কোরান ও সুন্নার আদের্শ জীবন যাপন করার লক্ষে পাকিস্তান কায়েমের জেহাদে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান বাঙলা ভাষায় জানালেও নিজের পেশাগত অভ্যাসের কারণে এবং সৈয়দ আমির আলির স্পিরিট অফ ইসলাম-এর প্রায় অর্ধেকটাই মুখস্থ থাকার ফলে সাদেক উকিলের বেশিরভাগ কথাই বেরিয়ে আসে ইংরেজিতে। ইসলামের বিজয়গাথা প্রচার ও সেই সঙ্গে রাজভাষার ব্যাকরণগত শুদ্ধতা বজায় রাখতে তার মনোযোগ, যত্ন ও নিষ্ঠা একেবারে নিরঙ্কুশ। তবে দুটো হ্যাজাক ছাড়াও মঞ্চ আলো করার একটি প্রধান উপাদান। খান বাহাদুর আলি আহমদের কোনো আমির আলি এখন পর্যন্ত দুর্গাভ্যক্রমে আবির্ভূত না হওয়ার তার মহানুভবতা, ইসলামের জন্যে তার ত্যাগ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার কথাগুলো। সাদেক আলিকে বলতে হয় বাঙলাতেই। কিছুক্ষণের মধ্যে. সে ফের ইংরেজিতে গড়ালে তার গুণকীর্তনের পাত্র স্থানান্তরিত হচ্ছে জেনে এবং ইংরেজি ভাষায় অভিভূত শ্রোতারা তার কথা কিছুই বুঝতে পাচ্ছে না তা ওয়াকিবহাল থাকায় শামসুদ্দিন ডাক্তার আস্তে করে টান দেয় মীর মোহাম্মদ সাদেক আলির ডোরাকাটা খয়েরি শেরোয়ানির লম্বা ঝুলের প্রান্ত ধরে এবং এই টান দেওয়াটা প্রায় টানাটানিতে দাঁড়ালে টানটান মনোযোগ প্রয়োগ করা থেকে শ্রোতাদের অব্যাহতি দিয়ে ভাষণ সংক্ষিপ্ত করতে সে বাধ্য হয়।
এবারে হাজেরানে মজলিশের সামনে দাড়ায় খান বাহাদুর সৈয়দ আহমদ আলি। কয়েক পুরুষের জমিদারি, পিতামহের মন্ত্রিত্ব ও এক পুরুষ গ্যাপ দিয়ে নিজের উপমন্ত্রিত্ব এবং তিন পুরুষ ধরে বিয়ে করা ও না-করা ইংরেজ ও এ্যাংলো ইনডিয়ান মেমসায়েবদের সঙ্গে প্রেম ও যৌন সঙ্গম প্রভৃতি কারণে খাটি সায়েবদের সাহচর্যের ফলে খান বাহাদুরের গলার ভেতর থেকে বেরুতে বেরুতে বাঙলা ভাষা অনেকটাই দুমড়ে যায়। বাকা বাঙলা, ভাঙা উর্দু ও সায়েবদের চেয়েও সায়েবি ইংরেজির মিশেলে মুসলমান কৃষকের ওপর হিন্দু জমিদার ও মহাজনদের জুলুমের কথা বলতে বলতে তার গলা ভারাক্রান্ত হয়, আট মিনিটের বেশি বলা তার পক্ষে আর সম্ভব হয় না। এ ছাড়াও দলের একটি কাজে তাকে এক্ষুনি টাউনে যেতে হবে। সুতরাং দুঃখিত হয়ে খান বাহাদুর সভাস্থল ত্যাগ করার এজাজত চায় দুই হাত জোড় করে। হ্যাজাকের আলোয় ধবধবে ফর্সা হাতজোড়া তার। লালচে দেখায় এবং হাতের রঙ ও বিনয়ে শ্রোতাদের মুগ্ধতা চড়ে যায় চরম পর্যায়ে। করজোড়ে তার মাফ চাওয়ায় অভিভূত কোনো কোনো বুড়া শ্রোতা বুকে ঠাণ্ডা লাগানোর ঝুঁকি নিয়েও গায়ের কথা টেনে নিজেদের ছানি-পড়বো-পড়বো চোখের কোণ মোছে।
নায়েবাবু দাঁড়িয়েছিলো মঞ্চের পেছনে। জমিদারবাবুর বুড়ো ছেলে আজ পদার্পণ করেছে লাঠিডাঙা কাচারিতে, খান বাহাদুরের সঙ্গে টাউনে যাবে বলে সেখানে অপেক্ষা করছে। নায়েবাবুর ইশারা পেয়ে খান বাহাদুর তাকে নিজের গাড়িতে উঠতে পাল্টা ইশারা দেয়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে গত কয়েক বছরে গোলাবাড়ি হাটের ওপর দিয়ে মোটরগাড়ি গিয়েছে অন্তত পাঁচবার। কিন্তু মোটরগাড়ির দীর্ঘকালীন অবস্থান এখানে এই প্রথম বলে স্থানীয় লোকজন ও মেলা উপলক্ষে আসা অন্য এলাকার জামাইরা তাদের ছেলেপুলে নিয়ে বেশ উত্তেজিত। খান বাহাদুরের সঙ্গে নায়েবাবু ও শামসুদ্দিন ডাক্তার ওঠার পর ফোর্ড গাড়ির চাকা গড়াতে না গড়াতে শ্রোতাদের উত্তেজনা নেমে আসে নিজনিজ পায়ে এবং তাদের প্রায় অর্ধেকই ছুটতে থাকে গাড়ির পেছনে। বাকি অর্ধেক কি তার একটু বেশি শ্রোতা তাকিয়ে থাকে ধাবমান গাড়ির দিকে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই অদৃশ্য-হওয়া গাড়ির শক্তি, সৌন্দর্য ও গতি নিয়ে তারা জরুরি আলোচনায় নিয়োজিত হয়। মঞ্চ থেকে ইসমাইল হোসেন চোঙায় মুখ লাগিয়ে চিৎকার করে, হাজেরানে মজলিশ, ভাইসব, ভাইসব, আপনারা বসে পড়ন, এখানে বসে পড়ুন। সভার কাজ আবার শুরু হচ্ছে, ছোটাছুটি করবেন না ভাইসব। বসে পড়ুন।
কিন্তু শ্রোতাদের আগ্রহ মোটরগাড়ির লুপ্ত আওয়াজের রেশের দিকে, ইসমাইলের আবেদনে তারা কান দেয় না। ইসমাইলের হুকুমে আবদুল কাদের প্রাণপণে নারায়ে তকবির, লড়কে লেঙে, পাকিস্তান ও কায়েদে আজম বলে স্লোগান তুললেও এর জবাবে যথাক্রমে আল্লাহ আকবর, পাকিস্তান, জিন্দাবাদ ও জিন্দাবাদ সাড়া দিতে হয় বলতে গেলে তাকে একাই, কারণ কর্মীদের সবাই আপাতত ফোর্ড গাড়ির পেছনে মাটির রাস্তার ধুলা, ধোঁয়া ও কুয়াশায় হারিয়ে গেছে।
ইসমাইল কাদেরকেই বলে, এসব কী? কোনো ডিসিপ্লিন নাই। যাও তোমার ওয়ার্কারদের নিয়ে এসো। সেই কবি কোথায়? ওকে নিয়ে এসো। গান হলে পারিক ফিরে আসবে। যাও।
কিন্তু পাকিস্তান নিয়ে কেরামত আলি এখন পর্যন্ত গান লিখতে পারে নি বলে এবং আলিম মাস্টারের সঙ্গে এর মাখামাখিতে বিরক্ত হয়ে কাদের আজ বিকালেই সভায় তার গান গাইবার আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এখন ইসমাইলের হুকুমে সে বিব্রত হয়, আমতা আমতা করে বলে, কিন্তু কেরামত আলির গানে তো পাকিস্তানের কথা নাই। এতোবার বললাম! এখনো লেখে নাই।
আঃ! যা বলি শোনা। গান হলেই চলবে।
ইসমাইলের তাগাদায় আবুদল কাদের খুঁজতে বেরিয়ে কেরামতকে পায় মুকুন্দ সাহার দোকানের সামনে। আলিম মাস্টার আর বৈকুণ্ঠের সঙ্গে দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে খুব গপ্পো মারছে। প্রায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসে কাদের তাকে উঠিয়ে দিলো মঞ্চের ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল বলে, ভাইসব, আপনারা বসে পড়ুন। এবার গান হবে। হাজেরানে। মজলিশের সামনে পাকিস্তানের গান শোনাবে কাদেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে কবির নাম জানতে চাইলে কাদের ফিসফিস করে বলে, কিন্তু পাকিস্তানের গান তো লেখে নাই। ইসমাইল ধমক দেয়, আঃ! নামটা বললা না। নাম জেনে নিয়ে সে ঘোষণা করে, কবি কেরামত আলি।
ঘোষণা শুনে কেরামত একটার পর একটা টোক গেলে। জয়পুর, পাঁচবিবি, আক্কেলপুর, আমদদিঘি, হিলি, এমন কি রেলওয়ে জংশন শান্তাহারে পর্যন্ত সে গান গেয়ে। গেয়ে গানের বই বিক্রি করেছে ডজন ডজন। কিন্তু সাদেক উকিলের অতি শুদ্ধ ইংরেজি এবং খান বাহাদুরের বাঁকাচোরা বাঙলা, ভাঙা উর্দু ও সায়েবদের চেয়েও সায়েবি ইংরেজি এবং সর্বোপরি মোটরগাড়ির আওয়াজে এই সভা গমগম করছে। তার উত্তাপে কালো কালো ঘামের ফোঁটা বেরোয় কেরামতের মুখ ফুড়ে। সে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে, সামনে কাউকে দেখতে পায় কি-না সন্দেহ।
তবে মঞ্চের ঠিক নিচে তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে বৈকুণ্ঠ গিরি। কেরামতকে অভয় দিয়ে সে বলে, তুমি একবার ধরো না! ফকির ওই যে তমিজের বাপের ঘরোত গান করা গেলা, ওইটাই ধরো। কেরামত তবু চুপচাপ থাকলে বৈকুণ্ঠ তাকে আশ্বাস দেয়, তুমি ধরো তো! ফকিরই তোমাক দিয়া কওয়াবি!
কেরামত এতে আরো ঘাবড়ে যায়। ভয়ে ভয়ে সে তাকায় পেছনে। পেছনে বটতলা ও বটগাছও বটে। ফকিরের ভরসায় নয়, বরং ফকির এসে ফের তার ওপর ভর না করে এই ভয়েই কেরামত শুরু করে,
বিসমিল্লা বলিয়া শুরু করে কেরামত।
ভারতবাসীর উপরে আল্লা করো রহমত।।
শুন শুনি ব্ৰজনে হিন্দু মোসলমান।
সোনার বাঙলার চাষার দুঙ্কে ফাটিবে পরান।।
শেষ দুই লাইন সে কয়েকবার করে আবৃত্তি করে। লোকজন জমতে থাকে ফের। লীগের কর্মীরা ফিরে এসে সবাইকে বসিয়ে দেয়, বসেন গো, তোমরা বসো। গান হবি। গান শোনেন।
মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে অভয় দেয় বৈকুণ্ঠ, কেরামত আলি, ফকির আসিছে। হামি দিশা পাচ্ছি, তোমার পাঁজরার মুড়া খাড়া হয়া আছে। তুমি তার গান ধরো। মনে পড়িচ্ছে না? আরে গোল করিও না তোমরা ফকিরে ঘুমায়। শুরু করো তো, ঠাকুরের নাম লিয়া গানটা ধরো। মনে ভুল্যা গেলে ফকির তো আছেই।
কেরামত আলির সেদিকে নজর নাই। মঞ্চের এদিক থেকে ওদিক এবং ওদিক থেকে এদিক সে পায়চারি করে এবং পায়চারি করতে করতেই চাঁদরের ভেতর থেকে চার পৃষ্ঠার রোগা একটি বই বার করে পড়বার প্রস্তুতি নেয়। বই না দেখেই সে গাইতে পারে, বলতে কী বইয়ের সামনে চোখ তার বড়ো একটা থাকে না। কিন্তু বই হাতে রাখলে আত্মবিশ্বাস তার বাড়ে। এ ছাড়া বইয়ের প্রচারও তো দরকার। চোখের সামনে রোগা বইটা ধরে একটু মোটা গলায় সে শুরু করে, একই সঙ্গে চলে তার প্রবল বেগে মাথা ঝাঁকানো,
যাহার হাতে নাঙল। যাহার হাতে নাঙল, ফলায় ফসল অন্ন নাই তার পাতে।
জমির পর্চা লইয়া জোতদার থাকে দুধেভাতে রক্ত করি পানি
র অ ক্ত করি পানি মাটি ছানি ভাদ্রে রোপাই ধান।
চার মাসের মেন্নতে দেহে নাহি থাকে পরান। পৌষে ধান কাটি
পৌষে ধান কাটি, বাঁটাবাঁটি করিল জোতদার।
ভাগে পাইলাম আধা ফসল চলে না সংসার। চাষার মেনুতের দাম,
তার গান শুনতে শুনতে বৈকুণ্ঠের ধার ঘেঁয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আলিম মাস্টার। কেরামতের দিকে তাকিয়ে সে চোখের নানারকম ইশারা করে। সেই সব ইশারায় সে কেরামতকে উৎসাহ দেয়, না হুঁশিয়ার করে বোঝা মুশকিল। কেরামত তার দিকে তাকায় না পর্যন্ত। তার নজর সামনের দিকে, শ্রোতাদের ওপর দিয়ে চোখ মেলে সে দেখছে সামনের রাস্তার অন্ধকার।।
সভার লোকজন একে একে বসে পড়ছে। কিছুক্ষণ আগে সাদেক উকিল ও খান। বাহাদুরের বক্তৃতার সামনে অখণ্ড নীরবতা এখন আর নাই। লোকজন এখন গান শুনতে শুনতে মাথা ঝাকাচ্ছে, কেউ কেউ উঠে দাঁড়িয়ে আরেকটু সামনে এগোয়, কেউ কেউ বসে বসেই এগোয়, দুই একজন চেরাগ আলি ফকিরের সঙ্গে কেরামতের তুলনা করে, গানের কথা না জেনেও কেউ কৈউ কেরামতের সঙ্গে গুনগুন করে সুর ভাঁজে। তাদের নিচু স্বরে কথাবার্তা সম্পূর্ণ নতুন গানের কথায় তাদের উৎসাহ ও উত্তেজনা তাদের সুরেলা ও বেসুরো গুনগুন করার ভেতরে ভেতরে সাঁতার কেটে চলে কেরামতের গান :
চাষার মেন্যুতের দাম খালি আকাম জোতদারেরই কাছে।
দুই মাস গেলে চাষা ঘোরে মহাজনের পাছো জোতদার মহাজনে
জো ও তদার মহাজনে মনে মনে উহাদের পিরীত।
চাষার মুখের গেরাস খাওয়া দুইজনেরই রীতা চাষার বড়ো দুষমন
চাষার বড়ো দুষমন এই দুইজন যেমন পাখির দুষমন খাঁচা।
চোরের দুষমন চান্দের পহর পোকের দুষমন প্যাঁচা।। রাবণের দুষমন
রাবণের দুষমন ভাই বিভীষণ রামের অনুচর।
ধর্মেরে করিল বরণ অধর্মেরে পরা দেহের দুষমন
আর দেহের দুষমন ভেদবমন গাছের দুষমন লতা।
চাষার দুষমন জমিদার জোতদার অতি লেয্য কথা বলি জমিদারি
ব অ লি জমিদারি উচ্ছেদ করি এমন আইন চাই।
জোতদার পাবে এক ভাগ ফসল চাষায় দুই ভাগ পাই। তাই তেভাগার ডাক
তা ই তেভাগার ডাক দাও জোরে হাঁক বলো চাষার জয়।
চাষা বিনা জগৎ মিছা ব্ৰজনে কয়। দেখো বর্মণী মায়ে
আহা বর্মণী মায়ে পুলিসের ঘায়ে হইয়াছে জখম।
পায়ে গুলি খাইয়াও বুকের বল তো নাহি কম। সকল চাষীজনে
চাষীমজুরজনে নাহি মানে জোতদারের জুলুম।
চাষীর রক্তে জোতদার বাঁচে সকলের মালুম।।
গানের শ্রোতার সংখ্যা বাড়ে খুব দ্রুত। মোটরগাড়ির পেছনে ছোেটা লোকদের কেউ কেউ রাস্তা থেকেই চলে গিয়েছে নিজের নিজের বাড়ি, তবে বেশিরভাগই ফিরে এসেছে। গান শুরু হলেই। এবং কেরামতের মাথা আঁকাবার সঙ্গে সঙ্গে শ্রোতারা মাথা দোলায়। গফুর কলুর নেতৃত্বে দাঁড়িয়ে থাকা একদল কর্মী ঘাড় নাড়িয়েই চলেছে, গফুর কলু অবশ্য মাঝে মাঝে দেখছে কাদেরকে। শুকনা মুখে কাদের তাকিয়ে থাকে ইসমাইলের দিকে। তবে এই গানে ইসমাইলের প্রতিক্রিয়া বোঝা মুশকিল। গায়কের চেয়ে তার দৃষ্টি বেশি আকর্ষণ করে শ্রোতারা, সে দেখে শ্রোতাদের মুখ আরো কিছুক্ষণ পর কেরামত চলে আসে গানের শেষ জায়গায়,
কেরামতের কথা। কে এ রামতের কথা রাখো গাঁথা সকলের হিরদয়ে।
চাষা যদি একজোট হয় ভাই দুষমন কাপে ভয়ে।।
কেরামত একটু সরে দাঁড়াতেই ইসমাইল সম্বোধন করে শ্রোতাদের, হাজেরানে মজলিশ, ভাইসব, জমিদারদের হাত থেকে, মহাজনদের হাত থেকে, জোতদারদের হাত থেকে মুসলমান প্রজাদের বাঁচাবার জন্যেই ভারতের দশ কোটি মুসলমানের নেতা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ আজ পাকিস্তান হাঁসেলের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কবি কেরামত আলি তার গানের মধ্যে দিয়ে মুসলিম লীগের কথাই বলে গেলো। রাতের ঘুম আর দিনের আরাম হারাম করে আমরা —
গান হোক। গান হোক। জনতার দাবির মুখে ইসমাইল একটু বিরতি দিলো। সাদেক উকিল আস্তে চাপ দেয় ইসমাইলের পিঠে, ফিসফিস করে বলে, গান করতে দাও। পাবলিক রাউডি হয়ে গেলে–
তার আবেদনে ভ্রক্ষেপ না করে ইসমাইল প্রায় ধমক দেয় শ্রোতাদের, খামোশ। আমার কথা শুনুন। খালি গান শুনলে কাজ হবে না। মানুষ কাজও করে, গানও শোনে। রোজগারের জন্যে আপনারা দিনরাত খাটেন, হয়রান হয়ে গান শুনে, গান গেয়ে, গল্প করে ক্লান্তি দূর করেন। দিনরাত ফুর্তি করে বেড়ালে জমিতে ফসল ফলাতে পারবেন?
শেষ প্রশ্নটির জবাব শুনতে সে কয়েক পলক অপেক্ষা করে। কেউ কিছু বলে না, তবে সবাই চুপ করে। ইসমাইল বলে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে গান হলে মনটা ভালো। থাকে। এবার জরুরি কথা বলি, পরে আবার গান শুনবেন।
শ্রোতারা এবার একেবারেই চুপ করে যায়। ইসমাইল বেশ ধীরে সুস্থে, কখনো চড়া গলায় আবার কখনো নিচু স্বরে ঘণ্টাখানেক ধরে বক্তৃতা করে। কেরামতের গানের সঙ্গে তার কথার কোথাও কোথাও সামঞ্জস্য আছে বুঝে শ্রোতাদের আগ্রহ বাড়ে। ইসমাইল বলে, মুসলিম লীগ জমিদারদের সংগঠন নয়, বাঙলার মুসলমানদের মধ্যে জমিদার আর কয়জন? যে কয়জন জমিদার জোতদার এই প্রতিষ্ঠানে আছে, দলের আদর্শ মেনে নিয়েই তারা দলে যোগ দিয়েছে। মুসলিম লীগের নীতির সঙ্গে মীরজাফরি করলে মুসলিম লীগ বিনা দ্বিধায় দল থেকে তাদের বহিষ্কার করবে। একটু থেমে শ্রোতাদের নিরঙ্কুশ মনোযোগ তৈরী করে সে জানায়, দরকার হলে আমাদের জেলার নেতা জেলা মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর সৈয়দ আলি আহমদকেও আমরা দল থেকে বহিষ্কার করবো।
এই কথায় শ্রোতারা স্তম্ভিত। মুহূর্তের মধ্যে তাদের বিস্ময় পরিণত হয় উত্তেজনা ও পুলকে এবং সভায় খুব হাততালি পড়তে থাকে। এমন কি, খান বাহাদুরের বিনয়ে একটু আগে অভিভূত হওয়ায় যাদের চোখ ছলছল করছিলো, তারা পর্যন্ত দ্বিতীয়বার ঠাণ্ডা লাগানোর ঝুঁকি নিয়ে কাঁথা থেকে দুই হাত বার করে হাততালি দিতে থাকে।।
সভাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে এনে ইসমাইল ডান হাত তুলে শ্রোতাদের হাততালি বন্ধ করার ইঙ্গিত দেয়। তারপর সম্পূর্ণ নীরবতার মধ্যে বলে, আজ দেশের কোথাও কোথাও কৃষকদের মধ্যে যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে তার সঙ্গত কারণ আছে। এর সমাধান সম্ভব কেবল পাকিস্তানেই, সেখানে কৃষকের পক্ষে আইন তৈরী করতে বাধা দেওয়ার অধিকার কারো থাকবে না। এখন দেখতে হবে, কৃষকরা আজ যাদের নেতৃত্বে সংঘাতে নেমেছে তার কোন জাতির মানুষ। হিন্দু জমিদাররাই তো কৃষকদের শোষণ করে আসছে বৃটিশ শাসনের শুরু থেকে। পলাশির আম্রকুঞ্জে নবাব সিরাজুদ্দৌলার পতনের পর থেকে ব্রিটিশের পায়রাবি করে তারাই তো মুসলমানদের অর্থসম্পদ, মানইজ্জত নিয়ে বাঁচার পাথে বাধা দিয়ে আসছে। মুসলমান কৃষককে সংঘাতের পথে ঠেলে দিয়ে তারা বিভেদ সৃষ্টি করছে মুসলমানদের মধ্যে। এতে স্বার্থ হাসিল হচ্ছে কার? রক্তপাতের পথে না গিয়ে মুসলমান কৃষক যদি পাকিস্তান আন্দোলনে সামিল হয় এবং পাকিস্তান যদি তারা কায়েম করতে পারে, তবে তাদের সমস্যার সমাধান হতে বাধ্য।
নানারকম দৃষ্টান্ত দিয়ে ইসমাইল তার লম্বা বক্তৃতা শেষ করলে কাদেরের নেতৃত্বে একটার পর একটা স্লোগান উঠতে থাকে। এমন কি এই স্লোগানে শরিক হয় কেরামত আলিও।
মঞ্চ থেকে নামতে নামতে সাদেক উকিল ইসমাইলের কানে কানে বলে, মিটিং তো ভালোই হলো। কিন্তু মুসলিম লীগের সভায় তেভাগার গান কেমন শোনায়?
ইসমাইল নিজের সাফল্যে গলা একটু উঁচু করে, আজ তেভাগার গান করলো। কালই আবার এই লোকটাই পাকিস্তানের গান লিখুবে। আপনি এটাও পারবেন না, ওটাও পারবেন না।
কেরামত হেঁটে যাচ্ছিলো আলিম মাস্টারের সঙ্গে, তার পাশে বৈকুণ্ঠ। যুধিষ্ঠির কর্মকার কোত্থেকে এসে তাদের পিছু নেয়। সুযোগ বুঝে আস্তে করে জিগ্যেস করে, গানের মধ্যে তেভাগার কথা কওয়া হলো, তেভাগা কি হবি?
কেরামতের হয়ে জবাব দেয় বৈকুণ্ঠ, গানের রহস্য বোঝা সহজ লয় বাপু। ফকিরে গান করিছে, একোটা গান হামরা কতোবার করা শুনিছি। উগলান গান এটিকার মানুষ জানে কোনদিন থ্যাকা! তো তার রহস্য বোঝে কয়জনা? আর কেরামতের গান, লতুন গান, একবার শুনলা আর বুঝবার পারলা, অতোই সোজা?
কেরামতের গান আবার তমিজের মাথাতেও কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়েছে। খিয়ার এলাকায় তেভাগার কাণ্ড তো সে নিজেও দেখে এসেছে। গানের কথা বাদ দাও। গানে কতো কথা থাকে, উগলান সব ধরলে চলে? বলতে বলতে তমিজ কেরামতের দিকে তাকায় আড়চোখে, তাকে একটু ঘায়েল করা গেছে ভেবে খুশিতে তার বুকের বল বাড়ে, খিয়ারেতে হামি লিজে দেখিছি। জোতদার শালা আধিয়ারের ধাবাড় খায়া গোয়ার কাপড় তুল্যা কুটি পালাবি দিশা পায় নাই।
তমিজের কথায় সবাই হাসে। জোতদারের ন্যাংটা হওয়াটা এদের অতিরিক্ত হাসির কারণ হতে পারে; আবার সভায় শোনা ভালো ভালো কথার চাপ থেকে খালাশ পেয়েও সবাই হাসতে পারে। এতো মানুষকে হাসাবার কৃতিত্বে খুশি হয়ে তমিজ কেরামতের ওপর রাগ সবটাই ঝেড়ে ফেলে। তাকেও সে খুশি করতে চায়, তোমার গান আজ খুব জমিছিলো গো। জয়পুরে বর্মণী মায়ের কথা আমিও শুনিছি। কেরামতের গানে তমিজ অভিভূত। সে বারবার তাকায় কাদেরের এক কর্মীর দিকে। ছাত্র কর্মীটি কিন্তু হাসে না, ইসমাইলের বক্তৃতার রেশ ধরে বলে, মারামারির কথা বলে খালি বিভেদ সৃষ্টি। মুসলমানদের মধ্যে ডিভিশন হলে লাভ হবে হিন্দুদের। তেভাগা তো পাকিস্তানে। এমনিতেই হবে।
তা তো হবে। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের তাতে লাভ কী? এদের হাতে তেভাগা হলে সে কি আর ফসলের উপযুক্ত ভাগ পাবে? কয়েকদিন আগে নায়েববাবু যুধিষ্ঠিরের বাবাকে বলেছে, মুসলিম লীগের লোকদের সঙ্গে তারা ওঠাবসা করে কোন আক্কেলে? পাকিস্তান হলে মুসলমানদের এঁটোকাটা খেতে হবে, গোরু খাওয়া হবে বাধ্যতামূলক, মুসলমানরা দিনরাত লাথিঝটা মারবে।-একি তারা জানে না? হিন্দু মেয়েদের সতিত্ব থাকবে পাকিস্তানেঃ জাত যদি ঠিক রাখতে হয় তো এদের সঙ্গে ওঠাবসা করা বন্ধ করো।
তবু কেবল তমিজের কথা শুনেই যুধিষ্ঠির সভায় এসেছিলো। স্বয়ং নায়েববাবুকে খান বাহাদুরের গাড়িতে উঠতে দেখে তার ভয়ও একটু কেটেছে। তেভাগার গানে তো সে রীতিমতো শিহরিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তেভাগা হবে মোসলমানদের জন্যে। পাকিস্তান হলে তবে তার খালি লোকসান। জাতও যাবে, তেভাগার ফসলও তার জুটবে না। তবে জগদীশ সাহা সেদিন বললো, পাকিস্তান টাকিস্তান কিছু নয়, সব ভাক্কাবাজি। মহাত্মাজী একটু শক্ত হলে মুসলমানরা কোথায় উড়ে যেতো! মুসলমানদের মধ্যে মাথা আছে নাকি? ছছাটো জাত টাকা করলেই আর মন্ত্রী হলেই ভদ্দরলোক হতে পারে নাকি?
যুধিষ্ঠিরের মাথাটা বড়ো এলোমেলো ঠেকে। তমিজের সঙ্গে তার এতো খাতির কিন্তু তেভাগার আশায় তমিজ যেমন লাফাচ্ছে সে তো তেমন পারছে না। আলিম মাস্টার তার পাশে এসে বলে, আ র দেশে একটা আইন হলে গেলির জন্যেই হবি। জয়পুরে কী হচ্ছে, খবর রাখো? কেরামতের গান ভালো করা বোঝে। বুঝলা? ভালো করা বোঝে।
তা যুধিষ্ঠির হলো কর্মকারের বেটা। বাবুদের পায়ের তলায় পড়ে থাকে। শরাফত মণ্ডলের জমি বর্গা করলো, সেখানেও সুবিধা করতে পারলো না। গানের রহস্য ভেদ করা কী তার মাথায় কুলায়?