২৩. ক্রিস্টমাস অন দ্য ক্লোজড ওয়ার্ড

২৩. ক্রিস্টমাস অন দ্য ক্লোজড ওয়ার্ড

এই জন্যই কি ডাম্বলডোর আর হ্যারির চোখের পানে তাকাবেন না? কিন্তু কেন? উনি কি ভাবছেন ভোল্ডেমর্ট হ্যারির চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকবেন? উনি কি মনে করেন ভোল্ডেমর্ট তার দুই চোখ হ্যারির দুই চোখের মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে রয়েছে। সেই দুই সবুজ চোখ সহসা লাল হয়ে যাবে, চোখের মণি দুটো বেড়ালের মতো সংকীর্ণ ফাঁকে ঘুর ঘুর করবে? হ্যারির মনে আছে সাপের মুখের মতো ভোল্ডেমর্ট একবার শক্তি প্রয়োগ করে প্রফেসর কুইরেলের মাথা পেছনে রেখে তার হাত দুটো ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। ভাবতে লাগলো, ভোল্ডেমর্ট যদি ওর মাথা চৌচির করে খুলির মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসেন। তা হলে কেমন অনুভব করবে।

আন্ডার গ্রাউন্ড ট্রেনে চেপে হাসপাতাল থেকে ফিরে আসার সময় কিছু নিরীহ, নির্দোষ মানুষজন যাদের মন ও দেহ ভোল্টেমর্টের অন্তর্নিহিত বিকৃতি থেকে মুক্ত, তাদের পাশে বসে কিছু মারাত্মক, নোংরা ছোঁয়াচে রোগের বীজ বহন করে চলেছে এমন এক মনোভাব হ্যারিকে বিচলিত করলো। ও শুধু সেই সাপকে দেখেছে তাই নয়, নিজেই সেই সাপে রূপান্তরিত হয়েছিলো সে কথা তো এখন জেনেছে।

এক অমোঘ অতি ভয়ঙ্কর চিন্তা তারপর ওর মনে উদয় হলো, একটি স্মৃতি মনের উপর ভাসতে থাকে, হঠাৎ মনের অভ্যন্তরে কি যেন মোচড় দিয়ে সাপের মতো কিলবিল করতে থাকে।

কী চান ভোল্ডেমর্ট, তার অনুগামীরাই বা কি চায়?

অস্ত্রের সাহায্যে, চৌর্যবৃত্তি করতে চায় যা গতবারে আয়ত্বে আনতে পারেননি।

হ্যারি চিন্তা করে আমি হচ্ছি অস্ত্র, অনেকটা বিষ যেন আমার শিরার মধ্যে অনর্গল বয়ে চলেছে, শরীরটা বরফের মতো এক হয়ে যাচ্ছে, ঘামের মধ্যে ভাসছে। ট্রেন চলছে অন্ধকার এক সুরঙ্গের মধ্যে দিয়ে। আমি একমাত্র লোক ভোল্ডেমর্ট যাকে ব্যবহার করার অনবরত চেষ্টা করে চলেছে, তাইতো আমি যেখানে যাই ওরা আমায় প্রহরী দিয়ে ঘিরে রাখে। কিন্তু আমাকে রক্ষার জন্য নয়, নিজেদের কাজে ব্যবহারের জন্য। ওরা তো সব সময় আমার সুরক্ষার জন্য হোগার্টসে কাউকে রাখতে পারে না।

আমাকে দিয়ে গতরাতে মি. উইসলিকে আক্রমণ করানো হয়েছিলো। ভোল্ডেমর্ট আমাকে তার আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন। এখন যদি তিনি আমার ভেতরে আসেন তাহলে আমার ভাবনা বুঝতে পারবেন।

মিসেস উইসলি খুব আস্তে বললেন–হ্যারি তোমার শরীর ভাল আছে তো? জিনিকে ডিঙ্গিয়ে ওকে বললেন। ট্রেনটা দূরন্ত গতিতে অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে চলেছে। মিসেসের গলা শুনে মনে হয় তিনি খুবই চিন্তিত। গ্রিমন্ড প্লেসের সবুজ ঘাসের মাঝ দিয়ে চলতে চলতে বললেন, তোমাকে দেখে খুব ফ্যাকাশে লাগছে, সকালের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলো তো? যাও তোমার ঘরে গিয়ে কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও, ডিনারের সময় তোমার ঘুম ভাঙিয়ে দেবো।

ও রাজি হয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে রনের ঘরে নিজের খাটে শুয়ে পড়লো। ও রন আর বিছানার মাঝ খানে ফিনিয়েস নিগেলাসের শূন্য ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে নাকানি চোবানি খেতে লাগলো। ওর মাথার ভেতরটা নানা প্রশ্নে আর মারাত্মক ভাবনায় জর্জরিত হতে লাগলো।

ও কেমন করে সাপে পরিণত হলো? তাহলে ও কি অ্যানিমেগাস? না না না ও কেন অ্যানিমেগাস হবে, সম্ভবত ভোল্ডেমর্ট অ্যানিমেগাস। হ্যাঁ হতে পারে, অবশ্যই নিজেকে সাপে পরিণত করতে পারেন। তারপর আমাকে আয়ত্ত্বে আনতে পারলে দুজনেই সাপে পরিণত হবে। কিছুতেই ওর মাথায় ঢুকছে না পাঁচ মিনিটের মধ্যে লন্ডনে গিয়ে, তারপর ফিরে এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়বে কি করে। পৃথিবীর মধ্যে বর্তমানে ও সবচেয়ে শক্তিশালী জাদুকর। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হ্যারি চললো।

ভাবতে ভাবতে হকচকিয়ে উঠলো, কি সব ভেবে হয়রান হচ্ছে? পাগলের মতো চিন্তা–যদি ভোল্ডেমর্ট আমাকে কবলে আনতে পারেন তাহলে আমি তাকে অর্ডার অফ ফনিক্সের হেডকোয়ার্টার সম্পর্কে সবকিছু জানিয়ে দিতে পারবো, এখনই একটুও দেরি না করে। উনি জানতে পারবেন অর্ডারের সর্বময় কর্তাকে? তার সবকিছু। সিরিয়স এখন কোথায়। আমি জানি সেখানে অনেকে কাজ করছে কিন্তু আমি তা কিছুতেই করবো না। প্রথম যখন হেডকোয়ার্টারে আমাকে ডার্সলিদের কাছ থেকে নিয়ে আসা হয়েছিলো সেদিন রাতে সিরিয়স আমাকে অর্ডার সম্বন্ধে সব বলেছেন।

এখন একটি মাত্র উপায় আছে গ্রিমন্ড প্লেস থেকে সোজা চম্পট দেওয়া। ডাম্বলডোর হোগার্টসে ক্রিস্টমাস একাই পালন করবেন। অন্যরা যে যার বাড়িতে চলে গেলে তারা ছুটির দিনগুলো নিরাপদে কাটাতে পারবে। না, তা হবে না। এখনও অনেক লোক হোগার্টসে রয়ে গেছে তাদের যে কোনও মুহূর্তে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। পরের বার সিমাস, নেভিল অথবা ডিনেরও ওর মতো অবস্থা হতে পারে, বা হলে? ও হাঁটা বন্ধ করে ফিনিয়েস নিগেলাসের শূন্য ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর পেটের মধ্যে সুপ্ত বেদনা ও পাকস্থলীর মাঝখানে জমাট হয়ে গেছে। আর কোনও বিকল্প নেই, সব জাদুকরদের ছেড়ে প্রাইভেট ড্রাইভে চলে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনও গতি নেই।

তাই যদি হয় তাহলে এখানে থাকার কোনও মানে হয় না। ডার্সলিরা ছমাস আগে ওকে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কেমন রূপ নেবে কে জানে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে হ্যারি ওর ট্রাঙ্কের ডালাটা সজোরে বন্ধ করে দিয়ে হেডউইগের খোঁজ করলো। কিন্তু হেডউইগ এখন তো হোগার্টসে আছে। ভালই হয়েছে প্রাইভেট ড্রাইভে যাবার সময় ওর খাঁচাটা বয়ে নিয়ে যেতে হবে না। ও ট্রাঙ্কের একটা কোণা ধরে হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে দরজার গোড়ায় নিয়ে গেলো। কে যেন তখন খন খনে গলায় বলে উঠলো ওহো পালিয়ে যাচ্ছে, সত্যি যাচ্ছো?

ও এধার ওধার তাকালো। দেখলো ফিনিয়েস নিগেলাস তার ফ্রেমের ক্যানভাসে ফিরে এসেছে। ফ্রেম থেকে মাথাটা বাড়িয়ে মজামজা মুখ করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে হাসছে।

ট্রাঙ্কটা ঘরের মধ্যে টানতে টানতে হ্যারি বললো, কই পালিয়ে তো যাচ্ছিনে।

ফিনিয়ে দাঁড়িয়ে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, তাই তো আমি ভাবছিলাম, গ্রিফিন্ডর হাউজের ছেলেরা তো সাহসী হয় গো? তোমাকে দেখে মনে হয়েছিলো আমার বাড়িতে তুমি বেশ সুখেই থাকবে। বুঝলে আমরা স্নিদারিরা সাহসী, ভীতু নই, বোকাও নই। এই ধরোনা সে রকম কিছু হলে আমরা আমাদের মাথা নোয়াবো না, পালিয়ে যাবো না।

হ্যারি চাঁছাছোলাভাবে বললো, ভুল করছেন, আমি আমার মাথা বাঁচাচ্ছি না নোয়াচ্ছি না। কথাটা বলে ঘরের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে দরজার কাছে মেঝের এবড়ো থেবড়ো কার্পেটের ওপর ট্রাঙ্কটা রাখলো।

–ওহ তাই নাকি? দাড়িতে টোকা মারতে মারতে ফিনিয়েস বললেন, তাহলে ভীতুর মতো পলায়ন নয়, তুমি খুবই সাহসী।

হ্যারি ফিনিয়েসকে কোনও রকম পাত্তা দিতে চাইলো না। দরজার নবে হাত দিতে যাবে ঠিক সেই সময় আবার ফিনিয়েস আড়াআড়ো ছাড়াছাড়া ভাবে বললেন, আলবাস ডাম্বলডোরের কাছ থেকে তোমার একটা খবর নিয়ে এসেছি গো, শুনবে?

হ্যারি ঝট করে ঘুরে দাঁড়ালো।

–কী খবর?

 –তাহলে তুমি যেখানে আছ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকো চুপটি করে।

হ্যারি দরজার নব থেকে ঝট করে হাত সরিয়ে নিয়ে বললো, কই আমিতো দাঁড়িয়ে আছি পালাইনি তো। তো খবরটা কি শুনি?

ফিনিয়েস নিগেলাস গড় গড় করে বললেন, বাঃ বোকামশাই বলছি তো, ডাম্বলডোর বলে পাঠিয়েছেন, যেখানে আছ সেখানেই তুমি থাকো।

হ্যারি ট্রাঙ্ক থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে উৎসুক হয়ে বললো, কেন?

হ্যারিকে অধৈর্য দেখে ফিনিয়েস তার একটা ভুরু তুলে বললেন, সেরকম কিছু নয়। তিনি বলেছেন, তাই বললাম।

হ্যারির মেজাজ সাপ যেমন লম্বা ঘাসের ওপোর শুয়ে ছটফট করে তেমনভাবে ছটফট করে উঠল। ও দারুণ ক্লান্ত, মনে সীমাহীন বিভ্রান্তি। ওর ভয়ঙ্কর প্রাণীর ও ব্যক্তির আতঙ্কের অভিজ্ঞতা আছে তারপর গত বারো ঘণ্টার মধ্যে আবার আতঙ্ক, তারপরও ডাম্বলডোর ওর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন না।

ও খুব জোরে জোরে বললো–ও তাই? যেখানে আছি সেখানে থাকতে হবে? ডিমন্টরদের আক্রমণের পর এমন কথা যে কেউ অনায়াসে বলতে পারে।

–বড় হয়েছ এখন নিজের সমস্যা যেখানে আছে সেখানে বসে সামলাও হ্যারি! আমরা তোমাকে কিছু বলতে চাই না বুঝলে? তোমার খোপড়ির মধ্যের ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক ঠিক বুঝে উঠতে পারবে না।

ফিনিয়েস নিগেলাস ওর চেয়ে গলা চড়িয়ে বললেন, বুঝলে, এইজন্যই আমি শিক্ষক হতে চাইনি বুঝলে? তোমার হেড মাস্টারের কোনও বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে এমন কথা বলতেন না। তাছাড়া হোগার্টসের হেডমাস্টারতো সব প্ল্যানের প্রতিটি ডিটেল তোমাকে জানাতে নাও পারেন। আজ পর্যন্ত কি ডাম্বলডোরের আদেশ প্রতিপালন করে তোমার কোনও ক্ষতি হয়েছে? তুমি দেখি আর সব ইয়ং ছেলে–মেয়েদের মতে, যা ভাব, চিন্তা করো–একাই অনুভব করো, একাই বিপদের মুখে দাঁড়াও। ভাবো তোমরা খুব চালাক, বাকি সবাই বোকা। ডার্কলর্ড কী প্ল্যান করছে সেটা একাই তুমি বুঝতে পারছে।

–আমাকে নিয়ে কিছু একটা প্ল্যান করছেন, তাতে কি হলো? হ্যারি একটুও দেরি না করে বললো।

–আমি কি তাই বলেছি? নিজের হাতে সিল্কের দস্তনা দেখতে দেখতে ফিনিয়েস নিগেলাস বললেন–এখন আমাকে ক্ষমা করো, আমার অনেক দরকারি কাজ আছে, বাচ্চা ছেলের মানসিক যন্ত্রণাদায়ক কথা শোনার আমার সময় নেই। চললাম।  

ফিনিয়েস তার ফ্রেমের বাইরে এসে উধাও হয়ে গেলেন।

হ্যারি শূন্য ফ্রেমের দিকে তাকিয়ে বললো, বেশতো দরকারি কাজ করতে যাও, কে তোমায় বাধা দিয়েছে। হা ডাম্বলডোরকে বলবেন, বিনা কারণে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছি।

হ্যারি খানিকক্ষণ শূন্য ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে থেকে ওর ট্রাঙ্কটা বিছানার পায়ের কাছে রেখে দিয়ে পোকায় কাটা বিছানায় উবুর হয়ে মুখে বালিশ চেপে শুয়ে রইলো।

হ্যারির অবসন্ন মন, ক্লান্ত দেহ। মনে হলো ও মাইলের পর মাইল হেঁটে এই মাত্র ফিরেছে। ভাবতে অদ্ভুত লাগছে, মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে চো, ওর সঙ্গে একটা মাইলস্টোনের নিচে কথা বলেছে। ও বড়ো ক্লান্ত, দুচোখ ঘুমে বন্ধ হয়ে এলেও ঘুমোতে ভয় পাচ্ছে। আর কতকাল ওকে এই অবস্থার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকতে হবে? ডাম্বলডোর ওকে এখানে থাকার নির্দেশ পাঠিয়েছেন। তার মানে ওকে ঘুমোবার অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু ও যে ঘুমোতে ভয় পাচ্ছে, আবার যদি গতকালেল মতো ঘটনা ঘটে; ভয়াল স্বপ্ন দেখে।

ও ছায়াতে তলিয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেন একটা ফিলমের রিল মাথায় রয়েছে সেটা শুরু হবার অপেক্ষায়। ও একটা নির্জন করিডোর দিয়ে একাই হেঁটে চলেছে। দুধারে অমসৃণ পাথরের দেওয়াল, সেখানে মশাল জ্বলছে, যেখান থেকে বা ধারে করিডোরের শেষ প্রান্তে নিচে যাবার একটা সিঁড়ি–সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা করিড়োর, তার শেষ প্রান্তে বড় একটা কালো দরজা। সেটা বন্ধ।

ও সেই কালো দরজার সামনে দাঁড়ালো। বন্ধ দরজা ধাক্কা দিয়েও খোলা গেলো না। ভেতরে যাবার জন্য উদগ্রীব হয়ে দরজার দিকে ও তাকিয়ে রইলো। ও মনের ভেতর থেকে একটা কিছু চাইছে, স্বপ্নের বাইরে একটা পুরস্কার। কপালের কাটা দাগে দারুণ চুলকানি ও ব্যথা বেদনা কমলে ও কি চায় তা ভালোভাবে ভাবতে পারে।

–হ্যারি, বহুদূর… বহুদূর থেকে যেন রনের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলো, মা বলছেন ডিনার রেডি।

হ্যারি তাকালো, দেখলো রন ঘরে নেই। রন চলে গেছে ডিনার খেতে।

ও নিজে থেকে আমার সঙ্গে কথা কইতে চাইছে না। হ্যারি ভাবলো মুডি কি বলেছেন ও শোনেনি।

অনেক ভেবে ভেবে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছল। ওকে আর কেউ চায় না। এখন ওরা সবাই বুঝতে পেরেছে ওর মনের ভেতরে কি রয়েছে।

না, ও নিচে ডিনার খেতে যাবে না; ওদের সঙ্গে ও মিশবে না। ও পাশ ফিরে শুলো, সামান্যক্ষণ পরে আবার ঘুমিয়ে পড়লো। ওর পাশের বেডে রন নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। ঘরের এধার ওধার তাকাতে ও দেখলো ফিনিয়েস নিগেলাস কখন এসে পোর্ট্রেটের ভেতর দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ওর মনে হলো, ডাম্বলডোর সম্ভবত: ওকে দেখাশোনা করার জন্য এখানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। যদি কেউ তাকে আক্রমণ করে তাহলে ও হ্যারিকে বাঁচাবে।

ওর অপরাধ প্রবণ মনের ভাবটা যেন বেড়েই চলেছে। ওর একটু একটু মনে হলো ডাম্বলডোরের আদেশ অমান্য করা ঠিক হবে না। মিন্ড প্লেসে থাকলে ওকে এখন থেকে এই রকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকতে হবে, প্রাইভেট ড্রাইভে গেলে হয়তো ও এখানের চেয়ে ভাল থাকবে।

***

ভোর থেকে হ্যারি শুনতে পাচ্ছে গ্রিমন্ড প্যালেসে যারা রয়েছেন তাদের হৈ চৈ। তারা ক্রিস্টমাস উপলক্ষে ঘর বাড়ি সাজাচ্ছে। মাঝে মাঝে ও ঠাণ্ডা ড্রইং রুমে বসে গডফাদার সিরিয়সের হৈ চৈ, জোরে জোরে ক্যারল, কথোপোকথন শুনতে পাচ্ছে। আগে কখনও সিরিয়সকে এতো বেশি উৎসাহী দেখেনি। হ্যারি সেদিক থেকে মনটাকে সরিয়ে নিয়ে খোলা জানালা দিয়ে ধূসর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিসেস উইসলি ওকে লাঞ্চ খাবার জন্য বেশ কয়েকবার ডেকেছেন ও সাড়া না দিয়ে যেমন বসেছিলো তেমনভাবে বসে রইলো। ঘণ্টা বাজা থামার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় মিসেস ব্ল্যাক চিৎকার করে চলেছেন। ও ভাবলো, খুব সম্ভব মুন্ডানগাস অথবা অন্য কেউ দরজা ধাক্কাচ্ছে। দুম দুম করে ধাক্কা দেবার শব্দ! হ্যারির ক্ষিধেতে পেট জ্বলে যাচ্ছে যেমনভাবে বসেছিলো তেমনিভাবে বসে রইলো।

–আমি জানি তুমি ভেতরে আছো, হারমিওন বাইরে থেকে বললো, দয়া করে বাইরে আসবে, তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

হ্যারি বাকবিকের দিকে তাকালো। সমস্ত ঘরটাতে ও গা আঁচড়ে, আঁচড়ে পালকে ভর্তি করে ফেলেছে। কোনও ইঁদুরের আশায় ওঁত পেতে বসে রয়েছে বাকবিক।

হ্যারি দরজাটা খুলতে খুলতে বললো, হঠাৎ তুমি এখানে কেন? তুমিতো তোমার মা-বাবার স্কিইং করবে বলে বাড়ি গিয়েছিলে?

হারমিওন বললো–শুনবে? স্কিইং করা আমার সম্ভব নয়, তাই এখানে ক্রিসমাসের ছুটি কাটাতে চলে এলাম। হ্যারি দেখলো হারমিওনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্নোতে চুপচুপ করছে, ঠাণ্ডায় লাল ঠোঁট বেগুনে হয়ে গেছে। দারুণ শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে।

হারমিওন বললো–কেন চলে এসেছি রনকে বলার দরকার নেই। মাকে বলেছি, হোগার্টসে না গেলে পড়াশুনো হবে না। পরীক্ষার জন্যে সব ছেলে-মেয়েরা এখন ওখানে রয়েছে। ওরা, আমি যাতে ভাল রেজাল্ট করি তার জন্য চলে আসতে বললেন। তবে মা-বাবার মন খুব খারাপ। যাকগে ওসব কথা, চলো তোমার ঘরে যাওয়া যাক। মিসেস উইসলি আমাদের জন্য গরম গরম স্যান্ডউইচ পাঠাচ্ছেন।

হ্যারি হারমিওনের সঙ্গে রনের ঘরে চললো (ওখানে ওর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে) ঘরে ঢুকে জিনি আর রনকে দেখে অবাক হয়ে গেলা। রন আর জিনি, রনের খাটে বসেছিলো।

হ্যারি কিছু বলার আগেই হারমিওন গায়ের জ্যাকেটটা খুলে ফেলে বললো, আমি নাইট বাসে এসেছি। স্কুলে গেলে ডাম্বলডোর সব বলেছেন আমাকে। তবে এখানে আসার আগে অফিসিয়াল টার্ম শেষ হবার জন্য স্কুলে ছিলাম। আমব্রিজের নাকের ডগা দিয়ে তোমরা স্কুল ছেড়ে এখানে এসেছো জেনে দারুণ চটেছেন। ডাম্বলডোর বলেছেন, মি. উইসলি অসুস্থ হয়ে সেন্ট মাংগোস হাসপাতালে আছেন তাই তোমরা সব চলে এসেছে।

হারমিওন জিনির পাশে বসে হ্যারির দিকে তাকিয়ে রইলো।

–তারপর, তোমরা সবাই কেমন আছো?

হ্যারি বললো–ভালই।

কথাটা শুনে হারমিওন বললো–স্রেফ বাজে কথা বললে। রন–জিনি বলছিলো সেন্ট মাংগোস থেকে ফিরে এসে তুমি কারও সঙ্গে কথা না বলে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে বসে আছ?

–বলতে দাও, বলতে দাও, কথাটা বলে হ্যারি রন আর জিনির দিকে তাকালো। রন মুখ নামিয়ে আর জিনি গম্ভীর হয়ে বসে রইলো।

–বাজে কথা বলবে না, যা বললাম, খাঁটি কথা।

হ্যারি রেগে গিয়ে বললো, আমি নই, ওরা আমার সঙ্গে কেউ কথা বলছে না।

–হতে পারে, হতে পারে, হারমিওন মৃদু হেসে বললো।

হ্যরি বললো–হতে পারে? বাঃ… না জেনে খুব চমঙ্কার কথা বললে। বাঃ বেশ মজা তো, হ্যারি বললো।

–এই তোমরা ঝগড়া থামাও। তুমি নাকি ওদের সেই আড়িপাতা যন্ত্রের কথা শোনার পর গুম হয়ে গেছে।

 হ্যারি জানালার বাইরে প্রচুর পরিমাণে স্লো পড়ছে দেখে বললো, তাই নাকি? সকলেই দেখি আমাকে নিয়ে কথা বলছে, তা তুমিই বা বাদ যাবে কেন? শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে হারমিওন।

জিনি বললো, হ্যারি তুমি ভুল বুঝেছে, আমরা নয়, তুমিই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে কারও সঙ্গে কথা বলছে না।

–আমি চাই না কারও সঙ্গে কথা বলতে, হ্যারি একটুও মনের ভাব না বদলে বললো।

জিনি রেগে গিয়ে বললো–বোকা কোথাকার। অদ্ভুত ছেলে তুমি, তুমি যদি জানতে ইউ-নো-হু আমাকে গ্রাস করেছে, তাহলে কি একলা ফেলে তোমরা সবাই মজা করতে?

হ্যারি চুপ করে রইলো মনে হলো জিনি খাঁটি কথা বলেছে।

হ্যারি দুঃখিত স্বরে বললো, আমার মনে ছিলো না।

জিনি তাপ উত্তাপ না দেখিয়ে বললো, ভাগ্য ভালো।

–সত্যি আমি দুঃখিত। তোমাদের কি মনে হয় ইউ-নো-ই আমাকে গ্রাস করে রেখিছিলেন? হ্যারি বললো।

জিনি বললো–সারাদিন যা করছে, বলছো, সবই কী তোমার মনে থাকে না মনে রাখতে পারো? কিছুটা তো ফাঁক থাকেই।

হ্যারি মাথা চুলকোলো।

–ইউ-নো-হু একমাত্র তোমাকে গ্রাস করেনি, জিনি বললো–আমাকে কখন যে করেছিলো বলতে পারি না। আমার মনে নেই, আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা কি করে চলেছি। হঠাৎ আমি দেখলাম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ সেই জায়গায় কেমন করে এসেছি–তাও জানি না।

হ্যারি ওর কথা বিশ্বাস করতে পারেনা। হতেও পারে, নাও হতে পারে। ওর বুকের ভেতরটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।

–সেই বীভৎস্য স্বপ্ন, সাপ আর তোমার বাবাকে নিয়ে…।

হারমিওন বললো–ওই রকম স্বপ্নতো তুমি আগেও দেখেছো হ্যারি। গত বছর তো ভোল্টেমর্টের কেরামতি দেখেছিলে।

–এই স্বপ্নটা সম্পূর্ণ আলাদা, হ্যারি মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, আমি সাপের মধ্যে ছিলাম, সাপ আমাকে গ্রাস করেছিলো। ঠিক আমি যেনো সাপে রূপান্ত রিত হয়েছিলাম। ভোল্ডেমর্ট যদি আমায় সেই অবস্থায় লন্ডনে স্থানান্তরিত করতো।

–হারমিওন বললো–তুমি একদিন হোগার্টস অ্যা হিস্ট্রি পড়বে। তখন তোমায় মনে করিয়ে দেবে যে অ্যাপারেট অথবা ডিসঅ্যাপারেট হোগার্টসে করতে পারতো না। এমন কি ভোল্ডেমর্টও তোমাকে তোমার ডরমেটরি থেকে সরিয়ে আনতে পারতো না হ্যারি।

রন বললো–বন্ধু তুমি একবারও বিছানা ছেড়ে ওঠেনি। তোমাকে জাগিয়ে দেবার আগ পর্যন্ত তুমি বিছানায় শুয়ে কাত্রাচ্ছিলে।

হ্যারি ঘরময় পায়চারি করতে লাগলো। ভাবলো, ওরা যা যা বলছে সবই সুন্দর শুধু নয়, আজেবাজে কথাও নয়। ও প্লেট থেকে কয়েকটা স্যান্ডউইচ তুলে নিয়ে গোগ্রাসে খেতে লাগলো।

খেতে খেতে ওর শরীর মন অনেক হালকা হয়ে গেলো। নিজেকে আর অন্যের হাতের অস্ত্র মনে হলো না। ও ছুটে গিয়ে সিরিয়সের সঙ্গে গলা মিশিয়ে ক্যারল গাইতে চাইলো। সিরিয়স মনের আনন্দে গাইছেন গাইছেন গড রেস্ট ইয়ে, মেরি হিপোগ্রিফস।

***

হ্যারি এখন ভাবতেই পারছে না কেমন করে ও প্রাইভেট ড্রাইভে চলে যাবার কথা মাথায় এনেছিলো। সিরিয়স সারা বাড়িটায় আনন্দের তুফান বইয়ে দিয়েছেন। হ্যারি সিরিয়সের সঙ্গে গলা মিলিয়ে গান করতে লাগলো। সকলের সঙ্গে ঘর-বাড়ি সাজাতে লাগলো। ঝাড়ু পোছ সব কিছু। সারা বাড়িতে এক কণা ধূলোবালি, ঝুল, মাকড়সার জাল রাখতে দেবে না।

হ্যারি ক্রিসমাসের সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলো পায়ের তলায় ক্রিস্টমাস গিফট-এর প্যাকেট পড়ে রয়েছে। দেখলো রন ওর গিফট প্যাকেট খুলছে। ওর প্যাকেটটা বেশ বড়।

একগাদা কাগজ জড়ো করতে করতে রন বললো, বাঃ এবার দেখছি বেশ বড় প্যাকেট। ব্রুম কমপাস দেওয়াতে ধন্যবাদ। দারুণ, হারমিওন যা দিয়েছে তার থেকে অনেক ভাল। ও দিয়েছে হোমওয়ার্ক প্লনার।

হারমিওনের হাতে লেখা প্যাকেটটা হ্যারি খুললো। ও উপহার দিয়েছে একটা ডায়রির মত বই। তার প্রতিটি পাতায় লেখা, আজই কাজ শেষ করো, ফেলে রাখলে পস্তাবে।

সিরিয়স আর লুপিন ওকে দিয়েছেন প্র্যাকটিক্যাল ডিফেনসিভ ম্যাজিক অ্যান্ড ইটস ইউজ এগেনস্ট দ্য ডার্ক আর্টস। অনবদ্য বই সন্দেহ নেই।

হ্যারি বইটার পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে ভাবলো, ওর ডিএ সংগঠনের ব্যাপারে বইটা খুব উপকারে লাগবে।

হ্যাগ্রিড পাঠিয়েছেন একটা বাদামী রং-এর ওয়ালেট, তার গায়ে দাঁত বসানো, সম্ভবত চোরেদের হাত থেকে বাঁচার সম্ভাবনা! হ্যারির মনে হলো ওয়ালেটের ভেতর অর্থ টর্থ রাখতে গেলে হাত কেটে যাবে। টোংক দিয়েছেন একটা ফায়ার বোল্ট, ওটা ঘরময় উড়তে পারে। সঙ্গে লিখেছেন বড় প্লেনে চাপার অপেক্ষায় রইলাম। রন দিয়েছে এক বাক্স এভার ফ্লেভার বিনস! মি. অ্যান্ড মিসেস উইসলি প্রতিবার যা দেন তাই, জাম্পার। ডব্বি দিয়েছে মস্তবড় একটা পেইন্টিং। সম্ভবত: এলফরা সমবেতভাবে ছবিটা এঁকেছে।

ঠিক সময় শুনতে পেলো খুব জোরে জোরে শব্দ ক্ল্যাক।

জর্জ বললো, মেরি ক্রিস্টমাস, তুমি নিচে যাবে না?

রন বললো, কেন যাবো না?

পার্সি মার তৈরি ক্রিস্টমাস জাম্পার ফেরত দেওয়াতে মা খুব কাঁদছেন।

–তাই নাকি ফেরত দিয়েছে? কিন্তু এখনও তো একবার ও বাবাকে দেখতে যায়নি শুধু তাই নয়, কেমন আছেন একবার জানতেও চায়নি।

ফ্রেড বললো, আমরা মাকে অনেক সান্ত্বনা দিয়েছি, মা তবু কান্না থামাচ্ছেন। মাকে বলেছি, ও একটা সমাজের জঞ্জাল, মরা ইঁদুর ফেলার বিন।

–শুনছেন না, চকোলেট ফ্রগ খেতে খেতে বললল, লুপিন এখন কান্না থামানোর ভার নিয়েছেন।

ডব্বির পাঠানো ছবিটা দেখতে দেখতে ফ্রেড বললো, ছবিটার মাথামুণ্ড বোঝার উপায় নেই। মনে হয় বড় বড় হাতওয়ালা একটা উল্লক, আর তার দুটো চোখ!

ঘুরতে ঘুরতে হারমিওনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। হারমিওন বললো, তোমার উপহার নিউ থিয়োরি অফ নিমাবোলজি ফর এজেসর জন্য অশেষ ধন্যবাদ। সত্যি রন, বইটা সত্যি ভিন্ন রকমের।

হারমিওনের হাতে একটা প্যাকেট দেখে রন বললো–ওটা কে দিয়েছে তোমাকে?

–ক্রেচার, হারমিওন হাসতে হাসতে বললো।

–জামা-কাপড় নয় তো?

–হতেও পারে, হারমিওন বললো–আমি ওকে একটা লেপ দেবো ভাবছি। লেপটা ওর বেডরুমে বেশ মানাবে। বেচারির একটাও ভাল জামাকাপড় নেই। ছেঁড়া ছেঁড়া সব পরে।

–বেডরুম? ত্যরি বললো–কেমনতর বেডরুম?

সিরিয়স বলেন, ওই একরকম বেডরুম বলতে পারো। কাবার্ডের নিচে এক বয়লারের পাশে ঘুমায়।

রন প্যানট্রির পাশে ছোট্ট একটা নড়বড়ে কাঠের দরজা ঢাকা জায়গা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো–তাহলে ওটাকেও বেডরুম বলতে পারো।

আসলে এলফ ক্রেচারের ঘর বলতে কিছু নেই। যখন যেখানে সুবিধে হয় শুয়ে পড়ে।

যে ঘরে পুরনো জিনিসপত্র ঠাসা থাকে সেখানেও ক্রেচার ওর সম্পত্তি রাখে।

মিসেস উইসলি ওদের দেখে বললেন–মেরি ক্রিস্টমাস।

ওরা কেউ তার চোখের দিকে তাকালো না।

 হারমিওন ক্রেচারের প্যান্ট্রির পাশে ঘর দেখিয়ে বললো–ওটা ওর বেডরুম।

হারমিওন বড় দেখে একটা প্যাকেট ক্রেচারের তথাকথিত বেডরুমের দরজা খুলে সেটা রেখে বললো–যখন আসবে দেখতে পাবে। পুরনো জিনিসগুলো ফেলে দিলে ভাল হয়।

সিরিয়স হাতে একটা বড় আকারের টার্কি নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। টার্কিটা কাবার্ডে রাখতে রাখতে বললেন–তোমরা কেউ ক্রেচারকে দেখেছো?

 হ্যারি বললো–আমি তো এখানে আসার পর ওকে দেখিনি। আপনিতো ওকে কিচেনের বাইরে যেতে বলছেন, শুনেছিলাম।

সিরিয়স ভুরু কোঁচকালেন, যা বলেছিলাম তো… তার মানে এই নয় যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলাম। মনে হয় ওপরের ঘরে কোথায় লুকিয়ে আছে।

–চলে যাবে না তা জানি। নতুন জামা-কাপড় দিয়ে কাজ ছাড়াতে হয়। ম্যালফয়দের বাড়ি ছাড়বার সময় ডব্বিকে দিতে হয়েছিলো।

 সিরিয়স খুব সম্ভব ক্রেচারের কথা ভাবছিলেন। বললেন, আচ্ছা দেখছি কোথায় আছে। খুব সম্ভব আমার মায়ের পুরনো জামা-কাপড় বা ওইরকম কিছুর সামনে বসে কাদছে, দেখি কি করছে।

ফ্রেড, জর্জ, রন হেসে উঠলে হারমিওন রাগত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকালো।

লাঞ্চ খাবার পর হ্যারি-হারমিওন ঠিক করলো মি. উইসলি কেমন আছেন, দেখতে হাসপাতালে যাবো। সঙ্গে ম্যাড আই আর লুপিন যাবেন। মুন্ডানগাস বিরাট ক্রিস্টমাস কেক পুডিং ট্রিফল সঙ্গে এনেছে। একটা গাড়ি ও যোগাড় করেছে কারণ ক্রিসমাসে পাতাল রেল বন্ধ থাকে। হ্যারির মনে হলো মুন্ডানগাস খুব সম্ভব গাড়ির মালিকের সম্মতি ছাড়াই গাড়িটা এনেছে। স্পেল করে গাড়িটা বড় করেছে, অনেকটা উইসলির ওল্ডফোর্ড অ্যাংগলিয়ার মতন।

হ্যারি জানে মিসেস উইসলি গাড়িতে চাপতে ইতস্তত করছিলেন কেন।

মুন্ডানগাস জানে মিসেস উইসলি ওর আনা গাড়ি কেন পছন্দ করেন না। বাইরে ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে থাকা যায় না তাই সকলে মুন্ডনগাসের আনা গাড়িতে বসলেন।

সেন্ট মাংগোস হাসপাতাল ক্রিস্টমাস উপলক্ষে খুব ভালোভাবে সাজিয়েছে বিশেষ করে সিসেপসন। ভিড়ও কম।

ওরা মি. উইসলির ঘরে গিয়ে দেখলো উনি উঠে বসেছেন। কোলের ওপোর রাখা ট্রেতে রয়েছে টার্কি ডিনারের কিছু অংশ।

মিসেস উইসলি বললেন, কেমন আছ? সব ঠিকঠাক?

ছেলে-মেয়েরা মি. উইসলিকে ক্রিস্টমাস গ্রিট করে, উপহার দিলো।

মি. উইসলি হেসে বললেন–বাঃ বেশ সুন্দর। আচ্ছা তোমরা হিলার স্মিথ উইককে দেখেছো?

মিসেস উইসলি বললেন–কই নাতো, কেন বলতো?

মি. উইসলি প্যাকেটগুলো দেখতে দেখতে বললেন–আশাকরি তোমাদের আজকের দিনটা ভালই কেটেছে। ওহহহ হ্যারি তুমি তো দেখছি দারুণ প্রেজেন্ট এনেছো।

মিসেস উইসলির মুখ দেখে মনে হয় আর্থারের জবাবে একটু খুশিই হয়েছেন। হ্যারির সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতে যাবার সময় মল্লি দেখতে পেলেন উইসলির বুকে ব্যান্ডেজ বাধা রয়েছে।

–আর্থার! ধরা ধরা ভয় মাখা কণ্ঠে মিসেস উইসলি বললেন। তোমার ক্ষতের ব্যান্ডেজ এখনও ড্রেস করেনি? আশ্চর্য গতকালই তো তোমার ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করার কথা ছিলো?

–কী বলছো? মিঃ উইসলি বললেন। গলার স্বরে ভয়ের ছাপ। চাঁদরটা টেনে গলা পর্যন্ত ঢাকলেন। না না তেমন কিছু নয়, মানে আমিই…।

মিসেস উইসলির কড়া দৃষ্টি থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বললেন।

–না না তোমার ব্যস্ত হবার কোনও কারণ নেই। অগাসটাস পাইর একটা আইডিয়া আছে, ও একজন শিক্ষানবীশ হিলার, খুব চটপটে সুন্দর ছেলে। নানা রকমের ওষুধ নিয়ে কাজকর্ম করছে, মানে মাগলদের রেমিডিজ, বলা হয় স্টিচেস। বললো, মাগলদের ক্ষতে ব্যবহার করে দারুণ কাজ পেয়েছে।

মিসেস উইসলি আর্থারের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন। লুপিন বেডের কাছ। থেকে উঠে গিয়ে যাকে ওয়ারউলফ কেটেছে তার কাছে গেলেন। ওর কাছে কেউ দেখা করতে আসে না, অথচ মি. উইসলির কাছে আসে অনেকে। বিল বললো, এককাপ চা খেলে কেমন হয়।

মিসেস উইসলি অসম্ভব রেগে গেছেন। খুব জোরে জোরে বলতে লাগলেন তোমায় কে মাগলদের রেমিডি ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছি জানতে পারি? প্রতিটি শব্দ চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলেন মিসেস উইসলি। অন্য রোগীদের সঙ্গে যারা দেখা করতে এসেছে তারা হকচকিয়ে গেলো।

মি. উইসলি বললেন–মল্পি তুমি যা ভাবছো তা নয়। পাই আর আমি ভাব লাম ওই মেডিসিন ব্যবহার করলে কেমন হয়। দুঃখের বিষয় আমার যে ক্ষতটা হয়েছে সেটা ওই ওষুধে কাজ হলো না।

–তার মানে?

–শোনো, শোনন। স্টিচেস কি সে সম্বন্ধে তোমার ধারণা নেই।

–তার মানে মনে হয় তোমার চামড়ায় নতুন সেলাই দিয়ে আবার সেটা খুলে ফেলা হয়েছে। মিসেস উইসলি অখুশির হাসি হাসলেন। কিন্তু আর্থার তুমি যে এতো বোকা তাতো আগে জানতাম না।

হ্যারি বললো, আমি এককাপ চা খেয়ে আসি।

হ্যারি চলে গেলো। ওর পিছু পিছু গেলো জর্জ, হারমিওন আর জিনি। ওরা দরজা বন্ধ করার সময় মিসেস উইসলির তীক্ষ্ম স্বর শুনতে পেলো। তুমি কি বলতে চাইছো, এটাই তোমার ধারণা?

জিনি বললো, বাবার ওই এক দোষ, যে যা বলে তাই মেনে নেন।

হারমিওন বললো, না ওদের ওষুধ ঠিক নয় তা বলছি না। নন ম্যাজিক্যাল ক্ষত হলে ওষুধটা কাজ করে। আমার মনে হয় সাপের বিষ ওই ওষুধটা অকেজো করে দেয়। আমাকেও এককাপ চা খেতে হবে।

হ্যারি বললো, চা খেতে গেলে আমাদের ছতলায় যেতে হবে।

ওরা করিডোর পেরিয়ে একটা ভগ্নপ্রায় সরু সিঁড়ি দিয়ে ছতলায় উঠতে লাগলো। সিঁড়ির পাশে দেওয়ালে সারিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে মারাত্মক চেহারার হিলারদের পোর্ট্রেট। ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় অনেক হিলার ওদের ডাকতে লাগলো চিকিৎসা করার জন্য। কেউ কেউ অদ্ভুত অদ্ভুত অসুখের বর্ণনা দিয়ে ওদের ভয় পাইয়ে দিতে লাগলো। একজন হিলার রনকে বললো–তোমার স্প্যাটারগ্রইট হয়েছে। রন অসুখের নাম শুনে ঘাবড়ে গেলো। বললো–সেটা আবার কী?

হিলার বললো–মারাত্মক চর্ম রোগ। তুমি এখন ছোট আছ বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে রোগটা বাড়বে। বসন্ত রোগের মতো সারা মুখে বড় বড় দানা বেরোবে, এখন। বীভৎস আছে আরও বীভৎস হবে।

রন রেগে গিয়ে বললো–কোথায় আমাকে এখন বীভৎস দেখলে?

–একমাত্র ওষুধ হচ্ছে, টোভের (একরকমের বেঙ) লিভার তোমার গলার পাশে বেঁধে রেখে, পূর্ণিমার দিন নগ্ন হয়ে একগাদা বানমাছের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে।

–বলছি তো আমার স্প্যাটারগ্রইট হয়নি!

–তাহলে তোমার মুখের দাগগুলো কী?

 -ব্রন আর তিল। তোমার জায়গায় গিয়ে দাঁড়াও, আমি ঠিক আছি।

 –আমরা কোন তলায় উঠলাম, হ্যরি বললো।

–মনে হয় ছতলা, হারমিওন বললো।

হ্যারি বললো, না, পাঁচতলা, আরও একটা তলা আছে।

ল্যান্ডিং পর্যন্ত উঠে হ্যারি দাঁড়ালো। পাশেই একটা ছোট জানালা তাতে দুটো ডবলডোর সেট করা। দরজায় লেখা রয়েছে স্পেল ডেমেজ। সেখান থেকে একটা করিডোরের শুরু। একজন দরজার পাল্লার কাঁচের নিচে দাঁড়িয়ে আছে, মাথায় তার লাল চুল, উজ্জ্বল নীল চোখ, মুখে ভাবলেশহীন হাসি, ঝকঝকে দাঁতগুলো বেরিয়ে রয়েছে দুঠোঁটের ফাঁক থেকে।

–ব্লিমে সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রন বললো।

–আরে কি সৌভাগ্য আমাদের, প্রফেসর লকহার্ট! হারমিওন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বললো।

ডার্কআর্টের প্রতিরোধের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক দরজাটা খুলে ওদের দিকে এগিয়ে এলেন। পরণে তার লিল্যাক রং-এর ড্রেসিং গাউন।

–হ্যালো তোমরা সবাই কেমন আছ, তোমরা আমার অটোগ্রাফ নেবে?

হ্যারি, জিনিকে সামান্য ঠেলে বললো, এখনও দেখছি একই রকম আছেন।

রনের ভুল জাদুদণ্ড প্রয়োগের জন্য প্রফেসর লকহার্টের স্মৃতি শক্তি খুবই খারাপ হয়ে যাওয়াতে সেন্ট মাংগোসে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছেন। তাই রন দোষী দোষী মুখ করে বললো, ভালো আছেন, প্রফেসর?

লকহার্টের স্মৃতিতে রন, হ্যারি নেই বললেই চলে। হ্যারি চুপ করে রইলো।

–ধন্যবাদ, ধন্যবাদ! আমি বেশ ভালই আছি, লকহার্ট খুশি হয়ে পকেট থেকে একটা দোমড়ানো মোচড়ানো ময়ূরের পালকের কুইল (লেখার জন্য) বার করে বললেন, আমার অটোগ্রাফ নেবে? তোমরা জানো আমি আজকাল গণ আন্দোলন সম্বন্ধে লিখি?

রন, হ্যারির দিকে তাকিয়ে চোখটিপে বললো, এখন আমাদের দরকার নেই।

হ্যারি বললো, প্রফেসর, করিডোরে না ঘুরে আপনি আপনার ওয়ার্ডে গেলে ভাল হবে।

লকহার্টের মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। বেশ খানিকটা সময় হ্যারির আপাদ মস্তক দেখে বললেন, আগে তোমায় কোথায় দেখেছি বলতো?

–হ্যাঁ, হ্যাঁ আপনিতো আমাদের হোগার্টস স্কুলে পড়াতেন, মনে নেই?

–পড়াতাম? একটু যেন অস্থির হয়ে লকহার্ট বললেন, আমি পড়াতাম?

তারপর হঠাৎ মুখে হাসি ছেয়ে গেলো। কেমন যেন অস্বস্তিকর। তোমাদের অনেক কিছু পড়িয়েছি। যাকগে, আমার অটোগ্রাফ তোমাদের দরকার নেই? বেশ আমি তোমাকে অনেকগুলো অটোগ্রাফ দিচ্ছি ওগুলো তোমাদের স্কুলের বাচ্চা ছেলেমেয়েদের দিয়ে দেবে, কেউ যেন বাদ না পড়ে।

ঠিক সেই করিডোরের শেষ প্রান্ত থেকে একটা ঘরের দরজা খুলে একজন মুখ বাড়িয়ে বললেন–গিল্ডারয় তুমি ভারি দুষ্টু, কখন পালিয়ে এলে?

একজন বয়স্ক মহিলা মাথায় চকচকে চুমকি লাগানো ক্লিপ এঁটে বাইরে এসে বললেন, ওহ গিল্ডারয় তোমার দেখছি বেশ কয়েকজন অতিথি এসেছেন। ক্রিসমাসে আসলে কতো ভালো লাগে বলতো। তোমরা বোধহয় জানো না কেউ হাসপাতালে দেখা করতে এলে কত ভালো লাগে। ও বেচারির (লকহার্ট) কাছে কেই দেখা করতে আসে না। তোমরা জানো ও খুব মিষ্টি স্বভাবের মানুষ।

গিন্ডারয় বললেন–অটোগ্রাফ।

বয়স্ক মহিলা একজন হিলার। তার কাজ লকহার্টের দেখাশুনা করা আর স্মৃতি শক্তি ফিরিয়ে আনা। লকহার্টের সঙ্গে তাই তিনি খুবই ভাল ব্যবহার করেন। তার ধারণা লকহার্ট অটোগ্রাফ দিলে পুরনো স্মৃতি ফিরে পাবেন। বন্ধ ওয়ার্ডে থাকেন। আমি যখন ক্রিসমাসের প্রেজেন্ট দেওয়া-নেওয়ায় ব্যস্ত, সেই সময় কোন ফাঁকে ঘর ছেড়ে চলে এসেছে। সাধারণত ঘরটা তালা দেওয়া থাকে। তারপর গলার স্বর খাটো করে বললেন–জানে না কে তিনি। ঘর থেকে বেরিয়ে ফেরার রাস্তা ভুলে যান। তোমরা লকহার্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছো? খুব ভালো।

রন বললো–ও হ্যাঁ, আসলে… আসলে আমরা…।

কিন্তু হিলার ওদের দিকে তাকিয়ে হেসেই চলেছেন। রনের চা খাবার কথা মাথায় উঠলো। শুধু শুধু সময় বরবাদ হলো। ওরা বোকার মতো তাকিয়ে রইলো।

রন বললো–এখানে ভ্যাবাগঙ্গারামের মতো দাঁড়িয়ে থাকার কোনও মানে হয় না।

হিলার তার ম্যাজিক দণ্ডটা বার করে জেনাস লিকের ওয়ার্ডের দরজার দিকে তাক করে বললো, অ্যালোহোমোরা। দরজাটা খুলে যেতেই লকহার্টের হাত শক্ত করে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে বেডের পাশে আর্ম চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

হিলার, হ্যারির দিকে তাকিয়ে বললো, আমাদের এটা সবচেয়ে পুরনো ওয়ার্ড। অনেকটা নিজেদের বাড়ির মতো।

গিল্ডারয়কে চেয়ারে বসিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একগাদা পার্চমেন্ট আর কুইল নিয়ে ফটাফট অটোগ্রাফ দিতে শুরু করলেন।

সই শেষ করে জিনির হাতে দিতে দিতে বললেন, এগুলো তোমার ব্যাগে রেখে। দাও। তুমি জানো লোকেরা এখনও আমাকে ভোলেনি। নিয়মিত ফ্যানেদের কাছ থেকে চিঠি পাই। গ্ল্যাডি আমাকে প্রতি সপ্তাহে একটা করে চিঠি পাঠায়। কথাটা বলেই হঠাৎ চিন্তাসাগরে কয়েক সেকেন্ড ডুবে গেলেন। তারপরই আবার চনমনে হয়ে সই করতে লাগলেন, বুঝলে আমি ভাল লোক তাই আমাকে কেউ ভোলেনি।

ঘরে বেশ কয়েকটি বেড। হিলার ওদের নিয়ে প্রতিটি বেডের পেশেন্টদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে দিতে একটা বেডের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন–ইনি অ্যাগনেস। ওর হাতে ক্রিস্টমাস প্রেজেন্ট দিয়ে বললেন–দেখো, তোমাকে আমি ভূলিনি। আজ তোমার ছেলে পাচার মারফত একটা চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, আজ রাতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। প্রেজেন্টটা কেমন?

অ্যাগনেস কথাগুলো শুনে খুব জোরে জোরে ঘেউ ঘেউ করে উঠলেন।

–এই দেখো ব্রডেরিক তোমাকে গাছের চারা আর ক্যালেন্ডার পাঠিয়েছে। হিপোগ্রিফদের সুন্দর সুন্দর বারোটা ছবি, তোমার দেখে খুব ভালো লাগবে, লাগবে না? হিলার যাকে কথাগুলো বললো সে একবার মুখ উঁচু করে সকলকে দেখে আপন মনে বিড় বিড় করতে লাগলো। হিলার সেই পটটা ওর ক্যাবিনেটের ওপোর রেখে হাতের দণ্ড দিয়ে ক্যালেন্ডারটা পেছনের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দিলো, আহ মিসেস লংবটম, আজ আপনি চলে গেছেন?

কথাটা শুনে হ্যারি ঘুরে তাকালো। ওয়ার্ডের শেষদিকে দুটো বেডের মাঝে পর্দা দেওয়া। দুজন ভিজিটর সেই বেডের পাশে ঘোরাফেরা করছে। একটা বেডে এক বৃদ্ধা কৃষকায়া জাদুকরী একটা সবুজ রঙের জরাজীর্ণ ফক্স ফার কোট গায়ে দিয়ে বসে আছে। মাথায় ছুঁচোলো ডেকরেটেড হ্যাট, হাতে একটা স্টাফড শকুনি, ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে নেভিল।

হ্যারির বুঝতে বাকি রইলো না বেডেতে কারা রয়েছেন। হ্যারি রনের দৃষ্টি এড়িয়ে নেভিলের কাছে কেমন করে যাবে তা ভাবতে লাগলো। কিন্তু হিলারের লংবটম কথাটা রনের কানে গেছে। হ্যারির মতো ও তাকালো। হ্যারি কিছু বলতে বাধা দেয়ার আগেই রন বেশ জোরে জোরে বলে উঠলো–নেভিল!

নেভিল তড়াক করে লাফিয়ে উঠে এক পাশে সরে গেলো। এমন এক ভাব করলো যেন বুলেটের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে।

–নেভিল আমরা, রন ওর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, তোমার লকহার্টের সঙ্গে এখানে দেখা হয়েছে? তুমি কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো?

–নেভিল দেখো তোমার বন্ধুরা তোমায় ডাকছে, নেভিলের ঠাকুমা ওদের দিকে তাকিয়ে স্নেহাপুত কণ্ঠে নেভিলকে বললেন।

নেভিল, এমনভাবে তাকালো যেন এই পৃথিবীতে ও দাঁড়িয়ে থেকেও নেই। ওর ফোলা ফোলা গাল দুটো লাল হয়ে গেলো; কিন্তু রন হ্যারির দিকে দৃষ্টিপাত করলো না।

–হ্যাঁ, ওর ঠাকুমা শীর্ণ একটা হাত হ্যারির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ও হ্যাঁ, তোমাকে তো আমি চিনি। নেভিল তো প্রায়ই তোমার কথা বলে।

বৃদ্ধার হাতটা ধরে হ্যারি বললো, ধন্যবাদ।

নেভিল তখনও ওদের দিকে না তাকিয়ে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।

–তোমাদের দুজনকে দেখে তো মনে হয় উইসলি পরিবারের মিসেস লংবটম বলে চললেন এবং রন আর জিনির দিকে হাত বাড়ালেন। আমি শুনেছি তোমাদের বাবা অসুস্থ, আর ওই সুন্দরী মেয়েটি নিশ্চয়ই হারমিওন, হারমিওন গ্রেঞ্জার?

হারমিওন মিসেস লংবটমের মুখে ওর নাম শুনে হকচকিয়ে গেল। মিসেস লংবটম ওকে চিনলেন কেমন করে বুঝতে পারলো না।

–নেভিল তোমাদের কথা আমাকে খুব বলে। তোমরা ওকে অনেক বিপদ আপদ থেকে বাঁচিয়েছে, তাই না? তারপর লম্বা নাক নেভিলের লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, খুবই শান্ত শিষ্ট ভাল ছেলে। কিন্তু বেচারি ওর বাবার মত গুণ পায়নি। কথাটা বলে মিসেস লংবটম ঘরের শেষ প্রান্তের দুটি বেডের দিকে তাকালেন। কোলের ওপোর রাখা স্টাফ কথা বলার সময় ঝটপট করে উঠল।

–কী বললেন? রন বললো। (ও হ্যারির পা দিয়ে পা টিপে কথা বন্ধ করার ইঙ্গিত বুঝতে পারেনি। আর পারবেই বা কেমন করে? এখন তো ও আর রোবস পরে নেই, রীতিমত জীনস–শার্ট পরেছে) নেভিল ওদিকে যিনি শুয়ে রয়েছেন তিনি তোমার বাবা?

নেভিলে ঘরের ছাদের সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে খুব বড় দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে, কথা না বলে শুধু ঘাড় নাড়লো। হ্যারির ওর বন্ধুর মুখ দেখে মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। নেভিলকে সাহায্য করার কোনও পথ ওর জানা নেই।

মিসেস লংবটম মনে হলো ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বললেন, না না এতে লজ্জার কি আছে। তখনও তার দৃষ্টি হ্যারি, হারমিওন আর উইসলি পরিবারের দিকে। তোমার গর্বিত হওয়া উচিত নেভিল, সত্যি গর্ব করার মতো। ওর বাবা-মা ওকে এমন কিছু দেয়নি যার জন্য ওর লজ্জা বলে বস্তুটি থাকবে না।

নেভিল দৃঢ়তার সঙ্গে বললো, আমি লজ্জিত নই। কথাটা বললো হ্যারির দিকে তাকিয়ে। রন ততক্ষণে দুটি বেডের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

–তোমাদের ইচ্ছে সব সময় লোকদের কিছু দেখাতে চাও! মিসেস লং বটম বললেন, আমার ছেলে, ছেলের বৌ, হ্যারি, রন, হারমিওন ও জিনির দিকে তাকিয়ে বলে চললেন–ঈশ্বর ওদের অনেক গুণ দিয়েছেন। ও হ্যাঁ, অ্যালিস তুমি কিছু বলবে?

নেভিলের মায়ের গায়ে নাইট ড্রেস। মুডির সঙ্গে যে ফটোগ্রাফটা অতীতে তুলে ছিলেন, এখন আর সেইরকম মোটা সোটা নেই, মুখেও হাসি নেই। অরিজিন্যাল অর্ডার অফ ফনিক্সের গ্রুপ ফটোগ্রাফের সঙ্গে বিস্তর তফাৎ! এখন তিনি অনেক শীর্ণ, একটু বয়স্কা মনে হয়, চোখ দুটোও ফোলা ফোলা, মাথার চুল অনেক সাদা হয়ে গেছে, সব মিলিয়ে কেমন যেন বেদনার ভাব। মুখ দেখে মনে হয় কথা বলতে চান না বা কথা বলার শক্তি কম। হাতে একটা কিছু নিয়ে নেভিলের দিকে এগিয়ে এলেন অ্যালিসা।

–আবার? মিসেস লংবটমের সামান্য চিন্তিত কণ্ঠস্বর, আচ্ছা আচ্ছা খুব ভালো অ্যালিস, নেভিল তোমার মা দিচ্ছেন নাও। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বললেন–ইউ-নো-হু ওদের ওপর নানা অত্যাচার করে পাগল করে দিয়েছে। ওরা দুজনেই অউরর তুমি সম্ভবত জানো, ওরা জাদুকর মহলে খুবই সম্মানীয় মানুষ।

নেভিল ওর মার দিকে হাত বাড়িয়ে জিনিসটা নিলো। বিশেষ কিছুই নয়, একটা উজ্জ্বল বেস্ট ব্লেডিং গামের মোড়ক, ভেতরে কিছুই নেই।

নেভিল মায়ের পিঠ চাপড়ে আদর করলে মিসেস লংবটম আনন্দের ভান করে বললেন, বাঃ বাঃ খুব সুন্দর জিনিস তো।

নেভিল শান্তভাবে বললো, খুব সুন্দর। ধন্যবাদ মা।

ওর মা আপন মনে বিড় বিড় করতে করতে ওয়ার্ডের অন্য প্রান্তে এগিয়ে যেতে লাগলেন। নেভিল খুব সম্ভব মনে দারুণ আঘাত পেয়ে নির্বাক। হ্যারি কখনই ভাবেনি এই রকম এক অদ্ভুত হাস্যকর দৃশ্য দেখতে হতে পারে।

মিসেস লংবটম হাতের সবুজ রং-এর দস্তানা ঠিক করে পরতে পরতে বললেন, আচ্ছা এবার তবে আমরা এগোই। তোমাদের দেখে আমার খুব ভাল লাগলো। ওই মোড়কটা বিনে ফেলে দাও নেভিল, তোমাকে তো মা অনেক দিয়েছেন।

হ্যারি কিন্তু যাবার সময় দেখলো, নেভিল ওর ঠাকুমার কথা মতো চকোলেটের মোড়কটা বিনে ফেলে না দিয়ে পকেটে রেখে দিলো।

দরজা বন্ধ হয়ে গেলো।

–আমি দায়ী, ডাম্বলডোর ব্যাপারটা আমাকে গোপন রাখতে বলেছিলেন। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ কাউকে বলবো না। আজকাবানে নেভিলের বাবা-মায়ের ওপোর কুসিয়াস কার্স করার জন্য বেল্লাট্রিকস্ লেস্টরেঞ্জকে পাঠানো হয়েছিলো। যতক্ষণ না ওরা স্মৃতি ভ্রংশ হয় ততক্ষণ কার্স থামেনি।

–বেল্লাট্রিকস লেস্টরেঞ্জ ওই কাজ করেছিলো? হারমিওন ভীতু ভীতু কণ্ঠে বললো–মহিলাটির ফটো ক্রেচার ওর ঘরে (ভেনে) রেখে দিয়েছে?

অনেক সময় নীরব থাকার পর লকহার্ট-এর রাগত গলা শুনতে পেলো শোনো, আমি বিনা প্রয়োজনে কোনো কিছুই করি না, তোমরা ভাল করেই জানো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *