২৩. অস্ত্রের ঝনাঝনানি

কুরাইশদের সংঘাতময় কর্মসূচী এবং আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইয়ের সঙ্গে পত্রালাপ (استفزازات قريش واتصالهم بعبد الله بن ابي):

মক্কার কুরাইশ মুশরিকগণ মুসলিমদের উপর কিরূপ অন্যায় অত্যাচার ও নিপীড়ন নির্যাতনের পাহাড় ভেঙ্গে ছিল এবং যখন তারা মদীনায় হিজরত শুরু করেন তখন তারা তাদের বিরুদ্ধে কী ধরণের বিদ্বেষমূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল তা ইতোপূর্বে বর্ণিত হয়েছে। যার ফলে তাদের ধনমাল ছিনিয়ে নেয়ার এবং সাধারণভাবে তারা হত্যার নির্দেশ প্রদানেরযোগ্য হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এরপরও তাদের অন্যায় আচরণ ও হঠকারিতামূলক কার্য-কলাপ বন্ধ হল না এবং তারা সে সব থেকে বিরতও থাকল না। পক্ষান্তরে, মুসলিমগণ তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে গিয়ে মদীনায় একটা নিরাপদ আশ্রয় লাভ করেছে এবং ধীরে ধীরে সুসংগঠিত ও শক্তি সঞ্চয় করে চলেছে। এটা প্রত্যক্ষ করে তাদের ক্রোধাগ্নি অতি মাত্রায় প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠল। তাই তারা আনসারদের নেতা আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে প্রকাশ্য হুমকি সহকারে একটি পত্র লিখল যিনি তখন পর্যন্ত খোলাখুলি মুশরিক ছিলেন। তখন মদীনাবাসীগণের মধ্যে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমন সংঘটিত না হলে তারা তাকেই মুকুট পরিয়ে তাদের বাদশাহ নির্বাচিত করত। মুশরিকদের এ পত্রের সার সংক্ষেপ ছিল নিম্নরূপ :

‘তোমরা আমাদের কিছু সংখ্যক বিপথগামী লোককে আশ্রয় দিয়েছ, এজন্য আমরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি যে, হয় তোমরা তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তোমাদের দেশ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে দেবে, অন্যথায় সদল বলে তোমাদের উপর ভীষণভাবে আক্রমণ পরিচালিত করে তোমাদের যোদ্ধাদের হত্যা এবং মহিলাদের মান হানি করব।’[1]

এ পত্র পাওয়া মাত্রই আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই তার ঐ মক্কাবাসী মুশরিক ভাইদের দির্দেশ পালনার্থে উঠে পড়ে লেগে গেল। যেহেতু তার অন্তরে এ বিশ্বাস বদ্ধমূল হয়েছিল যে, মদীনায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আগমনের কারণেই তাকে মদীনার বাদশাহী থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে সেহেতু পূর্ব থেকেই সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর প্রতি হিংসায় জ্বলে পুড়ে মরছিল। এ কারণে কাল বিলম্ব না করে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বিরুদ্ধে সে তার মুশরিক ভাইদের একত্রিত করে ফেলল।

এ সংবাদ অবগত হয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের নিকট আগমন করলেন এবং তাদের সম্বোধন করে বললেন, ‘আমি দেখছি যে, কুরাইশদের হুমকি তোমাদের অন্তরে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। কিন্তু এটা তোমাদের অনুধাবন করা উচিত যে, তোমরা নিজেরাই নিজেদেরকে যে পরিমাণ ক্ষতির মুখে ঠেলে দিতে যাচ্ছ কুরাইশরা কোনক্রমেই তোমাদের সেই পরিমাণ ক্ষতি করতে সক্ষম হবে না। তোমরা কি তোমাদের পুত্র ও ভ্রাতাদের সঙ্গে নিজেরাই যুদ্ধ করতে চাও?’

নাবী কারীম (ﷺ)-এর এ কথা শ্রবণ করে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে।[2] কাজেই, আব্দুল্লাহ ইবনু উবাইকে তার প্রতিহিংসাজনিত যুদ্ধের সংকল্প থেকে তখনকার মতো বিরত থাকতে হয়। কারণ, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কথায় তার সঙ্গী সাথীদের যুদ্ধ স্পৃহা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও কুরাইশদের সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগ চলতে থাকে। কারণ, মুসলিম ও কাফিরদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদ বাধিয়ে দেয়ার কোন সুযোগ হাতছাড়া করার ইচ্ছা তার আদৌ ছিল না। তাছাড়া ইহুদীদের সঙ্গেও সে যোগাযোগ রাখতে থাকে যাতে প্রয়োজন হলে তাদের কাছ থেকেও সাহায্য লাভ সম্ভব হয়। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সময়োচিত ও বিজ্ঞোচিত ব্যবস্থাপনার ফলে ঝগড়া বিবাদের প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখা ক্রমান্বয়ে প্রশমিত হতে থাকে।[3]

[1] সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।

[2]
সুনানে আবূ দাউদ, বাবু খাবারিন নাযীর।

[3]
সম্পর্কে সহীহুল বুখারীর ২য় খন্ড ৬৫৫, ৬৫৬, ৯১৬ ৯২৪ পৃঃ।

 মুসমানদের জন্য মসজিদুল হারামের দরজা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা (إِعْلَانُ عَزِيْمَةِ الصَّدِّ عَنْ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ):

এরপর সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ) উমরাহ করার উদ্দেশ্যে মক্কায় আগমন করেন এবং উমাইয়া ইবনু খালফের অতিথি হন। তিনি উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলেন, ‘আমার জন্য এমন এক সময়ের ব্যবস্থা করে দাও যখন আমি নির্জনে বায়তুল্লাহর ত্বাওয়াফ করতে পারি। সেই মোতাবেক উমাইয়া খরতপ্ত দুপুরে তাকে নিয়ে পথে বের হলে পথে আবূ জাহলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যায়। সে উমাইয়াকে সম্বোধন করে বলে, ‘হে আবূ সাফওয়ান, তোমার সঙ্গে ঐ লোকটি কে?’

উত্তরে উমাইয়া বলল, ‘এ হচ্ছে সা‘দ (রাঃ)।’

আবূ জাহল তখন সা‘দ (ﷺ)-কে লক্ষ্য করে বলল, ‘আমি দেখছি যে, তুমি বড় নিরাপদে ত্বাওয়াফ করতে রয়েছ, অথচ তোমরা বেদ্বীনদেরকে আশ্রয় দিয়েছ এবং তাদেরকে সাহায্য করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আল্লাহর কসম! যদি তুমি আবূ সাফওয়ানের সঙ্গে না থাকতে তবে নিরাপদে ফিরে যেতে পারতে না।

তার একথা শুনে সা‘দ (রাঃ) উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ‘দেখো আল্লাহর কসম! যদি তুমি আমার একাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি কর তবে তোমার এমন কাজে আমি প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াব যা তোমাদের জন্য হবে অত্যন্ত ভয়াবহ এবং তা হবে মদীনার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বাণিজ্য পথটি।[1]

[1] সহীহুল বুখারী ২য় খন্ড, কিতাবুল মাগাযী ৫৬৩ পৃঃ।

 মুহাজিরদেরকে কুরাইশদের ধমক প্রদান (قُرَيْشٌ تَهَدَّدَ الْمُهَاجِرِيْنَ):

কুরাইশ মুশরিকগণ মদীনার মুহাজিরদেরকে ধমকের সূরে বলে পাঠাল, ‘মক্কা হতে তোমরা নিরাপদে ইয়াসরিবে পালিয়ে যেতে পেরেছ বলে অহংকারে ফেটে পড় না যেন। এটুকু জেনে রেখ যে, ইয়াসরিবে চড়াও হয়েই তোমাদের ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা আমাদের রয়েছে।[1]

তাদের এ ধমক শুধু যে কথাবার্তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, বরং এ ব্যাপারে তারা গোপনে গোপনে তৎপরও ছিল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাদের এ ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের কথা এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সূত্র থেকে অবগত হয়েছিলেন যে, তিনি সতর্কতা অবলম্বন না করে পারেন নি। নিরাপত্তার খাতিরে হয় জাগ্রত অবস্থায় তিনি রাত্রি যাপন করতেন, নতুবা সাহাবীদের প্রহরাধীনে ঘুমোতেন। যেমনটি সহীহুল বুখারী এবং সহীহুল মুসলিম শরীফে ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন, ‘মদীনায় আগমনের পর একদা রাত্রি বেলায় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জাগ্রত অবস্থায় ছিলেন এবং আকাঙ্ক্ষা পোষণ করছিলেন যে, আজ রাত্রে যদি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে থেকে কোন ব্যক্তি এখানে এসে পাহারা দিতেন (তাহলে কতই না ভাল হতো)।

আমরা ঐ অবস্থাতেই ছিলাম এমন সময় অকস্মাৎ অস্ত্রের ঝনাঝনানি আমাদের কর্ণগোচর হল। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) প্রশ্ন করলেন, ‘কে’? উত্তরে শ্রুত হল ‘আমি সা‘দ ইবনু আবী অক্কাস’ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গভীর রাত্রে তোমার এখানে আগমনের কারণ কী’? জবাবে তিনি বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমার মনে বিপদের আশঙ্কা উদ্রেক হওয়ায় আপনাকে পাহারা দেয়ার উদ্দেশ্যে এসেছি।’ তার একথা শুনে তিনি তার জন্য দু‘আ করলেন এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।[2]

এটা স্মরণ রাখার বিষয় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়ার ব্যাপারটি শুধু কয়েকটি রাত্রির জন্য নির্দিষ্ট ছিল না, বরং এটা ছিল পর্যায়ক্রমিক এবং স্থায়ী ব্যবস্থা। ‘আয়িশাহ (রাঃ) হতে যেমনটি বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন যে, রাত্রিকালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে পাহারা দেয়া হতো। তারপর নিম্নের আয়াতটি অবতীর্ণ হয়ঃ

‏(‏وَاللهُ يَعْصِمُكَ مِنَ النَّاسِ‏)‏ ‏[‏المائدة‏:‏ 67‏]‏،

‘‘(হে রসূল!) মানুষ হতে আল্লাহ্ই তোমাকে রক্ষা করবেন।’ (আল-মায়িদাহ ৫ : ৬৭)

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কুববা (ঘর বিশেষ) থেকে মাথা বের করে বললেন,

‏‏(‏يَا أَيُّهَا النَّاسُ، اِنْصَرِفُوْا عَنِّيْ فَقَدْ عَصَمَنِيْ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ‏)‏‏

‘‘হে জনমন্ডলী! তোমরা ফিরে যাও। মহামহিমান্বিত প্রভূ পরওয়ার দেগার আল্লাহ আমাকে নিরাপত্তা দান করেছেন।’’[3]

আরব মুশরিকদের শত্রুতাজনিত এ বিপদ শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পর্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তা মুসলিম সমাজের সকল সদস্য পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। যেমনটি উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন যে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর সাহাবীগণ (রাঃ) মদীনা আগমন করেন এবং আনসারগণ তাদের আশ্রয় দান করেন, তখন আরব মুশরিকগণ তাঁদেরকে একই কামান দ্বারা আক্রমণ করে। তাই না তাঁরা অস্ত্র ছাড়া রাত্রি যাপন করতেন, না অস্ত্র ছাড়া সকাল বেলা নিদ্রা থেকে জাগ্রত হতেন।

[1] রহমাতুল্লিল আলামীন প্রথম খন্ড ১১৬ পৃঃ।

[2]
সহীহুল মুসলিম শরীফ ২য় খন্ড, বাবু ফাযালি সা‘ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) ২৮০ পৃঃ এবং সহীহুল বুখারী বাবুল হারাসাতে ফিল গাযভে ফী সাবীলিল্লাহ ১ম খন্ড ৪০৪ পৃঃ।

[3]
জামীউত তিরমিযী, আবওয়াবুত তাফসীর ২য় খন্ড ১৩ পৃঃ।

 যুদ্ধের অনুমতি (الإِذَانُ بِالْقِتَالِ):

এ ভয়ভীতি ও বিপজ্জনক অবস্থা মদীনায় মুসলিমদের অস্তিত্বের জন্য একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং যদ্দ্বারা এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, কুরাইশরা কোনক্রমেই তাদের বিদ্বেষপরায়ণতা ও এক গুঁয়েমি পরিহার করতে প্রস্তুত নয়। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমগণকে যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করেন, কিন্তু তখন পর্যন্ত মুসলিমদের উপর যুদ্ধ ফরজ হয় নি। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা যে আয়াত নাযিল করলেন তা হচ্ছে নিম্নরূপঃ

‏(‏أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَإِنَّ اللهَ عَلٰى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ‏)‏ ‏[‏الحج‏:‏ 39‏]‏‏.‏

‘‘ যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় তাদেরকে যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হল, কেননা তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষম।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ৩৯)

তারপর এ ধরণের আরো বহু আয়াত অবতীর্ণ হয় সেগুলোতে বলে দেয়া হয় যে, যুদ্ধের এ অনুমতি যুদ্ধ হিসেবে নয় বরং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে বাতিলের বিলোপ সাধন এবং আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠিত করণ। যেমনটি ইরশাদ হয়েছেঃ

‏(‏الَّذِيْنَ إِن مَّكَّنَّاهُمْ فِي الأَرْضِ أَقَامُوْا الصَّلاَةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوْا بِالْمَعْرُوْفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنكَرِ وَلِلهِ عَاقِبَةُ الأُمُوْرِ ‏)‏ ‏[‏الحج‏:‏ 41‏]

‘‘(এরা হল) যাদেরকে আমি যমীনে প্রতিষ্ঠিত করলে তারা সলাত প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত প্রদান করে, সৎ কাজের আদেশ দেয় ও মন্দ কাজে নিষেধ করে, সকল কাজের শেষ পরিণাম (ও সিদ্ধান্ত) আল্লাহর হাতে নিবদ্ধ।’ (আল-হাজ্জ ২২ : ৪১)

যুদ্ধের অনুমতি তো নাযিল হলও তা শুধু কুরাইশদের সাথেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের অনুমতির বিস্তৃতি ঘটে। এমনকি তা ওয়াজিবের স্তর বা পর্যায়ে উপনীত হয়। তখন এ নির্দেশ কুরাইশ ব্যতিত অন্যাদের বেলায় প্রযোজ্য হয়। এ সব ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে সংক্ষেপে এসব স্তর বা পর্যায় সম্পর্কে আলোকপাত করার প্রয়োজন মনে করছি :

১. মক্কার কুরাইশ মুশরিকদেরকে যুদ্ধরত গণ্য করা। কেননা তারাই প্রথম শত্রুতা আরম্ভ করে। ফলে তাদের সাথে যুদ্ধ করা মুসলমানদের পক্ষে আবশ্যক হয়ে পড়ে। আর সাথে সাথে মক্কার অন্যান্য মুশরিক ব্যতিত কেবল তাদের ধন-সম্পদকে বাজেয়াপ্ত করাও জরুরি হয়ে পড়ে।

২. ওদের সাথে যুদ্ধ করা যারা আরবের সকল মুশরিক কুরাইশদের সাথে মিলিত ও একত্রিত হয়। অনুরূপ কুরাইশ ব্যতীত অন্যান্য গোষ্ঠী যারা পৃথক পৃথকভাবে মুসলমানদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে।

৩. সে সব ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ করা যারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে সন্ধি ও প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও খিয়ানত করেছে এবং মুশরিকদের সাথে জোটবদ্ধ হয়েছে ও অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে।

৪. আহলে কিতাবদের মধ্যে যারা মুসলমানদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে তাদের সাথে যুদ্ধ করা (যেমন খ্ৰীষ্টান সম্প্রদায়) যতক্ষণ তারা বিনীত হয়ে যিজিয়া কর না দেয়।

৫. মুশরিক, ইহুদী, খ্ৰীষ্টান নির্বিশেষে যারাই ইসলাম গ্রহণ করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করা থেকে বিরত থাকা । ইসলামের হদ ব্যতীত তাকে কিছু করা যাবেনা। তার বাকী হিসাব আল্লাহর হাতে।

যুদ্ধের অনুমতি তো নাযিল হল, কিন্তু যে অবস্থার প্রেক্ষাপটে নাযিল হল ওটা যেহেতু শুধু কুরাইশদেরই শক্তিমত্ততা ও একগুঁয়েমির ফল ছিল সেহেতু এটাই ছিল সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও বিজ্ঞোচিত কাজ যে মুসলিমগণ নিজেদের দখল সীমা কুরাইশদের ঐ বাণিজ্য পথ পর্যন্ত বিস্তৃত করে নেবে যা মক্কা হতে সিরিয়া পর্যন্ত চালু ছিল। এ কারণেই দখল সীমা বিস্তৃতির উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) দুটি পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা দুটি হচ্ছে যথাক্রমে :

১. যে সকল গোত্র এ রাজপথের আশপাশে কিংবা এ রাজপথ হতে মদীনা পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গার মধ্যবর্তী এলাকায় বসবাসরত ছিল তাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন এবং যুদ্ধ না করার চুক্তি সম্পাদন।

২. এ রাজপথের উপর টহলদারী দল প্রেরণ।

প্রথম পরিকল্পনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ছিল ঐ ঘটনাটি যা পূর্বে ইহুদীদের সঙ্গে সংঘটিত হয়েছিল এবং যে চুক্তিটির বিস্তারিত বিবরণ ইতোপূর্বে প্রদত্ত হয়েছে। সামরিক তৎপরতা শুরু করার পূর্বে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এভাবে জুহাইনা গোত্রের সঙ্গেও বন্ধুত্ব, মিত্রতা ও পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত না হওয়ার একটি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। মদীনা থেকে তিন মনজিলের অধিক অর্থাৎ ৪০ থেকে ৫০ মাইলের ব্যবধানে তাদের আবাসস্থল অবস্থিত ছিল। টহলদারী সৈন্যদের পরিভ্রমণ কালে লোকজনদের সঙ্গে কয়েকটি চুক্তিও সম্পাদন করেছিলেন যার আলোচনা পরে আসছে। দ্বিতীয় পরিকল্পনাটি ছিল যুদ্ধ বিগ্রহের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।

 বদর যুদ্ধের পূর্বেকার সারিয়্যাহ ও গাযওয়াহসমূহ (الغَزَوْاتُ وَالسَّيرَايَا قَبْلَ بَدْرٍ):

যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিল হওয়ায় এ দুটি পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে মুসলিমদের সামরিক তৎপরতার কাজ শুরু হয়ে যায়। পরিভ্রমণকারী প্রহরীরূপে মুসলিম সেনাবাহিনী মদীনা এবং তৎসংলগ্ন এলাকাগুলোতে টহল দিতে শুরু করেন, যেমনটি ইতোপূর্বে আভাষ প্রদান করা হয়েছে। তাঁদের এ টহলদারীর মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল মদীনার আশ-পাশের পথসমূহের উপর সাধারণভাবে এবং মক্কা থেকে আগত পথগুলোর উপর বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা। এভাবে বিভিন্ন পথের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য করে যাওয়া এবং একই সঙ্গে এ সকল পথের আশে পাশে বসবাসকারী গোত্রগুলোর সঙ্গে মিত্রতা ও বন্ধুত্বের চুক্তি সম্পাদন করা। অধিকন্তু, এ সুসংগঠিত টহলদারীর অন্য যে একটি উদ্দেশ্য ছিল তা হচ্ছে ইয়াসরিবের ইহুদী, মুশরিক এবং বেদুঈনদের অন্তরে এ ধারণাটি বদ্ধমূল করা যে, মুসলিমগণ এখন যথেষ্ট শক্তিশালী এবং পূর্বের নাজুক অবস্থাকে পেছনে ফেলে তারা অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন। তাছাড়া কুরাইশ মুশরিকগণকে তাদের অর্থহীন ক্রোধ ও ইন্দ্রিয়াবেগের ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়া যাতে এখনো তারা তাদের নির্বুদ্ধিতার অন্ধকূপে যে পতিত অবস্থায় রয়েছে তা থেকে বেরিয়ে এসে জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচার বিবেচনার আলোকোজ্জ্বল পথে পদচারণা শুরুর মাধ্যমে নিজেদের আয় উপার্জন ও জীবন-জীবিকার পথে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা এড়ানোর উদ্দেশ্যে সন্ধির কথাটা সক্রিয়ভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে থাকে এবং মুসলিমদের আবাসস্থানের উপর চড়াও হয়ে তাদের ধ্বংস করে ফেলার যে চরম হঠকারী সিদ্ধান্ত তারা গ্রহণ করেছে, আল্লাহর দ্বীনের পথে যে সব প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে চলেছে ও মক্কার মুসলিমদের উপর যে অমানবিক নিপীড়ন নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে সে সব থেকে বিরত থাকে। সর্বোপরি, মুসলিমগণ যাতে আরব উপদ্বীপে আল্লাহর পয়গাম পৌঁছানোর ব্যাপারে নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে কর্মপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে সক্ষম হন সেটাও ছিল অন্যতম উদ্দেশ্য।

[ঐতিহাসিক পরিভাষায় যে যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেছেন তাকে বলা হয় গাযওয়াহ এবং যাতে তিনি স্বয়ং অংশ গ্রহণ করেন নি তাকে বলা হয় সারিয়্যাহ।]

 সারিয়্যাহ ও গায্ওয়াহসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ

মদীনায় হিজরতের পর মুসলিমদের যে সকল সারিয়্যাহ ও গায্ওয়ায় অংশ গ্রহণ করতে হয়েছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হল।

১। সারিয়্যাতু সীফিল বাহর বা সমুদ্রোপকূলের প্রেরিত বাহিনী[1]

হিজরী ১ম বর্ষ রমাযান মাস মুতাবিক মার্চ ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হামযাহ বিন আবুল মুত্তালিবকে এ অভিযানে সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং তাঁর অধীনে ৩০ জন মুহাজির সৈন্য দিয়ে তাদেরকে সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনকারী কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তিন শত সদস্য বিশিষ্ট এ কুরাইশ কাফেলার অন্যতম সদস্য ছিল আবূ জাহল। মুসলিম বাহিনী ‘ঈস’[2] নামক জায়গার পার্শ্ববর্তী সমুদ্রোপকূলের নিকট পৌঁছলে ঐ কাফেলার সঙ্গে তাঁদের সাক্ষাৎ ঘটে। উভয় দলই পরস্পরের মুখোমুখী হলে এক পর্যায়ে উভয় দলই যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু জুহাইনা গোত্রের নেতা মাজদী ইবনু ‘আমর- যিনি উভয় দলেরই মিত্র ছিলেন- অনেক চেষ্টা চরিত্র করে উভয় দলকে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে নিরস্ত করেন।

হামযাহ (রাঃ)-এর এটা ছিল প্রথম পতাকা যা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বীয় মুবারক হাত দ্বারা বেঁধে দিয়েছিলেন। এর বহনকারী ছিলেন আবূ মার্সাদ কিনায ইবনু হাসীন গানাভী (রাঃ)।

২. সারিয়্যাতু রাবিগ বা রাবিগ অভিযানঃ এ অভিযান পরিচালিত হয় হিজরী ১ম বর্ষের শাওয়াল মাস মুতাবিক এপ্রিল, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উবাইদাহ ইবনু হারিস ইবনু মুত্তালিবকে ৬০ জন মুহাজিরের সমন্বয়ে গঠিত এক বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে প্রেরণ করেন। এ অভিযানে তাঁরা রাবেগ উপত্যকায় আবূ সুফইয়ানের সম্মুখীন পরস্পর পরস্পরের উপর কিছু সংখ্যক তীর নিক্ষেপ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করেনি, যার ফলে বড় আকারের কোন ঘটনা সংঘটিত হয় নি।

এ অভিযান কালে মক্কা বাহিনী থেকে দু’জন মুসলিম এসে যোগদান করেন মুসলিম বাহিনীতে। এদের একজন হচ্ছেন মিক্বদাদ বিন আমরুল বাহরানী এবং অন্যজন হচ্ছেন উতবাহ বিন গাযওয়ান মাযেনী (রাঃ), উভয়েই মুসলিম ছিলেন। তাঁরা কাফিরদের সঙ্গে এ উদ্দেশ্যে বাহির হয়েছিলেন যে, সামনে গিয়ে মুসলিমদের সঙ্গে মিশে যাবেন। আবূ ওবায়দার (রাঃ) পতাকা ছিল সাদা এবং তার বহনকারী ছিলেন মিসতাহ বিন আসাসাহ বিন মুত্তালিব বিন আবদে মানাফ।

সারীয়্যায়ে খার্রার[3] এ অভিযান হিজরী ১ম বর্ষের যিলকদ মাস মুতাবিক মে ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত হয়।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)-কে এ সারিয়্যাহর সেনাপতি নিযুক্ত করেন এবং বিশ জন যোদ্ধার সমন্বয়ে এক বাহিনী গঠন করে একটি কুরাইশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। তাদেরকে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন যে, তারা যেন খার্রার হতে সামনের দিকে আর অগ্রসর না হন। এ বাহিনী পদব্রজে পথ চলতেন। তারা দিবাভাগে নিজেদের গোপন করে রাখতেন এবং রাতের বেলা পথ চলতেন। পঞ্চম দিবস সকালে তারা খার্রারে গিয়ে পৌঁছেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জানতে পারেন যে, একদিন পুর্বেই সেই কাফেলা সে স্থান অতিক্রম করে গিয়েছে। এ সারিয়্যাহর পতাকা ছিল সাদা রঙের এবং পতাকাবাহী ছিলেন মিক্বদাদ ইবনু ‘আমর (রাঃ)।

৪. গাযওয়ায়ে আবওয়া অথবা অদ্দান[4] : এ গাযওয়ার সময় ছিল হিজরী ২য় বর্ষের সফর মাস মুতাবিক আগষ্ট, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দ। ৭০ জন মুহাজির যোদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) স্বয়ং এ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। এ গাযওয়ায় যাত্রার প্রাক্কালে সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাঃ)-কে মদীনায় তার স্থলাভিষিক্ত রূপে নিযুক্ত করা হয়। তাঁদের এ যাত্রার উদ্দেশ্য ছিল একটি কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করা। তাদের অগ্রযাত্রার এক পর্যায়ে তিনি অদ্দানে গিয়ে পৌঁছেন।

কিন্তু সংঘাতমূলক কোন ঘটনা সংঘটিত হয় নি। এ গাযওয়া অভিযান কালেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু যমরাহ গোত্রের তৎকালীন সরদার ‘আমর ইবনু মুখশী যমরীর সঙ্গে মিত্রতামূলক চুক্তি সম্পাদন করেন। চুক্তির কথাগুলো নিম্নরূপঃ

‘‘এটা হচ্ছে বনু যমরাহর জন্য মহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দলীল। এ গোত্রের লোকজনেরা লাভ করবে তাদের জান ও মালের নিরাপত্তা। তারা আক্রান্ত হলে আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে তাদের সাহায্য করা হবে, যদি তারা আল্লাহর দ্বীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত না হয়। পক্ষান্তরে, যখনই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহায্যের প্রয়োজনে তাদেরকে আহবান জানাবেন তখনই তাঁর সাহায্যার্থে তাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।[5]

‘‘এটা ছিল প্রথম সৈন্য পরিচালনা যাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নিজে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। এ অভিযানে ১৫ দিন যাবৎ মদীনার বাইরে থাকার পর তিনি মদীনা ফিরে আসেন। এ অভিযানের পতাকার রঙ ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।

৫. গাযওয়ায়ে বুওয়াত বা বুওয়াতের অভিযানঃ এ অভিযান সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রবিউল আওয়াল মুতাবিক সেপ্টেম্বর, ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। দু’শ জন সাহাবী সমভিব্যাহার রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এ অভিযানে বহির্গত হন। এক কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। উমাইয়া ইবনু খালফসহ একশ জন কুরাইশ এবং আড়াই হাজার উট ছিল এ কাফেলায়। মুসলিম বাহিনী রাযওয়ার পার্শ্ববর্তী বুওয়াত[6] নামক স্থান পর্যন্ত পৌঁছেন। কিন্তু কোন সংঘর্ষ বাধেনি। এ গাযওয়ায় গমনকালে সা‘দ ইবনু মু’আয (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করা হয়। এ গাযওয়ার পতাকা ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ)।

৬. গাযওয়ায়ে সাফওয়ানঃ এ গাযওয়া সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রবীউল আওয়াল মাস মুতাবিক সেপ্টেম্বর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এ গাযওয়ার কারণ ছিল কুরয ইবনু জারির ফাহরী মুশরিকদের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী নিয়ে মদীনার চারণভূমির উপর আক্রমণ চালায় এবং কিছু গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সত্তর জন সাহাবীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং বদর প্রান্তরের পার্শ্ববর্তী সাফওয়ান উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছেন। কিন্তু কুরয এবং তার সঙ্গীরা অত্যন্ত দ্রুতবেগে তাদের নাগালের বাইরে চলে যেতে সক্ষম হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বাহিনীসহ মদীনা প্রত্যাবর্তন করেন। এ গাযওয়ায় শত্রু পক্ষের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হওয়ার কোন সুযোগই সৃষ্টি হয় নি। কেউ কেউ এ গাযওয়াকে গাযওয়ায়ে বদরে উলা বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেন।

এ গাযওয়ায় যাওয়ার সময় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যায়দ ইবনু হারিসাহকে মদীনায় আমীর নিযুক্ত করেন। এ গাযওয়ায় পতাকার রঙ ছিল সাদা এবং পতাকাবাহী ছিলেন আলী (রাঃ)।

৭. গাযওয়ায়ে যিল উশাইরাহঃ এ গাযওয়া সংঘটিত হয় হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের জামাদিউল ঊলা ও জামাদিউল উখরা মুতাবিক নভেম্বর ও ডিসেম্বর ৬২৩ খ্রিষ্টাব্দে। এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সঙ্গে অংশ গ্রহণ করেন দেড়শ কিংবা দু’শ মুহাজির সাহাবী। অবশ্য এ অভিযানে অংশ গ্রহণ করতে কাউকেই তিনি বাধ্য করেন নি। সওয়ারীর জন্য উট ছিল মাত্র ত্রিশটি এ কারণে তারা পালাক্রমে সওয়ার হতেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল সিরিয়া অভিমুখে এক কুরাইশ কাফেলার পথরোধ করা। জানা গিয়েছিল যে, এ কাফেলা মক্কা থেকে যাত্রা শুরু করেছে। এ কাফেলার সঙ্গে কুরাইশদের বহু সুন্দর সুন্দর মূল্যবান মালপত্র ছিল। এ কাফেলার সন্ধানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বাহিনীসহ যুল উশাইরাহ[7] পর্যন্ত অগ্রসর হন। কিন্তু তারা সেখানে পৌঁছার কয়েক দিন পূর্বেই কুরাইশ কাফেলা সে স্থান পরিত্যাগ করে গিয়েছিল। এটা ছিল ঐ যাত্রীদল সিরিয়া থেকে প্রত্যাবর্তনের পথে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যাদেরকে গ্রেফতার করতে চেয়েছিলেন। ঐ যাত্রীদল তার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু এর ফলে ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল বদর যুদ্ধের। ইবনু ইসহাক্বের বর্ণনা মতে এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বের হয়েছিলেন জামাদিউল উলার শেষ ভাগে এবং মদীনায় ফিরে এসেছিলেন জামাদিউল উখরায়। সম্ভবতঃ এ কারণেই এ গাযওয়ায় মাস নির্ধারণে নাবী (ﷺ)-এর জীবনী লেখকদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এ গাযওয়া কালে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বনু মুদলিজ এবং তাদের মিত্র বনু যমরাহর সঙ্গে যুদ্ধ না করার চুক্তি সম্পাদন করেন।

এ অভিযানের দিনগুলোতে আবূ সালামাহ ইবনু আব্দুল আসাদ মাখযুমী (রাঃ) মদীনার শাসন পরিচালনের দায়িত্ব পালন করেন। এবারের পতাকাও ছিল সাদা রঙের এবং পতাকাবাহী ছিলেন হামযাহ (রাঃ)।

৮. নাখলাহ অভিযান : এ অভিযানের সময় ছিল হিজরী দ্বিতীয় বর্ষের রজব মাস মুতাবিক জানুয়ারী ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে। এ অভিযানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে বারো জন মুহাজির সাহাবীর একটি বাহিনী প্রেরণ করেন। এ বাহিনীর বাহন ছিল প্রতি দুজনের জন্য একটি উট। একই উটের উপর তার পালাযথাক্রমে আরোহণ করতেন। বাহিনী প্রধানের হাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) একটি পত্র দিয়ে নির্দেশ প্রদান করেন যে, দু’দিনের পথ অতিক্রম করার পর যেন এ পত্র পাঠ করা হয়। সুতরাং দুদিন পথ চলার পর আব্দুল্লাহ (রাঃ) পত্রটি পাঠ করেন। পত্রে লিখিত ছিল ‘আমার এ পত্র পাঠ করার পর তোমরা সামনের দিকে এগিয়ে চলবে এবং মক্কা ও ত্বায়িফের মধ্যস্থানে অবস্থিত নাখলায় অবরতণ করবে। এক কুরাইশ কাফেলার আগমনের প্রতীক্ষায় তোমরা সেখানে ওঁৎ পেতে থাকবে এবং তাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে আমাদের অবহিত করবে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর এ নির্দেশ পালনের জন্য আব্দুল্লাহ দ্বিধাহীন চিত্তে মানসিক প্রস্তুতি নেয়ার পর তাঁর সঙ্গীদের নিকটে পত্রের বিষয়টি প্রকাশ করে বললেন, ‘আমি কারো উপর জোর জবরদস্তি করতে চাই না। তোমাদের মধ্যে যার শাহাদাত পছন্দনীয় নয় সে প্রত্যাবর্তন করবে। শাহাদাতই আমার কাম্য।’

তাঁর এ কথা শ্রবণের পর সঙ্গীরা সকলেই সম্মুখ পানে অগ্রসর হতে থাকলেন। কিছু পথ অতিক্রম করার পর সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রাঃ) এবং ‘উতবাহ ইবনু গাযওয়ানের উটটি হারিয়ে যায়। এ উটটিই ছিল তাঁদের উভয়ের বাহন। উট হারিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁরা পিছনে থেকে যেতে বাধ্য হন।

আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশ (রাঃ) এবং তার সঙ্গীগণ দীর্ঘপথ অতিক্রম করার পর নাখলায় অবতরণ করেন। সেই সময় একটি কুরাইশ বাণিজ্য কাফেলা সেই পথ দিয়ে যাচ্ছিল। তাদের বাণিজ্য সামগ্রী ছিল কিশমিশ, চামড়া এবং আরও অনেক সামগ্রী। ঐ কাফেলায় ছিল আব্দুল্লাহ ইবনু মুগীরার দু’পুত্র উসমান ও নওফাল এবং মুগীরার মুক্ত দাস ‘আমর ইবনু হাযরামী ও হাকীম ইবনু কায়সান। শত্রুপক্ষ নাগালের মধ্যে, অথচ দিনটি ছিল হারাম মাস রজবের শেষ দিন। এ দিনে মুসলিম বাহিনীর মনে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা পরস্পর পরামর্শ করতে থাকলেন। যদি তারা এ দিনে যুদ্ধে লিপ্ত হন তাহলে হারাম মাসের অসম্মান করা হবে। পক্ষান্তরে রাত্রি পর্যন্ত যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকলে ঐ কাফেলা আরও অগ্রসর হয়ে হারাম সীমার মধ্যে প্রবেশ করবে। উভয় সংকট জনিত দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম বাহিনী অবশেষে এ কুরাইশ কাফেলাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

আক্রমণের সূচনাতে মুসলিম বাহিনী ‘আমর ইবনু হাযরামীকে লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করলেন। তীরবিদ্ধ হাযরামী ঢলে পড়ল মৃত্যুর কোলে। তারপর তারা উসমান এবং হাকীমকে বন্দী করে ফেললেন। কিন্তু পলায়নপর নওফাল নাগালের বাইরে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হল। বন্দী দুজন এবং মালপত্রসহ মুসলিম বাহিনী নিরাপদে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করলেন। তারা গণীমতের মাল হতে এক পঞ্চামাংশ বের করেও নিয়েছিলেন।[8]

হারাম মাসে মুসলিম বাহিনীর যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি তো তোমাদেরকে হারাম মাসে যুদ্ধ করার হুকুম দেই নি।’ এ অভিযানের গণীমত এবং যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে তিনি কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করেন নি।

সারিয়্যাতু নাখলার ঘটনার ফলে মুশরিকেরা এ রটনা রটানোর সুযোগ পায় যে, মুসলিমগণ আল্লাহ তা‘আলার হারামকৃত মাসে যুদ্ধ এবং নরহত্যা করে ‘হারাম’ বিধান লঙ্ঘন করেছে এবং তার অমর্যাদা করেছে। এর ফলে দারুণ অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তা‘আলা ওহী নাযিল করে এ সমস্যার সমাধান করে দেন। ওহীর মাধ্যমে তিনি ঘোষণা করেন যে, মুশরিকেরা যে সকল কাজকর্ম করেছে তা মুসলিমদের এ কাজের তুলনায় বহুগুণে অপরাধজনক। কালাম পাকে – হয়েছেঃ

‏(‏يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيْهِ قُلْ قِتَالٌ فِيْهِ كَبِيْرٌ وَصَدٌّ عَن سَبِيْلِ اللهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِندَ اللهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ‏)‏ ‏[‏البقرة‏:‏ 217‏]‏‏.

‘‘ পবিত্র মাসে লড়াই করা সম্বন্ধে তোমাকে তারা জিজ্ঞেস করছে। বল, এতে যুদ্ধ করা ভয়ঙ্কর গুনাহ। পক্ষান্তরে আল্লাহর পথ হতে বাধা দান, আল্লাহর সঙ্গে কুফুরী, কা‘বা গৃহে যেতে বাধা দেয়া এবং তাত্থেকে তার বাসিন্দাদেরকে বের করে দেয়া আল্লাহর নিকট তার চেয়ে অধিক অন্যায়। ফিতনা হত্যা হতেও গুরুতর অন্যায়।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ২১৭)

এ ওহী নাযিল হওয়ার ফলে এটা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, মুসলিম মুজাহিদের সম্পর্কে মুশরিকেরা যে অপবাদ রটাচ্ছে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ অমূলক ও ভিত্তিহীন। কেননা, কুরাইশ মুশরিকগণ ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে অন্যায় অনাচার ও জুলুম নির্যাতন করার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও ইতস্তত করে নি কিংবা নিয়ম নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নি। যখন হিজরতকারী মুসলিমদের ধনমাল তারা ছিনিয়ে নেয়ার কাজে ব্যাপৃত থাকত এবং এমন কি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যার জন্য তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তখন হারাম মাস কিংবা হারাম সীমার (মক্কা) প্রতি তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করেনি। অথচ, কী কারণে হঠাৎ করে তারা এ পবিত্র মাসগুলোর পবিত্রতার ব্যাপারে এত সচেতন হয়ে উঠল এবং এগুলোর পবিত্রতা নষ্ট করা দূষণীয় বলে এত সোচ্চার হয়ে উঠল? অবশ্যই মুসলিমদের বিরুদ্ধে মুশরিকেরা যে গুজব রটিয়েছে এবং হৈ চৈ শুরু করেছে তা প্রকাশ্য বিদ্বেষ ও সুস্পষ্ট নির্লজ্জতার উপর প্রতিষ্ঠিত।

এরপর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বন্দী দুজনকে মুক্ত করে দেন এবং নিহত ব্যক্তিটির অভিভাবককে রক্তপণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন।[9]

এগুলো হচ্ছে বদর যুদ্ধের পূর্বেকার সারিয়্যাহ ও গাযওয়া। এগুলোর কোনটাতেই সুস্পষ্ট ও হত্যার তেমন কোন ঘটনা ঘটেনি, যে পর্যন্ত না কুরয ইবনু জাবির ফাহরীর নেতৃত্বে মুশরিকরা মদীনার সন্নিকটস্থ চারণ ভূমি থেকে কিছু গবাদি পশু লুট করে নিয়ে যায়। সুতরাং বুঝা গেল যে, এর সূচনাও মুশরিকদের পক্ষ থেকেই হয়েছিল। ইতোপূর্বে তারা যেমন বিভিন্ন প্রকার অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে এসেছিল, গবাদি পশু লুট কারার ঘটনাটিও ছিল অনুরূপ একটি ঘটনা।

আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের সারিয়্যার পর কুরাইশ মুশরিকদের মধ্যে কিছুটা ভয়-ভীতির ভাব পরিলক্ষিত হল এবং তারা সুস্পষ্টভাবে এটা উপলব্ধি করল যে, তাদের সামনে এক ভয়াবহ বিপদের সম্ভাবনা ক্রমেই দানা বেঁধে উঠছে। যে ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা তারা এতদিন করে আসছিল শেষ পর্যন্ত সেই ফাঁদেই তাদের পতিত হতে হল। এ বিষয়টিও তাদের নিকট পরিষ্কার হয়ে গেল যে, মদীনার মুসলিম বাহিনী অত্যন্ত সজাগ ও তৎপর রয়েছে এবং কুরাইশদের প্রত্যেকটি বাণিজ্য কাফেলার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে চলছে। তারা এটাও বুঝল যে, মুসলিমগণ এখন ইচ্ছা করলে তিনশ মাইল পথ অতিক্রম করে আক্রমণ চালাতে, লোকজনদের বন্দী করে নিয়ে নিরাপদে প্রত্যাবর্তন করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। এটাও তাদের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সিরিয়ামুখী ব্যবসা-বাণিজ্য এখন কঠিন বিপদের সম্মুখীন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা নিজেদের মূর্খতা এবং উদ্ধত আচরণ থেকে বিরত রইল না। তারা জুহাইনা এবং বনু যমরাহ গোত্রদ্বয়ের মতো সন্ধির পথ অবলম্বনের পরিবর্তে ক্রোধ, হিংসা ও শত্রুতার মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিল। তাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরাও সিদ্ধান্ত নিয়ে গেল যে, মুসলিমদের আবাসস্থানে আক্রমণ চালিয়ে তারা তাদের একদম নিশ্চিহ্ন করে ফেলবে। এ লক্ষ্যে এক সুসজ্জিত যোদ্ধা বাহিনীসহ তারা বদর প্রান্তর অভিমুখে অগ্রসর হল।

এখন মুসলিমদের সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের সারিয়্যার পর দ্বিতীয় হিজরী সনে শা‘বান মাসে আল্লাহ তা‘আলা তাদের উপর যুদ্ধ ফরজ করে দেন এবং এ সম্পর্কীয় কয়েকটি সুস্পষ্ট আয়াত অবতীর্ণ করেন। ইরশাদ হলোঃ

‏(‏وَقَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوْا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبِّ الْمُعْتَدِيْنَ وَاقْتُلُوْهُمْ حَيْثُ ثَقِفْتُمُوْهُمْ وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ تُقَاتِلُوْهُمْ عِندَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ حَتّٰى يُقَاتِلُوْكُمْ فِيْهِ فَإِن قَاتَلُوْكُمْ فَاقْتُلُوْهُمْ كَذٰلِكَ جَزَاء الْكَافِرِيْنَ فَإِنِ انتَهَوْاْ فَإِنَّ اللهَ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ وَقَاتِلُوْهُمْ حَتّٰى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ لِلهِ فَإِنِ انتَهَواْ فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِيْنَ‏)‏ ‏[‏البقرة‏:‏190‏- 193‏]

‘‘তোমরা আল্লাহর পথে সেই লোকেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, কিন্তু সীমা অতিক্রম করো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সীমা অতিক্রমকারীকে ভালবাসেন না। ১৯১. তাদেরকে যেখানেই পাও হত্যা কর এবং তাদেরকে বের করে দাও যেখান থেকে তারা তোমাদেরকে বের করে দিয়েছে। বস্তুতঃ ফিতনা হত্যার চেয়েও গুরুতর। তোমরা মাসজিদে হারামের নিকট তাদের সাথে যুদ্ধ করো না, যে পর্যন্ত তারা তোমাদের সাথে সেখানে যুদ্ধ না করে, কিন্তু যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে তোমরাও তাদের হত্যা কর, এটাই কাফিরদের প্রতিদান। ১৯২. তারপর যদি তারা বিরত হয়, তবে আল্লাহ ক্ষমাশীল, বড়ই দয়ালু। ১৯৩. ফিত্না দূরীভূত না হওয়া পর্যন্ত এবং দীন আল্লাহর জন্য নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, তারপর যদি তারা বিরত হয় তবে যালিমদের উপরে ছাড়া কোনও প্রকারের কঠোরতা অবলম্বন জায়িয হবে না।’ (আল-বাক্বারাহ ২ : ১৯০-১৯৩)

এরপর অতি সত্বরই অন্য প্রকারের আয়াত অবতীর্ণ হলো যাতে যুদ্ধের নিয়ম কানুন বর্ণিত হলো। ইরশাদ হলোঃ

‏(‏فَإِذا لَقِيْتُمُ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا فَضَرْبَ الرِّقَابِ حَتّٰى إِذَا أَثْخَنتُمُوْهُمْ فَشُدُّوْا الْوَثَاقَ فَإِمَّا مَنًّا بَعْدُ وَإِمَّا فِدَاء حَتّٰى تَضَعَ الْحَرْبُ أَوْزَارَهَا ذٰلِكَ وَلَوْ يَشَاء اللهُ لَانتَصَرَ مِنْهُمْ وَلَكِن لِّيَبْلُوَ بَعْضَكُم بِبَعْضٍ وَالَّذِيْنَ قُتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَلَن يُضِلَّ أَعْمَالَهُمْ سَيَهْدِيْهِمْ وَيُصْلِحُ بَالَهُمْ وَيُدْخِلُهُمُ الْجَنَّةَ عَرَّفَهَا لَهُمْ يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِن تَنصُرُوْا اللهَ يَنصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ ‏)‏ ‏[‏محمد‏:‏ 4‏-‏ 7‏]

‘‘তারপর যখন তোমরা কাফিরদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হও, তখন তাদের ঘাড়ে আঘাত হানো, অবশেষে যখন তাদেরকে পূর্ণরূপে পরাস্ত কর, তখন তাদেরকে শক্তভাবে বেঁধে ফেল। তারপর হয় তাদের প্রতি অনুগ্রহ কর, না হয় তাদের থেকে মুক্তিপণ গ্রহণ কর। তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, যে পর্যন্ত না শত্রুপক্ষ অস্ত্র সমর্পণ করে। এ নির্দেশই তোমাদেরকে দেয়া হল। আল্লাহ ইচ্ছে করলে (নিজেই) তাদের উপর প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তোমাদের একজনকে অন্যের দ্বারা পরীক্ষা করতে চান (এজন্য তোমাদেরকে যুদ্ধ করার সুযোগ দেন)। যারা আল্লাহর পথে শহীদ হয় তিনি তাদের কর্মফল কক্ষনো বিনষ্ট করবেন না। ৫. তিনি তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করেন আর তাদের অবস্থা ভাল করে দেন। ৬. তারপর তিনি তাদেরকে জান্নাতে দাখিল করবেন যা তাদেরকে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। ৭. হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে সাহায্য কর, তিনি তোমাদেরকে সাহায্য করবেন আর তোমাদের পদগুলোকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবেন।’ (মুহাম্মাদ ৪৭ : ৪-৭)

এরপর আল্লাহ তা‘আলা ঐ সকল লোকদের নিন্দা করেছেন যুদ্ধের হুকুম শুনে যাদের হৃৎকম্পন শুরু হয়েছিল। ইরশাদ হলোঃ

‏(‏فَإِذَا أُنزِلَتْ سُوْرَةٌ مُّحْكَمَةٌ وَذُكِرَ فِيْهَا الْقِتَالُ رَأَيْتَ الَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِم مَّرَضٌ يَنظُرُوْنَ إِلَيْكَ نَظَرَ الْمَغْشِيِّ عَلَيْهِ مِنَ الْمَوْتِ‏)‏ ‏[‏محمد‏:‏ 20‏]

‘‘তারপর যখন কোন সুস্পষ্ট অর্থবোধক সূরাহ্ অবতীর্ণ হয় আর তাতে যুদ্ধের কথা উল্লেখ থাকে, তখন যাদের অন্তরে রোগ আছে তুমি তাদেরকে দেখবে মৃত্যুর ভয়ে জ্ঞানহারা লোকের মত তোমার দিকে তাকাচ্ছে। কাজেই ধ্বংস তাদের জন্য।’ (মুহাম্মাদ ৪৭ : ৪-৭)

বস্তুতঃ যুদ্ধ ফরজ করা, তার প্রতি উৎসাহ দান করা এবং তার প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান ছিল পরিস্থিতির প্রয়োজন। এমন কি পরিস্থিতির প্রতি সতর্ক ও তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপনরত কোন সেনাধিনায়ক থাকলে তিনিও তাঁর সেনাবাহিনীকে সর্ব প্রকারের সংঘাতময় পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ প্রদান করতেন। তাহলে মহামহিমান্বিত আল্লাহ যিনি প্রকাশ্য ও গোপনীয় সকল বিষয় সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকেবহাল তিনি কেন এরূপ নির্দেশ প্রদান করবেন না? প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে প্রয়োজন ও পরিস্থিতির একান্ত আকাঙ্ক্ষিত ছিল ‘হক’ ও ‘বাতিলের’ মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের বিশেষ করে আব্দুল্লাহ ইবনু জাহশের অভিযান পরবর্তী পরিস্থিতির যা মুশরিকদের মর্যাদা ও আমিত্বের উপর ছিল কঠিন আঘাত স্বরূপ এবং যা তাদেরকে যন্ত্রণায় ফেলে রেখেছিল।

যুদ্ধের নির্দেশ সম্পর্কিত পূর্বাপর আয়াতগুলো দ্বারা অনুমিত হচ্ছিল যে, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সময় আসন্ন প্রায় এবং এতে মুসলিমদের বিজয়ও সুনিশ্চিত। এটা বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় যে, কিভাবে আল্লাহ তা‘আলা মুসলিমদের নির্দেশ দিচ্ছেন, ‘যেখান থেকে মুশরিকরা তোমাদের বের করে দিয়েছে তোমরাও তাদেরকে সেখান থেকে বের করে দাও।’ আর কিভাবে তিনি বন্দীদেরকে বেঁধে ফেলার এবং বিরোধীদেরকে পিষ্ট করে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর হিদায়াত দিয়েছেন যা একটি বিজয় কাহিনীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। এর মাধ্যমে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত হচ্ছিল যে, মুসলিমদের বিজয় সুনিশ্চিত।

কিন্তু এটা গোপনীয়তার সঙ্গে এবং আভাষ ইঙ্গিতেই বলা হয়েছে যাতে যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে যুদ্ধের জন্য যতটা আগ্রহী ও উন্মুখ থাকে কার্যতঃ তা প্রকাশ করতে সক্ষম হয়।

তারপর ঐ সময়েই অর্থাৎ দ্বিতীয় হিজরীর শা‘বান মাস মুতাবিক ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে আল্লাহ তা‘আলা বায়তুল মুকাদ্দাসের পরিবর্তে ক্বাবা’হ গৃহকে ক্বিবলাহ বলে ঘোষণা করলেন এবং নামাযে ঐ দিক মুখ ফিরানোর নির্দেশ প্রদান করলেন। এর ফলে যে ক্ষেত্রে মুসলিমগণ বিশেষভাবে উপকৃত হলেন তা হচ্ছে, যে সকল মুনাফিক্ব ইহুদী মুসলিমদের মধ্যে শুধু ফাটল ধরানো ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মুসলিমদের সারিতে এসে দাঁড়াত তাদের মুখোশ খুলে গেল। তারা এখন মুসলিমদের মধ্যে থেকে পৃথক হয়ে গিয়ে নিজেদের আসল অবস্থানে ফিরে গেল। আর এভাবে মুসলিমদের সারিগুলো বিশ্বাসঘাতক ও কপটদের বিশ্বাসঘাতকতা ও কপটতার দূষণ থেকে পবিত্র হয়ে গেল।

এ সময় ক্বিবলাহ পরিবর্তনের মধ্যে যে একটি সূক্ষ্ণ ইঙ্গিত নিহিত ছিল তা হচ্ছে এখন থেকে এমন একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে যা এ ক্বিবলাহর উপর মুসলিমদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। কেননা, এটা বড়ই বিস্ময়কর এবং কথা হবে যে, কোন জাতির ক্বিবলাহ তাদের শত্রুদের কব্জায় থাকবে। আর যদি তা সেভাবে থাকে তাহলে এটা খুবই জরুরী যে, তাদের শত্রুদের অধিকার থেকে মুক্ত করে সেখানে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এ নির্দেশাবলী ও ইঙ্গিতসমূহ প্রকাশের পর মুসলিমদের আনন্দানুভূতি ও আবেগ আরও বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল এবং আল্লাহর পথে তাঁদের যুদ্ধ করার উন্মাদনা এবং শত্রুদের সঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা বহুগুণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল।

[1] সীনে জের দিয়ে পড়া হয়েছে যার অর্থ সমুদ্রোপকূল।

[2]
আইন জের দিয়ে পড়তে হবে। এটা লোহিত সাগর এলাকার ইয়ামবু এবং মারওয়ার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি জায়গা।

[3]
খার্রার যোহফার নিকটবর্তী একটি স্থানের নাম।

[4]
অদ্দান হচ্ছে মক্কা মদীনার মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি জায়গার নাম। এটা রাবেগ হতে মদীনা যাওয়ার পথে ২৯ মাইল দূরত্বে অবস্থিত। আবওয়া হচ্ছে অদ্দানেরই নিকটবর্তী একটি জায়গার নাম।

[5]
আল মাওাহিবর লাদুন্নিয়্যাহ ১ম খন্ড ৭৫ পৃঃ যুরকানীর শারহসহ।

[6]
বুওয়াত রাযওয়া জুহাইনার পাহাড়গুলোর মধ্যে দুটি পাহাড় যা প্রকৃতপক্ষে একটি পাহাড়েরই দুটি শাখা। এটা মক্কা হতে সিরিয়া যাওয়ার পথের সাথে মিলিত হয়েছে। পাহাড় দুটি মদীনা থেকে ৪৮ মাইল দূরত্বে অবস্থিত।

[7]
উশাইরাহ ইয়ামবুর পার্শ্ববর্তী একটি স্থানের নাম। উশায়বাহকে উশায়রাহ অথবা উসাইরাহ বলা হয়।

[8]
চরিতকারগণের বর্ণনা হচ্ছে এটাই, তবে যাতে জটিলতা রয়েছে এবং তা হচ্ছে এক পঞ্চমাংশ বের করে নেয়ার নির্দেশ সংক্রান্ত আয়াত বদর যুদ্ধের পরে অবতীর্ণ হয়েছিল। আর এর শানে নযুলের যে ব্যাখ্যা তাফসীর কিতাবসমূহে দেয়া হয়েছে তাতে জানা যায় যে, এর আগ পর্যন্ত মুসলিমগণ পঞ্চমাংশের হুকম সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলেন।

[9]
সকল সারিয়্যাহ এবং গাযওয়ার বিস্তারিত নিম্নলিখিত পুস্তকাদি থেকে গৃহীত হয়েছে , যা’দুল মা’২য় খন্ড ৮৩-৮৫ পৃঃ ইবনে হিশাম ১ম খন্ড ৫৯১-৬০৫ পৃঃ, রাহমাতুল্লিল আলামীন ১/১১৫-১১৬ পৃঃ, ২য় খন্ড ২১৫-২১৬ ৪৬৮ থেকে ৪৭০ পৃঃ। গাযওয়া এবং সারিয়্যাহ সম্পর্কে যেখান থেকে তথ্যাদি গৃহীত হয়েছে তার ধারাবাহিকতা এবং তাতে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে। আমি আল্লামা ইবনুল কাইয়্যেম এবং আল্লামা মানসুরপুরীর গৃহীত তথ্যের উপর নির্ভর করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *