1 of 2

২৩. আমি যদি এই কোম্পানি ছেড়ে দিই

আমি যদি এই কোম্পানি ছেড়ে দিই তা হলে আপনি কী করবেন?

দীপনাথ একটু ভেবে বলল, কী করে বলি? আপনি কি সত্যিই ছাড়ছেন?

ছাড়তে পারি। একটা ইংলিশ ফার্ম ভাল অফার দিয়েছে। পুরোপুরি ইংলিশ নয়, ইন্ডিয়ান কোলোবোরেটর আছে।

ভাল অফার কি?

খুবই ভাল অফার। ডিরেক্টর করবে বলে প্রমিস করেছে। কিন্তু সেটা কোনও কথা নয়। আমার প্রশ্ন হল, আপনি কী করবেন?

দীপনাথ মিস্টার বোসের দিকে চেয়ে ছিল। বোস ঠ্যাং ছড়িয়ে বেতের আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছে। সামনে বেতের টেবিলে দুটো বিয়ারের বোতল আর গেলাস। বোতলের গায়ে এখনও ফ্রিজের কুয়াশা। দীপনাথ নিজের গেলাস নামিয়ে রেখে বলল, আমার তো এ কোম্পানিতে কোনও পাকা চাকরি নেই। আপনি চলে গেলে এরাই বা রাখবে কেন?

একজ্যাক্টলি। আমিও তাই জানতে চাইছিলাম, আপনি আমার সঙ্গেই থাকতে চান কি না।

বোসের গলার স্বর খুব সহানুভূতি এবং সমবেদনায় মাখনের মতো নরম হয়ে কানে বাজল।

দীপনাথ বলল, খবরটা খুব আনএক্সপেকটেড। আমি একটু ভেবে দেখি।

বোস অসহিষ্ণুভাবে বলে, আপনি কেন ইনস্ট্যান্ট ডিসিশন নিতে পারেন না বলুন তো? সব সময়ই সব কাজে আপনার জড়তা দেখতে পাই। জীবনে বড় কিছু করতে গেলে ডিসিশনটা মাস্ট বি প্রোন্টো।

তাড়াহুড়োর কিছু আছে কি?

আছে।–বোস প্লেট থেকে কাই মাখানো সসেজ কাটায় তুলে মুখে দেয়। বিয়ারে দীর্ঘ চুমুকের পর বলে, ইংলিশ ফার্মের ম্যানেজিং ডিরেক্টর গ্র্যান্ডে বসে চারদিকে জাল ফেলছেন। পরশু ফিরে যাচ্ছে বাংগালোরে। যাওয়ার আগেই পাকা কথা হয়ে যাবে।

শুয়োরের মাংসের প্রতি আজন্ম একটু খুঁতখুঁতোনি থাকা সত্ত্বেও স্রেফ বোসকে সঙ্গ দিতে দ্বিতীয়বার সসেজ খেয়ে খুব সংকোচের সঙ্গে বলল, এই কোম্পানিতে আমার কোনও স্ট্যাটাস ছিল না। নতুন কোম্পানিতে কোনও স্ট্যাটাস পাব কি?

স্ট্যাটাস!

বলে বোস হাঁ করে একটু চেয়ে থাকে। বারান্দায় কোনও আলো নেই। ঘর থেকে আর রাস্তা থেকে যেটুকু আলো আসছে তাতে অন্ধকার কাটেনি। তাই বোসের চাউনিটা ভাল করে বুঝতে পারল না দীপ। বোস একটা হুঁ বলে সোজা হয়ে বসল। তারপর বলল, কোম্পানি যে এখনই নতুন লোক নেবে এমন কোনও অ্যাসুরেনস নেই। আমিও কথা দিতে পারছি না। তবে ওখানেও আপনি এর চেয়ে খারাপ থাকবেন না।

আপনি কি আমার জন্য চেষ্টা করবেন?

করব। তবে প্রথম দিকে নয়। পরে। এ কোম্পানি সদ্য স্টার্ট করছে। দে নিড এ লট অফ এক্সপিরিয়েন্সড পিপল। কাজেই আপনারও চান্স আছে। কিন্তু প্রথম লটে নয়। আপনি তো ততটা এক্সপিরিয়েন্সড নন।

দ্বিতীয়বার ঘেন্না-পিত্তি সত্ত্বেও সসেজটি খারাপ লাগেনি দীপের। কিন্তু বোস যেহেতু আর সসেজ খেল না সেইজন্য তারও আর-একটা খেতে সংকোচ হচ্ছিল। পেটে যথেষ্ট খিদে। সে বিয়ারে নিরাসক্ত একটা চুমুক দিয়ে বলে, বাংগালোরেই যেতে হবে?

অফ কোর্স।

দীপ আনমনা হয়ে গেল কয়েক পলকের জন্য। বাংগালোরে। তার মানে হিমালয়ের সেই সব মহান পাহাড় থেকে আরও বহু দূরে। বাংগালোরে গেলে যখন-তখন প্রীতমটার কাছে গিয়ে হাজির হওয়া যাবে না। বাংগালোর দীপনাথের অচেনা নয়। বার তিনেক গেছে বোসের সঙ্গেই। বড় ভাল পরিচ্ছন্ন শহর। তবু তো দূর।

কী ভাবছেন?

ভাবছি, অনেকটা দূর।

বোস হঠাৎ হেসে ফেলে। খিলখিল মেয়েলি হাসি। বলে, দূর? কোথা থেকে দূর?

কলকাতা থেকে।

আমি যদি উলটো করে বলি বাংগালোর থেকেই কলকাতা দুর।

তার মানে?

বোস কথাটার সোজা জবাব না দিয়ে বলে, দুরের কনসেপশনটা বাঙালিদের খুব অদ্ভুত। আমার তো কোনও জায়গাকেই পরের জায়গা মনে হয় না, তাই দূরের জায়গা বলেও ভাবি না।

দীপনাথ একটু গোঁজ হয়ে থেকে অনিচ্ছার সঙ্গে বলে, সে অবশ্য ঠিক।

আপনাকে কলকাতার ভূতে পেল নাকি? কিন্তু শুনেছি আপনি নর্থ-বেঙ্গলের ছেলে।

দীপ একটু বিষণ্ণ গলায় বলল, কলকাতায় আমার এক ভগ্নিপতি থাকে। সে ভীষণ অসুস্থ। আমি ছাড়া ওদের মর্যাল গার্জিয়ান কেউ নেই।

বোস বোতল থেকে বিয়ার ঢালছিল গেলাসে। কথাটা শুনল কি না বোঝা গেল না, তবে পাত্তাও দিল না তেমন। বলল, ওটা কোনও কথা নয়। ইয়োর ডিসিশন মাস্ট বি ভেরি প্রম্পট।

বোস যখন বিয়ার ঢালছিল তখন প্রায় চুরি করার মতো করে আর-একটা সসেজ তুলে নিল দীপ। ভিতরটা হতাশায় ভরা। বোস চলে গেলে তার খুঁটি সরে যাবে। হতাশায় ফাঁকা পেরা অভ্যন্তরে সসেজটাকে পাঠিয়ে দীপনাথ কিছুক্ষণ বিয়ারের ঝিল্লিধ্বনি শুনল নিজের মাথায়। আজ মণিদীপা বাড়িতে নেই। কোথায় গেছে, আসবে। সেই পিকনিকের পর থেকেই মণিদীপার সঙ্গে কথা প্রায় বলেইনি সে। বড় অভিমান হয়েছিল। আর সবাই তাকে ফেলে চলে এলেও ক্ষতি ছিল না, কিন্তু মণিদীপা এল কী করে! সে তো মাতালও হয়নি সেদিন? সেই দিন দুপুরেই না মেজদার বাড়িতে গিয়ে খুব আঠা দেখিয়ে এসেছিল?

কী ভাবলেন?

কিছু না।

ভাবনাটা স্টার্ট করুন। কাল বা পরশুই একটা ফাইনাল কথা আমাকে জানিয়ে দেবেন।

আচমকা দীপ ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করে, ড়ু ইউ লাভ মি মিস্টার বোস?

বোস প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবে সময় নিয়ে এক রাউন্ড সসেজ বিয়ারের সঙ্গে ভিতরে পাঠিয়ে বলল, অ্যাজ এ ফ্রেন্ড ইউ আর টপ গ্রেড। অ্যান্ড আই রিয়েলি নিড এ ফ্রেন্ড।

এ কথার জবাব হয় না। কথাটা হয়তো আবেগ থেকেই বলা, যদিও বোসের আবেগ সহজে প্রকাশ পায় না।

একটু বাদে আর কিছু বিয়ার খাওয়ার পর বোস খুব গা ছেড়ে বসে ধীরে ধীরে বলে, আমার যে সত্যিকারের কেউ নেই তা বোধহয় আপনি এতদিনে টের পেয়েছেন।

দীপনাথ একটু মুশকিলে পড়ে গিয়ে আমতা-আমতা করে বলে, বৃহৎ মানুষরা সব সময়ই একা।

কথাটা দীপনাথ কোথায় যেন শুনেছিল। আজ আলটপকা কাজে লেগে গেল। বোস খুশিই হল বোধহয়। আহাম্মকটা হয়তো সত্যিই নিজেকে বৃহৎ মানুষ ভাবে। বিয়ার সহযোগে তাই হয়তো কিছুক্ষণ মনে মনে কথাটাকে উপভোগ করল। তারপর বলল, মিসেস বোস অবশ্য বাংগালোরে যেতে রাজি নন।

কেন?

কে জানে? শি হ্যাজ হার ওন ওয়ে। উনি ভয়ংকর স্টাববার্ন।

তা হলে?

তা হলে কিছুই না। আমি যাচ্ছিই।

মিসেস বোসের কী হবে?

শি মে সিক এ ডিভোর্স।

কথাটা এমন অনায়াসে বলে ফেলল বোস যে, খুব অবাক লাগল দীপনাথের। ডিভোর্সের ব্যাপারটা এখনও কোনও বাঙালির কাছে এতটা জলভাত হয়ে যায়নি। সে তাই বলল, না না, তাই কি হয়?

বোস কথাটায় কান না দিয়ে বলল, ওঁর একজন অ্যাডভাইজার আছে। স্নিগ্ধদেব চ্যাটার্জি। এ লেফটিস্ট হুলিগান। উনি তার পরামর্শ ছাড়া কিছু করবেন না। দ্যাট বাগার কন্ট্রোলস হার।

জুয়াড়ির মতো আবেগহীন মুখভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতে করতে দীপনাথ বলল, তাই নাকি?

বোস মাছি তাড়ানোর মতো করে হাত নেড়ে বলল, ও প্রসঙ্গ থাক। মিসেস বোসকে নিয়ে বেশি ভাববার কিছু নেই। আই অ্যাম র্যাদার ইন নিড অফ এ ফ্রেন্ড। অ্যান্ড আই হ্যাভ নান। আপনি কি আমার বন্ধু হতে পারেন?

বহুকাল চাকরবাকরের মতো থেকে এখন একটা মরিয়াভাব এসে গেছে দীপনাথের। সে আর ততটা মুখচোরা থাকতে চাইল না। হঠাৎ বলে বসল, বৃহতের সঙ্গে কি ক্ষুদ্রের বন্ধুত্ব হয় বোস সাহেব?

বলেই বুঝল এ প্রায় শরৎচন্দ্রীয় ডায়ালগ হয়ে গেল। আসলে সে মোটে আধ গেলাস বিয়ার খেয়েছে। কিন্তু অভ্যাস না থাকায় সেইটুকুই পেটে গিয়ে জিভটাকে একেবারে লাগামছাড়া করে দিয়েছে বোধ হয়।

বোস সাহেবের অবস্থাও খুব ভাল কিছু নয়। বেতের সোফার পিছনে আরও তিনটি খালি বোতল জমা পড়েছে, টেবিলের ওপর বাকি দুটোর মধ্যে একটার মুখ এখনও ভোলাই হয়নি। বাড়ির বেয়ারা এইমাত্র একপ্লেট গরম পকোড়া রেখে গেল টেবিলে। বোস সাহেব একটা পকোড়া তুলে কামড় দিয়ে বলল, হয়। মে বি আই অ্যাম সামটাইমস ভেরি রুড। আপনিও হয়তো অফিস-ওয়ার্কে তেমন এফিসিয়েন্ট নন। কিন্তু তার মানে এ নয় যে আমি আপনার ক্যারেকটারের প্লাস পয়েন্টগুলো লক্ষ করিনি। আই র্যাদার লাইক ইউ। অন দি আদার হ্যান্ড আমারও কিছু প্লাস পয়েন্ট আছে মিস্টার চ্যাটার্জি। সেগুলো কি আপনি লক্ষ করেছেন?

দীপনাথ আর একটু হলেই বোসের সামনেই লজ্জায় জিভ কেটে ফেলত বা বলে উঠত, আই অ্যাপোলাজাইস। কিন্তু বিয়ারের ধোয়ার ভিতর দিয়েও মগজের যুক্তি বুদ্ধি পথ হারিয়ে ফেলেনি। এ কথা সত্যি যে, সে বোসের প্লাস পয়েন্টগুলো লক্ষ করেনি। কিন্তু সে কথা স্বীকার করে কোন আহাম্মক?

সে বলল, আপনার প্লাস পয়েন্ট তো অনেক।

বোস বোকা লোক নয়। বোকা হলে এত অল্প বয়সে এত ওপরে উঠতে পারত না। কথাটা শুনে একটু হাসল। আবার পকোড়া আর বিয়ার খেয়ে বলল, আই হ্যাভ মাই ভাইসেস অলসো। কিন্তু একটা জিনিস কি জানেন? আপনি যদি কেবল আমার দোষগুলো লক্ষ করেন তা হলে কোনওদিনই আমাকে ভালবাসতে পারবেন না। মিসেস বোসের প্রবলেমটা এখানেই।

বলেই হঠাৎ বোস পিছনে হেলে ছাদের দিকে চেয়ে বড় একটা শ্বাস ফেলে বলল, দূর ছাই। এসব কথা আপনাকে বলছিই বা কেন?

আপনাদের ভিতরকার প্রবলেমটা কী তা আমি আজও জানি না। তবে মিসেস বোস ইজ এ উয়োম্যান অফ পার্সোনালিটি।

বলছেন! ঠিক আছে, মানছি। কিন্তু শি ইজ ক্রিয়েটিং এ ডেঞ্জারাস মানিটারি প্রবলেম ফর মি।

কী রকম?

কোম্পানি এক্সিকিউটিভদের অবস্থা যতটা ভাল বলে লোকে মনে করে আসলে তো ততটা ভাল নয়। আপনিও জানেন, আই হ্যাভ বিগ এক্সপেন্ডিচারস। মিসেস বোস হ্যাজ ইভন গ্রেটার এক্সপেন্ডিচারস। উনি খুব বড়লোকের মেয়ে নন, তবু খরচের হ্যাবিটা এত সাংঘাতিক—ইউ নো।

আপনার কি টাকার প্রবলেম চলছে বোস সাহেব?

ভেরি অ্যাকিউটলি। কোম্পানিতে আমার দেদার লোনও হয়ে গেছে। হাজার ত্রিশেকের কাছাকাছি।

বলেন কী?

বোস আর একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, সেটাও একটা মস্ত প্রবলেম। নতুন কোম্পানিতে যাওয়ার আগে এই কোম্পানির টাকা শোধ করতে হবে। নইলে দেয়ার মে বি আগলি কনসিকোয়েন্সেস।

বুঝতে পারছি।

বোস হাসল, বুঝতে তো পারছেন, কিন্তু এই টাকাটা আমি কোথায় পাব তা বলতে পারেন কি?

দীপনাথের মনে পড়ল, মণিদীপা তাকে কয়েকবারই বলেছে ‘আমি ওকে শেষ করে ছাড়ব।’ বোস সাহেবকে সেসব কথা কোনওদিনই বলা যাবে না। বলতে গেলে এই প্রথম তার বোস সাহেবের ওপর খানিকটা মায়া হচ্ছিল। এতকাল এই লোকটার তাবেদারি সে করেছে বটে, কিন্তু কোনওদিনই বিন্দুমাত্র সহানুভূতি বোধ করেনি। বরং মণিদীপা বোসকে শেষ করছে ভেবে সে মনে মনে এক রকমের আনন্দও পেত। আজ কষ্ট হল। বোস কোনওদিন এত খোলামেলা কথাবার্তা বলেনি তার সঙ্গে।

দীপনাথ মাথা নেড়ে বিষণ্ণ মুখে বলল, না। ত্রিশ হাজার আমার কাছে অনেক টাকা।

আমার কাছেও।–বলে বোস আবার একটা শ্বাস ছাড়ে। আস্তে করে স্বগতোক্তির মতো বলে, ক্লাবে আনপেইড বিল কত জমে গেছে কে জানে। হায়ার পারচেজ-এর দোকানেও অনেক পেমেন্ট রয়ে গেছে। বাংগালোরে যাওয়ার আগে সবই মেটাতে হবে। যাকগে, যা বলছিলাম। আপনি কি

আমার সঙ্গে যাবেন মিস্টার চ্যাটার্জি? আই নিড ইউ।

একটু ভেবে দেখি।

খুব বেশি ভাববেন না। তা হলে আর যাওয়া হবে না।

দ্বিধার সঙ্গে দীপনাথ বলে, বাংগালোরে বোধ হয় খরচ বেশি।

একটু বেশি হতে পারে। তবে সেখানে আমি তো বিশাল বাংলো পাব। মিসেস বোস যদি না যান তা হলে ইউ মে শেয়ার দি হাউস। আপনার মাসে কত হলে চলে যায়?

দীপনাথ মিথ্যে করে বাড়িয়ে বলতে পারত। কিন্তু মিথ্যে কথাটা চট করে তার মুখে আসে না। তাই বলল, ছ-সাত শো।

বোস মৃদু স্বরে বলল, আপনাকে আমার হিংসে হয়। এত কমে চালান কী করে?

দীপনাথ করুণ করে হাসল। কী করে সে চালায় তা তত বোসকে তারই জিজ্ঞেস করার কথা।

অন্ধকার বারান্দায় দু’জনের কথাবার্তা হঠাৎ থেমে গেল। নীচে গেটের সামনে একটা গাড়ি এসে থেমেছে। বোস সাহেবের নিজস্ব ছোট গাড়িটা। দারোয়ান গেট খুলে দিল। গাড়িটা বাঁক নিয়ে ঢুকে এল ভিতরে। মিসেস বোস।

দীপনাথের বুকের ভিতর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন কিছু বাড়ল। একটু দমের কষ্ট হতে থাকল। বেশ কিছুদিন হল সে মণিদীপার সঙ্গে অভিমানে কথা বলেনি। আর বোধহয় সেই কারণেই বুকের মধ্যে অনেক বেশি আবেগ জমে উঠেছে।

দু’জনেই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল।

প্রথম স্তব্ধতা ভেঙে বোস সাহেব বলল, প্রস্তাবটা নিয়ে একটু তাড়াতাড়ি ভাববেন। বেশি সময় নেই।

বোস সাহেবকে এত দুর্বল কোনওদিন দেখেনি দীপনাথ। আজ বিয়ারের ধাঁধার সঙ্গে এই হৃদয়দৌর্বল্য মিশে কেমন ভোম্বল-ডোম্বল লাগছিল নিজেকে। সে কিছুক্ষণ কান খাড়া করে বসে রইল। মণিদীপা যে ঘরে এলেন তা বোঝা গেল ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে। ডাইনিং হলেই বোধহয় বেয়ারার সঙ্গে কিছু কথা বললেন।

দীপনাথ উঠে বলল, আমি তা হলে আসি।

বোস আনমনে সামনের দিকে শূন্য চোখে চেয়ে বসে ছিল। ঠ্যাংদুটো ছড়ানো। কিছু দেখছে না। শুনছে না।

দীপনাথ আর-একবার বিদায় জানাতে বোস মুখটা ফিরিয়ে যেন অন্য কোনও মানুষকে বলল, গুড নাইট।

দীপনাথ প্যাসেজে ঢুকে একটু অপেক্ষা করে। ডান ধারে দুটি শোয়ার ঘর, বাঁ দিকে একটা মস্ত লিভিং রুম, সামনে ডাইনিং কাম ড্রয়িং। এতটা অতিক্রম করে তবে সিঁড়ি। কিন্তু এই পথটুকুতে মণিদীপার সঙ্গে দেখা হবে কি? যদি বেডরুমে ঢুকে গিয়ে থাকে?

দীপনাথের ভিতরটা আজ বড় কাঙাল। খুব প্রত্যাশা নিয়ে সে একটু গলাখাঁকারি দিল। তারপর ধীর পদক্ষেপে এগোতে লাগল। চোখের নজর ডাইনে বাঁয়ে খবর নিচ্ছে। প্রায় বয়ঃসন্ধির অবস্থা। বুক কাপছে, গলা শুকোচ্ছে, কান গরম হচ্ছে। অথচ পিকনিক থেকে ফেরার সময়ে এই ভদ্রমহিলা তার খোঁজও নেয়নি।

ডাইনিং হল পর্যন্ত কোনও ঘটনাই ঘটল না। একটু হতাশ হল দীপনাথ। আজকের দিনটা বোধহয় তার ভাল গেল না।

ড্রয়িংরুমে মণিদীপাকে বসে থাকতে দেখবে বলে মোটেই আশা করেনি দীপ। বাইরে থেকে ফিরে কোনও মহিলাই নিজের ড্রয়িংরুমে বসে ম্যাগাজিন দেখে না।

কিন্তু মণিদীপা ঠিক তাই করছে। যেন এ বাসা তার নয়, সে বেড়াতে এসেছে মাত্র। বাইরের ঘরে বসে অপেক্ষা করছে।

মণিদীপাকে এক পোশাকে দু’দিন কখনও দেখেনি দীপ। আজও তার পরনে দীপনাথের–দেখা একখানা নীল শাড়ি। যাদের রং চাপা তাদের নীল রং পরতে নেই। এমন একটা কথা কারও মুখে কখনও শুনে থাকবে দীপ। তাতে নাকি কালোকে আরও কালো দেখায়। কিন্তু মণিদীপা সেই নীল রংকে হজম করে আরও সুন্দর হয়ে বসে আছে। মস্ত চওড়া সোফায় গা ছেড়ে বসার ভঙ্গিটির মধ্যে একটু অহংকার মেশানো তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের ভাব আছে। তবে হ্যাঁ, ভঙ্গি, মুখের ভাব সব কিছুর মধ্যে একটা অপেক্ষার ভাব আছে ঠিকই।

কিন্তু কার জন্য অপেক্ষা? বুকের মধ্যে একটা আশার পাখি হঠাৎ গুড়গুড় করে ওঠে যে!

আত্মবিস্মৃত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল দীপনাথ। বোকার মতোই। প্রথম কয়েক সেকেন্ড মণিদীপা লক্ষই করল না। তারপর হঠাৎ বড় বড় চোখ তুলে নীরবে তাকাল। চোখে সেই পুরনো অহংকার।

চোখে চোখ। কয়েকটি দ্বিধাগ্রস্ত মুহূর্ত।

আচমকাই মণিদীপা জিজ্ঞেস করে, কী চলছিল? বিয়ার?

ওই একটু।

হাতের ম্যাগাজিনটা আবার দেখতে দেখতে মণিদীপা বলল, আগে তো এসব খেতেন না!

এখন মাঝে মাঝে খাই। বারণ করবার তো কেউ নেই।

মণিদীপার চোখ আবার উঠল। এবার চোখ দুটো বেশ কঠিন।

বারণ করারও লোক চাই নাকি?

লোক কেউ থাকলে ভাল লাগত।

আজকাল বেশ সাহসের সঙ্গে কথা বলতে পারেন তো!

মরিয়ার সাহসের অভাব হয় না।

মণিদীপা চমৎকার একটু হাসল, স্লেভারির চেয়ে এরকম সাহস অনেক ভাল।

তা হলে আমার উন্নতি হচ্ছে বলছেন?

বোধহয়। আর-একটু না দেখলে বোঝা যাবে না।

তা হলে দেখুন।–বলে একটু বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় দীপ। হেসে বলে, অনেককাল দেখেন না।

তাই নাকি? খুব শ্লেষের সঙ্গে বলে মণিদীপা।

কিন্তু দীপনাথ আর সেই পুরোনোে সংকোচটা বোধ করে না। বোস বাংগালোরে চলে যাচ্ছে এবং তাকে মিনতি করছে সঙ্গে যাওয়ার জন্য। তাতে বোস সাহেবের ওপরওয়ালাসুলভ চরিত্রটা ভেঙে গেছে। মণিদীপা ছিল বসের বউ, কিন্তু সেও এখন সম্ভাব্য ডিভোর্সের গাড়ায়। তবে দীপনাথের আর কাকে সংকোচ?

দীপনাথ তাই খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, আমি একটা গাছের তলায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেদিন। আমার বিশ্বস্ত বন্ধুরা আমাকে না নিয়েই চলে এসেছিল। অথচ সেইসব বন্ধুদের পায়ে কাঁটা ফুটলেও আমাকেই দায়ী হতে হত।

মণিদীপা হঠাৎ নিভে গিয়ে দাঁতে ঠোঁট কামড়ায়।

ম্যাগাজিনটা ফেলে রেখে নিজের খাটো চুল খোঁপায় বাঁধার একটা অক্ষম চেষ্টা করতে করতে বলে, আমার দোষ ছিল কি না ঠিক জানেন?

আপনার কথা বলছি না।

তবে কার কথা?

আমার ছদ্ম-বন্ধুদের কথা। আর দোষের কথাই বা উঠছে কেন? আমি সামান্য মানুষ, নজরে পড়ার মতোই তো নয়।

আমি খুঁজছিলাম। কিন্তু সেদিন ওঁকে নিয়ে এত বেসামাল হয়ে যাই যে কিছু করার উপায় ছিল না। দে ওয়্যার মেকিং এ সিন। আমি মিসেস সিনহাকে বলেছিলাম আপনাকে যেন ওঁদের গাড়িতে তুলে নিয়ে আসেন। পরে মিসেস সিনহা আমাকে বললেন তাড়াতাড়িতে আপনাকে নাকি খুঁজে পায়নি।

তা হবে।–উদাসভাবে বলে দীপ। তারপর দরজার দিকে এগোয়।

শুনুন।

বলুন। তেমনি উদাস স্বর দীপনাথের।

নিশ্চয়ই আপনি ও ব্যাপারটার জন্য আমার ওপর চটে যাননি!

আপনার ওপর চটার প্রশ্নই ওঠে না।

ছদ্ম-বন্ধু বলতে আপনি আমাকেই মিন করছেন।

না। আপনাকে কেন মিন করব?

হলে আপনার কোন বন্ধুই বা ওখানে ছিল?

বোধহয় সবাই আমার পরম বন্ধুই ছিল ওখানে।

একটু ঝাঁঝালো স্বরে এবার মণিদীপা বলে, এত ন্যাগ করতেও পারেন আপনি। আচ্ছা বাবা, ক্ষমা চাইছি। কান ধরছি।

হাসিমুখে দীপ ফিরে দাঁড়ায়। তার রাগ বেশিক্ষণ থাকে না। একটু মিষ্টি কথাতেই উবে যায়।

সে বলল, অতটার দরকার নেই।

এবার আর রাগ নেই তো?

মোটই নেই।

আবার আমি ভাল বন্ধু তো?

নিশ্চয়ই।

বসুন না একটু।

দীপ বসল। কোনও সংকোচ হল না। বোস সাহেব দেখে ফেললেও বোধহয় ক্ষতি নেই, এই মহিলাকে তো সে ডিভোর্সই করবে।

বলুন।

মণিদীপার মুখ-চোখ কাছ থেকে দেখে একটু শীর্ণ মনে হল। কাঁধের হাড় দুটোও একটু বেশি জেগে রয়েছে। বলল, বোস সাহেবের সঙ্গে কী কথা হল?

বাংগালোরে যাওয়া নিয়ে।

আমি কিন্তু যাচ্ছি না, শুনেছেন?

বলছিলেন।

আর কিছু বলেনি?

আর কী?

এ প্রশ্নের জবাব না দিয়ে মণিদীপা খুব সুন্দর করে একটু হাসল। ন্যাকামি নেই, অঙ্গভঙ্গি নেই, তেমন কোনও কটাক্ষ নেই, তবু নিছক নিজের চরিত্রের একটা সহজ সরল জোরে মণিদীপা কী করে তাকে সম্মোহিত রেখেছে তা দীপনাথ ঠিক বুঝতে পারে না।

মণিদীপা হাসিটা মুছে ফেলে মৃদু স্বরে বলল, যখন ভাঙল মিলনমেলা ভাঙল…।

দীপনাথ একটু গম্ভীর ও দুঃখিত মুখ করে বলে, কিছুই ভাঙবে না। আপনিও বাংগালোরে চলুন।

কেন? আপনার হুকুম?

না, তা নয়। শুনেছি আপনাকে হুকুম করার আলাদা লোক আছে।

আছেই তো। যার চরিত্র আছে সেই হুকুম করতে পারে।

ঠিক কথা। কিন্তু তিনি এ ক্ষেত্রে কী হুকুম দিয়েছেন?

ভ্রুকুটি করে মণিদীপা বলে, আগে বলুন আমাকে হুকুম দেওয়াব লোকটা কে?

হয়তো স্নিগ্ধদেববাবু।

স্নিগ্ধদেব সম্পর্কে আপনার এত স্বচ্ছ ধারণা হল কী করে?

আমার ধারণা নেই। বোস সাহেব বলছিলেন।

বোস সাহেব! বলে হঠাৎ যেন কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকে মণিদীপা। তারপর চাপা হিংস্র স্বরে বলে, স্নিগ্ধদেবের নাম ওঁর জানার কথা নয়। আপনি বলেছেন কে?

একটু অবাক হয়ে দীপনাথ বলে, আমি বলব কেন? আমি তো তেমন কিছু জানিও না।

তবে ও জানল কী করে?

দীপ মাথা নেড়ে বলে, তা আমি জানি না।

ও আপনাকে কী বলছিল?

দীপ একটু বিপদে পড়ে যায়। ভরসা এই, এই মেয়েটিকে বোস ডিভোর্স করবে এবং সম্ভবত দীপের বস হিসেবেও বোস আর থাকছে না। দীপনাথ তাই সাহস করে একটু হাসি মুখে এনে বলে, বলছিলেন আপনি নাকি স্নিগ্ধবাবুর কথায় চলেন।

মণিদীপার চোখে-মুখে ক্রুদ্ধ অহংকার ফুটে ওঠে। ঠোঁট উলটে বলে, আমাকে কেউ কখনও হুকুম করে না। আমি কখনও কারও কথায় চলি না।

তবু আমি ওয়েল-উইশার হিসেবে বলছি, আপনি বাংগালোরে যান। ভাল হবে। মিলনমেলা ভাঙবে না।

ভাঙলে বয়ে গেল। আপনি যাচ্ছেন বুঝি?

ঠিক করিনি। তবে যেতেও পারি।

তাই বুঝি আমাকে অত সাধাসাধি?

কথাটা বুঝতে একটু সময় লাগল দীপের। কয়েক সেকেন্ড। তারপরই তার ফর্সা রঙে আগুন ধরে গেল যেন। অপলক স্থির চোখে চেয়ে বলল, তার মানে?

মিস্টার বোস আপনাকে বলেননি যে আপনি আমার প্রেমে পড়েছেন আর আমি আপনাকে নাচাচ্ছি?

দীপনাথ হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে।

মণিদীপা হাসছিল। খুবই বিষাক্ত শ্লেষ ভরা হাসি। আস্তে করে বলল, আমাকে বলেছে।

কী বলেছে?

ওই যা বললাম।

আমি! আপনাকে?

হ্যাঁ, আপনি আমাকে এবং আমি আপনাকে। বলা উচিত ছিল। স্নিগ্ধদেবের কথা যখন উঠল তখন এটা উঠলেও দোষ ছিল না।

ছি ছি, আমি তো ভাবতেও পারি না।

বলেই দীপ অনুভব করল তার ভিতরকার ঠোঁটকাটা ইয়ারবাজ আর-একটা দীপনাথ খুব হোঃ হো করে হেসে বলল, পারোও বটে হে তুমি। ভাবতে ভাবতে ছাল তুলে ফেললে, আর মুখে বলছ ভাবতে পারো না!

আপনি ভাবতে না পারলে কী হবে? বোস সাহেব তো ভাবছেন।

খুব ভুল ভেবেছেন উনি।

ভুল ভাবায় উনি একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এ ব্যাপারটা হয়তো ততটা ভুল ভাবেননি।

এই বলে মণিদীপা হঠাৎ মুখে রঙিন ম্যাগাজিনটা চাপা দিয়ে আড়ালে হাসতে থাকে।

দীপ অবাক হয়ে বলে, কোন ব্যাপারটা?

এই আপনার আর আমার ব্যাপারটা।

তার মানে?

আপনি হয়তো সত্যিই আমার প্রেমে পড়েছেন।

কী যে বলেন!–দীননাথ বোধহয় রামধনুর মতো বহুরঙা হয়ে গেল লজ্জায়, ঘেন্নায়, আত্মধিক্কারে।

খুব অসম্ভব ব্যাপার কি?

খুবই অসম্ভব।

তা হলে আমার পক্ষে বেশ দুঃখের কথা। সারা জীবনে বহু লোক আমার প্রেমে পড়েছে। প্রায় সব পরিচিত যুবক এবং প্রৌঢ়। আপনারই না পড়ার কী?

কী যে বলেন!

দোষের তো কিছু নয়।

মিসেস বোসের মুখ ম্যাগাজিনে ঢাকা। তবু চোখ দেখে বোঝা যাচ্ছে মেয়েটি হাসছে।

দীপ দরজার নবের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আমি কারও প্রেমে পড়িনি।

সত্যিই? বলে চোখ বড় করে মণিদীপা।

বিশ্বাস করা না করা আপনার ইচ্ছে।

তা হলে আর বাংগালোরে গিয়ে আমার কী হবে? আপনি যদি আমার প্রেমে পড়তেন তা হলে বাংগালোরে গিয়েও সুখ ছিল!

ইয়ারকি করছেন?

মণিদীপা খুব ধীরে ধীরে ম্যাগাজিনটা মুখ থেকে নামায়। মুখে এতটুকু হাসি নেই, মজা নেই। বড় বড় দু’খানা চোখ নেমে যায় কার্পেটের দিকে।

জবাবের জন্য অপেক্ষা করে না দীপ। দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।

যদি কেউ ড্রয়িংরুমে থাকত তা হলে দেখত, জ্ঞানবয়সে মণিদীপা এই প্রথম সচেতনভাবে কাঁদছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *