কবিতা : অন্তর হতে আহরি বচন
উনিশশতকের প্রথমার্ধ ভরে চলে গদ্যের রাজত্ব; সবদিকে কেবল গদ্যের পতাকা উড়তে থাকে। সে-সময়ে গদ্যই সম্রাট। যেদিকে তাকাই গদ্য আর গদ্য; গদ্যের মহাসমুদ্রে অবিরাম ঢেউ উঠছে আর ভেঙে পড়ছে। এ-সময়ে চলছিলো কবিতার আকাল। কোনো ফসলই ফলছিলো না কবিতার। বাঙলাদেশে এমনটি আর দেখা যায় নি। যদি কবিতাই না থাকে, তবে থাকলে কী বাঙলা সাহিত্যের! বাঙলা সাহিত্যের দেবী চিরকাল কাব্যজীবী, কবিতার স্বাদ ছাড়া সে বাঁচতেই পারে না। কিন্তু উনিশশতকের প্রথমার্ধে সে-দেবীই হয়ে ওঠে গদ্যমুখর, যা বলে সব বলে গদ্যে। তার কণ্ঠে সুর নেই, গান নেই, ছন্দ নেই। ওই সময়টা কর্মীদের কাল। দশকেদশকে জন্ম নিচ্ছিলেন কর্মীরা; আর গদ্য ছিলো তাঁদের কর্মের হাতিয়ার। তখনো বাঙলার স্বাপ্লিকেরা জন্ম নেন নি। ওটা স্বপ্নের সময় ছিলো না। ওই স্বপ্নহীন সময়ের একমাত্র কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত [১৮২২-১৮৫৯]। তাঁর চোখেও স্বপ্ন ছিলো না; ছিলো বাস্তব জগৎ, আর বাস্তবের সংবাদ। তিনি ছিলেন “সম্বাদ প্রভাকর”-এর বিখ্যাত সম্পাদক। তিনি ছিলেন পুরোনো রীতির কবি। যাকে বলে আধুনিকতা, তা তাঁর কবিতায় ফোটে নি, কেবল আধুনিক বাতাস এসে লেগেছিলো তার কবিতার শরীরে ও মনে।
কবি ঈশ্বর গুপ্ত। তিনিই উনিশশতকের প্রথমার্ধের একমাত্র কবি আমাদের। তাঁর কবিতা ছিলো হাল্কা, ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরা। তাঁর কবিতায় কল্পনার স্থানও ছিলো না। ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন আধুনিক কালের মানুষ। কিন্তু তিনি আধুনিকতাকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করতে পারেন নি। এ-কবির দৃষ্টিও ছিলো একটু বাঁকা; তিনি সবকিছু দেখতেন বাঁকা চোখে, আর ব্যঙ্গবিদ্রুপে ভরে তুলতেন কবিতা। ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার বিষয়ও ছিলো চমৎকার; – তপসে মাছ থেকে শুরু করে ইংরেজদের ককটেল পার্টি সবকিছু ছিলো তাঁর কবিতার বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাকে বলেছেন ‘খাঁটি বাঙালি। আধুনিক কালে অবশ্য ‘খাঁটি বাঙালি হওয়া খুব প্রশংসার ব্যাপার নয়। তাঁর কবিতায় আগের কালের কবিওয়ালাদের প্রভাব বেশ গভীর।
ঈশ্বর গুপ্তের কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। তা হলো কবির হাস্যরসিকতা। তিনি সবকিছু থেকে হাস্যরস আহরণ করেন, দুঃখের মধ্যেও তাঁর হাসি থামে না। তাঁর একটি বড়ো দুঃখের কবিতা থেকে কিছু অংশ তুলে দিচ্ছি। কবিতাটির নাম “পৌষপার্বণ”। কবি বড়ো দুঃখের কথা বলেছেন :
এবার বছরকার দিন, কপালে ভাই,
জুটলো নাকো, পুলি পিঠে।
যে মাগগির বাজার, হাজার হাজার,
মোর্তেছে লোক, কপাল পিটে।।
কবি কিন্তু খুব চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর একটি কবিতায় এক ইংরেজ রমণীর। তিনি লিখেছেন :
বিড়ালাক্ষী বিধুমুখী মুখে গন্ধ ছোটে।
আহা তায় রোজ রোজ কতো রোজ ফোটে।।
উনিশশতকের প্রথমার্ধের শেষদিকে দেখা দেন আরেকজন কবি। তিনি ঈশ্বর গুপ্তের চেয়ে কিছুটা আধুনিক; কিছুটা নয়, অনেকটা। তবে তিনি খাটি কবি ছিলেন না। তাঁর নাম রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর পদ্মিনী-উপাখ্যান নামক একটি আখ্যায়িকা কাব্য বের হয় ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে। কাব্যটিতে আছে অনেক ঘটনা, অনেক উপমা। তিনি কাব্যের কাহিনী আহরণ করেছিলেন টডের রাজস্থান-কাহিনী নামক একটি বই থেকে। এ-কাব্যটিতেই আছে সেই বিখ্যাত চরণগুলো স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়? দাসত্ব শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়? তবে পদ্মিনী-উপাখ্যান আধুনিক কবিতাকে বেশিদূর এগিয়ে নিতে পারে নি। এ-কবির আরো কয়েকটি কাব্য হচ্ছে কর্মদেবী (১৮৬২), শূরসুন্দরী (১৮৬৮), কাঞ্চীকাবেরী (১৯৭৯)।
বাঙলা কবিতায় আধুনিকতা আনেন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩]। শুধু কবিতায় নয়, তিনি আধুনিকতা আনেন নাটকে, প্রহসনে। তাঁর মতো প্রতিভাবান কবি বাঙলা সাহিত্যে আছেন মাত্র আর একজন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করে বাঙলা কবিতার রূপ বদলে দিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বা রঙ্গলালের পর তার আগমন অনেকটা আকস্মিক। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন মাত্র কয়েক বছর, ধূমকেতুর মতো তিনি চোখ ধাধিয়ে এসেছেন, কতোগুলো সোনার ফসল ফলিয়েছেন, এবং হঠাৎ বিদায় নিয়েছেন। বাল্যকালে তিনি বাঙলা সাহিত্যের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করেন নি। কবি মধুসূদনের জীবন একটি বিয়োগান্তক নাটকের চেয়েও বেশি শিহরণময়, বেশি করুণ। ছেলেবেলা থেকেই তাঁর সাধ ছিলো বড়ো কবি হওয়ার; তবে বাঙলা ভাষার নয়, ইংরেজি ভাষার। ইংরেজি তিনি শিখেছিলেন ইংরেজের মতো, কবিতাও লিখেছিলেন ইংরেজিতে। ধর্ম বদলে হয়েছিলেন খ্রিস্টান, নাম নিয়েছিলেন মাইকেল। বিয়ে করেছেন দুবার, দুবারই বিদেশিনী। আবাল্য তিনি ছিলেন উদ্ধৃঙ্খল, হিশেব করা কাকে বলে তা তিনি জানতেন না। জীবনে তিনি অর্জন করেছেন অনেক টাকা, কিন্তু তাঁর জীবন সমাপ্ত হয়েছে দারিদ্রে। সব মিলে মধুসূদন তুলনাহীন। বিলেত যাওয়ার জন্যে তিনি ছিলেন পাগল। একটি ইংরেজি কবিতায় তাঁর আবেগ তীব্রভাবে তিনি প্রকাশ করেছেন; বলেছেন, “আই শাই ফর অ্যালবিঅনস ডিসট্যান্ট শোর’, অর্থাৎ ‘শ্বেতদ্বীপ তরে পড়ে মোর আকুল নিশ্বাস। তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখেছিলেন দুটি দীর্ঘ কাব্য; একটির নাম ক্যাপটিভ লেডি, অপরটির নাম ভিশনস অফ দি পাস্ট। কিন্তু মধুসূদন বুঝেছিলেন তিনি যে-অমরতা কামনা করেন, তা লাভ করা যাবে না ইংরেজিতে লিখে। তাই তিনি হঠাৎ আসেন বাঙলা কবিতার ভুবনে। তিনি আসেন, দেখেন, জয় করেন। একটি চতুর্দশপদী বা সনেটে মধুসূদন বাঙলা কবিতার রাজ্যে আসার কথা বলেছেন। তার কিছু অংশ :
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন-–
তা সবে (অবোধ আমি) অবহেলা করি,
পর-ধন-লোভে মত্ত, করিনু ভ্রমণ
পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।
কাটাইনু বহুদিন সুখ পরিহরি।
কবি মধুসূদন বাঙলা কবিতার ভুবনে আসেন ১৮৫৯ অব্দে তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য নামে একটি চার-সর্গের আখ্যায়িকা কাব্য নিয়ে। কাব্যটি বাঙলা কবিতার রাজ্যে নতুন। ভাব ভাষা প্রকাশরীতি সবদিকেই। তবু এটি মধুসূদনের প্রতিভার পরিচায়ক নয়। তাঁর প্রধান এবং বাঙলা কবিতার অন্যতম প্রধান কাব্য মেঘনাদবধকাব্য। প্রকাশিত হয় ১৮৬১ অব্দে। এ-কাব্য প্রকাশের সাথেসাথে স্বীকার করে নিতে হয় যে তিনি বাঙলার মহাকবিদের একজন। এটি একটি মহাকাব্য। নয় সর্গে রচিত এ-কাব্যের নায়ক রাবণ। মধুসূদন নতুন কালের বিদ্রোহী; তিনি চিরকাল দণ্ডিত রাবণকে তাই করে তোলেন তাঁর নায়ক। রাম সেখানে সামান্য। রাবণের মধ্য দিয়ে মধুসূদন তোলেন তাঁর সমকালের বেদনা দুঃখ আর ট্র্যাজেডি। মধুসূদন তার কাব্যের কাহিনী নিয়েছিলেন রামায়ণ থেকে; সীতা হরণ এবং রাবণের পতন এ-কাব্যের বিষয়। কিন্তু তাঁর হাতে এ-কাহিনী লাভ করে নতুন তাৎপর্য। হয়ে ওঠে অভিনব মহাকাব্য, বাঙলা ভাষায় যার কোনো তুলনা নেই।
এ-কাব্যে তিনি আর যা মহৎ কাজ করেন, তা হচ্ছে ছন্দের বিস্তৃতি। তিনি চিরদিনের বাঙলা পয়ারকে নতুন রূপ দেন। আগে পয়ার ছিলো বহুব্যবহারক্লান্ত ছন্দোরীতি। মধুসূদন পয়ারকে প্রচলিত আকৃতি থেকে মুক্তি দিয়ে করে তোলেন প্রবহমাণ। একে অনেকে বলেন ‘অমিত্রাক্ষর ছন্দ’। পয়ার এমন :
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে শশানে পুণ্যবান।।
আগে কবিরা চোদ্দ মাত্রার প্রতিটি চরণের শেষে এসে থেমে পড়তেন। প্রথম চরণের শেষে দিতেন এক দাঁড়ি, দ্বিতীয় চরণের শেষে দু-দাঁড়ি। এ-ভাবে শ্লথগতিতে কাব্য এগিয়ে চলতো। কবিরা তখন ছিলেন ছন্দের দাস, যা তারা বলতে চাইতেন পারতেন না বলতে; কেননা প্রতি চরণের শেষে তাঁদের জিরোতে হতো। কবি মধুসূদন ছন্দের এ-শৃঙ্খলটাকে ভেঙে ফেলেন। তিনি ছন্দকে করেন কবির বক্তব্যের অনুগামী। উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে :
সম্মুখ সমরে পড়ি, বীর-চূড়ামণি
বীরবাহু, চলি যবে গেলা যমপুরে
অকালে, কহ, হে দেবি অমৃতভাষিণি,
কোন বীরবরে বরি সেনাপতি-পদে,
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষঃকুলনিধি
রাঘবারি?
পংক্তিগুলো পাওয়া যাবে মেঘনাদবধকাব্য-এর শুরুতেই। এখানে প্রতি চরণে চোদ্দ মাত্রা ঠিকই আছে, কিন্তু প্রতি চরণে বক্তব্য না থেমে থেমেছে সেখানে, যেখানে শেষ হয়েছে বক্তব্য। এটি ছন্দের ক্ষেত্রে একটি বিশাল ঘটনা। মধুসূদন মুক্তি দেন বাঙলা ছন্দকে; পয়ারকে করে তোলেন প্রবহমাণ। একে নির্ভর করে অনেক বিবর্তন ঘটেছে বাঙলা ছন্দের।
তিলোত্তমাসম্ভবকাব্য এবং মেঘনাদবধকাব্য ছাড়া মধুসূদন আরো লিখেছেন ব্রজাঙ্গনাকাব্য (১৮৬১), বীরাঙ্গনাকাব্য (১৮৬২), এবং চতুর্দশপদী কবিতাবলী (১৮৬৬)। “ব্রজাঙ্গনা” রাধার বিরহ নিয়ে রচিত কাব্য। এ-কাব্যে আছে কিছু চমৎকার লিরিক বা গীতিকবিতা। তার একটি অংশ :
কেন এতো ফুল তুলিলি, সজনি–
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হলে পরে কি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে কুসুম রতনে
ব্রজের বালা?
মধুসূদনের বীরাঙ্গণা এক অসাধারণ অভিনব কাব্য। বাঙলা ভাষায় মধুসূদন সর্বপ্রথম রচনা করেন সনেট, তিনি যার নাম দিয়েছিলেন “চতুর্দশপদী কবিতা”। ১৮৬০ সালে তিনি প্রথম সনেট লেখার কথা ভাবেন, এবং একটি সনেট রচনাও করেন। এটিই পুরে পুনর্লিখিত হয়ে নাম পায় বঙ্গভাষা’। মধুসূদন সনেট লিখেছিলেন ফ্রান্সের ভার্সাই শহরে বসে। তখন তিনি ছিলেন পরবাসী, দারিদ্রপীড়িত। তাই এ-সনেটগুলোতে তাঁর মনের আবেগ, অনুভূতি, বেদনা থরেথরে প্রকাশিত হয়েছে। মধুসূদনকে আমরা জানি অলঙ্কারশোভিত ঘনঘটাময় মহাকাব্যের নৈব্যক্তিক কবি বলে। তাঁর ছিলো একটি অতি সকাতর চিত্ত, যা সাধারণত থাকে রোমান্টিক কবিদের। মধুসূদন বাঙলা কবিতাকে মধ্যযুগ থেকে নিয়ে আসেন আধুনিক কালে। সৃষ্টি করেন অমর কবিতা।
মধুসূদনের পরে বাঙলা কবিতায় দেখা দেয় অনুকৃতি, বৈচিত্র্যহীনতা। মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করেছেন, তাই তাঁর পরে অনেকে চেষ্টা করেন মহাকাব্য লিখে মহাকবি হ’তে। এর ফলে বাঙলা কবিতায় দেখা দেয় এক শ্রেণীর দীর্ঘ আখ্যায়িকা কাব্য, যেগুলো দেখতে মহাকাব্যের মতো, কিন্তু মহাকাব্য নয়। মহাকাব্য প্রতিবছর রচনা করা যায় না; মহাকাব্য রচিত হতে পারে কয়েকশো বছরে একটি। এছাড়া আধুনিক কাল মহাকাব্যের কালও নয়। মধুসূদনপরবর্তী কবিরা এ-কথাটি বুঝতে পারেন নি। বা পারলেও তাদের ক্ষমতা ছিলো না কবিতার দিক বদল করতে। তাই তাঁরা আপ্রাণ অনুসরণ করেন মধুসূদনকে। দেখতে মহাকাব্যের মততা, কিন্তু আসলে তা নয়, এরকম কাব্য লেখেন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৩৮-১৯০৩), নবীনচন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯), কায়কোবাদ [১৮৫৭-১৯৫১), এবং আরো অনেকে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন বীরবাহুকাব্য (১৮৬৪), বৃত্রসংহার (১৮৭৫-১৮৭৭)। তাঁর কিছু খণ্ডকবিতাও আছে। নবীনচন্দ্র সেন লেখেন পলাশির যুদ্ধ (১৮৬৬), ক্লিওপেট্রা (১৮৭৭), রঙ্গমতী (১৮৮০) এবং রৈবতক (১৮৮৬), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩), প্রভাস (১৮৯৬)। তিনি কিছু ক্ষুদ্র কবিতাও রচনা করেছিলেন, সেগুলো সংগৃহীত হয়েছিলো অবকাশরঞ্জিনী (১৮৭১) নামক কাব্যে। কায়কোবাদ মহাকবি হওয়ার জন্যে লিখেছিলেন মহাকাব্য, যদিও তাঁর মনটি ছিলো গীতিকবির। তিনি ছিলেন আবেগী, গীতিকবিতার চর্চা করলে তিনি আরো কবি হ’তে পারতেন। তিনি পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ অবলম্বনে রচনা করেন মহাশ্মশান কাব্য (১৯০৪)। তাঁর অন্যান্য কাহিনীকাব্য হচ্ছে মহররমশরিফ কাব্য (১৯৩২), শিবমন্দির (১৯৩৮)। তাঁর খণ্ডকবিতার বই বিরহবিলাপ (১৮৭০), অশ্রুমালা (১৮৯৫)। এ-সময়ে আর যারা কবিতা লিখেছেন তাঁদের মধ্যে আছেন শিবনাথ শাস্ত্রী, অক্ষয় চৌধুরী, ঈশানচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাঙলা কবিতায় যখন মহাকাব্যের ঘনঘটা চলছিলো, তখন এক লাজুক নির্জন কবি নিজের মনের কথা নিজের সুরে ধ্বনিত করেন। কবি নিজের আবেগে বিভোর, তাঁর চারদিকে কী আছে সেদিকে খেয়াল নেই। তিনি বাস করছেন নিজের অন্তরঙ্গলোকে; তিনি কারা উদ্দেশে কিছু বলেন না, শুধু গুণগুণ করেন নিজেকে নিজের কাছে। এ-কবির মধ্যে সর্বপ্রথম দেখা দেয় রোম্যান্টিকতা, যা একদিন বাঙলা কবিতাকে অধিকার করে নেয়। একবির নাম বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৪)। যে-কবি নিজের মনের কথা বলেন, যেকবি অদ্ভুতকে, সুন্দরকে, রহস্যকে আহ্বান করেন, যে-কবি যা পান না বা পাবেন না, তা চেয়েচেয়ে জীবন কাটান, তিনি রোম্যান্টিক কবি। বিহারীলাল বাঙলা কবিতার প্রথম রোম্যান্টিক কবি, প্রথম খাঁটি আধুনিক কবি। তার পথ ধরে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিহারীলালকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন বাঙলা কাব্যের ‘ভোরের পাখি’। ভোরের পাখি সূর্যোদয়ের আগে একাকী জাগে, মনের আনন্দে গান গায়, সূর্য ওঠার পর সে আর থাকে না। বিহারীলালও তেমনি, একাকী নিজের মনের গীতিকা সুরে বেঁধেছিলেন তিনি; তবে ভোর হওয়ার পরও তিনি আছেন। বিহারীলালের কবিতা পড়লে মনে হয় কবি বাস করছেন দিগদিগন্তব্যাপী। আবেগের কাতরতার মধ্যে, স্বপ্নের মধ্যে। ওই তাঁর বিশেষত্ব। তিনি স্বপ্নলোকের অধিবাসী, বাস্তবতা তাঁর অচেনা। তিনি বাঙলা কবিতার প্রথম ধাপ-না-খাওয়া কবি। তিনি একটি নতুন রোম্যান্টিকধারার প্রবর্তক হিশেবে চিরস্মরণীয়। বিহারীলালের মধ্যে রোমান্টিক আবেগের প্রাচুর্য রয়েছে, কিন্তু নেই সে আবেগকে রূপ দেয়ার শক্তি। এ-আবেগকে পরে রূপ দিয়েছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ, বিহারীলালের শিষ্য। বিহারীলাল এমন কিছু স্তবক ও পংক্তি লিখে গেছেন, যেগুলো বাঙলা কবিতার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
বিহারীলালের কবিতার বই আছে অনেকগুলো : সঙ্গীতশতক (১৮৬২), প্রেমপ্রবাহিণী (১৮৭০), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গ সন্দর্শন (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১২৮৬), সাধের আসন। এর মধ্যে যে-দুটি বই বিহারীলালের খ্যাতির কারণ, সেদুটি বঙ্গসুন্দরী এবং সারদামঙ্গল। বঙ্গসুন্দরী কাব্যে বিহারীলাল সর্বপ্রথম রোম্যান্টিক হাহাকার নিয়ে সবার সামনে উপস্থিত হন। এ-হাহাকার তীব্র, কবির আবেগে পাঠকও ভেসে যায়। অকারণ বেদনা হচ্ছে রোম্যান্টিক কবিতার একটি বড়ো লক্ষণ। কবি বেশ সুখে আছেন তবু সুখ পাচ্ছেন না, কেননা তিনি অসুখী তা তিনি নিজেও জানেন না। বিহারীলালের কবিতা থেকে তেমন চরণ তুলে আনি :
সর্বদাই হুহু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন,
চারিদিকে ঝালাপালা,
উঃ কি জ্বলন্ত জ্বালা!
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গ পতন।
কবির এ-জ্বালার কোনো কারণ নেই, তাইতো এ-জ্বালা অসহ্য। কবি বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ কাব্যের নাম সারদামঙ্গল। এ-কাব্যে তাঁর রোম্যান্টিক আকুলতা চরণেচরণে প্রকাশ পেয়েছে, যদিও সর্বত্র তা রূপ পায় নি। কবি এ-কাব্যে এতো রকমের স্বপ্ন দেখেছেন, এতো রকমের আবেগ প্রকাশ করেছেন যে কাব্যটি পড়ে বুঝতে কষ্ট হয় কবি কী বললেন। মনের আবেগে তিনি চরণের পরে চরণ রচনা করেছেন, একবারও ভাবেন নি পাঠকদের কথা। তবে কাব্যটির আছে ভালোভালো গীতিকবিতা, পাঠকের জন্যে ওইটুকু কম লাভ নয়। বিহারীলালের মধ্যে একজন বড়ো কবি বাস করতেন, কিন্তু সে-কবি আত্মপ্রকাশ করতে পারেন নি। আবেগের ঘনমেঘে সে চিরদিন অদৃশ্য রয়েছে। বিহারীলাল বাঙলা ভাষার বিশুদ্ধ কবিদের একজন।
বিহারীলালের অন্তরঙ্গ কবিতার পথ ধরে এসেছিলেন অনেক কবি। তাঁদের কয়েকজন : সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার (১৮৩৮-১৮৭৮), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৪০-১৯২৬), দেবেন্দ্রনাথ সেন (১৮৫৮-১৯২০), গোবিন্দচন্দ্র দাস (১৮৫৫-১৯১৮), অক্ষয়কুমার বড়াল (১৮৬০-১৯১৯), দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৮৬৩-১৯১৩), এবং রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১)। সুরেন্দ্রনাথের কাব্যের নাম মহিলা, দ্বিজেন্দ্রনাথের কাব্যের নাম স্বল্পপ্রয়াণ, গোবিন্দচন্দ্র দাসের কাব্যের নাম প্রেম ও ফুল, শোকোচ্ছাস, মগের মুলুক। তিনি প্রতিবাদী কবি ছিলেন। দেবেন্দ্রনাথ সেনের কাব্যের নাম ফুলবালা, অশোকগুচ্ছ গোলাপগুচ্ছ, পারিজাতগুচ্ছ, শেফালিগুচ্ছ। অক্ষয়কুমার বড়ালের কাব্যের নাম এষা। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্যের নাম আর্যগাথা, আষাঢ়ে, হাসির গান, মন্দ্র, আলেখ্য।