প্রদীপ কহিল,—“অজয়ের সঙ্গে গেলে না? নিলো না বুঝি?”
নমিতা রুখিয়া উঠিল : “কোথায় মরতে যাব ওর সঙ্গে? তার চেয়ে এই আমার ঢের ভালো।” বলিয়া ভোলা জালাগুলি সে বন্ধ করিতে লাগিল : “জলে কী হয়েছে দেখুন-ঘরের মধ্যে নদী বইছে। মেঝেটা লেপতে হবে।”
—“এখন থাক।”
—“এখন থাকবে কী! ঘুমুনো যাবে নাকি তা হ’লে? উনুনটুনুও বোধহয় ভেসে গেল। একটা হাক দিন্ না, মথুর কিছু খাবার জোগাড় করে নিয়ে আসুক। টিফিন্-কেরিয়ারে যা ছিল সব উজোর করে খেয়ে গেছে”।
—“তোমার খুব খিদে পেয়েছে নাকি?”
তরলকণ্ঠে নমিতা কহিল,—“আহাহা, রাত্রে যেন আমি কত খাই। আপনার জন্যে বলছি—সারাদিন ত’ পেটে কিছু পড়ে নি। শরীরটা ত’ গেল। যা হোক, উনুটা ধরিয়েছিলাম, ঝড় আর আপনার বন্ধু এসে সব মাটি করে দিল। ডাকুন না মথুরকে।”
একটা ন্যাড়া দিয়া নমিতা ঘর মুছিতেছিল, আভরণহীন সেই হাতখানির দিকে চাহিয়া থাকিয়া প্রদীপ কহিল,—“মথুরকে ডেকে কাজ নেই। সত্যি আমার একটুও খিদে পায় নি।”
—“না, পুরুষমানুষের খিদে না পেয়ে পারে? আমার কথা শুনে ত’ আপনার পেট ভরবে না।”
—“সত্যি বলছি, আমার খিদে নেই। কাল খুব ভোরে উঠে না-হয় দুটি বেঁধে দিয়ে।”
—“বেধে আমি এখনই দিচ্ছি। একটিবার মথুবকে ডেকে দিন্ না।“
—“তুমি বাঁধতে গেলেই আমি আলো খাব না। এই আমি শুয়ে পড়লাম।” বলিয়াই প্রদীপ নমিতার নিজের জন্য পাতা বিছানাটার উপর শুইয়া পড়িল : “তোমার বিছানায় শুলাম, নমিতা।”
নমিতা ধীরে কহিল,—“বেশ ত। ঐ, জালাটা খুলে গেল। শিগগির বন্ধ কবে দিন। নইলে এক্ষুনি ভীষণ ঠাণ্ডা লেগে যাবে। একেই ত’ আপনার শরীরটা ভালো নেই—”
জাল্লাটা বন্ধ করিয়া প্রদীপ আবার বিছানায় শুইয়া পড়িল। নিতান্ত ছেলেমানুষের মত আবদারের সুরে কহিল,—“কাল থেকেই মাথাটা কেমন ধরে’ আছে, নমিতা”
নমিতা শুধু কহিল,—“যাচ্ছি। আমার এই হ’ল বলে।”
প্রদীপ অসাড় হইয়া চক্ষু বুজিয়া পড়িয়া রহিল। কতক্ষণ পরে নমিতা শিয়রের কাছে আসিয়া স্নেহার্দ্র কণ্ঠে কহিল,—“বালিশের ওপর মাথাটা ভালো করে রাখুন। কোনখানটায় ধরেছে?” বলিয়া সে প্রদীপের শিয়র ঘেঁসিয়া পা গুটাইয়া বসিল। প্রদীপ একবার ভালো করিয়া নমিতার মুখ দেখিতে চেষ্টা করিল, কিন্তু সে আগেই লণ্ঠনটা নিবাইয়া দিয়াছে। অন্ধকারে সেই মুখের বিন্দুমাত্র আভাস পাওয়া গেল না।
নমিতা প্রদীপের কপালের উপর স্নিগ্ধ আঙুলগুলি ধীরে বুলাইতে বুলাইতে কহিল,—“কপালটা টিপে দিই, কেমন? একটু ঘুমুবার চেষ্টা করুন। এ কয়দিন ত’ শরীরের ওপর আর কম অত্যাচার হয় নি।”
প্রদীপ কহিল,—“আমি ঘুমিয়ে পড়ব কি! আর তুমি?”
–“পরে আমিও না হয় ঘুমিয়ে পড়ব। এমন বৃষ্টিতে শরীর ভেঙে ঘুম নেমে আসবে।”
—“তুমি এখানে শোও; আমি আমার বিছানায় যাই।”
নমিতা প্রদীপের ললাটের উপর করতলটি বিস্তৃত করিয়া স্থাপন করিয়া কহিল,—“এখানে একা শুতে আমার ভয় করবে যে।”
কপালের উপর নমিতার ঠাণ্ডা হাতখানি মুঠির মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া। প্রদীপ কহিল,—“তবে?”
প্রদীপের করতলের মধ্যে নিজের ভীরু হাতখানি ছাড়িয়া দিয়া নমিতা বলিল,-“তবে আর কি? ঘুম পেলে কখন একসময় আপনারই পাশে শুয়ে পড়বে না হয়।”
—“আমার পাশে?”
—“হ্যাঁ, আপনাকে আমি ভয় করি নাকি?” নমিতার কথার সুরে একটুও রুক্ষতা নাই,ভারি কোমল, আর্দ্র কণ্ঠস্বর!
এই ভাবে বসিবার সুবিধা হইতেছিল না; নমিতা বিছানার উপর পা তুলিয়া ঠিক করিয়া বসিতে না বসিতেই প্রদীপ বালিশটা তাড়াতাড়ি ঠেলিয়া দিয়া তাহার বিস্তৃত কোলের উপর মাথাটা তুলিয়া দিল। নমিতা কিন্তু মাথাটা নামাইয়া রাখিল না। স্নেহ-আনত দুইটি আয়ত চক্ষু প্রদীপের মুখের উপর নিবদ্ধ করিয়া অকুণ্ঠিত আবেগে তাহার কপালে ও গালে হাত বুলাইতে লাগিল।
প্রদীপ কহিল,-“তোমার প্রতি অনেক দুর্ব্যবহার করেছি, নমিতা—”
জোরে একটু হাসিয়া নমিতা বলিল,-“তার শাস্তিই ত’ এখন পাচ্ছেন।”
প্রদীপ নমিতার একখানি হাত ধরিয়া ফেলিয়া একেবারে বুকের মধ্যে গুঁজিয়া ফেলিল; কহিল,-“বিধাতা সবারই জন্যে সমান পথ তৈরি করে রাখেন নি–”
নমিতা কহিল,—“কারুর জন্যেই পথ তিনি তৈরি করে রাখেন না। পথ সৃষ্টি করবার গৌরবও যদি আমাদের না থাকে তবে চল্বার আমাদের আর আনন্দ কোথায়?”
—“আমার জন্যে এই ভুবন-ভরা খাতুর উৎসব—”।
–“আর কারুর জন্যে বা ঘন-গহন অন্ধকার!”
—“আমার জন্যে তোমার প্রেম, এই যৌবন, এই অগ্নিশিখা।” বলিয়া মুহমান প্রদীপ সহসা নমিতাকে বুকের মধ্যে আকর্ষণ করিয়া তাহার চিবুকে অধরে চোখের পাতায় চোখের নীচে অজস্র চুম্বন করিতে লাগিল।
প্রতিরোধ করিবার সমস্ত শক্তি নমিতা হারাইয়া ফেলিয়াছে। সে যে নিষ্প্রাণ একটা দেহপিণ্ড! ঝড়ের রাত্রে সে যেন অসহায় পৃথিবী!
বুকের উপর নমিতার আলুলিত রুক্ষ চুলগুলিতে হাত বুলাইতে বুলাইতে প্রদীপ কহিল,—“যে যা বলে বলুক নমিতা, আমরা ধূলির ধরণীতে স্বর্গ আবিষ্কার করব—আমাদের প্রেমে, সহকর্মিতায়। আমি কবি, তুমি আমার আকারময়ী কল্পনা! নমিতা!”
নমিতা তাড়াতাড়ি মুখ তুলিয়া কহিল,—“সারা রাত ভরেও কথা কয়ে শেষ করতে পারবেন না। শেষই যেন তার না থাকে। এই কথা আপনার অক্ষরে ফুটে উঠুক। আনন্দের কথা সন্ধ্যার বর্ণচ্ছটার মত মিলিয়ে যায়, কিন্তু ব্যর্থতার কথা রাত্রির অন্ধকারে তারা হয়ে অক্ষয় অক্ষরে জেগে থাকে!”
প্ৰদীপ নমিতার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। বিস্রস্ত অবগুণ্ঠনের নীচে সে-মুখোনিতে অসীম বেদনার মেঘছায়া মাখিয়া রহিয়াছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে চুপ করিয়া পড়িয়া রহিল।
নমিতা বলিল,—“মনটাকে খানিকক্ষণ একেবারে কঁকা রাখুন, আপনিই ঘুম এসে যাবে। আমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আপনি না ঘুমুলে আমি কি করে শুই।”
প্রদীপ কহিল,—“তুমি কি আমাকে একবারো তুমি বলবে না?”
কিছু কাল স্তব্ধ থাকিয়া হঠাৎ নমিতা নত হইয়া মুখটা প্রদীপের কানের কাছে নিয়া গিয়া অতি গাঢ়কণ্ঠে ডাকিল : “তুমি, তুমি, তুমি!”
—“এবার যদি আমি মতামও নমিতা, আমার দুঃখ থাকতো না।”
নমিতা বলিল, “নিশ্চয়। তোমার জন্যে এই অলস আবেগময় মৃত্যু, কারুর জন্যে বা কন্টকত কদৰ্য জীবন। প্রেমহীন আশ্বাসহীন কঠোর মুহূর্ত। কিন্তু, আর নয়, এবার ঘুমুও।”
প্রদীপ নিঃশব্দে নমিতারই কোলের উপর মাথাটা কাৎ করিয়া ঘুমাইবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
এক সময়ে স্পষ্ট বুঝিল নমিতা আর হাত বুলাইতেছে না—স্তব্ধ। হইয়া পাষাণ-প্রতিমার নিশ্চল অটুট ভঙ্গিতে বসিয়া আছে। তার পর নমিতা যে আর কী করিল বোঝা গেল না। প্রদীপ ততক্ষণে গাঢ় নিদ্রায় ঢলিয়া পড়িয়াছে।
ধীরে ধীরে প্রদীপের মাথাটা বালিশের উপর নামাইয়া রাখিয়া নমিতা উঠিয়া পড়িল। দক্ষিণের জানালাটা খুলিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রাত্রি অনেক হইয়াছে—আকাশে মেঘ কাটিয়া বিবর্ণ ঘোলাটে জ্যোৎস্না ফুটিয়াছে। ভোর হইয়াছে ভাবিয়া কয়েকটা কাক এখানে-সেখানে চীৎকার করিতেছিল। নদীতে দু’ একটি নৌকাও দেখা যায়। কোথায় একটি বাতি জ্বলিতেছে-না-জানি কত দূরে!
ঘাটে যেখানে নৌকার যাত্রী লইয়া দূর ষ্টিমার-ষ্টেশনে পৌঁছাইয়া দিবার জন্য সৰ্ব্বদা গাদি করিয়া থাকে সেই ঘাটের পথ সে চিনিতে পারিবে ত’? এই রাত্রে নিশ্চয়ই কেহ নৌকা ছাড়িবে না, উত্তরপশ্চিম কোণে এখনো মেঘ আছে। হয় ত’ উহারই বিপদের আশঙ্কায় নৌকা ছাড়িবে না। নমিতার জীবনে আবার বিপদ কিসের? তরঙ্গ-সন্ধুল ফেনোচ্ছসিত নদী যে তাহার বন্ধু, সহযাত্ৰিনী। বিধাতা, আজিকার এই অভিসারে যেন অজয়ের সঙ্গে তাহার দেখা না হয়। সে যেন একাই চলিতে পারে, একাই মরিতে পারে যেন। এই গৰ্বটুকু তাহার নষ্ট করিয়ো না।
এখান হইতে তার পাশা—তার পরে ষ্টিমারে গোয়ালন্দ। সেখানে ট্রেন দাঁড়াইয়া আছে। তার পর কলিকাতা। তার পর? এখানে বসিয়া থাকিলেও, তার পর? ক্ষণকালবিহারী মানুষের চিত্তে ইহার সমাধান কোথায়!
একেবারে একা—সঙ্গীহীন। সম্মুখে পথ—মুহূৰ্ত্ত হইতে মহাকালে। নমিতা একবার ফিরিয়া দাঁড়াইল। যাইবার সময় ঐ ঘুমন্ত অসহায় প্রদীপের চেহারা দেখিয়া তাহার মমতার আর অন্ত রহিল না। একবার সাধ হইল নিজে ইচ্ছা করিয়া প্রদীপের কপালে অস্ফুট একটি বিদায়-চুম্বন উপহার দিয়া আসে; গভীর শব্দহীনতায় গোপনে বলিয়া আসে : এই চুম্বনে তোমার ললাট দগ্ধ করে যাই, বন্ধু। আমাদেরই মত তুমি ব্যর্থ হও, ধন্য হও।
কিন্তু না, যদি জাগিয়া উঠে! যদি দুই ব্যাকুল বাহু-বন্ধনে তাহাকে বন্দী করিয়া রাখিতে চায়! যদি এই অবসন্ন জ্যোৎস্নাটুকুর মতই তাহার সকল সঙ্কল্প স্তিমিত হইয়া আসে!
নমিতা বাহির হইয়া আসিল।
সমস্ত পাড়া নিঝুম। মাঠে জল জমিয়াছে। সেই জল ভাঙিয়া নমিতা অগ্রসর হইল। পথ সে ভাল করিয়া চিনে না, কিন্তু পথ তাহাকে খুঁজিয়া লইতে হইবে। এক পথ হইতে অন্য পথে, এক দিনের পর অন্য রাত্রে। থামিবার সময় কোথায়?
কিছুদূর অগ্রসর হইতেই দূরে কাহাকে যেন দেখা গেল। কে যেন তাহাকে হাতছানি দিয়া ডাকিতেছে। নমিতা থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। লোকটা তবু তাহাকে সঙ্কেত করিতেছে। তাহারই সম্মুখীন না হইয়া নমিতা আর যায় কোথায়?
আরো খানিকটা কাছে আসিতেই লোকটাকে চিনিতে পারিয়া নমিতার সর্বদেহ ভয়ে ও উত্তেজনায় কাঁপিয়া উঠিল। এ যে তাহার স্বামী–সুধী! রাণীগঞ্জে শালবনে সেইদিন যে-পোষাকে বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলেন পরনে সেই পোষাক। মুখে সেই অম্লান হাসিটি; তেমন করিয়া বাঁ হাতে কোঁচাটা তুলিয়া ধরিয়াছেন।
যেন সেই মূর্তি তাহাকে বলিল : “এস আমার সঙ্গে।”
আর একটু আগাইয়া হাত বাড়াইয়া দিলেই যেন নমিতা সে-মূর্তিকে ধরিয়া ফেলিবে। নমিতা ত্বরিত পদে পথ চলিতে লাগিল, কিন্তু তবুও তাহার নাগাল পাইল না।
নমিতা চীৎকার করিয়া উঠিল : “কোথায় আমাকে নিয়ে যাচ্ছ?”
সে-মূর্তির কণ্ঠ হইতে স্পষ্ট উত্তর আসিল: “এস আমার সঙ্গে। তোমার কিচ্ছু ভয় নেই।”