২৩. আজ লায়লার বিয়ে

আজ লায়লার বিয়ে

আজ লায়লার বিয়ে।

দায়সারা টাইপ বিয়ে। বর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে। কয়েকজন আত্মীয়স্বজন থাকবে। কাজি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। বিয়ে পড়ানো হবে। তারা কনে নিয়ে চলে যাবে। পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহর। এক লাখ উসুল।

এটা কী রকম বিয়ে? গায়ে হলুদ না, কিছু না। লায়লা ঠিক করে ফেলেছে দুপুরে সে পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করে নি। কল্যাণপুরে তার এক বন্ধবী থাকে। তাদের বাড়িতে ওঠা যায়। সেখানে টেলিফোন আছে। টেলিফোনে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

বিয়ের দিনটা অন্যরকম থাকে। অথচ তার বিয়ের দিন অন্য দিনগুলোর চেয়ে মোটেও আলাদা না। সবকিছু আগের মতো শুধু টগর-পলাশ স্কুলে যাচ্ছে না। তারা বারান্দায় মহা উৎসাহে ফুটবল খেলছে।

তারেকও অফিসে যায় নি। সে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে ছেলেদের খেলা দেখছে। তারেক বলল, লায়লা আমাকে চা দে।

লায়লা চা বানাতে গেল। কমলার মা বলল, বিয়ার দিন চুলার ধারে যাইয়েন না আফা। ঘরে গিয়া টাইট হইয়া বইয়া থাকেন। চা আমি বানাইতেছি।

লায়লা তাকে ধমক দিয়েছে–বেশি কথা বলবে না। কমলার মা। এত কথা আমার ভালো লাগে না।

চা বানাতে গিয়ে লায়লার চোখে পানি এসে গেল। তার কত শখ ছিল অল্প বয়েসী, লম্বা পাতলা সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। যার সঙ্গে সে নানান ধরেনের আহ্লাদী করবে। আহ্লাদী করতে তার খুব ভালো লাগে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তার সঙ্গে সে আহ্লাদী কী করবে? হেডমাস্টার চেহারার একজন মানুষ। আগে বিয়ে হয়েছে। সেই পক্ষের ছেলে আছে। কে জানে ছেলেও হয়তো বাবার বিয়েতে বরযাত্রী আসবে।

মানুষটার কথাবার্তাও গা জ্বালা ধরনের–শুনুন প্লেইন এন্ড সিম্পল বিয়ে হবে। কোনো অনুষ্ঠান না কিছু না। অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে আমি যেতে চাচ্ছি না।

তুই অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে যাবি কিরে গাধা? তোর একটুও চক্ষুলজ্জা নেই! দুদিন পরে পরে বিয়ে করছিস!

লায়লা তার বিয়ের খবর কাউকে জানায় নি। কোন লজয় জানাবে? সবাই হাসাহসি করবে না! হয়তো বলবে–গাছে না। উঠতেই এক কাদি? বিয়ের আগেই এত বড় ছেলে?

ভাইয়া চা নাও।

তারেক চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বল, মা-বাবা কেউ তো এখনো আসছে। না? মা বোধহয় রাগ করেই বসে আছে। আমাকে গিয়ে রাগ ভাঙিয়ে আনতে হবে। বড়বুবুরই বা ব্যাপারটা কী? সব ঠিকঠাক করে—তারই খোঁজ নেই।

লায়লা জবাব দিল না। তারেক বলল, চা ভালো বানিয়েছিস। একটু কড়া হয়েছেআরেকটু কড়া হলে ভালো হতো।

রকিব কি তোর বিয়ের খবর জানে?

আমি জানি না।

হাসানকে বলেছিলাম খবর দিতে। দিয়েছে হয়তো। লায়লা যা আমার জন্যে আরেক কাপ চা আন।

লায়লা চা আনতে গেল। সেখান থেকেই দেখল হাসান বের হচ্ছে। এই সকালে চা-টা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে। লায়লা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। হাসানকে ডাকবে না ডাকবে না করেও ডাকল, ভাইয়া শোন। যাচ্ছে কোথায়?

রহমানদের বাড়িতে। তার দাদির অবস্থা নাকি খুব খারাপ। রাতে খবর পাঠিয়েছে। যেতে পারি নি। চট করে দেখে আসি।

চা খাবে?

চা হচ্ছে নাকি? চা হলে দে। তোর মুখ এমন শুকনা লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয় নি?

না।

বিয়ে নিয়ে টেনশান করছিস?

তোমরা কেউ টেনশন করছ না, আমি শুধু শুধু টেনশান করব কেন?

রাগ করেছিস নাকি?

আমি রাগ করব কেন? আমার রাগ করার কী আছে? তুমি ভাইয়ার কাছে বোস আমি চা নিয়ে আসছি।

লায়লার চোখে আবার পানি আসছে। হাসানকে সরিয়ে দিতে না পারলে সে তার চোখের পানি দেখে ফেলবে। কী দরকার চোখে পানি দেখানোর।

লায়লা!

হুঁ।

আমি দেরি করব না। যাব আর আসব–যেতে-আসতে যা সময় লাগে। এই ধর দুঘণ্টা। তোর কিছু লাগবে?

না আমার আবার কী লাগবে?

হুট করে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল–এইজন্যে আর উৎসব হচ্ছে না। এটা নিয়ে মন খারাপ করবি না। উৎসব বড় ব্যাপার না। যার সঙ্গে সারা জীবন থাকিবি সেই মানুষটা বড় ব্যাপার। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়েছে।

ভালো।

এখন তুই খুব রেগে আছিস–তোর পছন্দ হবে সবচেয়ে বেশি। তুই আমাদের সামনেই ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আহ্লাদী করবি–দেখে রাগে আমার গা জ্বলে যাবে।

এই নাও তোমার চা।

লায়লা আজ সকালে কি তুই আয়নায় নিজেকে দেখেছিস?

আয়নায় নিজেকে দেখার কী আছে।

তোকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে। যা আয়নায় নিজেকে দেখে আয়।

ভাইয়া প্লিজ আহ্লাদী করবে না। লায়লা তারেকের চায়ের কাপ নিয়ে বের হয়ে গেল। আসলেই আয়নার সমানে আজ দাঁড়ানো হয় নি। হাসান যখন বলেছে তখন একবার নিজেকে দেখতেই হয়। লায়লা নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন চোখে পড়ল বাসার সামনে ট্যাক্সি থামল। ট্যাক্সি ভর্তি মানুষ। বড়বুবু সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন। পেছনে আরেকটা ট্যাক্সি সেখান থেকে মা-বাবা নামছেন। সবার মুখ হাসি হাসি। এ কী! উৎসব শুরু হয়ে গেল নাকি? লায়লার বুকে সামান্য কঁপন লাগল। ছোটবেলায় ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই যেমন মনে হত আজ। ঈদ এবং বুকে কাঁপন লগত তেমন কাঁপন।

টগর এবং পলাশ দাদিমা দাদিমা বলে বিকট চিৎকার করছে। বড়বুবু হাতে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে নামছেন। কে জানে প্যাকেটগুলাতে কী আছে।

 

আম্বিয়া খাতুন আবারো একটা ভেলকি দেখিয়েছেন। হাতপা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন। এক সময় শ্বাস নেয়া স্তিমিত হয়ে গেল। সেকান্দর আলী ‘ও আমার মারে’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠতেই আম্বিয়া খাতুন ক্ষীণ গলায় বললেনগাধাটা চিল্লায় কেন? আম্বিয়া খাতুনের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিয়মিত শ্বাস পড়তে লাগল। তিনি পানি খেতে চাইলেন। আত্মীয়স্বজনরা দল বেঁধে এসেছিলেন তারা চলে যেতে চাচ্ছিলেন, সেকান্দর আলি বললেন— এখন যাবেন না। মৃত্যুর আগে আগে হঠাৎ শরীরটা ভালো হয়ে যায়। তাই হচ্ছে। আপনারা চলে যাবেন, ঘটনা ঘটে যাবে। আপনাদের মনে থাকবে আফসোস–শেষ সময়ে কাছে থাকতে পারলেন না। আত্মীয়স্বজন বেশিরভাগই থেকে গেলেন। সব অপেক্ষই যন্ত্রণাদায়ক, মৃত্যুর অপেক্ষাও তাই।

হাসান যখন পৌঁছলো তখন লোকজনে বাড়ি গমগম করছে। উৎসব উৎসব ভাব। ছোট বাচ্চারা উঠোনে খেলছে। বয়স্করা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। ট্রেভর্তি চা এসেছে। চা নেয়া হচ্ছে। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব। শুধু সেকান্দর আলি বিরসমুখে বসে আছেন। রাত্রি জাগরণের কারণে তার শরীর খারাপ করেছে। সামান্য হাঁপানির টানও উঠছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হতো। সেটা ভালো দেখায় না। মারা এখন তখন অবস্থা আর পুত্র এসি ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে! তার যেসব আত্মীয়স্বজন একটু পর পর তাকে বলছে ‘সেকান্দর তুমি যাও শুয়ে একটু রেষ্ট নাও, তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না’–তারাই তখন নানা কথা ছড়াবে। দরকার কী?

হাসানকে দেখে সেকান্দর আলি বললেন, কী খবর হাসান?

হাসান বলল, জ্বি চাচা ভালো।

মার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তোমাকে দেখতে চাচ্ছিলেন। এসেছ ভালো করেছ। যাও দেখা দিয়ে এস।

রহমান কোথায়?

ওকে টঙ্গী পাঠিয়েছি। একজন কাউকে তো ব্যবসাপতি দেখতে হবে।

জ্বি দেখতে তো হবেই।

শোন হাসান, তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। গ্রামের দিকে যেতে হবে। স্কুলমাস্টারি। শিক্ষকতা পেশা হিসাবে খারাপ না। গ্রামে থাকবে ফ্রেশ। আলোবাতাস, ফ্রেশ সবজি। সবাই শহর। শহর করলে গ্রামগুলো চলবে কীভাবে?

জায়গাটা কোথায়?

আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমারই দেয়া আমার মায়ের নামে স্কুল—আম্বিয়া খাতুন গার্লস হাইস্কুল।

ও আচ্ছা।

নদীর পাড়ে স্কুল। অতি মনোরম পরিবেশ। মেয়েদের হোস্টেল আছে। শিক্ষদের থাকার জায়গা আছে। বেতন যা দেয়া হয়। খারাপ না। সরকারি ডিএ তো আছেই। আনম্যারিড কোনো শিক্ষক ওই স্কুলে দেয়া হয় না–তোমার বেলায় নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। গ্রামে যাবে?

জ্বি ভেবে দেখি।

হ্যাঁ ভেবে দেখ। আর যদি যাবার সিদ্ধান্ত নাও তাহলে বিয়ে করে ফেল। বউ নিয়ে থাকবে। সুখে থাকবে। তোমরা ঢাকা শহর ঢাকা শহর করা। কী আছে। এই শহরে! পলিউশন। বেবিট্যাক্সির ধোঁয়া খেয়ে মানুষের গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর। ঠিক না?

জ্বি।

আচ্ছা যাও মার সঙ্গে দেখা করে আস। একটি কথা শোন–মা তোমার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?

জানি না চাচা।

বুঝলে হাসান, মাের এই ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝি না। আমি অতি মাতৃভক্ত ছেলে। মা যা বলছে করেছি। স্কুল বানাতে বলেছে, বানিয়েছি। শীতের সময় আসে মা বলে, গ্রামের গরিব-দুঃখীকে শীতের কম্বল দে, পুরনো কম্বল দিবি না।—নতুন কম্বল। দেই নতুন কম্বল। অমুক এতিমখানার ছেলেপুলেদের ঈদের কাপড় দে। এতিমখানায় কি ছেলেপুলে একটা-দুটা থাকে? শত শত ছেলেপুলে। উপায় কী-মাতৃআজ্ঞ; তাদের দেই। কাপড়–অথচ দেখ আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। আচ্ছা তুমি যাও দেখা করে আস। চাকরির ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে আমাকে জানাবে।

জ্বি আচ্ছা।

হাসান ভেতরের দিকে রওনা হলো।

 

আম্বিয়া খাতুনকে আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে চামচে করে তাঁকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি তাকে দেখে খুবই বিরক্ত মুখে তাকাল। আম্বিয়া খাতুন বললেন, কী রে হাসান তোর সময় হলো শেষ পর্যন্ত?

কেমন আছেন দাদিমা?

ভালো আছি। দেখছিস না। সুপ খাচ্ছি। তোর চাকরি-বাকরি কিছু হয়েছে?

জ্বি না।

যার যা ক্ষমতা আল্লাহপাক তাকে তাই দেন। যার ক্ষমতা চোর হবার তাকে তিনি চোর বানান। যার কিছুই করার ক্ষমতা নেই তাকে কিছুই বানান না–সে তোর মতো পথে পথে ঘোরে। বুঝেছিস?

জ্বি।

সেকান্দরকে বলেছি তোর চাকরির জন্যে।

দাদিমা আমার চাকরির জন্যে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ব্যস্ত তোকে কে বলেছে? তোর চাকরি হলেই কী আর না হলেই কী? যা আমার সামনে থেকে। যাবার আগে সেকান্দরের সঙ্গে দেখা করে যাবি।

জ্বি আচ্ছা।

তোকে স্কুলের চাকরি গছিয়ে দিতে চাইবে। খবরদার নিবি না। কোনো মতে একটা চালাঘর তুলে দিয়েছে–না আছে। ছাত্র না আছে কিছু। মাস্টাররা বেতন পায় না। বুঝেছিস?

জ্বি।

বিয়েটিয়ে করবি না?

হাসান চুপ করে রইল।

না করাই ভালো। বউ তো আর তোর মতো বাতাস খেয়ে থাকবে না। তোকে না। চল যেতে বললাম, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজকাল কি কানেও শুনতে পাস না?

যে মেয়েটি স্যুপ খাওয়াচ্ছিল সে শুকনো গলায় বলল, আপনি এখন যান। উনাকে আর বিরক্ত করবেন না। স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছি।

হাসান বের হয়ে এল। এই বৃদ্ধার মেহের কোনো কারণ সে জানে না। কোনোদিন জানবেও না। ঘর থেকে বের হবার সময় হঠাৎ তার মনে হলো, এই বৃদ্ধর সঙ্গে আর দেখা হবে না। এ রকম মনে হবার কোনো কারণ নেই। তবু মনে হলো। গুরুতর অসুস্থ যে কোনো মানুষের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় এ রকম অনুভূতি হয়–যার আসলে তেমন গুরুত্বই নেই।

সেকান্দর সাহেব বলেলেন, হাসান চলে যাচ্ছে নাকি?

জ্বি।

মা কী বলল?

তেমন কিছু বলেন নি।

আচ্ছা ঠিক আছে। স্কুলের ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে জানাবে। স্কুলের চাকরি খারাপ না। স্যাটিসফেকশান আছে। একটা ভালো কাজ করছ, তার স্যাটিসফেকশন।

জ্বি।

সন্ধ্যার দিকে সময় পেলে একবার এসো। মার জন্যে খতমে শেফা পড়াচ্ছি। বাদ মাগরেব দেয়া হবে।

বাসায় একটা কাজ আছে চাচা।

কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।

সেকান্দর আলি বিমর্ষমুখে সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে তিনি কোনো স্বাদ পেলেন না।

 

লায়লার বিয়ে হয়ে গেল।

তার মন খারাপ ভাবটা বিয়ের পর পুরোপুরি কেটে গেল। যতটা দায়সারা বিয়ে হবে বলে সে ভেবেছিল দেখা গেল বিয়েটা সে রকম দায়সারা হয় নি। ওরা বিয়ের শাড়িই এনেছে তিনটা। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। এর মধ্যে একটা নীল শাড়ি দেখ লায়লা মোহিত হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, ভাবি নীল শাড়িটা কেমন লাগছে?

বিয়ে উপলক্ষে রীনা এসেছে। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছে। টগর-পলাশ মাকে দেখে বেশ স্বাভাবিক আছে। তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো আবেগ বা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না।

রীনা বলল, শাড়িটা তো খুবই সুন্দর।

এখন বল শাড়ি কোনটা পরব?

সবচে’ সুন্দরটাই পর। নীলটা পর।

কিন্তু ভাবি লাল শাড়ি ছাড়া বিয়ে কেমন কেমন জানি লাগছে।

তাহলে থাক লালটাই পর। বিয়ে পড়ানো হোক–তারপর বদলে নীলটা পরলেই হবে।

গায়ে হলুদ হয় নি বলে। লায়লার মনে যে খুঁতখুঁতনি ছিল সেটা দূর হয়েছে–রীনা দুপুরে এসেই গায় হলুদের ব্যবস্থা করেছে। লায়লা খুবই আপত্তি করছিল, কী ছাতার বিয়ে তার আবার গায়ে হলুদ! ভাবি তুমি বরং কিছু শুকনা মরিচ পিষে গায়ে ডলে দাও। গায়ে মরিচ হয়ে যাক!

রীনা ধমক দিয়েছে–ঝামেলা করবে না তো। এস বলছি। লায়লা আর ঝামেলো করে নি। খুশি মনেই গিয়েছে। বিয়ের শাড়ি পরানোর পর লায়লার খুব ইচ্ছা করতে লাগল কোনো একটা পার্লারে গিয়ে চুল বেঁধে আসতে। ভুরুও প্লাক করা দরকার। তুরু প্লাক সে নিজে নিজে করে। বিউটি পার্লারে ওরা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে করবে। কিন্তু কথাটা সে বলবে কাকে? বলতে লজ্জাও লাগবে। তার বান্ধীরা কেউ থাকলে বলত। কাউকেই আসতে বলা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আসতে বললে ভালো হতো। নীল শাড়িটা সবাইকে দেখাতে ইচ্ছা করছে।

বরযাত্রীদের কাজি নিয়ে আসার কথা। তারা আনতে ভুলে গেছেন। গাড়ি পাঠানো হয়েছে কাজি আনতে। লায়লা সেজোগুজে অপেক্ষা করছে। মাথার চুল বাধাটা নিয়ে তার মনটা খুঁতখুঁত করছে। আচ্ছা লজ্জার মাথা খেয়ে সে কি ভাবিকে বলে ফেলবে? ভাবি আবার তাকে বেহায়া ভাববে না তো? লায়লা ক্ষীণস্বরে ডাকল, ভাবি।

রীনা বলল, কী ব্যাপার বল? লায়লা তোমাকে কিন্তু খুবই সুন্দর লাগছে। আয়নায় দেখেছি নিজেকে।

চুল বাঁধাটা মনে হয় ঠিক হয় নি ভাবি। কেমন ফুলে ফুলে আছে। রীনা বলল, লায়লা চল একটা কাজ করি। এখনো তো হাতে সময় আছে চল কোনো পার্লারে গিয়ে বেঁধে আসি।

যাব কী করে ভাবি? বেবিট্যাক্সি করে? বিয়ের শাড়ি পরে বেবিট্যাক্সি করে যাওয়া বিশ্ৰী দেখাবে না?

বেবিট্যাক্সি করে যাব কেন? তোমার বরের গাড়ি নিয়ে যাব। তোমার বরের গাড়ি তো তোমারই গাড়ি।

দেখ ভাবি তুমি যা ভালো বোঝ। কী ছাতার বিয়ে–এর জন্যে আবার পার্লারে গিয়ে চুল বাঁধা!

লায়লা তোমার গয়নাগুলো দেখেছি। একটা নীল পাথরের সেটও আছে। তোমার নীল শাড়ির সঙ্গে খুব মানাবে।

ওইসব তুমি দেখ ভাবি, আমার কিছু দেখতে ইচ্ছে করছে না।

দেখতে ইচ্ছা করছে না বললেও লায়লা পাথরের সেটটা আগেই দেখেছে। উফ! এত সুন্দর।

যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সেই মানুষটাকেও সে এক ফাঁকে দেখেছে। বাহ্‌! পায়জামাপাঞ্জাবিতে খুব মানিয়েছে! আর আগে একবার দেখেছিল শার্ট-প্যান্ট পর্যা–তখন এত ভালো লাগে নি। আশ্চর্যের ব্যাপার–লোকটার ছেলের জন্যেও তার মায়া লাগছে। বাচ্চা একটা ছেলে–মারা ভালবাসা পাচ্ছে না। ছেলেটাকে সে অবশ্যই আদর করবে। সে বেচারা তো কোনো দোষ করে নি। তাকে এরা কোথায় একা একা রেখে এসেছে কে জানে। মনে করে নিয়ে এলেই হতো। লোকে কী বলবে? বলুক। লায়লা মানুষের কথার ধার ধারে না।

লায়লার বান্ধবীরাও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে এসে যুক্ত হলো। বিউটি পার্লার থেকে লায়লা তাদের টেলিফোন করে দিয়েছিল। দু’জনের বাসায় টেলিফোন ছিল না। লায়লা চিঠি লিখে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য এই গাড়িটা তাদের ভাবতেও ভালো লাগছে। সে যখন ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে বলল, এই দু’জনকে আমার চিঠি দিয়ে আসতে পারবেন? ড্রাইভার বলেছে, অবশ্যই পারব ম্যাডাম। ড্রাইভারের মুখে ম্যাডাম শব্দ শুনতে এত ভালো লাগল!

বর-কনে চলে যাবার পর মনোয়ারা রীনাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন। গভীর গলায় বললেন, শোন বউমা তুমি যে এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি দশ রাকাত নফল নামায পড়ে তোমার জন্যে দোয়া করেছি। মা তুমি কি থাকবে না চলে যাবে?

আমি চলে যাব। হাসানকে বলেছি ও পৌঁছে দেবে।

এক কাজ করলে কেমন হয় মা, আমি তারেককে ডাকি ও কানে ধরে তোমার সামনে দশবার উঠবোস করুক।

ছিঃ মা! কী বলছেন এসব!

ভুল বলছি না। ঠিকই বলছি। ও কানে ধরে উঠবোস করলে তোমার রাগটা একটু পড়বে।

মা এইসবের কোনো দরকার নেই।

তারেক যে কাণ্ড করেছে তারপরে তোমাকে আমি থাকতেও বলতে পারি না। বুড়ো মার একটা কথা তুমি রাখি। আজ রাতটা থাক কাল সকালে চলে যেও।

একটা রাত থাকলে কী হবে?

গাধাটার সঙ্গে কথা বল। কথা বলে তোমার যদি মন গলে।

আচ্ছা ঠিক আছে মা আজ রাতটা থেকে যাচ্ছি।

একটু বস আমার সামনে। তোমার সঙ্গে গল্প করি। লায়লাকে কেমন মনে হলো মা–খুশি?

হ্যাঁ, খুব খুশি।

একেবারে গাধা মেয়ে। শাড়ি-গয়না দেখে এলিয়ে পড়েছে। যে যা চায় আল্লাহ তাকে তাই দেন। ও শাড়ি-গয়না চেয়েছিল, আল্লাহ তাকে শাড়ি-গয়না দিয়েছেন। আমার একেকটা ছেলেমেয়ে হয়েছে একেক পদের।

তারেক শুয়ে পড়ছিল। রীনা ঘরে ঢুকতেই উঠে বসে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এটা পান দাও তো।

যেন কিছুই হয় নি। সব আগের মতো আছে। রীনা পান এনে দিল। তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, বাতি নিভিয়ে আস। তুমি ছিলে না মশারি তুলে ফেলেছিলাম। মশারি খাটিয়েছি।

ভালো।

মশা অবশ্যি নেই বললেই হয়। কয়েকদিন ঝড় হয়েছে তো বেশিরভাগ মশার পাখা ঝড়ে ছিঁড়ে গেছে। ওরা উড়তে পারে না।

ভালো।

রীনা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, লাবণী কেমন আছে?

ভালো আছে। ওর মেয়েটার নিউমোনিয়ার মতো হয়েছে। খুব টেনশানে আছি। নিউমোনিয়া খারাপ ধরনের অসুখ। চিকিৎসার চেয়ে যত্নটা বেশি লাগে। লাবণী অফিস নিয়ে ব্যস্ত, বাচ্চাটার যত্ন হচ্ছে কি না কে জানে।

ডাক্তার দেখছে না?

দেখেছে। রসিফিন দিচ্ছে। রসিফিন ভালো এন্টিবায়োটিক। নিউ জেনারেশন ড্রাগ। ঠিকমতো ওষুধ পড়ছে কিনা কে জানে।

তুমি চলে যাও। দেখে শুনে ওষুধ দেবে।

যাব। বৃহস্পতিবার নাইটকোচে চলে যাব। শুক্ৰ-শনি ছুটি আছে। নাইট কোচগুলো ভালো করেছে। পাঁচ ঘণ্টা লাগে যেতে। গাড়িতে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে।

তারেক মশারির ভেতর থেকে বের হবার উপক্রম করল। রীনা বলল, যাচ্ছ কোথায়?

তারেক চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। আগুনের ফুলকি উঠছে–নোমছে। রীনা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। এই মানুষটাকে ছেড়ে সে কাল ভোরে চলে যাবে। কিন্তু তার কী প্ৰচণ্ড ইচ্ছাই না করেছে মানুষটার সঙ্গে থাকতে। একটা জীবন সুখে-দুখে পার করে দিতে।

রীনা চোখের জল সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *