রায় আড়াই শো-তিন শো জনের পেছনে। লরিতে চেপে বিভিন্ন ক্লাবের ছেলেমেয়েরা আসছে দল বেঁধে। কেটল ড্রাম ও বিউল বাজাতে বাজাতে এলো একটা মিছিল, সব মিলিয়ে একটা উৎসবের পরিবেশ। একটু দূরে একটা মাইক্রোফোনে শোনা যাচ্ছে ভরাট গলায় আবৃত্তি :
মশা মেরে ঐ গরজে কামান—’বিপ্লব মারিয়াছি।
আমাদের ডান হাতে হাতকড়া, বাম হাতে মারি মাছি।’
মেনে শত বাধা টিকটিকি হাঁচি
টিকি দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,
যা হোক
একটা দাও কিছু হাতে, একবার মরে বাঁচি!
মঞ্জু আর হেনা দু’জনেই সাতসকালে উঠে স্নান সেরে নিয়েছে, তাদের ভিজে চুল ও চোখের পল্লবে লেগে আছে স্নিগ্ধতা। সুখুর উৎসাহ সবচেয়ে বেশী, তার ভালো নাম নজরুল ইসলাম, সে এসেছে আর এক নজরুল ইসলামকে দেখতে। নতুন কুর্তা-পাজামা পরানো হয়েছে তাকে, মাথায় একটি জরির টুপি। এই ফুটফুটে ছেলেটিকে অনেকেই গাল টিপে আদর করে যাচ্ছে।
ধীর গতিতে এগোচ্ছে লাইন। মঞ্জু আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো, আবার না বৃষ্টি অ্যাইস্যা পড়ে!
গত রাত্রে খুব একচোট ঝড় বৃষ্টি হয়ে গেছে। আকাশ এখনও পরিষ্কার নয়, তবে গরমটা একটু কমেছে। হেনা বললো, বৃষ্টি নামলেও ভিজবো!
মামুন একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। তাঁর মনে পড়ছে নজরুলের অনেক কবিতার লাইন। এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি খুঁজতে লাগলেন চেনাশুনো কেউ এসেছে কি না। সেরকম কারুকে চোখে পড়লো না। এখানে কত দেরি হবে! তিনি ভেবেছিলেন, দশটার মধ্যে এখান থেকে চলে যেতে পারবেন।
এক ঘণ্টা কেটে যাবার পর সুখু আর ধৈর্য ধরে রাখতে পারছে না, ছটফট করছে, এক সময় সে মায়ের হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটে যেতেই মামুন দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরলেন। পুরোনো আমলের একটা অদ্ভুত জন্তুর মুখের মতন কপোরেশনের কল থেকে জল ঝরে পড়ছে। অবিরাম। সুখু সেই জল খেতে চায়। মামুন তাকে একটা মৃদু ধমক দিলেন।
সারা গায়ে দু’তিনটি ক্যামেরা ঝোলানো একজন ফটোগ্রাফার খচাখচ করে সুখু ও মামুনের দু’তিনটি ছবি তুলে ফেললো। একটি জলের কল, জড়ির টুপি পরা বালক ও এক প্রৌঢ়, এই কমপোজিশন সম্ভবত তাকে আকৃষ্ট করেছে। ছবি তোলার পর ফটোগ্রাফারটি বললো, আপনারা কী জয় বাংলার লোক?
মামুন মাথা ঝুঁকিয়ে বললেন, জী!
ফটোগ্রাফারটি বললো, আপনারা কতক্ষণ এই লাইনে দাঁড়াবেন? সঙ্গে বাচ্চা রয়েছে, আসুন আমার সঙ্গে!
মামুন বললেন, আমার সাথে আরও দুটি মেয়ে রয়েছে, আমার কন্যা আর ভাগনী!
–তাদেরও নিয়ে আসুন, আমি ঢুকিয়ে দিচ্ছি! ফটোগ্রাফারটি সত্যি বেশ করিৎকর্মা। সে ভিড় ঠেলে, দু’তিনজনকে ফিসফিস করে কী সব বুঝিয়ে সে মামুনদের দলটিকে ঠিক নিয়ে গেল ভেতরে।
সেই সময় বাংলাদেশ মিশনের হোসেন আলী উপস্থিত হয়েছেন সদলবলে, এসেছেন কলকাতা শহরের মেয়র, আরও কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি, তাই বাইরের লাইনের লোকদের এখন আসতে দেওয়া হচ্ছে না।
একটা ফরাসের মাঝখানে বসে আছেন কবি। এদিকে ওদিকে ছড়ানো অসংখ্য ফুল ও মালা। কবির কোনোদিকে ভূক্ষেপ নেই। ফটোগ্রাফাররা বলছে, একবার মুখ তুলুন, একবার এদিকে তাকান। কেউ কেউ চেঁচিয়ে তাঁকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছে তাঁরই কবিতার লাইন। কবি কিছুই দেখছেন না, কিছুই শুনছেন না।
মামুনের মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হলো একটা গানের লাইন : ফুলের জলশায় নীরব কেন কবি?
হোসেন আলী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে মাল্যদান করলেন কবিকে। কবি হাত দিয়ে সেই মালা ছেড়বার চেষ্টা করতে লাগলেন। নগর-কোটাল পাঠ করলেন কবির উদ্দেশে একটি মানপত্র, কবি বিড়বিড় করতে লাগলেন আপন মনে। কবির পুত্রবধূ কল্যাণী কাজী ভক্তদের আনা উপহারের বাক্সগুলি থেকে একটা সন্দেশ নিয়ে ভেঙে খাওয়াতে গেলেন। কবিকে, কবি থুঃ থুঃ করে ছেটাতে লাগলেন চারদিকে। কল্যাণী অনুনয় করে বলতে লাগলেন, বাবা, খান, একটুখানি খান।
মামুনের বারবার মনে পড়ছে ছাত্র বয়েসে দেখা কবির চেহারা, কোথায় গেল মাথার সেই ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, চোখের দীপ্ত জ্যোতি। কী সুন্দর করে হেসে বলেছিলেন, তুমি মোতাহারের ব্যাটা না?
পাশ ফিরে তিনি দেখলেন, হেনার মুখখানা যেন ভীতি-বিহ্বল আর মঞ্জুর চোখের কোণে চিকচিক করছে অশ্রু। সুখু এখনও বুঝতেই পারেনি, এর মধ্যে কোনজনকে দেখতে আসা হয়েছে, সে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করছে, আম্মা, কে? কে?
আর বেশীক্ষণ এখানে থাকার কোনো মানে হয় না, মামুন সবাইকে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বাইরে। ঘরের মধ্যে খুব গরম ছিল, ঘামে ভিজে গেছে সারা গা।
কবি যে সুস্থ নেই তা জানতেন মামুন, কিন্তু নিজের চোখে দেখার অভিঘাত অনেক প্রবল। তাঁর মনটা বিষণ্ণ হয়ে রইলো, রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মামুন একটুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলেন না।
নিজের নামের আর একজন মানুষকে দেখার সাধ মিটে গেছে সুখুর। সে মামুনের হাত ধরে। টেনে বলতে লাগলো, চিড়িয়াখানা! চিড়িয়াখানায় যাবো এবার!
মামুন আজ ওদের ভিক্টোরিয়া ও চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ওদের তো বাড়ি থেকে বেরুনোই হয় না।
মৌলালির মোড়ে এসে বাসস্টপে দাঁড়াবার কয়েক মুহূর্ত পরেই একখানা প্রাইভেট গাড়ি থামলো তাঁদের সামনে। সেই গাড়ি থেকে মুখ বাড়িয়ে একজন জিজ্ঞেস করলো, হক সাহেব
! আপনে কবে আইলেন? মামুন প্রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। হোটেলওয়ালা হোসেন সাহেব, দিনকাল পত্রিকার মালিক! এই ব্যক্তিকে মামুন কলকাতায় দেখবেন আশাই করেননি। ঢাকায় গণ্ডগোল হলে এর পক্ষে করাচি কিংবা রাওয়ালপিণ্ডিতে আশ্রয় নেওয়াই স্বাভাবিক ছিল।
হোসেন সাহেব সহর্ষে বললেন, আচ্ছালামো আলাইকুম! আচ্ছালামো আলাইকুম!
মামুন শুকনো গলায় প্রতি-অভিবাদন জানালেন।
হোসেন সাহেব বললেন, কোথায় যাইত্যাছেন? গাড়িতে উঠেন! গাড়িতে উঠেন!
হোসেন সাহেবকে দেখে মামুনের উল্লসিত হবার কোনো কারণ নেই। এই ব্যক্তিটি একসময় তাঁকে বিনা নোটিসে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। তাঁকে বলেছিল, ইন্ডিয়ার দালাল!
মামুন বললেন, ধন্যবাদ। আমরা বাস ধরবো!
হোসেন সাহেব বললেন, ওঠেন, ওঠেন! যেহানে যাবেন, লামাইয়া দিমু! বিদ্যাশে কোনো চেনা মানুষরে দ্যাখলেই আনন্দ হয়।
সুখু এর মধ্যে গাড়ির দরজা খুলে ফেলেছে। তার গাড়ি চড়ার লোেভ। মামুন আর আপত্তি করতে পারলেন না।
হোসেন সাহেব বসছেন সামনে ড্রাইভারের পাশে, মামুন সপরিবারে উঠলেন পেছনে। খুব সম্ভবত ভাড়া করা গাড়ি, ড্রাইভারটির মুখ ভাবলেশহীন।
–কোন দিকে যাবেন?
–ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে।
–ভালো কথা, ভালো কথা, আমিও হেইখানে যামু। দেইখ্যা লমু আপনাগো লগে লগে! গাড়িটা চলতে শুরু করার পর হোসেন সাহেব পেছন ফিরে একটা সোনার সিগারেট কেস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ন্যান! ধূমপান করেন। বাসা লইছেন কোথায়? নাকি কোনো রিলেটিভ আছে কইলকাতায়?
হোসেন সাহেব পরে আছেন একটি সূক্ষ্ম, স্বচ্ছ আদ্দির পাঞ্জাবি। দাড়ি কামানো মসৃণ মুখ। দুহাতে হীরে-মুক্ত বসানো অন্তত সাত-আটটি আংটি। যে-লাইটারটি বাড়িয়ে তিনি মামুনের সিগারেট ধরিয়ে দিলেন, সেটাও সোনার।
তিনি বললেন, আজমীর শরীফ ঘুইরা আসলাম ইতিমধ্যে, বোঝলেন? আপনি গ্যাছেন নাকি? বড় সুন্দর দ্যাশ এই ইন্ডিয়া, রেল ব্যবস্থা খুব ভালো, আপনি যখন যেখানে ইচ্ছা যান, কোনো অসুবিধা নাই। রাজস্থানে আছিলাম দশদিন, হোটেলের চার্জ শস্তা।
মামুনের হাসি পেল। এই হোসেন সাহেব প্রতিদিন ইন্ডিয়ার মুণ্ডপাত না করে পানি খেত না, আজ তার মুখে ইন্ডিয়ার এত প্রশংসা! এক জীবনে কতরকম ভেল্কির খেলাই যে দেখতে হয়!
মামুন জিজ্ঞেস করলেন, আলতাফের কী খবর? সে আপনার সাথে আসে নাই?
হোসেন সাহেব বললেন, নাঃ! সে আসলো না! কী জানি সে কোথায় আছে! আইচ্ছা, হক সাহেব, কইলকাতা থিকা একটা পেপার বার করা যায় না? আমাগো স্বাধীন বাংলাদেশের সব খবর থাকবে? আমি কিছু কিছু হোটেল মালিকের সাথে আলাপ করত্যাছি, যদি এইখানে একটা হোটেল খোলন যায়, অনেকেই তো আসতে আছে বর্ডার ক্রশ কইরা–
মামুন বললেন, পত্রিকা তো বার হচ্ছে একটা।
–ঐ বালু হক্কাক লেনের ‘জয় বাঙলা? গেছিলাম অগো আয়। ঐ প্যাপারে কোনো কাম হবে না! আপনার মতন একজন তেজী সম্পাদক চাই!
মামুন এবার সশব্দে হেসে উঠলেন। মানুষ এমন অম্লান বদনে বিপরীত কথা বলতে পারে।
–হাসলেন যে? আমি সীরিয়াস। কেপিটাল আমি যোগাড় করমু, হ্যাঁর জন্য কোনো চিন্তা নাই, আমার সোর্স আছে। আসেন, খুব শিগগিরই আপনার সাথে বইস্যা আলোচনা করা যাক। কাইল আসবেন, গ্র্যান্ড হোটেলে আমার সাথে লাঞ্চ খান!
–আমার আর সম্পাদক হবার শখ নাই!
–এটা কি শখের ব্যাপার? দ্যাশের কাজ! দ্যাশ স্বাধীন করতে হবে! হক সাহেব, টাকা পয়সার কথা ভাইবেন না, ইন্ডিয়ার যে-কোনো প্যাপারের এডিটরের সমান বেতন পাবেন।
–আপনার অফারের জন্য ধন্যবাদ। আপনি অন্য সম্পাদক খোঁজেন, হোসেন সাহেব। আমি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে অন্য একটি কাজে যুক্ত আছি।
গাড়িটা এসে থামলো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটে। হোসেন সাহেব আরও অনেকক্ষণ। সঙ্গে সেঁটে থাকবে ভেবে মামুন শঙ্কিত বোধ করছিলেন, কিন্তু হোসেন সাহেব এর মধ্যেই আবার মত বদলেছেন।
মামুনরা নামতেই তিনি বললেন, এই রাখেন আমার কার্ড। কাইল পরশুর মধ্যে একবার আইস্যা পড়েন, আপনার সাথে আরও অইন্য কথা আছে। আমি আর নামলাম না, আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বাংলাদেশ মিশনে।
গাড়িটা চলে যাবার পর মামুন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর তিনি বললেন, ইস, প্রতাপের মেয়েটা বুঝি এতক্ষণে ফিরে চলে গেছে?
গেটের উল্টোদিকে মহারানীর ভিক্তোরিয়ার মূর্তির পাদদেশে একটা বই হাতে নিয়ে বসে। আছে মুন্নি। সে এসেছে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট আগে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে গেছে তার কপালে।
সিঁড়ি থেকে নেমে এসে সে বললো, মামুনকাকা, এই যে আমি! তারপর সে মামুনের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।
মামুন তার কাঁধ ধরে টেনে তুলে বললেন, আহা রে, তোরে কতক্ষণ বসায়ে রেখেছি। নিদারুণ ভিড় হয়েছিল রে কবির বাসায়।
মুন্নি বললো, আমি একবার দেখতে গিয়েছিলাম ওঁর জন্মদিনে। প্রত্যেক বছরই ভিড় হয়।
–এ বৎসর আরও বেশি ভিড়। জয় বাংলার সক্কলেই গেছে তো! বাসার সব কেমন আছে, মুন্নি? তোমার মায়ের জ্বর সারছে?
–হ্যাঁ, সেরে গেছে। আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে আপনাদের সবার নেমন্তন্ন। বাবা বিশেষ করে বলে দিয়েছেন।
–এর মধ্যে আবার ওসব কেন? নতুন বাসা, এখনও সব সাজানো-গুছানো হয় নাই।
–মোটামুটি হয়ে গেছে। নেমন্তন্ন মানে কী, দুপুরে খাওয়াটা ওখানে গিয়ে খাবেন।
মামুন বললেন, মঞ্জু, হেনা, তোরা মুন্নির সাথে ভিতরে গিয়ে দেখে আয় সব। আমি আর। যাবো না, আগে তো দেখেছি, আমি গাছের ছায়ায় গিয়ে একটু বসি।
সুখু বললো, চিড়িয়াখানা? আমরা চিড়িয়াখানায় যাবো না?
মামুন তার মাথায় চাঁটি মেরে বললেন, যাবো, যাবো, আগে এটা দেখে নে! এটাও কত সুন্দর।
ফাঁকা জায়গা পেয়ে সুখু এক দৌড় লাগালো। তিন তরুণী আস্তে আস্তে এগোতে লাগলো শ্বেত সৌধের পটভূমিকায়, মামুন সেদিকে একটুক্ষণ মুগ্ধ ভাবে তাকিয়ে থেকে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসলেন।
বোধশক্তিহীন কবিকে দেখে তাঁর মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছিল, হোটেলওয়ালা হোসেন সাহেবকে দেখার পর তাঁর মন অন্যরকম জর্জর বোধ হচ্ছে।
হোসেন সাহেব কট্টর ইসলামী এবং পাকিস্তানের গোঁড়া সমর্থক। হঠাৎ পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে তাঁর এত উৎসাহ জাগলো কেন? মানুষ কি রাতারাতি বদলে যেতে পারে? নাকি এর মধ্যে অন্য কিছু আছে?
এই বিষয়টি নিয়ে অন্তরঙ্গ কয়েকজনের সঙ্গে মাঝে মাঝেই আলোচনা হয়েছে।
পশ্চিম বাংলায় তথা ভারতে এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে, যেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মানুষই পাকিস্তানী শাসনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে, সকলেই স্বাধীনতা চায়। প্রবাসী সরকারকে জোরদার করার জন্য এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি আদায়ের জন্য এরকম একটা প্রচারও চালানো হচ্ছে সঙ্গত কারণেই।কিন্তু মামুনরা তো জানেন, এরকম একটা সর্বাত্মক দেশাত্মবোধ অলীক ব্যাপার। এখনো অনেকেই মনে করে হিন্দু ইন্ডিয়া ইসলামের দুশমন। ইন্ডিয়ার সাহায্য নিয়ে পাকিস্তানকে ভাঙার অর্থ ইন্ডিয়ার ফাঁদেই পা দেওয়া। অনেক মানুষ কি পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে হাত মেলায়নি? অনেকেই কি ভাবছে না যে এই আন্দোলন কিছুদিন পরেই থেমে যাবে, পাকিস্তান যেমন ছিল তেমনই থাকবে?
সীমান্ত পেরিয়ে যারা এদিকে চলে আসছে, তারা সকলেই কি স্বাধীন বাংলার সমর্থক? মাঝে মাঝেই এমন কয়েকজনের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, যারা কিছুদিন আগেই ছিল কট্টর মৌলবাদী, তারা বাঙালী জাতীয়তাবাদকে ইসলামবিরোধী মনে করে। তাছাড়া উগ্র চীনা পন্থীরাও পাকিস্তানী জঙ্গী শাসনের বিরোধিতা করে নি, তারা এদিকে আসছে কেন? হোসেন সাহেবের মতন মানুষ এদেশে এসেও এত টাকা পাচ্ছেন কোথা থেকে? কেউ কেউ কি স্বাধীনতা আন্দোলনে স্যাবোটাজ করার চেষ্টা করবে না? সে সম্ভাবনা মোটেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেউ কেউ নিশ্চয়ই এসেছে সীমান্তে মুক্তিযুদ্ধের খবরাখবর ও কলকাতায় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গোপন ক্রিয়াকর্মের কথা ঢাকায় জানিয়ে দেবার জন্য। ঢাকা বেতারে মাঝে মাঝেই এসব খবর প্রচার করছে, যা শুনলে চমকে যেতে হয়। একটা যুদ্ধ মানেই অনেক ষড়যন্ত্র, চক্রান্ত, গুপ্তচরদের তৎপরতা, বিশ্বসঘাতকতা, এইরকম অনেক কিছু।
রোদ্দুরে ঝকঝক করছে অনেক রকম ফুল। দু’দিকে দুটি সুন্দর বাঁধানো পুষ্করিণী, তাতে টলটল করছে স্বচ্ছ জল। পাশের ঝোঁপটায় ডাকছে কয়েকটা বুলবুলি পাখি, একটু দূরে এক ঝাঁক শালিক। মেমোরিয়ালের উঁচু গম্বুজের চুড়ায় ডানা-মেলা কৃষ্ণপরীর ওপর দিয়ে উড়ে গেল এক ঝাঁক টিয়া পাখি।
চতুর্দিকে এতসব সুন্দর, এর মাঝখানে বসে মামুন ভেবে যাচ্ছেন যুদ্ধ, ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার কথা? এক সময় যিনি কবিতা লিখতেন, তাঁর মনে একটুও কবিত্ব জাগছে না। মামুন নিজেই নিজেকে ভর্ৎসনা করলেন। এই পারিপার্শ্বিকের মধ্যে জীবন কত শান্ত, নিরুদ্বেগ। জোড়ায় জোড়ায় তরুণী ঘুরে বেড়াচ্ছে মাঠে, কেউ কেউ বসেছে ঘাসের ওপর। দূরে দ্রুত, চলন্ত গাড়ির শাঁ শাঁ শব্দ, বড় বড় রেনট্রি ও কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ওপর দিয়ে হিল্লোলিত হচ্ছে বাতাস।
একগুচ্ছ রক্তিম রঙ্গন ফুলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মামুন। একটা বড় আকারের ভোমরা সেখানে ঘুরে ঘুরে উড়ছে বোঁ বোঁ শব্দ করে। এত ব্যস্ত ও হুড়োহুড়িময় কলকাতা শহরের মধ্যেও এই জায়গাটা এমন নিস্তব্ধ যে পাখির ডাক, ভোমরার ডানার শব্দ স্পষ্ট শোনা যায়।
সেই ফুলের গুচ্ছের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকেও মামুনের মনে কোনো কবিত্ব জাগলো। না, চোখের সামনে ভেসে উঠলো থকথকে রক্ত। ছাব্বিশে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে তিনি দেখেছিলেন এখানে সেখানে ছড়ানো লাশ, আর কালো রাস্তার ওপর টগবগে তরুণ ছেলেদের রক্তের দাগ।
ভিক্টোরিয়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়া হলো চিড়িয়াখানা। সেখানে বেশীক্ষণ থাকা হলো না , গরমে টেকা যায় না। এর মধ্যে হেনা একবার বমি করে ফেললো। মেয়েটার বমির ধাত আছে। মামুন আরও ভয় পেলেন গরমে সর্দি-গর্মি না হয়ে যায়। কলকাতায় গরম যেন এখন। অনেক বেশী পড়ে। ঢাকায় এত গরম লাগে না মে মাসে। মামুনের যৌবনেও কলকাতা বোধহয় এত তেতে উঠতো না। চিড়িয়াখানার জন্তু-জানোয়ারেরাও এই গরমে ঝিমিয়ে পড়েছে।
সেখান থেকে দু’বার বাস বদলে আসা হলো ঢাকুরিয়ায়। মাত্র সাতদিন আগে বাড়ি বদল করেছেন প্রতাপ, বড় রাস্তা থেকে পাঁচ সাত মিনিট হাঁটা পথে, গলির মধ্যে একটা বাড়ির দোতলায় ছোট ছোট তিনখানা ঘর, আর এক চিলতে বারান্দা। বাড়িটা পশ্চিমমুখা, ভালো করে আলো ঢোকে না। কিছুক্ষণ আগে চিড়িয়াখানায় দেখা খাঁচায়বন্দী বাঘের ছবিটাই মামুনের মনে আসে প্রতাপকে দেখে।
কালীঘাটের বাড়িতে অনেক ঝাট চলছিল বলে মামুনদের সবাইকে এ পর্যন্ত একদিনও নেমন্তন্ন করে খাওয়াতে পারেননি প্রতাপ। বাইরে অনেকবার দেখা হয়েছে, মামুনও কালীঘাটের বাড়ি ঘুরে গেছেন দু’বার। প্রতাপ আজ ছুটি নিয়েছেন। পাজামা ও গেঞ্জি পরে দাঁড়িয়েছিলেন বারান্দায়, ওদের দেখে নিচে নেমে এসে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত দেরি হলো তোমাদের? মুন্নি, তুই রাস্তা ভুল করেছিলি নাকি?
মামুন বললেন, না, না, মুন্নিমা আমাদের খুব ভালো করে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, আমরাই দেরি করে ফেলেছি।
সরু, অন্ধকার সিঁড়ি। তা দিয়ে উঠতে উঠতে মামুনের মনে পড়লো, মালখানগরে প্রতাপদের কত বিরাট বাড়ি ছিল। প্রতাপের মনটাও ছিল বড়। এখনও তার মন সেইরকমই আছে, কিন্তু সামর্থ্য নেই। প্রতাপের আর্থিক অনটনের কথা মামুনের বুঝে নিতে দেরি হয় নি, তবু প্রতাপ মামুনের সঙ্গে ট্রামে বাসে উঠলে কিছুতে মামুনকে টিকিট কাটতে দেবেন না। মামুনের সিগারেট তিনি কিনে দেবেন, এর মধ্যেই মমতার নাম করে মঞ্জু-হেনা-সুখুকে শাড়ী জামাও দিয়েছেন। প্রতাপকে নিষেধ করেও কোনো লাভ নেই।
প্রতাপ বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের খিদে পেয়েছে, আগে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসে যাও
মামুন বললেন, আগে ছোটরা খেয়ে নিক, তুমি আর আমি পরে বসবো!
তিনতলার ফ্ল্যাট থেকে তিনজন মহিলা এসে উঁকিঝুঁকি মারতে লাগলেন দরজার কাছে। টুনটুনির কাছে তাঁরা আগই শুনেছিলেন যে আজ কয়েকজন জয় বাংলার মানুষ আসবে এ বাড়িতে। জয় বাংলার মানুষ এখন একটা দ্রষ্টব্য বিষয়।
মঞ্জু আর হেনাকে ঘিরে ধরে সেই মহিলারা নানান প্রশ্ন করতে লাগলেন। ওরা দু’জনেই যে পরিষ্কার বাংলা বলতে পারে, এটাই যেন মহা বিস্ময়ের ব্যাপার। পশ্চিম বাংলার সাধারণ মানুষের সঙ্গে পূর্ব বাংলার বাঙালীদের বিচ্ছেদ মাঝখানের কতকগুলি বছরে এমনই গম্ভীর হয়ে গেছে যে, এদিকের মানুষ ওদিক সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানে না। মুসলমান মেয়েরাও স্বাভাবিক বাংলায় কথা বলে, একইভাবে শাড়ী পরে, কপালে টিপ দেয়! তিনতলার মহিলাদের ধারণা ছিল, ঢাকার মেয়েরা বুঝি বোরখা না পরে বাইরে বেরোয় না।
ওঘরের কিছু কিছু কথা ছিটকে আসছে এ ঘরে, মামুন কৌতুক বোধ করছেন। এমনকি মঞ্জু হঠাৎ লাজুক লাজুক গলায় এক সময় দু’লাইন গান গেয়েও শোনালো ওদের।
এক সময় মামুন বললেন, প্রতাপ, তোমার দিদি কোথায়? একদিনও তাঁর সাথে দেখা হলো। না।
মামুন এর আগে যে-দুদিন এসেছিলেন, সুপ্রীতি তখন বাড়িতে ছিলেন না। কানুর স্ত্রী হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, বাড়িতে দুটি অল্পবয়েসী ছেলেমেয়ে, বিপদে পড়ে কানু এসে খুব কাকুতি-মিনতি করেছিল। দিদি, দাদা-বৌদিরাই তো তার নিজের লোক। মমতা দু’দিন গিয়ে দেখে এসেছেন কানুর স্ত্রীকে, সুপ্রীতিকে কয়েকদিন থাকতে হয়েছিল।
সুপ্রীতি অবশ্য এখন ফিরে এসেছেন। তবু প্রতাপ আমতা আমতা করে বললেন, থাক, খাওয়া-দাওয়া সেরে নাও, পরে বিকেলে না হয়–
মামুন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, না, না, আগে দিদির সাথে দেখা করে আসি!
প্রতাপ মামুনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তিনি অস্বস্তি লুকোতে পারছেন না। এরা সবাই আসার পরেও দিদি একবারও ঘর থেকে বেরোননি। সকালবেলাতেই তিনি বলে রেখেছেন। বাড়িতে অতিথি আসবে আসুক, তিনি কোনো ব্যাপারের মধ্যে থাকবেন না!
প্রতাপের মনে পড়লো, দায়ুদকান্দিতে মামুনদের বাড়িতে সেই প্রথম যাওয়ার দিনটির কথা। সেদিন মামুনের মনের ভাব কী হয়েছিল, তা আজ প্রতাপ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। ঘাম জমে যাচ্ছে প্রতাপের কপালে। বন্ধুর মুখের দিকে ভালো করে তাকাতে পারছেন না। তাঁর নিজের বাড়িতে যে কখনো এরকম একটা অবস্থা হবে, তা তিনি স্বপ্নেও ভাবেন না। সুপ্রীতি এক সময় মামুনকে ঠিক নিজের ভাইয়ের মতনই স্নেহ করতেন। কিন্তু তুতুলের ব্যাপারে তিনি। একেবারে অবুঝ হয়ে গেছেন।
প্রতাপ বললেন, শোনো, মামুন, দিদির বয়েস হয়েছে তো, শুচিবাই হয়েছে, পুজো-আচ্চার দিকে মন গেছে। এমন ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক হয়েছে যে স্নান করার পর আমাদেরই ছুঁতে চান।
মামুন হেসে উঠে বললেন, আমি মোছলমান বলে দিদি আমারে ছোঁবেন না? দূর, তাও কী। হয়? দিদিরে আমি চিনি না? দিদির বরানগরের বাসায় গিয়ে কতবার আমি খেয়ে এসেছি।
মামুন ঘর থেকে বেরুতে উদ্যত হতে প্রতাপ তাঁর পিঠে হাত রেখে ধীর স্বরে বললেন, শোনো, মামুন, আরও দু’একটা কথা আছে। দিদির জীবনে অনেক দুভোর্গ গেছে। জানো তো, জামাইবাবু অসময়ে হঠাৎ মারা যান। শ্বশুরবাড়িতে ওরা দিদিকে থাকতে দেয়নি, সম্পত্তির ভাগ দেয় নি, দিদি তবু কারুর কাছে মাথা নীচু করেননি কখনো। বড়লোকের বাড়ির বউ ছিলেন, আমার এখানে এতগুলো বছর কষ্ট করে কাটালেন…।
তুমিও এক সময় বড়লোকের ছেলে ছিলে।
–সে তো প্রায় আগের জন্মের কথা! দিদির একটাই মোটে মেয়ে, ভালো মেয়ে, পড়াশুনায় খুব ভালো, ডাক্তার, দিদির শেষ গয়না বিক্রি করে তাকে বিলেতে পাঠানো হলো, দিদির খুব আশা ছিল, সে ফিরে এলে একটু সুখের মুখ দেখবেন। কিন্তু তাতেও একটা মুশকিল হয়ে গেল–
–সেই মেয়ে ফিরে আসে নাই?
ব্যাপার হলো কী জানো, তুতুল ওখানে গিয়ে একটা মুসলমান ছেলের সঙ্গে ভাব করলো, তাকেই বিয়ে করতে চাইলো। তাতে দিদির ঘোর আপত্তি! চিঠি পেয়েই দিদি একেবারে ক্ষেপে উঠেছিলেন।
মামুন ভুরু কুঁচকে দু’এক মুহূর্ত চুপ করে রইলেন। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, সেই মেয়েরই বা কেন মুসলমান বিয়ে করার জন্য জেদ ধরা? বিধবা মায়ের যদি আপত্তি থাকে… স্বজাতির মধ্যে কি ভালো পাত্র পাওয়া যায় না?।
প্রতাপ বললেন, ঐভাবে তো বলা যায় না। আজকালকার লেখাপড়া জানা মেয়ে, বিলেতে গেছে, তার যদি কারুকে বিশেষ পছন্দ হয়–
–তুমি সে বিয়েতে মত দিয়েছিলে?
–আমি না-ও বলিনি, হা-ও বলিনি!
–আমি হলে আপত্তি জানাতাম। তোমার দিদি সারা জীবন অত কষ্ট পেয়েছেন, তার ওপরে তাঁকে আবার দুঃখ দেওয়া মোটেই উচিত নয়। বয়স্ক লোকদের কিছু কিছু বিশ্বাস, সংস্কারের মূল্য দিতে হয়।
–বিয়েটা এখনও হয় নি। তার ফল আরও খারাপ হয়েছে। মেয়ে বিয়েও করে না, দেশেও ফেরে না। কিছুদিন আগে একবার সে কিছু টাকা পাঠিয়েছিল, দিদি রিফিউজ করে দিয়েছেন!
–ঠিক করেছেন! সেইজন্যই কি দিদির সব মুসলমানদের ওপরেই রাগ? দিদির চোখে আমিও কি মুসলমান? তা হতেই পারে না!
–থাক, মামুন, দিদিকে এখন আর ঘাঁটাবার দরকার নেই। খাওয়ার আগে যদি তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, মঞ্জুরা যদি কিছু শুনে ফেলে
–দিদি আমাকে দূর দূর ছাই ছাই করলেও আমি কিছু মনে করবো না! ঘরের দরজা ভেজিয়ে রেখেছিলেন সুপ্রীতি। প্রতাপ ঠেলা দিয়ে সেই দরজা খুললেন, তাঁর মতন মানুষেরও কথা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল। মামুনদের তিনি আজ খাবার নেমন্তন্ন করেছেন, এই সময় দিদি যদি ওদের কোনো রকম অপমান করেন।
প্রতাপ বললেন, দিদি, মামুন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। মনে আছে তো মামুনকে?
ঘরটা অবছা অন্ধকার। চৌকির ওপর জোড়াসনে বসে আছেন সুপ্রীতি, সাদা থান পরা, চেহারাটা শীর্ণ শালিকের মতন।
মামুন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়তেই সুপ্রীতি তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, থাক থাক, ঐখান থেকে কথা বললো! ঐখান থেকে।
মামুন বললেন, দিদি, আপনাকে প্রণাম করবো না?
সুপ্রীতি বললো, না, প্রণামের কী দরকার?
মামুন বললেন, দিদি আপনার মনে আছে, বরানগরে আপনার শ্বশুরবাড়িতে কতদিন গিয়ে আপনার হাতের রান্না খেয়েছি। অসিতদাদা আমাকে খুব স্নেহ করতেন।
সুপ্রীতি নীরস গলায় বললেন, তোমরা সব সুখে থাকো, ভালো থাকো।
মামুন বললেন, সুখে থাকবো, ভালো থাকবো কী দিদি! আমার বউ আর এক মেয়েকে ওখানে ফেলে আসতে হয়েছে, তাদের জন্য সর্বক্ষণ চিন্তা। আমার সাথে যে ভাগ্নী এসেছে, তার স্বামী আছে ওখানে, তার কোনো খবর পাই না। আবার কবে দেশে ফিরবো তা জানি না, এই অবস্থায় কী ভালো থাকা যায়? আমার মেয়েকে আপনি দেখবেন না? প্রতাপ, হেনা আর মঞ্জুকে একটু ডাকো!
সুপ্রীতি বললেন, থাক, থাক, এখন ডাকার দরকার নেই। বললাম তো, তোমরা সুখে থাকো, বেঁচে বর্তে থাকো, আমার আর কদিন! আমি আছি নেই, তাতেই বা কি আসে। যায়।
–আপনে এরকম ঘরের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকবেন? বাইরে আসেন দিদি!
–আমি এখন ঘুমোবো!
প্রতাপ মামুনের হাত ধরে টানলেন। আর দরকার নেই, দিদি যে রাগারাগি করেননি, সেটাই যথেষ্ট! মামুনকে তিনি বাইরে নিয়ে এলেন।
এ বাড়িতে কোনো খাওয়ার ঘর নেই। মঞ্জু-হেনাদের খেতে দেওয়া হয়েছে মুন্নির ঘরে। তাদের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। প্রতাপ বললেন, বড় খিদে পেয়ে গেছে, মমো আমাদের এই বারান্দাতেই জায়গা করে দাও!
পুরোনো আমলের দুটি পশমের আসন পেতে দেওয়া হলো। আজ তিনি কাঁসার থালা ও গেলাসও বার করেছেন। বারান্দায় জল ছিটিয়ে থালা পাতলেন মমতা। প্রথমে বাটিতে করে মাছ তরকারি সাজিয়ে দিলেন।
আসনে বসে পড়ে মামুন বললেন, পাগলের কাণ্ড, এর কোনো মানে হয়!
তিনরকম মাছ রান্না করা হয়েছে, সেই সঙ্গে মুগীর মাংস। মোচার তরকারি, দু’রকম ডাল, পটল ভাজা, আলু ভাজা। কলকাতায় মাছের কী আগুন দাম তা মামুন জানেন, বড় চিংড়ি মাছ। তো ছোঁয়াই যায় না। প্রতাপ গাদা খানেক টাকা খরচ করেছেন আজ।
মমতা ভাত বেড়ে দিতে এলে মামুন হাত তুলে তাকে বাধা দিয়ে বললেন, বৌঠান, আপনার হাতের রান্না এরপরেও বহুদিন খেতে হবে। আপনি নেমন্তন্ন না করলেও আসবো। কিন্তু আজ দিদি নিজের হাতে পরিবেশন না করলে আমি খাবো না!
প্রতাপ অনুরোধের চোখে মামুনের দিকে তাকালেন। কেন মামুন সব কিছু কঠিন করে তুলছেন আজ!
এত ছোট ফ্ল্যাট যে বারান্দার কথা যে-কোনো ঘর থেকেই শোনা যায়। সুপ্রীতিও নিশ্চয়ই শুনেছেন। মামুন আবার চেঁচিয়ে বললেন, দিদিকে বলো, উনি পরিবেশন না করলে তাঁর ছোটভাই মামুন আজ খাবে না কিছুতেই।
তারপর প্রতাপের দিকে ফিরে তিনি দৃঢ়ভাবে বললেন, সত্যিই আমি খাবো না।
প্রতাপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, মমো, তুমি ডেকে বলবে দিদিকে?
মুন্নি বেরিয়ে এসেছে এর মধ্যে। সে বললো, আমি ডাকছি!
ঘরের দরজা খুলেই সে চেঁচিয়ে বললো, ওমা, পিসিমা আবার ফিট হয়ে গেছেন!
মামুন আর প্রতাপ একসঙ্গে আসন ছেড়ে উঠে এলেন। খাটের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়েছেন সুপ্রীতি, দু’দিকে ছড়ানো হাত দুটো মুঠো করা, পা দুটো ছটফট করছে, মুখ দিয়ে তিনি ই-ই-ই করে একটা শব্দ করছেন।
প্রতাপ বিচলিত হলেন না, তিনি বললেন, মুন্নি, স্মেলিং সল্ট নিয়ে আয়–।