২২. ৩০ জুলাই ১৯৪১ সন

৩০ জুলাই ১৯৪১ সন। সকাল ন’টা। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে রবীন্দ্ৰনাথ শুয়ে আছেন। তাঁর শরীরের অবস্থা ভালো না। তিনি অসহায় এবং অস্থির বোধ করছেন। তাকে বড় বড় ডাক্তাররা ঘিরে আছেন। বিধান রায় এসেছেন, নীলরতন সরকার এসেছেন। বিখ্যাত শৈলচিকিৎসক মোহনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন।

মোহনলাল একটা অপারেশন করতে চাচ্ছেন। তিনি নিশ্চিত যে, অপারেশন কবির জন্য মঙ্গলজনক হবে।

বিধান রায় রাজি না। তিনি বলছেন, আমার মন সায় দিচ্ছে না।

মোহনলাল বললেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান মন দিয়ে চলে না। অপারেশন না করা ভুল হবে।

বিধান রায় তারপরেও জেদির মতো বলছেন, না।

রবীন্দ্ৰনাথ ইশারা করলেন যেন একজন কেউ খাতা-কলম নিয়ে বসে। তার মাথায় কবিতা এসেছে। নিজের হাতে লেখার সামর্থ্য নেই। তিনি মুখে মুখে বলবেন, কেউ একজন লিখবো। তিনি ক্ষীণ স্বরে লাইনগুলি বলছেন। প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট উচ্চারণ করছেন, যেন শ্রুতিলিখনে ত্রুটি না হয়। এমন হতে পারে যে, তিনি শুদ্ধ করার সময় পাবেন না। জীবনের সর্বশেষ রচনায় ভুল থেকে যাবে।

তোমার সৃষ্টির পথ

তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্ৰ ছলনাজালে
হে ছলনাময়ী!
মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে
সরল জীবনে!

এই প্ৰবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;
তার তরে রাখি নি গোপন রাত্রি।
তোমার জ্যোতিষ্ক তারে
যে পথ দেখায়
সে যে তার অন্তরের পথ,
সে যে চিরস্বচ্ছ,
সহজ বিশ্বাসে সে যে
করে তারে চিরসমুজ্জ্বল।
বাহিরে কুটিল হোক, অন্তরে সে ঋজু
এই নিয়ে তাহার গৌরব।
লোকে তারে বলে বিড়ম্বিত।
সত্যেরে সে পায়।
আপন আলোকে-ধৌত অন্তরে অন্তরে।
কিছুতে পারে না তারে প্রবঞ্চিতে,
শেষ পুরস্কার নিয়ে যায় সে যে
আপন ভাণ্ডারে।
অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে
সে পায় তোমার হাতে
শান্তির অক্ষয় অধিকার।

মোহনলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অপারেশন করলেন। জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই অপারেশন হলো। রবীন্দ্রনাথ চোখ বন্ধ করলেন, আর খুললেন না। ২২শে শ্রাবণ দুপুর বারোটা দশ মিনিটে তিনি এমন এক ভুবনের দিকে যাত্রা শুরু করলেন যে ভুবনকে তিনি তাঁর রচনায় গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে চিহ্নিত করেছেন।

রবীন্দ্রনাথ বাঙালি জাতিকে এগিয়ে দিয়ে গেলেন একশ’ বছর। তাঁর মৃত্যুর ত্ৰিশ বছর পর বাংলাদেশ নামের যে রাষ্ট্রের জন্ম হলো সেই রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীতটিও তাঁর রচনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *