২৩. উত্তরকথন (অপারেশন ওয়ারিস্তান)
কমনওয়েলথ অফ বাহামাস। নিউ প্রভিডেন্স আইল্যান্ড।
নাসাউ। ৫ অক্টোবর। সকাল সাড়ে সাতটা।
.
নাসাউয়ের লোকাল বাসকে জিটনি বলে। লিনডেন পিন্ডলিং ইন্টারন্যাশন্যাল এয়ারপোর্ট থেকে দশ মাইল দূরে, সমুদ্রের ধার দিয়ে, জিটনি চড়ে বে স্ট্রিট দিয়ে যাচ্ছে রকি। পরনে কারগো আর টি শার্ট। হাতে ট্যাব। রকির পাশে বসে কিয়ারা। সে হটপ্যান্ট আর টি শার্ট পরে। রকির মুখ শুকনো। কিয়ারা হাসিখুশি। সে রকির গালে হাত বুলিয়ে বলল, ‘স্মাইল রকি! এভরিথিং উইল বি অলরাইট!’ রকি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘শাটাপ!’ তারপর ট্যাবে মুখ রেখে নীচু গলায় বলল, ‘বলো গ্রিনবার্গ।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে গ্রিনবার্গ বলে, ‘টু কাট আ লং স্টোরি শর্ট, রাজু ইজ নো মোর। তোমার চেষ্টা ব্যর্থ হল রকি।’
‘রাজু মারা গেছে? কী করে?’ রকি উত্তেজিত।
‘ওর লাইফলাইন খুলে নেওয়া হয়। বাই দ্য ওয়ে, রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারে তোমার থাকার কথা ছিল।’ গ্রিনবার্গ নিরুত্তাপ।
‘আমি প্রাণে বেঁচে আছি, এটাই যথেষ্ট। দমদম এয়ারপোর্টে যা কাণ্ড হল, তারপরে আমি প্রাণ হাতে নিয়ে কোচির ফ্লাইটে উঠেছিলাম। সিয়োর ছিলাম, কোচিতে নেমেই অ্যারেস্টেড হব! ওপরওয়ালার দয়ায় হইনি। দিপু গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি গাড়িতে বেঙ্গালুরু চলে এসেছি। অপূর্ব কুমার রায়ের পাসর্পোট, ভিসা, অন্যান্য ডকুমেন্ট পুড়িয়ে দিয়েছি।’
‘এখন তোমার কী নাম? বেঞ্জামিন ডি সুজা?’
‘ওসব কথা থাক গ্রিনবার্গ। জিয়া কোথায়?’
‘জিয়া তোমাকে তিনসেট ডকুমেন্ট বানিয়ে দিয়েছিল। অপূর্ব কুমার রায়ের মৃত্যু ঘটেছে। এখন তুমি হয় বেঞ্জামিন, না হয় মনোজ শর্মা।’ রকি আবার প্রশ্ন করে, ‘জিয়া কোথায়?’ উত্তর না দিয়ে গ্রিনবার্গ বলে, ‘তুমি এখন কোথায়?’
‘বেঙ্গালুরুতে। এখানকার কাগজে বা টিভিতে ওই ঘটনার ভালো কভারেজ নেই। তাই তোমাকে ফোন করলাম।’
‘ঘটনা খুব সিম্পল। সিআইএসএফ মেঘনাদ আর বালাজিকে অ্যারেস্ট করে। প্রাথমিক চার্জ ছিল সরকারি কর্মীদের বাধাদান আর ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট। নন-বেলেবল অফেন্স। মেঘনাদ ওর কানেকশান ইউজ করে নিজেকে বাঁচিয়ে নিত। বাধ সাধল বলবিন্দর আর রিনা নামের দুই সিআইএসএফ। ওরা খবরের কাগজে প্রকাশিত বডি স্ক্যানার সংক্রান্ত লন্ডনের রিপোর্টটা ওদের বসকে দেখায়। প্রথমাকে হাসপাতালে ভরতি করে অবজার্ভেশানে রাখা হয়। শি ওয়াজ ড্রাগড। ছ’ঘণ্টার মধ্যে ওষুধের এফেক্ট চলে যায়। ও সব কিছু বলতে শুরু করে। অ্যাক্সিডেন্টের পরে জ্ঞান ফেরা, খবরের কাগজ পড়ে জানা যে বুকের মধ্যে চামচ লুকিয়ে রাখলে এয়ারপোর্টে পুলিশ ধরবে, গণেশের সঙ্গে মোলাকাত—সব! পায়েস খাওয়ানোর সময় সিন্টুকে পালাতে বলেছিল, কেন না সবাই তখন সিন্টুকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। ওই সামান্য সময়ের মধ্যে ও চামচটা বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে!’
‘এগুলো ও কাকে বলল? সিআইএসএফকে, না অন্য কাউকে?’
‘হা-হা! গুড কোয়েশ্চেন রকি। এই কেস ততক্ষণে ইন্ডিয়ার রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকাল উইং বা র’য়ের হাতে চলে গেছে। এর মধ্যে ঢুকে গেছে মিনিস্ট্রি অফ এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স।’
‘এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার্স? বাইরের দেশের হাত আছে, এটা ওরা জেনে গেছে?’
‘হানড্রেড পারসেন্ট। রি-লাইফ মেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের মালিক ডক্টর মেঘনাদ লাহিড়ি এখন জেল কাস্টডিতে। রি-সাইকল মেডিক্যাল সেন্টারের মালকিন লুসি লাহিড়িও জেল কাস্টডিতে। দুটো সেন্টারই পুলিশ সিল করে দিয়েছে। কোথাও এই নিয়ে আলোড়ন নেই। মিডিয়ায় কোনও কভারেজ নেই। হেল্পিং হ্যান্ড নামের একটা এনজিওতে একাধিক ডেডবডি পাওয়া গেছে। এনজিওটা পুলিশ সিল করেছে। ওখান থেকে বুনো নামের একটা লোককে পুলিশ কাস্টডিতে নেওয়া হয়েছে। খড়গপুরের একটা ল্যাবরেটরিকেও ওরা সিল করেছে। তনয়া মিত্র নামের এক মহিলাকে পুলিশ কাস্টডিতে নিয়েছে। দে উইল ক্র্যাক দ্য প্ট সুন।’
‘জিয়া কোথায় গ্রিনবার্গ?’
‘জিয়া মারা গেছে। ওয়ারিস্তানের মিলিটারি ওকে মেরে দিয়েছে।’
‘হায় রে!’ কাতরে ওঠে রকি। গ্রিনবার্গ বলছে, ‘আমি এখন ইন্ডিয়ায়। রাকেশ জৈনের বাড়িতে। জাহাজ বিক্রি না করলে আমার চলবে না। তুমি কি সত্যি বেঙ্গালুরুতে? তাহলে দিল্লি চলে এসো।’
রকি চুপ।
‘ইয়ু আর নট ইন ইন্ডিয়া। তুমি কোথায় রকি? আমি কিন্তু তোমাকে খুঁজে বের করবই।’ গ্রিনবার্গ আরও কী সব বলছিল। না শুনে ফোন কাটে রকি। ট্যাব থেকে সিমকার্ড বার করে ট্র্যাশবিনে ফেলে দেয়। এদিক-ওদিক দেখে ট্যাবটা ফুটপাথে আছড়ে ভেঙে, টুকরোগুলো কারগোর পকেটে পোরে। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন ট্র্যাশবিনে টুকরোগুলো ফেলতে থাকে।
বে স্ট্রিট দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রকি বলল, ‘কিয়ারা, আমি তোমার কাছে এসেছি। কিন্তু আমার কাছে সামান্য কয়েক হাজার ডলার আছে। কীভাবে চলবে?’
জুঁইফুলের মতো দাঁতের পাটি দেখিয়ে কিয়ারা হাসল। ‘বেঁচে থাকতে যেটুকু ডলার লাগে, সেটা আমি বিচ হাউসে কাজ করে কামিয়ে নেব। তুমিও জয়েন করে যাও।’
বে স্ট্রিটের এক পাশে মহার্ঘ্য কোরাল বিচ হাউস। সবুজ সমুদ্র, নীল আকাশ, হলুদ বালি, প্রজাপতি রঙা বিকিনি পরা মেয়েদের জলকেলি—এইসবের মধ্যে ওয়ারিস্তানের প্রাক্তন সেনাপ্রধান রকি চৌধুরী কিয়ারার রেকমেন্ডেশানে হাউস কিপিং-এর কাজে জয়েন করে গেল। যে বিচ হাউসে থেকে সে বাকি জীবন কাটানোর স্বপ্ন দেখত, সেটার বাথরুমের টয়লেট পেপার বদলাতে বদলাতে রকির মনে হল, এখন থেকে তার নাম বেঞ্জামিন ডি সুজা। নিসিম গ্রিনবার্গ তাকে খুঁজছে। সারা পৃথিবী জুড়ে খুঁজছে। রকি জানে, পালানোর পথ নেই। প্রশ্ন এটা নয় যে গ্রিনবার্গের সঙ্গে দেখা হবে কি না। প্রশ্ন এটা যে, কত দেরিতে ‘ডেথ সি শিপ ইয়ার্ড’-এর মালিক, সেই মৃত্যুদূতের সঙ্গে দেখা হবে? মৃত্যুভয়কে ছায়াসঙ্গী করে, বাকি জীবন ভিনদেশে, ভিন্ন নামে, গরিবের মতো খেটে খেতে হবে। মনে মনে সবাইকে অভিশাপ দেয় রকি। রাজুকে, মায়াকে, জিয়াকে, মেঘনাদকে, লুসিকে, বালাজিকে, বুনোকে, গণেশকে, সিন্টুকে, ষষ্ঠীকে, প্রথমাকে।
সবচেয়ে বেশি অভিশাপ দেয় প্রথমাকে। ওর জন্যেই এত কাণ্ড হল। মেয়েটা এখন কোথায় কে জানে! পারলে কাইমেরাটাকে নিজের হাতে খুন করত রকি! হাফ শিম্পাঞ্জি কোথাকার!
কোলাঘাট। ৫ অক্টোবর। বিকেল পাঁচটা।
রকি যখন প্রথমাকে অভিশাপ দিচ্ছে, ঠিক তখন কোলাঘাট ব্রিজ পেরিয়ে ছ’নম্বর ন্যাশনাল হাইওয়ে থেকে সরু রাস্তায় নামল একটা এসইউভি। মিনিটদশেক চলার পরে গাড়ি এসে দাঁড়াল উমা আর কৃষ্ণকান্তর বাড়ির সামনে। গাড়ির দরজা খুলে নামল প্রথমা, সিন্টু, ষষ্ঠী, আর একটা লোক। লোকটাকে দেখলেই বোঝা যায়, এ আর্মিতে কাজ করে। প্রথমা দৌড়ে গিয়ে উমাকে জড়িয়ে ধরল। সিন্টুও প্রথমার দেখাদেখি উমার কোল ঘেঁষে দাঁড়াল। ষষ্ঠী সেদিকে গেল না। সে একপাশে দাঁড়িয়ে কৃষ্ণকান্ত আর লোকটার কথাবার্তা শুনছে। লোকটা বলল, ‘আপনি কৃষ্ণকান্ত মাইতি?’
‘হ্যাঁ স্যার।’
‘আপনি কোলাঘাট শ্যামাচরণ বিদ্যাপীঠের সায়েন্সের মাস্টারমশাই?’
‘হ্যাঁ। আপনি কে জানতে পারি কি?’
‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’
‘আপনি পুলিশের লোক?’
‘না। যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। প্রথমা অনাথ। ওর কোনও গার্জেন নেই। থাকার জায়গাও নেই। আমরা ওকে কোনও হোমে রাখতে চাইছি না। ও আপনাদের কাছে থাকবে বলেছে। আপনারা কি রাজি?’
‘হ্যাঁ….তা…কিন্তু আপনার পরিচয়টা?’
প্রথমার সঙ্গে ওই বাচ্চাটি এবং এই ছেলেটিও এখানে থাকবে। আপনি এদের নিজের বাড়ি রাখতে পারেন, অথবা আপনার গ্রামেই অন্য কোথাও রাখতে পারেন। খরচের জন্য চিন্তা করবেন না। খরচ আমরা দেব।’
‘আরে কী মুশকিল! আমরা মানে কারা? আপনি কে বলুন তো মশাই!’ বিরক্ত হয়ে গলা তোলে কৃষ্ণকান্ত। উত্তর না দিয়ে লোকটা ঠান্ডা চোখে কৃষ্ণকান্তর দিকে তাকাল। বলল, ‘ছেলেমেয়েগুলোকে বাড়িতে রাখুন। প্রথমাকে অফিসিয়ালি দত্তক নিন। ওদের ভালো স্কুল কলেজে পড়ান। আইনি সমস্যা আমরা সামলাব।’
কৃষ্ণকান্ত চুপ করে গেছে। উমা চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আমরা রাজি।’
সিন্টু বলল, ‘আমিও রাজি।’
তুই আবার কীসে রাজি?’ ধমক দেয় ষষ্ঠী। সিন্টু তুড়ুক জবাব দেয়, ‘এই দুজনকে বাবা-মা হিসেবে দত্তক নিতে। তাহলে আমি পমদির ভাই হব। তবে তুমি এই গণ্ডগোলে ঢুকো না।’
সিন্টুর কাঁধে চাপ দিয়ে, তাকে চুপ করিয়ে লোকটা বলল, ‘কৃষ্ণকান্তবাবু, আমাদের লোক আপনাদের বাড়ি মাঝে মাঝে ভিজিটে আসবে। রাতবিরেতেও আসতে পারে। চিন্তা করবেন না। আপাতত এই চেকটা রাখুন। ব্যাঙ্কে জমা করে দেবেন। আপনার ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাদের কাছে আছে। এখানে প্রতি মাসের তিন তারিখে পঞ্চাশ হাজার টাকা জমা পড়বে। দেখবেন, এদের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠায় যেন কোনও অসুবিধে না হয়। প্রাইমারিলি এরা এখানে কয়েকমাস থাকুক। তারপর পড়াশুনোর জন্য কলকাতা বা কোথাও শিফট করতে পারে।’
কৃষ্ণকান্ত দেখল, তার হাতে একলক্ষ টাকার একটা চেক। সেটা এসেছে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে। চোখ গোলগোল করে সে বলল, ‘চেকে সই করেছেন প্রধানমন্ত্রী হরভজন সিং। ওরেব্বাবা!’
লোকটা গাড়িতে ওঠার আগে বলল, ‘প্রাইম মিনিস্টারস অফিসের যে কেউ চেকে সই করতে পারত। কিন্তু অনারেবল প্রাইম মিনিস্টার সই করেছেন এইটা বোঝাতে যে এদেরকে আমরা কী চোখে দেখি।’
কৃষ্ণকান্ত বিড়িবিড় করে বলল, ‘এরা কী এমন কাণ্ড করেছে যে খোদ প্রধানমন্ত্রী দেখভালের দায়িত্ব নিচ্ছেন?’
লোকটা গাড়ির দরজা বন্ধ করার আগে বলল, ‘সব জিনিস জানতে নেই।’
কৃষ্ণকান্ত মাথা চুলকে বলল, ‘গিন্নি, আমাদের ছেলেটা অকালে মারা যাওয়ার পরে কত কান্নাকাটি করতে। দ্যাখো, কেন্দ্রীয় সরকার তোমাকে দু’দুটো বাচ্চা দিল।’
উমা বলল, ‘কথার কী ছিরি!’
ষষ্ঠী এতক্ষণ চুপ করে ছিল। সে এবার বলল, ‘আমার কী হবে?’
‘কী আবার হবে? উমা তার চুল ঘেঁটে দিয়ে বলে, ‘আমাদের সঙ্গে থাকবি। কলেজ যাবি। লেখাপড়া করে মানুষ হবি। আর কী চাই?’
প্রথমা লজ্জা লজ্জা মুখ করে ষষ্ঠীর দিকে তাকায়। ষষ্ঠী তাকায় প্রথমার দিকে। দুজনে একসঙ্গে বলে ওঠে, ‘মানুষ যদি না-ও হতে পারি, অমানুষ হব না।’
এই কাহিনিতে বর্ণিত স্থান, কাল, পাত্র ও ঘটনাবলী সম্পূর্ণ কাল্পনিক।
বাস্তবের সঙ্গে কোনও মিল নেহাতই কাকতলীয়।