আধুনিক ভারতে ইতিহাসের বিকাশ
প্রাচীন রোমানগণ একটি বড় সত্য কথা বলিয়া গিয়াছেন যে “অস্ত্রের ঝঞ্ঝনার মধ্যে ন্যায়শাস্ত্র নীরব থাকে।” রাষ্ট্র বিপ্লবে, এমন কি দীর্ঘকালব্যাপী অশান্তির মধ্যেও শুধু আইন নহে, সাহিত্য জ্ঞান কলা সকলেরই চর্চা অসম্ভব হয়, বাগদেবীর পূজা বন্ধ থাকে। তখন ইতিহাস রচিত হইতে পারে না। ভারতের মধ্যযুগের সভ্যতা ক্ষয়রোগে অবসান হইলে পর, শত বর্ষ ধরিয়া কম বেশী উপদ্রব ঘাত-প্রতিঘাত চলিল, অবশেষে ১৮৫৭-৫৯ খ্রিস্টাব্দে অশান্তির শেষ প্রবল সৈন্যদল দমিত হইল, ইংরাজ রাজশক্তি নিঃসংশয়রূপে নিজেকে স্থাপিত করিল, আমাদের দেশে নব্য জ্ঞান সেই যুগ হইতে ব্যপ্তভাবে আরম্ভ হইল। আমাদের এই জাতীয় জাগরণই ব্রিটিশ শান্তির শ্রেষ্ঠদান। তখন যে সভ্যতার বীজ বপন করা হয়, বিংশ শতাব্দীতে তাহাই বাড়িয়া নানা শাখা-পল্লবে বিস্তৃত হইয়াছে, আর সমস্ত ভারত তাহারই নানা পুষ্প ও ফল সম্ভোগ করিতেছে।
সম্রাট পঞ্চম জর্জের রাজত্বকাল আজ শেষ হইল। এ যুগে আমরা অনেক দিকে অগ্রসর হইয়াছি, দেশের অনেক প্রকার উন্নতি ঘটিয়াছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, কলা; সভ্যত’ উপাদান-শিক্ষা, কলকারখানা, পথঘাট, রেল ও উড়োজাহাজ– সব দিকেই এই পঁচিশ বৎসরের আরম্ভ এবং শেষের অবস্থা তুলনা করিলে আশ্চর্য হইতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা আজ বড় হইলেও পৃথিবীর মধ্যে প্রথম নহি। কিন্তু একটি বিষয় আছে যাহা ভারতবর্ষের পক্ষে সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক গৌরবের কথা, বাণীর একটি প্রকোষ্ঠ আছে যেখানে ভারতবর্ষ আজ জগতের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করিয়াছে; জ্ঞানের একটি বিভাগে সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক পাইতে হইলে, চূড়ান্ত মীমাংসা জানিতে হইলে, আজ অন্যান্য জাতির পক্ষে ভারতে আসা, ভারতীয় জ্ঞানীর শিষ্য হওয়া ভিন্ন উপায় নাই। সেই বিষয়টি ইংরাজ পূর্ব্ব যুগের ভারতের ইতিহাস।
সত্য বটে, ভারতের বাহিরে বৌদ্ধধর্ম্মের বিকাশের ও ইতিহাসের চর্চ্চায়, চীন মঙ্গোলিয়ায় নবাবিষ্কৃত উপাদান পাইয়া ইউরোপীয় পণ্ডিতগণ এখনও নিজ প্রাধান্য রক্ষা করিতেছেন। সত্য বটে, ব্রিটিশযুগের ইতিহাসের অপ্রকাশিত রাশি রাশি দলিলপত্র একমাত্র বিলাতে থাকায় সে দেশের লেখকগণ ঐক্ষেত্রে গবেষণায় এখনও অগ্রণী আছেন, মসলার অভাবে আমরা তাঁহাদের দ্বারস্থ হইতে বাধ্য। কিন্তু ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম্ম ও কীৰ্ত্তি, হিন্দু যুগ, মুসলমান যুগ, মারাঠা রাজপুত শিখ, এ সকলের অভ্যুদয় ও পতনের ইতিহাস, আর ব্রিটিশ-পূর্ব্ব যুগের সমাজ, ধর্ম্ম, দেশের দশা, ঘরের কথা, এই সমস্ত গবেষণার ক্ষেত্রে ভারতীয় পণ্ডিতগণ জগতের সুধীসমাজে আজ সর্ব্বোচ্চ আসন অধিকার করিয়াছেন; ইউরোপীয় পণ্ডিতমণ্ডলী এ কথা মানিয়া লইয়াছেন।
পঁচিশ বৎসরের মধ্যে এই যে পরিবর্তন ঘটিয়াছে এটা কত বড়, কত কল্পনার অতীত, তাহা ভারতীয়দের জ্ঞানের ক্ষেত্রে ইতিহাসের স্থান এবং ভারতীয় ঐতিহাসিকদের কীৰ্ত্তি ও কার্য প্রণালী, আগের সহিত পরের তুলনা করিলে স্পষ্ট বুঝা যাইবে। প্রথমে তাহাই দেখাইতে চেষ্টা করিব। সব দেশেই দেখা গিয়াছে যে যখন হৃদয়ে মাতৃভূমির বোধ প্রথম উন্মেষিত হয়, জাতীয় জীবনের সেই অতি প্রত্যূষে দেশের লুপ্ত কাহিনী জানিবার জন্য, অতীত গৌরব-কাহিনী বাণী প্রচার করিবার জন্য, জন সেবকদের মনে এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠে। ইহার মধ্যে যে জ্যোতি অপেক্ষা তাপ বেশী, জ্ঞান অপেক্ষা আবেগ বেশী, তাহা সত্য হইলেও নিন্দার কথা নহে; কারণ এই আবেগই যুগ-যুগ ব্যাপী বদ্ধমূল অন্ধকার নিশ্চেষ্টতার বাধাকে অতিক্রম করিবার উপযোগী ধাক্কা জাতির মনকে দেয়। তাহার পরিণত ফল পরে ফলে। তাই দেখিতে পাই যে বঙ্কিম– বঙ্কিম কেন, তাঁহার এক পুরুষ আগের বিদ্যাসাগর পর্যন্ত– বঙ্গের, ভারতের প্রকৃত ইতিহাস জানিবার জন্য এত লালায়িত হইয়াছিলেন। বিদ্যাসাগর সংস্কৃতে অগাধ পণ্ডিত, বাঙ্গলা গদ্য তাঁহারই হাতে গড়িয়া তোলা, কিন্তু তাঁহার ‘পরাণ-প্রিয়’ সাহিত্য ছিল ভারত-ইতিহাস। সেই বিভাগের অতি দুষ্প্রাপ্য পুরাতন বইগুলি তিনি অজস্র অর্থব্যয়ে কিনিতেন, নবাবের উপযোগী মূল্যবান কাপড় চামড়া ও সোনার জল দিয়া বাঁধাইতেন, আর নিজের হাতে ঝাড়িয়া-পুঁছিয়া রাখিতেন; অথচ তিনি নিজে অতি সামান্য কাপড় পড়িতেন, যাহা দেখিয়া ধনী ঘরের দাসীরা তাঁহাকে উড়ে বেহারা ভাবিত! বঙ্কিমের ইতিহাস-পিপাসা তাঁহার অনেক উপন্যাসে এবং ভূমিকায়ই প্ৰকাশ পাইয়াছে।
কিন্তু তাহারা এই অজ্ঞাত জঙ্গলে প্রথম ভ্রমণকারী, এজন্য সাহেবদের লেখা যে সব ভারত-ইতিহাস হাতের কাছে পাওয়া গেল, তাহা লইয়াই তাঁহাদের কাজ করিতে হইয়াছিল। শত ইচ্ছা থাকিলেও তাঁহারা এই ক্ষেত্রে মৌলিক গবেষণা করিতে পারেন নাই। মার্শম্যানের স্কুলপাঠ্য ইতিহাস, রেমং-কৃত সিয়ার-উল-মুতাখরীনের অনুবাদ, এইগুলি মাত্র তাহাদের অবলম্বন ছিল। প্রত্নতত্ত্বের ক্ষেত্রে, শিলালিপি তাম্রশাসন মুদ্রা প্রভৃতি লইয়া জ্ঞানার্জ্জনের পথ প্রথম দেখাইলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র। এইরূপে ইতিহাসের খাঁটি উপকরণের সংগ্রহ ও সংশোধন আরম্ভ হইল। দক্ষিণ-ভারতে রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকর সুদীর্ঘ জীবন এই কাজেই সঁপিয়াছিলেন। রামদাস সেন, কৃষ্ণবিহারী সেন, ফার্সী পণ্ডিতদের বৌদ্ধ গবেষণার ফল বঙ্গীয় পাঠকদের নিকট পরিচিত করিয়া দিলেন। শত শত রাজকার্যের মধ্যে মগ্ন রমেশচন্দ্র দত্ত প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে, নব্য ভারতীয় অর্থনীতিতে নানা ভাণ্ডার হইতে সংকলন করিয়া, অন্যের অর্জিত তথ্য সরল ভাষায় সাধারণের মধ্যে প্রচারিত করিলেন। তাহা ভিন্ন পর মধ্যকালীন ভারত-ইতিহাসের রাজ্যে এলিয়ট ও ডাউসন্ অনূদিত আর্ট ভলুম (১৮৬৯-১৮৭৭ মুদ্রিত) এক নূতন পথ খুলিয়া দিল, কিন্তু ইহাতে মুসলমান রাজত্বের মূল ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলির সহিত পরিচয় মাত্র হইল। আমাদের স্বদেশবাসীদের মধ্যে ফার্সী ভাষায় গভীর জ্ঞান না থাকায়, এবং ফার্সী ইতিহাসগুলির প্রায় সমস্তই অপ্রকাশিত এবং তাহাদের হস্তলিপিও লেখকদের পক্ষে ভারতে দুষ্প্রাপ্য হওয়ায়, আমরা অনেক দিন ধরিয়া এলিয়টের প্রদর্শিত পথে পা দিতে পারি নাই। এইমাত্র অক্লান্তকৰ্ম্মী একনিষ্ঠ ইতিহাস সাধক জৰ্ম্মন ব্লকম্যান এশিয়াটিক সোসাইটির ভাণ্ডারের সাহায্যে ভারতবর্ষে বসিয়া কত মূল্যবান গবেষণা করা যায় তাহার প্রমাণ দিয়া গেলেন।
এই গেল আমাদের ইতিহাস-চর্চ্চার প্রথম স্তর, অর্থাৎ সংকলনের, অনুবাদের যুগ– মৌলিক রচনার নহে। তাহার পর পালি ও ফার্সী ভাষায় গভীর এবং বিজ্ঞানসম্মত জ্ঞান লাভ করিয়া, তবে আমাদের নবীন ইতিহাস-শ্রমিকগণ এদেশে মৌলিক গবেষণা সম্ভবপর করিলেন।
ইতিমধ্যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে ঐতিহাসিক প্রণালী এবং ইতিহাসের উদ্দেশ্য লইয়া ইউরোপে যে যুগান্তর পরিবর্তন ঘটিয়াছিল, তাহার প্রবাহ বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতবর্ষে পৌঁছিল। ইতিহাসের মূল উপাদান সমসাময়িক দলিলপত্র; তাহার অধিকাংশই অপ্রকাশিত; এগুলির আবিষ্কার, সংশোধন, যথার্থ ব্যাখ্যা এবং তুলনামূলক সমালোচনা ভিন্ন কোন ইতিহাসকেই অটল ভিত্তির উপর গড়িয়া তোলা যায় না, এই সত্য আজ সভ্য জগত স্বীকার করিয়াছে। কিন্তু ইউরোপেও অতি অল্প দিন হইল এই মত পরিবর্তনটি ঘটিয়াছে; লর্ড য়্যকটন পর্যন্ত “অপ্রকাশিত দলিলগুলির” (documents ine’dites) প্রতি কতকটা অশ্রদ্ধা ও সন্দেহের ভাব প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন, যদিও তাহার পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বে ফন্ রাঙ্কে এই সত্য প্রচার করেন।
যাহা হউক, ইউরোপে বিংশ শতাব্দীর গোড়া হইতেই যাহারা ইতিহাস লিখিয়াছেন তাহারা এই নবীন প্রণালী বিনাবাক্যব্যয়ে গ্রহণ করিয়াছেন; হল্যান্ড রোজের রচিত ফরাসী রাষ্ট্রবিপ্লবের ইতিহাসের সহিত লেকীর সেই বিষয়ের অধ্যায়গুলি তুলনা করিলেই একথা স্পষ্ট বুঝা যাইবে। ভারতে আমরা পঞ্চম জর্জের রাজত্বেই প্রথম স্বীকার করিয়াছি যে পুরাতন দপ্তরখানার কীট হওয়া ভিন্ন ঐতিহাসিকের মুক্তির পন্থা নাই। শুধু সংকলন, অনুবাদ এবং ঘটনার অনেক পরে রচিত কাহিনী, এমনকি ঐতিহাসিক মঞ্চের প্রকৃত অভিনেতাদের প্রাচীন বয়সে বিবৃত স্মৃতি বা মুখে-শুনা কথার উপর নির্ভর করিয়া ইতিহাস লেখার দিন চলিয়া গিয়াছে। এই মৌলিক উপাদানগুলি যে-যে ভাষায় লেখা তাহা ভাল করিয়া শিখিতে হইবে, সেই যুগের লোকদের মনের ভিতর প্রবেশ করিয়া ঐ দলিলগুলির যথার্থ অর্থ বাহির করিতে হইবে, এবং যত বেশী এবং যত বিভিন্ন পক্ষের সমসাময়িক সাক্ষ্য আজ পাওয়া সম্ভব তাহা সংগ্রহ করিয়া অতীতের উপর চারিদিক হইতে আলোকপাত করিতে হইবে। তবেই আমাদের ইতিহাস স্থায়ী হইবে, বাহির জগতে আদৃত হইবে।
একটা দৃষ্টান্ত দিতেছি, বৌদ্ধধর্ম্মের ও সভ্যতার ইতিহাস ও বিস্তার জানিতে হইলে আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় শেষ পর্যন্ত পালি ত্রিপিটক ও অন্যান্য সিংহলী সাহিত্য মধ্যে আবদ্ধ থাকিতাম; সে ক্ষেত্রে Furnouf এবং Kern-এর গ্রন্থগুলিই আমাদের সম্বল ছিল; আমরা হীনযানে আবদ্ধ থাকিতাম, মহাযানের সঙ্গে নামমাত্র পরিচয় ছিল। আর আজ, আমাদের সামনে নেপাল, চীন, মধ্য-এসিয়া, তিব্বত হইতে উদ্ধার করা সংস্কৃত-মহাযান বৌদ্ধ-সাহিত্য রূপ মহা সমুদ্রের ঢেউ খেলিতেছে, আমরা হীনযানের মত মহাযানেরও সূক্ষ্ম তত্ত্ব পাইয়া সমগ্র বৌদ্ধধর্ম্মের পূর্ণ জ্ঞান লাভ করিতেছি।
ঐতিহাসিক প্রণালীতে যেমন এই এক যুগান্তর সংগঠিত হইয়াছে, ইতিহাসের উদ্দেশ্যও তেমনি একটা মহা পরিবর্তন এই ২৫ বৎসরের মধ্যে ভারতে আসিয়া পড়িয়াছে। আগে অনেক শতাব্দী ধরিয়া ঐতিহাসিকগণ শুধু এইটি জানিতে চেষ্টা করিতেন যে অতীত যুগে সত্যসত্যই কী কী ঘটনা ঘটিয়াছিল। কিন্তু আজ আমরা এ সন্ধানে সন্তুষ্ট নহি, আজ লেখক ও পাঠক উভয়েরই জিজ্ঞাস্য এই যে সেই পুরাতন ঘটনাগুলি কেন ঘটিয়াছিল; অর্থাৎ ইতিহাসের যে দিকটাকে দর্শন বলা যাইতে পারে তাহাই আজ আমাদের মধ্যে সর্ব্বোচ্চ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। তাহার ফলে গত আট দশ বৎসরের মধ্যে ইউরোপে যে ধরনের ইতিহাস-গ্রন্থগুলি অত্যন্ত প্রসার ও লোকপ্রিয়তা লাভ করিয়াছে তাহাতে ঘটনার খুঁটিনাটির, যুক্তি ও সাক্ষী-সমালোচনার উপর দৃষ্টি নাই; এই হাল ফ্যাশানের ঐতিহাসিকগণ ইতিহাসকে কতকটা নভেলে পরিণত করিয়াছেন, অর্থাৎ মনস্তত্ত্বের সাহায্যে সেই যুগের নেতাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করিয়া, তাঁহাদের মনোবৃত্তির অনিবার্য্য ফলে যে জ্ঞাত ঘটনাগুলি ঘটিয়াছিল ইহাই প্রমাণ করিতে নবীন ঐতিহাসিকগণ ব্যগ্র। একথা স্বীকার করিতে হইবে যে এইসব মুখরোচক ছদ্মবেশী নবীন ইতিহাসগুলির ভিত্তিতে অপর ঐতিহাসিকের দীর্ঘ কঠিন পরিশ্রমে অর্জিত কতকটা অপাঠ্য, তথ্যপুঞ্জ আছে।
ইতিহাসের সত্য ঘটনার ভিতর দিয়া কোন নেতা-বিশেষের, কোন জাতি-বিশেষের চরিত্র কিরূপে প্রকাশ পাইয়াছিল, জাতীয় জীবন কিরূপে ছোট হইতে বড় হয়, সবল অবস্থা হইতে দুর্ব্বল হয়, আমাদের ঐতিহাসিকগণকে তাহা প্রতিপন্ন করিতেই হইবে- শুধু কাহিনী লিখিলে, প্রমাণ সংগ্রহ করিলে চলিবে না। কারণ, এইখানেই ইতিহাসের প্রাণ; ইতিহাস নিশ্চয়ই দেখাইবে যে জগৎস্রষ্টার অভিপ্রায়, তাঁহার অপরাজেয় বিধি, কিরূপে মনুষ্য বিশেষের মতই জনসমষ্টি অর্থাৎ নেশন-বিশেষের উপর নিজের শক্তি প্রকাশ করিয়াছে, তাঁহার ন্যায়বিচারে দণ্ড ও পুরস্কার অনিবার্য্য প্রভাবে জগতে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। কবিরা তাঁহাদের কাব্যে ব্যক্তি-বিশেষ সম্বন্ধে-
Speak to mortals, of their little week;
of their sorrow and delights;
of their passions and their spites;
of their glory and their shame;
what doth strengthen and what maim;
জনসমষ্টি-সম্বন্ধে ঐতিহাসিক ঠিক এই শিক্ষা দেন।
এখন বিশেষজ্ঞের যুগ আরম্ভ হইয়াছে। এখন সৰ্ব্বত্রই দেখিতে পাই যে এক-একজন পণ্ডিত একটিমাত্র ব্যক্তি কাল বা বিষয়ের ভগ্নাংশ লইয়া নিজ জীবন উৎসর্গ করিয়া দিয়া, কেবলমাত্র তাহারই অতিগভীর পুঙ্খানুপুঙ্খ চর্চ্চা করিয়া কতকগুলি সত্য আবিষ্কৃত বা স্থাপিত করিতেছেন। আর সেইরূপ বিশ-ত্রিশ জন বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতকে একত্র করিয়া (a syndicate of scholars), তাঁহাদের মধ্যে একটা বড় ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায়গুলি বাঁটিয়া দিয়া, তাঁহাদের ব্যক্তিগত চেষ্টার সমবায়ের ফলে একখানা বড় প্রামাণিক ইতিহাস রচিত হইতেছে। ইহার প্রথম দৃষ্টান্ত, The Cambridge Modern History. কিন্তু এইরূপ সমবেত চেষ্টার জোড়া-দেওয়া ফলকে ইতিহাসের চরম দৃষ্টান্ত মনে করা মহা ভ্রম। এইরূপ ফকিরী আলখাল্লা সদৃশ গ্রন্থ অনেক স্থলে মেসের মাছের ঝোলের রস দেয়া, তাহার একদিকে হলুদ ভাসিতেছে, অপর দিকে ধনে বা লঙ্কা বাঁটা; এক স্তরে সরের মত কি একটা আচ্ছাদন, আর তাহার নীচে বিশুদ্ধ জল। ফলতঃ এইরূপ গ্রন্থ অনেকস্থলেই বিভিন্ন কারিগরের সংগৃহীত তথ্য এক পুটপাক করিয়া এক অভিনব সামঞ্জস্যপূর্ণ সারে পরিণত করা হয় নাই। এরূপ সামঞ্জস্য একমাত্র ক্ষণজন্মা মনীষীই রচনা করিতে পারেন, তাহাই সর্ব্বোচ্চ ঐতিহাসিক সাহিত্য হয়– যেমন গীবন ও মসেনের কীর্তি। ভারতের পক্ষে এরূপ চরম ইতিহাস লিখিবার সময় এখনও আসে নাই, কিন্তু তাহার মালমশলা সংগ্রহে যেন আমরা বিলম্ব না করি। যে আদর্শ ভারত-ইতিহাসের হৰ্ম্মা গড়িবার জন্য ইট পাথর, খণ্ড খণ্ড অলঙ্কারগুলি যোগাইয়া দিতে আজ হিন্দুস্থান দাক্ষিণাত্য হইতে, বাঙ্গালী পাঞ্জাবী রাজপুত গুজরাটি মাদ্রাজী মারাঠা সকল জাতির লেখকই চেষ্টা করিতেছেন। ইহা ভিন্ন ভারতের প্রকৃত ইতিহাস রচনা সম্ভব নহে। একথা এই সেদিনমাত্র গোবিন্দ সখারাম সরদেশাই তাঁহার পাটনার বক্তৃতায় প্রচার করিলেন।
এখন দেখা যাক্ ইতিহাসের প্রণালী ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পণ্ডিত-জগতে এইসব মত-বিপ্লবের ফলে গত পঁচিশ বৎসরে আমাদের প্রধানত কি কি লাভ হইয়াছে, কোন্ কোন্ দিকে আমরা ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ হইতে অগ্রসর হইয়াছি।
প্রথমত: আজ আমরা সকলেই যদি আদি ও অকৃত্রিম ঐতিহাসিক দলিল ও চিঠিপত্র খুঁজিতেছি, এবং যতক্ষণ তাহা পাওয়া না যায়, ততক্ষণ ক্ষান্ত হই না। “পাথুরে ইতিহাস” বলিয়া ঠাট্টা করিবার দিন আর নাই, কারণ সকলেই এখন বুঝেন যে এরূপ ব্যঙ্গ সত্য কিংবা শেষ কথা নহে। আজকাল একখানি নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসন ও শিলালিপির সন্ধান পাইলে আমাদের স্বদেশী ইতিহাস-সেবকগণ চারি দিক হইতে মধুর লোভে পিপীলিকার মত সেখানে ছুটিয়া আসেন। এরূপ দলিল বা প্রাচীন মুদ্রা একটি মাত্র কোথাও খুঁড়িয়া পাইলে, তাহার মূল্য না জানিয়া তাহা যে কেহ হারাইয়া বা গলাইয়া ফেলিবে এরূপ ভয় আর নাই; কারণ এখন আমাদের প্রতি শহরে, প্রায় গ্রামে গ্রামে, এইসব জিনিসের মূল্য জানেন এরূপ লোক একজন-না-একজন আছেন; এবং এ- দেশের কোন পণ্ডিত এগুলির সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা ও সদ্ব্যাহার করিতে পারেন বা এ সম্বন্ধে পরামর্শ দিতে পারেন, তাহাও সকলেই জানেন।
মধ্যযুগের ভারতের, বিশেষত হিন্দু- শক্তির ইতিহাসের, দুইটি মহা কীৰ্ত্তিস্তম্ভ এই গত দশ বৎসরের মধ্যে খাড়া করা হইয়াছে। প্রথমটি, পেশোয়ার দপ্তরের যত দলিলপত্র খুঁজিয়া সাজাইয়া, তাহার সূচী (Handbook) এবং বাছা বাছা কাগজের সংকলন ৪৫ ভল্লুমে গোবিন্দ সখারাম সরদেশাই ছাপাইয়াছেন selections from the Peshwas’ Dafter, Bombay Govt. Press. ) আর রাজ্যের যে কাগজগুলি পুণার সরকারী দপ্তরখানাতে না রাখিয়া, নানা- ফড়নি নিজ গ্রাম মেনাবলীতে লইয়া যান, তাহার অধিকাংশ দত্তাত্রেয় বলবন্ত পারসনিস ছাপিবার পর, অপ্রকাশিত বাণ্ডিলগুলি সাতারা মিউজিয়মে আশ্রয় পাইয়াছে, এবং গত নভেম্বরে তাহার মধ্যে ২৩২ পৃষ্ঠা হইয়াছে। আর দিল্লীর মুঘল দরবারের সহিত পত্রের আদান-প্রদানের অমূল্য ও বিরাট সংগ্রহ জয়পুর রাজদরবারের আঁধার কোঠা হইতে উদ্ধার করিয়া, আলমারীতে সাজাইয়া রাখা হইয়াছে এবং তাহার তালিকা-রচনা প্রায় শেষ হইয়াছে। অপেক্ষাকৃত ছোট ছোট উপাদান সংগ্রহের কথা বলিলাম না ৷
বর্তমান যুগে আমাদের দ্বিতীয় লাভ এই যে, ঐতিহাসিক আদি উপকরণের সংগ্রহ এখন আমাদের দেশেই হইতেছে। গত পঁচিশ বৎসরে আমাদের মধ্যে অনেক নূতন মিউজিয়াম স্থাপিত হইয়াছে, ইউনিভার্সিটি ও বিদ্বৎসভার সংখ্যা অনেক বাড়িয়াছে, এবং তাহাদের মধ্যে সকলেই বহুমূল্য পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ ও পত্রিকা সংগ্রহ- অনেক স্থলে হস্তলিপি মুদ্রা ও মূর্ত্তি সংগ্রহও আরম্ভ করিয়াছেন। তাহার উপর অনেক আবশ্যক সংস্কৃত পালি আরবী ফার্সী মৌলিক গ্রন্থ ও লিপি মুদ্রিত- এবং কিছু কিছু অনূদিত-হইয়া ইতিহাস-চর্চার পথ মফস্বলবাসীর পক্ষেও সুগম করিয়া দিয়াছে। পঁচিশ বৎসর আগে আমরা যে দুরবস্থা ও অসুবিধার মধ্যে কাজ আরম্ভ করি তাহা আর নাই।
তৃতীয়ত: পণ্ডিতদের বাৎসরিক, কখন তিন বৎসর অন্তর, মিলন দেশের নানান স্থানে হইতেছে। আগে Oriental Congress শুধু ইউরোপে বসিত, ভারতীয় ঐতিহাসিকদের ভাগ্যে তাহার ফল ভোগ করা স্বপ্নাতীত ছিল। কিন্তু আজকাল Oriental Conference, Historical Records Commission প্রভৃতি নামে এরূপ বিদ্বজ্জন-সম্মিলন ভারতে স্থায়ী অনুষ্ঠান হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এখন অসংখ্য ভারতীয় ইতিহাস-সেবক অতি সহজে, অতি অল্প সময়ে ও সামান্য অর্থব্যয়ে, প্রায় দ্বারের কাছে এই সব অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন এবং এগুলির যাহা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ফল, অর্থাৎ পণ্ডিতে পণ্ডিতে শিক্ষকে ছাত্রে মৌখিক আলোচনা ও পরামর্শ, তাহা লাভ করিয়া ধন্য হইতে পারেন। এরূপ আলোচনা এমন কি বড় বড় পণ্ডিতের সাক্ষাৎকার, নবীন ইতিহাস-কর্মীদের মধ্যে যে কতটা মনপ্রাণ-মাতান শক্তির সঞ্চার করে তাহা বলা অনাবশ্যক।
চতুর্থত: আমাদের প্রায় সব বিদ্যায়তনেই গবেষণার ফলে সর্ব্বোচ্চ উপাধি, যথা Ph. D., D.Litt., দিবার নিয়ম জারি হইবার ফলে মৌলিক জ্ঞানান্বেষণ ও গ্রন্থরচনার প্রবাহ এই যুগের একটি নবীন দৃশ্য। ভারতীয়দের রচিত এরূপ গ্রন্থ (এখানের ও বিলাতের লইয়া) বৎসরে আর্টস্-বিভাগেই চল্লিশ-পঞ্চাশখানি প্রকাশিত হইতেছে। আজ কোন প্রকৃত মেধাবী ছাত্রই পুঁথি-গতবিদ্যার জোরে এম-এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া ক্ষান্ত হয় না, স্বাধীন জ্ঞান চর্চ্চার এবং মৌলিক রচনার পথে এই Ph. D.,D.Litt.-এর প্রবল বন্যা তাহাকে ঠেলিয়া লইয়া যায়। ইহার ফলে এ পর্যন্ত বিশ পঁচিশখানি স্থায়ী সগ্রন্থ বাহির হইয়াছে, আর শত শত যুবক মৌলিক গবেষণার মন্ত্রে দীক্ষিত হইতেছে।
পঞ্চমত: কিন্তু আমার মনে হয় যে বর্তমান রাজার রাজ্যকালে আমাদের সবচেয়ে বেশী সৌভাগ্যের বিষয় এইটি যে, আজ ভারত-ইতিহাসের প্রায় সমস্ত বিভাগেই বিশেষজ্ঞ শ্রেষ্ঠ মনীষীরা ভারতেই বাস করিতেছেন; তাহাদের গ্রন্থ সংগ্রহ, অপ্রকাশিত টীকা ও খসড়া ভারতেই থাকিয়া যায়; যে কোন ভারতীয় জ্ঞানপিপাসু নবীন শ্রমী ডাকযোগে এক বা দু-দিনের মধ্যে তাঁহাদের নিকট হইতে পরামর্শ ও সাহায্য পাইতে পারে, অল্প রেল ভাড়া দিয়া দেখা করিতে পারে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত যখন সাহেবেরা এইসব ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ছিলেন। তখন তাঁহাদের সমস্ত জীবনের সংগৃহীত জ্ঞান, পুস্তক ও হস্তলিপি, তাঁহারা অবসর গ্রহণ করা মাত্র বিলাতে চলিয়া যাইত, আমরা তাহা হইতে বঞ্চিত থাকিতাম। কিন্তু আজ, ব্রিটিশ-পূর্ব্ব যুগের ভারতীয় ইতিহাসে যদি কোন বিদেশী শ্রেষ্ঠ কাজ করিতে চাহেন, তবে তাহাকে ভারতবর্ষে আসিতেই হইবে, ভারতীয় পণ্ডিতদের সাহায্য লইতেই হইবে।
এই শতাব্দী পাদে ইতিহাসের ক্ষেত্রে ভারতে যে উন্নতি সাধিত হইয়াছে, তাহা মানসচক্ষে দেখিলে যুগপৎ আহ্লাদ ও আশায় হৃদয় ভরিয়া উঠে। এক্ষেত্রে আমাদের স্বদেশীদের কাজ আজ “বিদেশের মহোজ্জ্বল মহিমা মণ্ডিত পণ্ডিত সভা” সাদরে বরণ করিয়া মাথায় তুলিয়াছে। এই কঠোর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াই আমাদের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। অন্তত একটি বিভাগে ভারতবাসীর কাজ সাৰ্ব্বজনীন, অমর বলিয়া স্বীকৃত হইল।
হরপ্রসাদ নেপাল হইতে বার-বার অতি অদ্ভুত আদিম বঙ্গসাহিত্য ও কলাদ্রব্য বাহিয়া আনিয়া দিয়া, রাখালদাসের ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা মহেঞ্জোদড়োর পঞ্চ সহস্র বর্ষের ধূলায় ঢাকা বিস্মৃতি সভ্যতার যবনিকা ছিঁড়িয়া ফেলিয়া, আমাদের দেশে, আমাদেরই সমক্ষে, জ্ঞানের অচিন্তিতপূর্ব্ব নব দ্বার খুলিয়া দিয়াছেন। মধ্য-এসিয়া ও মঙ্গোলিয়ার বালুচাপা বা গহ্বরে রুদ্ধ শাস্ত্র ও কাব্য ইতিহাস ও চিত্র, মুক্ত করিয়া দিয়া, ইউরোপীয়রা আমাদের জীবন কালেই আর একটি নবীন জগৎ আবিষ্কার করিয়াছেন। আশা করিতে পারি না কি যে যদি আরও কিছু দিন বাঁচি তবে দেখিতে পাইব যে এই সব নবলব্ধ উপাদানের শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা ও পুটপাক ভারতীয় পণ্ডিতগণেরই কীর্ত্তি হইয়াছে?
হে অর্থে নিস্পৃহ, কৃচ্ছ্রসাধনতত্পর, বাগ্ দেবী-ধ্যানে তন্ময়, ভারতীয় তপস্বীদের আধুনিক বংশধর! হৃদয় আশায় ভরিয়া রাখ, এই জ্ঞানযোগে সিদ্ধিলাভ হইবেই হইবে, কারণ ইতিহাসের রাজ্যটি অসীম; এখানে-
কালোহ্যয়ং নিরবধি
বিপুলা চ পৃথ্বী ৷
[কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাঃ) রজত-জয়ন্তী ভারত সাম্রাজ্যের পঁচিশ বৎসর (১৯১১-১৯৩৫), (প্রথম সংস্করণ, জুন, ১৯৩৫)। প্রকাশক– বেঙ্গল জার্নালস্ লিমিটেড।]
The theory of the solemn transfer of the Caliphate by al-Mutawakkil, the last Egyptian Abbasid to the Othman Sultan Selim, is devoid of any foundation ( একথা Barthold 1912 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করেন।) It owes its dissemination to a Stambul Armenian in Swedish service, M. ed’Ohsson who published it in his Tableau genaral de I’ Empire Othoman ( Paris, 1788-1824)
বিষ্ণুপাদের অনুকরণে পাথরে খুদা কদমরসূল অর্থাৎ মুহম্মদের পদযুগলের চিহ্নের মত এই খিলাফও অর্থলাভের উদ্দেশে জাল দলিল।
[ইতিহাস, ৫ম খণ্ড, ২য় সংখ্যা, অগ্রহায়ন-মাঘ, ১৩৬১।]