২৩. ইউল বল
ছুটিতে প্রচুর হোমওয়ার্ক চতুর্থবর্ষের ছাত্র–ছাত্রীদের দেওয়া সত্ত্বেও টার্ম শেষ হবার মুখে হ্যারি সে সম্বন্ধে নির্বিকার। ক্রিস্টমাসের আগের সপ্তাহটা হ্যারি যতটা পারে নিজেকে যুক্ত রাখল গ্রিফিন্ডর হাউজের বন্ধুদের সঙ্গে। ফ্রেড আর জর্জের খুব উৎসাহে এলফরা নানা রকম কেক, পেস্ট্রি, স্টু, স্যাডরি পুডিং বানাচ্ছে; কিন্তু ওদের বানান ক্যালরি ক্রিম দেওয়া যে কোন খাবার জিনিস সযত্নে পরিহার করছে। হ্যারির ওদের তৈরি টন–টাংগ–টফি খেয়ে ডাডলির অবস্থার কথা মনে আছে।
অসম্ভব শীত পড়েছে। ক্যাসেল, তার সংলগ্ন মাঠ তুষার আবৃত হয়ে আছে। নীল বন্ধুবেটনের বিরাট ক্যারেজকে দেখে চেনা যাবে না। হ্যাগ্রিডের কেবিনের (জিঞ্জার ব্রেড হাউজ) সেটাও তুষার আবৃত বরফের তৈরি বিরাট কুমড়োর মতো দেখাচ্ছে। ডারমস্ট্র্যাংগের জাহাজের রূপও বদলে গেছে। জাহাজের দরজা জানালা–আশপাশে সব গর্ত বরফে ঢেকে চকচকে করছে। হোগার্ট স্কুলের কিচেনে হাউজ এলফদের মরবার ফুরসৎ নেই। সব সময় নানারকম সুস্বাদু খাবার, গরম স্টু, স্যাভরী পুডিং বানাতে ব্যস্ত! ফ্লেউর ডেলাকৌরের কোন জিনিসই মনোমত হয়, একটা না একটা খুঁত বের করবেই। কোনও খুঁত ধরার মতো কিছু খুঁত না থাকলেও তবু মুখ বেঁকিয়ে বলল–ওগওয়ার্টসের (হোগার্ট) খাবারদাবারগুলো দারুণ গুরুপাকের, গ্রেটহল থেকে খাওয়া–দাওয়ার পর যেতে যেতে বলল। (রন আর হ্যারি এমন এক জায়গায় বসেছিল হাতে ডেলাকৌরের চোখে না–পড়ে)-এই রকম হেভি খাবার খেলে আমার কোনও জামা, প্যান্ট গায়ে আঁটবে না! আলখেল্লাও ফিট করবে না।
ফ্লেউর দল ছেড়ে চলে গেলে হারমিওন বলল-এটাই ট্রাজেডি!… ও নিজেকে দারুণ দেখতে মনে করে… তোমরাও কি মনে কর?
রন বলল–হারমিওন বল না কে তোমার সঙ্গে নাচবে?… রন বারবার একই প্রশ্ন করে যায় কলের গানের মতো; কিন্তু হারমিওন ভুরু কুঁচকে বলে–তোমাকে কেন বলব? বললেই তোমরা আমার পেছনে লাগবে।
ম্যালফয় পেছনে বসেছিল, বলল–ঠাট্টা করোনা উইসলি তুমি কাউকে বলের
জন্য বলনি… তোমার প্রিয় মাড ব্লাডকেও বলবে না।
ক্রুদ্ধ হ্যারি আর রন চতুর্দিকে তাকাল; কিছু ওরা করে ওঠার আগেই হারমিওন সরবে বলে উঠল–হ্যালো প্রফেসর মুডি! ম্যালফয়ের মুডি নাম কানে আসতেই মুখ শুকিয়ে গেল। তড়াক করে লাফিয়ে পেছনে চলে গেল। এধার ওধার তাকাল মুডিকে দেখার জন্য। মুডি তখন স্টাফ টেবিলের সামনে বসে গরম সু খতম করছেন।
হারমিওন তিক্ত গলায় ভীত–সন্ত্রস্ত ম্যালফয়কে বলল–তুমি একটি পাতলা সুতো… এক টানে ছিঁড়ে যাবে। তাই না ম্যালফয়… ঠিক বললাম না? ম্যালফয়কে উচিৎ শিক্ষা দিতে পেরে হারমিওন, রন হ্যারি হাসতে হাসতে মার্বেল সিঁড়ির কাছে গেল। রন আড়চোখে তাকিয়ে বলল,–হারমিওন… তোমার দত…।
ও বলল–কেন কী হয়েছে?
–মনে হল অন্য রকম তাই বললাম।
–বদলে গেছে।
–অবশ্যই বদলে গেছে–তুমি কী আশা করেছ ম্যালফয়ের দেওয়া বিষদাঁতগুলো সযত্নে রাখব?
–না আমি বলছিলাম তা তোমার আগের দাঁত থেকে এখনটা ভিন্ন। এখন তো বেশ সেট করা দাঁত।
হারমিওন হঠাৎ দুষ্ট দুই মুখে হেসে উঠল। হ্যারি লক্ষ্য করল ওর হাসিটা আগের মতো নয়।
–ওহ, তোমাদের বলা যায়নি।… জাদুর মন্ত্রে যখন আমার দাঁত বড় হয়ে গেল… তখন হাসপাতালে গেলে ম্যাডাম পমফ্রে দাঁত ছোট করে দিয়েছেন। মা বাবা অবশ্য জানতে পারলে খুশি হবেন না। তারা জন্ম থেকে যা আছে তা বদলানোর পক্ষপাতি নন। আসলে ওরা তো ডেন্টিস্ট, দাঁত ঠিক করা আর ম্যাজিক এক মনে করেন না… আরে তোমাদের প্যাঁচা পিগইজিয়ন ফিরে এসেছে দেখছি।
রনের ছোট পাচাটি সিঁড়ির ব্যানিস্টারে লাফালাফি করছিল। ওর পায়ে পাকানো পার্চমেন্ট বাঁধা। যারা সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করছে তারা পিগের নাচানাচি দেখে হাসিতে ফেটে পড়েছে।…, দেখ দেখ ছোট কি কিউট প্যাঁচা!
রন ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল, অ্যাই বোকা পাচা চুপ! তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ওর পা থেকে পার্চমেন্ট খুলে নিল …, তোমার কাজ যার চিঠি তাকে দেওয়া… নেচে গেয়ে সবাইকে দেখান নয়।
পিগউইজিয়ন রনের ঘুষি তোলা হাত ঘোড়াই কেয়ার করে। কিন্তু ওর মাথার চারপাশে ঘুরপাক খেতে খেতে সুন্দর করে ডাক দিয়ে উড়তে আর পারলো না। রন ওকে এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে। তৃতীয় বর্ষের মেয়েদের ওই দৃশ্য দেখে মন খারাপ হয়ে গেল।
–ভাগো এখান থেকে, রন মেয়েদের দিকে তাকিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, হ্যারি এটা ধর দেখি ওদের হাসির মজা দেখাচ্ছি। ও পিগের পা থেকে সিরিয়সের জবাবি চিঠিটা খুলে নিয়ে হ্যারি দিকে ছুঁড়ে দিলে হ্যারি ফ্লোর থেকে তুলে নিল। সিরিয়স কি লিখেছে পড়ার জন্য গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে তাড়াতাড়ি চলে গেল।
ওরা তিনজনে জানালার ধারে বসল। অন্ধকার জানালা… বরফ জমে একটুও আলো আসছে না।
হ্যারি চিঠিটা পড়ল
প্রিয় হ্যারি,
অভিনন্দন! তোমার হর্নটেল পরাস্ত করার সংবাদে আমি খুশি, তবে যে তোমার নাম, তোমার ক্ষতি করার জন্য গবলেটে দিয়েছিল সে কতটা দুঃখিত অথবা খুশি তা আমি বলতে পারবো না। আমি তোমাকে ড্রাগনদের চোখের দৃষ্টি অচল করার জন্য কনজাংকটিভিটিস কার্স সাজেস্ট করেছি।
হারমিওন ফিসফিস করল–ক্রাম খুব সম্ভব ওই কার্স প্রয়োগ করেছিল।
কিন্তু তোমার পদ্ধতিটাও ভালো
ছিল, আমি অত্যন্ত খুশি।
আমার অনুরোধ, তুমি সবেমাত্র একটা টাস্কে উত্তীর্ণ হয়েছে। একবারও তারজন্য আত্মহারা হবে
না। যে তোমার নাম গবলেটে দিয়েছে,
টুর্নামেন্টে তোমাকে বিপদে ফেলার জন্য আরও অনেক ফাঁদ পাততে পারে
সে। সর্বদাই সর্তক থাকবে। মনে রাখবে সে তোমার আশেপাশে ঘুরছে।
বিপদে যাতে না পড়ো তার দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে, আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলবে।
আমি সব সময় তোমার কাছ থেকে অস্বাভাবিক যা ঘটবে তা জানতে চাই।
সিরিয়স
হ্যারি বলল–মুডি একই কথা বলেন সদা জাগ্রত থাকবে। চিঠিটা পড়ে হ্যারি জামার পকেটে রেখেদিল। ও দেওয়ালে হালকা চাপড় মেরে বলল–আপনারা কী মনে করেন আমি চোখ বন্ধ করে ঘুরে বেড়াই?
হারমিওন বলল–রাগের ব্যাপার নয় হ্যারি, ওরা ঠিক কথাই বলেন। মনে রেখ তোমাকে আরও দুটো টাস্ক বাকি। তোমার ডিমের ভেতরে কি আছে সেটা তোমার দেখা উচিত ছিল, তা এখনও তুমি দেখনি। তুমি দেখ এবং কি করতে হবে ঠিক করতে থাক। এটাই এখন প্রয়োজন, ওরা তাই বলেছেন।
রন বলল–হারমিওন, আমাদের হ্যারি বৃদ্ধ হয়ে গেছে, ও এখন ঘরে বসে বসে দাবা খেলতে চায়।
–হ্যা তাই চাই, হল তো, হ্যারি রেগে গিয়ে বলল। তারপর হারমিওনের কঠিন দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলল–বেশ তাহলে ডিম খোলাই যাক; কিন্তু এই গন্ডগোলে খোলা সম্ভব নয়। এই সোরগোলে ডিম কি বলল শুনতে পারে না?
–মনে তো হয় না, হারমিওন দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাবা খেলা দেখতে লাগল। রন এখন চেকমেট দিয়েছে।
.
হ্যারির ক্রিস্টমাসের ভোরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙার কারণ বুঝতে বেশ সময় লাগল। ও চোখ খুলে দেখল বিরাট এক গোলাকার বস্তু ওর সামনে। ওর সবুজ দুটো চোখ অন্ধকারে জ্বল জ্বল করছে, আর ওর দিকে তীব্রভাবে তাকিয়ে রয়েছে, এত কাছে যে ওর নাক স্পর্শ করবে। ডবি তুমি! হ্যারি ধরফর করে ঘুম থেকে উঠে বসল। এলফ থেকে দূরে সরতে গিয়ে, আরেকটু হলেই খাট থেকে পড়ে যেত হ্যারি, রেগে গিয়ে বলল, আর কখনো এরকম করবে না ডব্বি!
ডব্বি ওর বড় বড় আঙ্গুল মুখে রেখে প্রায় লাফিয়ে পিছু হটে বলল–ডব্বি অত্যন্ত দুঃখিত স্যার! ডব্বি হ্যারি পটারকে হ্যাপি ক্রিস্টমাস জানাতে এসেছে… একটা উপহারও এনেছে স্যার! হ্যারি পটার বলেছিলেন, একদিন ডব্বির সঙ্গে দেখা করবেন স্যার!
–ঠিক আছে, ঠিক আছে। মনে রেখ ভবিষ্যতে তুমি আচমকা আমার ঘুম ভাঙাবে না, এত কাছে মুখটা আনবে না। হ্যারি বলল।
হ্যারি পর্দাটা সরিয়ে দিতে ঘরে সামান্য আলো এল। বেডের চশমাটা নিয়ে পড়ল। ওর ভয়ার্ত ডাকে রন, সিমস, ডিন আর নেভিলের ঘুম ভেঙে গেছে। সকলেই ওদের মোটা ঝুলন্ত বিছানা থেকে উঠে এলো।
সিমাস ঘুম ঘুম চোখে বলল,–কি হয়েছে তোমায় কেউ আক্রমণ করেছিল হ্যারি?
–না, ডব্বি… ডব্বি এসেছে আমার কাছে। তোমরা নিশ্চিন্তে ঘুমাও।
সিমাস হ্যারির খাটের দিকে তাকিয়ে বলল–আরে, অনেক উপহার দেখছি। রন, ডিন, নেভিল ক্রিস্টমাস উপহারের কথা শুনে লাফিয়ে উঠল। ওদের ঘুম উধাও হয়ে উপহার দেখার জন্য বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল।
ডব্বি এখন লজ্জায় অবনত মস্তকে হ্যারির খাটের পাশে দাঁড়িয়ে। হ্যারিকে ঘুম ভাঙিয়ে দারুণ এক অপরাধ করে ফেলেছে। ওরা দেখল ডব্বির গরম টুপিতে ক্রিস্টমাস বাবল বাধা রয়েছে।
ও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল–ডব্বির এই ক্রিস্টমাস প্রেজেন্ট কি হ্যারি পটার গ্রহণ করবেন?
হ্যারি বলল–নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই নেব।… আমিও তোমাকে কিছু দেব বলে রেখে দিয়েছি।
ডাহা মিথ্যে কথা। হ্যারি, ডব্বিকে দেবার জন্য কোনও উপহার আনেনি। তা সত্ত্বেও ও ট্রাঙ্ক খুলে দুটো মোজা বের করল। ওর সবচেয়ে পুরনো শতছিন্ন গন্ধে ভরা হলুদ রংয়ের অপরিচ্ছন্ন মোজা।… তা আবার সেগুলো আঙ্কেল ভার্ননের থেকে পাওয়া। তা একবছর তো হয়ে গেছে। ও মোজা দুটো ডব্বির হাতে দিয়ে বলল সত্যি দুঃখিত…, মুড়ে রাখার একটুও সময় পাইনি-একেবারে ভুলেও গেছিলাম…।
কিন্তু এলফ ডব্বি, হ্যারির কাছ থেকে দুর্গন্ধ শতছিন্ন নোংরা মোজা জোড়া পেয়ে যেন হাতে স্বর্গ পেল।
–মোজা ডব্বির সবচেয়ে পছন্দ স্যার। ও নিজের পায়ের মোজা খুলে আঙ্কেল ভার্ননের মোজা পরতে লাগল। তারপর মোজা দুটো টেনে টেনে হাঁটু ছাড়িয়ে আর একটু ওপরে তুলে বলল–দোকানে তারা একটা দারুণ ভুল করেছে। ওরা দুটো মোজা একই রকম দিয়েছে।
রন বলল–ওহ হো, হ্যারি কেনার সময় ভুল করেছে। যাকগে তুমি এই দুটো মোজা নাও ডব্বি তাহলে আর অসুবিধে হবে না। রন বিছানায় বসে বসে ওর মোজা দুটো ডব্বির দিকে ছুঁড়ে দিল। এই নাও তোমার জাম্পার।
ডব্বি উত্তেজনায় কথা বলতে পারছেনা।–স্যার খুব দয়ালু। চোখে ওর জল। হাতে মোজা আর জাম্পার নিয়ে ক্রন্দনজড়িত কণ্ঠে বলল–ডব্বি জানে স্যার খুব বড় জাদুকর। হ্যারি পটার ডব্বির বন্ধু… কিন্তু ডব্বি জানে সে একজন দয়ালু, মহৎ লোক… সে স্বার্থপর নয়।
রন হ্যারির জন্য আনা ডবির উপহারের প্যাকেট খুলল। সুন্দর একটি কাড়লে ক্যাননের হ্যাট। টুপিটা মাথায় পরে বলল–আঃ।
ডব্বি একটা ছোট প্যাকেট হ্যারিকে দিল। হ্যারি খুলে দেখল–মোজা।
–ডব্বি নিজে বুনেছে স্যার, ডব্বি খুশিতে ফেটে পড়ে বলল–ডব্বি ওর পারিশ্রমিকের অর্থে উল কিনেছে স্যার।
দু রকম রং-এর দুটো মোজা। একটা টকটকে লাল, অন্যটা সবুজ।
হ্যারি বলল–অসংখ্য ধন্যবাদ ডব্বি। মোজা দুটো ওর সামনে পরাতে, ডব্বির দু চোখ আনন্দে জলে ভরে গেল।
–ডব্বি এবার যাবে স্যার। আমরা কিচেনে ক্রিস্টমাস ডিনার বানাচ্ছি। ডব্বি বলল।… তারপর সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ঘর থেকে চলে গেল ডব্বি।
অনেকেই হ্যারিকে ক্রিস্টমাস প্রেজেন্ট পাঠিয়েছে। ডব্বির বেঢপ মোজার চাইতে অনেক ভাল সন্দেহ নেই। ডার্সলি খুবই সাধারণ একটা জামা পাঠিয়েছেন। খুব সম্ভব এখনও টন–টাংগ–টফির কথা ভোলেন নি। হারমিওন একটা বই দিয়েছে কিডিচ টিম্স অব ব্রিটেন অ্যান্ড আয়ারল্যান্ড।
রন একটা বড় ব্যাগ, সিরিয়স একটা সুন্দর পেননাইফ–যে কোনও তালা খোলার একটি চাবি, হ্যাগ্রিড এক বাক্স ভর্তি মিষ্টি–সব কটাই হ্যারির অতি পছন্দসই। মিসেস উইসলি যথারীতি একটা জাম্পার (সবুজ রং-এর ড্রাগনের ছবি দেওয়া) তার সঙ্গে বাড়ির তৈরি পাই কিমা।
হ্যারি রন কমনরুমে হারমিওনের সঙ্গে দেখা হল। তারপর একসঙ্গে সকালের নাস্তা খেতে গেল। সকাল বেলা অনেকটা সময় গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে বসে সবাই মিলে আড্ডা দিল। সকলেই তাদের উপহার নিয়ে খুব খুশি। আনন্দে ভরপুর। তারপর গ্রেটহলে লাঞ্চ খেতে গেল। এলাহি ব্যাপার–রোস্টেড টার্কি, ক্রিস্টমাস পুডিং, একগাদা ক্যারি বাজেস, উইজার্ডিং ক্রাকারস…।
লাঞ্চ সেরে অনেকটা সময় গল্প–গুজব করে বিকেলের দিকে মাঠে বেড়াতে গেল। মাঠ–ঘাট–রাস্তায় তখন জমা বরফ। যাতায়াতের জন্য বক্সটেন আর ডারমস্ট্রাংগের ছাত্র–ছাত্রীরা বরফ কেটে সড়ক বানিয়ে নিয়েছে। হারমিওন বরফের বল ছোঁড়া হুঁড়িতে অংশ না নিয়ে রন আর অন্যান্যদের স্নো–বল ছোঁড়া হুঁড়ি দেখতে লাগল।
রন হারমিওনকে দেখে বলল,–পাক্কা তিন তিনটে ঘণ্টা কীভাবে কাটাবে? জর্জের ছোঁড়া একটা বেশ বড়সড় স্নো–বল রনের মুখে বাঁ–পাশে লাগল। আবার সেই একই কথা বলল–হারমিওন তাহলে কার সঙ্গে নাচছ? কিন্তু কোনও জবাব না–দিয়ে হারমিওন ক্যাসেলের দিকে একাই চলে গেল।
গ্রেট হলে প্রোগ্রাম বিকেলের দিকে ক্রিস্টমাস চা, বল ড্যান্স আর ফিস্ট! সময় সন্ধ্যা সাতটা। আলো কমে আসতে সকলেই স্নো–বল খেলা ছেড়ে যে যার কমন রুমে চলে এল। ফ্যাট লেডি বান্ধবী ভায়োলেটের সঙ্গে ফ্রেমে বসেছিল। দুজনেই মদ্যপান করেছে, সেই সঙ্গে আচ্ছামতো খেয়েছে চকলেট। উপহার পাওয়া চকলেটগুলোর বেশিটাই সাবাড় তো করেছেই, আর চকলেটের মোড়কগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে চারপাশ নোংরা করেছে। ওর ছবির ফ্রেমের নিচে দেখো মোড়কের স্তূপ।
পাশওয়ার্ড বলে হ্যারি, সিমাস, রন, ডিন ও নেভিল ডরমেটরিতে ড্রেস চেঞ্জ করার জন্য গেল। সকলেই খুব নিজেদের চেহারা আর সাজ পোশাক সম্বন্ধে খুবই সচেতন। তবে রন একটু বেশি বেশি। বাবার বড় আয়নাতে দেখতে লাগল। রন মুখে মৃদু মৃদু হাসি। রোবটা ঠিক রোবের মতো বানায়নি… অনেকটা শার্টের মতো। আরও ম্যানলি যাতে দেখায় তার জন্য সার্বিং চার্ম গায়ে হাতে মাখল।
ডিন খবর পেয়েছে পার্বতী থাকছে হ্যারির সঙ্গে, আর ওর ছোট বোন পদ্ম রনের সঙ্গে বল ড্যান্সের জন্য। ডিন একটু জেলাস। বিড়বিড় করে ডিন বলল আশ্চর্য হোগার্টের সবচেয়ে বেস্ট লুকিং গার্লকে ওরা দুজনে কেমন করে ম্যানেজ করল।
রন হেসে বলল,–খুব সোজা চুম্বক–হাতা থেকে একটা সুতো ছিঁড়তে লাগল সে।
কমনরুম এখন অপূর্ব এক রূপ নিয়েছে। নানা বয়সের নানা দেশের মহিলা পুরুষ–ছেলে–মেয়ে। বিচিত্র তাদের পোষাক… স্বাভাবিক কালো পোশাক কেউ পরেনি। পার্বতী সিঁড়ির ধাপে হ্যারির অপেক্ষায় বসেছিল। ওকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে… সেজেছে সুন্দর করে। মাথার কালো চকচকে সোনালী রিবন, দুহাতের কব্জিতে সোনার ব্রেসলেট! ওকে হাসতে দেখে হ্যারির মনের মধ্যে ধুকপুকানি কমে এলো:
–তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে পার্বতী, হ্যারি কি বলবে না বলবে ভেবে না পেয়ে বলল।
–ধন্যবাদ।–রন, পদ্মা তোমার জন্য এনট্রেন্স হলে অপেক্ষা করছে।
–ঠিক আছে, রন বলল…. হারমিওনকে দেখতে পাচ্ছিনা! পার্বতী কাধ নেড়ে বলল, চল আমরা নিচে যাই হ্যারি।
হ্যারি বলল–ঠিক আছে। ভাবছিল, কমনরুমে বসলে ভাল হত। পোর্টেট হোল দিয়ে যাবার সময় ফ্রেডের সঙ্গে দেখা হল। ফ্রেড চোখ টিপল।
এনট্রেন্স হলে প্রায় সকলেই এসে গেছে। সকলেই আটটা বাজার অপেক্ষায়, কখন গ্রেটহলের দরজা খোলা হবে।
পদ্মাকে, পার্বতী খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে গেল, পদ্মাকেও পার্বতীর মতো আকর্ষণীয় লাগছে। ওর মুখ দেখে মনে হয় রনের সঙ্গে নাচতে ওর খুব একটা উৎসাহ নেই।
–হায়, রন বলল। ওর দৃষ্টি কিন্তু হলের ভিড়ের দিকে। ও হ্যারির পেছনে দাঁড়িয়ে হাঁটু মুড়ে দাঁড়াল। ডেলাকৌর দারুণ জামা পরেছে। রূপালী–ধূসর সার্টিনের রোবস। ওর সঙ্গে ব্ল্যাভেন ক্ল কিডিচের ক্যাপ্টেন রোজার ডেভিস।… ওরা দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেল, রন আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।
ও আবার জিজ্ঞেস করল,–হারমিওনকে দেখতে পাচ্ছি না। দিারিনের কিছু ছাত্র–ছাত্রী তাদের ডানজুয়ান কমনরুম থেকে এনট্রেন্স হলে ঢুকল। ওদের সবার আগে ম্যালফয় পরনে কাল ভেলভেটের উঁচু কলারের রোবস। হ্যারির কাছে ওকে ঠিক ধর্মযাজকের মতো দেখাচ্ছে। প্যানসি পারকিনসন ম্যালফয়ের হাত ধরে রয়েছে। ও পরণে ফ্লিল দেওয়া ফিকে গোলাপি রং-এর রোবস। ক্রাব ও গোয়েল দুজনেই সবুজ রোবস পরেছে। ওদের দেখে মনে হয় দুটো শ্যাওলা লাগা বড় পাথর। হ্যারি দেখে খুশি হল–যাক শেষমেষ ওরা পার্টনার পেয়েছে।
সামনের প্রকাণ্ড ওকের দরজা খুলতেই ডারমস্ট্রংগ ছাত্রছাত্রীদের আসতে দেখা গেল। ওদের নিয়ে এসেছেন প্রফেসর কারকারফ। ক্রাম ওদের সবচেয়ে আগে। সঙ্গে একটি সুশ্রী মেয়ে পরনে সবুজ রোবস। হ্যারি–ওকে আগে দেখেনি।
দরজার ওধারে হ্যারি দেখল রঙ–বেরঙের বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। মাঠে শত শত জীবন্ত পরীরা হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে বসে রয়েছে। পেছনে গোলাপের বাগান।… হাতে বলগা হরিন নিয়ে রাখা সান্তাক্লসের মূর্তি।
তারপরই প্রফেসর ম্যাকগোনাগলকে বলতে শোনা গেল, অনুগ্রহ করে চ্যাম্পিয়নরা এখানে সমবেত হও!
ঘোষণা শোনার পর পার্বতী চনমন করে উঠল, হাতের বালা ঠিক করে নিল। হ্যারি আর পার্বতী, রনকে বলল এক মিনিট পরই তোমাদের সাথে দেখা হবে, কথাটা বলে ওরা দুজনে ম্যাকগোনাগলের দিকে এগিয়ে গেল। অন্যরা ওদের যাবার জন্য পথ করেছিল। প্রফেসর ম্যাকগোনাগল লাল টার্টনের রোবস পড়েছেন, টুপির চারধারে কাটা গাছের ছোট ছোট ডালপালা লাগিয়েছেন। দেখতে খুব অসুন্দর লাগছে। চ্যাম্পিয়নের আর তাদের নৃত্যসঙ্গিনীদের বললেন,–দরজার একপাশে তোমরা দাঁড়িয়ে থাক। সকলে গ্রেট হলে চলে যাবার পর তোমরা ভেতরে যাবে। ফ্লেউর ডেলাকৌর আর রোজার ডেভিস দরজায় সর্বপ্রথমে দাঁড়াল। রোজার ফ্লেউরকে পার্টনার পেয়ে দারুণ সুখী। ফ্লেউরের দিক থেকে ওর দৃষ্টি সরাতে পারে না। নিজেকে পরম ভাগ্যবান মনে হয়। সেডরিক আর চো হ্যারির খুব কাছেই বসল। ওদের সঙ্গে যাতে কথা বলতে না–হয় হ্যারি তাই অন্যদিকে মুখ করে বসল।… কিন্তু ক্রামের পাশে কে? হ্যারি থতমত খেয়ে গেল ওর পার্টনারকে দেখে।
পার্টনার হারমিওন!
কিন্তু ওকে হারমিওনের মতো দেখাচ্ছে না। চুলের স্টাইল বদলেছে… এলোমেলো নয় সিল্কের মতো চকচক করছে। মাথায় একটা গিট দিয়েছে। ওর রোবস বেশ ছড়ান, রংটা কচি পাতার। দাঁড়ানর ভঙ্গিটাও অন্য রকম। সব সময় কুড়ি–বাইশটি বই দু হাতে নিয়ে চলার জন্য সোজা হতে পারে না। এখন হাতে বই নেই, সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ও নার্ভাসনেস কাটাবার জন্য মৃদু মৃদু হাসছে। সামনের বড় দুটি দাঁত ছোট করে দেওয়াতে হাসিটার তফাৎ চোখে পড়ে। হ্যারি বুঝতে পারে কেন ওকে এত খোঁজার পরও দেখা পায়নি।
–হায়, হ্যারি, ও বলল–হায় পার্বতী!
পার্বতী হারমিওনের দিকে তাকিয়ে থেকে বিশ্বাস করতে পারে না ও হারমিওন অন্য এক মেয়ে।
সকলের দৃষ্টি যেন হারমিওনের ওপর।
সকলেই আসন্ন আনন্দোৎসবের জন্য সাগ্রহে হলে বসে থাকার পর ম্যাকগোনাগল চার জন চ্যাম্পিয়নকে তাদের পার্টনারদের সঙ্গে নিয়ে লাইন তার পিছু পিছু আসতে বললেন। টপ অব দ্য হলে একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সমস্ত হল শুভেচ্ছা–অভিনন্দন–করতালিতে ভরে উঠল। গোল টেবিলে বিচারকরা বসে আছেন।
হলের দেয়াল চকমকে রূপালি তারা, সুন্দর–সুন্দর ফেস্টুনে সাজান হয়েছে। অপূর্ব রং-এর বাহার সোনালী, রূপালী যেখানে যেমনটি মানায়। হলে সব হাউজ টেবিল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শূন্যস্থানে ছোট ছোট টেবিল তার উপর লণ্ঠন জ্বলছে। এক একটা টেবিল বার জনের জন্য নির্দিষ্ট।
হ্যারি বেচারি নাচতে পারে না, পদক্ষেপ ঠিক হয় না। পার্বতী সম্পূর্ণ বিপরীত। ও দর্শকদের তার সাবলীলতায় মুগ্ধ করতে লাগল। মনে হল হ্যারিপটার একটা পোষা কুকুর, তার গলা বেল্ট আর চেন বেঁধে ওকে নিয়ে ছুটোছুটি করছে।… টপ টেবিলের কাছে হ্যারির রন–পদ্মার দিকে চোখ পড়ে গেল। রন বাঁকাচোখে হারমিওনকে দেখল। পদ্মা গোমড়া মুখে নাচতে হবেই বলে নেচে চলেছে। তবু রন ওর সঙ্গে তাল রাখতে পারছে না।
ডাম্বলডোর আনন্দের সঙ্গে হাসলেন; কিন্তু কারকারফ অন্য রকম… হারমিওন–ক্রাম ওর কাছাকাছি এলে রনের মতো মুখের ভাব করলেন। লালুডো বেগম্যান তার জাকজমক পোশাক পরে ছেলে মানুষ ছাত্র–ছাত্রীদের মতো আনন্দে হাততালি দিলেন। ম্যাডাম ম্যাক্সিম খুব একটা হৈ–চৈ না করে শান্ত–ভদ্রভাবে হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করলেন। হঠাৎ হ্যারির মনে হয় সকলেই আছেন, কিন্তু ক্রাউচ? তার শূন্য চেয়ারে পার্সি উইসলি বসে আছে।
নাচের শেষে চ্যাম্পিয়নরা তাদের পার্টনারদের নিয়ে টেবিলের কাছে এলে পার্সি একটা খালি চেয়ার ওর পাশে রেখে হ্যারির দিকে তীক্ষ্ণভাবে তাকাল। হ্যারি পার্সির চোখের নির্দেশ বুঝতে পেরে পার্সির পাশের খালি চেয়ারটায় বসে পড়ল। পার্সি দারুণ পোশাক পরেছে। নতুন নেভি ব্লু রোবস। পরিছন্ন–ফিটফাট। আত্মতৃপ্ত মুখের ভাব।
হ্যারিকে চাপাগলায় বলল–শুনে খুশি হবে আমি প্রমোশন পেয়েছি; এমন এক মুখোভাব আর স্বরে বলল,–যেন পুরো দুনিয়াটার ও একমাত্র শাসনকর্তা হয়েছে। আমি এখন মিঃ ক্রাউচের ব্যক্তিগত সহকারী। ক্রাউচের প্রতিনিধিত্ব করতে আসতে হয়েছে।
–তিনি এলেন না কেন? হ্যারি জিজ্ঞেস করল। ডিনারে কলড্রনের তলা সম্বন্ধে বকবক করতে তার আর ইচ্ছে হচ্ছে না বুঝি!
–ওয়ার্ল্ড কাপের পরেই উনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বয়স হয়েছে… তাহলেও কর্মঠ; কিন্তু অসুস্থ হয়ে পড়লে কি আর করবেন। ওর মনটাও খুব বিশাল। ওই ওয়ার্ল্ড কাপ মন্ত্রণালয়ের জন্য বলতে পার লজ্জাজনক। তাছাড়া তার হাউজ-এলফের অসদাচরণে তিনি নিজে খুবই মর্মাহত। কি যেন নাম ওর…? ব্লিঙ্কি।… স্বাভাবিক কারণে ওকে তাড়িয়ে দিয়েছেন… তো তার এখন এমন হয়েছে কারও সাহায্য ছাড়া কিছু করা সম্ভব না।… তারপর টুর্নামেন্টের ব্যবস্থা করা… বেশ শক্ত কাজ… স্কীটারের উপদ্রপ তো আছেই…। সে যাই হোক উনি এবার শান্তিতে ক্রিস্টমাস পালন করতে চান। ভিড় ভাল লাগে না তার।
হ্যারির খুব ইচ্ছে করল মি : ক্রাউচ এখনও ওকে ওয়েদারবাই বলে ডাকেন কিনা। কিন্তু ইচ্ছেটা সংযত করল।
তারপর ক্রিস্টমাস ভোজের নানা রকম সুস্বাদু খাবার তখনও আসেনি। টেবিল থালা–প্লেট–কাঁটা–চামচ ইত্যাদি সুন্দর করে টেবিলে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেক টেবিলে মেনুকার্ড রাখা। হ্যারি একটা মেনুকার্ড নিয়ে পড়তে পড়তে অর্ডার দেবার জন্য কোনও ওয়েটার দেখতে পেলো না। দেখতে পেল ডাম্বলডোরও মাথা নিচু করে মেনুকার্ড পড়ছেন… তারপর সামনে রাখা সোনার প্লেটকে বললেন, পর্ক চপ!
প্লেটভর্তি পর্ক চপস হাজির! সকলেই হ্যারির মতো ওয়েটারের কথা ভাবছিল। সেই ভাবনার পথ দেখালেন ডাম্বলডোর। তখন তাদের ইচ্ছানুসারে খাবারের নাম বলতেই প্লেটে খাবার ভর্তি হতে লাগল।
হ্যারি হারমিওনের দিকে তাকাল। ভাবল ডাম্বলডোরের নতুন উদ্ভাবন ও কেমনভাবে গ্রহণ করেছে।… নিশ্চয়ই নতুন ব্যবস্থাটার পেছনে কিচেনের হাউজ এলফদের অনেক পরিশ্রম আছে। মনে হল, এই প্রথম যেন হারমিওন আর SPEWর কথা ভাবছে না, ভিক্টর ক্রামের সঙ্গে গভীরভাবে কিছু আলোচনায় মগ্ন। কি খাচ্ছে সেদিকেও মন নেই।
হ্যারির মনে হল-এখনো পর্যন্ত তো ভিক্টর ক্রামকে কোনো কথা বলতে শোনেনি… তবে নিশ্চয়ই খেতে খেতে হারমিওনের সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলছে।
–হ্যাঁ আমাদেরও একটা ক্যাসেল আছে, তবে তোমাদের মতো বড়, আরামদায়ক নয়। হারমিওনকে ও বলল।… আমাদের চারটে ফ্লোর আছে তবে প্রত্যেক ফ্লোরে একটি মাত্র আগুন জ্বলে ম্যাজিকের জন্য। আমাদের যে মাঠটা আছে সেটা তোমাদের মাঠের চেয়ে বড়… শীতকালে আমাদের তো সূর্য ওঠে না… সব সময় গভীর রাত্রি মনে হয়। তাই খুব একটা আনন্দ করতে পারি না।… তবে গ্রীষ্মকাল বড় সুন্দর। বড় বড় লেক, পাহাড়, অরণ্যের ওপর ফ্লাই করে বেড়াই।
কারকারফের গলা শোনা গেল, ও ভিক্টর (হাসল) তোমার কি আমাদের সাথে কিছু বলার নেই। তোমার বান্ধবী ছাড়া আমরাও তো আছি। আমাদের দিকে একটু তাকাও।
ডাম্বলডোর হাসলেন, চোখ দুটো কৌতুকে নাচতে লাগল, ইগর…. তোমার কথা শুনে মনে ইচ্ছে তুমি মেহমান পছন্দ করো না।
কারকারফ বললেন,–ভাল কথা বলেছ ডাম্বলডোর। কথাবলার সময় ওর হলুদ হলুদ দাঁত বেরিয়ে এল। আমরা সকলেই নিজেদের অধিকৃত জায়গায় আবদ্ধ।… বল তাই না? আমরা কী আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা যা ন্যস্ত করা হয়েছে সেগুলো সতর্কতার সঙ্গে পাহারা দিয়ে চলি না? আমরা যে নিজেদের স্কুলের গোপনীয়তা সম্বন্ধে জানি সেজন্য কী আমরা গর্বিত নই এবং সেগুলো রক্ষা করার দায়িত্ব নেই?
–ওহ্ আমি কিছু ধরে নিয়ে ভাবি না। যা সত্য–তাই দেখি ও বলি। ইগর আমি নিশ্চিত নই যে, হোগার্টের সব সিক্রেট জানি, ডাম্বলডোর বললেন। কিন্তু আজ সকালে আমি বাথরুমে যাবার সঠিক রাস্তাটা ঠিক করতে পারিনি। তাই দরজা খুলে দেখি সেটা বাথরুম নয়, একটা সুসজ্জিত ঘর, ওই রকম ঘর বিশ্বাস কর আগে কখনও দেখিনি-এ ঘরে নানা রকম সুন্দর সুন্দর চ্যাম্বার পটসের সগ্রহ। আমি সেগুলো কাছ থেকে ভাল করে দেখবার জন্য যেতেই… দেখলাম সেই ঘরটা অদৃশ্য হয়ে গেল। এ বিষয়টি আমার জানা উচিত ছিল! মনে হয় সেই ঘরটায় যাবার বা দেখার সুযোগ সকাল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত, অথবা চাঁদের চতুর্থ দিনে।… অথবা স্বীকারের অত্যাধিক বাথরুম পেয়ে ব্লাডার ফুললে…।
হ্যারির কাছে কথাগুলো তেমন অর্থহী না হলেও মনে হল ডাম্বলডোর সিক্রেসি সম্বন্ধে বেশ মজা করে জবাব দিয়েছেন।
সকলেই মজাদার খাবারের সঙ্গে বন্ধু–বান্ধবীদের নিয়ে আলাপ–আলোচনায় মশগুল।
হ্যারি খেতে খেতে হলের চারপ্রাপ্ত ভাল করে দেখল। হ্যাগ্রিড কোথায় গেলেন? হ্যাঁ দেখতে পেয়েছে। হ্যাগ্রিড তার কিছুতকিমাকার পোশাক পরে আর মাথার ডেলাডেলা চুলের অপর্যাপ্ত তেল মেখে একটা স্টাফ টেবিলে বসে আছেন। দৃষ্টি তার টপ টেবিলে। দেখল মাদাম ম্যাক্সিমকে দেখে হাত নাড়লেন। তিনি হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানালেন। মোমবাতির আলোতে তার চশমার চৌকো কাঁচ দুটো চকচক করে উঠল।
খাওয়া পর্ব শেষ হলে ডাম্বলডোর হাতে জাদুদণ্ড নিয়ে দাঁড়ালেন। ছাত্র ছাত্রীদেরও দাঁড়াতে বললেন। তার হাতের দণ্ডটা উর্ধ্বে তুলে ধরেছেন।
গবলেট অব ফায়ার বলে দণ্ডটি দোলাতেই সব টেবিল দেওয়ালের দিকে চলে গেলে ঘরের মধ্যস্থলটা ফাঁকা হয়ে গেল। তারপর ডানদিকের দেওয়ালে জাদু বলে আরও একটা প্লাটফরম সৃষ্টি করলেন। সেই প্লাটফরমে নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র রাখা হল। হ্যারি অন্যমনস্ক হয়ে কিছু ভাবছিল। ভাবজগৎ থেকে ফিরে এল ওয়েরড সিস্টারদের স্টেজে দাঁড়াতে দেখে।
করতালিতে সারা হল মুখরিত হল। ওয়েরড দুই বোন দর্শকদের দিকে হাত তুলে শুভেচ্ছা জানিয়ে ওদের বাদ্যযন্ত্র তুলে নিল। হ্যারি মুগ্ধ হয়ে স্টেজের দিকে তাকিয়েছিল। সব লণ্ঠন উধাও হয়ে গেছে… আর ও ছাড়া বাকি সব চ্যাম্পিয়ন তাদের পার্টনারদের নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
পার্বতী হাতছানি দিয়ে হ্যারিকে ডেকে বলল–বসে আছ কেন, আমাদের এখন নাচতে হবে!
হ্যারি লম্বা রোবটা সামান্য তুলে এগিয়ে উঁড়াল। ওয়েরড বোনেরা তখন অতি ধিরে ধীর লয়ের শুর বাজাতে শুরু করেছে। হ্যারি এখন অতি উজ্জ্বল ড্যান্স ফ্লোরে দাঁড়াল। ও ইচ্ছে করে কারও দিকে তাকাল না। (অবশ্য আড় চোখে দেখল সিমাস ও ডিন হাত তুলল) পার্বতী ওর একটা হাত ধরে অন্য হাতটা ওর সরু কোমরে জড়াতে বলল।
হ্যারি অযথা ভেবে মরছিল। আগে যতোটা নার্ভাস হয়েছিল এখন তত নয়। বেশ স্বচ্ছন্দে পার্বতীর কোমর জড়িয়ে হাত ধরে বাজনার তালে তালে নাচতে লাগল। এবার শুধু চ্যাম্পিয়ন আর তাদের পার্টনারদের নাচ নয়, সকলেই যে যার পার্টনার নিয়ে নাচতে লাগল। হলে নানা রংয়ের আলো চক্রাকারে ঘুরতে লাগল। রূপালী বাষ্পে হলটা ছেয়ে গেল। ছাত্র–ছাত্রী, শিক্ষকরাও নাচছেন। মুডি তার কাঠের পা নিয়ে প্রফেসর সিনিস্টারা সঙ্গে নাচছে দেখে, হ্যারি পার্বতীর দিকে তাকিয়ে হাসল। সকলের নার্ভাসনেস উধাও হয়ে গেছে। নাচে–গানে গ্রেটহল অপূর্ব হয়ে উঠল। গমগম করতে লাগল। নেভিল বারবার জিন্নির পায়ে অজান্তে পা ফেলাতে জিন্নি রেগে গেল। ডাম্বলডোর মাদাম ম্যাক্সিমের হাত ধরে ধীর তালে চক্রাকারে নাচছেন। তিনি লম্বায় এত ছোট যে মাঝে মাঝ তার মাথার পয়েন্টে হ্যাটের একটা প্রান্ত মাদাম ম্যাক্সিমের চিবুকে ঠেকে তার অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছে।
মুডির কাছ দিয়ে পার্বতী যাবার সময় মুডি ম্যাজিকেল চোখ দিয়ে হ্যারিকে দেখে বললেন,–দারুণ মোজা পরেছ দেখছি।
–ঠিক বলেছেন, হাউজ এলফ ডব্বি আমাকে উপহার দিয়েছে হ্যারি হাসতে হাসতে বলল।
পার্বতী হ্যারির কানের কাছে মুখ এনে বলল–মুডির চোখ দেখলে ভয়ে গা শির শির করে। আমার মনে হয় এমন সুন্দর এক উৎসবে–আনন্দের দিনে ওই রকম চোখ নিয়ে আসতে দেওয়া ঠিক নয়।
ব্যাগপাইপ বাজার শেষের মধ্যে দিয়ে প্রথম পর্বের নাচ শেষ হতে হ্যারি যেন বন্দীত্ব থেকে ছাড়া পেল। ওয়েয়ার্ড দুই বোন বাজনা বন্ধ করেছে…. হল আবার আনন্দ ধ্বনি আর করতালিতে গমগম করে উঠল।
ওয়েয়ার্ড সিস্টার্স আবার নতুন গান শুরু করল। এবার দ্রুত তালে।
পার্বতী হাততালি দিয়ে বলল–অপূর্ব!
–আমার একটুও পছন্দ হচ্ছে না, হ্যারি সত্য কথা বলল না। কথাটা বলার পর পার্বতাঁকে নিয়ে ড্যান্স ফ্লোর ছেড়ে চলে গেল। তখন ফ্রেড–আঞ্জেলিনা গানের সঙ্গে পাগলের মতো নেচে চলেছে। দর্শকরা ওদের ধাক্কা লাগার ভয়ে পেছনে হটতে লাগল। রন–পদ্মার ঘাড়ের ওপর পড়ার অবস্থা!
–তোমার কেমন লাগল, রনকে হ্যারি–প্রশ্ন করল। হ্যারি ওর পাশে বসে এক বোতল বাটার বিয়র খুলল।
রন ওর কথার কোনও জবাব না দিয়ে হারমিওন–ক্রামের দিকে তাকাল। ওরা তখন পদ্মার কাছাকাছি নেচে চলেছে। পদ্মা তখন দু হাত বুকে জড়ো করে গানের তালের সঙ্গে পা নাচাচ্ছে। মাঝে মাঝে রনের দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। রন পদ্মাকে এরিয়ে যেতে চাইছে। একবারও পদ্মার দিকে তাকাচ্ছে না। পার্বতী আবার ফিরে এসে হ্যারির সামনাসামনি বসল। তারপরই বক্সবেটনের একটি ছেলে এসে ওকে নাচার জন্য অনুরোধ করতে পার্বতী হ্যারিকে বলল, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?
হ্যারি তখন চো–আর সেডরিকের নাচ দেখছিল। কথাটা যেন ভাল করে ওর কানে যায়নি। হকচকিয়ে পার্বতীর দিকে তাকিয়ে বলল–কি বললে?
একটু পরে হারমিওন ক্লান্ত হয়ে সামনে বসল। পার্বতী সেই চেয়ারটা খালি করে গেছে।
–হাই, হ্যারি বলল। রন কোনও কথা বলল না।
হারমিওন বলল–গরম লাগছে। রুমাল দিয়ে হাওয়া করতে লাগল।
–ভিক্টর পান করতে গেছে, হারমিওন বলল। ওখনও ওর গালের লাল ছোপ ছোপ দাগ মেলাই নি।
রন হারমিওনের দিকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ভিক্টর? এখনও পর্যন্ত ও তোমাকে ভিকি বলে ডাকতে বলেনি?
হারমিওন আশ্চর্য হয়ে রনের মুখের দিতে তাকাল।
–তাতে তোমার কী? হারমিওন বলল।
রন বলল–তুমি যদি না–জানো, তাহলে আমিও জানি না।.. কেন সে প্রশ্নের জবাব আমি তোমাকে দিতে চাই না।
হারমিওন হ্যারির দিকে তাকাল। হ্যারি শ্রাগ করল,–রন কী হয়েছে?
রন থুতু ফেলে বলল,–কী আবার, হারমিওন এখন হোগার্টে নয় ডারমস্ট্রাংগে বাস করছে। হ্যারির বিরুদ্ধে লড়ছে শুধু নয়, হোগার্টের বিরুদ্ধেও। শত্রুর সঙ্গে মিত্রতা! সেটাই তুমি এখন আমাদের ছেড়ে করতে চলেছ!
হারমিওন চুপ করে রইল। তারপরই বলল–মুখের মতো কথা বলবে না। শত্রু! সত্যি শত্রু? তাই ওরা যখন এসেছিল তুমি শুধু আনন্দে নেচে উঠেছিলে শুধু নয় ভিক্টরের অটোগ্রাফ নেবার জন্য ক্ষেপে উঠেছিলে। বুঝলে আমি নই, তুমি। ডরমেটরিতে ওর মডেল কে রেখেছে শুনি!
রন পুরনো কথা তুলতে চাইল না।… তোমরা যখন লাইব্রেরিতে ছিলে তখন ও তোমাকে ওর সঙ্গে আসতে বলেছিল। তাই না?
–হাঁ বলেছিল… তাতে কী হল? হারমিওনের মুখের চেহারা বদলে গেল।
–আর তুমি বোধহয় ওকে SPEWতে যোগ দিতে বলেছ?
–না, আমি বলিনি।… তুমি, যদি সত্যিই জানতে চাও–ও বলছে, আমি যখন লাইব্রেরিতে একা পড়াশুনা করি তখন সে আমার সঙ্গে কথা বলতে প্রতিদিন সেখানে যায়। কিন্তু কখনো কথা বলতে সাহস করেনি!
হারমিওন কথাগুলো খুব তাড়াতাড়ি বলল। ওর মুখটা রাগে–অপমানের আরও লাল হয়ে উঠল।
রন বিশ্রীভাবে বলল–ওহহ, তাহলে ও এই বিষয়।
–তার মানে তুমি কী বলতে চাও, বলত। খুলে বলবে?
–সহজ কথা, অতি সোজা কথা। ও কারকারফের ছাত্র তাই না? ও জানে কাঁদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াও… ও সুযোগ বুঝে হ্যারির ঘনিষ্ঠ হতে চায়, ওর কাছ থেকে ওর খবর সংগ্রহ করতে চায় নয়ত কাছাকাছি এসে ওকে হেয় করতে চাইছে।
.
হারমিওন এমনভাবে বনের দিকে তাকাল যেন ও হঠাৎ ওকে একটা চড় মেরেছে। কথা বলার সময় গলা কেঁপে উঠল–তুমি জানবে ও এখন পর্যন্ত আমাকে হ্যারি সম্বন্ধে একটি প্রশ্ন ও করেনি।
রন এবার ভিন্নভাবে কথাটি বলল–দেখবে, এক সময় ও সোনার ডিমের ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাইবে। মানে লাইব্রেরিতে প্রসঙ্গক্রমে তোমার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবে।
–অবশ্যই, আমি ওকে কোনওভাবেই সাহায্য করব না। হারমিওনকে দেখে মনে হয় ও খুব ক্ষিপ্ত, কিছুক্ষণ থেমে আবার বলল।
–না, কখনই না… তুমি এমন কথা বলবে না রন।… তুমি কি জানো না আমি চাই টুর্নামেন্টে হ্যারি জিতুক? কি করে এই কথাটি তুমি আমাকে বললে। হ্যারিও এটা ভালভাবেই জানে।
রন মুখ ভঙ্গি করে বলল–তোমার ভাবভঙ্গি দেখে কি তা মনে করা যায়।
হারমিওন সরু সরু গলায় জোর দিয়ে বলল-এই টুর্নামেন্টের আসল উদ্দেশ্য বিদেশী জাদুকরদের জানা… তাদের বন্ধুতা সূত্রে আবদ্ধ হওয়া।
রন চীকার করে বলল–কখনই না।… কে হারে, কে জেতে… সেটাই উদ্দেশ্য।
ওরা এত উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে যে এধার–ওধারে থেকে অনেকেই ওদের দিকে তাকাল।
…রন, হ্যারি ধীরস্থির কণ্ঠে বলল–আমি তো হারমিওনের ক্রামের সঙ্গে কথা বলাতে কোনও মতলব খুঁজে পাই না।
কিন্তু রন হ্যারির কথায় কর্ণপাত করে না।
রন বলল–যাও যাও দেখে এস তোমার ভিক্তি কোথায় একা একা ঘুরছে… হয়ত তোমাকেই পাগলের মতো খুঁজছে।
হারমিওন ঝট করে দাঁড়িয়ে চোখ পাকিয়ে বলল–ভিক্কি ভিকি বলবে না!… এক রকম ঝড়ের বেগে ড্যান্সফ্লোরের দিকে গিয়ে জনতার মধ্যে মিশে গেল।
রন হারমিওন চলে যাবার পর একটু রেগে গেলেও… মুখে হাসি ফুটে উঠল। পদ্মা এসে বলল–আমার সঙ্গে তুমি আরো নাচবে না?
–না। ওর দৃষ্টি তখনও হারমিওনের চলে যাবার দিকে।
–বেশ তাই। পদ্মা, পার্বতী আর বক্সটেনের ছেলেটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল।
হা–র–মি–ওনকে দেখছো? কে যেন কাছ থেকে বিদেশী ভাষায় কথাটা বলল।
রন মুখ উঁচু করে দেখলাম ওদের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হাতে দুটো বাটার বিয়র বোতল।
–বলতে পারি না, রন ক্রামের দিকে তাকিয়ে বলল। ওকে খুঁজে পাচ্ছো না?
–ওয়েল, তোমরা ওকে যদি দেখতে পাও তো বলো আমার কাছে পানীয় আছে… বলেই ও মন্থরগতিতে চলে গেল।
–ভিক্টরের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে… রন?
কোথা থেকে পার্সি এসে হাজির। হাত রগড়াতে রগড়াতে বলল (ওকে খুব তাতারী দেখাচ্ছিল), অতি চমৎকার… এইতো চাই… একেই বলে নিজেদের মধ্যে জাদুময় বোঝাপড়া।
হ্যারিকে ভ্রুক্ষেপ না করে পার্সি পদ্মার পরিত্যক্ত চেয়ারে বসল। টপ–টেবিল তখন শূন্য। প্রফেসর ডাম্বলডোর, প্রফেসর প্রাউটের হাত ধরে নাচছেন। লুডো বেগম্যান, প্রফেসর ম্যাগগোনাগলের সঙ্গে। হ্যাগ্রিড আর মাদাম ম্যাক্সিম অনেক জায়গা নিয়ে নাচছেন। কারকারফের কোনও পাত্তা নেই। পরবর্তী গান শেষ হলে আবার সকলে হাততালি দিল। হ্যারি দেখল লাডো বেগম্যান, প্রফেসর ম্যাগগোনাগলের হাতে চুম্বন করলেন… তারপর জনতার ভিড়ে মিশে গেলেন। ঠিক সেই জর্জ–ফ্রেড এসে দাঁড়াল।
–ওরা কি ভাবে নিজেদের, মন্ত্রণালয়ের অফিসারদের অবজ্ঞা করে চলেছে। ফ্রেড আর জর্জকে আসতে দেখে চুপ করার আগে ফিসফিস গলায় পার্সি বলল…. একেবারেই কোন সম্মান নেই।
লাডো বেগম্যান হ্যারিকে দেখে টেবিলের কাছে একটা চেয়ার টেনে এনে বসলেন।
পার্সি, বেগম্যানকে বলল–আমার দু ভাই আপনাকে বিরক্ত করছে না তো?
–কী বললে? বিরক্ত? না না মোটেই না, বেগম্যান বললেন। আসলে ওরা আমাকে ওদের নকল জাদুদন্ডের কথা বলছিল। ভাবছি, আমি ওদের ওগুলো নিয়ে ব্যবসা করতে বলব। আমি ওদের দুএকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেখব বলেছি। বিশেষ করে জুংকোস জোকশপের সঙ্গে।
পার্সি খুশি হল না। হ্যারি বাড়ি গিয়ে ব্যাপারটা মিসেস উইসলিকে বলে দিতে পারে। ইদানীং ফ্রেড আর জর্জের উচ্চ আকাক্ষা বেড়েই চলেছে। নকল জাদুদণ্ড বিক্রি করার প্ল্যান করছে।
বেগম্যান হ্যারিকে কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য মুখ তুলতেই পার্সি অন্য আলোচনায় চলে গেল।
–মি. বেগম্যান টুর্নামেন্টে কেমন চলছে, আপনার মনে হয়? আমাদের ডিপার্টমেন্ট তো খুব খুশি, গবলেট অব ফায়ার নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও টুর্নামেন্টটা ঠিক মতো চলছে, আপনার কি মনে হয়?
–খুব ভাল, খুব ভাল, বেগম্যান সহাস্যে বললেন–অনেক আনন্দ দিচ্ছে। ও হা বার্টি কেমন আছে? আশ্চর্য ব্যাপার, ও কেন আসেনি বলত? লজ্জার ব্যাপার।
–ওনার শরীর তেমন ভাল নেই। দুএকদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠবেন আশা করি, পার্সি নিজেকে বেশ উঁচুদরের অফিসার ভাব করে তেমন সুরে বলল।তবে আমি কাজ যেন পড়ে না থাকে সে বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি দিয়ে চলেছি। মি. ক্রাউচের অনুপস্থিতিতে আমার কাজ বেড়ে গেছে। মি. ক্রাউচের সব কাজের দায়িত্ব আমার কাঁধে চেপেছে।… ও, আপনি আলি বশিরের নাম শুনেছেন তো? শুনছি ও একজন আন্তর্জাতিক স্মাগলার। বে–আইনিভাবে আমাদের দেশে ফ্লাইং কার্পেট পাচার করে আনার জন্য ধরা পড়েছে… শুনেছেন তো? তারপ ট্রান্সসিলভানিঅনসের সঙ্গে আন্ত র্জাতিকভাবে দ্বন্দ্ব যুদ্ধ নিষিদ্ধ সম্বন্ধে আলাপ–আলোচনা চলছে। নতুন বছরে ম্যাজিক্যাল সহযোগিতার বিভাগীয় কর্তার সঙ্গে আমার একটা মিটিং আছে।
রন, হ্যারিকে বলল–চল আমরা একটু হেঁটে আসি।… উঃ পার্সি কান ঝালাপালা করে দিয়েছে।
আরও একটু ড্রিঙ্কস দরকার ভান করে ওরা গ্রেটহল থেকে বেরিয়ে গেল…।
ফ্রন্টডোর খোলা ছিল… বাইরের রোজগার্ডেনের বাহারি আলো ঠিকরে পড়ছে। আরেকটু এগিয়ে যাবার পর ওরা একটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে এসে পড়ল। তার চার পাশে ঝকঝকে পাকা–রাস্তা… রাস্তার দুধারে সুন্দর সুন্দর গাছ স্ট্যাচু। হ্যারির কানে এল অঝোর ধারায় জল পড়ার শব্দ… অনেকটা ঝরণা থেকে যেন জল পড়ার শব্দের মতো। রাস্তার ধারে কারুকার্য করা বেঞ্চের ওপর অনেকে বসে রয়েছে। রোজগার্ডেনের পেছনের দিকে একটা বাঁকা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে সামান্য একটু এগোতেই ওরা পরিচিত কণ্ঠের চাপা কথা শুনতে পেল। খুব একটা স্বাভাবিক কথাবার্তা নয়।
–ইগরকে নিয়ে যে সব ঘটছে সেদিকে তাকাবে না।
–সেভেরাস, তুমি ভান করে থাকতে পার না–যে কিছু ঘটছে না, কারকারফের কথায় চাপা কেউ যেন শুনতে না পায়।… দিনেদিনে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে আসছে, আমি ভীষণ ভাবছি, সে কথা অস্বীকার করতে পারছি না।
স্নেইপ চাচাছোলা গলায় বলল–পারছে না তো পালাও, তোমরা চলে গেলে, কেন গেছ সে ব্যাপারে আমি একটানা একটা অজুহাত খাড়া করব।… আমি আপাত: হোগার্ট ছেড়ে কোথায় যাচ্ছি না।
স্নেইপ আর কারকারফ ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। স্নেইপ ওর জাদুদণ্ড দিয়ে গোলাপ গাছের ঝোপ সরাতে সরাতে বেরিয়ে আসলো।
একটি মেয়ে ওদের সামনে দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখে স্নেইপ বললেন, ফসেট হাফলপফের দশপয়েন্ট গেল! র্যাভেন ক্লর ও দশ নম্বর যাবে, স্টেবিনস! মেয়েটির দিকে একজনকে যেতে দেখে বললেন স্নেইপ, তারপরই চোখ পড়ে গেল হ্যারির ওপর।–তোমরা দুজনে এখানে কি করতে এসেছ?… হ্যারির কারকারফের মুখের চেহারা দেখে মনে হল ওদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু থতমত খেয়ে গেছেন। ছাগল দাড়িতে হাত বুলোতে লাগলেন। আঙ্গুলগুলো কাঁপছে দাড়িতে হাত বুলোবার সময়।
–আমরা হাঁটতে বেরিয়েছি, হ্যারি স্নেইপকে বলল।–নিয়মের বাইরে নিশ্চয়ই নয়?
স্নেইপ খ্যাক খ্যাক করে বললেন, বেশ হাট হাঁট। তারপর ওদের ছেড়ে এগিয়ে গেলেন। যাবার সময় ওর কাল আলখেল্লা হাওয়াতে পৎপৎ করতে লাগল। কারকারফ হন্তদন্ত হয়ে স্নেইপের পিছু পিছু চললেন। হ্যারি–রন রোজগার্ডেনের চারপাশে ঘুরতে লাগল।
রন বলল–আচ্ছা কারকারফ এত উদ্বিগ্ন কেন বল তো?
হ্যারি আস্তে আস্তে বলল–জানি না, তবে হয়ত কোনও কারণ আছে। হাঁটতে হাঁটতে একটা পাথরের তৈরি বলগা হরিণের সামনে দাঁড়াল। তার পেছনে বিরাট একটা ঝরণা চাঁদের আলোয় জল চকচক করছে। অদূরে একটা বেঞ্চের ওপর কালো কালো ছায়ার মতো দুটো বিরাট মূর্তিকে বসে থাকতে দেখে থমকে গেল। ওরা দুজনে চাঁদের আলো পড়ে চকচকে ঝরণার জল মোহিত হয়ে দেখছে মনে হল। তারপরই হ্যারির কানে এল হ্যাগ্রিডের অতিপরিচিত কণ্ঠস্বর।
মাদাম আমি দেখেছিলাম, আমি জানতাম। হ্যাগ্রিড অদ্ভুত এক ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন।
ওরা দুজন যেন বরফ হয়ে গেছে।… এমন একটা দৃশ্য দেখতে পারে ওরা ভাবেনি।… হ্যারি সামনে পেছনে তাকাল। দেখতে পেল ফ্লেউর ডেলাকৌর আর রোজার ডেভিসকে। গোলাপ ঝাড়ের পেছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।… হ্যারি রনের কাঁধে টোকা দিয়ে ওদের দিকে চোখ রাখল। হ্যারির ওদের দেখে মনে হল ওরা খুব ব্যস্ততার সঙ্গে কিছু আলোচনা করছে। ফ্লেউরের সঙ্গে ডেভিসকে দেখে রনের চোখ বড় বড় হয়ে গেল। হ্যারিকে জোর করে বলগা হরিণের পাথরের মূর্তির পেছনে আত্মগোপন করায় রন।
–তুমি কি করে জানলে ্যাহ্যাগ্রিড মাদাম ম্যাক্সিম বললেন, গলায় ফাস ফাস শব্দ।
হ্যারি কথা বাড়াতে চাইল না। ও জানে ওরা লুকিয়ে কথা শুনছে জানতে পারলে হ্যাগ্রিড পছন্দ করবেন না। হ্যারি দুকানে আঙ্গুল গুঁজে গুনগুন করে গান গাইতে চাইল যাতে ওদের কথা শুনতে না হয়। ও মন–কানকে অন্যমনস্ক করার জন্য পাথরের বলগা হরিণের পেছনে একটা গুবড়ে পোকাকে গুটি গুটি হাঁটতে এগিয়ে যেতে দেখতে লাগল। কিন্তু পোকাটার চাইতে হ্যারির কান হগ্রিডের কথা শুনতে আগ্রহ বেশি।
–আমি জানি না তুমি আমার… মা, অথবা আমার বাবার মতো!
–আমি জানি না তুমি কী বলতে চাইছ হ্যাগ্রিড।
–আমার মায়ের মতো, হ্যাগ্রিড শান্তস্বরে বলল। তার চেহারা আমার এখন মনে নেই। আমার তিনবছর বয়সে মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। মা যেমন স্নেহপ্রবণ হন তেমন তিনি ছিলেন না… কেন তা ঠিক জানি না। জানি না এখন তিনি বেঁচে আছেন, না মারা গেছেন। মনে হয় এতদিনে মারা গেছেন।
মাদাম ম্যাক্সিম চুপ করে রইলেন। হ্যারি আবার পোকাটার গতিবিধির ওপর নজর দিল। আগে কখনও হ্যাগ্রিডের শৈশবের কথা ওর মুখ থেকে শোনেনি।
মা চলে গেলে বাবা খুব ভেঙে পড়েছিলেন। বাবা বেশ নরম প্রকৃতির ভাল মানুষ ছিলেন। আমার যখন দু বছর বয়স তখনই বাবাকে তুলে আলমারির ওপর বসিয়ে দিতে পারতাম। অবশ্য বাবা যখন আমার উপর রাগ করতেন তখন। তারপরই বাবার রাগ উবে যেত; বাবা হাসতেন।… কথাগুলো বলতে বলতে হ্যাগ্রিডের ভরাটগলা কেঁপে কেঁপে উঠল। মাদাম ম্যাক্সিম একাগ্রচিত্তে হ্যাগ্রিডের শৈশবের কথা মন দিয়ে শুনেছিলেন। মাঝে মাঝে ঝরণার জলের দিকে তাকাচ্ছিলেন। স্কুলে ভর্তি হবার কিছুদিন পর আমার বাবা মারা গেলেন। ডাম্বলডোর সত্যই বড় দয়ালু মহান ব্যক্তি। আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।… তারপর হ্যাগ্রিড, মাদাম ম্যাক্সিমকে বললেন, আমার সম্বন্ধে তো আপনাকে অনেক বললাম। এবার আপনার কথা বলুন।
কিন্তু মাদাম ম্যাক্সিম কোনও কথা না বলে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন।
খুব ঠান্ডা লাগছে, মাদাম বললেন। কিন্তু হ্যারির মনে হল দারুণ ঠাণ্ডা হোক আর যাই হোক… মাদাম ম্যাক্সিমের ঠাণ্ডা গলার স্বরের মতো নয়।… এবার আমরা যাই–হ্যাগ্রিডকে মাদাম বললেন।
হ্যাগ্রিড অদ্ভুত স্বরে বললেন, এখন যাবেন না, আপনার মতো কারো সাথে আমার দেখা হয়নি।
–পরিষ্কার করে বলুন। কি বলতে চান, মাদাম আবার সেই রকম ঠাণ্ডা গলায় বললেন।
হ্যারির মনে হল হ্যাগ্রিডকে বলে, ওর কথার জবাব দেবে না। কিন্তু ও ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে রইল। ঠাণ্ডায় ওর সমস্ত শরীর ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। আশা… আশা করতে লাগল… হ্যাগ্রিড যেন নীরব থাকেন।
হ্যাগ্রিড বললেন, আপনি অর্ধ দানবী।
-এত সাহস আপনার? এর আগে কেউ আমাকে এমন কথা বলতে ভয় সাহস পায়নি।
ম্যাক্সিমের তীব্র গলার স্বরে শান্ত রাতের বাতাস জাহাজের সাইরেনের শব্দের মতো তীব্র হয়ে ফেটে পড়ল। হ্যারি দেখল অদূরে ফ্লেউর আর রোজার গোলাপের ঝোপ–ঝাড়ু থেকে চলে গেল।–আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এমন অপমান করেনি। আমি অর্ধদানবী?… আমার দেহে বড় বড় হাড়?
ঝড়ের বেগে মাদাম ম্যাক্সিম চলে গেলেন। যাবার সময় ঝোপ–ঝাড়ে সামান্য ধাক্কা লাগতেই গাছের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা নানা রং-এর শত শত পরীরা বাতাসে উড়তে লাগল। হ্যাগ্রিড তখনও একদৃষ্টি মাদাম ম্যাক্সিমের যাবার পথের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বেশ অন্ধকার তাই ওর মুখের ভাব দেখতে পেলোনা হ্যারি। তারপর এক মিনিট পরে হ্যাগ্রিড উঠে পড়ে ক্যাসেলের দিকে না গিয়ে অন্যদিকে চলতে লাগলেন।
হ্যারি, রনের হাতে মৃদুটান দিয়ে বলল, চল আমরা যাই। কিন্তু রন একটুও নড়ল না।
–কী হল, যাবে না? হ্যারি আশ্চর্য হয়ে বলল।
রন, হ্যারির দিকে তাকাল। মুখটা অতি গম্ভীর…
–তুমি কী জান হ্যাগ্রিডও অর্ধদানব?
–না, হ্যারি বলল,–তো কী হয়েছে?
রনের দৃষ্টি থেকে হ্যারির বুঝতে বাকি রইল না ও জাদুকর পৃথিবীর কিছুই জানে না, কোনও তার অভিজ্ঞতা নেই। ডার্সলে পরিবারে বড় হয়েছে। তা সত্ত্বেও জাদুকররা ধরে নিয়েছে সে একেবারে অনভিজ্ঞ নয়। স্কুলে উপরের ক্লাসে ওঠার পর এই প্রশ্নটি একেবারেই কমে এসেছে। এখন অবশ্য ও বলতে পারে… বেশিরভাগ জাদুকর বলবে না তাতে কী?… এক বন্ধুর মা দানবী ছিল জেনে কোনো জাদুকর পরিবারের লোক কী তার মতো এ কথা বলবে!
রন বলল–ভেতরে চল দৈত্য–দানব, অস্বাভাবিক বৃহক্কায় মানুষ বলতে কি বোঝয় বলছি।.. চল।
ফ্লেউর আর রোজার ডেভিস খুব সম্ভবতঃ আরও কোনও নিরিবিলি জায়গায় লুকিয়ে পড়েছে।
হ্যারি আর রন গ্রেটহলে ঢুকল। দেখল পার্বতী আর পদ্ম অদূরে বসে একদল ছেলের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। হারমিওন তখনও ক্রামের সঙ্গে নাচছে। ড্যান্স ফ্লোর থেকে সরিয়ে দেওয়া একটা টেবিলের কাছে ওরা বসল।
হ্যারি এখন দানব–দানবী সম্বন্ধে জানতে উৎসুক। বলল–দানব–দানবীর সমস্যাটা কোথায়?
রন বলল–মানে…, হ্যারি শব্দ খুঁজে পাচ্ছে না কি বলবে… ওরা খুব একটা ভালো না। রন জানে হ্যাগ্রিডের মা ছিলেন অর্ধ দানবী।… তা হলেও হ্যারিকে ধীরে–সুস্থে বলবার চেষ্টা করল।
হ্যারি বলল–সমস্যা কোথায়! হ্যাগ্রিডের কি কমতি আছে।
রন ভারিক্কি চালে বলল–তুমি জাদুকর পরিবারে জন্মালেও, মাগল পরিবারে বড় হয়েছে।… যাকগে আমি জানি কোনও অপরাধ বা কমি নেই।… কিন্তু আমি জানি শিশু অবস্থা থেকেই হ্যাগ্রিড বিশ্রী এনগরজমেন্ট চার্ম দেখে তার আবহাওয়াতে বড় হয়েছে। কথাটা কাউকে ও জানাতে চায় না।
–কিন্তু ওর মা দানবী হলে কি আসে যায়?, ব্যরি বলল।
–হা লোকেরা না জানলে কিছু যায় আসে না। কারণ সকলেই হ্যাগ্রিডকে জানে দানব–দানবীর মতো ও ভয়ঙ্কর নয়। রন হ্যারিকে খুব ধীরে ধীরে বলল।… কিন্তু হ্যারি, তুমি জানো দানবরা অত্যন্ত অসৎ, বদমেজাজী, দূষিত ও খারাপ, ব্যাধিতে আক্রান্ত।… হ্যাগ্রিডও এই কথা বলেন, ওটা ওদের রক্তের মধ্যে মিশে গেছে… জন্মগত স্বভাব.. ওরা অনেকটা বলা যায় অতি প্রাকৃত প্রাণী ওরা সব সময় খুন–হত্যা–মারামারি নিয়ে থাকে। সকলেই জানে। এখন আমাদের দেশে ওরা নেই বললেই চলে তাহলেও…।
–তাহলে এখন ওরা কোথায় থাকে?
-একটু একটু করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অনোরর মারাও হচ্ছে অনেক। ওরা আসলে বহিরাগত… এদেশের আদি প্রকৃত প্রাণী নয়।… শোনা যায় আমাদের দেশে পাহাড়–পর্বতে আত্মগোপন করে থাকে।
–মাদাম, হ্যাগ্রিডের কথায় এত রেগে গেলেন কেন জানিনা, হ্যারি বলল। (বিচারকদের সঙ্গে গম্ভীর মুখে বসেছিলেন ম্যাক্সিম)–হ্যাগ্রিড যদি অর্ধদানব হন, তাহলে মাদাম অবশ্যই বিরাট বিরাট হাড়ওলা দানবী। মনে হয় ডাইনোসরদের (অধুনালুপ্ত সরিসৃপ… আনুমানিক আশি ফুট দীর্ঘ) চেয়ে তার দেহের হাড় সামান্য ছোট।
হ্যারি–রন গ্রেটহলে বসে বসে বলড্যান্সের বাকি সময়টা দানব–দানবী নিয়ে আলোচনা করে কাটিয়ে দিল। ওদের নাচার আর কোনও প্রবৃত্তি বা উৎসাহ নেই। হ্যারির একটুও মন চাইল না চো–সেডরিককে দেখতে। ওর মনে হল কোনও কিছুর ওপর প্রচন্ডভাবে লাথি মারে।
গভীর রাতে ওয়ের্ড বোনদের গান শেষ হলে… হলের সকলেই ওদের করতালি, হৈ–চৈ… নানা সুন্দর মন্তব্য দিয়ে অভিনন্দিত করল। দল বেঁধে সকলে ওদের এনট্রেন্স হলের মুখ পর্যন্ত পৌঁছে দিল। এত জমে উঠেছিল যে অনেকেই চাইছিল মধ্যরাতে শেষ না হয়ে বাকি রাতটুকু চলুক। কিন্তু হ্যারি আর বসতে চাইছিল না। ডরমেটরিতে শুয়ে পড়তে পারলে বাঁচে।… অন্তত ওর কাছে ক্রিস্টমাসের সন্ধ্যেটা হর্ষ আনন্দে কাটেনি।
এনট্রেন্স হলের মুখে ওরা হারমিওনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ও তখন ক্রামকে শুভরাত্রি জানাচ্ছিল। ক্রাম ডারমস্ট্রাংগ জাহাজে ফিরে যাবে। হারমিওন রনের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকাল। একটিও কথা ওর সঙ্গে না বলে মার্বেল পাথরের সিঁড়ির দিকে চলল। হ্যারি–রন ওর পিছু পিছু চলল। প্রায় অর্ধেক সিঁড়িটা পার করেছে তখন ওর নাম ধরে কেউ ডাকল।
–হে, হ্যারি!
হ্যারি পেছন ফিরে দেখল সেডরিক ডিগরি! হ্যারি দেখেছে চো ওর জন্য এনট্রেন্স হলের মুখে অপেক্ষা করছিল।
সেডরিক একরকম দৌড়তে দৌড়তে হ্যারির পাশে দাঁড়াল।
সেডরিকের মুখ দেখে হ্যারির মনে হল রনের সামনে ও কিছু বলতে চায় না। রনও মেজাজের সঙ্গে সেডরিকের দিকে তাকিয়ে গটগট করে চলে গেল।
রন উধাও হলে সেডরিকে বলল–শোন… তুমি আমাকে ড্রাগনের কথা আগে বলেছিলে–সত্যই কৃতজ্ঞ। তোমার সোনার ডিম সম্বন্ধে মনে আছে? তুমি কবে ডিমের মুখটা খুলবে তা ঠিক করেছো?
–হ্যাঁ খুলেছি, হ্যারি বলল।
–স্নান করতে যাও।
–মানে? হ্যারি কথাটার অর্থ না বুঝে পুরো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
–বললাম তো স্নান করতে যাও।
–কী সব বকছ?
–বলছি স্নান করতে যাবার সময় ডিমটাকে সঙ্গে নিয়ে যাও… সামান্য গরম জল দিয়ে মুখটা ঘষে।… তখন ভাবতে সাহায্য করবে। আমার ওপর ভরসা রাখ, বিশ্বাস কর।
হ্যারি সেডরিকের মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
বললাম তো স্নান। প্রিফেকটদের বাথরুমে। চারতলার বোরিস দ্যা রিউইলডার্ডর স্ট্যাচুর বাঁ দিকে পাঁচতলায় যাবে। পাশওয়ার্ড হচ্ছে পাইন—ফ্রেশ–দেরি করো না যাও…।
–আচ্ছা শুভরাত্রি।
চলে যাবার আগে আবার সেডরিক হাসল… তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে চোর কাছে গেল।
হ্যারি একা একা গ্রিফিন্ডর টাওয়ারে চলে গেল।… সেডরিকের কথাবার্ত ওর কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হল। স্নান করে ডিমের মুখে জল ঢাললেই জানতে পারবে ডিম কি আর্তনাদ করবে? সেডরিক তো ওকে বোকা বানাতে চাইছে না তো? সকলের সামনে হ্যারিকে কি হেয় প্রতিপন্ন করতে চাইছে? চোর কাছে ও যে সকলের সেরা তাই দেখাতে চাইছে?
হ্যারি পাশ ওয়ার্ড ফেয়ারি লাইটস বলে কমনরুমে ঢুকল। অনেক রাতে ঘুম ভাঙিয়ে দেবার জন্য ফ্যাটলেডী ওর ওপর খ্যাপল। ও দেখল রন আর হারমিওন কথা কাটাকাটি করছে। মাত্র দশ ফিট দূরে দাঁড়িয়ে এমন জোরে কথা বলছে যেন ওরা সহস্র মাইল দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
হারমিওন বলল–বেশ তোমার ভাল না লাগে তাতে আমার কিছু করার নেই। ওর চোখ–মুখ রাগে ফেটে পড়ছে। মাথার চুলের বাঁধন খুলে গেছে।
–আসছেবার চুপ করে বসে না থেকে আগে আমায় জিজ্ঞেস করবে।
রনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হারমিওন গট গট করে নিজের ঘরে চলে গেল।