লিখছি, চোখের সামনে কম্পমান কুয়াসার মত কি-একটা এসে দাঁড়াল ভাসতে ভাসতে। আস্তে-আস্তে সে শূন্যাকার কুয়াসা রেখায়িত হয়ে উঠল। অস্পষ্ট এক মানুষের মূর্তি ধারণ করলে। প্রথমে ছায়াময়, পরে শরীরী হয়ে উঠল।
অপরূপ সুন্দর এক যুবকের মূর্তি। যুবক, না, তাকে কিশোর বলব? ধোপদস্ত ধুতি-পাঞ্জাবি পরে এসেছে, পায়ে ঠনঠনের চটি। মাথায় একরাশ এলোমেলো চুল। সেই শিথিল খলিত কেশদামে তার গৌর মুখোনি মনোহর হয়েছে। ঠোঁটে বৈরাগ্যনির্মল হাসি, চোখে অপরিপূর্ণতার ঔদাস্ত। হাতে কতগুলি ছিন্ন পাণ্ডুলিপি।
কে তুমি?
চিনতে পাচ্ছ না? ম্লানমুদুরেখায় হাসল আগন্তুক: আমি সুকুমার।
কোন সুকুমার?
সুকুমার সরকার।
চিনতে পারলাম। কল্লোলের দলের নবীনতম অভ্যাগত।
হাতে ও কী! কবিতা? প্রশ্ন করলাম সকৌতূহলে।
পৃথিবীতে যখন এসেছি, কবিতার জন্যেই তো এসেছি। কবিতায়ই তো পৃথিবীর প্রাণ, মানুষের মুক্তি। স্বর্গের অমৃতের চেয়েও পৃথিবীর কবিতা অমৃততর।
কিসের কবিতা? প্রেমের?
প্রেম ছাড়া আবার কবিতা হয় নাকি? তোমাদের এ সময়ে রুটি নিয়ে ঢের রোমাণ্টিসিজম চলেছে—কিন্তু যাই বলো, সব খিদেই মেটে, প্রেমের ক্ষুধাই অতৃপ্য। লাখো লাখো যুগ হিয়ে হিয় রাখনু–এ তো কম করে বলা। শুনবে একটা কবিতা? সময় আছে?
তার পাণ্ডুলিপি থেকে কবিতা আবৃত্তি করতে লাগল সুকুমার :
সে হাসির আড়ালে রাখিব দুই সারি খেত মুক্তামালা,
রাঙা-রাঙা ক্ষীণ মণি-কণা পাশে-পাশে অঙ্কিব নিরালা!
শ্রাবণের উড়ন্ত জলদে রচি এলো-কেশ নিরুপম,
সিঁথি দেব তমালের বনে সরিতের শীর্ণ ধারা সম!
ললাট সে লাবণ্যবারিধি, সিঁদুর প্রদীপ তার বুকে
অলকের কালিমা-সন্ধ্যায় ভাসাইব তৃপ্তিভরা সুখে!
বাহু হবে বসন্ত উৎসবে লীলায়িত বেতসের মত,
স্পর্শনের শিহর-কণ্টকে দেবে মধুদংশ অবিরত!
চম্পকের কুঁড়ি এনে এনে সৃষ্টি করি সুন্দর আঙুল,
শীর্ষদেশে দেব তাহাদের ছোট-ঘোট বাঁকা চন্দ্রফুল!
সুমুখী কুসুমের বুকে যে সুবর্ণ যৌবনের আশ
নিঙাড়িয়া তার সর্বরস এঁকে দেব বক্ষের বিলাস!
পরে অর্থ হৃৎপিণ্ড মোর নিজ হাতে ছিন্ন কবি নিয়া
দেহে তব আনিব নিশ্বাস প্রেমমন্ত্রে প্রাণ প্রতিষ্টিয়া!
মুহূর্তে সুকুমারের উপস্থিতি দিব্যাকচ্যুতিময় হয়ে উঠল। আর তাকে রেখার মধ্যে চেতনাবেষ্টনীর মধ্যে ধরে রাখা গেল না। মিলিয়ে গেল জ্যোতির্মগুলে।
কতক্ষণ পরে ঘরের স্তব্ধতায় আবার কার সাড়া পেলাম। নতুন কে আরেকজন যেন ঢুকে পড়েছে জোর করে। অপরিচিত, বিকটবিকৃত চেহারা। ভয় পাইয়ে দেবার মত তার চোখ।
না, ভয় নেই। আমি। শ্রান্তিমাখানো সুরে বললে।
গলার আওয়াজ যেন কোথায় শুনেছি। জিগগেস করলাম, কে তুমি?
আমি সেই সুকুমার।
সেই সুকুমার? সে কি? এ তুমি কী হয়ে গিয়েছ! তোমার সেই চম্পককান্তি কই? কই সেই অরুণ-তারুণ্য? তোমার চুল শুষ্করুক্ষ, বেশবাস শতছিন্ন, নগ্ন পায়ে ধুলো–
বসব একটু এখানে?
বসো।
তুমি বসতে জায়গা দিলে তোমার পাশে? আশ্চর্য! কেউ আর জায়গা দেয় না। পাশে বসলে উঠে চলে যায় আচমকা। আমি ঘৃণ্য, অস্পৃশ্য। আমি কি তবে এখন ফুটপাতে শুয়ে মরব?
কেন, তোমার কি কোনো অসুখ করেছে?
করেছিল। এখন আর নেই। বিদ্রূপকুটিল কণ্ঠে হেসে উঠল সুকুমার।
নেই?
বহুকষ্টে সেরে উঠেছি।
কি করে?
আত্মহত্যা করে।
সে কি? চমকে উঠলাম : আত্মহত্যা করতে গেলে কেন?
নৈরাশ্যের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁচেছিলাম, মনোবিকারের শেষ আচ্ছন্ন অবস্থায়। সংসারে আমার কেউ ছিল না—মৃত্যু ছাড়া। আর একজন যে ছিল সে আমার প্রেম, যে অপ্রাপ্তব্য অলব্য—যার মুখ দেখা যায় না প্রত্যক্ষচক্ষে। সেই অন্ধ আবৃত মুখ উস্মোচিত করবার জন্যে তাই চলে এলাম এই নির্জনে, এই অন্ধকারে–
কেন তোমার এই পরিণাম হল?
যিনি পরিণামদায়ী তিনি বলতে পারেন। হাসল সুকুমার : যুগব্যাধির জল ঢুকেছিল আমার রক্তে, সব কিছুকে অস্বীকার করার দুঃসাহস। সমস্ত কিছু নিয়মকেই শৃঙ্খল বলে অমান্য করা। তাই নিয়মহীনতাকে বরণ করতে গিয়ে আমি উচ্ছৃলতাকেই বরণ করে নিলাম। আমার সে উজ্জ্বল উদার উচ্ছৃঙ্খলতা! অল্পপ্রাণ হিসেবী মনের মলিন মীমাংসা তাতে নেই, নেই তাতে আত্মরক্ষা করবার সংকীর্ণ কাপুরুষতা। সে এক নিবারণহীন অনাবৃতি। পড়ব ত মরব বলে ভয় করব না। বিদ্রোহ যখন করব তখন নিজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব। তাই আমার বিদ্রোহ সার্থকতম, পবিত্রতম বিদ্রোহ! প্রদীপ্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল সুকুমার।
কিন্তু, বলল, কী লাভ হল তোমার মৃত্যুতে।
একটি বিশুদ্ধ আত্মদ্রোহের স্বাদ তো পেলে। আর বুঝলে, যা প্রেম তাই মৃত্যু। জীবনে যে আবৃতমুখী মৃত্যুতে সে উন্মোচিতা।
বলতে-বলতে সমস্ত কামালিন্য কেটে গেল সুকুমারের। অন্তরীক্ষের ধৌতধবল জ্যেতিমান উপস্থিতিতে সে উপনীত হল। হৃদয়ের মধ্যে শুধু একটি কুমার-কোমল বন্ধুর স্নেহস্পৰ্শ রইল চিরস্থায়ী হয়ে।
শিশিরকুমার ভাদুড়ির নাট্যনিকেতনে একদা রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ‘শেষরক্ষা’ দেখতে। সেটা কল্লোলের পক্ষে একটা স্মরণীয় রাত, কেননা সে অভিনয় দেখবার জন্যে কল্লোলের দলেরও নিমন্ত্রণ হয়েছিল। আমরা অনেকেই সেদিন গিয়ে ছিলাম। অভিনয় দেখবার ফাঁকে-ফাঁকে বারেবারে রবীন্দ্রনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করেছি তাতে কখনও কতটুকু হাসির রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। স্বভাবতই, অভিনয় সেদিন ভয়ানক জমেছিল, এবং ‘যার অদৃষ্টে যেমনি জুটেছে’ গানের সময় অনেক দর্শকও সুর মিলিয়েছিল মুক্তকণ্ঠে। শেষটায় আনন্দের লহর পড়ে গিয়েছিল চারদিকে। শিশিরবাবু ব্যস্তসমস্ত হয়ে ছুটে এলেন কবির কাছে, অভিনয় কেমন লাগল তার মতামত জানতে। সরলক্ষিপ্ত কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথ বললেন, কাল সকালে আমার বাড়িতে যেও, আলোচনা হবে। আমাদের দিকেও নেত্রপাত করলেন : তোমরাও যেও।
দীনেশদা, নৃপেন, বুদ্ধদেব আর আমি—আর কেউ সঙ্গে ছিল কিনা মনে করতে পারছি না–গিয়েছিলাম পরদিন। শিশিরবাবুও গিয়েছিলেন ওদিক থেকে। রবীন্দ্রনাথের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে বসবার ঘরে একত্র হলাম সকালে। স্নানশেষে রবীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকলেন।
কি কি কথা হয়েছিল স্পষ্ট কিছু মনে নেই। ইংরিজি পাবলিক কথাটার রসাত্মক অর্থ করেছিলেন–লোকলক্ষ্মী–এ শব্দটা গেঁথে আছে। সেদিনকার সকাল বেলার সেই ছোট্ট ঘটনাটা উল্লেখ করছি, আর কিছুর জন্যে নয়, রবীন্দ্রনাথ যে কত মহিমাময় তা বিশেষ ভাবে উপলব্ধি করেছিলাম বলে। এমনিতে শিশিরকুমার আমাদের কাছে বিরাট বনস্পতি—অনেক উচ্চস্থ। কিন্তু সেদিন রবীন্দ্রনাথের সামনে ক্ষণকালের জন্যে হলেও, শিশিরকুমার ও আমাদের মধ্যে যেন কোনোই প্রভেদ ছিল না। দেবতাত্মা নগাধিরাজের কাছে বৃক্ষ-তৃণ সবই সমান।
শরৎচন্দ্র এসেছিলেন একদিন কল্লোলে—কালিকলমে একাধিক দিন।
কলেজ স্ট্রিট মার্কেটের উপরে বরদা এজেন্সি অর্থাৎ কালি-কলম আপিসের পাশেই আর্য-পাবলিশিং হাউস। আর্য-পাবলিশিং-এর পরিচালক শশাঙ্কমোহন চৌধুরী। শশাঙ্ক তখন বাংলার কথায় সাবএভিটারি করে আর দোকান চালায়। বেলা দুটো পর্যন্ত দোকানে থাকে তারপর চলে যায় কাগজের আপিসে। বেস্পতিবার কাগজের আপিসে ছুটি, শশাঙ্ক সেদিন পুরোপুরি দোকানের বাসিন্দা।
মুরলী আছে? মুরলী আছে? শশব্যস্ত হয়ে শরৎচন্দ্র একদিন ঢুকে পড়লেন আর্য-পাবলিশিং-এ।
দরজা ভুল করেছেন। লাগোয়া আর্য-পাবলিশিংকেই ভেবেছেন বরদা এজেন্সি বলে।
এত ত্বরা যে, দোকানের পিছন দিকে যেখানটায় একটু অন্তরাল রচনা করে শশাঙ্ক বসবাস করত সেখানে গিয়ে সরাসরি উঁকি মারলেন। অথচ ঘরে ঢোকবার দরজার গোড়াতেই যে শশাঙ্ক বসে আছে সে দিকে লক্ষ্য নেই। পিছন দিকের ঐ নিভৃত অংশৈ মুরলীকে পাওয়া যাবে কি না বা কোথায় পাওয়া যাবে সে সম্বন্ধে শশাঙ্ককে একটা প্রশ্ন করাও প্রয়োজনীয় মনে করলেন না। মুরলী যে কী সম্পদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা মুরলী জানে না–মুরলীকে এই দণ্ডে, এই মুহূর্তবিন্দুতে চাই। যেমন দ্রুত এসেছিলেন তেমনি ত্বরিতগতিতে চলে গেলেন।
গায়ে খদ্দরের গলাবন্ধ কোট। তারই একদিকের পকেটে কী ওটা শুঁড় বার করে রয়েছে। .
বুঝতে দেরি হল না শশাঙ্কর। শরৎচন্দ্রের পকেটে চামড়ার কেসে মোড়া একটি আস্ত জলজ্যান্ত রিভলবার।
সদ্য লাইসেন্স পাওয়ার পর ঐ ভায়োলেন্ট বস্তুটি শরৎচন্দ্র তাঁর নন-ভায়োলেন্ট কোটের পকেটে এমনি অবলীলায় কিছুকাল বহন করেছিলেন।
ওদিককার কোটের পকেটে আরো একটা জিনিস ছিল। সেটা কাগজে মোড়া। সেটা শশাঙ্ক দেখেনি। সেটা শরৎচন্দ্রের সতী গল্পের পাণ্ডুলিপি।
ঐ গল্পটিই তিনি দিতে এসেছিলেন কালি-কলমকে। তারই জন্যে অমনি হন্তদন্ত হয়ে খুঁজছিলেন মুরলীধরকে। মুরলীধরকে না পেয়ে সোজা চলে গেলেন ভবানীপুরে—বঙ্গবাণীতে। সতীর পূতস্পর্শ পড়ল না আর মসীচিহ্নিত কালি-কলমে।
এদিকে ঐ দিনই মুরলীধর আর শৈলজা সকালবেলার ট্রেনে চলে এসেছে পানিব্রাস। শরৎচক্রের বাড়িতে গিয়ে শোনে, শরৎচন্দ্র সকালবেলার ট্রেনে চলে গিয়েছেন কলকাতা। এ যে প্রায় একটা উপন্যাসের মতন হল। এখন উপায়? ফিরবেন কখন? সেই রাত্রে। তাও ঠিক কি।
এতটা এসে দেখা না করে ফিরে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। রাত্রে না হোক, পরদিন কিংবা কোনো একদিন তো ফিরবেন। সুতরাং থেকে যাওয়া যাক। কিন্তু শুধু উপন্যাসে কি পেট ভরবে?
শরৎচন্দ্রের ছোট ভাই প্রকাশের সঙ্গে শৈলজা ভাব জমিয়ে ফেলল। কাজেই থাকা বা খাওয়া-দাওয়ার কিছুরই কোনো অসুবিধে হল না।
রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি পালকির আওয়াজ শোনা গেল। আসছেন শরৎচন্দ্র।
কি জানি কেমন ভাবে নেবেন ভয় করতে লাগল দুই বন্ধুর। এত রাত পর্যন্ত তার বাড়ি আগলে বসে আছে ঘাপটি মেরে এ কেমনতর অতিথি!
পালকি থেকে নামতে লণ্ঠনটা তুলে ধরল শৈলজা। এমন ভাবে তুলে ধরল যাতে আলোর কিছুটা অন্তত তাদের মুখে পড়ে—যাতে তিনি একটু চিনলেও চিনতে পারেন বা! প্রতীক্ষমান বিদেশী লোক দেখে পাছে কিছু বিরক্তিব্যঞ্জক উক্তি করেন, তাই দ্রুত প্রণাম সেরেই মুরলীধর বলে উঠলেন : এই শৈলজা; আর শৈলজাও সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিধ্বনি করল : এই মুরলীদা।
আরে, তোমরা? শরৎচন্দ্রের স্তম্ভিত ভাবটা নিমেষে কেটে গেল। আমি যে আজ দুপুরে তোমাদের কালি-কলমেই গিয়েছিলাম। কি আশ্চর্য—তোমরা এখানে? এলে কখন?
দুঃসংবাদটা চেপে গেলেন—ভাগ্যের কারসাজিতে কী সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছে কালি-কলম। উচ্ছ্বলিত হয়ে উঠলেন আতিথেয়তার ঔদার্যে : তা বেশ হয়েছে–তোমরা এসেছ! খাওয়া-খাওয়া হয়েছে তো? অসুবিধে হয়নি তো কোন? কি আশ্চর্য–তোমরা আমার বাড়িতে আর আমি তোমাজের খুঁজে বেঁড়াচ্ছি! তা এইরকমই হয় সংসারে। একরকম ভাবি হয়ে ওঠে অন্যরকম। আচ্ছা তোমরা বোসো, আমি জামা-কাপড় ছেড়ে খেয়ে আসি। কেমন?
বলেই ভিতরে চলে গেলেন, এবং বললে বিশ্বাস হবে না, মিনিট পনেরোর মধ্যেই বেরিয়ে এলেন চটপট। তারপর শুরু হল গল্প–সে আর থামতে চায় না। মমতা করবার মত মনের মানুষ পেয়েছেন, পেয়েছেন অন্তরঙ্গ বিষয়—জীব আর জীবন—তাঁকে আর কে বাধা দেয়! রাত প্রায় কাবার হতে চলল, তরল হয়ে এল অন্ধকার, তবু তার গল্প শেষ হয় না।
তাঁকেও বারণ করবার লোক আছে ভিতরে। প্রায় ভোরের দিকে ডাক এল : ওগো, তুমি কি আজ একটুও শোবে না?
তক্ষুনি মুরলীদারা তাঁকে উপরে পাঠিয়ে দিলেন। যেতে-যেতেও কিছু দেরি করে ফেললেন। তাঁর লাইব্রেরি ঘরে মুরলীদাদের শোবার বিস্তৃত ব্যবস্থা করলেন। তাতেও যেন তাঁর তৃপ্তি নেই। বিছানার চারপাশ ঘুরে-ঘুরে নিজ হাতে মশারি গুঁজে দিলেন।
আমি একবার গিয়েছিলাম পানিত্ৰাস। একা নয়, শৈলজা আর প্রেমেনের সঙ্গে। ভাগ্য ভালো ছিল, শরৎচন্দ্র বাড়ি ছিলেন। আমি তো নগণ্য, নেতিবাচক উপসর্গ, তবুও আমারও প্রতি তিনি স্নেহে দ্রবীভূত হলেন। সারা দিন আমরা ছিলাম তার কাছে কাছে, কত-কী কথা হয়েছিল কিছুই বিশেষ মনে নেই, শুধু তার সেই সামীপ্যের সম্প্রীতিটি মনের মধ্যে এখনো লেগে আছে। আমাদের সেদিনকার বহুব্যঞ্জনব্যঞ্জিত অন্নের থালায় যে অদৃশ্য হস্তের স্নেহ-সেবা-স্বাদ পরিবেশিত হয়েছিল তাও ভোলবার নয়।
কথায়-কথায় তিনি হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করলেন : কার জন্যে, কিসের জন্য বেঁচে আছ?
মন্দিরের ঘণ্টার মত কথাটা এসে বাজল বুকের মধ্যে।
জীবনে কোথায় সেই জাগ্রত আদর্শ? কে সেই মানসনিবাস? কার সন্ধানে এই সম্মুখযাত্রা?
আদর্শ হচ্ছে রাতের আকাশের সুদূর তারার মত। ওদের কাছে পৌঁছুতে পারি না আমরা, কিন্তু ওদের দেখে সমুদ্রে আমরা আমাদের পথ করে নিতে পারি অন্তত।
সত্যরত হও, ধৃতব্রত। পার্বতী শিবের জন্যে পঞ্চানল জ্বেলে পঞ্চতপ করেছিলেন। তপস্যা করেছিলেন পঞ্চমুণ্ডির উপর বসে। নিরুত্থান তপস্যা। ইন্ধন না থাকে, তবুও আগুন নিভবে না। হও নিরিন্ধনাগ্নি।
যে শুধু হাত দিয়ে কাজ করে সে শ্রমিক, যে হাতের সঙ্গে-সঙ্গে মাথা খাটায় সে কারিগর, আর যে হাত আর মাথার সঙ্গে হৃদয় মেশায় সেই তো আর্টিস্ট। হও সেই হৃদয়ের অধিকারী।
কালি-কলমের আড্ডাটা একটু কঠিন-গম্ভীর ছিল। সেখানে কথন ছিল বেশি, উপকথন কম। মানে যিনি বক্তা তারই একলার সব কর্তৃত্ব ভোক্তৃত্ব। আর সব শ্রোতা, অর্থাৎ নিশ্চলজিহ্ব। সেখানে একাভিনয়ের ঐকপত্য। বক্তার আসনে বেশির ভাগই মোহিতলাল, নয়ত সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, নয়তো কখনো-সখনো সুরেন গাঙ্গুলী, নয়তো কোনো বিরল অবসরে শরৎচন্দ্র। কালি-কলমের আড্ডায় তাই মন ভরত না। তাই কালি-কলমের লাগোয় ঘরেই আর্য-পাবলিশিং-এ আমরা আস্তে-আস্তে একটা মনোম আড্ডা গড়ে তুললাম। অর্থাৎ কালি-কলমের সঙ্গে সংসর্গ রাখতে গিয়ে না শুদ্ধ শুষ্কতর্ক নিয়েই বাড়ি ফিরি।
আর্য-পাবলিশংএ জমে উঠল আমাদের বারবেলা ক্লাব। সেই ক্লাবের কেন্দ্রবিন্দু শশাঙ্ক। বৃহস্পতিবার শশাঙ্কের কাগজের আপিসে ছুটি, আই সেদিনটা অহোরাত্রব্যাপী কীর্তন। এ শুধু সম্ভব হয়েছিল শশাঙ্কের ঔদার্যের জন্যে। নিজে যখন সে কবি আর সৌভাগ্যক্রমে হৃদয়ে ও দোকানে যখন সে এতখানি পরিসরের অধিকারী, তখন বন্ধুদের একদিনের জন্যে অন্তত আশ্রয় ও আনন্দ না দিয়ে তার উপায় কি? দোকানের কর্তা বলতে সে-ই, আর নিতান্ত সেটা বইয়ের দোকান আর দোতলার উপর বইয়ের দোকান বলে নিরন্তর খদ্দেরের আনাগোনায় আমাদের আড্ডার তালভঙ্গ হবার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু এত লোকের গুলতানির মধ্যে শশাঙ্ক নিজে কোথাও স্পষ্ট-স্ফুট হয়ে নেই। মধ্যপদ হয়েও মধ্যপদলোপী সমাসের মতই নিজের অস্তিত্বটুকুকে কুণ্ঠিত করে রেখেছে। এত নম্র এত নিরহঙ্কার শশাঙ্ক। অতিথিসৎকারক হয়েও সৎই থেকে গেল চিরদিন, কারকত্বের কণামাত্র অভিমানকেও মনে স্থান দিল না।
সাহিত্যিক-সাংবাদিক অনেকেই আসত সে আড্ডায়। কল্লোল সম্পর্কে এতাবৎ যাদের নাম করেছি তারা তো আসতই, তা ছাড়া আসত প্রমোদ সেন, বিজন সেনগুপ্ত, গোপাল সান্যাল, ফণীন্দ্র মুখোপাধ্যায়, নলিনীকিশোর গুহ, বারিদবরণ বসু, রামেশ্বর দে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, তারানাথ রায়, বিজয়লাল চট্টোপাধ্যায়, বিজয়ভূষণ দাশগুপ্ত, শচীন্দ্রলাল ঘোষ, বিনয়েন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, অবিনাশ ঘোষাল, সন্ন্যাসী সাধুখাঁ এবং আরো অনেকে। এ দলের মধ্যে দুজন আমাদের অত্যন্ত অন্তিকে এসেছিল—বিবেকানন্দ আর অবিনাশ—দুজনেই প্রথমে সাহিত্যিক পরে সাংবাদিক। বিবেকানন্দ তখন প্রাণময় প্রেম বা প্রেমময় প্রাণের কবিতা লেখে, আর ভাগ্যের প্রতিরথ হয়ে জীবিকার সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। বেঁটে, বামুন আর বাঙাল—এই তিন ব নিয়ে তার গর্ব, যেন ত্রিগুণাত্মক ত্রিশূল ধারণ করে লে দিখিয়ে চলেছে। আরো এক ব–সে অধিকারী–সে তার তেজোতপ্ত নাম। মোটকথা, হস্তী অশ্ব রথ ও পদাতি—এই চতুরঙ্গে পরিপূর্ণ সৈনিক। অবিনাশ ক্ষয়োদয়রহিত একনিষ্ঠ সাধক–ফলাকাঙ্ক্ষাহীন। সহায়সম্পন্ন না হয়েও উপায়কুশল। মলয় হাওয়ার আশায় সারাজীবন সে পাখা করতে প্রস্তুত, এত শুদ্ধবুদ্ধিময় তার কাজ। সেই কাজের শুদ্ধিতে তার আর বয়স বাড়ল না কোনদিন। এদিকে সে পবিত্রর সমতুল।
বারবেলা-ক্লাবে, শশাঙ্কর ঘরে, আমাদের মুৎফরাক্কা মজলিস। কখনো খুনসুটি, ছেলেমানুষি, কখনো বা বিশুদ্ধ ইয়ার্কি। প্রমথ চৌধুরী মাঝে-মাঝে এসে পড়তেন। তখন অকালমেঘোদয়ের মত সবাই গম্ভীর হয়ে যেতাম, কিন্তু সে-গাম্ভীর্ষে রসের ভিয়ান থাকত। এক-একদিন এসে পড়ত নজরুল। ভাঙা হারমোনিয়ম একটা জুটত এসে কোত্থেকে, চারদিক সরগরম হয়ে উঠত। ওর প্রথম কীর্তন ‘কেন প্রাণ ওঠে কাঁদিয়া’ এই বারবেলা-ক্লাবেই প্রথম ও শুনিয়ে গেছে। কোন এক পথের নাচুনী ভিক্ষুক মেয়ের থেকে শিখে নিয়েছিল সুর, তারই থেকে রচনা করলে—রুমুঝুমু রুমুঝুমু কে এলে নূপুর পায়, আর তা শোনাবার জন্যে সটান চলে এল রাস্তার প্রথম আস্তানা শশাঙ্কর আখড়াতে।
তবু, এত জনসমাগম, তবু যেন কল্লোলের মত জমত না। জনতার জন্যেই জমত না। জনতা ছিল, কিন্তু ঘনতা ছিল না। আকস্মিক হুল্লোড় ছিল খুব, কিন্তু কল্লোলের সেই আকস্মিক স্তব্ধতা ছিল না। যেন এক পরিবারের লোক এক নৌকোয় যাচ্ছি না, ছত্রিশ জাতের লোক ছত্রভঙ্গ হয়ে চলেছি এক জাহাজে, উত্তেজ-উদ্বেল জল ঠেলে।
তবু নজরুল নজরুল। এসে গান ধরলেই হল, সবাই এক অলক্ষ্য সুরে বাঁধা পড়ে যেতাম। যৌবনের আনন্দে প্রত্যেক হৃদয়ে বন্ধুর স্পন্দন লাগত, যেন এক বৃক্ষে পল্লব-পরম্পরায় বসন্তের শিহরণ লেগেছে। একবার এক দোল-পূর্ণিমায় রামপুরে গিয়েছিলাম আমরা অনেকে। বোটানিক্যাল গার্ডেনস পর্যন্ত নৌকো নিয়েছিলাম। নির্মেঘ আকাশে পর্যাপ্ত চন্দ্র—সেই জ্যোৎস্না সত্যি-সত্যিই অমৃত-তরঙ্গিণী। ছিল। গঙ্গাবক্ষে সে রাত্রিতে সে নৌকোয় নজরুল অনেক গান গেয়েছিল-গজল, ভাটিয়ালি, কীর্তন। তার মধ্যে ‘আজি দোল পূর্ণিমাতে দুলবি তোরা আয়’, গানখানির সুর আজও স্মৃতিতে মধুর হয়ে আছে। সেই অনির্বচনীয় পরিপার্শ্ব, সেই অবিস্মরণীয় বন্ধুসমাগম, জীবনে বোধহয় আর দ্বিতীয় বার ঘটবে না।